#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪১]
নিস্তব্ধ রাত! চারপাশ একদম ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন। দূর আকাশে অর্ধ গোলাকার চাঁদটার আলোতে ধরনী আলোকিত। ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কর্কষ কণ্ঠস্বর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের কারণে কান অব্দি পৌছাচ্ছে না। তবুও যেন চিন্তা মাথা থেকে নামছে না। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো দীবা। রাত প্রায় পৌনে দুইটা। কিন্তু রুম ফাঁকা কেন? রুমের আনাচে কানাচে, ওয়াশরুম অব্দি খোঁজ চালালো দীবা। কিন্তু কোথাও আবরারকে দেখতে পেলো না। এমনিতেই নুরার এমন কান্ড, তার উপর আবার এতো রাতে আবরার গায়েব। সব মিলিয়ে মারাত্মক দুশ্চিন্তায় দীবা। মোবাইলটাও রুমে ফেলে এসেছে। নাহলে কল দিয়ে জেনে নিতে পারতো। কিন্তু গেলো কোথায় লোকটা?ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো দীবা। ঘড়ি ধরে সর্বোচ্চ দশ মিনিট অপেক্ষার পর আবরারের আগমন ঘটলো। দুশ্চিন্তা শেষে খুশি হওয়ার কথা ছিলো দীবার। কিন্তু তার বদলে আবরারের অবস্থা দেখে বিস্মিত হলো। বৃষ্টিতে ভিজে একদম চুপসে গেছে সে। চুল দিয়ে টুপটাপ পানির ফোটা পরছে। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। দীবার মনে পরলো সেই দিনের রাতের কথা। যেদিন আবরার প্রথম তার রুমে এসেছিলো। তাও আবার বৃষ্টিতে ভিজে। জ্বর আসলো নাকি লোকটার? কথাটা মাথায় আসতেই অস্থির হয়ে গেলো দীবা। দ্রুত পায়ে আবরারের দিকে এগিয়ে এসে কপাল ছুঁয়ে দিয়ে বললো, ‘আবার বৃষ্টি ভিজেছেন কেন আপনি?’
আড়ষ্ট চোখে দীবার দিকে তাকালো আবরার। চেহারা তার একদম মলিন। প্রত্যুত্তর করলো না একদম। দীবা আবরারের মলিন মুখশ্রীর দিকে ধ্যান দিলো না আপাতত। জলদি ব্যাগ থেকে আবরারের টিশার্ট প্যান্ট বের করলো। ওয়াশরুমের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো দ্রুত চেঞ্জ করে নিতে। আবরার বাধ্য ছেলের মতো তাই করলো। কাপড় বদলে রুমে আসলে দীবা তাকে বিছানায় বসালো। তারপর আবরারের সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন সহকারে ভিজা চুল গুলো টাওয়াল দিয়ে মুছতে লাগলো। বৃষ্টি ভেজার অপরাধে রেগে শাসন করতে লাগলো, ‘আপনি কি বাচ্চা? বৃষ্টি ভিজতে গেলেন কেন? এখন যদি জ্বর আসে কি করবেন? আশেপাশে হাসপাতাল আছে কিনা তাও জানি না। ঘুরতে এসে হুট করে জ্বর বাধালে…’
দীবার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবরার দীবার কোমড়ে দুই হাত রেখে দীবাকে জড়িয়ে ধরলো। আবরারের ভেজা চুল গুলোর কারণে দীবার পেটের কাপড়ের অংশ বিশেষ ভিজে চুপসে গেছে। আবরার দীবাকে জড়িয়ে ধরেই বললো, ‘আমি তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসি দীবা।”
আলতো ভাবে হাসলো দীবা। নিজের থেকে আবরারকে সরাতে সরাতে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। এবার সোজা হয়ে বসুন চুল গুলো মুছি।’
কথাটা মজা করে বলেছিলো দীবা। কিন্তু আবরার ভাবলো হয়তো দীবা রাজের মতোই তার ভালোবাসাকে মোহ ভাবছে। তাই দীবাকে ছেড়ে চটজলদি উঠে দাঁড়ালো। অস্থির হয়ে দীবার দুই হাত ধরে বলে উঠলো, ‘বিশ্বাস করো দীবা। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি। আমি তোমার সৌন্দর্যের প্রেমে পরিনি। জানি বিয়ের দিন রাতে আমি তোমাকে ফেলে গিয়েছিলাম। তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। সেদিন আমি ভুল ছিলাম। আব্বুর উপর রেগে ছিলাম তাই মেনে নিতে পারি নি। তোমাকে প্রথম দেখায় ভালো লাগলেও এখন সত্যি মন থেকেই ভালোবাসি। তোমার এই সৌন্দর্য না থাকলেও আমি তোমাকে ভালোবাসবো সারাজীবন!’
আবরারের মাঝে এমন অস্থিরতা দেখে হতবাক হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝে আসলো না তার। মনে হলো আজকের রাতটাই কেবল বিস্মৃত হওয়ার রাত। প্রথমে নুরার ব্যবহার, তারপর আবরারের এমন অদ্ভুত আচরণ। তাই হতভম্ব হয়ে চুপচাপ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো। দীবাকে নিশ্চুপ দেখে আবরার আরো ভেঙ্গে পরলো। দীবার গালে হাত রেখে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘বিশ্বাস করছো না আমার কথা? তোমরা এমন কেন বলো তো? মানছি সেদিন আব্বুর সাথে রেগে ছিলাম তাই তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছি। ফিরে এসেছি তো। সব মেনে নিয়েছি। সরি বলছি। আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না। ভালোবাসি তোমাকে বিশ্বাস করো। আমার ভালোবাসা তোমার সৌন্দর্যের কারণে না। আমি তোমার সৌন্দর্যের প্রেমে পরিনি। বিশ্বাস করো দীবা। কি করলে বিশ্বাস করবে? টিএনেজারের মতো হাত কাটবো?”
আবরারের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। এই বুঝি চোখের কোটড় থেকে জলের বিন্দু কণা গাল বেয়ে পরবে। তার এমন অস্বাভাবিক আচরনের কারণে ভয় পেয়ে গেলো দীবা। অস্থির হয়ে আবরারের কপাল, গাল ও গলা ছুঁয়ে দিতে দিতে বললো, ‘জ্বর উঠেছে আপনার? কিসব আবুলতাবুল বলছেন। কি হয়েছে?’
দীবার কথার গুরুত্ব না দিয়ে আবরার নিজের মতো আবারো বলে উঠলো, ‘বলো বিশ্বাস করো না আমাকে?’
‘হ্যাঁ! বিশ্বাস করি আপনাকে। অনেক বেশি বিশ্বাস করি। আমি জানি আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন।’
আবরার দীবাকে ঝাপটে ধরলো। বাচ্চাদের মতো এমন আচরনে দীবা বিস্মিত। আবরারকে শান্ত করার উপায় খুঁজলো। ঘড়িতে তো অনেক রাত। ঘুমালে হয়তো শান্ত হবে। তাই আর বিলম্ব করলো না দীবা। আবরারকে বিছানায় নিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পরলো। আবরার দীবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। প্রথমের মতো আবারো বিলাপ করতে লাগলো, ‘আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি দীবা। আমি তোমার মোহে পরিনি।’
দীবা আবরারের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্ত করতে বললো, ‘আমি জানি তো। অস্থির হচ্ছেন কেন? বাচ্চাদের মতো কান্না করা থামিয়ে এবার ঘুমান।’
‘তুমি আমাকে ভালোবাসো না?’
‘হ্যাঁ ভালোবাসি তো। অনেক বেশি ভালোবাসি।’
বলেই আবরারের কপালে গভীর একটা চুমু খেলো দীবা। অশান্ত আবরারের মন এবার শান্ত হলো। হৃদয়ে প্রশান্তির ছোঁয়া লাগতেই শান্তিতে চোখ বন্ধ করলো। দীবাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরেই ঘুমের দেশে পারি জমালো। ফুঁশ করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। হঠাৎ দুই ভাই বোনের কি হয়েছে? কিছু না করেও নুরার থা’প্প’ড় খেতে হয়েছে তার। তাকে থা’প্প’ড় দেওয়ার পরেও নুরা নিজে কাদঁলো। আচ্ছা নুরা কি হারিয়েছে? রিমি তো শুধু তার ব্রেসলেট নিয়েছে তারই জন্মদিনে গিফট দিবে ভেবে। এছাড়া কোনো কিছুই তিনজনের অজানা নয়। তাহলে? নুরা কি কিছু লুকাচ্ছে তাদের থেকে? লুকিয়ে থাকলে সেটা কি? অতিরিক্ত চিন্তা করতে করতে নিজেও ঘুমিয়ে গেলো দীবা।
জাগ্রত রইলো নুরা। কান্না তার বাধা মানছে না। ফ্লোরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে কাঁদছে। রাজের মুখ থেকে এমন কিছু শুনতে পারবে তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। প্রথমে ক্রাশ ক্রাশ বলে চেঁচালেও কখন যে ক্রাশটাই সিরিয়াস হয়ে গেছে সেটা তার নিজেরও অজানা। রাজকে নিয়ে মনে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। অনুভূতির সুপ্ত কোণে ভালোবাসার জায়গা দিয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে এমন হলো কেন? দীবাকে এতো আগে থেকে ভালোবাসে স্যার? কিন্তু দীবা তো বিবাহিত। তার ভাইয়ের বউ। আর দীবাকে সে তার নিজের বোনের মতোই মনে করে। তখন রাগের বশে কেন দীবাকে থাপ্পড় দিল সে? রাজ যদি দীবাকে ভালোবাসে তাহলে তো দীবার কোনো দোষ নেই। নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো নুরা। চুল খামচে ধরে কাঁদতে লাগলো আবারো। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে গেছে। ফরশা মুখও রক্তিম। বারবার নাক টানছে। এতো কষ্ট কি শুধু তার জন্যই লিখা ছিল? কি এমন হতো যদি রাজ কাউ কে না ভালোবাসতো। তাহলে হয়তো নুরা রাজকে নিজের করতে পারতো না। কিন্তু এখন? আর ভাবতে পারলো না রিমি। মাথা ব্যাথা দ্বিগুণ হয়ে গেলো তার। চোখ দুটো ঝাপসা। চোখের পানি মুছে ওয়াশরুম থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে আসলো। টাওয়ার দিয়ে মুখ মুছার সময় আবরারকে বলা রাজের প্রতিটা কথা পূর্ণরায় মনে পরলো। সকচকিত হলো তার মস্তিষ্ক। রাজ কি বললো তখন? দীবা বিবাহিত হওয়ার পরেও দীবাকে ছাড়বে না? কিন্তু এমন তো হতে দেওয়া যাবে না। দীবাকে আরব ভাই ভালোবাসে। দীবাও তাই। মাঝ খানে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে স্যারকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু কিভাবে কি করবে সে? আকাশ সমান চিন্তা মাথায় ঢুকলো তার। চিন্তিত হলো আরব আর দীবাকে নিয়ে। কিভাবে দুইজনের সম্পর্কের মাঝে থেকে রাজ কে সরানো যাবে।
___________________
ভোরের আলো ফুটেছে কেবল। চারপাশ আলোকিত হলেও কোয়াশার কারণে আচ্ছন্ন। হালকা শীত শীত আমেজ চারপাশে। সাদা টপ শার্ট আর জিন্স পরনে তাই শীতের ঠান্ডা ভাবটা শরিরে খুব সহজেই লাগলো। সারারাত ভালো ঘুম হয়নি তার। তাই মাথা ঝিমঝিম করছে। ভোর হতে না হতেই রাইমার রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমের সামনে এসেছিলো। দরজার ফাঁকা অংশ দিয়ে দেখেছে নুরা ঘুমিয়ে আছে তাই ডাক দেয়নি। দীবাও আরব ভাইয়ের রুমে। তাই কাউকে বিরক্ত না করে নিজেই একা চা বাগানে ঘুরতে এসেছে রিমি। মাথায় নুরাকে নিয়ে আকাশ সমান চিন্তা। মন ভালো করার জন্য-ই এখানে আসা। চারপাশে চা পাতার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগুচ্ছে। তখুনি চা গাছের পাশে একটা ইয়েলো কালার বেলুন নজরে আসলো তার। বেলুনটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ছোট একটা তির চিহ্ন দেওয়া। অর্থাৎ তাকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে। রিমি এমনিতেও কৌতুহল প্রেমী। তাই মনে আগ্রহ জন্মালো। এখানে বেলূণোটা রাখলো কে? বেলুনের সূত্র ধরে সামনে এগুলে আরো একটা বেলুন পেলো। যার মাঝে একটা চিরকুট আটকানো। রিমি চিরকুট টা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো ইংলিশে বড় হাতের অক্ষরে লিখা,
‘AREKTO SAMNE ASO PLEASE.’
ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রিমি। সন্দেহ হলো কিছুটা। চিরকুট অনুযায়ী সামনের দিকে আগাতেই বিস্মিত হয়ে গেলো রিমি। অবাক চোখে সামনে তাকিয়ে রইলো। চা বাগানের মাঝে ছোট ছোট গাছে বেশ কিছু বড় বেলুন টাঙ্গানো। সেখানে প্রত্যেক টা বেলুনের মাঝে বড় হাতের অক্ষরে লিখা ‘SORRY MY LOVE.’
হেসে ফেললো রিমি। কাজটা যে অভ্রের তা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি। বেলুন গুলোর মাঝে একটা হলুদ গোলাপ ফুল আছে। মিলি তড়িঘড়ি করে গোলাপটা হাতে নিয়ে নিলো। ঠোঁটে তার এখনো প্রাণবন্ত হাসি ঝুলানো। ফুলটা হাতে নিয়ে খুশি মনে দেখতে লাগলো। তখুনি পিছন থেকে কারোর অস্তিত্ব টের পিয়ে ফিরে তাকালো। অভ্রকে দেখে মুখের হাসি আরো চৌড়া হলো তার। অভ্র গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে দুই হাত গুঁজে বললো, ‘এর বেশি কিছু করা সম্ভব না এখানে। অনেক কষ্টে এই কয়টা বেলুন আর হলুদ গোলাপ জোগাড় করেছি। খুশি হয়েছো তো?”
খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো রিমি, ‘প্রচুর!’
কথাটা বলেই এক দৌড়ে অভ্রের কাছে এসে অভ্রকে জড়িয়ে ধরলো রিমি। মহারানীর রাগ ভাঙ্গাতে পেরে শান্তি পেলো অভ্রের মন। নিজেও মৃদু হেসে উঠলো। রিমি অভ্রকে ছেড়ে ফুলটা দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমার হলুদ গোলাপ অনেক পছন্দ।’
অভ্র রিমির কোমড়ে দুই হাত রেখে তার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বললো, ‘আর আমার তোমাকে।’
মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করলো রিমি। অভ্র রিমির এক গালে হাত রেখে বললো, ‘ আই লাভ ইউ রিমি।’
রিমি চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিলো, ‘আই লাভ ইউ টু।’
______________________
পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো দীবার। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই আবরারের মায়াবী মুখখানি ভেসে উঠলো সামনে। স্মিতি হাসলো দীবা। এগিয়ে আবরারের কপালে আলতোভাবে চুমু খেলো। খুব সাবধানতার সাথে নিজের থেকে আবরারকে সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। ধীর পায়ের কদম ফেলে নিঃশব্দে দরজা খুলে রুমের বাহিরে চলে আসলো। সারারাত ঘুমায় নি লোকটা। এখন একটু শান্তিতে ঘুমাক। এই ফাঁকে নুরার অবস্থা দেখে আসা যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে নুরার রুমের সামনে আসলো। দরজা খুলা দেখে ভিতরে ঢুকলো চুপিচুপি। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখলো নুরা নেই। এতো সকালে গেল কোথায় মেয়েটা? তখুনি বারান্দা থেকে নুরার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,
‘আমি এখানে।’
দীবা শব্দহীন পায়ে বারান্দায় গিয়ে নুরার পাশে দাঁড়ালো। নুরা নিশ্চুপ। গায়ে পাতলা শাল পেঁচিয়ে দূর দূরান্তরের পাহাড়ী গাছগাছালি দেখছে এক মনে। বিপরীতে দীবা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে এমন কি অপরাধ করে যে তার উপর নুরা এভাবে রাগতে পারে? কিছুই বুঝে আসলো না দীবার। ফুঁশ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো দীবা। সামনের দিকে তাকিয়ে আলতোভাবে শুধাল, ‘জানিস ছোট থেকেই আমার একটা ভাই বোনের শখ ছিলো। কিন্তু আম্মুর সমস্যার কারণে ডক্টর বলেছে আমার আর ভাইবোন হবে না। মন খারাপ হতো অনেক। আব্বুর সাথে যখন রাউজান ছেড়ে আগ্রাবাদ এসে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন তোর আর রিমির সাথে পরিচয় হয়েছিলো। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তোরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলি আমার। মন থেকে তোদের দুইজন শ’য়’তা’ন কে ভালোবাসি।’
শ’য়’তা’ন বলায় অন্যদিকে তাকিয়ে শব্দ না করে হেসে ফেললো নুরা। আর দীবা নিজের মতোই আপনমনে বলতে লাগলো, ‘তোদের দুইজনের কাছে কখনো কিছু লুকাই নি। যা পেটে ছিলো সব বলে দিয়েছি। আজও বলছি। বিশ্বাস কর বোইন তোর কিছু আমি চুরি করি নাই। এখানে ঘুরতে আসার আগে রিমি তোর প্রিয় ব্রেসলেট চুরি করছে তোরই বার্থডে তে গিফট দিবে বলে। আমি না করেছিলাম। তবুও আমার কথা শুনেনি। মাঝ খান থেকে ফাউ তালে আমি নির্দোষ মাসুম মাইয়া চ/ড় খাইলাম।’
শেষের কথাগুলো কাদুকাদু গলায় বললো দীবা। নুরা হাসি থামাতে পারলো না। মৃদু হেসে দীবার দিকে ফিরে দাঁড়ালো। এক হাত বাড়িয়ে আহ্লাদী গলায় বললো, ‘আহারে, কোন গালে যেন মে’রে’ছিলাম?”
দীবা তার বাম গালটা দেখিয়ে দিলো। নুরা এগিয়ে গালে আলতোভাবে হাত বুলিতে তিনটা চুমু দিয়ে দিলো। আবারো হাত বুলিয়ে বললো, ‘আদর দিয়ে দিলাম। সরি আর হবে না।’
নুরার রাগ ভেঙ্গেছে দেখে দীবা খুশি হলো। খুশিতে তার চোখে পানি জমে গেছে। সে নুরাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুই অনেক ভালো নুরা।’
স্মিতি হাসলো নুরা। দীবাকে নিজেও জড়িয়ে ধরে আনমনে শুধাল, ‘তুই নিজেও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেক লাকি।’
চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪২]
গভীর ঘুমে বিভোর থাকা নেত্রপল্লব পিটপিট করে খুললো আবরার। চোখের দৃষ্টি তার ঝাপসা। মাথাটা তীব্র ব্যাথায় ঝিমঝিম করছে। ঘড়িতে সময় কয়টা তার জানা নেই। রুমের পর্দা খোলা। পুরো রুম আলোকিত। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই দীবাকে পাশে দেখতে পেলো সে। পলকহীন চোখে একমনে দেখতে লাগলো আবরার। দীবার উন্মুক্ত চুল গুলো বাহিরের বাতাসে উড়ছে। স্নিগ্ধ মুখখানি তে এক চিলতে হাসি ফুটে আছে। অনেক পুরাতন একটা বই হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। তার এই মুচকি হাসিতে মুগ্ধ হলো আবরার। নিজেও মৃদু হাসলো। বিছানায় শুয়ে থেকেই দীবাকে অবলোকন করতে লাগলো আবরার।
নুরার সঙ্গে ভোরের সময়টা কাটানোর পর খুবই একা একা লাগছিলো দীবার। রাইমার রুমের দরজা ভিড়ানো ছিলো। ভেবেছিল রিমি ও রাইমা বুঝি ঘুমিয়ে আছে। তাই তাদের বিরক্ত করেনি। আবরারের রুমে এসে দেখলো আবরারও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হতাশ হলো দীবা। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে পুরো রুমের আসবাবপত্র ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। তারপর একটা তক্তার পিছনে খুব পুরনো একটা ডাইরি পেয়েছে। হাতের লিখা প্রতিটা পৃষ্টা। একজন যুবকের প্রেমকাহিনী। সেই যুবকের প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলো উল্লেখিত রয়েছে। ঘটনা গুলো পড়তে পড়তেই দীবার ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটেছে। অনেকটা সময় বই মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। আবরারকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘গুড মর্নিং!’
আবরার বালিশে মাথা রেখেই স্মিতি হেসে বলল, ‘গুড মর্নিং! কখন ঘুম থেকে উঠেছো? ডাকো নি কেন?’
দীবা ডাইরি টা বন্ধ করে বিছানার পাশে থাকা ছোট কর্ণার টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো, ‘অনেক আগেই। নুরার সাথে ছিলাম এতোক্ষণ। এখনো কেউ উঠেনি। ভালো লাগছে না একা একা।’
শেষের কথাটা মন খারাপ করে ঠোঁট উলটে বললো দীবা। এতোক্ষণে প্রাণ খুলে শব্দ তুলে হাসলো আবরার। একটু এগিয়ে দীবার কোলে মাথা রেখে কোমড় জরিয়ে ধরলো। চোখ বন্ধ করে মৃদু গলায় বলল, ‘এইযে আমি আছি না?’
আবরারের প্রত্যুত্তর শুনে মুচকি হাসলো দীবা। কিন্তু তাকে আবারো ঘুমানোর পায়তারা করতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই আর ঘুমাবেন না। অনেক বেলা হয়েছে। সেই কখন নাস্তা দিয়ে গেছে। এতোক্ষনে মনে হয় নাস্তা ঠান্ডা হয়ে গেছে। উঠুন নাস্তা করবো। ক্ষিদে পেয়েছে আমার।’
আবরারকে ঠেলে উঠিয়ে দিলো দীবা। দেরি হওয়ার পরেও শুয়া থেকে উঠতে চায়নি আবরার। কিন্তু দীবার ক্ষিদে পেয়েছে তাই আলসেমি না করে উঠে পরলো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে এক সঙ্গে নাস্তা করতে বসলো।
_____________________
গায়ে পাতলা খয়েরি রঙ্গের একটা শাল জড়িয়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটছে নুরা। মনোযোগ তার অন্যত্র। মস্তিষ্কে হাজারো চিন্তা, দুশ্চিন্তা ঘিরে রেখেছে তাকে। মাত্র এক রাতেই চোখ দুটো কালচে হয়ে গেছে। চেহারা একদম মলিন। উষ্কখুষ্ক চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে খুব ভয়ানক ভাবে নুরার মন ভেঙ্গেছে। কিন্তু নুরা নিশ্চুপ। মৌনতার সঙ্গে শাল জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। তখুনি নিজের কক্ষ থেকে বেরুলো রাজ। শার্টের হাতা হোল্ড করতে করতে নিচে যাবার জন্য পা বাড়াবে তখন নুরার দিকে দৃষ্টি গেলো তার। প্রথমে স্বাভাবিক ভাবে নিলেও পরে নুরার চেহারা দেখে থমকে গেলো। কপাল কুঁচকে এলো তার। মনে প্রশ্ন জাগলো হঠাৎ হাস্যউজ্জ্বল থাকা মেয়েটার চেহারার এই অবস্থা কেন? কারণটা জানার আগ্রহ প্রকাশ করলো রাজ। তাই দাঁড়িয়ে রইলো নুরার সঙ্গে কথা বলার জন্য।
নুরা রাজকে একদম খেয়াল করে নি। প্রথমের মতো হাঁটছে। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার কারণে হঠাৎ রাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে নিয়েও লাগেনি। হকচকিয়ে গেলো নুরা। বুকে হাত রেখে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, ‘সরি স্যার একদম খেয়াল করিনি।’
কাছ থেকে নুরার এই নাজেহাল অবস্থা দেখে আরেক দফা বিস্মিত হলো রাজ। দূর থেকে সন্দেহ করলেও কাছে আসার পর ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেলো তার। নুরার লাল ও ফোলে থাকা ফরশা মুখশ্রী দেখে অনায়াসে বুঝে গেলো যে নুরা সারারাত কেঁদেছে। কিন্তু কি এমন কারণ এভাবে কাঁদবে মেয়েটা? এই বয়সটায় ছেলেমেয়ে উভয় অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। নুরাও কি তাহলে? মনে সংশয় জাগতেই প্রশ্ন করলো, ‘তুমি কেঁদেছ?’
হঠাৎ-ই এমন প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হয়ে গেল নুরা। কম্পিত হলো চোখের দৃষ্টি। এদিক সেদিন তাকিয়ে আড়ালে আনতে চাইলো নিজেকে। মেকআপ করতে ভুলে গেছে নাকি সে? শিট গার্ল! নিজের বোকামোতে নিজেকেই কয়েকটা গালি দিল নুরা প্রত্যুত্তর করার মতো কোনো শব্দ পেলো না সে।
নুরার চোখের দৃষ্টি ও অস্বস্তি দেখেই রাজ বুঝে গেছে। তাই নুরাকে আর বিব্রত করতে চায়নি। কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললে উঠলো, ‘একা কোথায় যাচ্ছো এখন?’
নুরা স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল, ‘বাগানে। ভালো লাগছিলো না তাই ভাবছি ওখানে গিয়ে সময় কাটানো যাক।’
রাজ পকেট থেকে হাত বের করে মাথার পিছনে চুলকে বললো, ‘আমিও ওইদিকেই যাচ্ছিলাম। এক সাথে যাই? আসলে আমারও আজ মন ভালো নেই।’
মলিন মুখে স্মিতি হাসলো নুরা। রাজের মন খারাপের কারণ তার অজানা নয়। অসম্মতি প্রকাশ করলো না। মাথা এক পাশে কাত করে ‘হ্যাঁ’ বুঝালো। অনুমতি পেয়ে প্রচ্ছন্ন হাসলো রাজ। হাত দিয়ে সিঁড়ির দিকে ইশারা করলো সে। অতঃপর দুইজন একত্রে চা বাগানের নিরিবিলি নির্জন পরিবেশের উদ্দেশ্যে পা চালালো।
_____________________
বাড়িটা যেমন অদ্ভুত, ঠিক তেমনি অদ্ভুত বাড়ির নিয়মকানুন গুলো। দীবার বুঝে আসলো না বাড়িতে এতো বড় একটা ডাইনিং টেবিল থাকতে রুমে প্রতিদিন খাবার খেতে হয় কেন? সায়েন্স টা কি ভাই? ভেবেছিল সবাই এক সাথে বসে খাবার খাবে। কিন্তু এই বাড়িতে তা হবে না। আশ্চর্য! মনে মনে মহা বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো দীবা। নাস্তার প্লেট গুলো নিয়েও আবার অদ্ভুত নিয়ম। প্রত্যেক রুমের বাহিরে দরজার পাশে একটা টেবিল রাখা আছে,নিজেদের নাস্তা শেষে নাস্তার প্লেট গুলো বাহিরের এই টেবিলের উপর রাখতে হয়। পরে বাড়ির কর্মচারীরা নিজেদের সময় অনুযায়ী এসে প্লেট ভাটি গুলো নিয়ে যায়। এইসব আজগুবি আবার কোন দেশের নিয়ম ভাই? দীবা দুজনের নাস্তার প্লেট গুলো টেবিলটার উপর রেখে বলে উঠলো,
‘মানে পুরো বাড়িটাই অদ্ভুতে ভরপুর।’
কথাটা বলে পিছু ফিরতেই বাড়ির নিচে নজর গেলো তার। ভ্রুঁ জোরা কুঁচকে এলো আপনা আপনি। নুরা ও রাজকে পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির দক্ষিণ দিকে বাগানের দিকে যেতে দেখে মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো নুরার এই ক্রাশটাই যেন ফাইনাল হয়ে যায়। তাহলে দুই বোন একই বাড়িতে সংসার করবে। কতো কিউট না ব্যাপার টা? দুইজনের দিকে তাকিয়ে প্রসন্নময় হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে গেলো দীবা।
___________________
দুইপাশে সবুজ চা গাছের মাঝে সরু মাটির রাস্তা। ছোট ছোট রংবেরঙের প্রজাবতীদের আনাগোনা চলছে তাদের উপর। খুঁজাখুঁজি করলে বোধহয় ঘাসফড়িং’য়ের দেখা মিলবে। চা বাগানের মাঝে স্থায়ী ছায়া হিসেবে কালশিরিষ, শীলকড়ই ও লোহাশিরিষ গাছ লাগানো। সেই গাছেদের ছায়ার তলে দাঁড়ালো দুজন। নুরা আনমনে সামনে তাকিয়ে আছে এক মনে। মনে মন নানান রকম কল্পনা জল্পনা করতে লাগলো। মুক্ত বাতাসের সংস্পর্শে এসে ফুরফুরে হয়ে গেলো মন। ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখে সামনে তাকিয়ে চা বাগানের সৌন্দর্য অবলোকন করছে।
রাজ তাকিয়ে আছে নুরার দিকে। কান্নায় জর্জরিত হওয়া মলিন মুখখানি দেখে নিজেও দুঃখপ্রকাশ করলো। নুরার চিঠিটা পড়ার কারণেই হয়তো কান্নার কারণ সহজেই ধরতে পেরেছে সে। এক পাক্ষিক ভালোবাসা যে কতো বেদনাদায়ক সেটা শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিটাই উপলব্ধি করতে পারে যে ভালোবাসে। দূর থেকে ভালোবাসা, দূর থেকে প্রিয় মানুষটাকে দেখা, কাছে আসার যেই অভিলাষ, ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্যজনকে দেখার তীব্র ব্যাথা শুধু মাত্র সেই ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারে যে ভুক্তভোগী। এই ব্যাথার স্বীকারুক্তি রাজ নিজেই। বুকের ভিতর চিনচিন একটা ব্যাথা অনুভব হলো তার। ব্যাথাটায় চাপা আর্তনাদ রয়েছে। শুধু শব্দ করে চিৎকার করা বাকি। কিন্তু রাজ কাঁদবে না। ছেলে মানুষদের কাঁদতে মানা। যে মানুষটা তার না, সেই মানুষটাকে ভালোবেসে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা নিতান্তই অযুক্তিক ব্যাপার। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাজ। পকেটে দুই হাত গুঁজেই সামনে তাকিয়ে থেকে আলতোভাবে বলে উঠলো,
‘এক পাক্ষিক ভালোবাসা বড্ড পীড়াদায়ক নুরা। যারা এক পাক্ষিক ভালোবাসে তাদের চেয়ে বড় দুঃখি আর কেউ হতে পারে না।’
চট করে চোখ ফিরিয়ে রাজের দিকে তাকালো নুরা। হঠাৎ রাজের থেকে এমন বানী শুনতে পারা তার জন্য বিস্ময়ের চেয়েও কম কিছু নয়।তাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাজের দিকে।
রাজ আবারো বললো, ‘এক পাক্ষিক ভালোবাসার মাঝে একটা পার্থিব অনুভূতি কাজ করে জানো। অনেকে এটাকে ভালোলাগা বলে। কিন্তু আমি বলবো এই অনুভূতি ভালোলাগার চেয়েও তীব্র। হাজার মাইল দূরে থেকেও সেই মানুষটাকে নিয়ে নিজের হাজারো অনুভূতি অনুভব করা যায়। এই অনুভূতিকে ভালোলাগা নয় ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করতে হবে।”
নিশ্চুপ নুরা! এক মনে রাজের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে রাজের বলা প্রতিটা কথা শুনছে। রাজ এখনো সামনে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে রাজ আবারো বলে উঠলো, ‘আমরা যারা এক পাক্ষিক হয়ে ভালোবাসি। তাদের চাওয়ার সীমা অতিসাধারণ। আমরা ততোদিন পর্যন্ত সেই মানুষটাকে চাইতে পারি যতোদিন না সেই মানুষটা অন্য কারোর হবে। যখুনি দেখবে সেই মানুষটা আর তোমার নেই। তখন সেই মানুষটাকে চাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দিতে হবে। কারণ হাজার সাধনা করলেও সেই মানুষটাকে ফিরে পাওয়া যাবে না। তকদিরে যা আছে তাই হবে।’
নুরা নির্বাক। রাজের কথার মাঝে পালটা প্রত্যুক্তি করার জন্য কোনো শব্দগুচ্ছ খোঁজে পেলো না। রাজের কথা গুলো তাকে ভাবাচ্ছে। তবে নিজেকে নিয়ে না বরং সে ভাবছে দীবাকে নিয়ে। দীবা তো এখন আরব ভাইয়ের স্ত্রী। রাজের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে কি রাজ দীবা ও আবরারের মাঝে বাধা হবে না? চুপচাপ নেমে নিবে সব? কিছুটা চিন্তিত, বিস্ময়যুক্ত চোখে রাজের দিকে তাকালো। সে যা ভাবছে তা রাজের বলা প্রতিটা কথানুযায়ী “কাছের মানুষটার ফিরে আসার সুযোগ না থাকলে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা নিহাত বোকামি। তকদিরে যা আছে তাই হবে।” তাহলে সত্যি যেন তাই হয়। মনে মনে এইসব ভেবেই নিজেকে শান্ত করলো নুরা। মাথা থেকে দুশ্চিন্তা নেমে গেলো।
‘আমি কি বুঝাতে পেরেছি?’
হঠাৎ রাজের কথা ধ্যান ভাঙ্গলো নুরার। চমক চোখে রাজের দিকে তাকিয়ে জড়তাহীন গলায় প্রশ্ন করে উঠলো, ‘যদি ভালোবাসার মানুষটা ফিরে আসার সুযোগ থাকে? তাহলে কি বলবেন?’
প্রশ্ন শুনে চোখে চোখ রাখলো রাজ। সমগ্র চোখের দৃষ্টি দিয়ে নুরাকে আজ প্রথমবারের মতো অবলোকন করতে লাগলো। ফরশা মুখখানি এক দিনে শুকিয়ে গেছে। চোখে বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। নিষ্পাদিত চোখের মায়াবী দৃষ্টি। অযত্নের কারণে চোখের নিচটা কালচে লাগছে। গোলাপি চিকন পাতলা ঠোঁট জোড়া। গাল ও নাকের মধ্যিখানের অংশ বিশেষ স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার কারণে লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। হাজার সৌন্দর্যের অধিকারীনি নুরার পাগলাটে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কি কোনো পুরুষের আছে? কে সেই হতভাগা যে কিনা ভালোবাসার বৃহৎ সমুদ্র পেয়েও গা ভিজাচ্ছে না? আচ্ছা নুরার জায়গায় যদি দীবা হতো তাহলে কি সে-ও ফিরিয়ে দিতো? দীবা না হোক নুরাকেও পারতো ফিরিয়ে দিতে? এক পাক্ষিক ভালোবাসার পাল্লা যে ঠিক কতোটা ভারি সেটা রাজের চাইতে অন্য কেউ ভালো জানে না। এতো বড় বোকামো তো রাজ করবে না। এইটুকু পিচ্চি মেয়ের এই অসীম ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তার নেই। আর না কোনো থাকবে।
শব্দ করে একটা লম্বা নিশ্বাস ছুড়লো রাজ। নুরার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি এখনো ছোট নুরা। এইসব নিয়ে ভাবার সময় আরো আছে। এই বয়সে ভুল সিদ্ধান্ত..’
রাজের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নুরা তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠলো, ‘আমাকে দেখে সবার চেয়ে বেশি দুষ্টু আর চঞ্চল ভাবতে পারেন। কিন্তু রিমি আর দীবার চেয়েও যথেষ্ট ম্যাচুরিটি আমার মাঝে আছে। সেক্রিফাইজ, কম্প্রোমাইজ, মানিয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়া সবই জানি। কখন কি সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেটাও জানি। মানুষ চিনতে কখনো ভুল করি না। আম্মু বলে এই গুনটা নামি বড়মার কাছ থেকে পেয়েছি। আমি কখনো হুট করেই সিদ্ধান্ত নেই না স্যার। ভেবে চিন্তে সময় নিয়ে তারপর যা করার করি।’
গম্ভীর্য চোখেমুখে কঠোরতার সঙ্গে কথা গুললো বললো নুরা। আত্মনির্ভরতা প্রবল তার মাঝে। নুরার নিজের প্রতি এই দৃঢ়ভাব দেখে সন্তোষ হলো রাজ। এমনিতেও নুরাকে যথেষ্ট চতুর ও জ্ঞানী ভাবে রাজ। আর আজকে নুরার এমব কঠিন প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে তা একদম পরিষ্কার হয়ে গেলো তার মাঝে।
‘আমি কিন্তু আমার উত্তর পেলাম না স্যার।’
চলমান…. #আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪৩]
‘আমি কিন্তু আমার উত্তর পেলাম না স্যার।’
রাজকে চুপ থাকতে দেখে নুরা আবারো বলে উঠলো। সকচকিত হয়ে নুরার দিকে তাকালো রাজ। প্রশ্নের প্রত্যুত্তর কিভাবে করবে সেটাই ভাবছে সে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে শব্দ ভাণ্ডারে বাক্য সাজিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, ”কথায় আছে ‘পাই না পাই সাধন করতে মানা নাই’। আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশার মাঝে পার্থক্য আছে। পার্থক্য থাকলেও দুইটো শব্দ একে অপরের সাথে সংযুক্ত। কোনো কিছু পাবার তীব্র বাসনা কে আকাঙ্ক্ষা বলে। আমি কখনো বলবো না পাওয়ার আশা ছেড়ে দাও। তকদিরে থাকলে দেরি হলেও আসবে। যদি ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা মনে থাকবে।’
‘আপনার পছন্দের মানুষটার ফিরে আসার সম্ভাবনা কতোটুকু?’
হকচিকিত হলো রাজ। চমক দৃষ্টি চটপট নুরার দিকে তাকালো। অবাক হলো বেশ। এইটুকু সংক্ষিপ্ত আলাপে রাজের এতো বছরের গোপনীয়তা কিভাবে বুঝে গেলো মেয়েটা? সে তো কোনো প্রকার ইঙ্গিত দেয় নি। আশ্চর্যবোধক ব্যাপার। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুরা মৃদু শব্দে হেসে উঠলো। চোখ ফিরিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিভাবে জানলাম সেটা নাহয় পরে বলা যাবে। আর আপনি প্রশ্নের উত্তর দিতে এতো দেরি করেন কেন বলুন তো?’
নুরার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচে তাকালো রাজ। ফুঁশ করে একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকালো। নুরা এখনো প্রশ্নের উত্তরের আশায় তার দিকে অধীক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার এতো কৌতুহল দেখে মনে মনে হাসলো রাজ। কিছুটা সময় নিয়ে, মনে মনে উত্তর দেবার জন্য শব্দ গুচ্ছ সাজিয়ে, শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয় ভিজিয়ে বলে উঠলো, ‘তাকে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা তো দূর কখনোও পসিবল না।’
নুরা কারণটা জানে। তবুও না-বুঝের মতো জানতে চাইলো, ‘কেন? সে কি চলে গেছে?’
‘না! সে অন্য কাউ কে ভালোবাসে। আমি পারতাম তাকে জোরপূর্বক আমার করতে। কিন্তু আমি এতোটাও নিষ্ঠুর না যে নিজের ভালোবাসা পাবার জন্য অন্য কারোর ভালোবাসা ভেঙ্গে দিবো। আমি মন থেকেই চাই আমার ভালোবাসা যেন তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে সুখি থাকে।’
বিমুগ্ধ হলো নুরা। রাজ তাহলে দীবাকে পাবার জন্য কোনো পন্থা- অবলম্বন করবে না? তাহলে আরব ভাই আর দীবা দুইজনের জীবনে কোনো বাধা আসবে না। বুকের ভীতর থেকে চাপা ভয় এতোক্ষণে কেটে গেল। গতকাল রাতে যেই ভয়ে সে নির্ঘুম রাত কাটালো, আজ সকালে সেই ভয় রাজের কথায় নিমিষেই কেটে গেলো। রাজ তাহলে দীবাকে আর চাইবে না। তাহলে কি ভালোবাসবে? প্রশ্নটা মনে জাগতেই বিষণ্ণ হলো তার কোমলায়ন মন। কোনো মেয়েই চায় না তার ভালোবাসার মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসুক। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। হয়তো এটাই তার কপালে ছিলো। নিরবে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। রাজ আরো কিছুক্ষণ কথা বললো নুরার সাথে। তারপর হাত ঘড়িতে সময় দেখে দেখলো অনেকক্ষণ হয়েছে এখানে আছে তারা। বাড়ি ফেরা দরকার।তাই বাড়িতে যাবার জন্য পা বাড়ালো দুজন। নুরার থেকে একটু এগিয়ে রাজ। নিজের মতো হেঁটে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। আর নুরা রাজকে দেখে হাঁটছে। রাজের বলা প্রতিটা কথা তার মনে নতুন করে প্রেম জাগিয়েছে। নতুন করে রাজের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছে। রাজের সর্বশেষ এইটুকু কথাই নুরার মনে গেঁথে রইলো। আর সেটা হলো,
“ভালোবাসা মানেই হচ্ছে ভালো থাকার এক অনুভূতি। যাকে দেখলেই মনের সব বিষ ছু মন্তর ছু হয়ে যায়, আমরা তাকেই ভালোবাসি।”
ভালোবাসার মানুষটার কাছে অদ্ভুত এক জাদু শক্তি আছে। যেই শক্তির মাধ্যমে বিপরীত মানুষটাকে অনায়াসে নিজের অজান্তে ভালো রাখে। বিষন্ন মনকে প্রাণবন্ত করে তুলে। নুরার মনটাও তাই। রাজকে পাশে পেয়ে বিষণ্ণতা দূর হয়ে গেলো। মনে পরলো কয়েকটা লাইন। লাইন গুলো আজ কানে আপনাআপনি বেজে উঠলো।
“যা দিয়েছিলে, ফিরিয়ে নিয়েছিলে সেই কবে। আবারও যদি আমায় সব দিতে চাও, তবে নিয়ে নিলাম। তুমি যা দিতে চাও তার সব আমি নিয়ে নিলাম। আমার বুকে আঁতকে ওঠা প্রেমের ঝড়ে, কাছে টেনে নেবো তোমায় আমার করে।”
____________________
সকালটা সুন্দর ভাবে কাটলো সবার। কিন্তু দুপুরে সূর্য মাথার উপরে আসার আগেই অম্বর কাঁপিয়ে ভারি বর্ষণে মুখরিত হলো ধরনী। রুমের ভিতর থেকে বৃষ্টির ঝুম শব্দ শুনে উল্লাসিত হলো দীবা। দ্রুত পা বাড়িয়ে রুমের বাহিরে আসলো। রুমের বাহিরে বিশালাকৃতি লম্বা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালো। এক হাত বাড়িয়ে ধরনীর বুক চিঁড়ে পরা বৃষ্টির টুপটাপ ফোটা গুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে দীবা। ঠোঁটে তার আমোদিত হাসি। গতকাল বৃষ্টি ভেজার ফলে মাথা ব্যাথা করেছে। তাই আজ বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছে হলেও বৃষ্টি ভেজার মতো দ্বিতীয়বার দুঃসাহস দেখালো না। তবে এইজন্য অবশ্য বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তার। সে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বৃষ্টিময় দুপুর পর্যবেক্ষণ করছে। তার ঠিক পিছনে পকেটে দুই হাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবরার। সে এক মনে দীবার এই প্রফুল্লিত হাসি মুখ দেখছে। দীবার হাসিতে বিমুখিত হয়ে নিজেও মৃদু হাসলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে দীবার দিকে এগিয়ে গেলো। দীবার দুই পাশে দুই হাত রেখে রেলিং ধরে দীবার কাধে নিজের চিবুক রাখলো সে। নিজেও দেখতে লাগলো বৃষ্টিস্নাত দুপুর। হঠাৎ-ই পিছন থেকে আবরার জড়িয়ে ধরায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকালো একবার। ভাগ্যিস কেউ নেই। যদি কেউ এই অবস্থায় তাদের দুজনকে দেখতো তাহলে লজ্জায় ম’রে যেতো সে। মনে মনে স্বস্তি পেলেও চেহারায় রাগ ফুটিয়ে বলে উঠলো, ‘এভাবে ধরেছেন কেন? কেউ দেখে ফেলবে। ছাড়ুন।’
নির্বাক আবরার। গুরুত্ব দিলো না দীবার কথায়। ভাবলেশহীন ভাবে দীবার কাধে আলতো ভাবে চুমু খেয়ে বললো, ‘দেখলে দেখুক। আমি কি অন্য কারোর বউকে জড়িয়ে ধরেছি নাকি? আমি আমার বউকে জড়িয়ে ধরবো যেখানে খুশি সেখানে। তাতে কার বাপের কি?’
দীবা চোখ পাকিয়ে তাকালো, ‘আপনার মাঝে লজ্জার ল টাও নেই। আশ্চর্য লোক কোথাকার।’
দীবার কোমড় ধরে নিজের দিকে ঘুরালো আবরার। মুখের দুপাশে পরে থাকা ছোট চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে দীবার এক গালে হাত রাখলো। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠলো, ‘লজ্জা পেলে আব্বু ডাক জীবনেও শুনবো না। তাই আমি বউয়ের সাথে লজ্জা পাচ্ছি না।’
আবরারের বুকে ধা’ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো দীবা। রাগে কটমট করতে করতে রুমের ভিতরে যেতে যেতে বললো, ‘এখানে আসাই আমার ভুল হয়েছে।’
দীবার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো আবরার। চলে যাবার জন্য রুমের দিকে পা বাড়াতেই থেমে গেলো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালো। সেখানে রাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো আবরার। নিরবে চোয়াল শক্ত করে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
দরজা বন্ধ করে পিছু ফিরে তাকাতেই জানালার পাশে দীবাকে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসলো। নিজেও নিঃশব্দে দীবার পাশে বসে দীবাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। দীবার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে আলতোভাবে বললো, ‘আই লাভ ইউ দীবা।’
দীবা মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর করলো, ‘আই লাভ ইউ টু।’
আবরার দীবাকে নিজের দিকে ফিরালো। মুখের সামনের চুল গুলো যত্ন সহকারে গুছিয়ে দিয়ে দীবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বাহিরে শ্রাবণের মনোরম বর্ষণের দৃশ্যপট দেখে গান শুনার ইচ্ছে জাগলো দীবার। তাই সঙ্গে সঙ্গে আবদার করে বসলো, ‘আমাকে ওই গানটা শুনান।’
‘কোনটা??’
‘ভালোবাসি সুহাসিনী।’
আবরার মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। দীবা আবারো সামনের দিকে ফিরে বসলে আবরার তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। দীবার ঘাড়ে চিবুক রেখে আলতো স্বরে গাইতে লাগলো…
রোজ সকালে তোর মায়াবি ছবি
চোখে ভাসে তোর মিষ্টি হাসি
বেলী গাঁথা তোর চুলের বেণী
মায়াপূর্ন তোর চোখের চাহনি।
_____________________
নিচ তলায় রাজিব ও সাবিতের সঙ্গে বিয়ে সংক্রান্ত কিছু ব্যাপারে আলাপ আলোচনা শেষ করে মাত্রই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিল। একদম উপরের সিঁড়িতে উঠার পর দীবা ও আবরারকে পাশাপাশি বারান্দার রেলিংয়ের কাছে দেখে থেমে গেলো। বুকের বাম পাশটা ভারি হয়ে এলো তার। দীবাকে অন্য কারোর পাশে দেখার মতো সাধ্য তার ছিলো না। কিন্তু পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আজ সেই করুণ দৃশ্যটাই তার নজরে আটকালো। রাগ হলো প্রচুর। তবুও নিজেকে সংযত রাখলো যথাসম্ভব। দীবা রুমে যাবার পর আবরারও রুমের দিকে পা বাড়ালো। ডান দিকে রাজকে দেখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সে নিজেও ভিতরে চলে গেলো। সিঁড়ির পাশে থাকা একটা মাটির ফুলের টবে রাগে লা:থি দিল একটা। ভাগ্যবশত টবটা ভাঙ্গে নি। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় নি রাজ। গটগট পায়ে তৃতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।
দূর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা দেখে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। রাজের অসহায়ত্ব দেখে কষ্ট লাগলো ভীষণ। চোখে জমে এলো পানি। রাজের এই ভালোবাসা যদি তার জন্য হতো তাহলে কি এমন ক্ষতি হতো? সে কি কখনো রাজকে কাছে পাবে না? ধীর পায়ে এগিয়ে চেয়ার টেনে টেবিলের কাছে বসলো। ব্যাগ থেকে কলম আর নীল রঙ্গের এ ফোর সাইজ কাগজ বের করলো। ছয় ইঞ্চি পরিমানের মাপ নিয়ে টুকরো করে কেটে নিলো কাগজটা। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা দম নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো নুরা। এক পাক্ষিক ভালোবাসার প্রতি হৃদয়ের সুপ্ত কোণে অভিমান জমলো। নিজের জন্য নিজের বড্ড মায়া লাগলো। কাগজটায় কলম চালিয়ে লিখে ফেললো প্রিয় একটা লাইন। চিরকুটটা লিখার পর ওইদিন রাতের পর আর ভুল করেনি। ব্যাগের সাইড পকেটে রেখে দিলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো নুরা। কোমল গোলাপি ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে মৃদু গলায় বললো,
‘সৃষ্টিকর্তা জোড়ায় জোড়ায় মানবজাতির সৃষ্টি করেছেন। যদি, আপনি আমার সেই জোড়া হোন, তবে আপনাকে আমি শেষ অব্দি ভালোবাসি।’
____________________
চলমান…