আমি পদ্মজা – ৫৯
__________
মাথার উপর সূর্য নিয়ে কলসি কাঁখে পূর্ণা আজিদের বাড়িতে ঢুকে। পাতলা ছিপছিপে গড়ন অথচ কাঁখে পিতলের প্রকাণ্ড কলসি! খালি কলসির ভারেই একটু বাঁকা হয়ে পড়েছে সে। পানিভর্তি কলসি নিয়ে কী করে বাড়ি ফিরবে কে জানে! সকাল থেকে তাদের টিওবওয়েলে সমস্যা। পানি আসছে না। সকালে বাসন্তী আজিদের বাড়ি থেকে পানি নিয়েছেন। এখন আবার আসতে চেয়েছিলেন,পূর্ণা আসতে দিল না। সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। বাসন্তী অনেকবার বলেছেন,’এইটুকু শরীর নিয়ে পারবে না তুমি।’
পূর্ণা অহংকার করে বলেছে,’আমি পারি না এমন কিছু নেই। তুমি ঘরে যাও তো।’
আজিদের বাড়ির সামনে পুকুর আছে। সেখানে নতুন ঘাট বাঁধানো হয়েছে। ঘাটে গোসল করছে আজিদের বউ আসমানি। মাসেক ছয় আগেই বিয়ে হলো। আসমানির সাথে পূর্ণার অনেকবার কথা হয়েছে।
পূর্ণা আসমানিকে দেখেনি। আসমানি পূর্ণাকে দেখে ডাকল,’কি গো পূর্ণা! ফেইরাও চাইলা না। ভাবিরে চোক্ষে পড়ে নাই?’
পূর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অপরাধী কণ্ঠে বলল,’খেয়াল করিনি ভাবি।’
‘পানি নিতে আইছো?’
‘হুম,আমাদের টিউবওয়েল-
‘শুনছি খালাম্মার কাছে। একটু বইসো। আমি ডুব দিয়া আইতাছি।’
‘আচ্ছা ভাবি।’
পূর্ণা মুখে আচ্ছা বললেও সে মনে মনে পরিকল্পনা করে পানি নিয়ে অন্য পথ দিয়ে বাড়িতে চলে যাবে। আসমানি একবার কথার ঝুড়ি নিয়ে বসলে, কথা ফুরোয়ই না। পূর্ণা আড্ডাবাজি খুব পছন্দ করে। কিন্তু এখন তার তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি ফেরা চাই। দুপুর হয়ে গেছে। পদ্মজাকে এখনও দেখতে যেতে পারেনি সে। গতকাল বিকেলে যে দেখে এলো,তারপর আর খোঁজ মিলেনি। চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি পূর্ণার। আজিদের বাড়ির অঙ্গন শূন্য, ঘরের বাইরে কেউ নেই। পূর্ণা সোজা কলপাড়ে চলে আসে। দ্রুত কল চেপে কলসি পানি ভর্তি করে। তারপর কলসি কাঁখে তুলতে গিয়ে হয় সমস্যা। কিছুতেই তুলতে পারছে না। আসমানি গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে। ফর্সা, সুন্দর একটা মুখ। নতুন বউ,নতুন বউ ছাপটা যেন এখনও মুখে লেগে আছে। আসমানি কাছে এসে হেসে বলল,’এত বড় কলসি নিবা কেমনে? খালাম্মারে পাঠাইতা।’
‘তুমি একটু সাহায্য করো।’
‘কী কও? আমি লইয়া যামু কলসি?’
‘আমি কি তা বলছি ভাবি! কাঁখে তুলতে সাহায্য করো।’
আসমানি ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,’ওহ! বাড়ির বউ তো শরম লজ্জার ডরেই বাইর হই না। নয়তো বাড়ি অবধি দিয়া আইতাম।’
‘বাড়ি থেকে বের হতেই লজ্জা, ভাসুরের সাথে শুতে লজ্জা নাই!’
পূর্ণা কটাক্ষ করে বলল। ঠোঁটে তিরস্কার করা হাসি। আসমানির চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়। ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠে। চোখ ছাপিয়ে জল নামে। ক্ষণমুহূর্ত পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকে আসমানি। তারপর এদিক ওদিক দেখে পূর্ণার এক হাত চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল,’কী কইরা জানছো?’
পূর্ণা এক ঝটকায় আসমানির হাত সরিয়ে দিল। বলল,’তোমার সাথে দেখা করার জন্য এসেই জানালা দিয়ে এই নোংরামি দেখেছি। আজিদ ভাই মাটির মানুষ। কত ভালো উনি। উনাকে কেন ঠকাচ্ছো ভাবি?’
আসমানি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাত দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। চোখ থেকে জলের ধারা নেমেছে। পূর্ণার দেখে মায়া হয়। সে কণ্ঠ নরম করে বলল,’ কাউকে বলিনি আমি। বারো-তেরো দিন যখন চেপে রাখতে পারছি, সারাজীবন পারব। ভালো হয়ে যাও ভাবি। আজিদ ভাইকে ঠকিও না। পাপ করো না।’
আসমানি অশ্রুরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল,’আমারে খারাপ ভাইবো না।’
পূর্ণা কিছু বলল না। খারাপ কাজ করার পরও কী করে খারাপ না ভেবে থাকা যায়! সে আসমানিকে অগ্রাহ্য করে কলসি তোলার চেষ্টা চালালো। আসমানি দ্রুত পায়ে কলপাড় ছাড়ে। পূর্ণা কলসি কাঁখে তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু ভার খুব বেশি। এখনই কোমর মচকে যাবে বোধহয়। পূর্ণা কলপাড় ছাড়তেই সামনে এসে দাঁড়ায় আসমানি। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে, এক নিঃশ্বাসে বলল,’কাউরে কইয়ো না পূর্ণা। আমারে তোমার ভাই আর ঘরে রাখব না। আমি চাই নাই এমন করতে। শফিক ভাই তো আমগোর থানার পুলিশ মানুষ। আমার ছোডু বইনডা এক মাস ধইরা হারায়া গেছে। অনেক খুঁজছি পাই নাই। পুলিশ দিয়া খোঁজানোর ক্ষেমতা আমার বাপের নাই। শফিক ভাইরে কইছিলাম,তহন উনি কইছে,উনার সাথে-
আসমানি ফোঁপাতে থাকে। চোখের জলে সমুদ্র বয়ে যাবে এক্ষুণি। পূর্ণা খুব অবাক হয়। একটা মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হলে এভাবে ছোট ভাইয়ের বউয়ের বিপদে সাহায্য করার নামে এমন কুৎসিত শর্ত রাখতে পারে? পূর্ণার রাগ হয় খুব। সে মনে মনে ভাবে,আপাকে সব বলব। আপা পারবে এই সমস্যা সমাধান করতে। সে বিশ্বাস করে,তার আপা চাইলে সব পারে। আসমানিকে আশ্বাস দিয়ে পূর্ণা বলল,’ভাবি কেঁদো না। যে মানুষ এমন শর্ত দিতে পারে সে কখনোই কাউকে সাহায্য করতে পারে না। উনি তোমার বোনকে খুঁজবে না। কিন্তু আশা দেখিয়ে ভোগ ঠিকই করবে। আর সুযোগ দিও না। দোয়া করো শুধু,তোমার বোন যেন ফিরে আসে।’
আসমানি শাড়ির আঁচল দিয়ে দুই চোখ মুছে বলল,’জানো পূর্ণা,আমি আমার বইনরে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারতাম না।’
‘তোমার সাথে তো এক মাসে আরো দুইবার দেখা হয়েছে। কখনো তো বললে না,তোমার বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘আম্মা কইছে,ছেড়ি মানুষ হারায়া গেলেও কেউরে কইতে নাই। মানুষ ভাববো ছেড়া নিয়ে পলাইছে।’
‘আচ্ছা ভাবি,আমি আসি আজ। কাল এসে সব শুনব। অনেক কথা বলব।’
আসমানি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। পূর্ণা ধীর পায়ে আজিদের বাড়ির উঠোন ছাড়ে। পথে উঠতেই দেখা হয় আজিদের মার সাথে। নাম মালেহা বানু।সাথে আবার পাশের বাড়ির বৃদ্ধা জয়তুনি বেগম রয়েছেন। বৃদ্ধার মাজা বয়সের ভারে ঈষৎ ভেঙ্গে শরীর সামনে ঝুঁকে পড়েছে। পূর্ণাকে দেখে মালেহা বললেন,’কি রে ছেড়ি, পানি নিতে আইছিলি?’
‘জি,খালা।’
‘কলসির ভারে দেহি সাপের লাহান বাঁইকা গেছস লো!’ বললেন জয়তুনি বেগম।
পূর্ণার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কলসি নামাল। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল। মালেহা বললেন,’বিয়েশাদী কি করবি না? তোর বইনে না আইছে বিয়া দিব?’
‘দিবে মনে হয়।’
‘তোর লগে হাওলাদার বাড়ির কোন ছেড়ার নাকি ঢলাঢলি চলে?’ বললেন জয়তুনি বেগম। কথা বলার ভঙ্গিটা দৃষ্টিকটু ছিল। পূর্ণার গা জ্বলে উঠে। রেগে যায়। বলে,’আপনাকে কে বলেছে?’
‘এইসব কিচ্ছা বাতাসে ছড়ে। এমন আর করিছ না পূণ্ণা। গায়ের রঙডা ময়লা,বয়সও বেশি আবার তো আরেক কিচ্ছাও আছে। কয়েক বছর আগে বেইজ্জতি হইছিলি গ্রামবাসীর হাতে। এহন আবার এমন কিচ্ছা কইরা বেড়াইলে কেউ বিয়া করব না। এহন দেখ তোর বইনে কোনো ল্যাংড়া, লুলা দেইখা বিয়া দিতে পারেনি।’ বললেন মালেহা।
পূর্ণার মাথার আগে মুখ চলে বেশি। সে কিছু কড়া কথা শোনাতে উদ্যত হয়। তার পূর্বেই একটা প্রিয় পুরুষ কণ্ঠ ধেয়ে আসে,’পূর্ণারে কে বিয়া করব না করব সেটা তো আপনেরে দেখতে কয় নাই কেউ।’
পূর্ণা না তাকিয়েই চিনে যায় কণ্ঠটির মালিককে। বুকের বাঁ পাঁজর ছ্যাঁত করে উঠল। উপস্থিত তিনজন একসাথে ঘুরে তাকায়। কিছুটা দূরে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় গামছা বাঁধা। পরনে কালো শার্ট আর নীল লুঙি। রোদের আলোয় গায়ের ফর্সা রঙটা চিকচিক করছে। কী সুন্দর! পূর্ণা হেসে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিল। মৃদুল মালেহাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,’নিজের চরকায় তেল দেন। পূর্ণার গায়ের রঙ ময়লা আর আপনের কি পরিষ্কার? নিজের রঙডা আগে দেখেন।’
‘এই ছেড়া তুমি কই থাইকা আইছো? বাপের নাম কিতা?’ বললেন মালেহা।
‘কেন? পছন্দ হইছে? ছেড়ি আছে? বিয়া দিবেন? ছেড়ির গায়ের রঙ পরিষ্কার তো?’
মালেহা বানু হকচকিয়ে গেলেন। এ কেমন জাতের ছেলে! কেমন ফটফট করে! মৃদুল যেন বিরাট রসিকতা করেছে,এমনভাবে হাসল পূর্ণা। মৃদুল কলসি কাঁধে তুলে নিল। পূর্ণাকে আদেশের স্বরে বলল,’হাসি থামায়া,হাঁটো।’
মালেহা বানু ও জয়তুনি বেগমকে অবাক করে মৃদুল, পূর্ণা চলে যায়। কিছুটা দূর এসে পূর্ণা প্রথম মুখ খুলল,’কখন এসেছেন?’
‘কিছুক্ষণ আগে। মুখটা শুকনা দেখাইতাছে কেন?’
‘আপাকে দেখেছেন আপনি?’
‘না। অন্দরমহলে ঢুকি নাই।’
পূর্ণা চুপ হয়ে যায়। মৃদুল বলল,’এতো ভার কলসি নিতে পারছো?’
‘কষ্ট হয়েছে।’
‘তো নিতে গেলা কেন?’
পূর্ণা আবার চুপ হয়ে গেল। মৃদুল দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এক মিনিট হাঁটলেই মোড়ল বাড়ি। সে পূর্ণার মুখের দিকে চোখ রেখে বলল,’খুশি হও নাই?’
‘কী জন্য?’ পূর্ণা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘এইযে আইয়া পড়ছি।’
পূর্ণা চোখ নামিয়ে ফেলে। মুচকি হাসে। চোখেমুখে লজ্জা ফুটে উঠে। মৃদুলও হাসল। সে যা বোঝার বুঝে যায়। আশেপাশে অনেক গাছপালা। বড় একটা গাছের ছায়ায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের কেউ দেখে ফেলবে,এই ভয় দুজনের কারোর মধ্যে নেই। পূর্ণার পরনের কাপড়খানি ভেজা। কলসি থেকে পানি পড়েছে বোধহয়। কিছু অংশ পেট ও এক পাশের কোমড়ের সাথে কাপড় লেপ্টে আছে। মাথায় ঘোমটা নেই। গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে এক ঝলক রোদ পূর্ণার মুখ ঘেঁসে কাঁধ ছুঁয়ে মাটিতে পড়ে। সবকিছু মৃদুলের খেয়ালে চলে আসে। সে চমৎকার করে পূর্ণাকে বলল,’ঘোমটা দিয়ে পথে হাঁটবা। বুঝছো ডাগরিনী?’
পূর্ণা ঠোঁটে হাসি রেখেই বাধ্যের মতো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। তারপর চট করে ঘোমটা টেনে নিল। মৃদুলের ডাগরিনী শব্দটা তার মন কাঁপিয়ে তুলেছে। খুশিতে উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ডাগরিনী বলেছে মানে,তার চোখ দুটি ডাগর,ডাগর যা মৃদুলের ভালো লেগেছে! তার প্রশংসা করেছে!
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সম্পন্ন করে পূর্ণা তৈরি হয় হাওলাদার বাড়ি যাওয়ার জন্য। সাথে তৈরি হয় বাসন্তী, প্রেমা ও প্রান্ত। তখন মগা আসে। পূর্ণার হাতে চিঠি দিয়ে বলে,’তোমার বইনে দিছে।’
চিঠি হাতে নিয়ে পূর্ণা মনে মনে ভয় পেল। আপা চিঠি কেন পাঠাবে? অজানা আশঙ্কায় পূর্ণার বুক ধুকপুক করতে থাকে। মগা চলে যায়। পূর্ণা চিঠি খুলে-
আদরের বোন,
তুই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস আমি জানি। আমার সব কথাও মানিস। মাঝে মাঝে ফাঁকিবাজিও করিস তবে এখন আমি তোকে যা করতে বলব একদম অমান্য করবি না। এটা আমার অনুরোধ।
যতদিন না আমি আসছি বা চিঠি লিখছি একদম এই বাড়িতে আসবি না। কেউ যদি বলে,আমি পাঠিয়েছি তোকে আনতে। তাও আসবি না। চোখ-কান খোলা রাখবি। প্রেমাকে দেখে রাখবি। আমি ভালো আছি। পায়ে একটু আরাম পেয়েছি। একদম চিন্তা করবি না। আমি খুব দ্রুত আসব। কেন নিষেধ করেছি আসতে তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। আমি একদিন তোকে সব বলব। এখন আমার কথাটা রাখ। এমুখো হস না। আমি ভালো আছি। আবার ভাবিস না,আমি কোনো বিপদে আছি। শুনবি কিন্তু আমার কথা। আমার কথা অমান্য করলে আমার সঙ্গ আর পাবি না,মনে রাখবি। খাওয়াদাওয়া করবি ঠিকমতো। নামায পড়বি। ঘরের কাজকর্মে হাত লাগাবি।
ইতি
তোর আপা।
লেখাগুলো এলোমেলো, অগোছালো। মনে হচ্ছে,তাড়াহুড়ো করে লিখেছে অথবা অনেক কষ্টে একেকটা অক্ষর লিখেছে। কপালে ছড়িয়ে থাকা এক গাছি চুল কানে গুঁজে পূর্ণা আবার চিঠিটা পড়ল। পড়ার পর এতটুকু নিশ্চিত হয়েছে,তার বোন ভালো নেই। বড় বিপদে আছে।
আমি পদ্মজা – ৬০
_____________
ঘুম ভাঙতেই পদ্মজা হকচকিয়ে যায়। চোখের সামনে সব কালো। কালো রঙ ব্যাতীত কিছু নেই। ঘোর অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা চোখ কচলে আবার তাকায়। না,কিছুই পরিবর্তন হয়নি! সবকিছু কালো। বিকেলে সে বৈঠকখানার সোফায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। তারপর নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙতেই দেখছে সব অন্ধকার! পদ্মজা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় দেয়ালের সুইচ। তখন সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে একটা আলো। আলোয় ভেসে উঠে আমিরের মুখ। পদ্মজা দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আমির পদ্মজার চেয়ে দুই হাত দূরে এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি আবেগপ্রবণ। পদ্মজার হৃদস্পন্দন থমকে যায়। কাচুমাচু হয়ে প্রশ্ন করল,’আপনি সব বাতি নিভিয়েছেন?’
আমির জবাব না দিয়ে হাতে থাকা সুন্দর কাচের হারিকেনটি পাশে রাখল। তারপরই পদ্মজা কিছু বুঝে উঠার আগে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিল। পদ্মজা আমতাআমতা করে শুধু বলতে পারল,’এ…এ…ই কি…কি?’
আমির তাদের নিজস্ব ঘরে নিয়ে আসে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘর দেখে অবাক হয়। ঘরের চারিদিকে অদ্ভুত সুন্দর কাচের ছোট হারিকেন। আর মাঝে এক ঝুড়ি পদ্মফুল! সময়টা শরৎকাল। দিনের বেলা শরতের সাদা মেঘ নীল আকাশে পাল তুলে, ছবির মতো ঝকঝকে সুন্দর করে তুলে আকাশ। কমে এসেছে যখন তখন বৃষ্টির জ্বালাতন। সময় বিল ঝিল ঝাপিয়ে শাপলা আর পদ্ম ফোটার। এতো পদ্ম ফুল দেখে মনে হচ্ছে বড় এক বিলের সব পদ্ম ফুল তুলে নিয়ে এসেছে আমির। পদ্মজা প্রশ্ন করার পূর্বে আমির পিছন থেকে দুই হাতে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,’মনে আছে,প্রথম রাতে বলেছিলাম একদিন পদ্ম ফুল দিয়ে আমার পদ্মাবতীকে সাজাব! সময়টা নিয়ে এসেছি। দেখো তাকিয়ে।’
পদ্মজা ঝুড়ি ভর্তি পদ্ম ফুলগুলোর দিকে তাকায়। তার চোখ দুটি জলে ছলছল করে উঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমিরের দিকে চেয়ে আবেগমাখা কণ্ঠে বলল,’সে কথাটাও মনে রেখেছেন!’
উত্তরে আমির হেসেছিল। প্রথম রাতের চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর ছিল না সেই রাত। পদ্মজা সেজেছিল পদ্ম ফুল দিয়ে। স্বামী যত্ন করে সাজিয়েছিল। সময়টাকে আরো সুন্দর করে তুলতে প্রকৃতি দিয়েছিল মৃদু শীতল বাতাস।
জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসের দাপটে পদ্মজার ঘুম ছুটে যায়। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে আমিরকে খোঁজে। নেই,বিছানা খালি! আবার সে পুরনো দিনের আরেকটি সুন্দর মুহূর্ত স্বপ্নে দেখেছে। তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠে। আজ পাঁচ দিন আমির নেই। তার কাছে তার স্বামী নেই। কোনো এক অজানা জায়গায় বন্দি হয়ে আছে। পদ্মজা এক হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। বালিশের উপর থাকা আমিরের শার্টটা হাতে নিয়ে চুমু খেল। তার চোখ দুটি আবার ভিজে উঠে। সেদিন রিদওয়ান, খলিল,মজিদ দ্বারা আহত হওয়ার পর তাকে ওখান থেকে কে এনেছে সে জানে না। চোখ খুলে ফরিনাকে দেখেছিল। তিনি ডুকরে কাঁদছেন আর চোখের জল মুছছেন। লতিফাকে জিজ্ঞাসা করে পদ্মজা জানতে পারে,সময়টা দুপুর । সর্বাঙ্গে তখন বিষধর ব্যথা। উঠার শক্তিটুকু নেই। গলায় ব্যথা একটু বেশি ছিল। প্রথমে তার মাথায় আসে আমিরের কথা। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই বুঝে যায়,এভাবে সে এদের সাথে পারবে না। তাকে তার মায়ের মতো শান্ত হতে হবে। সময়-সুযোগ বুঝে কাজ করতে হবে। ফরিনা আদর করে খাইয়ে দেন। তিনি পদ্মজার উপর করা নির্মম অত্যাচার আটকাতে পারেননি বলে
বারবার ক্ষমাও চেয়েছেন। তিনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন। কীরকম চেষ্টা করেছেন সেটা বলেননি। পদ্মজা জিজ্ঞাসাও করেনি। এরপর পদ্মজা কাঁপা হাতে পূর্ণাকে চিঠি লিখে,ফরিনার হাতে দেয়। তিনি যেন মগাকে দিয়ে দেন।
তারপরের দিনগুলো চুপচাপ কাটিয়ে দেয় পদ্মজা। আমিরের শোকে ভেতরে ভেতরে ঝড় বইলেও সামনে সে নিশ্চুপ থেকেছে। সুস্থ হওয়াটা আসল। নয়তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। উল্টো নর্দমার কীটগুলোর হাতে মরতে হবে। আমিরের জন্য দোয়ায় দুই হাত তুলে অঝোরে কেঁদেছে,যেন আমির ভালো থাকে। আর তার কাছে ফিরে আসে। খুব মনে পড়ে মানুষটাকে! হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে পদ্মজার। পদ্মজা আমিরের শার্ট বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ফরিনা এসে দাঁড়ান দরজার সামনে। কেউ একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই,পদ্মজা হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে তাকাল। ফরিনা ঘরে প্রবেশ করেন। গায়ে সাদা-খয়েরি মিশ্রণের শাল। পদ্মজা আমিরের শার্ট বালিশের উপর রেখে বলল,’আছরের আযান পড়েছে আম্মা?’
মৃদুল অন্দরমহলের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। তাকে মদন কিছুতেই অন্দরমহলে ঢুকতে দিচ্ছে না। গত চারদিন ধরে সে চেষ্টা করছে অন্দরমহলে ঢোকার। গত তিন দিন ভুড়িওয়ালা একজন ঢুকতে দিত না। এখন দিচ্ছে না মদন। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সে মৃদুলের সাথে তর্ক করছে। মৃদুল বলছে,’দুলাভাই ঢুকতে দেন কইতাছি। সমস্যাটা কিতা ঢুকলে? সেটাই তো বুঝতাছি না।’
‘দেহো মৃদুল মিয়া এইডা আমার কথা না। মজিদ চাচার কথা। উনি কইছে বাড়ির ভিতরে নতুন কেউরে ঢুকতে না দিতে।’
‘আমি তো আত্মীয় নাকি? আমার সাথে এমন করা হইতাছে কেন? আগে তো ঠিকই ঢুকতে দিত। এহন দেয় না কেন?’
‘হেইডা তো আমি জানি না।’
‘সরেন কইতাছি। নইলে ওইযে গাছের মোড়াডা ওইডা দিয়ে আবার মাথাডা ফাডায়া দিব। একবার মারছে আপাই এহন আমি মারাম।’
‘হেইডাই করো,তবুও আমি চাচার কথা অমান্য করতে পারতাম না।’
‘আমার কিন্তু কইলাম, রাগ উঠতাছে। মাটির তলায় গাইরালামু।’
‘মিয়া ভাই তুমি আমারে যা ইচ্ছা কইরালাও। আমি-
মৃদুলের মাথা বরাবরই চড়া! হুট করে খুন করার মতো রাগ চেপে যায় মাথায়। সে মদনের গলা চেপে ধরে। মদন কাশতে থাকল। আলো কান্না শুরু করে। আলোর কান্না শুনে খলিল বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। সদর দরজার সামনে এমন দৃশ্য দেখে তিনি দৌড়ে আসেন। মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন। হুংকার ছাড়েন,’তোমার এতো সাহস কেমনে হইছে? আমার জামাইয়ের গলা চাইপা ধরো!’
মৃদুলের নাক লাল হয়ে গেছে রাগে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাগী মেজাজ নিয়েই দুই হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,’ আপনার জামাই আমারে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।’
‘তুমি মেহমান মানুষ, আলগ ঘরে থাকবা। এইহানে কী দরকার?’
‘এই নিয়ম কবে করছেন আপনেরা? আগের বার যখন ছিলাম তহন তো ঠিকই ঢুকতে দিছেন।’
‘এহন আর ঢুহন যাইব না। এইডা অন্দরমহল। বাড়ির বউ-ছেড়িদের জায়গা।’
‘সত্যি কইরা কন তো,বাড়ির ভিতর কী চলে?’
খলিলের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে,অসভ্য ছেলেটার কানের নিচে কয়টা দিয়ে দিতে। তিনি কটাক্ষ করে মৃদুলকে বললেন,’নিজের বাড়ি রাইখা এইহানে পইড়া রইছো কেন? মাইনষের অন্ন নষ্ট করতাছো। নিজের বাড়িত যাও।’
অপমানে মৃদুল বাকহীন হয়ে পড়ে! সে ক্ষণকাল কথা বলতে পারে না। তার আপন ফুফা এমন কথা বললো! ক্ষণমুহূর্ত পর সে জ্বলে উঠে বলল,’আপনের বাড়ির উপর থুথু মারি। আমি ব্যাঠা মিয়া বংশের ছেড়া। শত বিঘার মালিক আমি একাই। আপনের অন্নের ঠেকা পড়ে নাই আমার। আমার বাড়িত কামলাই আছে দশ-বারো জন। আমি কাইলই চইলা যাইয়াম বাড়িত।’
মৃদুলের আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। সে ঘুরে দাঁড়ায়। কাছেই একটা বিরাট পাতিল ছিল। কোনো কাজে হয়তো বের করা হয়েছে। সে পাতিলে জোরে লাথি মেরে হনহন করে চলে যায়। পূর্ণা তার বোনের খবর নিয়ে দিতে বলেছে বলেই,সে বার বার অন্দরমহলে ঢোকার চেষ্টা করেছে। নয়তো মৃদুলকে কেউ একবার কোনো ব্যপারে না করলে,সে দ্বিতীবারের মতো সেখানে ফিরেও তাকায় না।
পদ্মজার কথার জবাব দিলেন না ফরিনা। তিনি পদ্মজার পাশে গিয়ে বসলেন। পিছনে রিনু আসে। হাতে খাবারের প্লেট। তিনবেলা ফরিনাই খাইয়ে দিচ্ছেন। যত্ন নিচ্ছেন পদ্মজার। মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম করছেন না। তবুও এই মানুষটা কোন কারণে সেদিন তার চিৎকার শুনেও বাঁচাতে যায়নি? ফরিনা প্লেট হাতে নিতেই পদ্মজা বলল,’আমি এখন মোটামুটি ভালোই আছি আম্মা। আমি খেয়ে নিতে পারবো। হাঁটতেও তো পারি।’
পদ্মজার এক কথায় খাবারের প্লেট পদ্মজার হাতে তুলে দিলেন ফরিনা। আর রিনুকে চলে যেতে বললেন। পদ্মজা চুপচাপ খেয়ে নেয়। তার খেতে ইচ্ছে করে না একদমই। কিন্তু সামনের যুদ্ধটার জন্য তার খেতেই হবে। তাকে সুস্থ থাকতে হবে। সুস্থতা ছাড়া যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব নয়। যতক্ষণ পদ্মজা খেল,ততক্ষণ ফরিনা পাশে বসে থাকলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা ফরিনাকে বলল,’আব্বাকে খুব ভয় পান আম্মা?’
ফরিনা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলেন,’সব বউরাই স্বামীরে ডরায়।’
‘না,আপনি একটু বেশি ভয় পান। যমের মতো।’
‘কবিরাজের দেওয়া ঔষধডি খাও এহন।’
‘আপনি কথা এড়াচ্ছেন আম্মা। আচ্ছা,ঔষধ দেন আগে।’
ফরিনা আলমারি খুলে ঔষধ বের করলেন। তারপর এগিয়ে দিলেন পদ্মজার কাছে। পদ্মজা ঔষধ খেয়ে বলল,’কবিরাজ আনার অনুমতি ওরা দিয়েছিল ভেবে আমি অবাক হয়েছি আম্মা! ওরা কেন চায়? আমি সুস্থ থাকি?’
ফরিনা কিছু বললেন না। পদ্মজা ফরিনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মানুষটার আয়ু কী শেষের পথে? কেমন যেন মৃত, মৃত ছাপ মুখে। চোখ বুজলে মনে হবে,অনেক দিনের উপোষ করে মারা গিয়েছেন। পদ্মজার মায়া হয় মানুষটার জন্য। কোন দুঃখে তিনি ধুঁকে,ধুঁকে মরছেন! পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে এসে ফরিনার সামনে দাঁড়াল। বলল,’আম্মা, আপনি আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে একটা আবদার রাখবেন?’
‘তুমি তো আমার ছেড়িই।’
‘তাহলে আবদার রাখবেন?’
‘রাখাম।’ ফরিনার শুষ্ক চোখ। অথচ গলা ভেজা মনে হলো!
পদ্মজা বলল,’তাহলে আপনার সব গোপন কথা আমাকে বলুন। যা ভেবে ভেবে আপনি কষ্ট পান।’
ফরিনা দুই হাতে পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খান। এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে পদ্মজার হাতে। মমতাময়ী স্পর্শ! পদ্মজার শরীরের
লোম খাড়া হয়ে যায়। ফরিনা বললেন,’তার আগে কও আমি সব কওয়ার পর তোমারে যা করতে কইয়াম তাই করবা তুমি।’
পদ্মজা অপলক নয়নে ফরিনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি করতে বলবেন তিনি? যদি সে সেটা করতে না পারে! সম্ভব না হয়! পদ্মজা বলল,’আপনি যা বলবেন আমাকে তার সাথে যদি যা করতে বলাটা মানানসই হয়,যুক্তিগত হয়। আমি তাই করব আম্মা।’
ফরিনা চোখের জল মুছেন। তারপর বললেন,’আমি বাবুর বাপরে দেইখা আইতাছি। তুমি শুইয়া থাকো।’
কথা শেষ করেই ফরিনা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান। পদ্মজার মাঝে উত্তেজনা কাজ করছে। সে জানে না সে কী শুনতে চলেছে,তবে সেটা কোনো সাধারণ ঘটনা বা কথা হবে না এটা নিশ্চিত। সে ঘরে পায়চারি করতে করতে জানালার ধারে আসে। দেখতে পায় রিদওয়ানকে। হাতে একটা পলিথিন নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। এই জঙ্গলের মাঝেই তো আছে তালাবন্ধ রহস্যজাল। যার চাবি বোধহয় তার কাছে আছে। আলমগীরের দেয়া চাবিটাকে পদ্মজার কোনো তালাবন্ধ রহস্যজালের চাবি মনে হয়! রিদওয়ান গত দিনগুলোতে তিন-চার বার তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু কিছু বলেনি। রিদওয়ানের মতিগতি বোঝা যায় না। অদ্ভুত সে। রিদওয়ানকে দেখলে পদ্মজার শরীর রাগে কাঁপে।
বেশ কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ আসে কানে। শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে পুরুষের পায়ের শব্দ। পদ্মজা দ্রুত এসে বিছানার এক কোণে বসে। যে কোণে ছুরি রাখা আছে। ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান। পদ্মজাকে দেখেই লম্বা করে হেসে বলল,’তারপর বলো কেমন আছো?’
পদ্মজার থেকে জবাব না পেয়ে রিদওয়ান আবার প্রশ্ন করল,’সুস্থ আছো তো?’
পদ্মজা সাড়া দিল না। রিদওয়ান চেয়ার টেনে বসল। বলল,’তোমাকে এত চুপচাপ দেখে অবাক হচ্ছি। কী পরিকল্পনা করছো বলোতো?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল,’কাপুরুষ বোধহয় আপনার মতো মানুষকেই বলা হয়।’
রিদওয়ানের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তারপর হুট করেই হেসে দিল। বলল,’ কাপুরুষের কী করেছি?’
‘স্বামীর অবর্তমানে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। আবার সেই স্ত্রী অসুস্থ ছিল। এমন তো কাপুরুষরাই করে।’
‘এতো কথা না বলে চুপচাপ যা বলি শুনো। আমির আমাদের ব্যপারে অনেক নাক গলিয়েছে। অনেক সমস্যা করেছে। তবুও আমরা আমিরকে এক শর্তে ফিরিয়ে দেব। যদি তুমি সেই শর্ত মানো।’
‘কী শর্ত?’
‘তুমি আমিরকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। কখনো অলন্দপুরে ফিরবে না।’
‘যদি না মানি?’
‘অবুঝের মতো প্রশ্ন করতে বলিনি। শর্ত দিয়েছি,মানা না মানা তোমার ব্যপার।’
‘আপনারা আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন?’
রিদওয়ান হাসল। পদ্মজা বলল,’সেদিন মেরে আধমরা করেছেন। এবার একদম মেরে দিন। তাহলেই আপনাদের সমস্যা শেষ। বেহুদা, আমাদের মুক্তি দিয়ে ভেজাল কেন বাড়াচ্ছেন? ঢাকা ফিরে গিয়ে পুলিশ নিয়েও তো আসতে পারি।’
রিদওয়ান বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক উচ্চারণ করল। বলল,’তোমাকে মারা যাবে না।’
‘আমাকে দিয়ে আপনাদের কী কাজ হবে যে মারা যাবে না?’
‘এতো প্রশ্ন কেন করছো?’
‘মনে আসছে তাই।’
রিদওয়ান রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে,’তুমি শর্তে রাজি নাকি না?’
‘আগে বলুন,কার কাজে আমি লাগব? কার খাতিরে আমাকে মারা যাবে না?’
‘তুমি শর্তে রাজি নাকি সেটা বলো। এইযে আমার পাঞ্জাবিতে তাজা লাল দাগটা দেখছো এটা কিন্তু রক্তের। আর রক্তটা আমিরের।’
পদ্মজার চোখ দুটি জ্বলে উঠে। এমনিতেই এই হিংস্র মানুষটার হাসি,কথা তার গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তার উপর তার স্বামীর রক্ত দেখাচ্ছে রিদওয়ান। পদ্মজা উঁচু গলায় প্রশ্ন করল,’উনাকে জঙ্গলেই রেখেছেন তাই না?’
‘শর্তে রাজি তুমি?’
‘না।’
‘তোমাকে তো আমি-
রিদওয়ান রেগে তেড়ে আসে। পদ্মজা পাশের টেবিল থেকে ঔষধের কাচের বোতলটা নিয়ে রিদওয়ানের মাথায় আঘাত করে। রিদওয়ান আকস্মিক আক্রমণে বিছানায় পড়ে যায়। পদ্মজা দ্রুততার সাথে ছুরি হাতে নেয়। রিদওয়ান বিছানায় পড়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে তার পিঠে ছুরি দিয়ে হেঁচকা টান মারে। রিদওয়ান আর্তনাদ করে উঠল। পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ছুরির আঘাত শরীরের মাংস অবধি চলে গিয়েছে। সুযোগ পদ্মজার হাতের মুঠোয়। সে এই সুযোগ হারাবে না। এতদিন সে এদের মানুষ ভেবে এসেছে। অথচ,এরা মানুষরূপী শয়তান। আর শয়তানকে বুঝেশুনে নয়, ইচ্ছামত আঘাত করা উচিত। পদ্মজা দ্রুত কাঠের চেয়ার তুলে নেয় হাতে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে বারি মারে রিদওয়ানের মাথায়। রিদওয়ানের কানের পাশ দিয়ে রক্তের ধারা নামে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার শরীর। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনীর মতো হাঁপাতে থাকে। মিনিট দুয়েক পর শাড়ির আঁচল মেঝে থেকে তুলে বুকে জরিয়ে নেয়। হুট করেই যেন শান্ত সমুদ্র গর্জন তুলে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে চারপাশ।
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
চলবে….
®ইলমা বেহরোজ