#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি (সাথী)
#পর্ব_৫
রাত টা কাটিয়ে সকালেই মধুকে বাসায় নিয়ে এসেছে মাহতাব। সারারাত মধু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ছিল। মাহতাবের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও অস্বস্তি হচ্ছিল। অথচ মাহতাব ছিল স্বাভাবিক। সব সময়ের মতো শান্ত। মধু আড় চোখে মাহতাবের অগোচরে মাহতাব কে দেখেছে। প্রত্যেক টা অঙ্গভঙ্গি গভীর চোখে অবলোকন করেছে।আশ্চর্যজনক ভাবে এই শান্ত গম্ভীর লোকটাকে তার ভালো লেগেছে। এক কথায় ভিষণ ভালো লেগেছে। বয়স নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। বয়স শুধু একটা সংখ্যা। মনের মিল কতটুকু হয় এখন এটাই দেখার অপেক্ষা।
মধুকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই হুলুস্থুল পরে গেলো। কুলসুম বেগম আর ময়না বেগম তিন তলা থেকে নেমে এসেছে তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। লামিয়া রান্নাবান্নায় লেগে গেছে। বাড়িতে আজ কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের ইনভাইট করা হয়েছে। হুট করেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কাউকে জানানো হয়নি। তাই সামান্য আয়োজন করে তাদের জানানোর ব্যবস্থা। তাছাড়া ভাড়াটিয়ারা আছে।তাদেরকেও নিজ থেকেই জানিয়ে দিতে চায় কুলসুম বেগম। অযথা তার সোনার টুকরো ছেলে নিয়ে কুৎসা রটুক তা সে চায় না। ময়না বেগম অবশ্য এসব ঝামেলা করতে নিষেধ করেছিলেন। মধুর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এখন এসব করে আরো প্রশ্নের মুখে পরতে হবে। কিন্তু কুলসুম বেগম শোনেনি। ময়না বেগম ও আর কথা বাড়ায় নি৷ তার বুঝদার মা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসে থাকে।
মধু এখন আগে থেকে অনেকটাই সুস্থ।শরীরে আঘাতের দাগ অনেকটা মিলিয়ে এসেছে। মাহতাব তাকে হাত ধরেই গাড়ি থেকে নামালো। ময়না বেগম এগিয়ে গিয়ে আগলে ধরলো মধুকে। মধু মুচকি হেসে কুশল বিনিময় করলো তার সাথে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কুলসুম বেগমের দিকে এগিয়ে গেলো। মাহতাব অনেকটা অস্থির হয়ে মাকে একহাতে জরিয়ে ধরলো৷ মুখে চিন্তার ছাপ তার। তবে আরেক হাতে ঠিকই মধুকে ধরে রেখেছে৷ এটা খুব সামান্য একটা বিষয়। তবুও মধুর ভিষণ ভালো লাগলো।
— আপনি নিচে এসেছেন কেন আম্মা? আমরাই তো আসছিলাম। কষ্ট করে আবার নামতে গেলেন কেন?
— আমার ছেলের বউ কে আমি এগিয়ে নিবো না! এ কেমন কথা বাবা? আমি তো আর সিরি ভেঙ্গে নামিনি। লিফট দিয়েই এসেছি৷ আমার একটুও কষ্ট হয়নি।
মাহতাব শান্ত হলো। গম্ভীর মুখে মায়ের হাত ধরে দাড়িয়ে রইলো। কুলসুম বেগম মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— কেমন আছো মা?
মধু সালাম দিয়ে বলল,
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা।আপনি কেমন আছেন?
— আমি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। এখন থেকে আরো ভালো থাকবো।
মাহতাব তাদের কথা থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— বাসায় গিয়ে বাকি কথা বলো আম্মা।এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার হাটু ব্যথা বেড়ে যাবে।
কথা শেষ হতেই মাহতাব কুলসুম বেগম কে ধরে লিফটের দিকে হাটা শুরু করেছে। যাওয়ার আগে ময়না বেগমের হাতে মধুর হাত টা আস্তে করে দিয়ে দিয়েছে। ময়না বেগম মধুকে নিয়ে তাদের পিছনেই লিফটে ঢুকে গেলো। মধু পাচতলা বাড়িটা চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছে। পুরোনো আমলের হলেও বাড়িটা সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর বেলি ফুলের বাগান টা। সবার বাগানে নানান রকম ফুল গাছ শোভা পেলেও মাহতাব নিজের বাগানে প্রায় পঞ্চাশ টা বেলি ফুলের গাছ লাগিয়েছে। রাতে বেলিফুলের সুভাষে সারা বাড়ি মো মো করে।
বাসায় ঢুকে সরাসরি নিজের রুমে চলে গেছে মাহতাব। তাকে কয়েকঘন্টার জন্য বাইরে যেতে হবে। আসার সময় মধু মাহতাব কে অনুরোধ করে বলেছে আলেয়া বেগমে সহ সবাইকে ছেড়ে দিতে। খারাপ হলেও এতো বছর তাদের কাছেই বড় হয়েছে সে। মাথার উপরে ছাদ তো দিয়েছিল।সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই তাদের উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিয়েছে মধু।তাই মাহতাবকে বুঝিয়ে বলেছে তাদের উপর করা কেইস তুলে নিতে৷ মাহতাব মেনেছে।তবে শান্ত গলায় সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে আজ থেকে তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে পারবেনা মধু। এখন তার একমাত্র পরিচয়, সে মাহতাব ইব্রাহীমের স্ত্রী। তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
মাহতাব নাস্তা করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। দুপুরের মধ্যেই তাকে বাসায় ফিরতে হবে। লামিয়ার শুকনো মুখটা চোখে এড়ায়নি তার। আত্মীয়রা আসলে মেয়েটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে। বিয়ের সাত পাচ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের ঘরে কোন সন্তান নেই। আত্মীয় স্বজনরা আসলেই লামিয়াকে খুচিয়ে খুচিয়ে কথা শোনায়।মাহতাব জানে সবটা।তাই ভাইকে আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। কথা বলে ফেললে যতই প্রতিবাদ করা হোক,সেই কথা আর ফিরিয়ে দেয়া যায় না৷ বন্দু*কের গু*লির চেয়েও কথার আঘাত ভয়ংকর। মাহতাব চায়না আজ লামিয়া কোন কথার আঘাত সহ্য করুক।মেহরাব বাসায় নেই। আজ তার কয়েকটা অপারেশন আছে।তাই সকাল সকাল হসপিটালে চলে যেতে হয়েছে।
ময়না বেগম মধুকে মাহতাবের রুমে নিয়ে গেলেন। শুভ্র রঙের রুমে বিছানার চাদর থেকে শুরু করে সব কিছুই সাদা। ছিমছাম গোছানো রুমে ঢুকে মধু ইতস্তত করতে লাগলো। কোথাও বসতেও তার ভয় করছে। মনে হচ্ছে তার গা থেকে ময়লা লেগে যাবে।
ময়না বেগম মধুর হাতে একটা সুতির থ্রি পিস ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— কোন রকম সংকোচ করবে না। এখন থেকে এই রুম,এই বাড়ি, আর এই বাড়ির মানুষ গুলোও তোমার। নির্দিধায় থাকবে সব সময়। ওটা ওয়াশরুম(আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে)।ফেশ হয়ে এসো।ভালো লাগবে।
মধু মাথা কাত করে সায় জানালো। তার ভিতরের অস্বস্তি কমছে না। তাদের সাথে বড্ড বেমানান লাগছে তাকে। অযত্নে চেহারা মলিন হয়ে গেছে। যেখানে খাওয়া জুটত না ঠিক ভাবে সেখানে চেহারার যত্ন নেয়া বিলাসিতা।
মধু ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ময়না বেগম ওখানেই বসে রইলেন।মেয়েটা খুব শান্ত। হয়তো পরিস্থিতির চাপে পরে চুপচাপ হয়ে গেছে। তার ভাইটা ও শান্ত,গম্ভীর। দুজন ঠান্ডা মানুষ মিলে কি বাড়ি টা কি হিমালয় বানাতে চাইছে নাকি!
থানায় গিয়ে ঝামেলা মিটাতে অনেকটা সময় চলে গেলো মাহতাবের। দুই দিন তাদের ভালোই আপ্যায়ন করা হয়েছে। মাহতাব সেদিকে ধ্যান দিলো না। শক্ত গলায় বলে এলো মধুর সাথে আর কখনো যোগাযোগ না করতে। আলেয়া বেগম আর জয়নাল বেপারীর চুপসানো মুখ দেখে মনে মনে শান্তি পেলো খুব।
নতুন বউ দেখতে আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবাই আসছে। মধু রেস্ট নিতে পারছে না ঠিকঠাক ভাবে। লামিয়া বুদ্ধি করে মধুকে হালকা সাজিয়ে দিয়েছে। এতে তার মুখের অস্পষ্ট দাগ গুলো ও ঢেকে গেছে৷ লং স্লিভের জন্য হাতের দাগগুলো ও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক দফা দেখাদেখির পর ময়না বেগম স্পষ্ট সবাইকে বলে দিলেন এখন মধু রেস্ট করবে। আবার বিকেলে সবাই এসে চা খেয়ে যাবে সাথে বউও দেখে যাবে।
কুলসুম বেগমের বাপের বাড়ি থেকে তার আত্মীয় স্বজনরা এসেছে। কুলসুম বেগমের ভাইয়েরা কেউ বেচে নেই। দুই ভাবি আর তার ছেলে, ছেলের বউ তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সাহিদাও তার দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে হাজির। কুলসুম বেগমের বড় ভাবির ভাতিজি সাহিদা। তাই কেউ কিছু বলতেও পারছে না। আসার পর থেকেই মুখ কুচকে বসে আছে সে। তার চোখ গুলো আকুপাকু করছে মাহতাবের বউকে দেখার জন্য। মাহতাব যে এই বয়সে এসে বিয়ে করবে তা কল্পনাও করেনি সে। এতদিন মনে মনে অহংকার হতো তার,তার জন্য মাহতাব ঘর বাধেনি কারো সাথে। মাহতাব এখনো তাকেই ভালোবাসে এ ভেবেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতো। মনে মনে আফসোস হতো মাহতাব কে ছাড়ার জন্য। আগে মাহতাবের তেমন কিছু না থাকলেও এখন মাহতাব টাকার কুমির। তার পা থেকে মাথা অব্দি আভিজাত্য দিয়ে মোড়ানো। এখন এই মেয়ে নিশ্চয়ই এসব কিছু ভোগ করবে। এসব তো তার হতো। নিজের স্বার্থপরতায় হারিয়েছে সব। হিংসে হচ্ছে তার। মাহতাব অন্য কারো সাথে জীবন শুরু করেছে ভাবতেই মন বিষিয়ে যাচ্ছে।
স্বার্থপর মানুষদের এই এক সমস্যা। তারা সব কিছুতে নিজের স্বার্থ খোঁজে। মাহতাবের একা থাকা সাহিদার মনে প্রশান্তি জোটাতো। সে অন্যকাউকে নিয়ে সংসার করছে তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মাহতাব কেন করবে!এই তার ভালোবাসা!
মনে মনে গজগজ করছে সাহিদা।মাহতাব আসলে আজ কিছু কথা শুনিয়ে দিবে সে।দেখবে কোন রুপসী মেয়ে দেখে তার মাথা ঘুরিয়ে গেছে যে এই বয়সে এসে বিয়ে করতে হলো।
ময়না বেগম একটু পর পর সাহিদার দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানো হাসি দিচ্ছে। এতো বছর পর একটা মোক্ষম জবাব দিয়েছে এই মেয়েকে। মধুকে দেখলে এই মেয়ের রাতের ঘুম হারাম হবে নিশ্চিত। কালনাগিনী একটা।
লামিয়া সুফিয়া খালা কে বলল ড্রয়িং রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দিতে। কুলসুম বেগম তার ভাবিদের সাথে গল্প করছেন। সাহিদা কে দেখেই লামিয়া চোখ মুখ কুচকে ফেললো। এউ মেয়েকে তার একদম ভালো লাগে না। সোফার একপাশে বসতেই তার বড় মামীশাশুড়ী মুখ কুচকে বলল,
— তোমার কি খবর ছোট বউ। কোন খুশির খবর আছে নাকি? শোন,মাইয়া মাইনসের স্বার্থকতা হইলো বাচ্চাকাচ্চায়। অনেক বছর তো পার হইলো। আর তো দেড়ি করণ ঠিক হইবো না। মেহরাব রে কও আরেকটা বিয়া করতে। পুরুষ মানুষের দুইডা বউ থাকলে সমস্যা কই? আল্লাহ তো হুকুম দিছে চাইরডা পর্যন্ত করার। তুমিও থাকবা।হেয় তো আর তোমারে ছাইড়া দিতাছেনা।
লামিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখের পানি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আরো।এই মহিলার অনেকেই তার কথায় স্বায় জানিয়েছে।
ময়না বেগম চোখ মুখ শক্ত করে মায়ের দিকে তাকিয়ে। তার মাও বাচ্চা নিয়ে লামিয়ার উপর কিছুটা অসন্তুষ্ট। তাই সে চুপচাপ বসে আছে।
— বিয়ে করে আমরা আমাদের প্রশান্তির কারণ হিসেবে একজন জীবন সঙ্গিনী আনি।কোন বাচ্চা জন্মদেয়ার মেশিন নয় মামী। আল্লাহ চাইলে বাচ্চা হবে নাহলে হবে না। আমার ভাই লামিয়া কে নিয়েই সুখী। তাই তাদের ভালো টা তাদেরকেই ভাবতে দিন। এসেছেন, বেড়াবেন। হাসিখুশিতে থেকে চলে যাবেন। আমার পরিবারের কাউকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তার জন্য আমি এখনো বেচে আছি।
মাহতাবের শক্ত কথায় দমে গেল সবাই। বাসায় ঢুকেই এসব কথা শুনে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু এটা কালে কালে প্রমাণিত। নাহলে একজন মেয়ে হয়ে কিভাবে আরেকজন মেয়েকে সতিন আনতে বলতে পারে!
সাহিদার দিকে চোখ যেতেই মাহতাব মুচকি হাসলো। লামিয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— কাদবে না।ভাইয়া আছি তো।এবার আমকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও লামু।
লামিয়া হাসিমুখে পানি আনতে চলে গেলো। মাহতাব সাহিদার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— কেমন আছো সাহিদা? এসেছো ভালো হয়েছে। নতুন ভাবিকে দেখে যেও।ঠিক আছে? আমি ফ্রেশ হয়ে এসে গল্প করবো।
ময়না বেগম ফিক করে হেসে দিলো। তার কম কথা বলা ভাই ময়না পাখির মতো কথা বলছে। সাহিদার মুখটা দেখার মতো হয়েছে।
চলবে,,