আমার অবেলায় তুমি পর্ব -১১

#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১১

“আপার ভাইকে তোমার কেমন লাগে বললে না তো মধু”
মধু দ্বিধান্বীত চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে।মাহতাব পকেটে হাত গুজে দাড়িয়ে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে উত্তর দিতে না পারলে তাকে শূণ্য দিয়ে ফেইল করানো হবে। মোটা বেত দিয়ে দু ঘা লাগিয়েও দিতে পারে। মধু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,

— ভালো।

— শুধু ভালো!

মধু অসহায় বোধ করলো। মনে মনে লোকটাকে খুব জেদি ঘোষিত করে আচ্ছা করে ঝেড়ে দিলো।

— ঘুমাতে হবে মধু। একটু তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয়।

মাহতাবের কথা শেষ হতেই মধু টানটান হয়ে শুয়ে পরলো। মাহতাব এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। মধু মাহতাব কে মেকি তাড়া দিয়ে বলল,

— তাড়াতাড়ি শুয়ে পরুন। কাল অফিস আছে না?ঘুমাতে হবে তো। এক টা বাজলো প্রায়!

মাহতাব শান্ত গলায় বলল,

— উত্তর না দিলে ঘুমাতে দিবো না।

মধু অসহায় গলায় বলল,

— আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন? আপনি কি রেগে আছেন।

মাহতাবের সোজা জবাব,

— না।

— কাল উত্তর দিবো। এখন ঘুমান।প্লিজ!

— আচ্ছা। ওহ! আমি তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম মধু৷ তুমি কিন্তু রাতে মারাত্মক নাক ডাকো। সে জন্য মাঝে মাঝে আমার তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে হয়। ভেবো না আমি ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরি। শুধু নাক ডাকা বন্ধ করার জন্য ধরি। আমাকে ভুল বুঝবে না। ঠিক আছে?

মধু তাড়াক করে উঠে বসলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে হতভম্ব গলায় বলল,

— কি বলছেন! আমি সত্যিই নাক ডাকি? আগে তো কেউ কখনো বলে নি!

মাহতাব বিছানার আরেক পাশে নিজের গা এলিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

— আগে কি তোমার বর ছিল? এখন তোমার বর আছে। সে রাতে মনোযোগ দিয়ে তোমার নাক ডাকা শোনে। তাই আজ তুমি জানতে পারলে৷ কয়েক বছর আগে বিয়ে করলে আগেই জেনে যেতে। ভেরি ভেরি ব্যাড লাক মধু।

মাহতাবের আফসোস শুনে মধুর চোখ টলমল করে উঠলো। নিজের এমন সাংঘাতিক একটা সমস্যা জানেনা ভেবে নিজেকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হলো খুব! কি আশ্চর্য! এ জীবন তার ষোল আনাই বৃথা। এই অসভ্য নাক টাকে বটি দিয়ে কেটে ফেলার তীব্র বাসনা মনে চাপা দিয়ে
বালিশ নিয়ে নিচে নামতেই মাহতাব হাত ধরে আটকালো।
মধুকে নিজের পাশে বসিয়ে শান্ত গলায় বলল,

— কোথায় যাচ্ছো?

মধু নাক টেনে বলল,

— নিচে যাচ্ছি। আমার জন্য আপনার ঘুমের অসুবিধা হবে। বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না আমি নাক ডাকি।জানলে আপনাকে বিরক্ত করতাম না। আমি বরং বারান্দায় ঘুমাই? আপনি এখানে আরাম করে ঘুমান।

— বারান্দায় ঘুমালে তোমার নাক ডাকার শব্দে পাশের বাসার সবার ঘুম ভেঙে যাবে। চিন্তার কোন কারণ নেই। তুমি নাক ডাকলে আমি তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো। ঠিক এভাবে।

কথা শেষ করেই মাহতাব মধুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরেছে। স্বামীর প্রথম আলিঙ্গন অনুভব করা বাদ দিয়ে মধু প্রতিবেশীর ঘুম ভাঙা নিয়ে ভাবতে বসলো। সে কি এতো জোরেই নাক ডাকে যে পাশের বাসার মানুষের ঘুম ভেঙ্গে যাবে! এই যে এখন নাক থেকে শব্দ বের হওয়ার ভয়ে সে খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে। এভাবে নিলে তো আর কারোর ঘুম ভাঙ্গবে না। আচ্ছা, নাকে একটা ক্লিপ লাগিয়ে নিলে কেমন হয়?

হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে মধু ঘুমিয়ে গেলো। মাহতাব তার সহজ সরল বউয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বুকের সাথে আরেকটু গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে ধীর গলায় বলল,

— ভালোবাসা নাম্বার পাচ।

ভোর সারে চারটায় ঘুম ভাঙ্গলো মধুর। নিজেকে মাহতাবের বাহুবন্ধনীতে দেখে লাফিয়ে উঠলো। ভয়ার্ত চোখে মাহতাবের কোচকানো গেঞ্জির দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা হাতে তা ঠিক করে দিলো। এখন কি সে ঘুমের মাঝে মানুষের গেঞ্জি ধরে টানাটানি করে নাকি! এই অভ্যাস কবে থেকে হলো! কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য!

ওয়াশরুম থেকে ওজু করে এসে দেখে মাহতাব উঠে পরেছে। ঘুমে ফোলা ফোলা চোখে কুচকে বিছানায় বসে আছে। ঘুম ঠিকভাবে না হওয়ার দরুন মাথা ব্যাথা করছে৷ চোখ ও হালকা জ্বালাপোড়া করছে।
মধুর মন খারাপ হয়ে গেলো। বেচারা রাতে তার জন্য ঘুমাতে পারেনি হয়তো। মুখ কালো করে মাহতাবের কাছে গিয়ে ধীর গলায় বলল,

— মসজিদে যাবেন না?

— যাবো।

— আচ্ছা। আমি নামাজের রুমে গেলাম।

— যাও।

মধু বিষন্ন মনে নামাজ আদায় করতে চলে গেলো। মাহতাব সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা এতো আদুরে কেন?

সকালে মাহতাব আজ দেড়ি করে উঠেছে। নামাজ পড়ে এসে আরো কয়েকঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। ঘুম ঠিকভাবে না হলে সারাদিন খারাপ যাবে।কোন কাজ ঠিক হবে না।

নাস্তার টেবিলে মেহরাব বাদে বাকি সবাই মাহতাবের জন্য অপেক্ষা করছে। লামিয়া উদাস মনে বসে আছে। ময়না বেগম কয়েকবার খেয়াল করলেও কিছু বলেনি।ইদানীং মেহরাব খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। আসেও খুব দেড়ি করে। লামিয়ার মন খারাপের কারণ সে কিছুটা আচ করতে পারছে। তবে ভাইয়ের উপর তার বিশ্বাস একচুলও কম নেই। তার ভাইয়েরা লাখে একটা। তাই সে নিশ্চিন্ত।
ময়না বেগম নিজেও ডিপ্রেশনে রুগী। সে চায় না লামিয়া অযথা মন খারাপ করে ডিপ্রেশনে তলিয়ে যাক। আগে মেহরাবের খবর নিতে হবে। ভাইয়ের উপর তার পূর্ণ ভরসা আছে৷ কিন্তু তার ভাই মানুষ। আর মানুষ বদলায়। মেহরাব যদি বদলে গিয়ে কোন কেলেংকারী করে থাকে তাহলে সে লামিয়া কে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবার বিয়ে দিবে। মনে মনে পাশের বাসার হ্যান্ডসাম ছেলেটা কে লামিয়ার জন্য ঠিকও করে ফেললো। যৌতুক হিসেবে মা আর মাহতাব কে পটিয়ে এই বিল্ডিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোর লিখে দিবে লামিয়ার নামে। স্বামী নিয়ে সেও এখানেই থাকবে। মেহরাবের চোখের সামনে বরের হাত ধরে ঘুরে বেরাবে লামিয়া। তখন বেয়াদপ টা বুঝবে কেমন লাগে।

ময়না বেগমের বিস্তর পরিকল্পনার মাঝেই মাহতাব উপস্থিত হলো। চোখ গুলো লাল হয়ে ফুলে আছে। কুলসুম বেগম চিন্তিত হলেন। ব্যাস্ত গলায় বললেন,

— তোমার চোখে কি হয়েছে বাবা? এভাবে ফুলে আছে কেন? রাতে ঘুমাও নি?

— ঘুমিয়েছি আম্মা। মাথা ব্যাথা করছে তাই এমন দেখাচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে।

— খেয়ে মেডিসিন নিয়ে নাও। আজ পারলে অফিস মিস দাও। অসুস্থ শরীর নিয়ে অফিস যেতে হবে না।

— যেতেই হবে আম্মা। অনেক কাজ জমে আছে। আমি তারাতাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করবো। চিন্তা করবেন না।বেশি খারাপ লাগলে বাসায় চলে আসবো।

কুলসুম বেগম মাথা নাড়লেন। ছেলে কাজের বেলায় খুব দায়িত্বশীল। তাই তাকে আটকানো উচিত হবে না।

মধুর মুখ কালো দেখে ময়না বেগমের ভ্রু কুচকে গেল। এখন কি ওর জন্য ও ছেলে খুজতে হবে নাকি! এভাবে মুখ ফুলিয়ে রাখার কি হলো! চোখ ছোট ছোট করে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে পরোটা চিবাতে লাগলো সে। এই বদ আবার কি করেছে? ছোট বউ এনে দিয়েছি।সারাক্ষণ বউয়ের আগে পিছে ঘুড়বি। তা না করে ফ্যাক্টরির আগে পিছে ঘুরছে। আহ!বউ গুলোর কপাল খারাপ।

কুলসুম বেগম খেতে খেতে মাহতাব কে বললেন,

— শেষ বয়সে এসে বিয়ে করেছো। বছর ঘুরতেই নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই। কবে মরে যাই ঠিক নেই। মরার আগে অন্তত বংশের প্রদীপ দেখে যেতে চাই।

মাহতাব বাদে সবার খাওয়া থেমে গেলো। মধু মাথা নিচু করে বসে আছে। লামিয়ার মন আবার বিষন্নতায় ভরে উঠলো। ময়না বেগম মাকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মাহতাব যখন আছে তখন তার মুখ খোলার দরকার নেই। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাহতাবের ছোট্ট জবাব,

— আচ্ছা।

মধু চোখ বড় বড় করে তাকালো মাহতাবের দিকে। আচ্ছা! আচ্ছা মানে কি? বাচ্চা কি অনলাইন অর্ডার করেছে নাকি!এভাবে আচ্ছা বলে তাকে হার্ট অ্যাটাক দেয়ার অপচেষ্টা কেন করা হচ্ছে? লোকটার কোন সিক্রেট বাচ্চাকাচ্চা নেই তো! কি ভয়ংকর!

ময়না বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের স্বরে কিছু বলতে গিয়েও বলল না।মায়ের আহ্লাদে আটখানা মুখ দেখে নিজেকে কনট্রোল করে ফেললো। লামিয়া নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মাহতাব ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবাইকে বলে বেড়িয়ে গেল।

মধুর মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো। শুধুমাত্র তার নাক ডাকার জন্য একটা সুস্থ মানুষ এভাবে অসুস্থ হয়ে গেলো! এখন কেমন ভুলভাল বকছে। কষ্টে তার গলায় খাবার আটকে গেল। মনে মনে সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। আজ থেকে আর রাতে ঘুমানো যাবে না। দরকার হলে ভুরুর সাথে চোখ টেপ দিয়ে আটকে দিবে। তবুও ঘুমাবে না।তাতে যদি মানুষ টা সুস্থ হয়!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here