আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -৩৩+৩৪+৩৫

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩৩]

সূর্যমামা পশ্চিমাকাশে ডুবি-ডুবি অবস্থা। হলুদ লালচে আভায় মুখরিত পরিবেশ। ভেঁজা মাটির ভ্যাঁপসা গন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে স্পট ভাস্যমান। হু-হু করে চলছে প্রভঞ্জন। তাপমাত্রা অতিরিক্ত শীতলতার কারণে মানব দেহ ইষৎ কেঁপে উঠার উপক্রম। তাই গায়ে পাতলা শাল জড়িয়ে নিলো রিমি। চুল গুলো ছেড়ে আয়নার সামনে নিজেকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে বের হলো রুম থেকে। সিঁড়ি কোঠার দিকে না গিয়ে প্রথমেই পা বাড়ালো একদম শেষের রুমটার দিকে। কাঙ্ক্ষিত রুমটার সামনে এসে নিজেকে প্রস্তুত করে টোকা দিলো কয়েকবার। বেশ কিছুক্ষণ পর রুমের দরজা খুলে বাহিরে আসলো অভ্র। সামনে রিমিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুর জোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘কি?’

রিমি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগ্রহ দেখালো না। যে কাজে এসেছিলো তাই করতে মশগুল হলো। অভ্রের হাত বিনা সংকোচে ধরে টেনে বললো, ‘ছাদে আসো তো আমার সাথে।’

চূড়ান্ত পর্যায়ে বিস্মিত হলো অভ্র। অবাক চোখে রিমির কাণ্ডকারখানা দেখছে অভ্র। এই অবেলায় ছাদে যাবে কেন মেয়েটা? কারণ জানতে চাইলো, ‘এখন ছাদে গিয়ে কি করবে?’

ইতিমধ্যে অভ্রকে ছাদের সিঁড়ির কাছাকাছি টেনে নিয়ে এসেছে রিমি। অভ্রের ধরেই রিমি স্বাভাবিক গলায় শুধাল, ‘তোমার সাথে প্রেম করবো। চুপচাপ আসো তো।’

এমন প্রত্যুত্তর শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো অভ্র। থমথমে মুখে রিমির সঙ্গে পা বাড়ালো। ছাদে আসার পর মুহূর্তেই এক দমকা শীতল হাওয়া গায়ের শিরা উপশিরায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। ছাদের পাশে হেলে পরে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ডালটা থেকে ফুলের রক্তিম পাপড়ি উড়ে উড়ে পরছে। রিমি অভ্রকে নিয়ে সেখানটায় দাঁড়ালো। অভ্র এখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রিমির দিকে তাকিয়ে আছে। রিমি অভ্রের বাহু ছেড়ে অভ্রের বাম হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ভাজে নিজের ছোট ছোট আঙ্গুল গুলো মিলিয়ে দিলো। তারপর ফুল গুলো দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমাকে কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে দাও প্লিজ।’

অভ্র রিমির হাতের বাঁধনের দিকে তাকালো। তারপর চোখ তুলে রিমির দিকে তাকালো একবার। মেয়েটা তার হাত ধরায় স্মিতি হাসি ফুটে এলো ঠোঁটে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল টার দিকে তাকিয়ে শুধাল, ‘ফুল গাছেই সুন্দর। হাতে মানায় না।’

রিমি কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘শুনেন, পুরুষ মানুষের চোখে ফুল মানায় প্রেমিকা চুলে। যদি কোনো পুরুষ প্রেমিকার চুলে ফুলের সৌন্দর্য দেখতে পায় তাহলে সেই পুরুষ টাই হবে খাটি প্রেমিক।’

অভ্র ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে বলে উঠলো, ‘এই মেয়ে তুমি জানো আমি তোমার কত বড়? আমার সাথে এইসব কথা বলতে লজ্জা লাগছে না?’

রিমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো, ‘না লাগছে না। আপনি আমার প্রেমিক। তাছাড়া লজ্জা পেলে জীবনেও মা হতে পারবো না। তাই আমি লজ্জা-টজ্জা পেতে পারবো না। এখন আমাকে ফুল ছিঁড়ে দাও। আজান দেওয়ার আগে। তাড়াতাড়ি দাও।’

রিমির প্রথমে কথা গুলো শুনে হতবাক হয়ে গেলো অভ্র। কিংকর্তব্য-হীন হয়ে পরেছে সে। অপর দিকে ফুল পাড়ার জন্য রিমি তাগিদ দিতে লাগলো। বাধ্য হলো অভ্র। হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া ফুল ছিঁড়ে দিলো কয়েকটা। খুশি হলো রিমি। ফুল গুলো হাতে নিয়ে খুশি হয়ে আহ্লাদের সাথে অভ্রের দুই গাল টেনে দিলো। তারপর আপন মনে প্রত্যেকটা ফুলের সৌন্দর্য দেখতে লাগলো। আর অভ্র দেখতে লাগলো পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। এই বাচ্চা মেয়েটা নাকি তার প্রেমিকা? সিরিয়াসলি? ভাবতেই আমনে মৃদু হেসে ফেললো অভ্র।
_________________________

প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সূর্য তার সঠিক সময়ে পশ্চিমাকাশে ডুব দিয়েছে। ধরনী করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। আকাশ একদম স্বচ্ছ। ঘন কালো মেঘের ছিটেফোঁটার ছোঁয়া নেই তার মাঝে। প্রবল শীতল বাতাসের কারণে বারান্দার দরজায় ঝুলানো সাদা পর্দা গুলো বাতাসে উড়ছে। দীবা চটজলদি পড়ার টেবিল থেকে উঠে বারান্দার দরজা টা লাগিয়ে দিলো। পর্দা গুলো টেনে ঠিক করার সময় আবরারের খেয়াল আসলো তার। লোকটা কি করছে? দেরি করে বাড়ি ফিরায় রেগে গিয়েছে নাকি? রেগেছে-ই বোধহয়। নাহলে শব্দ করে দরজা লাগাতো? কখনোই না! ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো দীবা। কিছুসময় চিন্তা করার পর ভাবলো আবরারের রুমে যাবার কথা। তাই আর বিলম্ব করলো না। চটজলদি পা চালিয়ে রুমের সামনে আসলো। দরজা হালকা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলো আবরার ঘুমিয়ে আছে। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে রুমের ভিতরে ঢুকলো দীবা। এই সময় কেউ ঘুমায়? আজান দিয়েছে নামাজ পরে নি নাকি? বিছানার সামনে একটা বেতের মোড়া রেখে বসলো সেখানে। বিছানায় দুই হাতের কুনই’য়ের ভর দিয়ে গালে হাত রেখে আবরারের মুখের দিকে কিছুটা ঝুকে তাকালো। পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো আবরার কে। এই লোকটা নাকি তার হাসবেন্ড! এতো বড় সেলেব্রিটি হয়েও তাকে ভালোবাসে? আপন মনে ভাবলো কিছুক্ষণ। গালে হাত রেখেই চিন্তিত হয়ে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে উঠলো, ‘যেই মানুষটার জন্য হাজার টা মেয়ে পাগল ; সেই মানুষটা কিনা আমার পিছু পিছু ঘুরে? পাপ্পি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে? ভাবা যায় এই গুলা?’

ভাবতেই প্রসন্ন হলো দীবার মন। খুশিতে আমোদিত হয়ে ফিশফিশ গলায় বলে উঠলো, ‘দীবা রে? কখনো ভেবেছিস এতো বড় সেলেব্রিটি তোর জামাই হবে?’ কথাটা বলেই বুকে এক হাত রেখে চোখটা বন্ধ করে আবারো বললো, ‘আল্লাহ! আমার জামাই টা এতো কিউট কেন? কেন? কেন? খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে একদম।’

আবরারের ঘুমানোর সুযোগে ফিশফিশ করে একাই বিড়বিড় করে কথা গুলো বলছে দীবা। ঘুমন্ত আবরার বোধ হয় টেরও পাচ্ছে না। বন্ধ চোখ উন্মুক্ত করে তাকালো আবরারের দিকে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে কিছুটা অসন্তুষ্টির সঙ্গে বলে উঠলো, ‘সবই ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাটা তুই আস্তো লুইচ্চা। সুযোগ পেলেই অসভ্য অসভ্য টাইপ কথা বলে শুধু। নির্লজ লোক। বলি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে এইসব বলেন নাকি? মুখে লাগাম নেই?’

কথা গুলো বলেই বিরক্তিকর চোখেমুখে বুকে দুই হাত গুঁজে অন্য দিকে তাকালো দীবা। কয়েকবার নিশ্বাস নেবার পরে আবারো নিজেকে নিজেই বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য মেয়ে তো তুই দীবা। তোকে না বললে আর কাকে বলবে? বউ তো একটাই। বলুক যা ইচ্ছা। শুধু মানুষটা তোর পাশে থাকলেই চলবে।’

বলেই মুচকি হাসি দিলো দীবা। গালে হাত রেখে আবারো আবরারের ঘুমন্ত মুখখানি দেখতে লাগলো। তখুনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকলো রিমি। খুবই সাবধানতার সঙ্গে দীবাকে ডাকলো যেন আবরারের ঘুম না ভাঙ্গে। দীবা তার দিকে তাকাতেই রিমি কিছুটা ঝাঁঝ মিশিয়ে, চোখ পাকিয়ে বললো, ‘এখানে কি করছিস তুই? আরব ভাইয়ের ঘুম ভাঙ্গে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলবে। নিচে আয় তোকে ডাকছে।’

‘ঠিক আছে।’ প্রত্যুত্তর করলো দীবা। তাড়াতাড়ি আয় বলে চলে গেলো রিমি। দীবা কিছুক্ষণ আবরারের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যঙ্গ্য করে বলে উঠলো, ‘কেলেঙ্কারি বাধাবে না ছাই। উলটো আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাইবে। অসভ্য লোক বলে কথা।’

দাঁড়ালো না আর এখানে। নিঃশব্দে চলে গেলো আবরারের রুম থেকে। দীবা যেতেই আবরার চোখ বন্ধ রেখেই হেসে উঠলো। এতোক্ষণ সজাগ ছিলো আবরার। শুনেছে সব। কিন্তু উপরে স্বাভাবিক ছিলো। দীবাকে বুঝতে দেয় নি যে তার ঘুম দীবা রুমে আসার আগেই হালকা হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটা এতো কিউট কেন? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেই তো আবরারকে পাগল করেছে। টানা টানা ভয়ার্ত চোখের চাহনীতেই আবরারকে ঘায়েল করেছে। লাজুক হাসিতে মুগ্ধ করে আবরারকে। দীবাকে ছাড়া থাকা আবরারের পক্ষে অসম্ভব।
______________________

চট্টগ্রামে দুটো সৌন্দর্য রয়েছে। দিনের বেলা যেমন সবুজ শ্যামলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঠিক তেমনি রাতের অন্ধকারাবৃত পরিবেশে ছিমছাম জ্যোৎস্নার আলোতে রয়েছে আরেক সৌন্দর্য। পিচ ঢালা রাস্তার দুই পাশে সাড়ি বদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সোডিয়ামের কৃতিম লাইট। দিনের তুলনায় রাতেও রাস্তাঘাটে জনসংখ্যার কমতি নেই। ব্যস্ত মানুষ আপন মনে চলছে যার যার কাজের উদ্দেশ্যে। পরিচিত একটা জুয়েলারির দোকানের সামনে সাবিত গাড়িটা থামালো। নিশিতা, রাইমা ও দীবা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। রাইমার বিয়ের গয়না বানাতে এসেছে দোকানে। দোকানী সাবিতের বন্ধু সেই হিসেবে তাদের বহু পরিচিত। সাবিত গাড়ি থেকে নেমেই কল লাগালো রাজিবের নাম্বারে। যেহেতু বিয়ের গয়না বানাবে সেহেতু রাজিবের পরিবারের লোকজনও এখানে উপস্থিত থাকা লাগবে। কল দিয়েই জিজ্ঞেস করলো তারা এখনো কতো দূর? রাজিব জায়গার নাম বললে সাবিত তাদের নিয়ে আসতে এগিয়ে গেলো। যেহেতু রাজিবের পরিবার রাউজান থাকে সেহেতু আগ্রাবাদের দোকানপাট সম্পর্কে তারা এখনো অবগত নয়। দীবা রাইমার এক হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে এটা ওটা বলে হাসাচ্ছে রাইমাকে। দুইজনের প্রাণখোলা হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে দেখছে নিশিতা।

কিছুসময় পর সাবিতের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হলো রাইমার হবু-শাশুড়ি ও তার দেবর রাজ। রাইমা তার শাশুড়িকে খুবই সাবলীল ভাবে সালাম দিয়ে ভাব বিনিময় করলো। সঙ্গে দীবাও। সংক্ষিপ্ত আলাপ শেষে জুয়েলারির শো-রুমে ঢুকলো সবাই। সাবিতের বন্ধু সবাইকে সাধরে গ্রহন করলো। দোকানের কর্মচারী কে সব কিছু ভালোভাবে দেখাতে বলে সাবিতের বন্ধু সাবিতকে নিয়ে অন্যদিকে গেলো। ব্যস্ততার কারণে দুই বন্ধু তেমন দেখাসাক্ষাৎ করতে পারে না। আজ মেয়েরা গয়না চয়েজ করার ফাঁকে নাহয় আড্ডা দেওয়া যাক।

দোকানের কর্মচারী রাইমা কে বিভিন্ন ডিজাইনের গয়না দেখাতে লাগলো। রাইমা এক এক করে সব গুলো ডিজাইন দেখতে লাগলো। তার পাশেই বসে আছে দীবা। সেও এক্সাইটেড হয়ে রাইমার সাথে বসে গয়না দেখতে। তাদের পাশেই নিশিতা ও রাইমার শাশুড়িও ব্যস্ত গয়না দেখায়।

একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে রাজ। চেয়ারে বসে থুতনি তে এক হাত ঠেকিয়ে দীবার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দীবা বিভিন্ন ডিজাইনের গলার হার নিজের গলায় রাখছে আর আয়না দিয়ে দেখছে। সঙ্গে হেসে হেসে রাইমার গলায়ও চেক করছে ঠিক কেমন মানায়। একবার ইয়ারিং দেখছে তো আরেক বার হাতের চুড়ি দেখছে। একটু দূরে বসেই দীবার রি হাস্যউজ্জ্বল চেহারা পর্যবেক্ষণ করছে রাজ। মুগ্ধ হয়ে মৃদু হাসলো।

দীবা গয়না দেখতে দেখতে একপাশে হাতের ব্রেসলেট দেখে পছন্দ করলো। দোকানী কে বের করে দিতে বললে দোকানী বের করে তার হাতে দিলো। দীবা মুগ্ধ চোখে ব্রেসলেট টা দেখলো। তারপর হাতে পরার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু ব্রেসলেটের হুকটা ঠিক লাগাতে পারছে না। তবুও বারবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে দীবা। এক পর্যায়ে না পেরে বিরক্ত হয়ে গেলো। দূর থেকে সবই দেখলো রাজ। দীবার বিরক্তিকর মুখটা দেখে মৃদু হাসলো। তারপর এগিয়ে আসলো দীবার কাছে। ঠোঁটে হাসি রেখেই অনুমতি চাইলো, ‘আমি পরিয়ে দেই?’

রাজের দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো দীবা। এক বার ব্রেসলেট টার দিকে তাকালো। দ্বিধায় পরে গেলো সে। মুখের উপরে না করে দিবে? নাকি রাজি হবে? না করলে যদি স্যার অপমানবোধ করে তাহলে? বয়সে যেহেতু বড়, আবার স্যার, পারিবারিক ভাবে আত্মীয় হবে কিছুদিন পর। সব কিছু ভেবেই রাজি হলো। ব্রেসলেট টা রাজের দিকে এগিয়ে দিলো। রাজ সেটা হাতে নিয়ে দীবার বাম হাতে পরিয়ে দিলো। খুশি হলো দীবা। ঠোঁটে হাসি রেখেই আয়নার মাঝে হাতটা দেখলো। তার এই খুশি দেখে রাজ প্রশ্ন করলো, ‘পছন্দ হয়েছে?’

দীবা ব্রেসলেট টা দেখতে দেখতে উত্তর দিলো, ‘ভীষণ।’
_______________________

দীবা রুম থেকে যাবার পরেও মাত্র কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিল আবরার। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখলো রিমি নুরা বসে ওয়েব সিরিজ দেখছে। আবরার তাদের পাশে বসে কিছুক্ষণ সিরিজ দেখার পর বাকি সবাই কোথায় জানতে চাইলো। তখন নুরা এক এক করে সবার খোঁজ জানালো।সঙ্গে এটাও জানালো যে বাকিরা রাইমার বিয়ের জন্য গয়না দেখতে গিয়েছে। দাঁড়ালো না আর আবরার। সাবিতের কাজ থেকে এড্রেস টা নিয়েই বেড়িয়ে গেলো জুয়েলারির দোকানের উদ্দেশ্যে। যথাসময়ে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাবার পর গাড়ি থেকে নামলো আবরার। প্রতিবারের মতোই মুখে মাক্স আর মাথায় ক্যাপ পরা। দোকানের ভিতরে ঢুকার সময় মনটা ফুরফুরে থাকলেও ভিতরে ঢুকার পর ফুরফুরে মেজাজ বিগড়ে গেলো। দীবার হাতে রাজকে ব্রেসলেট পরিয়ে দিতে দেখেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। দাঁতে দাঁত পিষে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।

আবরারকে দেখে নিশিতা ডেকে উঠলো, ‘আরে আবরার কখন এলি? এইদিকে আয়।’

নিশিতার ডাক শুনে দীবা পিছু ফিরে তাকিয়ে আবরারকে দেখেই বিস্মিত হলো। ধরফড়িয়ে রাজের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো। বিস্মিত হলো কিছুটা।

আবরারের সাথে রাইমার শাশুড়ির পরিচয় করিয়ে দিলো নিশিতা। ভদ্রমহিলা খুশি হলেন আবরারের সাথে পরিচিত হয়ে। রাজ এগিয়ে এসে আবরারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডসেক করার জন্য। আবরার চুপচাপ হ্যান্ডসেক করলো রাজের সাথে। ভাব বিনিময় করলো। যদিও ভিতরে ভিতরে রেগে আছে প্রচুর।
.

অনেকটা সময় নিয়ে গয়না পছন্দ করে বানাতে দেওয়া হলো। বানানো ছাড়াও প্রয়োজনীয় কিছু গয়না সাথে নিলো নিশিতা আর রাইমার শাশুড়ি। কেনাকাটা শেষে দোকান থেকে বেরিয়ে আসলো সবাই। রাজ ও তার মা সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। নিশিতা গাড়িতে উঠে বসতে নিলেই আবরার বলে উঠলো, ‘আম্মু দীবা আমার সাথে যাবে। তোমরা চলে যাও।’

চলমান…

নোট : আমি বরাবরই অলস প্রকৃতির। তাই প্রতিবার গল্প লিখার পরে রিচেক করতে আলসেমি করি। আজও আলসেমি করলাম। ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩৪]

গালে দুই হাত ঠেকিয়ে ঠোঁট উলটে মনমরা ভাবে বসে আছে দীবা। সামনে তার বিফ স্টেকের চার চারটে প্লেট। সব গুলো নাকি তাকে একা শেষ করতে হবে। কিন্তু এটা আদৌ তার একার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু মহাশয়ের কঠোর নির্দেশ। হঠাৎ এই বিফ স্টেকের উপর ক্ষেপলো কেন লোকটা? আসলেই খাবারের উপর ক্ষেপেছে নাকি দীবার উপর? তাই এই খাবার দিয়ে তাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করছে? পরিবেশটা নির্জন। রাত হওয়ার কারণে আশেপাশে মানুষজনের আনাগোনা একদম কম। নিরিবিলি, নির্জন একটা রেস্টুরেন্টের এক পাশে টেবিলে বসে আছে দুজন। আবরার প্রথমেই পর্দা টেনে দিয়েছে প্রাইভেসির জন্য। যদিও তার মুখে এখনো মাক্স পরা। দীবা এখানে আসার পর বুঝেছিল ডিনার ডেইট। কিন্তু তার ভাবনার বিপরীত হলো। কোনো ব্যাপারে দীবার উপর আবরার রেগে আছে প্রচুর। মলিন চোখ দুটো তুলে সামনে তাকাতেই আবরারের ভাবলেশহীন চেহারা নজরে আসলো তার। সে তাকাতেই আবরার আবারো চোখের ইশারায় খাওয়ার জন্য তাগিদ দিলো। হতাশ হলো দীবা। কাদুকাদু চেহারায় মাথা এপাশ থেকে ওপাশ নাড়িয়ে ‘ না ‘ বুঝালো। তাকে বারণ করতে দেখে আবরার দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কেন খাবে না? বিফ স্টেক তো তোমার অনেক প্রিয়। ডিনারে, লাঞ্চে ভালোই খেতে পারো। তাহলে এখন খাবে না কেন? এখানের সব গুলো তোমাকে একা শেষ করতে হবে। দেরি করলে চারটা প্লেটের বদলে পাঁচটা হবে।’

দীবার অবস্থা এবার কান্না করে দেবার মতো। রাগে, ক্ষোভে, অতি দুঃখে মৃদু আর্তনাদ করে বললো, ‘মানে কি ভাই? আমি কি এমন দোষ করেছি যে এভাবে শাস্তি দিচ্ছেন?’

আবরার অবাক হওয়ার ভান ধরে দীবার কথার প্রত্যুত্তর করলো, ‘শাস্তি দিচ্ছি কোথায়? হাসবেন্ড হয়ে কি তোমাকে খাবারের ট্রিট দিতে পারবো না? আশ্চর্য তো!’

দীবা চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘ট্রিট দিচ্ছিলেন? তাও এভাবে?’

আবরার নিশ্চুপ রইলো। নির্বিকার ভাবে দীবার দিকে প্রথমের ন্যায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো। দীবা একটা প্লেটে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তারপর বুকে দুই হাত গুঁজে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠলো, ‘আমি খেতে পারবো না।’

নিরবে চোয়াল শক্ত করলো আবরার, ‘আমি বিফ স্টিক দিলে খাবে না অথচ রাজ দিলে দিব্যি পেট ভরে খেতে পারো। আবার কলেজ শেষে বাড়ি না ফিরে রাজের সাথেই রেস্টুরেন্টে বসে পাস্তা খেতে পারো। তাহলে এখন কেন পারবে না?’

স্তব্ধ হয়ে গেলো দীবা। চিবুক তার আপনা-আপনি ঝুলে গেছে। বিস্মিত চোখেমুখে তাকিয়ে রইলো আবরারের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে। উনি জানলো কিভাবে? এই কারণেই কি এতো রেগে আছে?

‘আপনি জানেন কিভাবে?’

‘কেন আমার জানার কথা ছিলো না? লুকিয়ে সব হজম করতে চেয়েছিলে?’

‘আমি তো স্যারকে নোট দেখাতে গিয়েছিলাম। আর..’

দীবা কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই আবরার কণ্ঠস্বর দ্বিগুণ করে ধমকে উঠলো, ‘নোট দেখাতে গিয়ে খাবার খাচ্ছিলে তুমি? বোকা পেয়েছো আমাকে?’

মৃদু কেঁপে উঠলো দীবা। ভয়ার্ত চোখে তাকালো আবরারের দিকে। ধমক শুনে কান্না পাচ্ছে ভীষণ। আবরার তাকে সন্দেহ করছে? রাজ শুধু তার টিচার। এর বাহিরে রাজের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র এক সাথে দেখে এভাবে সন্দেহ করলো? ভাবতেই ঠোঁট ভেঙ্গে আসছে তার। চোখ লাল হয়ে গেলো আপনমনে। দীবার এমতাবস্থা দেখে নিভলো আবরার। চোখ বন্ধ করে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো।শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয়ে জিভ বুলিয়ে বললো, ‘স্টপ ক্রায়িং দীবা। কান্না করার মতো কিছু বলি নি আমি।’

কান্না থামালো দীবা। মুখটা কালো করে ফেললো একদম। বিবর্ণ মুখে কাচুমুচু অবস্থায় বুকে দুই হাত গুঁজে অন্য দিকে তাকালো। মনে মনে বিরক্ত হয়ে কয়েকটা জঘন্য গালি শুনিয়ে দিলো আবরারকে। হচ্ছে টা কি ভাই? ধমক দিয়েও বলছে কান্না করার মতো কিছু করে নি। কান্না করবো না তো কি নাচবো?

‘তুমি জানো ওই ছেলের সাথে তোমার বিয়ের কথা হয়েছে। তবুও কিভাবে তুমি ওই লোজার টার সাথে মিশো?’

অবাক চোখেমুখে আবরারের দিকে তাকালো দীবা। কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ফুটিয়ে বলে উঠলো, ‘পাগল আপনি? রোশ আঙ্কেল কখন আমার বিয়ের কথা বললো? এই পর্যন্ত কোনো শ্বশুরকে দেখেছেন ছেলের বউয়ের বিয়ের আলাপ করতে? আজগুবিকথা কই থেকে পান আপনি?’

আবরার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দীবা আবারো বলে উঠলো, ‘আর শেষে কথাটা কি বললেন? স্যারের সাথে মিশতে যাবো কেন? ওনি আমাকে নোট বানাতে বলেছিলেন। ছুটির পর আমি নোট বানিয়ে ওনাকে দেখাতে গিয়েছিলাম কিন্তু তখন স্যার খেতে যাচ্ছিলেন। তাই সাথে আমাকেও..”

দীবার কথা সম্পূর্ণ হতে দেয় নি আবরার। তার আগেই বিদ্রোপ মাখা কন্ঠে তীক্ষ্ণ চোখে বলে উঠলো, ‘বাহ্, এমন টিচার পাওয়া সত্যি বিরল। স্টুডেন্টের ক্রিয়েট করা নোট দেখার জন্য রেস্টুরেন্টে যেতে হয়। কলেজে বুঝি লাইব্রেরি, অফিস ছিলো না? স্টুডেন্টের সাথে পারসোনালি টাইম স্পেন্ড করা কোন পর্যায়ে যায় দীবা?’

আবরারকে শেষের কথাটা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলতে দেখে ভড়কে গেলো দীবা। নিজের ভুলটা ঠিক কোথায় তা অনায়াসে ধরে ফেললো। অপরাধীদের মতো করে তাকালো দীবা। ভুল স্বীকার করে শুধাল, ‘আমি কি জানতাম নাকি এমন কিছু হবে। স্যার বারবার বলেছিলো তাই বারণ করতে পারি নি। আচ্ছা সরি। আর এমন হবে না। প্লিজ রাগ করবেন না।’

দীবার সহজসরল স্বীকারুক্তি দেখে আরেকটু সুযোগ নিলো আবরার। এই উছিলায় কঠোর থ্রে:ট দিয়ে বসলো, ‘ফারদার রাজকে তোমার আশেপাশে দেখেছি কিংবা তোমাকে রাজের সাথে কথা বলতে দেখেছি তাহলে কিন্তু খুব বেশি খারাপ হবে দীবা। আমি ঠিক কি কি করতে পারি সেটা তোমার ধারণার বাহিরে।’

জানার আগ্রহের কারণে সরল মনে প্রশ্ন করে বসলো দীবা, ‘কি করবেন তাহলে?’

মারাক্তক ক্রোধান্তিত হলো আবরার, ‘থা:প্রা:তে থা:প্রা:তে চান্দের দেশে পাঠাবো বে’য়া’দব মেয়ে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করো।’

গভীর অপমানে মুখ কালো করে ফেললো দীবা। অপ্রসন্ন চেহারায় একটা প্লেট টেনে সামনে আনলো। তারপর গালে এক হাত রেখে অপর হাতে কাটা চামচ দিয়ে প্লেটে টুংটাং শব্দ করতে লাগলো।
______________________

নিস্তব্ধ নিশিত। চারপাশ নিঝুম অন্ধকার। অর্ধগোলকাকৃতির চাঁদটা সুবিশাল অম্বরে ভাস্যমান। আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কর্কষ ডাক কানে আসছে। সে দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই রিমির। সে আপনমনে অভ্রের বাম হাতের বাহু জড়িয়ে ধরে সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। প্রায় আধঘণ্টা যাবত চুপচাপ একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেলো অভ্র। কোমড় ব্যাথা হয়ে গেছে অলরেডি। কতোবার বলেছে ভিতরে চলো কিন্তু রিমি তার কথা শুনছেই না। সইতে পারলো না আর। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলেই উঠলো, ‘এবার অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে না রিমি?’

রিমি অভ্রের কথার সঙ্গে সঙ্গে মাথা উপর নিচ দুলালো। অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে বললো, ‘আসলেই অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের বান্ধুবি রা বিয়ে করে বাচ্চা-কাচ্চা স্কুলে ভর্তি করাচ্ছে। আর আমি এতো দিনে একটা জোরপূর্বক বয়ফ্রেন্ড যোগাড় করলাম। জীবন যুদ্ধে কে এগিয়ে গেলো তাহলে? বান্ধুবি নাকি আমি?’

রিমির এমন প্রত্যুত্তর শুনে তাজ্জব বনে গেলো অভ্র। হতভম্ব হয়ে রিমির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। রিমি প্রথমের ন্যায় ভাবলেশহীন ভাবে পা দুটো পানিতে নাড়াচ্ছে। অভ্র নিজের হাত রিমির থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটায় রাগান্বিত হলো রিমি। দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় করে তাকালো অভ্রের দিকে। অভ্র মারাক্তক লেভেলের বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য মেয়ে তুমি। আমি বাড়ির ভিতরে যাবার কথা বলেছি। আমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছো কতোক্ষণ ধরে? আমি তো তোমার মতো এতো আজাইরা ঘুরাঘুরি করি না। আমার অনেক কাজ জমে আছে। তুমি আসলে আসো নাহলে আমি রুমে যাচ্ছি।’

অভ্র উঠে দাঁড়াতে নিলেই রিমি তার হাত ধরে আটকে বললো, ‘আশ্চর্য লোক তো তুমি। গার্লফ্রেন্ডের থেকে কাজ বেশি বড় হয়ে গেছে তোমার?’

অভ্র ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘কে বলেছে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড?’

রিমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বাহিরের এক দমকা হাওয়ার কারণে রিমির উন্মুক্ত চুল গুলো উড়ে মুখের সামনে এসে পরলো। রিমি চুল গুলো মুখ থেকে সরিয়ে কোমড়ে দুই হাত রেখে কটমট করে বললো, ‘অবশ্যই আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড। কেন বিশ্বাস হয় না?’

অভ্র পকেটে দুই হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ালো। তার এমন ভাব দেখে রিমির শরিরে রাগ তিরতির করে বেড়ে গেলো। রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে উঠলো, ‘বউ পাবি না বলে দিলাম।’

গটগট পায়ে রাগে বিড়বিড় করতে করতে অভ্রকে হাজার টা গালি দিতে দিতে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো রিমি। সে যেতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো অভ্র। মেয়েটা বড্ড অবুঝ। একদম ছেলেমানুষি। আর এই বাচ্চা মেয়েটাকেই তার ভালো লাগে।
____________________

রাতের ঘড়ির কাটা প্রায় সাড়ে এগারো টার ঘরে। শান্তি নিবাসের সবাই যার যার রুমে আপন কাজে ব্যস্ত। বোতলে পানি না থাকায় নিচে নামলো রিমি। রান্নাঘরে গিয়ে বোতল ভর্তি পানি নিলো। পরনে ঢিলেঢালা সাদা টিশার্ট। অতিরিক্ত ঢিলে হওয়ায় টিশার্ট টা টেনে কোমড়ের কাছে গিট্টু দিলো একটা। বোতল নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই সদর দরজা খোলার শব্দ কানে আসলো। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো অনেক রাত। এই সময় কে আসলো? পিছু ফিরে তাকাতেই দীবার মনমরা চেহারা নজরে আসলো তার। দীবার পাশে আবরার পকেটে এক হাত গুঁজে নির্বিকার ভাবে মোবাইল টিপে হাঁটছে। ভ্রুঁ জোড়া আপনাআপনি কুঁচকে এলো রিমির। রাইমা আপুর কাছে জানতে পেরেছে আবরার দীবা এক সাথে আছে। তাহলে দুজন একা সময় কাটানোর পরেও দীবার মন খারাপ কেন? হলো টা কি? প্রাণপ্রিয় বান্ধুবির এমতাবস্থা দেখে মনটা আকুপাকু করে উঠলো রিমির। কারণ জানার জন্য দ্রুত পা চালিয়ে দীবার কাছে এসে এক হাতের বাহু ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো, ‘কিরে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?’

প্রত্যুত্তর করলো না দীবা। মনমরা করে দাঁড়িয়ে রইলো। আবরার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে দীবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘ঘুমানোর আগে আমার রুমে এসো।’

চলে গেলো আবরার। রিমি আবারো জানতে চাইলে দীবা রাগে দুঃখে বলে উঠলো, ‘তোর ভাই আস্তো একটা শ’য়’তা’ন।’

রিমি ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে বললো, ‘কেন তোর সাথে আবার কি শ’য়’তা’নি করলো?’

দীবা কাদুকাদু চেহারায় তাকালো রিমির দিকে। রুমে যেতে যেতে এক এক করে সব ঘটনা খুলে বললো। রিমি বেচারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে সব শুনে। হাসবে নাকি কাঁদবে ভেবে সে নিজেও কানফিউজড।
______________________

বিছানার মাঝখানে বসে বিস্কুট খাচ্ছে আর দীবার কাজকারবার দেখছে রিমি। ঠিক কি বলা উচিত কিছুই বুঝে আসছে না তার। তাই নিরব থেকে শুধু কর্ণপাত করছে। তবে নুরাকেও বড্ড মিস করছে রিমি। এই মুহূর্তে নুরা উপস্থিত থাকলে দীবাকে আচ্ছা মতো পচানো যেতো। কিন্তু আফসোস নুরা ঘুমাচ্ছে আর সে এখানে একা। যদি ভুলেও উলটা-পালটা কিছু বলে ফেলে তাকে তাকে কেল্লাফতে করে ফেলবে এই মেয়ে। তাই নিরব থাকা শ্রেয়। দীবার থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনার অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো রিমি, ‘ভাইয়ার রাগ করাটা স্বাভাবিক।’

আলমারি তে টিশার্ট খুঁজছিলো দীবা। রিমির কথা কর্ণপাত হতেই অবাক চোখে পিছু ফিরে তাকালো। এক হাত কোমড়ে রেখে আরেক হাত উঠিয়ে বলে উঠলো, ‘তাই বলে এতো গুলো খাবার আমাকে খাওয়াবে? অন্য ভাবে শাস্তি দিতে পারতো না? আর আমি কি এমন ভুল করেছি শুনি?’

‘তুমি জামাই থাকার পরেও স্যারের সাথে লাঞ্চ করেছো, বিফ স্টিক খেয়েছো এটা ভুল নয় কি?’

দীবা হতাশ হয়ে বললো, ‘আশ্চর্য রিমি। তুইও এভাবে বলছিস?’

রিমি বিস্কুট রেখে বিছানা থেকে নামলো। বোতলের ক্যাপ খুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে দীবার রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে শুধাল, ‘জেলাস জেলাস। আরব ভাই জেলাস বুঝছোস। হ্যাপি থাক এই ভেবে যে ভাই তোকে ভালোবাসে।’

রিমি কে বেড়িয়ে যেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো দীবা, ‘রিমোটের বাচ্চা বিস্কুটের প্যাকেট কে নিয়ে যাবে? ওই ফকিন্নি।’

দীবার ডাকে পাত্তা দিলো না রিমি। গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো দীবার রুম থেকে। বিরক্তিতে ফুঁশ করে একটা নিশ্বাস ছুড়লো দীবা। টিশার্ট হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে বিছানায় তাকাতেই বিস্মিত হয়ে গেলো দীবা। কারণ বিছানার উপর আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছে আবরার। তাকে এখানে বসে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে দীবা প্রশ্ন করে উঠল,’এখানে কি আপনার?’

আবরার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে দীবার দিকে তাকিয়ে আদেশ করলো, ‘লাইট অফ করে বিছানায় আসো। ঘুম পেয়েছে আমার।’

দীবা হাতে থাকা ভিজে টাওয়াল চেয়ারে মেলে দিতে দিতে বললো, ‘ঘুম পেলে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমান। আমার অনেক কাজ আছে। প্রচুর লিখতে হবে।’

আবরার চোয়াল শক্ত করে রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো, ‘তুমি কি আবারো রাজের জন্য নোট করছো?’

দীবা বিরক্ত হলো বেশ। চেহারায় অপ্রসন্নতা ফুটিয়ে বললো, ‘আশ্চর্য ভাই আপনি। আমার নিজের পড়াশোনা নেই নাকি? কাল কলেজে গিয়ে স্যার দের হোমওয়ার্ক কি আপনি দেখাবেন?’

প্রত্যুত্তর করলো না আবরার। বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বসে চুপচাপ দীবাকে দেখতে লাগলো। দীবা চেয়ার টেনে বসে খাতা বের করে লিখা শুরু করলো। মিনিটের কাটা চলতে লাগলো। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। অনেক ঘুম পেলো দীবার। চোখ দুটো ভার হয়ে এসেছে তার। লাল হয়ে আসা চোখ দুটো খোলে রাখার মতো শক্তি পাচ্ছে না। তবুও খাতায় কলম চালাচ্ছে।

বিছানা থেকে নেমে দীবার কাছে আসলো আবরার। পুরোটা সময় চুপচাপ দীবাকে দেখেছে সে। দীবার ঘুমুঘুমু চেহারা দেখে মুচকি হেসেছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি রেখে দীবাকে কোলে তুলে নিলো আবরার। প্রচুর ঘুম পাওয়ার কারণে বাধা দিলো না দীবা। উলটো আবরারের গলা জড়িয়ে ধরলো ঘাড়ের কাছে মুখ এনে চোখ বন্ধ করলো। তার কান্ডে মৃদু হাসলো আবরার। বিছানায় ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে লাইট অফ করে দিলো। নিজেও বিছানায় এসে দীবাকে আগলে ধরে গভীর ঘুমে মশগুল হলো।

চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩৫]

আষাঢ়মাসের চন্দ্রকলার তিথী শেষে মাসের সমাপ্তি ঘটলো। বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী পরবর্তি মাস শ্রাবণের আগমন ঘটলো। ভারি বর্ষণের মাত্রা তিরতির করে বেড়ে গেলো। আবহাওয়া হলো শীতল। বৃষ্টির পানিতে রাস্তাঘাট, গাছগাছালি পরিচ্ছন্ন। শাপলা ফুলের সৌন্দর্যে নদনদী মুখরিত। সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো রোশান ও রাইমার শ্বশুর আফজালের। প্রথমে বিয়ের ডেইট আষাঢ় মাসের শেষে ঠিক করা হলেও ব্যস্ততার কারণে পিছাতে হয়েছে।পারিবারিক বৈঠকের পর চলতি মাসের তেইশ তারিখ ঠিক করা হলো। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে লাগলো সবাই।

যেহেতু বিয়ের ডেইট আসতে আরো দেরি ; সেহেতু এই ফাঁকে ছোটখাটো একটা ট্রুর দেওয়াই যায়। প্ল্যানটা অবশ্য আরিয়ান করেছে। সম্মতি দিয়েছে মেয়েরা। নিশিতা প্রথমে রাজি ছিলো না। বিয়ের আগে মেয়েদের ঘুরাঘুরি করা অনুচিত। আয়েশার মতামতও না এর পক্ষে ছিলো। কিন্তু রিমি, নুরা, দীবা ও বিশেষ করে রাইমার জোরাজোরিতে আয়েশা নিজেও রাজি হলো আর নিশিতাকেও রাজি করালো। সবাইকে রাজি করানোর পর পরলো আরেক বিপাকে। ট্রুরে যাবে বলে লাফিয়েছে ঠিকই কিন্তু যাবে কোথায়? এই নিয়ে চিন্তিত সবাই। সন্ধ্যা হতেই গুলপট্টি বাধাচ্ছে একত্রে।

‘মানে কি রে ভাই? এতো বড় একটা দেশে ঘুরতে যাবার মতো কোনো প্লেস নাই? এইডা কোনো কথা?’ হতাশ হয়ে বলে উঠলো আরিয়ান।

নুরা সোফায় হেলান দিয়ে চিপসে কামড় দিয়ে বললো, ‘সাজেক ছাড়া আপাতত কোথাও যাওয়ার জায়গা দেখছি না।’

নুরার পাশেই রিমি বসে ছিলো। তাই সে অনায়াসে নুরার গায়ে একটা চাপড় বসিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘বর্ষাকালে সাজেক গিয়ে হাত পা ভাঙ্গার ইচ্ছা আছে নাকি?’

নুরা বিরক্তিকর চোখেমুখে রিমির দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো, ‘আব্বে বাল আমি যেতে বলেছি নাকি?’

আবরার নিরবে হেসে ফেললো দুই বোনের কাহিনী দেখে। চোখ ঘুরিয়ে দীবার দিকে তাকাতেই দেখলো দীবা দুই গালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। ভাব এমন যেন অত্যন্ত চিন্তিত মেয়েটি। কোথায় যাবে এই নিয়ে মহা বিপাকে। আচ্ছা দীবার পছন্দের কোনো প্লেস আছে? বা দীবার কেমন পরিবেশ ভালো লাগে? জানার আগ্রহ জাগলো আবরারের মনে। কিছু বলার জন্য উদ্যোগ নিতেই রাইমা বলে উঠলো, ‘আসো চা বাগানে যাই। ওখানে গিয়ে হরেক রকমের চা খাই। উফফফ!’

আরিয়ান তার কথার ব্যাঙ্গ্য করে উঠলো, ‘এহেহে তুই নিজে কঙ্কাল তাই আমাদেরও কঙ্কাল বানানোর পায়তারা করছিস? খালি কেমিক্যাল ওয়ালা পানি খাওয়ার লাগি কোন বেক্কলে এতো দূরে যায়?’

রাইমা কাটকাট ভাবে উত্তর দিল, ‘তুমি নিজেই বেক্কল তাই যাও না। চায়ের প্রেম তোমার মতো গর্দভ রা বুঝবে না। তাই আমি আর তর্কে জড়াচ্ছি না।’

আরিয়ান ত্যাঁছড়া ভাবে হেসে রাইমার দিকে হাত তুলে বলে উঠলো, ‘হেহে বেডি মানুষ। লজিক নাই তবুও হার মানবো না। তুই তর্ক করবি কেমনে তোর কাছে কোনো যুক্তি আছে? নাই। বস দের সাথে তর্ক করতেও কিছু যোগ্যতা রাখা লাগে। যা বেডি মানুষের নাই।’

শেষের কথাটা শার্টের কলার ঠিক করে ভাব নিয়ে বললো আরিয়ান। রাইমা পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘বেডা মানুষদের সাথে কথা বলায় বেকার।’

রাইমার কথার সম্মতি দিয়ে খুশি খুশি মনে দীবা বলে উঠলো, ‘আপু চা বাগানই পারফেক্ট হবে। চারপাশে শুধু সবুজ গাছ আর গাছ। সন্ধ্যা বেলায় খোলা আকাশের নিচে বসে বারবিকিউ পার্টি। ভালো হবে না?’

দীবা সম্মতি দেওয়ায় এতোক্ষণে মুখ খুললো আবরার, ‘তাহলে এটাই ফাইনাল। এখন কোন চা বাগানে যাবি সেটা ডিসাইড কর।’

‘তোমারা তোমাদের খালামনিদের বাড়ি যাচ্ছো না কেন?’

আয়েশার কথা কর্ণপাত হতেই চকচকিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালো সবাই। সবার এমন রিয়েকশন দেখে আয়েশা স্মিতি হাসলো। শাড়ির আঁচল টেনে সিঁড়ি থেকে নেমে সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাইমা চিন্তান্বিত হয়ে বললো, ‘কিন্তু আম্মু খালামনিরা তো ইউকে থাকে। খালি বাড়িতে গিয়ে কি করবো?’

তখুনি খুশিতে লাফিয়ে উঠলো আরিয়ান। হঠাৎ-ই তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে নুরা রিমি ভড়কে গেলো। দীবার হাতে পপকর্ন ছিলো ভড়কে গিয়ে কিছু পপকর্ন নিচে পরে গেছে। রাইমা বুকে হাত দিয়ে বললো, ‘হয়েছে টা কি? ব্যঙের মতো এভাবে লাফাইতাছো কেন?’

আরিয়ান রাইমার কথার তোয়াক্কা করলো না। আয়েশার দিকে তাকিয়ে দুই হাত ঠোঁটে কাছে এনে ফ্লাইং কিস দিয়ে বলে উঠলো, ‘উফফ ছোট আম্মু ইউ আর গ্রেট! অলওয়েজ তুমি পারফেক্ট আইডিয়া দাও।’

নুরা ভ্রুঁ কুঁচকে জানতে চাইলো, ‘কিভাবে পারফেক্ট হলো?’

‘খালামনিরা দেশে না থাকায় পুরো বাড়ি খালি। আর বাড়ির পাশে বিশাল চা বাগানে কর্মচারী বাদে কোনো পর্যটক এলাউ না। তারমানে বাড়িসহ বিশাল চা বাগান একদম জনমানবশূন্য। শুধু মাত্র আমরা থাকবো। নিরিবিলি পরিবেশ। পারফেক্ট হবে না?’

আরিয়ানের কথার সঙ্গে সঙ্গে দীবাও তাল মিলিয়ে বলে উঠলো, ‘আর রাতে আকাশের নিচে বারবিকিউ পার্টি হবে। সবাই আনন্দ করবো। ট্রুথ, ডেয়ার, গানের কলি খেলবো। কতো সুন্দর হবে।’

অভ্র তাদের সমর্থন করলো, ‘রাইমার চয়েজ আর দীবার প্ল্যান দুটোই পারফেক্ট। আমারো পছন্দ হয়েছে।’

সাবিতও তার সম্মতি জানালো, ‘আমারো পছন্দ হয়েছে।’

নুরাও চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ইয়ে আমারো হয়েছে।’

সবার মতামত নেওয়ার পর আবরার খালামনির বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্তই ফাইনাল করলো। আয়েশা জানালো সে তার বোনকে জানিয়ে সব ব্যবস্থা করে রাখবে। তখুনি সেখানে উপস্থিত হলো নিশিতা। নিচে এসে সবার পরিকল্পনা শুনলো। নিজেও কিছু টিপস দিলো কিভাবে ফূর্তি করবে। কথার ফাঁকে আবরারকে এটাও বললো, ‘রাজিব আর রাজকেও সঙ্গে নিতে পারো।’

রাজের নামটা শুনতেই বিরক্ত হলো আবরার। অপ্রসন্ন চোখেমুখে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠলো, ‘ওরা আমাদের সাথে যাবে কেন?’

নিশিতা অসন্তুষ্ট হয়ে বললো, ‘মানে কি আবরার? ওরা কিছুদিন পর আমাদের আত্মীয় হবে। সাথে নিয়ে যেতে সমস্যা কোথায়? মিলেমিশে ঘুরতে যাবে এক সাথে। ভালো দেখাবে না? তুমি ওদের কল দিয়ে তোমাদের সাথে জয়েন করতে বলো।’

আবরার প্রথমের মতোই পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসে থেকে ভাবলেশহীন ভাবে প্রত্যুত্তর করলো, ‘পারিবারিক কাজে সাবিত আছে। তাকে দিয়েই বলাও। আমাকে এইসবে টানবে না।’

ছেলের উত্তর শুনে হতাশার নিশ্বাস ফেললো নিশিতা। পুরনো দণ্ড এখনো মিটে নি। সেই কবেকার একটা ঘটনা কেন্দ্র করে ছেলেটা পরিবার থেকে মুখ ফিরিয়েছে। মনে মনে নিজের স্বামীকেই দোষারোপ করতে লাগলো নিশিতা। কি এমন ক্ষতি হতো যদি তখন আবরারের কথা মেনে নিতো? আবরারের উপর জবরদস্তি না করতো? রোশানের উপর ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ করলো না। সাবিতকে বললো, ‘তুই ইনভাইট করবি তো? নাকি তোরও সমস্যা হবে?’

সাবিত হতভম্ব হয়ে বলে উঠলো, ‘এইসব কি বলছো বড় আম্মু? আমার সমস্যা হবে কেন? নিশ্চিন্তে থাকো একদম। ঘরে বাইরে সব কাজে সাবিত হাজির।’

মুচকি হাসলো নিশিতা আর আয়েশা। সাবিত পকেট থেকে মোবাইল বের করে রাজিবের নাম্বারে ডায়াল করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। সবাই অধিক আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে কি মতামত আসে জানার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কথা বললো সাবিত। তারপর এসে জানালো রাজিব যেতে রাজি হয়েছে। কিন্তু রাজ যাবে কিনা সে ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত না রাজিব। রাতে জানাবে বলে দিয়েছে।

অতঃপর নিশিতা ও আয়েশা সবাইকে তাগিদ দিলো যে যার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। খুশিতে লাফিয়ে উঠলো মেয়েরা। প্রস্তুতি নিতে লাগলো সবাই। কি নিবে, কি পরবে, কি কি করবে সব পরিকল্পনা করে ফেলেছে। এবার শুধু সকাল হবার পালা।
_____________________

শ্রাবণের চলতি সময়। সুবিশাল আকাশটা আজ অদ্ভুত ভাবেই স্বচ্ছ। কোথায় ঘন কালো মেঘের আনাগোনা নেই। বাড়ির পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের বেশিরভাগ ফুল গতকাল রাতের ভারি বর্ষণের কারণে অকালে ঝরে পরেছে। তাদের এই বেহাল অবস্থা দেখে বড্ড মায়া হলো দীবার। ঠোঁট উলটে আকাশের দিকে তাকালো। সুবিশাল আকাশটা পর্যবেক্ষণ করার পর দীবার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে যে আজ বৃষ্টি হবে না। মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ছুড়লো দীবা। ভাগ্যিস আজই আকাশ পরিষ্কার। যদি বৃষ্টি হতো এখন তাহলে ঘুরতে যাওয়া ক্যান্সেল করে দিতো। আকাশ স্বচ্ছ, আবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের খবর অনুযায়ী আজ বৃষ্টি হওয়ার আশংকা নেই। শতভাগ নিশ্চিত হয়েই নিশিতা আয়েশা সবাইকে ছাড়লো। এইসব ভেবেই গাড়ির দরজা খুললো দীবা। তখুনি পিছনে এসে দাঁড়ালো আবরার। দীবা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠলো, ‘তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে দীবা।’

আবরারের থেকে হুট করে এমন প্রশংসা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো দীবা। অবাক চোখে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো পরনে তার লাল রঙের লং কুর্তি। হাতে লাল রঙের চুড়ি। এইটুকুতেই সুন্দর লাগছে? কিছুটা লজ্জাভূতি হলো দীবা। গাল লাল হয়ে এলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে লজ্জা নিভানোর চেষ্টা করলো। গাড়ির ভিতরে রিমি নুরা বসেছিল। আবরারের কথা শুনে জানালা দিয়ে মুখ বাহিরে এনে দুইজন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রুঁ জোড়া নাচালো। রিমি দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো, ‘বাহ্ শুধু বউকে কমপ্লিমেন্ট দিলেই হবে? আমাদেরও দাও। আমরাও সুন্দর করে সেজেছি।’

আবরার এক গাল হেসে উঠলো রিমির কথা শুনে। হাসির শব্দ থামিয়ে কূটস্থ করে বলে ফেলল, ‘এই জন্যই বউয়ের প্রশংসা করেছি। তোরা মুখে আটা-ময়দা মেখে সেজেছিস। আর বউ কে দেখ? একদম নেচারাল সুন্দরী।’

লজ্জা কাটিয়ে আহাম্মক হয়ে গেলো দীবা। ফ্যালফ্যাল চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আবরারের মুখের দিকে। নুরা, রিমি উচ্চস্বরে হাসিতে মেতে উঠলো। দুইজন কে এভাবে হাসতে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো আবরার। নুরা হাসতে হাসতে দাঁত মুখ খিঁচে বলল, ‘তোমার বউ নেচারাল সুন্দরী? আজকে কয় ঘন্টা সময় নিয়ে সেজেছে জানো ভাই?’

দীবা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে নুরার দিকে কটমট চোখে তাকালো। মনে মনে শ’খানেক গালিয়ে শুনাতে লাগলো দুজনকে। আবরার এক হাতে মাথা চুলকে ভাবুক কন্ঠে বলল, ‘ওহহ দীবাও মেকআপ করেছে?’

রিমি বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। পাক্কা দুই ঘন্টা সময় লাগিয়েছে।’

দীবা কপাট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘মিথ্যে বলবি না একদম।’

আবরার ক্ষান্ত হলো না। বরঞ্চ দীবার প্রশংসা অটুট রাখতে বলে উঠলো, ‘সাজলে সাজুক। তোদের সমস্যা কি? মেয়ে মানুষ মানেই সাজবে। আমার বউ সেজেছে। আগের মতোই সুন্দর লাগছে। একদম কিউটের ডিব্বা লাগছে।’

কথাটা বলার মাঝেই কল আসলো আবরারের। তাই সে কথার সমাপ্তি এখানেই ঘটালো। কল রিসিভ করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। দীবা চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসতেই নুরা তার গাল টেনে বলে উঠলো, ‘আসলেই কিউটের ডিব্বা লাগছে।’

রিমি অপর গাল টেনে বললো, ‘উহুম, কিউটের পাতিল।’

দুইজন দুই গাল টেনে বেহাল অবস্থা বানিয়ে ফেলায় চেঁচিয়ে উঠলো দীবা। নিজের গালে হাত বুলাতে বুলাতে রাগে কিড়মিড় করে বলল, ‘অ*সভ্যের দল। আমার গাল কি তোদের সরকারি সম্পত্তি লাগে? হুদাই ধরে টানাটানি করিস কেন? ব্যা:থা লাগে না। বিলাইয়ের দল।’

তখুনি সেখানে উপস্থিত হলো রাইমা। গাড়িতে উঠতে উঠতে কড়া থ্রে’ট দিয়ে বসলো, ‘তোরা তিনটা আবার ঝ’গ’ড়া করলে রাস্তার মাঝেই নামিয়ে দিবো বলে দিলাম।’

রিমি ভাব নিয়ে বললো, ‘আমরা তো বাড়ি চিনি। ঠিকই রাস্তা চিনে চলে আসতে পারবো।’

এক এক করে উপস্থিত হলো সবাই। ডার্ক ফরেস্ট অর্থাৎ গাঢ় সবুজ রঙের বড় একটা জিপ গাড়িতে উঠে বসলো সকলে। আবরার বসলো ড্রাইভিং সিটে। তার পাশেই সাবিত। পিছনের সিটের তিনটে সাড়ি। প্রথম সাড়িতে রাইমা, দীবা ও নুরা। মাঝের সাড়িটা রাজিব ও রাজের জন্য ফাঁকা রেখে শেষের সাড়িতে বসলো আরিয়ান, অভ্র ও রিমি। পিছনে অবশ্য রাইমা বসতে চেয়েছিলো কিন্তু রিমি নিজে থেকে জোরপূর্বক বসেছে। অন্য সবাই কারণটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও অভ্রের বুঝতে বাকি নেই আসল কারণ ঠিক কি।

সবাই ঠিকঠাক ভাবে বসার পরেই আবরার গাড়ি স্টার্ট দিলো। সু-সু শব্দ তুলে চলতে লাগলো গাড়ি আগ্রাবাদের ইয়া বড় পিচ ঢালা রোডের উপর দিয়ে। বৃষ্টি শেষ রাতে হলেও সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। তাই পরিবেশটা আজ মনোরম। রিমি জানালার বাহিরে তাকিয়ে উপভোগ করছে। মনটা বেশ ফুরফুরে। আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে পাশে তাকালো রিমি। আরিয়ান কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। আর দুজনের মাঝে বসে থাকা অভ্র আপন মনে মোবাইল চালাচ্ছে। রিমি আপনমনে অভ্রকে দেখলো কিছুক্ষণ। আনমনে মুচকি হেসে অভ্রের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। হঠাৎ রিমি কাধে মাথায় রাখায় হকচকিয়ে গেলো অভ্র। চটজলদি রিমির মাথা কাধ থেকে সরিয়ে দিয়ে চমক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। না! কেউ দেখে নি। অভ্র কণ্ঠস্বর নিচু করে ফিশফিশ করে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি রিমি? কাধে মাথা রাখলে কেন?’

চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here