আমি পদ্মজা পর্ব ৫৫+৫৬

আমি পদ্মজা – ৫৫
_________________
অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা তার ঝাঁপি থেকে অন্ধকার নিয়ে এসে ঝপ করে রাত নামিয়ে দিল। বিদ্যুৎও চলে গেল। পদ্মজা হারিকেন জ্বালিয়ে প্রেমার ঘরে এলো। প্রেমা পড়ছিল। পূর্ণা শুয়ে আছে। পদ্মজাকে দেখে প্রেমা এগিয়ে এসে হারিকেন নিল। এরপর বলল,’আপা সন্ধ্যার নামায পড়েনি।’
‘তুই পড়। আমি দেখছি।’

পদ্মজা পূর্ণার শিয়রে বসে কাশি দিল,পূর্ণার মনোযোগ পেতে। পূর্ণার সাড়া পাওয়া যায়নি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেদিনের ঘটনার ছয় দিন কেটে গেছে। পূর্ণার স্বাভাবিক হতে দুইদিন লেগেছিল। দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। কিন্তু কাঁধের ক্ষতটা শীতের কারণে পেকেছে। খুব জ্বালাতন করে। আপা,আপা করে কাঁদে। পদ্মজার ভালো লাগে না সেই কান্না শুনতে। কষ্ট হয়। পদ্মজার বুক ভারি হয়ে আসে। পূর্ণার গায়ে লেপ জড়িয়ে দিল। তারপর পূর্ণার মাথায় কিছুক্ষণ বিলি কেটে দিয়ে প্রেমাকে প্রশ্ন করল,’ প্রান্ত কোথায়?’
‘লাহাড়ি ঘরে।’
‘কী করে ওখানে?’
‘কী হিবিজিবি বানায়। বিজ্ঞানী হয়ে যাবে দেখো।’
‘মজা করে বলছিস কেন? হিবিজিবি বানাতে বানাতেই একদিন চমকে দেয়ার মতো কিছু বানিয়ে ফেলবে। বিরক্ত করিস না। ওকে ওর মতো সময় কাটাতে দিস।’
‘কে যায় ওরে বিরক্ত করতে। আমি আমার পড়া নিয়েই আছি।’ কথা শেষ করেই প্রেমা পড়ায় মনোযোগ দিল। পদ্মজা মুচকি হাসল। প্রেমাকে খুব ভালো লাগে তার। মেয়েটা লাজুক না শুধু,ভীষণ বুদ্ধিমতীও বটে। চাল চলন আকর্ষণ করার মতো।

বাসন্তী এই রাতের বেলা হারিকেন জ্বালিয়ে কাঁথা সেলাই করছেন। পদ্মজা রাগী স্বরে বলার চেষ্টা করল,’রাতের বেলা কী করছেন আপনি? বিশ্রাম নিন এখন।’
বাসন্তী পদ্মজার দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন,’কিছুক্ষণ আগেই তো সন্ধ্যা হলো।’
‘সারাদিন কাজ করেন। এখনও করবেন? বিকেলে এতোসব রান্নাও করলেন। যতদিন গ্রামে আছি আমি এই সেলাই-টেলাই যেন আর না দেখি।’
বাসন্তীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা কাঁথা কেড়ে নিল। বাসন্তীর কোনো কথা শুনেনি। আলমারির ভেতর কাঁথা,সুতা,সুঁই রেখে বলল,’যতদিন আছি আমি এগুলো বের করতে যেন না দেখি। বুঝছেন?’
‘আমার কী আর কিছু বলার আছে?’
পদ্মজা হেসে ফেলল। সাথে বাসন্তীও। আমিরের আগমন ঘটে তখনি। পরনে বেশ দামী জ্যাকেট। পায়ে বুট। সে বাইরে গিয়েছিল,হেমলতার মিলাদের ব্যবস্থা করতে। পদ্মজা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,’সব ঠিক হয়েছে? আর একদিন পরেই কিন্তু-
‘কোনো চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে গেছে। পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে। খেতে দাও।’
বাসন্তী বিছানা থেকে দ্রুত নামলেন,’দিতেছি বাবা।’
‘আমি যাচ্ছি তো।’ বলল পদ্মজা।
‘তুমি জামাইকে নিয়ে কলপাড়ে যাও। দেখ, জুতায় কাদা লাগিয়ে আসছে।’
সাথে সাথে পদ্মজা আমিরের পায়ের দিকে তাকাল। আমিরও তাকাল। পদ্মজা আক্ষেপের সুরে বলল,’এতো কাদা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কেন!’
আমির তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। অপরাধী স্বরে বলল,’দুঃখিত আমি।’
‘আসুন কলপাড়ে।’

কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে আছে। কুয়াশার স্তর এতোই ঘন যে পাঁচ-ছয় ফুট দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা কল চাপছে, আমির জুতা থেকে কাদা ধুয়ে ফেলছে। কলের পানি কুসুম গরম। শীতের সময় কল থেকে গরম পানি আসার ব্যাপারটা দারুণ। আমির বলল,’পূর্ণা কী ঘুমিয়ে গেছে?’
‘হু।’
‘হু,ঘুমাবেই তো। প্রতিদিন সন্ধ্যার আযান পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর ফজরের আযানের আগ থেকে উঠে পকপক শুরু করে। ঘুমাতে পারি না।’
পদ্মজা শব্দ করে হাসল। বলল,’ঠিকই তো করে। ফজরে কীসের ঘুম?’
‘বোনের পক্ষই তো নিবে।’

ক্ষণকাল পিনপতন নিরবতা। আমিরের জুতা ধোয়া শেষ। পদ্মজা শুকনো কণ্ঠে বলল,’ওই বাড়ির মানুষদের আসতে বলেছেন?’
ওই বাড়ির নাম উঠতেই আমির জ্বলে উঠল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’ওই বাড়ির নাম নিতে নিষেধ করেছি।’
‘তবুও-
‘না বলিনি। আর বলবও না।’
আমির পায়ে গটগট শব্দ তুলে চলে যায়। পদ্মজা আমিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল। সে রাতের পর ওই বাড়িতে তারা তিন দিন ছিল। তারপরই আমির চাপ দিতে থাকে,ওই বাড়ি ছাড়তে। সে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা যায় না। আমির রাতে ঘুমায় না, ছটফট করে। এই বুঝি পদ্মজার কিছু হয়ে গেল। পদ্মজা খেয়াল করেছে, আমির রাতে কপালের উপর হাত রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তাছাড়া এইভাবে লাশ অদৃশ্য হয়ে গেল। পর পর তিন দিন কেটে যায় তবুও কেউ কিছু বলেনি। কারো মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ব্যাপারটা ভয়ংকর। পূর্ণার ওখানে থাকা বিপদজনক। সে বিপদকে ভয় পায় না। কিন্তু পূর্ণার কিছু হলে সে মানতে পারবে না। আবার পূর্ণা একা এই বাড়িতে আসবে না। তাই বাধ্য হয়ে তিনজন একসাথে চলে এসেছে। তবে পদ্মজা আবার যাবে ওই বাড়িতে। যেতে তাকে হবেই। হাওলাদার বাড়ির প্রতিটি কোণার রহস্য সে নিজের নখদর্পণে আনবেই। এটা তার শপথ।

অনেক রাত হয়েছে। রাতের খাবারের সময় পূর্ণাকে ডেকে তোলা হয়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে পূর্ণা আর ঘুমাতে পারে না। ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায়। প্রেমা এখনও পড়ছে। পূর্ণা বিরক্তি নিয়ে প্রেমার দিকে তাকাল। মনে মনে বলে,এই মেয়ে কী বিশ্ব জয় করে ফেলবে পড়ে? এতো তো আপাও পড়েনি।
‘বাত্তিডা নিভিয়ে এসে ঘুমা। অনেক পড়ছস।’ কিড়মিড় করে বলল পূর্ণা।
প্রেমা গুরুজনদের মতো করে বলল,’বাত্তিডা না বাতিটা হবে।’
‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত গাছে তুলে দেব, আমাকে কিছু শেখাতে আসলে।’
প্রেমার মুখে আঁধার নেমে আসে। সে থমথমে মুখ নিয়ে বই বন্ধ করে। ঝিম মেরে বসে থাকে। পূর্ণা সন্তুষ্ট হয়ে বলে,’এবার হারিকেনের আগুন নিভা। এরপর শুয়ে পড়।’
প্রেমা হারিকেনের আগুন নিভাতে প্রস্তুত হতেই,পূর্ণা বলল,’না,থাক নিভাতে হবে না। ভয় করে। তুই শুয়ে পড়।’
প্রেমা বাধ্যের মতো এসে শুয়ে পড়ে। লেপের ভেতর ঢুকে। তার ঠান্ডা পা জোড়া পূর্ণার পায়ে লাগতেই,পূর্ণা হইহই করে উঠে,’ও মাগো কী ঠান্ডা! দূরে যা।’
প্রেমা রাগী চোখে তাকাল। পূর্ণা ধমক দিয়ে বলল,’কি হইছে? এমনে তাকাস কেন? খেয়ে ফেলবি?’

পূর্ণার সাথে কথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে ইচ্ছে হচ্ছে না প্রেমার। পূর্ণার কথাবার্তাকে পাত্তা দিলে প্রেমার ঘুম নষ্ট হবে,সকালে উঠে নামায পড়াও হবে না,বই পড়াও হবে না। এটা ভেবে প্রেমা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও যায়। পূর্ণা মাথা তুলে দেখে প্রেমা ঘুমালো নাকি। যখন বুঝলো ঘুমিয়ে গেছে,তখন লেপ দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিল প্রেমাকে। এরপর জড়িয়ে ধরল। যেন দ্রুত প্রেমার ঠান্ডা শরীর গরম হয়ে আসে। এই বোনটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। খুব বেশি। শুধু ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারে না কেন জানি! প্রেমার ঘুম খুব পাতলা। পূর্ণা তাকে জড়িয়ে ধরতেই তার ঘুম ছুটে যায়। ঠোঁটে ফুটে উঠে মুচকি হাসি। প্রায় এরকম হয়। সে ঘুমালে পূর্ণা তার কপালে চুমু দেয়,চুলে বিলি কেটে দেয়। হাত-পায়ের নখ কেটে দেয়। ভালোবাসার অনেক রূপ হয়! তেমনি এই দুই বোনের ভালোবাসাটা অন্যরকম। লুকিয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। দুজনই টের পায়। কিন্ত প্রকাশ্যে সাপে-নেউলে যুদ্ধ চলে!

পূর্ণার কিছুতেই ঘুম আসছে না। হারিকেনের আলো নিভু,নিভু। পূর্ণা উঠে বসে। আবার শুয়ে পড়ে। নিভু, নিভু আলোর দিকে চেয়ে মৃদুলের কথা ভাবে। মানুষটার কথা ইদানীং উঠতে বসতে মনে পড়ে তার। কাঁধে আঘাত পাওয়ার পর পূর্ণা দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। তাই মৃদুল বার বার পূর্ণার ঘরে উঁকি দেয়। পদ্মজা সারাক্ষণ থাকতো তাই ঢোকার সাহস পায়নি। দুই দিন পর পূর্ণা ছাদে যায়। পিছু পিছু মৃদুলও আসে। পূর্ণার পিছনে দাঁড়িয়ে কাশে। পূর্ণা ফিরে তাকায়। মৃদুলকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়। পূর্ণা প্রশ্ন করল, ‘কিছু বলবেন?’
মৃদুল বলল,’কেমন আছো ? হুনলাম,রাইতে রান্নাঘরে নাকি পইড়া গেছিলা।’
‘হু। ভালো আছি।’
‘তোমার কি ধপাস, ধপাস কইরা পইড়া যাওয়ার ব্যামো আছে?’
পূর্ণা কিছু বলেনি। পদ্মজা নিষেধ করেছে,সেদিনের রাতের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে। মৃদুল দেখল,পূর্ণা কপাল কুঁচকে,কাঁধে হাত বুলাচ্ছে। সে বিচলিত হয়ে জানতে চাইল,’বেদনা করে? দা’য়ের উপর পড়ছো কত্তটা কাটছে কে জানে! তার উপরে শীতের দিন এই ঘা সহজে ভালা হইব না। এইখানে তো বাতাস হইতাছে। ঘরে যাও। ঘা বাড়াইও না।’
‘না। এইখানেই থাকব।’

মৃদুল আর জেদ ধরেনি। পূর্ণা যতক্ষণ ছিল, সেও ছিল। এরপরদিন একটু পর পর পূর্ণার খোঁজ নিয়েছে। পূর্ণা খুব সুন্দর একটা অনুভূতির সাক্ষাৎ পায়। শুরুতে মৃদুলকে দেখে শুধুই ভালো লাগলেও,আস্তে আস্তে মৃদুলের বিচরণ শুরু হয়েছে তার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। মৃদুলের কথা বলা,দুষ্টুমি,হাসি সব ভালো লাগে। মনের অনুভূতিগুলো হাটি হাটি পা করে গুরুতর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মৃদুলও যে তার ব্যপারে আগ্রহী পূর্ণা টের পায়। এই বাড়িতে আসার পরদিন মৃদুল আমিরের সাথে দেখা করার অজুহাতে পূর্ণার সাথে দেখা করতে আসে। সবার অগোচরে বলে যায়, তার সাথে পরের দিন দুপুরে উত্তরের ঘাটে দেখা করতে। পূর্ণা বলেছিল যাবে। কিন্তু পূর্ণা দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। তাই আর যাওয়া হয়নি। গতকাল পদ্মজা বের হতেই দিল না। পূর্ণার মন কেমন কেমন করছে। খুব মনে পড়ছে মৃদুলকে। হারিকেনের আলো নিভে যায়,তখনই জানালায় টোকা পড়ে। পূর্ণা ভয় পেয়ে যায়। কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। ভূত এলো নাকি! পূর্ণা ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নামে। আবারও সেই ডাক ভেসে আসে। কণ্ঠটা পরিচিত। পূর্ণা ভ্রুকুঞ্চন করে টিনের দেয়ালে কান পাতে। আবারও ভেসে আসে চেনা স্বর,’এই পূর্ণা।’

কণ্ঠটা চেনার সাথে সাথে পূর্ণা জানালা খুলল। মৃদুলের মুখটা ভেসে উঠে। পূর্ণার বুক ধক করে উঠল। সর্বাঙ্গে একটা উষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে যায়। সে ফিসফিসিয়ে বলল,’পাশের ঘরে আপা,ভাইয়া। আপনি ঘাটে যান। আমি আসছি।’
‘আচ্ছা। ‘
মৃদুল চলে যায়। পূর্ণা তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার পরে। শাল দিয়ে মাথা ঢাকল। তারপর হারিকেনে নতুন আগুন জ্বালিয়ে, হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। কোনো সম্পর্ক নেই দুজনের। তবুও পূর্ণা কোনো এক বশীকরণের জাদুতে ছুটে যাচ্ছে মৃদুলের কাছে। কলপাড় অবধি গিয়ে আবার ছুটে আসে ঘরে। আয়না,কাজল বের করে। চোখে কাজল দেয়। তারপর বেরিয়ে যায়। ব্যস্ত পায়ে ঘাটে আসে। চারিদিকে জোনাকিপোকা। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। একটু দূরেই মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণার হাঁটার গতি কমে যায়। সে অকারণে লজ্জা পাচ্ছে। মৃদুল এগিয়ে আসে। তার গলায় মাফলার। মাথায় টুপি। পরনে সোয়েটার। শীতল জলোবাতাসে শীত যেন আরো বেশি জেঁকে ধরছে। পূর্ণা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে, বিনিদ্র আরক্ত চোখে হারিকেনের মৃদু আলোয় নদীর অশান্ত জলরাশির দিকে চেয়ে বলল,’কেন ডেকেছেন?’
‘কেমন আছো?’
পুরুষালি ভরাট কণ্ঠটি পূর্ণাকে কাঁপিয়ে তুলে। অন্যবেলা তো এমন হয় না। এখন এরকম হওয়ার কারণ কী, রাতের অন্ধকার এবং নির্জনতা?
পূর্ণা বলল,’ক্ষতস্থান পেকেছে। তাই একটু যন্ত্রণা হয়। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো নেই।’ মৃদুলের কণ্ঠটি করুণ শোনায়।
পূর্ণা মৃদুলের দিকে চোখ তুলে তাকায়। চোখাচোখি হয়। হারিকেনের আলোয় পূর্ণার কাজল কালো চোখ দুটি তীরের বেগে মৃদুলকে ঘায়েল করে। পূর্ণা সাবধানে প্রশ্ন করল,’কেন?’
‘জানি না।’
‘এতো রাতে আসা ঠিক হয়নি।’
‘এতো রাইতে আমার ডাকে তুমি কেন সাড়া দিলা?’
‘জানি না।’
দুজনের কেউই কথা খোঁজে পাচ্ছে না। দুজনের কেউই জানে না তারা কেন দেখা করেছে। মৃদুল জানে না, সে কেন এতো রাতে,তীব্র শীতে এখানে ছুটে এসেছে। পূর্ণা জানে না,সে কেন পর পুরুষের ডাকে সাড়া দিল। শুধু এইটুকু জানে,তাদের অশান্ত মন শান্ত হয়েছে। খালি খালি জায়গাটা পূর্ণ হয়েছে। তবে, হৃদস্পন্দন ছন্দ তুলে নৃত্য করছে। পূর্ণার কাঁধের ব্যথা বাড়ে। তাই তার ভ্রু দুটি বেঁকে গেল। কাঁধে এক হাত রাখে। মৃদুল ব্যথিত স্বরে জানতে চাইল,’আবার বেদনা করে? দেখি কেমনে কী হইছে।’
মৃদুল দুই পা এগিয়ে আসে। পূর্ণা পিছিয়ে যায়। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,’ অবিবাহিত মেয়ের কাঁধ দেখতে চাওয়া অন্যায়।’
‘সে তো দেখা করাও অন্যায়। সব অন্যায় কী মানা যায়?’
‘অনেকে তো মানে।’
‘আমি পারি না।’
‘আপনি অন্যরকম।’
‘ব্যথা কমেছে?’
‘হু,হুট করে ব্যথা বেড়ে যায়। আবার সঙ্গে সঙ্গে কমেও যায়।”
‘পাকলে এরকম হয়।’
‘হু।’
‘ভয় হচ্ছে না?’
পূর্ণা কেমন করে যেন মৃদুলের দিকে তাকাল। মৃদুল থমকে যায়। পূর্ণা বলল,’কার ভয়? আপনার?’
‘আমার আর সমাজ। দুইটাই।’
‘আপনাকে ভয় পেলে আসতাম না। আর সমাজের ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে।’

উত্তরে বলার মতো কিছু পেল না মৃদুল। ঝিঁঝিঁপোকারা ডাকছে। আলো দিচ্ছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। তার মাঝে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী দাঁড়িয়ে আছে,বুকে ভালোবাসার উথালপাতাল ঢেউ নিয়ে। অনেকক্ষণ পর মৃদুল বলল,’আমি আসতে চাইনি।’
পূর্ণা আবারও সেই মন কেমন করা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল,’তাহলে কেন এসেছেন?’
‘মনে হইতাছে,কোনো বশীকরণ তাবিজের জোরে এখানে আইসা পড়ছি।’
পূর্ণা হেসে ফেলল। হারিকেনের মায়াবী আলোয় সে হাসি কী যে ভালো দেখাচ্ছিল। তার প্রশংসা করার মতো যোগ্য শব্দ মৃদুলের ভাষার ভান্ডারে মজুদ নেই। সে গাঢ় স্বরে বলল,’পিরিতির মায়া বড় জ্বালা।’
কপাল ইষৎ কুঁচকে পূর্ণা প্রশ্ন করল,’কার পিরিতের দহনে জ্বলছেন?’
‘তোমারে কইতে হবে?’
‘না।’
‘ঘরে যাও।’
পূর্ণা তার মুখের ধারে হারিকেন ধরে মৃদুলের দিকে চেয়ে বলল,’আমি কাজল দিয়েছি।’
পূর্ণা ভেবেছে তার কাজল কালো চোখ মৃদুল দেখেনি। কিন্তু মৃদুল তো শুরুতেই দেখেছে। আর ঘায়েল হয়েছে। সে হেসে পূর্ণার চোখ,মুখ আবার দেখল। হারিকেনের হলদে আলোয় পূর্ণার তেলতেলে ত্বক চিকচিক করছে। মৃদুল বলল,’দেখেছি। ভালো লাগছে।’
মৃদুলের এইটুকু প্রশংসায় পূর্ণার মন নেচে উঠল। সে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,’সাবধানে বাড়ি যাবেন।’
আমি পদ্মজা – ৫৬
_____________
সুষ্ঠুভাবে হেমলতার মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ সম্পন্ন হয়। বিকেলে মোড়ল পরিবারের সদস্যরা একসাথে আটপাড়ার মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাথে বৃদ্ধা মনজুরা এবং হিমেল রয়েছে। মসজিদের কবরস্থানে পাশাপাশি শুয়ে আছেন মোর্শেদ,হেমলতা ও পারিজা। কবরের কাছে আসা নিষেধ বলে মেয়েরা দূর থেকে দুই চোখ ভরে তিনটি কবর দেখছে এবং চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। মৃত্যুর এতোগুলি বছর পেরিয়ে গেছে তবুও কবরের সামনে এসে দাঁড়ালে বুকে এতো কষ্ট হয়! কাছের মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ভয়ানক বিষের নাম। এই বিষ যারা পান করেছে তারাই জানে কষ্টের মাত্রা। পূর্ণা ছিঁচকাঁদুনে। সে চোখের জলে স্নান করছে। পদ্মজা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে কবরগুলোর দিকে। মা নামক মমতাময়ী মানুষটার ছায়ার অভাববোধ প্রতিটি পদক্ষেপে সহ্য করতে হয় । কত ভালোবাসতেন তিনি। মাথার উপর তার ছায়া ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়া দায় ছিল। আর আজ এতো বছর ধরে পদ্মজা দিব্যি এই মানুষটাকে ছাড়াই বেঁচে আছে। জন্মদাতা পিতা ছোট থেকে অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা করেছে। কত আকুল হয়ে থাকত পদ্মজা, পিতার ভালোবাসা পেতে। যখন ভালোবাসা পেল বেশিদিন পৃথিবীতে রইলেন না । মা মরা মেয়েদের রেখে নিজেও পাড়ি জমালেন ওপারে। তারপর পদ্মজার কোল আলো করে এলো কন্যা পারিজা। পিতা-মাতার মৃত্যুর শোক কিছুটা হলেও লাঘব হয়। কিন্তু এই সুখও বেশিদিন টিকেনি। খুব কম আয়ুকাল নিয়েই জন্মেছিল পারিজা। পদ্মজাকে আঁধারের গহীনে ছুঁড়ে ফেলে এক এক করে চলে যায় সুখতারারা। পদ্মজা বেশিক্ষণ দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি বুকের ভেতর চেপে রাখতে পারেনি। সে মুখ এক হাতে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। বাসন্তী পদ্মজার মাথাটা পরম যত্নে নিজের কাঁধে রাখেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’কেঁদো না মা। একদিন দেখা হবে। হাশরের ময়দানে।’

_________
সময় তার নিজের গতিতে চলে। কারো জন্য থেমে থাকে না। কেটে যায় আরো তিনটা দিন। এর মাঝে পূর্ণা মৃদুলের সাথে শুটিং দেখতে গিয়েছে একবার। গ্রামের পথে দুজন হেসেখেলে কথা বলেছে। এতেই কানাঘুষা শুরু হয়েছে। এদিকে আমিরের ভীষণ জ্বর। শুকিয়ে গেছে অনেক। ভেতরে ভেতরে কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। খাওয়া দাওয়াও কমে গেছে। সবসময় চিন্তিত থাকে। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকে না। এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। এখন শুয়ে আছে বারান্দার ঘরে। পদ্মজা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। আমিরের চোখ দুটি বন্ধ। পদ্মজা আদুরে গলায় ডাকল,’শুনছেন?’
আমির চোখ বন্ধ রেখেই বলল,’হু?’
‘কী এতো ভাবেন?’
আমির চোখ খুলে পদ্মজার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি ভয়ংকর লাল। রাতে না ঘুমানোর ফল। সে পদ্মজাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,’কী ভাবব?’
‘জানি না। কিছু তো ভাবেনই। চোখ দুটি তার প্রমাণ। আপনি কোনো কিছু নিয়ে কি ভীতিগ্রস্ত?’
আমির বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল,’তেমন কিছু না।’
‘যেমন,কিছুই হউক। বলুন না আমাকে।’
‘আমাদের ঢাকা ফেরা উচিত।’
‘হঠাৎ? ‘
‘জানি না কিছু। আমার প্রায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। তোমাকে হারাতে পারব না আমি।’
‘আমার কিছু হবে না। আমি কারো কোনো ক্ষতি করিনি যে-

পদ্মজা থেমে গেল। সে তো একজনকে খুন করেছে! পদ্মজার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসে। আমির পদ্মজার দিকে চেয়ে বলল,’তুমি কী করে কাউকে খুন করতে পারলে! আমি ভাবতেই পারি না। এরপর থেকেই ভয়টা বেড়ে গেছে। আমার খুব চিন্তা হয়। ঘুম হয় না। রাত জেগে পাহারা দেই কেউ যেন আমার পদ্মবতীকে ছুঁতে না পারে।’
পদ্মজার দুই চোখ জলে ভরে উঠে। বলে,’প্রথম তো বিশ্বাস করেননি,এটাই ভালো ছিল। এখন তো বিশ্বাস করে চিন্তায় পড়ে গেছেন। আর অসুস্থ হয়েও পড়েছেন।’
‘আমি ভেবেছিলাম,স্বপ্ন দেখেছো। তাই ঘুম থেকে উঠে আবোলতাবোল বলছো। তারপর সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবেও যখন বললে,অবিশ্বাস কী করে করি?’
‘এতো ভালোবাসতে নেই। আমার কপালে সয় না।’
‘ভালোবাসতে না করছো?’
‘মোটেও না। মাত্রা কমাতে বলছি।’

_________
পাশেই অজয়বাবুর আম বাগান। সাঁ সাঁ করে শীতল হাওয়া বইছে। পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে। পূর্ণা মৃদুলের চেয়ে পাঁচ-ছয় হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মস্তক নত। ওড়না বেসামাল হয়ে উড়ছে। মগাকে দিয়ে পূর্ণাকে ডেকে এনেছে মৃদুল। আসার পর থেকেই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণা। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। মৃদুল নিরবতা ভেঙে বলল,
‘আমি আগামীকাল বাড়িত যাইতেছি।’
পূর্ণা চকিতে তাকাল। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে প্রশ্ন করল,’কেন?’
মৃদুল মুচকি হেসে বলল,’নিজের বাড়িত কেন যায় মানুষ? এইহানে তো বেড়াইতে আইছিলাম।’
‘ওহ।’
পূর্ণা মৃদুলের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কান্না পাচ্ছে তার। মৃদুল এক ধ্যানে পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকল। তারপর বলল,’অন্যদিকে চাইয়া রইছো কেন? এদিকে চাও।’

পূর্ণা বাধ্যের মতো মৃদুলের কথা শুনে। তার দুইচোখে জল টলমল করছে। পূর্ণার মেঘাচ্ছন্ন দুটি চোখ দেখে মৃদুলের ভীষণ কষ্ট অনুভব হয়। সে কেমন একটা ঘোর নিয়ে জানতে চাইল,’চলে যাব,শুইনা কষ্ট হইতাছে?’
পূর্ণা আবারও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। অভিমানী স্বরে বলল,’মোটেও না। চলে যান।’
‘দুইদিন পরই আসতাছি।’
পূর্ণার চোখেমুখে হাসির ছটা খেলে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’সত্যি?’
‘সত্যি। এবার হাত ধরি?’
মৃদুলের বেশরম আবদারে পূর্ণা লজ্জা পেল। সে দুই কদম পিছিয়ে যায়। দুই হাত পিছনে লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,’বাড়ি থেকে আসার পর।’
পূর্ণা দৌড়ে পালায়। মৃদুল পিছনে ডাকে,’এই কই যাও।’
চঞ্চল পূর্ণা না থেমে ফিরে তাকায়। তার লম্বাকেশ হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল,’বাড়ি যাই। আপনি সাবধানে যাবেন। জলদি ফিরবেন।’

মৃদুল তার গোলাপি ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরে হেসে মাথা চুলকাল। কী অপূর্ব দেখাচ্ছে গ্রামের চঞ্চল শ্যামবর্ণের মেয়েটিকে। হাওয়ার তালে মেঠো পথ ধরে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। চুল আর ওড়না দুটোই হাওয়ার ছন্দে সুর তুলে যেন উড়ছে।

__________
সকাল সকাল মগা এসে খবর দিল,রানি মদনের মাথায় আঘাত করেছে। মদন এখন হাসপাতালে ভর্তি। খলিল হাওলাদার রানিকে মেরে আধমরা করে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। এ কথা শুনে পদ্মজা অস্থির হয়ে পড়ে। খলিল হাওলাদার এতোই জঘন্য যে, পদ্মজার মনে হয় এই মানুষটা নিজের মেয়েকে যেকোনো মুহূর্তে খুন করে ফেলতে পারে। পদ্মজা আমিরকে চাপ দেয়,ওই বাড়িতে নিয়ে যেতে। নয়তো সে একাই চলে যাবে। একপ্রকার জোর করেই আমিরকে নিয়ে আসে হাওলাদার বাড়িতে।হাওলাদার বাড়ির পরিবেশ থমথমে, নির্জন। সবসময়ই এমন থাকে। এ আর নতুন কি! অন্দরমহলে ঢুকতেই আমিনা আমিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকুতি-মিনতি করে বলে,’বাপ,আমার মেয়েরে আমার কাছে আইননা দেও। নাইলে,ওর কাছে আমারে লইয়া যাও। তোমার দুইডা পায়ে ধরি।’
আমির আমিনাকে মেঝে থেকে তুলে আশ্বাস দেয়,’আমি দেখছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমির খলিলের ঘরের দিকে যায়। ফরিনা এসে বিস্তারিত বললেন,’রাইতের বেলা মদনের চিল্লানি হুনি। দৌড়ে সবাই আইয়া দেহি মদন পইড়া আছে। মাথা দিয়া কী যে রক্ত বাইর হইতাছে। আর রানির হাতে এত্ত বড় একটা ইট। ছেড়িডারে দেইখা মনে হইতাছিল,ছেড়িডার উপরে জ্বীনে আছর করছে। আরেকটু অইলে এতিম ছেড়াডা মইরা যাইত। বাবুর বাপ আর রিদওয়ান মেইলা তাড়াতাড়ি হাসপাতাল লইয়া গেছে। আর এইহানদে তোমার চাচা শ্বশুরে রানিরে মাইরা ভর্তা কইরা লাইছে। নাক মুখ দিয়া রক্ত ছুটছে। তবুও থামে নাই। আমরা অনেক চেষ্টা করছিলাম তোমার চাচাশ্বশুরের হাত থাইকা বাঁচাইতে,পারি নাই। আলোডা কি যে কান্দা কানছে! এহন ঘুমাইতাছে।”

আমির চাবি নিয়ে আসে। আমিনা সাথে যেতে চাইলে আমির বলল,’আমি আর পদ্ম যাচ্ছি। রানিরে নিচে নিয়ে আসি। পদ্ম আসো।’

পদ্মজা ছুটে যায় আমিরের পিছু পিছু। ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই রানি তাকায়। রুম্পা যে ঘরে ছিল সেই ঘরেই তাকে রাখা হয়েছে। রানি কাঁদছিল। দরজা খোলার শব্দ শুনে থেমে যায়। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখমুখের রক্ত শুকিয়ে গেছে। আমির,পদ্মজাকে দেখে রানি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কাউকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে নিজের জীবন নিয়ে সুখী না। পৃথিবীর সব কষ্ট যেন তার বুকে। এসব মারধোর আর গায়ে লাগে না। বাপের কথায় বাড়ির কামলা বিয়ে করল। এটা তার জন্য কতোটা অপমানের কেউ বুঝবে না। সে শুধু মানুষ ভেবেই বাড়ির কামলাকে স্বামী মানতে পারেনি। এতোটা উদার সে নয়। সে মানে সে ভালো না। বাপের জোরাজুরিতে নাতনিও দিল। তারপর থেকেই মদন পেয়ে বসে। কারণেঅকারণে তাকে ছুঁতে চায়। মদনের একেকটা ছোঁয়া রানির জন্য কতোটা বেদনাদায়ক তাও কেউ জানবে না। গতকাল রাতে মদন জোরদবস্তি করেছিল তাই রানি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
খালি ড্রামের নিচে থাকা ইট নিয়ে চোখ বন্ধ করে মদনের মাথায় আঘাত করে। এতে সে এখন মোটেও অনুতপ্ত না। পদ্মজা রানির মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝতে পারছে। মেয়েটা হাসিখুশি থাকার জন্য বাচ্চাদের সাথে কাবাডি,গোল্লাছুট, কানামাছি কত কী খেলে! তবুও সুখী হতে পারে না। পদ্মজা সাবধানে রানির পাশে এসে বসল। বলল,’খুব মেরেছে?’
রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে তীব্র কটাক্ষ করে বলল,’তুমি জাইননা কী করবা? মলম লাগাইয়া দেওন ছাড়া আর কী করনের আছে?’
আমির কিছু বলতে উদ্যত হয়। পদ্মজা আটকে দেয়। সে চমৎকার করে হেসে রানিকে বলল,’মলম লাগানোর মানুষই বা কয়জনের ভাগ্যে জুটে আপা?’

রানির দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। এই মেয়েটার সাথে রাগ দেখানো যায় না।
পদ্মজার মাঝে অদ্ভুত কিছু আছে। যা রাগ দমন করতে পারে। রানি বলল,’আমি…আমি ভালা নাই পদ্মজা। আমি একটু আরাম চাই। সুখ চাই। আর কষ্টের বোঝা টানতে পারতাছি না।’ রানির কথার ধরণ এলোমেলো। সে অন্য এক জগতে আছে। বন্দি পাখির মতো ছটফট করছে। মুক্তির আশায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। পদ্মজার খুব মায়া হয়। ভীষণ অসহায় লাগে। ভালোবাসার মানুষ জীবনে এসে আবার হারিয়ে গিয়ে এভাবেই জীবন এলোমেলো করে দেয়। এতো যাতনা কেন প্রেমে? যার শূন্যতা আজও শান্তি দিল না রানিকে। প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রানির ভেতরটা যে একেবারে শূন্য। সে পিরিতের যন্ত্রনায় আজও কাতর! আচ্ছা,যদি রানিকে তার উপযুক্ত কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হতো তবে কী সে তার ভালোবাসাকে ভুলতে পেরে একটু সুখী হতে পারত?

আমির,পদ্মজা ধরে ধরে রানিকে নিচ তলায় নিয়ে আসে। সবাই কত কী প্রশ্ন করে। রানি নিশ্চুপ। কারোর কোনো কথার উত্তর দেয়নি। সবাই যত্ন আত্তি করে। আমিনা খাইয়ে দেন। পুরো দিন রানি বিছানায় শুয়ে থাকে। আমিনা সারাদিন চেষ্টা করেছেন রানি যাতে কথা বলে। কিন্তু রানি যেন পণ করেছে,কথা না বলার। অন্যদিকে মদন ভালো আছে। কয়দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। সেলাই লেগেছে। গঞ্জের হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল এরপর সেখান থেকে শহরে। এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। রানিকে সবাই অনেক খারাপ কথা বলছে। অভিশাপ দিচ্ছে। অনেকে বাড়ি বয়ে এসে কটু কথা বলে গেছে। বাড়ির কেউ নিষেধ করেনি। রানি চুপ করে শুনেছে। বাড়ির অবস্থার কথা ভেবে আমির মোড়ল বাড়িতে ফেরার কথা বলেনি। দিনশেষে রাত আসে। সুন্দর পৃথিবীকে জাপটে ধরে ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হারিয়ে যায় রানি। সকালে চিঠি পাওয়া যায়। তাতে লেখা- “আমার আলোরে দেইখা রাইখো তোমরা।”

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here