আরোও_একবার_বসন্ত💔 পর্ব ২

#আরোও_একবার_বসন্ত
#২য়_পর্ব

চিকিৎসার মধ্যেই তাকে জিজ্ঞেস করে প্রিয়ন্তী,
– তোমার সাথে কি কেউ এসেছে?
– আমি এসেছি ওর সাথে

কথাটা কানে আসতেই পেছনে ঘুরে তাকায় প্রিয়ন্তী। পেছনে ফিরতেই দেখে একজন নেভি ব্লু কালারের শার্ট এবং কালো জিন্স পরিহিত একজন যুবক তার সামনে দাঁড়ানো। যুবকটির উচ্চতা কম করে হলেও ছ’ফুট হবে। দেখতে শ্যাম বর্নের, চুলগুলো বেশ কায়দা করে স্টাইল করা। চোখে চশমা, দেখলে একজন নিতান্ত সুদর্শন ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। রাস্তায় তার চেহারা না দেখতে পারলেও এই ছেলেটাই যে চোরটাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো সেটা বুঝতে বাকি রইলো না প্রিয়ন্তীর। চোখজোড়া সরু করে ভ্রুযুগল কুচকে ধীর কন্ঠে বলে,
– আপনি ওর সাথে?
– জ্বী
– কি হন রোগীর?
– হুমমম….আমি ওর বড় ভাই
– ওহ, রোগীর টেস্ট করতে হবে, ইন্টার্নাল ব্লিডিং হচ্ছে কিনা একটু দেখা লাগবে। আর হাত হয়তো ফ্রাকচার হতে পারে। এক্স-রেতে বুঝা যাবে, না হলে একটা সিটি স্ক্যান করাতে হবে। নিচে গিয়ে ওকে এডমিট করিয়ে দিন।
– ঠিক আছে, আপনার নাম?
– জ্বী?
– রেফারেন্সের জন্য।
– ডা. প্রিয়ন্তী আহমদ

নামটি শোনামাত্র কোনো কথা না বলেই পেছনে ঘুরে হাটা দেয় ছেলেটি। এতে প্রিয়ন্তীর একটু আতে লাগে। একেই আজ সকাল থেকে মেজাজটা বিগড়ে আছে। উপরে ছেলেটার এমন ব্যাবহার যেনো কিছুতেই হজম হলো না প্রিয়ন্তীর। এতো অভদ্র মানুষ হয়! ভদ্রতার বালাই নেই। একে চোরের বড় ভাই, পোশাক আশাক দেখে বোঝার জো নেই লোকটা এতো ধুরন্দর৷ তাই আর সংযম না রাখতে পেরে পেছন থেকে বলে উঠে,
– শুনুন
– জ্বী, কিছু বললেন?

ছেলেটি পেছনে ফিরে একটু কর্কশ কন্ঠে কথাটা বলতেই প্রিয়ন্তী বলে উঠে,
– প্যাশেন্ট সবার আগে, তাই চোর ছ্যাচর না দেখেই আমি চিকিৎসা শুরু করেছি। চিকিৎসা হয়ে গেলে যথারীতি থানায় ফোন করবো আমি। আহত হলেও মানুষটির পেশা তার জীবনে প্রভাব ফেলে
– একটু আগেই না বললেন তাকে হাসপাতালে থাকতে হবে।
– হ্যা পুলিশের সাথে আমি সেভাবেই কথা বলে নিবো।
– আচ্ছা তবে আমি বলছি যতক্ষণ ও ঠিক না হচ্ছে ও এখানেই থাকুক।

লোকটার কথার ভঙ্গিমা এমন যেনো কোনো থানার ইন্সপেক্টর। প্রিয়ন্তীর মেজাজটা অত্যাধিক খারাপ হতে লাগলো। কিন্তু তার মাঝেই নিজেকে ঠান্ডা করে ধীর কন্ঠে বললো,
– আপনি কি নিজেকে পুলিশ ভাবছেন? আপনার পোশাক আশাক দেখে বোঝার উপায় নেই যে আপনি ওর ভাই। নিজের ভাইকে এভাবে চুরির শিক্ষা দেওয়াটা বোধহয় কোনো বড়ভাই এর দায়িত্ব নয়। আপনিও কি তবে এই লাইনের?
– দেখুন আপনি ভুল বুঝছেন!
– আমি ঠিক ই বুঝছি, আমার ধারণা আপনি নিজেই ওকে দিয়ে এই কাজ গুলো করান। সুমাইয়া, একটু থানায় ফোন দাও তো।
– আরে আজিব মহিলা তো আপনি। আমি নিজেই পুলিশ। আপনি কাকে ফোন দিয়াচ্ছেন?

ছেলেটার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের স্বরে প্রিয়ন্তী বলে,
– ওহ তাই নাকি? এটা কি বাংলা সিনেমা? একভাই পুলিশ তো আরেক ভাই চোর? ফাজলামি করছেন আমার সাথে। আপনাকে তো সবার আগে জেলে ভরা উচিত। এই সুমাইয়া ফোন করো থানায়।

প্রিয়ন্তীর হুংকার কন্ঠের আদেশ পালন করতে বাধ্য হলো নার্স সুমাইয়া। প্রিয়ন্তীকে বুঝানোর অসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সামনের যুবক এবং চোর ছেলেটি। কিন্তু কে শুনে কার কথা, একেই হয়তো বলা হয় এক জায়গার রাগ অন্য জায়গায় মেটানো।
________________________

নিজের টেবিলে বসে রয়েছে প্রিয়ন্তী। মুখটা লজ্জায় নিচু হয়ে রয়েছে। তার ঠিক অপরপাশে বসে রয়েছে যুবকটি এবং দুজন পুলিশ অফিসার। যুবকটি বাঁকা হাসি হেসেই যাচ্ছে। যুবকটি সত্যি সত্যি একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। মুখে বাঁকা হাসি রেখেই ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– কে যেনো বলছিলো আমাকে সবার আগে জেলে ভরা উচিত?
– আই এম সরি, আসলে আপনি যখন বলেছিলেন আপনি ওর ভাই তখন আমি ভেবেছিলাম
– এইজন্য মানুষের কথা শুনতে হয়, নিজের মুখটা একটু বন্ধ রাখতে হয়। আপনি তো ডাক্তার আপনার তো অভ্যেস থাকার কথা এসবের।
– আপনি কি আমাকে টন্ট করছেন?
– না ফ্রি এডভাইস দিচ্ছি। রাখলে রাখেন না রাখলে নেই। বাই দ্যা ওয়ে ওই রাসেল নামের ছেলেটার ট্রিটমেন্টটা ভালো করে করবেন। বেশ মার খেতে হয়েছে ওকে।
– আপনি কি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?
– হ্যা তুলছি, যা হেনস্তা করলেন আমাকে। আপনার টপ লেভেল নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। এতো হট মেজাজের কি ডাক্তার হয়?

যুবকটির কথাগুলো শুনে গা যেনো জ্বলে উঠলো প্রিয়ন্তীর। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– দেখুন মিস্টার!
– আরাফাত, ইন্সপেক্টর ইয়াসির আরাফাত।
– ওয়াটএভার। আমার কোয়ালিফিকেশন নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে একটু চিন্তা করা উচিত আপনার। আগে আমার সম্পর্কে জেনে নিবেন তারপর কথা বলবেন
– আপনার মনে হয় না, আপনার ও কোনো মন্তব্য দেবার আগে দুবার চিন্তা করা উচিত! রাসেল নামক ছেলেটাকে চোর বলার আগে একটু চিন্তা করেছেন?

আরাফাতের কথাটি শোনার পর চুপ মেরে যায় প্রিয়ন্তী। সত্যি সেই কখন থেকে সে ওই ছেলেটাকে চোর বলেই উল্লেখ করে যাচ্ছে। ছেলেটির বয়স ষোল কি সতেরো হবে। কি মিষ্টি একটা চেহারা, গোল গাল, ফরসা একটা চেহারা! ছেলেটার এই বয়সে পড়াশোনা করার কথা। অথচ তার আজকাল রাস্তায় মার খেতে হচ্ছে। প্রিয়ন্তীকে চুপ থাকতে দেখে আরাফাত ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– রাসেলের বয়স পনেরো। ছেলেটার মা-বাবা কে সেটা ওর জানা নেই। পেটের ক্ষুধা আর অভাব মানুষকে সব কিছু করায়। রাসেলের ব্যাপারটাও তাই। মুদির দোকানে একটা বাটারবান চুরি করতে যেয়ে ধরা খেয়েছে। তাই এই নাবালক ছেলেটাকে সামান্য দশ টাকার বাটারবান চুরির অপরাধে আটকে রাখার ইচ্ছে আমার হলো না। ওর চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখবেন না। আমি বিল দিয়ে দিবো। এমনেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে আমার। আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। উঠলাম৷

বলেই উঠে দাঁড়ালো আরাফাত। আরাফাতের কথাগুলো গা জ্বালানো কিন্তু লোকটা অন্য রকম। প্রিয়ন্তী চাইলেও তাকে ঘৃণা করতে পারছে না। হ্যা এটা ঠিক মাত্রাতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হচ্ছে। লোকটার কথা বলার ধরণ অত্যন্ত বাজে। হয়তো পুলিশে আছে বলেই এতো ভাব। প্রিয়ন্তীও কম যায় না, নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমার দায়িত্বজ্ঞানের হিসেব আমি আপনাকে দিবো না। সুতরাং আমাকে আমার মতো কাজ করতে দিবেন এটাই আশা করি। তবে নিশ্চিন্ত থাকুন আমি কখনো আমার দায়িত্বে কোনো ত্রুটি রাখি নি। আজ ও রাখবো৷ আসতে পারেন।

আরাফাত এক দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর পকেটে হাতখানা গুজে গটগট করে বেড়িয়ে গেলো প্রিয়ন্তীর রুম থেকে। আরাফাত বেড়িয়ে গেলে স্টেথোস্কোপটা গলা থেকে নামিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো প্রিয়ন্তী। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুই ছুই। এই লোকটা তার দুঘন্টা সময় নষ্ট করেছে। এরকম কখনোই হয় নি তার সাথে, একটা লোকের সাথে প্রথম দেখাতেই একেবারে ঝগড়া হয়ে যাওয়া এটা তার সাথে এই প্রথম হলো। তবে মনে শান্তি লাগছে, লোকটার মুখের উপর উচিত জবাব দিয়েছে সে। পাঁচ মিনিট রেস্ট করে আবার রাউন্ডে যেতে হবে। ব্যস্ততাই ভালো, অন্তত বুকের চাপা কষ্টগুলো চাপাই থাকে। মাথায় উপর চড়ে বসে না।

রাত ৮টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আরাফাত, হাতে সিগারেট। উত্তরের বাতাস লোম খাড়া করে তুলছে। মাসটা পৌষের শেষের দিক। বাহিরে শুন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে সুখটান দিতে ব্যস্ত আরাফাত। ব্যস্ত শহরটাকে দেখতেও আলাদা মজা। প্রায় এই সময়টা উপভোগ করে সে। কিন্তু আজকে একটা অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করলো। তার ভালো লাগছে না ব্যস্ত শহর দেখতে। বারবার সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে হতে লাগলো। এই সাতাশ বছরের জীবনে এমনটা তার সাথে প্রথম হলো। তাকে কেউ অহেতুক কারণে জেলে ভরতে চাইলো। তার সাথে ঘন্টা ধরে ঝগড়া করলো। কিন্তু সেই নারীটি তার মস্তিষ্কে জেকে বসে রয়েছে। অনুভূতিটা বিরক্তিকর নয়। কিন্তু সুখময়ও নয়। আরাফাত বুঝতে পারছে না। তার কি করা উচিত! প্রিয়ন্তী আহমদের চেহারাটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝাড়তে পারছে না। শীতের পরিমাণ বেড়েছে, এখনো ফাল্গুনের ছোঁয়া আসে নি ঢাকা শহরে। হয়তো একারণেই মাথাটা জমে রয়েছে। ঠান্ডার সাইড ইফেক্ট হয়তো। আরাফাতের দৃষ্টি বাহিরের দিকে। কিন্তু মাথায় একটি নাম ঘুরপাক খাচ্ছে “প্রিয়ন্তী আহমদ”। হঠাৎ রেলিং এর উপর থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো। ভাবনার সাগর থেকে বেড়িয়ে সিগারেটটা নিভিয়ে মোবাইলটা রিসিভ করলো সে। রিসিভ করতেই একটা মিষ্টি কন্ঠ কানে এলো তার,
– হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম আরাফাত সাহেব?
– ওয়ালাইকুম সালাম, জ্বী বলুন
– আমি এস.এ হসপিটাল থেকে ডা. প্রিয়ন্তী আহমদ বলছিলাম। আপনি কি একটু হাসপাতালে আসতে পারবেন?
– কেনো বলুন তো?
– একটু ইমার্জেন্সি, রাসেল ব্যাপারে। একটু আসতে পারবেন?

প্রিয়ন্তীর কন্ঠে উদ্বিগ্নতা ছিলো। তাই আরাফাত ও দেরি না করে সম্মতি জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলো। রাসেলের কি কিছু হয়েছে? চিন্তার ঝুড়ি মাথায় জেকে বসলো। কোনো সময় নষ্ট না করেই ছুটলো হাসপাতালে। চিন্তায় মাথা বন্ধ বন্ধ লাগছে। হাসপাতালে যেতেই………

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here