জন্মদিনে দীপ্রকে সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই এত বড় সারপ্রাইজ পেয়ে যাবে, সুপ্রভা বুঝতেই পারেনি। প্রিয়া, তনু, রনি বাপ্পি সবার সাথে প্ল্যান করা হয়েছিল আগে থেকেই। জন্মদিনের আয়োজনে কোথাও কোনো ত্রুটি রাখে নি ওরা। সুপ্রভার প্ল্যানমত সব আয়োজন করেছে, তবে সুপ্রভা কোথাও ছিল না।
ঠিক কেক কাটার আগের মুহুর্তে দীপ্র বারান্দায় গিয়ে সুপ্রভাকে ফোন করেছিল।
-তুই আসলি না, প্রভা, খুব মিস করছি তোকে! আমি জানি এসব তোরই প্ল্যান!
সুপ্রভা তখন বাড়ির গেটে। হাসতে হাসতে বলেছে, আরে ধুর পাগল! যা কেক কাট! আমি ঠিকই দেখব।
-নিশ্চয়ই কেউ লাইভ করবে, তাই না!
-যা, কেক কাট। দেরী করিস না।
কেক কাটতে ছুড়িটা হাতে নিতেই সুপ্রভা দরজা ঠেলে একটা সাদা গোলাপে বুকে হাতে ঢুকে বলল, শুভ জন্মদিন দীপ্র! প্রার্থণা করি, সব সুখ তোর পায়ে ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ুক!
বন্ধুরা সবাই হাত তালি দিলো আর দীপ্র এর মুখটা একশ ওয়াটের বাতির মতো ঝলমলে হয়ে উঠল।
-আমি জানতাম, তুই আসবি! আরে আমার তো এবার সারপ্রাইজের উপর সারপ্রাইজ! ভাইয়াও না জানিয়ে চলে এসেছে!
সুপ্রভা থমকে যায়! ভাইয়া! মানে কে শুভ্র? শুভ্র দেশে এসেছে? কবে এলো, সেই চার বছর ধরে যে দেশে আসার কথা মনেও করে নি! কোনো এক বিদেশিনীকে বিয়ে করে মার্কিন মুলুকে যার স্থায়ী হয়ে যাওয়ার কথা যার, সবাই এমন আন্দাজ করে আলোচনা করে, সেই শুভ্র!
সেই শুভ্র, যে কিনা সাড়ে চার বছর আগে সুপ্রভাকে কাঁদিয়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল দূর মহাদেশে! পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে যে কখনো কোনো খোঁজ রাখেনি, সুপ্রভা বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে!
প্রভার ভাবনার অবকাশ হয় দীপ্রর ডাকে, এই প্রভা! চলে আয়!
প্রভা তাকিয়ে দেখে দীপ্রর পাশে শুভ্র দাঁড়িয়ে। চোখমুখে কোনো দ্বিধা নেই, করে যাওয়া অন্যায় নিয়ে কোনো পাপবোধও নেই। ধবধবে সাদা একটা টিশার্ট আর শর্টস পরে ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। আড় চোখেও সুপ্রভাকে দেখছে না। সুপ্রভাও দেখবে না, কি দরকার এই খারাপ ছেলেকে দেখার। সুপ্রভার ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না শুভ্র। বরং করুণা হওয়া উচিত, এত ভালোবাসা পেয়েও হারিয়েছে।
সুপ্রভা মৃদু স্বরে বলল, এখানেই ঠিক আছি৷ আমি দেখি, তুই কেক কাট এখন!
সুপ্রভা একেবারে সামনে দাঁড়ায়। দীপ্র কেক কাটে। স্কয়ার শেপের পাঁচ পাউন্ডের পাঁচটা আলাদা ফ্লেভারের কেক। দীপ্রকে কেক খাইয়ে দেয় শুভ্র। তারপর, আমি আসছি, বলে দ্রুত ড্রয়িংরুম থেকে হাতের বায়ের রুমটায় ঢুকে গেল শুভ্র।
সাড়ে চার বছর, অনেক বদলে গেছে সুপ্রভা। সদ্য কৈশোর থেকে তরুণী হয়ে ওঠা সুপ্রভাকে ফেলে শুভ্র চলে গিয়েছিল, সে আজ পুরোপুরি বাইশ পেরোনো যুবতী। জলপাই রঙের জামদানীতে কি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে প্রভাকে, শুভ্র তাকাতে পারছে না। বছর চারেক ভিনদেশে থেকে, একশটা মেয়ের সঙ্গ করে কি লাভ হলো তাহলে ! আজ সুপ্রভাকে দেখে বুকটা কাঁপছে কেন! কিভাবে মেনে নিবে প্রভাকে দীপ্রর পাশে!
শুভ্রর পুরুষালি শক্ত সমর্থ শরীর, দাঁড়ি গোফওয়ালা মুখের আড়ালে থাকা নরম মনটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে!
মেয়েটা যে কি প্রচন্ড ভালোবাসতো শুভ্রকে, শেষদিনটা কাঁদতে কাঁদতে প্রায় সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছিল। কোনো অপরাধ না করা মেয়েটাকে কীভাবে এত কষ্ট দিয়েছিল শুভ্র! যেন আর কোনোদিন শুভ্রকে মনে না করে! তীব্র ঘৃণা তৈরি হয় শুভ্রের নামটা শুনলেই! কি এমন হয়েছিল সেদিন!
শুভ্র ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়!
আজ তো আসার কথা ছিল না প্রভার। শুভ্র বার বার দীপ্রকে জন্মদিনের প্ল্যান জিজ্ঞেস করছিল। দীপ্র মন খারাপ করে বলছিল, প্রভা আসতে পারবে না। ওর অফিসে কোনো একটা কাজ আছে।
অফিসে কাজ! সেই ছোট্ট প্রভা, এখন জব করছে একটা বড় কোম্পানিতে। সেই পাতলা পাতলা গড়নের মেয়েটা এখন পুরোদস্তুর এক ভদ্রমহিলা! কি সুন্দরই না হয়েছে দেখতে! অবশ্য আগেও তো ভীষণ মিষ্টিই ছিল!
শুভ্রর মনে পড়ে যায় সুপ্রভাকে প্রথম চুমু খাওয়ার স্মৃতি! প্রথম স্পর্শ, এগুলো কি এত সহজে মুছে ফেলা সম্ভব জীবন থেকে! শুভ্রও পারে নি!
★★★
সুপ্রভা বসেছিল ড্রয়িংরুমে। দীপ্রর মা ডাকলেন, এই প্রভা, আয় এদিকে। কখন এসেছিস? কি খাবি?
-এই মেয়েটাকে দীপ্রর ভীষণ পছন্দ। কয়েকদিন পরে তিনিই বিয়ের কথা তুলবেন। শুভ্রর বিয়েটা দিতে পারলেই।
-এসেছি কালকেই আন্টি, তোমার ছেলেকে সারপ্রাইজ দিতে ঘরে বসে ছিলাম।
-হায় আল্লাহ, সারপ্রাইজ! তোকে দেখেই কত খুশির হইছে দীপ!
প্রভা একটু হাসল। দীপ্র ওকে পছন্দ করে, যেমন তেমন পছন্দ না। হয়তো ভালোও বাসে। শুভ্র চলে যাওয়ার পরে প্রভা কেমন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দীপ্র ওকে ছেড়ে যায় নি। অবশ্য প্রভা দীপ্রকে কখনো বলে নি, শুভ্রর সাথে ওর প্রেম ছিল! গাধাটা বুঝতেও পারে নি ওরই ভাইয়ের সাথে চার বছর টানা প্রেম করেছে সুপ্রভা।
-সবার সাথে বসে খাই আন্টি, আলাদা আর কি খাব!!
-একটু ডিমের জর্দা খেয়ে যা, আয়।
আন্টি খাওয়াবেনই- সুপ্রভা এগিয়ে যায়।
আন্টি নিজেই পিরিচে তুলে প্রভার মুখে দিয়ে দেন। মুখ ভরে নিয়ে প্রভা বলে৷ আর না আন্টি। এরপর আর কিছু খেতে পারব না।
শুভ্র কাঁধে টাওয়েল নিয়ে বের হয়ে ডাইনিংয়ে এলো। মা প্রভাকে আদর করে খাইয়ে দিচ্ছেন! তার আদরের ছোটো ছেলের হবু বউ৷ খাওয়াবেনই তো! শুভ্র কিছু এসে যায় না তাতে!
প্রভাকে অগ্রাহ্য করে শুভ্র বলল, মা, আমাকে একটু কফি দিতে পারবে? নো সুগার, নো মিল্ক!
-দিচ্ছি।
প্রভা জগ থেকে ঢেলে পানি খায়। তারপর শুভ্রর পাশ থেকে চলে যেতে উদ্যত হলেই শুভ্র জিজ্ঞেস করে, হাই, কেমন আছ!
বলেই – মনে মনে বলে শিট! কথা বলার দরকারই ছিল না। যদি রিএ্যাক্ট করে!
প্রভা স্মিত হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
শুভ্র নিজের ঘরে ঢুকে গেল আবার।
বন্ধুরা সব গল্প করছে, দীপ্র ভাইয়া কোথায় গেল, ডেকে আন! একা একা বোর হচ্ছে। দীপ্র তাই রুমে উঁকি দিয়ে শুভ্রকে ডাকল, ভাইয়া এসো বাইরে?
শুভ্র বলল, না রে, এত ভীড়ে সাফোকেশন হচ্ছে। এ সি অন করে বসেছে শুভ্র।
ওকে, তুই রিলাক্স কর।
দীপ্র এসে বলল, এ সি অন করে বসেছে, গরমটা সহ্য করতে পারছে না একদম!
সুপ্রভা ভাবল, শুভ্র এত বদলে গেল কীভাবে! এই ছেলেটা সব কিছু করতে পারত! সব পরিস্থিতিতে এডজাস্ট করতে পারত!
প্রভা৷ একটু আয় তো, দীপ্রও আয়, টেবিলে খাবারটা সার্ভ করে দে। সবাই নিয়ে খাবে।
পিউ বলল, প্রভাকে আন্টি এমনভাবে ডাকে, যেন প্রভা এই বাড়িরই কেউ!
নাতাশা বলল, দীপ্রর সাথে সেটল করে নে প্রভা।তোদের বন্ধুত্ব নিয়ে তো সবাই চিন্তিত!
প্রভা হেসে বলল, তোরা এবার দীপ্রকে একটা বিয়ে দে৷ তাহলে চিন্তা কমবে।
-তার আগে শুভ্র ভাই আছে- পাশ থেকে রনি বলল।
প্রভা উঠে চলে যাওয়ার পরে দীপ্র বলল, তোরা না পারিসও! এগুলো বলার কারণে পরের ছয়মাস আর কোনো মিটিংয়ে প্রভাকে আর পাবি না!
-তাহলে মামা, তুমি বলো! প্রপোজ করো! আর কত! বয়স তো কম হয় নাই তোমাগো- রনি বলল।
দীপ্র বলল, বাদ দে তো, প্রভার মনে হয় অন্য কোনো পছন্দ আছে। আমাকে বন্ধুই মনে করে।
-আর তুই?
তনির প্রশ্নে দীপ্র মাথা চুলকে বলল, বুঝিসই তো, পাত্তা না দিলে কি করব!
যাহ, একটু ইমপ্রেস করার চেষ্টা কর! – দীপ্র উঠে চলে গেল।
আন্টি এক মগ কফি দীপ্রকে দিয়ে বলল, যা, শুভকে দিয়ে আয়।
দীপ্র, এদিকে শোন- পিয়ার ডাকে দীপ্র মগটা প্রভার হাতে দিয়ে বলল, ভাইয়াকে দিয়ে আয়। আমি আসছি!
সুপ্রভা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি!
হ্যা, সমস্যা কি! যা তো!
দীপ্র চলে গেল।
সুপ্রভা মনে মনে ভাবল, ঠিকই তো, সমস্যা কি! এত রিএ্যাক্ট করলে শুভ্র ভাববে ওর কথা মনে করে এখনো কষ্ট পায় প্রভা। কিন্তু বিষয়টা তো সত্য! প্রভা প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে এতগুলো বছর কাটিয়েছে। তবে ওর মত বাজে ছেলেকে প্রভা এখন আর পাত্তা দেবে না!
দরজা ঠেলে প্রভা দেখল রুমে কেউ নেই, কফি রেখে বের হয়ে আসার সময় চোখে পড়ল টেরাকোটার আয়নাটা! সেই আয়নাটা, যেটা প্রভাকে ধরা পড়িয়ে দিয়েছিল শুভ্র কাছে।
এত দিন এটা কোথায় ছিল, চোখে পড়ে নি তো! আয়নাটা মনে হয় পলিশ করা হয়েছে নতুন করে৷
এটা কি নতুন করে বের করেছে শুভ্র, কিন্তু কেন!
শুভ্র ওয়াশরুম থেকে বের হলো, হালকা নীল রঙের টাওয়েল জড়িয়ে উন্মুক্ত বুকে। প্রভা দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছিল, শুভ্র অস্বস্তি ছাড়াই বলল, কেমন আছ?
প্রভা উত্তর দিলো না। দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছিল।
প্রভা, যেটা ছিল সেটা অতীত, তুমি আমার পরিবারের আপন, তাই এরকম করলে সেটা সবার চোখে লাগবে না?
সুপ্রভা দরজা খুলে বের হয়ে গিয়ে দরজাটা জোরে লাগিয়ে দিলে।
শুভ্র একটু হেসে মনে মনে বলল, বেচারা দরজা, শুধু শুধু মার খেলি! সরি রে, আমার ভাগের রাগটা তোকে দেখতে হলো।
আরশিকথা -১
চলবে
শানজানা আলম
(এই গল্পটা যারা পুরোপুরি পড়তে চেয়েছিলেন, তাদের জন্য সুখবর, আমার এখন এটা লিখতে ভালো লাগতেছে, প্রেমে ভাসার জন্য তৈরি তো?)