আমার ভাঙা ক্যানভাসে পর্ব -২১ ও শেষ

#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (২১)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

জয় ডাইরির পাতা উল্টে চলেছে, মায়ের অনুভূতি, ভালোবাসা সবটা সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা আছে। জয়ের ইচ্ছা জাগছে ডাইরিটা সম্পূর্ণ পড়ার আবার মন বলছে কারোর পার্সোনাল জিনিস হোক সেটা মা তবুও তো তার পার্সোনাল বলে কিছু থাকতেই পারে। দোনোমনো হয়ে ডাইরিটা রেখে দিলো। কিন্তু কিছুতেই ডাইরির উপর থেকে আকর্ষণ সরাতে পারছে না।

শেষে নিজের সাথে লড়াই করে ডাইরটি হাতে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করল। প্রথম দেখতে যাওয়া, কথা বলা, তারপর বিয়ের কিছু টুকরো স্মৃতি, জয়ের ছোটবেলা, দিয়ার ছোটবেলা সবটা লেখা আছে। জয় নিজের ছেলেবেলার কথা মনে করে মৃদু হাসল।‌ পাতা উল্টে যেতে লাগল, একটা জায়গায় গিয়ে জয় থমকে গেল।

– ‘আজকে জয়ের বাবা বিদেশে পাড়ি দেবে। সবার বারন সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত নিলেন, আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে মানুষটাকে ছাড়া থাকব কিভাবে!!”

পরের কিছু পাতা সম্পূর্ণ ফাঁকা তারপর আবারো লেখা,

– ‘জয়ের বাবা বিদেশে যাবার পর আমার দায়িত্ব কতগুন বেড়ে গেছে। একা হাতে সন্তাদের বড়ো করে তুলতে হবে যদিও আমার তাতে আপত্তি নেই তবে একটা বিষয় বড্ড পীড়া দেয়। জয়ের বাবা বিদেশে চলে যাবার পর থেকে কিরকম একটা বদলে গেছে আগের মানুষটাকে আর খুঁজে পাই না।’

আবারো কয়েকপাতা ছেড়ে লেখা,
– ‘একটা নারীর কাছে তার এক মূল্যবান সম্পদ তার স্বামী। একদিন জয়ের বাবা ফোন করে বললেন, তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল, আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে পরনারীতে আসক্ত হয়েছে এটা আমার কাছে মৃ’ত্যু সমান।’

জয় থমকে গেল। তার বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেছে এটা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না কিন্তু মা তো মিথ্যা বলবে না। জয় নিজের কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে গোটা ডাইরিটা পরে ফেলল। বাবার আসল রূপ এইটা সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ছিঃ ওর বাবা এতটা নীচ।

**

পরেরদিন সকালটা হলো ভিন্নভাবে। জয়ের নিঝের বাবার মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছে না, মায়ের ডাইরির লেখা গুলো বারবার নিজের চোখের সামনে ফুটে উঠছে।

– ‘জয়।’

বাবার ডাকে বিরক্ত হলো জয়, তবুও কিছু প্রকাশ না করে বললেন,

– ‘আমি দু-তিনদিনের মধ্যেই আবারো বিদেশে চলে যাবো।’
– ‘আচ্ছা।’ (শান্ত কন্ঠে)

জহির সাহেব অবাক হলেন ছেলের উদাসীনতা দেখে। উনি চলে যাবে বলছেন, অথচ জয় কোনো প্রকার বাধা দিচ্ছে না কারন কি?

জয় জহির সাহেবকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে গেল।‌ বিষয়টা ওনার কাছে খুব খারাপ লাগল, মনের ভেতরে একটা খচখচানি হয়েই চলেছে।

জয় অফিসে বেরিয়ে যাবার পর জহির সাহেব নিজের স্ত্রীর ঘরে আসলেন।

– ‘কি ব্যাপার আপনি এইখানে?’
– ‘জয়কে সব বলে দিয়েছো তাই না!!’
– ‘আপনার কি মনে হয় বলার হলে এতদিন অপেক্ষা করতাম?’
– ‘আগে স্বার্থ ছিল আর এখন স্বার্থ মিটে গেছে তাই হয়তো বলে দিয়েছো।’
– ‘কিসের স্বার্থ!!’ (একরাশ বিস্ময় নিয়ে)
– ‘কেন টাকা। এতদিন টাটার প্রয়োজন ছিল তাই সবকিছু স্বাভাবিক করে রেখেছিলে কিন্তু এখন জয় প্রতিষ্ঠিত আমাকে কি আর দরকার!’

আতিকা ঘৃনা চোখে তাকিয়ে বলল,,

– ‘একটা মানুষের মন এতটা নীচ হয় ছিঃ।’
– ‘সত্যি কথা সবার গায়ে লাগে।’

আতিকা তেঁতে উঠল।

– ‘কি সত্যি মিথ্যার কথা বলছেন আপনি আপনার লজ্জা করে না কথাগুলো বলতে। আজকে জয়কে সত্যি বলেছি নাকি না নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করছেন অথচ যখন অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে স্ত্রী সন্তানকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন তখন কোথায় ছিল আপনার সত্য মিথ্যার বিচার! সন্তানদের যেকোন ঝামেলা, সুবিধা অসুবিধা সবটা
আমাকে একাকে সামলাতে হয়েছে তখন আপনি কোথায় ছিলেন? আর টাকার কথা বললেন না, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন জয় দিয়া শুধুমাত্র আমার একার নয় আপনারও সন্তান। তাদের প্রতি আপনার কর্তব্য দায়িত্ব আছে। শুধুমাত্র টাকা দিয়ে দিলেই সেই দায়িত্ব পূরন হয়ে যায় না। একটা মেয়ের কাছে তার স্বামী মহা মূল্যবান সম্পদ সেখানে আপনি অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে আমার গোটা সংসারটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন। এতগুলো বছরে সবটা সহ্য করে আবারো নতুন করে‌ সাজিয়েছি আবারো ভেঙে ফেলতে চাইছেন আপনি!! আপনাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না, কখনোই না।’

এতগুলো বছর পর জহির সাহেব প্রথম উপলব্ধি করলেন নিজের প্রথম পক্ষের স্ত্রী সন্তানদের প্রতি কি অন্যায় করেছেন কিন্তু এখন চাইলেই কিছু বলতে ফেলা যাবে না। ওনাকে ফিরতে হবে সেই শহুরে এলাকায়।

**

জয় বিষন্ন হয়ে বারান্দায় বসে আছে। মনটা ভীষন ভার, বাবা জানিয়েছে কালকেই ফিরে যাবেন। রুহি জয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে হালকা কাশি দিলো। জয় রুহির উপস্থিতি টের পেয়েও কিছু বলল না, রুহি এগিয়ে এসে জয়ের হাতে হাত রাখল।

– ‘মনখারাপ!’
– ‘হুমম, আচ্ছা রুহি বলতে পারবি আমার সাথেই এইরকম হলো কেন?’
– ‘কিরকম?’
– ‘আমি জানি তুই সবকিছু জানিস!’
– ‘তুমি কিসের কথা বলছ?’
– ‘বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা।’ (মিনমিনিয়ে কন্ঠে)

রুহি চমকে উঠল। জয় যে জেনে গেছে, সেটা আন্দাজ করতে পারেনি।

– ‘তুমি জানলে কিভাবে?’
– ‘মায়ের ডাইরি পড়েছি।’

রুহি চমকে উঠল।

– ‘মা এতগুলো বছর নিজের কষ্টগুলো কিভাবে চেপে রেখেছিল! আমাদের এতটুকুও বুঝতে দেয়নি।’

জয়ের চোখ ছলছল করছে, রুহি জয়ের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বলল,

– ‘কথাতে বলে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। হয়তো ভালো কিছুর জন্যই আঙ্কেল দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। মামনির জীবনটা তো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে, এখন তুমি দিয়া মামনির পাশে আছে কিন্তু যে মানুষটাকে আঙ্কেল বিয়ে করেছে তার কি হবে? আঙ্কেল যদি আমাদের সাথে জীবন শুরু করে তাহলে সেই মহিলার কি হবে! তার থেকে ভালো হয় না, আঙ্কেলকে আঙ্কেলের মধ্যে ছেড়ে দাও সে তার মতো লাইফ লিড করুক আর আমরা সবাই নিজেদের মতো লাইফ কাটায়।’

জয় মাথা নাড়ল। রুহি কিছুটা থেমে বলল,

– ‘জয়।’

রুহি জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘কি বলবি বল।’
– ‘আমি সবটা জেনে গেছি।’
– ‘কি জেনে গেছিস তুই?’
– ‘নাসরিনের বিষয়ে।’

জয় মৃদু হেসে বলল,
– ‘নাসরিন আমাকে বলেছে, তুই ওর সাথে দেখা করতে গেছিস।’
– ‘তোমাকে বলে দিয়েছে।’
– ‘হুমম। ওর লাইফটা বড্ড এলোমেলো, সেইদিন ফোন করে বলল আবারো অশান্তি করেছে। আর তখনি বলল।’
– ‘ওহ।’

জয় কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
– ‘এইবার আমাকে কি মাফ করা যায়।’
– ‘একদম না।’
– ‘তাহলে কি করতে হবে।’
– ‘একান্ত আপন করে নিতে হবে।’

রুহির কথাটার মানে বুঝতে জয়ের কিছুটা সময় লাগল। কথাটার অর্থ বোঝার পরেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। শুরু হলো নতুন একটা অধ্যায়, দুজনের এতদিনের রাগ অভিমান সবটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল জয়-রুহি।

১বছর পর,

সময়ের সাথে সবকিছু বদলে গেছে, শুধু বদলে যায়নি জয় -রুহির পরিবারের মানুষগুলো।

হামিদ চৌধুরী নিজের বাবার বাড়িতেই থাকেন, সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকেন। জহির সাহেব বিদেশে চলে যাবার পর থেকে সকলের সাথে দূরত্ব কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ওনার পাঠানো কোনো কিছুই কেউ আর নেয়নি। জয় নিজের রোজগারে সবকিছু সুন্দরভাবে মেনটেন করে চলেছে। রুহিও নিজের আঁকাকে নিজের পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে সবাই ভালো আছে।

দিয়া আর রোহান মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে ট্রেনিং এ আছে‌। সোহান আর প্রিয়ার সম্পর্কটাও গভীর হয়ে উঠেছে, একসাথে থাকতে থাকতে দুজন দুজনকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছে। বাড়িতেও সবাই আন্দাজ করেছে, কারোরই আপত্তি নেই।

কয়েকদিন ধরে রুহির শরীরটা প্রচন্ড রকমের খারাপ। রির্পোট নিয়ে আসার পর থেকে মনখারাপ করে বসে আছে, জয় রুহিকে এইভাবে থাকতে দেখে বলল,

– ‘কি হয়েছে? ডাক্তার কি বলল!’

রুহি চুপ করে আছে। জয় রুহির সামনে গিয়ে দুইগালে হাত রেখে বলল,
– ‘কি হয়েছে রুহু সোনা। ডাক্তার কি বলল।’
– ‘ডাক্তার বলল…
– ‘কি হয়েছে বলো না। আমার তো টেনশান হচ্ছে।’

রুহি জয়ের চিন্তিত মুখটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জয়ের গালে হাত রেখে বলল,

– ‘তুমি বাবা হতে চলেছ।’

জয় চমকে উঠল। রুহির দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাতেই রুহি চোখের ইশারায় বলল হ্যাঁ। জয় রুহিকে জড়িয়ে ধরে মুখে, চোখে ভালোবাসার পরশ একে দিতে লাগল।

– ‘তুমি আমাকে এতটা খুশির খবর দিয়েছ আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না রুহি।’

রুহি জয়কে জড়িয়ে দিয়ে বলল,

– ‘আমার ভাঙা ক্যানভাসটাকে পুনরায় সাজিয়ে দেবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। তোমার জন্য আমার জীবনটা আবারো এতটা সুন্দর হয়ে উঠেছে । এইভাবেই সারাটা জীবন তোমার সাথে হাতে হাত রেখে চলতে চাই। ভালোবাসি জয়, অনেক বেশি ভালোবাসি।’
– ‘ভালোবাসি রুহু পাখি।’

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here