আমার অবেলায় তুমি পর্ব -১৭

#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৭

ভোর সারে চারটায় বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। সবাই তখন নামাজে দাঁড়িয়েছে। মাহতাব আর মেহরাব মসজিদে গিয়েছে। আজ আজানের প্রায় সাথে সাথেই সবাই নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। দরজার ওপাশে থাকা মানুষটার যে মোটেও ধৈর্য নেই তার বেল বাজানোর ধরনেই তা স্পষ্ট। অনবরত বিরামহীন ভাবে সে কলিং বেল বাজিয়ে চলেছে। ময়না বেগম দুই রাকাত সুন্নত আদায় করে সালাম ফিরিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,

— এভাবে কে বেল বাজাচ্ছে। সামান্যতম ভদ্রতা জ্ঞান নেই! আর বাসায় ঢুকেছে কিভাবে? দারোয়ান ব্যাটা কি হালকা হতে গেট খুলে চলে গিয়েছে। আজকে ওর বেতন থেকে পঞ্চাশ টাকা কাটা যাবে। বেয়াদব!

— আহ! চুপ করো ময়না। নামাজে বসে অসভ্যের মতো কথা বলছো কেন?

কুলসুম বেগম সালাম ফিরিয়ে বিরক্ত গলায় মেয়েকে ধমক দিলেন।
মধু সালাম ফিরিয়ে দ্রুত দরজা খুলতে গিয়েছে। রহিমা আর জরি সবার শেষে নামাযে দাঁড়িয়েছে। তাই তাকেই যেতে হলো। ময়না বেগম ও ধীর পায়ে আসলো মধুর পিছু পিছু। এই অসভ্যের চেহারা না দেখলে তার নামাজে মন বসবে না। বয়সে ছোট হলে হাতে মধু মেখে চটাশ করে এক চর বসাবে। বাসায় না শিখালে কি হয়েছে। সে নিজে চড়িয়ে চড়িয়ে ভদ্রতা শিখিয়ে দিবে।
মধু দরজা খুলতেই পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলো। বহুকালের চেনা জানা মানুষটা কে দেখে মুখে হাসি ফুটলেও পরক্ষণেই তা অভিমানের চাদরে মিলিয়ে গেলো।

দরজার ওপাশের মানুষটাও মধুকে দেখে কম অবাক হয়নি। মধুর এখানে থাকা তাকে বিষ্ময়ের চরম শিখরে নিয়ে গিয়েছে। হাতের লাগেজ টা রেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

— মধুরিমা! তুই এখানে?

মধু কিছু না বলেই চুপ করে রইলো। ময়না বেগম সন্দিহান চোখে সামনে আসতেই নিজের ছেলে সামির কে দেখে অবাক হয়ে গেলো৷ গোল গোল চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর তার হুস ফিরলো ছেলের পাশে সাদা চুল ওয়ালা এক মেয়েকে দেখে। মেয়েটাও তার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। ময়না বেগম আতংকে এক হাত বুকে আর এক হাত পায়ে দিলেন। সে নিশ্চিত তার বেঈমান ছেলে এই বিদেশী পাটখড়ি কে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। পায়ের স্লিপার খুলে সোজা ছেলের গায়ে ছুড়ে মারলেন। হঠাৎ অতর্কিত হামলায় শামির বোকা হয়ে গেলো। স্যান্ডেল সোজা তার নাকে এসে লেগেছে। সামনে তাকিয়ে মা কে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগে দ্বিতীয় পায়ের স্যান্ডেলটি ও ছুড়ে মেরেছে ময়না বেগম।
এবার তা সোজা পাটের আশের মতো চুল বিশিষ্ট মেয়েটির গায়ে লেগেছে। মধু এক হাতে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

শামির অবাক চোখে তাকালো ময়না বেগমের দিকে। যার নজর আপাতত মধুর পায়ের স্যান্ডেলের দিকে। ওগুলো ও মারবে নাকি!

— আম্মু! এসব কি করছো? কোথায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরবে।তা না করে জুতো মারছো কেন?

ময়না বেগম গুনগুন করে কাদতে লাগলো। ড্রয়িং রুমের এই ভয়ংকর অবস্থা নামাজের রুমে এখনো পৌছায়নি।
মধু অসহায় মুখ করে দাড়িয়ে আছে। শামির নিজেও হতভম্ব চোখে মায়ের কান্না দেখছে। মধু গিয়ে ময়না বেগম কে আগলে ধরলো। সোফায় বসিয়ে দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো তার দিকে। ময়না বেগম বুকে হাত রেখে আহাজারি করতে করতে বলল,

— আমার ভাইয়েদের রক্ত পানি করা টাকায় এই ছেলে কে বিদেশ পাঠিয়েছি পড়াশোনা করতে। আর এই কুলাঙ্গার বিদেশী ধরে এনেছে। ভাইদের সামনে মুখ দেখাবো কিভাবে আমি! আমার নাক কে*টে তিন টুকরো করেছে এই বেয়াদব। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই দিন দেখার আগে বিপি লো হয়ে আমি জ্ঞান হারালাম না কেন?

শামির চোয়াল ঝুলিয়ে মায়ের অভিনয় দেখছে। চেচামেচি শুনে কুলসুম বেগম সহ সবাই নামাজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। শামিরের সাথে আসা মেয়েটা অবাক চোখে ময়না বেগমের কান্ডকারখানা দেখছে। তার হাতে ময়না বেগমমের
দুই নাম্বার জুতো বিদ্যমান।

— ও আজমল আংকেলের মেয়ে মারিয়া আম্মু। এভাবে রিয়্যাক্ট করা বন্ধ করো।

কুলসুম বেগম এতক্ষণ মেয়ের কান্নার কারণ খুজছিল। নাতির গলা শুনে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। খুশিতে চোখ টলমল করতে লাগলো। এক হাতে লাঠি ভর দিয়ে আরেক হাতে নাতিকে কাছে ডাকলো। শামির ও গিয়ে কুলসুম বেগম কে জড়িয়ে ধরলো। মধু এতক্ষণে নিজের মাথার জট খুলতে পারলো। শামির তাহলে এ বাড়ির নাতি। ময়না বেগম নাক টেনে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো। কুলসুম বেগম নাতির চোখে মুখে চুমু খেয়ে সারা মুখে হাত বোলাচ্ছেন। কুলসুম বেগম ছেলের সামনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। শামির শব্দ করে হেসে নিজেও আগলে নিলো মাকে৷

— কেমন আছিস বাবা? শুকিয়ে আমস্বত্তা হয়ে গেছিস। আয় আমি তোকে ভাত দেই।

শামির ময়না বেগম কে থামিয়ে দিলো। মায়ের কপালে চুমু খেয়ে মুচকি হেসে বলল,

— পরে খাবো আম্মু। এখন ফ্রেশ হবো। মামারা কোথায়? আর ছোট মামি কি তার মামার বাড়ি গিয়েছে? দেখছিনা যে? আর মধু এখানে কি করছে?

— তোর মামারা মসজিদে। লামিয়া একটু অসুস্থ। নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে। আর মধুকে কি তুই আগে থেকে চিনিস?

— হ্যা আম্মু। আমার একমাত্র বন্ধু ছিল হাইস্কুলে। বলেছিলাম না তোমাকে একটা মেয়ের কথা। এই সেই মেয়ে।

— ওওও। এখন আর সে তোমার শুধু বন্ধু নেই। বড় মামী হয় তোমার। মামী বলেই ডাকবে।

শামির অবাক চোখে তাকালো মধুর দিকে। মধু নিচের দিকে তাকিয়ে পা দিয়ে ফ্লোর খুটছে। শামির মধুর সামনে গিয়ে দাড়ালো। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে হুট করেই মধুর মাথায় চাটি দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— বলেছিলাম না মধুর চাক,তোর জীবনে একদিন ভালোবাসার জোয়ার আসবে। মিললো তো?

মধু কিছু বললো না। অভিমানী চোখে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। শামির মধুর অভিমান বুঝলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহিমা কে বলল মারিয়া কে গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে। কাল মারিয়া দিনাজপুর তার দাদার বাড়ি চলে যাবে। এরকম কিছু হতে পারে শামির তাকে রাস্তায় ই বলেছিল। তবুও মারিয়া কম অবাক হয়নি। তার কাছে ময়না বেগম কে অসম্ভব ভালো লেগেছে। সুযোগ পেলে একটু বন্ধুত্বও করবে সে।

মাহতাব আর মেহরাব বাসায় এসে শামির কে দেখে অবাক হলো না। তারা জানতো আজ শামির আসবে। শামির সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। পরিনামে জুতো খেতে হলো। ময়না বেগম ছেলেকে কাছে ডাকলেন। শামির কাছে যেতেই সপাটে এক চড় পরলো তার গালে। মাহতাব আর মেহরাব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেহরাব বিরবির করে বলল,

— বেস্ট অফ লাক শামির।

শামির গালে হাত দিয়ে হতভম্ব গলায় বলল,

— মারলে কেন?

— এই সময় বাসার সবাই নামাজ পড়ে জানো না? অসভ্যের মতো বেল বাজাচ্ছিলে কেন? ভদ্রতা শেখোনি বেয়ারা ছেলে।

শামির গালে হাত দিয়ে মিনমিন করে বলল,

— সরি।

— হুম।রুমে যাও।

সবার সাথে কুশল বিনিময় করে শামির ময়না বেগমের রুমে গেলো। আজ সে এখানেই থাকবে। কাল ছাদের রুমে সিফট হয়ে যাবে। রহিমাকে দিয়ে পরিস্কার করিয়ে রাখতে হবে।

— এভাবে ছেলেটা কে মারলে কেন আপা? মাত্র দেশে এসেছে। একটু ভালো ব্যবহার তো করতে পারো।

— বেশি বুঝবি না। এক বিদেশী মেয়ে নিয়ে সকাল সকাল বাসায় এসে হাজির হয়েছে। তার উপর অসভ্যের মতো একটানা বেল বাজিয়েই চলেছে। এই মেয়ে দেখে যদি আমি হা*র্ট অ্যা*টাক করে মা*রা যেতাম! আরো কয়েকটা দেয়া দরকার ছিল।

মাহতাব চোখের ইশারায় মধুকে ডেকে নিজের রুমে চলে গেলো। আপার সাথে তর্কে যাওয়ার দুঃসাহস তার নেই। ওটা মেহরাবের কাজ।
মধু ধীর পায়ে মাহতাবের পিছনে গেলো। এ বাড়ির তর তরিকা বুঝতে তার অনেক তেল মশলা খরচ করতে হবে। কয়েকদিনেই তার মাথা খারাপের অবস্থা।

ভাবনার মাঝে কখন মাহতাব দাড়িয়ে গেছে মধু খেয়ালই করেনি। ফলাফল মাহতাবের পিঠের সাথে ধাক্কা। মাহতাব এক হাতে রুমের দরজা লাগিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

— ধাক্কা বুকে এসে খেতে হয় মধু। তাহলেই তো আমি তোমাকে দু হাতে আগলে নিতে পারবো। এসো,সামনে এসে আমার বুকে এসে ধাক্কা খাও।

মধু হতভম্ব হয়ে গেল। সে কি ইচ্ছে করে পরিকল্পনা মাফিক ধাক্কা খেয়েছে? এভাবে বলছে কেন? ব্যাথা পেলো নাতো আবার? তার মাথা কি বেশি শক্ত? লোহার মতো?

— কি হলো? এসো।

— আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা খাইনি। আপনি কি ব্যথা পেয়েছেন?(আমতা আমতা করে)

— হুম পেয়েছি। আনরোমান্টিক বউ পেলে সব বর ই ব্যথা পায়। আমার মতো বুড়ো হলে তো তুমি সংসার আলাদা করে বলবে,”আপনাকে আর দরকার নেই বাবুর আব্বু। আমি একা থাকতে পারি।আমাদের সংসার আজ থেকে ভিন্ন হলো। আপনি আপনার রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়”।

— বাবুর আব্বু কে?

— আমি।

— কিন্তু আপনার তো কোন বাবু নেই।

— আজ থেকে প্রতিদিন সকালে ভেজানো বাদাম খাবে। বুদ্ধির জন্য ভালো। বুঝেছো? এবার এসে আমার পাশে চুপচাপ শুয়ে পরো।

— নামাজ দুই রাকাত বাকি আছে।

— যাও পড়ে এসো।

— আচ্ছা।

মধু চলে যেতেই মাহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here