#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-০৫]
বিছানায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন আবরার। গতকাল রাত তিনটায় কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছে সে। এখন সকাল সাড়ে দশটা বাজে তাও ঘুম ভেঙ্গে উঠতে পারেনি। বিছানায় উপুড় হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ-ই ফোনের কর্কষ রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো তার। বিরক্ত হয়ে মুখে ‘চ’ উচ্চারণ করলো। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো নিশিতা কল দিয়েছে। এতোক্ষণ বিরক্ত লাগলেও মোবাইলে ইংরেজি ক্যাপিটাল ওয়ার্ডে ‘AMMU’ লেখা দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। এক মুহূর্তও দেড়ি না করে কল রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আম্মু?’
অপর পাশ থেকে প্রসন্ন আওয়াজে নিশিতা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা! কেমন আছিস?’
‘ভালো! তুমি কেমন আছো? বাসার সবাই ভালো আছে?’
‘হ্যাঁ সবাই ভালো। এখনো ঘুমাচ্ছিলি নাকি?’
আবরার উঠে বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বসলো। আয়েশী ভঙ্গিতে বললো, ‘রাতে দেড়িতে ঘুমিয়েছিলাম। তাই এখনো ঘুম আছে।’
‘কাজের চাপ বেশি? সময় করে একটু আয় না বাবা। কতদিন তোকে দেখি না।’
‘মা এমন ভাবে বলছো যেনো আমি চট্টগ্রামে কত থেকেছি। তাছাড়া তিন মাস আগেই তো চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম।’
‘হ্যাঁ! সেটা তো তিন মাস আগের কথা। মাত্র তিন দিন থেকেছিলি।’
‘ওই তিন দিনেই যা কান্ড ঘটিয়েছো তোমরা। তার পরেও কি মনে হয় আমি সেখানে থাকবো?’
‘যা হওয়ার হয়েছে তো। তকদিরে যা থাকে তাই হয়। ভাগ্যের লিখন কেউ মুছতে পারে না।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।’ ত্যাঁছড়া করে বললো আবরার।
‘এই দিকে পাহাড়ি দের আঞ্চলিক মেলা বসবে। তাছাড়া রাইমাকে দেখতে আসবে কিছুদিন পর। তুই বড় ভাই হয়ে থাকবি না? রিমি তো কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দেয় তোর জন্য। কত বছর হয়েছে তুই আমাদের সাথে থাকিস না। আমাদের কি ইচ্ছে করে না তোকে কাছে পেতে বল? তোর বাবার কথা বাদ দিয়ে আমাদের কথা চিন্তা করেও কিছু দিন সময় নিয়ে আসতে পারিস।’ শেষের কথা গুলো অনুনয় স্বরে বললো নিশিতা।
মায়ের এই অনুরোধ ফেলতে পারেনি আবরার। ছোট করে ‘দেখা যাক!’ বলে লাইন কেটে দিল সে।
মোবাইল টা হালকা করে ছুড়ে ফেললো বিছানার উপর। সিলিং’য়ের দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে তার একদমই নেই। তবে গতকাল রাতের পর থেকে কেমন অদ্ভুত ভাবে মায়া কাজ করছে। বারবার মনে হচ্ছে বাড়ির কথা। মনে পরছে লাল কুর্তি পরা মেয়েটির কথা। মেয়েটিকে দেখার আগ্রহ বাড়ছে। বাড়িতে থাকলে নিশ্চয় মেয়েটিকে দেখতে পারতো সে। এই মেয়েটি-ই কি সেই মেয়েটি? যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। শীট! ওইদিন রাগ না করে যদি মেয়েটির চেহারা ভালো করে দেখতে পারতো। মাত্র দুইবার অল্প সময়ের জন্য দেখেছিলো তাও তিন মাস আগে। এতোদিনে চেহারাও ভুলে গেছে। হতাশ হয়ে নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করলো আবরার। মায়ের বলা কথা গুলো ভাবতে লাগলো। একটা মানুষের সাথে রাগ করে এতোদিন বাড়ি থেকে দূরে থাকার মানেই হয়না। তাছাড়া সে এখন যথেষ্ট এস্টাবলিশড। তার নিজেরই টাকার অভাব নেই। সুতরাং সেখানে অনায়াসে সে যেতেই পারে। বহুক্ষণ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো আবরার। অতঃপর বিছানা থেকে নেমে অভ্রকে ডাকলো। এখন সাপ্তাহ খানেকের জন্য ফ্রি সে। এই কয়েকদিন নাহয় চট্টগ্রামে কাটানো যাক। তাই আবরার সিদ্ধান্ত নিলো সএ চট্টগ্রামে যাবে। অভ্র কে নিজের জিনিস পত্র গুছাতে বলে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলো।
_____________
সাইন্সের ক্লাসে বসে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে সকল শিক্ষার্থী। আসলে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সবাই আড্ডায় মশগুল থাকলেও ‘মুফতাহির রাজ’ স্যারের ক্লাসের আগে সবাই পড়া রিভার্স করে। মুফতাহির রাজ ফিজিক্স আর হায়ার ম্যাথম্যাটিকস ক্লাস করায়। এখন ফিজিক্স ক্লাসের পালা। স্যারের ধ’ম’ক খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সবাই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এখন।
মুফতাহির রাজ ক্লাসে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। সুঠাম দেহের অধিকারী উজ্জ্বল ফরশা গায়ের রঙ। মেদহীন শরিরের সঙ্গে গায়ের বর্ণ পারফেক্ট। দেখতে সুদর্শন হলেও গম্ভীর ও রাগি একজন মানুষ। প্রথম কয়েকদিন ক্রাশ বলে সবাই চেঁচালেও বর্তামানে তার রাগের কারণে সেই ক্রাশ কারোর মাঝে রইলো না।
রাজ ক্লাসে ঢুকার পরেই এক পলক দীবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে সবাইকে বললো, ‘সিট ডাউন!’
ফিজিক্স প্রথম পত্র বই বের করে ষষ্ঠ অধ্যায় ‘মহাকর্ষ এবং অভিকর্ষ’ পড়ানো শুরু করলো রাজ। বোর্ডে লিখছে আর হাত নেড়ে পড়া বুঝাচ্ছে সবাইকে। চেহারা, কন্ঠে স্পষ্ট গম্ভীরতা ভাস্যমান। নুরা গালে এক হাত রেখে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে রাজের দিকে। লোকটার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে বারবার-ই মুগ্ধ হয় সে। এই যে এখন লেকচার দিচ্ছে আর পাশাপাশি দুই হাত নেড়ে কথা বলছে। সিল্কি চুল গুলো কপালে ঝাপটে পরে আছে। কথার সঙ্গে লালচে গোলাপি ঠোঁট দুটো নড়ছে। বরাবরই প্রেমে পরার মতো অবস্থা। নুরা মৃদু হাসি ঠোঁটে রেখে তাকিয়ে আছে রাজের দিকে। রিমি ও দীবা বোর্ডে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে সব। তখন দীবার হাতে হাল্কা ধাক্কা দিলো নুরা। দীবা তার দিকে তাকাতেই নুরা রাজের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে আনমনে বলে উঠলো, ‘বইন দেখ কি সুন্দর লাগতাছে স্যার কে। উফফ এতো কিউট কেনো স্যার? খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে একদম।’
দীবা চোখ বড় বড় করে তাকালো নুরার দিকে। তারপর বললো, ‘ছিঃ কি বলছিস এসব? উনি আমাদের টিচার।’
‘হ্যাঁ তো? টিচাররা কি স্টুডেন্টদের বিয়ে করে না? করে করে। বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চাও পয়দা করে। রাজ জানুর বংশের বাত্তি জ্বালাতে আমাকে বিয়ে করবে। দেখে নিস।’
দীবা আওয়াজ নিচু করে বললো, ‘ বিয়ের পর ফুটবল টিম বানানোর চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দে। নয়তো তোর মতো গাধা কে স্যার জীবনেও পাত্তা দিবে না।’
দুজনের কথোপকথন রাজের অগোচর হলো না। ক্লাসের ফাঁকে কথা বলা তার মোটেও পছন্দ না। পকেটে দুই হাত গুঁজে গম্ভীর কন্ঠে দীবাকে ডেকে উঠলো, ‘মিস দীবা সানজিদাহ। স্টেন্ড আপ!’
রাজের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো দীবা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ক্লাসের উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তার দিকে। বিব্রতবোধ করলো সে। দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে নুরার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো দীবা। নউতো ও ভয়ার্ত তার দৃষ্টি।
রাজ গম্ভীর কন্ঠে বললো, ‘আপনি জানেন আমার ক্লাসে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না। তাহলে কথা বলছিলেন কেনো?’
ধাতস্থ হলো দীবা। কিছুটা আমতা আমতা করে বললো, ‘সরি স্যার! আর হবে।’
রাজ দীবার দিকে প্রগাঢ়ভাবে তাকালো। তার জড়তা, ইতস্ততবোধ দেখে মনে মনে হাসলো রাজ। এই মেয়েটা এতো ভীতু কেনো? কি সুন্দর করে কথা বলে। বরাবরই সে মুগ্ধ হয় দীবাকে দেখে। ভিতরে তার ভালোলাগা কাজ করলেও উপরে গম্ভীরভাব রেখে বলে উঠলো, ‘ফারদার যদি দেখি আমার ক্লাসে আপনি কথা বলেছেন তো ক্লাস থেকে বের করতে বাধ্য হবো। গট ইট?’
দীবা মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় উত্তর দিল, ‘জি!’
‘ওকে সিট ডাউন!’
দীবা চুপচাপ বসে পরলো। মন খারাপ হলো বেশ। এভাবে সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে অনেক লজ্জা পেয়েছে। ইশ! স্যার কি ভাবলো তাকে? নিশ্চয় বেয়াদব ভেবেছে। ক্ষুন্ন হলো মন। কান্না পেল্য ভীষণ। চুপচাপ বই হাতে নিয়ে বসে রইলো।
রাজ আবারো ব্যস্ত হয়ে ক্লাস শুরু করলো। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে দীবার দিকে তাকাচ্ছে। ক্লাসে সবার সামনে এভাবে দাঁড় করিয়েছে বলে দীবা মুখ গুমরো করে বসে আছে। দীবার মন খারাপ দেখে বুকের বাম পাশে গিয়ে লেগেছে। ঠিক এমন-ই গুমরো ঠোঁট ফুলানো দীবাকে মেলায় দেখে সে প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলো। আর আজ আবারো মুগ্ধ হলো রাজ। এই মেয়ের মাঝে থাকা সব কিছুই যেনো রাজকে মুগ্ধ করে। কাছে টানে তাকে। ভেবেই সকলের অগোচরে মুচকি হাসলো।
______________
সকালের মধ্যেই সব কিছু গুছিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হলো আবরার। কিন্তু বাড়ির কাউকে জানায় নি। কারণ হঠাৎ করে ‘শান্তিনিবাস’ এ উপস্থিত হয়ে সবাই কে বড়সড় একটা সারপ্রাইজ দিবে সে। ভাবতেই নিজের মাঝে ভালো লাগা কাজ করলো। মনটা বেশ ফুরফুরে আবরারের।
গাড়িতে আবরার ও অভ্র পাশাপাশি বসে আছে। আবরারের মন এতো খুশি খুশি দেখে বার বার আড় চোখে তাকাচ্ছে অভ্র। এই কয়েক বছরে কোথাও যাওয়া নিয়ে এবিকে সে এতো এক্সাইটেড দেখিনি। তাই আজ এতো অবাক হচ্ছে। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে আবরারকে বলে উঠলো, ‘স্যার আপনাকে এতো এক্সাইটেড লাগছে কেনো?’
আবরার অভ্রর দিকে ফিরে তাকাতেই অভ্র ভড়জে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো, ‘না মানে কখনো তো কোথাও যাওয়া নিয়ে এতো এক্সাইটেড হতে দেখি নি। আবার যাচ্ছেন কয়েক দিনের জন্য তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।’
আবরার মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘অনেক দিন পর বাড়িতে যাচ্ছি। এক্সাইটেড লাগবে না?’
অভ্র আলতো হেসে মাথা দুলালো। বললো, ‘বাড়ি যাওয়ার আনন্দটা অনেক।’
আবরার মুখে হাসি রেখেই বললো, ‘অনেক ভেবে দেখেছি অভ্র একটা মানুষের জন্য কেনো আমি বাকি মানুষ গুলোকে কষ্ট দিবো? আমার জন্য সবাই কষ্ট পাচ্ছে। তারাই তো আমার কাছের মানুষ। অন্তত্য ওদের জন্য হলেও আমার চট্টগ্রাম যাওয়া উচিত।’
বিনিময়ে অভ্রও মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। বহুদিন পর স্যার কে এতো এক্সাইটেড দেখছে সে। একপ্রকার রাগের কারণে পরিবারকে ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছিল আবরার। যতোই গানে নিজেকে ডুবিয়ে রাখুক না কেনো ভিতরে থাকা চাপা কষ্ট যেনো বিরাজমান। আবরার কাঁচ নামিয়ে আপাতত বাহিরের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত। গাড়ি চলছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।
চলমান..#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-০৬]
চট্টগ্রাম পাহাড়, পর্বত ও সমুদ্রঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি জেলা। তাই চট্টগ্রাম জেলা কে প্রাচ্যের রানী হিসেবে ডাকা হয়। আগ্রাবাদ, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার ডবলমুরিং থানার অন্তর্গত প্রধান বানিজ্যক এলাকা যা শহরের দক্ষিন দিকে অবস্থিত।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আবরারের গাড়ি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ঢুকলো। আবরার বাহিরে তাকিয়ে আগ্রাবাদের দৃশ্য দেখছে। সেই আট বছর আগে এই শহর ছেড়ে ছিলো সে। তারপর তিন মাস আগে এসেছিলো নিশিতার জুরাজুরিতে। কিন্তু সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য রাগে দ্বিতীয় বার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলো। মনে মনে ভেবেছিলো শান্তিনিবাসে আর আসবে না! কিন্তু তা আর হলো না। নিজের শহর, নিজের পরিবারের টানে এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়েছে। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবরার। আচ্ছা শান্তিনিবাস গেলে তো সেই মেয়ে টার সাথে দেখা হবে। মেয়েটি কি তার বউ হওয়ার অধিকার ফলাবে? মেয়েটি দেখতে কেমন? তখন তো রাগের মাথায় মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকায় নি আবরার। মেয়েটি যেমন খুশী তেমন হোক, আবরারের মতো এতো বড় নামকরা গায়ক নব্বই দশকের মতো বাধ্য ছেলে নয় যে তাকে জোড় করে বিয়ে দিবে আর সে চুপচাপ মেনে নিবে।
‘স্যার, আমরা এসে গেছি!’
অভ্রর ডাকে হুঁশ আসে আবরারের। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ‘শান্তিনিবাস’ বাড়ির গেইটের সামনে আছে তারা। দারোয়ান গেইট খুলে দিতেই বাড়ির ভিতরে বিশাল বাগান পেরিয়ে গাড়ি থামলো। আবরার গাড়ি থেকে নেমে একবার বাড়ির দিকে চোখ বুলালো। তিন তলার এই বাড়িটি যেনো রাজকীয় আমেজে ভরপুর। বাড়ির বাগানের মালি জসিম মিয়া আবরার কে দেখে খুশিতে আত্মহারা। দৌড়ে বাড়ির মানুষ দের ডাকতে গেলে আবরার বারন করলো। ইশারায় দরজা খুলতে বললো তাকে। জসিম মিয়া কথামতো তাই করলো। আবরার এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে। অভ্র আবরারের পিছু পিছু চারপাশ দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলো।
সদর দরজার কাছে এসে ধীর পায়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো আবরার। এখানেই তার শৈশবকাল কেটেছে। এই বাড়ির সাথে জুড়ে আছে তার হাজার হাজার স্মৃতি। আজ সেই বাড়ির সংস্পর্শে আসায় বুকের ভারি পাথর সরে গেলো। ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলে সবাইকে দেখতে পেলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সদর দরজার কাছে।
সকলের আড্ডার মাঝে নুরার চোখ হঠাৎ সদর দরজার দিকে গেলো। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি কে দেখে সে প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হলো। অতিরিক্ত খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আরব ভাইইই…!’
ডাক দিয়েই দৌড়ে সদর দরজার দিকে গেলো। কাছে এসেই আবরারকে খুশিতে ঝাপটে ধরলো। নুরার এমন কান্ডে সবাই সদর দরজার দিকে তাকাতেই অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো। স্বব্ধ হয়ে গেলো সবাই। আরিয়ানের মুখ হা হয়ে গেলো। বিস্মিত চোখেমুখে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘ভাইইইই! তুমি এখানে?’
আবরার নুরাকে ছাড়িয়ে হেসে উত্তর দিলো, ‘কেন? বাড়িটা কি তোর একার? আমি আসতে পারি না?’
খুশি হলো আরিয়ান। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। রাইমার চোখমুখ খুশিতে চকচকিয়ে উঠেছে। আবরারের মা নিশিতা ছেলে কে পেয়ে কেঁদে ফেললো একদম। পরিবারের সকলের অবস্থা খুশিতে কান্না প্রায়।
রিমি আর দীবা রুমে বসে ছিলো। নুরার চেঁচানোর শব্দ শুনে অবাক হলো দুজন। কাহিনী কি জানার জন্য তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো দুজন। সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত আসতেই থমকে গেলো তারা। রিমি তার ভাইকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো ‘ভাইয়া?’ বলেই তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে এসে আবরারকে জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে আত্মহারা প্রায়।
দীবা আবরারকে দেখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অসাড় হলো তার শরির। লোকটাকে সে মোবাইলে দেখেছে বহুবার। কিন্তু সামনা সামনি এই নিয়ে মাত্র কয়েকবার দেখা। বিয়ের পর আবরারের ভয়ংকর রা দেখে আবরারের প্রতি ভয় এসে হানা দিয়েছিল দীবার মনে। সেই ভয় আজ আবারো জেগে উঠলো। এই লোকটা তার স্বামী? বৈধ ভাবে বিয়ে হয়েছে তাদের। অস্বস্তি, ভয়, জড়তা কাজ করলো মনে। দীবা চুপচাপ শুকনো ঢুক গিললো। নিঃশব্দে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসলো। ভয়ে তার মাথা রীতিমতো ঘুরপাক খাচ্ছে। লোকোটা ফিরে এলো কেন? এখন কি তার উপর স্বামীর অধিকার খাটাবে? জোড় করবে তার উপর? ভয়ে হাত পা কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে। কপালে জমে এসেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বারবার শুকনো ঢুক গিলছে। আজ কিছুতেই সে দরজা খুলবে না। কিছুতেই না!
______________
এতোদিন পর বাড়ির বড় ছেলে ফিরে আসায় আদর যত্নে ব্যস্ত হয়ে পরলো নিশিতা আর আয়েশা। রান্নাঘরে বিশাল আয়োজন করতে ব্যস্থ দুজন। বিকেলে দীবার মা রোহানা ঘুমিয়ে ছিলো বিধায় আবরারের সাথে দেখা হয়নি তার। সন্ধ্যা রাতে নিচের নামার পর নিশিতা আবরারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো তাকে। আবরার বেশ সৌজন্যমূলক ভাবে পরিচিত হয়েছে রোহানার সাথে। রোহানার কথাবার্তা, আদর সব মিলিয়ে আবরারের পছন্দ হয়েছে বেশ। খুশী হয়েছে আবরার রোহানার সাথে কথা বলে।
রান্না বান্না শেষ! এবার রাতে খাবার সাজানোর আমেজ শুরু হলো। নিশিতা, আয়েশা আর রোহানা মিলে খাবার টেবিলে গুছিয়ে দিলো। টেবিলে সবাই বসলো খাবার খেতে। নিশিতা, আয়েশা ও রোহানা মিলে খাবার সার্ভ করে দিলে সবাই খাওয়া শুরু করে দিলো। আয়েশা আবরার কে নিজের ছেলের মতো আদর করে খাওয়াচ্ছে। নিশিতা আর আয়েশা দুই পাশে দাঁড়িয়ে এটা ওটা আবরারের মুখে পুরে দিচ্ছে। পাশে বসে থাকা আরিয়ান এইসব দেখে গালে হাত রেখে আফসোস করে বলে উঠলো, ‘বাহ্ বাহ্, এতো দিন বাড়িতে থেকেও এমন আদর যত্ন পেলাম না।’
সাবিতও আরিয়ানের সাথে তাল মিলিয়ে আফসোস করে বললো, ‘কি লাভ হলো এতো দিন বাড়িতে থেকে???’
আবরার ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। উত্তর দিল, ‘এতো দিন বাড়িতে ছিলাম না তাই সব আদর জমেছে। এখন বাড়িতে এসেছি আর সব আদর একসাথে পাচ্ছি!’
আরিয়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে আবারো বলে উঠলো, ‘এমন আদর যত্ন পেতে হলেও কয়দিন পর পর বাড়ি থেকে উধাও হতে হবে।’ হাসলো সবাই।
রাইমা ত্যাছড়া ভাবে বলে উঠলো,, ‘দেখা যাবে উধাও হয়ে ফিরে আসলে জুতা পিটার যত্ন কপালে জুটবে।’
রাইমার কথায় উচ্চস্বরে হেসে ফেললো রিমি, নুরা। ওরা মাত্রই এসেছিলো। দুজন চেয়ার টেনে বসে পরলো টেবিলে। রিমি আরিয়ান আর সাবিতের উদ্দেশ্যে বললো, ‘এতো হিংসুটে কেনো তোমরা?’
সাবিত অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো, ‘কে হিংসা করছে? এতো বড় অন্যায় হচ্ছে তোরা দেখিস না? আমাদের দুজনের সাথে এই অন্যায় মানা যায়? রাজপথে নামতে হবে দেখছি।’
আরিয়ানও সম্মতি দিয়ে বলে উঠলো, ‘অবশ্যই নামতে হবে। আপনারা তিন জন মিলে আমাদের দুজনের সাথে চরম লেভেলের অন্যায় করছেন। ইহা গ্রহণযোগ্য নহে।’
নিশিতা চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, ‘চুপ করবি তোরা? এমন করে বলছিস যেনো তোদের আমরা চোখেই দেখি না।’
নুরা হেসে বলে উঠলো, ‘বড় মা দেখবে কিভাবে? একটা মশার শরীর খালি চোখে দেখা যায় না। আরেকটা..’
নুরার কথার মাঝেই সাবিত নুরার চুল টেনে বললো, ‘তোরা নিজেরা কিরে? শরির দেখেছিস ভালো করে? আস্তো শুটকি। তোদের বয়সের মেয়েরা বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে মুটকুস হয়ে আছে। লজ্জা নেই এইসব বলতে?’
নুরা নিজের চুল ছাড়িয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো সাবিতের দিকে। নিশিতা অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বাবা তুমি বসে আছো কেন? খাবার পছন্দ হয়নি? খাচ্ছো না যে?’
অভ্র এতোক্ষণ তাদের ভাই বোনের ঝগড়া দেখছিলো আর হাসছিলো। এখন নিশিতার কথা কর্ণপাত হতেই মুচকি হেসে উত্তর দিল, ‘না আন্টি। খাবার পছন্দ হয়েছে।’
রোহানা অভ্রের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললো, ‘বাড়িটা নিজের মনে করে থাকো। কোনো সমস্যা হয়ে জানাবে কেমন?’
অভ্র মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। তখন আয়েশা রিমি আর নুরাকে জিজ্ঞেস করলো ‘তোরা একা যে, দীবা কোথায়?’
নুরা প্লেট হাতে নিয়ে উত্তর দিল, ‘আছে রুমেই। কয়েকবার ডেকেছি। বললো মাইগ্রেনের ব্যাথা নাকি উঠেছে তাই নিচে আসবে না।’
রিমিও সেম কথা বলে বললো, ‘খাবার দিয়ে দিও ছোট মা। আমি রুমে নিয়ে যাবো।’
তখন আরিয়ান সিরিয়াস হয়ে বলল, ‘আম্মু, দীবার মাইগ্রেনের প্রবলেম একটু বেশি মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় আরেক বার ট্রিটমেন্ট করানো দরকার।’
তখন পাশ থেকে রোহানা মেয়ের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে রাগি কন্ঠে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ মেয়ে যা ইচ্ছা তাই করবে আর ব্যাথা উঠলে ডক্টর দেখাবে। বিকেলে এতো করে বারণ করা পরেও গোসল করছে তাও এক ঘন্টা লাগিয়ে। আমার কথা শুনে? একটু পর দেখা যাবে আম্মু আম্মু বলে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছে।’
আবরার মনে মনে কয়েক বার ‘দীবা’ নামটা আওড়ালো। অতঃপর সেই দিকে পাত্তা না দিয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। রাতের খাবার খাওয়ার পর আবরার কে তার আগের রুমে থাকতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। অভ্র রিমির রুমের পাশে মানে একদম শেষের রুমে থাকবে।
আবরার নিজের রুমে এসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো একটা। ঘুরে ঘুরে পুরো রুমটা দেখল সে। কিছু কিছু জিনিস বদলে গেছে। তার ব্যবহৃত পুরনো কিছু জিনিস নেই। যার বদলে নতুন জিনিসের স্থান এখানে। পা বাড়িয়ে বারান্দায় গেলো আবরার। বারান্দায় কয়েকটা টবে ফুল গাছ রয়েছে। এই রুমটা অন্য কেউ ব্যবহার করেছে অনায়াসেই বুঝে গেলো। বারান্দায় কিছু সময় অতিবাহিত করে রুমে আসলো। লাগেজ থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে।
অভ্র তার থাকার রুমে এসেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পরলো। এতো বড় জার্নি শেষে এখন এতো এতো খাবার খেয়ে তার নিজেকে হাতি হাতি লাগছে তার। জামাই আদর করে খাইয়েছে মনে হচ্ছে। অভ্র ভাবছে এতো প্রানউজ্জ্বল পরিবার থাকতে আবরার কেন দূরে থাকে? আরিয়ান, সাবিতের সাথে অভ্রের ভালো ভাব হয়েছে। সবাই তো খুব ভালো তাহলে কেন হুদাই দূরে থেকে একাকিত্বের ভোগ করছে এবি? উত্তর মেলে নি তার। তাই মাথা থেকে এসব ঝেড়ে আপাতত ঘুমানোর প্রয়োজন মনে করছে সে। চোখ বন্ধ করে লম্বা দম নিয়ে ঘুনানোর প্রয়াস করলো অভ্র।
পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে দীবা। এক হাত কোমড়ে রেখে আরেক হাতের নখ কামড়াচ্ছে। সবাই কি শুয়ে পরেছে? দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালে দেখতে পেলো রাত বারোটা চল্লিশ। খাবার তো সন্ধ্যায় খেয়েছে সবাই। জার্নি করে এসে এতোক্ষণে নিশ্চয় শুয়ে পরেছে। জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলো। শুকনো ঢুক গিললো একটা। দরজা খুলে অল্প ফাঁক করে বাহিরে উঁকি দিলো। বাড়িটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। মৃদু আলোতে আনাচে-কানাচে ঝাপসা আলোকিত। কেউ নেই। ঘুমিয়ে পরেছে নিশ্চয়। নিশ্চিন্তে বাহিরে আসলো দীবা। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি ফেললো। লোকটার সামনে না পরলেই হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। চুপিচুপি পায়ের কদম ফেলে রিমির রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
যতোই জার্নি করুক না কেন এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যেস নেই আবরারের। ল্যাপটপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো। পানির পিপাসা পাওয়ায় খেয়াল করলো রুমের কোথাও জগ বা গ্লাস নেই। ইচ্ছে না থাকা পরেও রুম থেকে বেরুলো পানি আনার জন্য। বাহিরে এসে সিঁড়ির দিকে যাবে তখুনি দাঁড়িয়ে পরলো সে। মৃদু আলোতে একটা মেয়েকে স্পষ্ট দেখতে পেলো আবরার। এটা কে? রিমি নাকি নুরা? কিন্তু রিমি নুরার সাথে মিল পেলো না। তাহলে? ওই মেয়েটি? প্রশ্ন আসতেই ভ্রুঁ কুঁচকালো আবরার। এতো রাতে বাহিরে চুরের মতো কি করছে। দেখার জন্য নিজে একটু আড়াল হয়ে দাঁড়াল। দীবা আশেপাশে প্রখর করে রিমির রুমের কাছে গিয়ে দরজা ধাক্কালো। বেশ কয়েকবার নক করার পর রিমি দরজা খুললো। রুমের ভিতরে লাইট অন থাকায় রিমিকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে আবরার। তবে দীবার পিছনের দিকটা ছাড়া মুখ দেখেনি। সাদা টিশার্ট পরা একটা বাচ্চা মেয়ে। খুবই চিকন। স্বাস্থ্য নেই বললেই চলে। হাইট বোধহয় পাঁচ ফুট তিন চার। নুরার থেকে অনেকটা কম। আবরার দাঁড়িয়ে দেখলো দীবাকে। রিমি দরজা খুলার পরেই চটজলদি দীবা রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসলো আবরার। নিজের বাড়িতে এভাবে চুরের মতো হাঁটার মানে আছে? বিরক্তিকর!
#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-০৭]
আষাঢ় মাসের শুরু কেবল। আকাশে জমে আছে কালো মেঘ। তাদের আনাগোনার খেলা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। স্নিগ্ধ এই সকাল। চারপাশে শীতল হাওয়া বিরাজমান। গাছের কচি পাতা থেকে চুইয়ে ঝরছে শিশিরের ছোট ছোট বিন্দু কণা। শুভ্র কাদম্বরী দূর দূরান্ত থেকে দৃশ্যমান যেনো হাত বাড়ালেই তাদের ছোঁয়া। প্রত্যেকটা স্নিগ্ধ প্রভাত যদি চা দিয়ে আরম্ভ হয়; তাহলে সেই মুগ্ধতায় মন একদম চাঙ্গা হয়। রোজকার দিনের মতো আজও দীবা সবার জন্য চা বানালো। এক এক করে সবার রুমে চা পৌছে দিল সে। রিমির রুমে চা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় খেয়াল করলো অভ্রের রুমের দরজা খুলা। চা দিবে? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলো। যেহেতু এখন অতিথি সেহেতু চা দেওয়ায় যায়। তাই দীবা নিজে থেকে অভ্রর জন্য চা নিয়ে গেলো। দরজার কাছে এসে নক করলো দীবা। অভ্র বিছানায় বসে ইমেইল চেক করছিলো। দরজায় টোকা পরার শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে দরজা খুলার পর দীবা কে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো একটা। ঠোঁটে হাসি রেখেই সালাম দিলো। দীবা প্রত্যুত্তরে নম্রতার সাথে সালামের উত্তর দিলো। তারপর এক কাপ চা এগিয়ে দিলে অভ্র চা হাতে নিয়ে বললো, ‘ধন্যবাদ!’
দীবা স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইলো, ‘আপনি কি প্রতিদিন ভোরে উঠেন?’
অভ্র মাথা দুলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ! ভোরের এই সময়টায় আমি আমার একাংশ কাজ শেষ করি। এইসময় ব্রেইন এক্টিভ থাকে। তাই রিলেক্সে ইজিলি কাজ কমপ্লিট করা যায়।’
দীবা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘তাহলে প্রতিদিন সকালে এক কাপ চা আপনার জন্য বরাদ্দ।’
বিনিময়ে অভ্র মুচকি হাসলো। কিছুটা প্রফুল্লিত হয়ে বললো, ‘ঠিক আছে ভাবি। আব্ মানে..!’
ভাবি বলে নিজেই হকচকিয়ে গেলো অভ্র। কিছুটা আমতা আমতা করতে লাগলো। দীবা স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘আমাকে দীবা বলে ডাকতে পারেন। আমি আপনার থেকে অনেক ছোট।’
অভ্র মাথা কাত করে ‘আচ্ছা’ সম্মতি জানালো। দীবা চুপচাপ চলে আসলো সেখান থেকে। অভ্র রুমের দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসলো। মনে মনে ভাবলো মেয়েটা বেশ ভালো আর মিশুক বটে। দেখতে এতোটাও খারাপ না। এবি মেনে নিলো না কেন? সেদিনের ঘটনায় অভ্র উপস্থিত ছিলো বিধায় সে সবই জানে। এমনকি দীবাকেও দেখেছে সে। কয়েকবার কথাও হয়েছিলো। তাই চিনতে ভুল হয়নি। এতো কিউট আর মিশুক মেয়ের প্রেমে এবি কিভাবে না পরে থাকে দেখবো। ভাবতেই হেসে উঠলো অভ্র।।
দীবা গায়ে ওড়না ভালো ভাবে পেঁচিয়ে বাগানের দিকে যাচ্ছে। যেতে যেতে অভ্রর বলা ‘ভাবি’ ডাকটা নিয়ে ভাবতে লাগলো দীবা। সে তো একমালুম ভুলেই গেছে যে সে বিবাহিত। তিন মাস আগে আবরার নামে এক ব্যক্তিকে সে কবুল বলে স্বামী হিসেবে গ্রহন করেছে। অথচ যার নাম ছাড়া আজ অব্ধি কিছুই জানে না। সেই ঘটনা পর রুমে বসে প্রচুর কেঁদেছিল দীবা। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো হঠাৎ এমন হওয়ায়। অতঃপর নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলো। তখন রাতে ড্রয়িংরুম থেকে ভাঙ্গচুর আর চেঁচামিচির আওয়াজে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। উপর থেকেই নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে ড্রয়িংরুমে আবরারের রা’গা’রা’গি দেখলো দীবা। ওইদিন আবরার তার ভয়াংকর রাগ বহিঃপ্রকাশ করে যা দীবার মনে গভীর দাগ কাটে। প্রচুর ভয় পেয়ে যায় সে আবরার কে। কাল বিকেলে আবরার আসার পর থেকে সে রুম থেকেই বের হয়নি। আর আজ মনে মনে দো’য়া করছে যেন আবরারের সামনে যেন ভুলেও না পরে।
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাগানে চলে এসেছে টের পায়নি দীবা। মালি জসিম মিয়ার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গলো তার। জসিম মিয়া কে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে আসলো। তারপর হলুদ রঙের গোলাপ ফুল গাছে পানি দিতে দিতে বললো, ‘চাচা? আমার মনে হয় গোলাপ গাছের পাতা গুলো ছাঁটিয়ে দিতে হবে। মোজাইক পরেছে। নাহলে বাকি গাছ গুলো নষ্ট হয়ে যাবে।’
মালি জসিম মিয়া আফসোস করে বললেন, ‘এতো যত্ন করার পরে গাছের এই অবস্থা? অথচ রাস্তার অপর পাশের গাছ গুলো দেখো। কেউ কোনো যত্ন করে না। কিন্তু কতো সুন্দর।’
দীবা হেসে প্রতিত্তুর করলো, ‘অতিরিক্ত যত্নে থাকা জিনিস কখনো মূল্য দিতে বুঝে না।’
জসিম মিয়া মাথা দুলালেন। দীবার সাথে কথা বলতে বলতে বাগান পরিচর্যা করতে লাগলেন।
_______________
পরিচিত হলেও আজ এই কক্ষ আবরারের জন্য বড্ড অচেনা। একদম নতুনত্ব। এই রুমে আবরার আগে থাকলেও অভ্যেস বদলে গেছে। নতুন জায়গা, নতুন বিছানায় ঘুমানো কষ্ট হয়ে গেছে। সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। শেষরাতে একটু ঘুমিয়েছিলো। কিন্তু ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার। এই মুহূর্তে কড়া করে এক কাপ কফি হলে ভালো হতো। কিন্তু কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করে না। তাই উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই মৃদু শীতল বাতাস গায়ে লাগলো। ফুরফুরে হয়ে গেলো মন। বাহিরে সূর্যের আলোতে পরিবেশ আলোকিত হয়ে আছে। আবরার আড়মোড় ভাঙ্গলো। আশেপাশে তাকাতেই বাগানের এক পাশে চোখ আটকে গেলো তার। ছোট গোলগাল মায়াবী এক মুখশ্রী জসিম কাকার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর গাছে পানি দিচ্ছে। পরনে তার শুভ্র রঙের থ্রি-পিস। চুল গুলো উঁচু করে কাঠি দিয়ে খোঁপা বাধা। আবরার রেলিঙে দুই হাত ভর দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকালো সোনালি রৌদ্দুরে আলোকিত হয়ে থাকা এই রমনীর দিকে। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো আবরার। হঠাৎ মনে হলো পাশে থাকা সাদা নয়নতারা ফুল ছিঁড়ে যদি তার কানে গুঁজে দেওয়া হতো তাহলে এই মুখশ্রীর সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বেড়ে যেত! অথবা বেলী ফুলের মালা যদি খোঁপায় বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে? নিশ্চয় আরো সুন্দর লাগবে। আবরারের অবাধ্য মন মেয়েটির মায়াবী মুখশ্রী ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা পুষণ করলো। হঠাৎ নিজের এমন বেহায়াপনায় হকচকিয়ে গেলো আবরার। রেলিং থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এক হাত দিয়ে মাথা চুলকিয়ে নিজের এই অধম মন কে কয়েকটা গালি দিল। মেয়েটি কে? কথাটি মাথায় আসতেই সজাক হলো তার মস্তিষ্ক। আপনা আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘দীবা?’ অবাক চোখে দীবার দিকে তাকালো আবরার। এবার চোখ ছোট ছোট করে ভালোভাবে দেখতে লাগলো দীবাকে। অতঃপর বিড়বিড় করে বলে উঠলো ‘বউ আমার ভালোই সুন্দরী!’ আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ভিতরে চলে আসলো। কিছুক্ষন আগে নিজের এহেন কান্ডে নিজেই বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুমে গেলো। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। রুম থেকে বের হয়ে অভ্রকে সাথে নিয়ে আবরার ড্রয়িংরুমের আসলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ড্রয়িংরুমে রোশান ও হোসেন কে দেখতে পেলো। দুইজন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কাল অনেক বড় জার্নি করে এসেছিলো বিধায় আবরার ও অভ্র তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেছে। আর রোশান ও হোসেন দুইজনই দেড়ি করে বাড়িতে এসেছে। যার জন্য তাদের দেখা হয়নি। আবরার কে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে হোসেন হেসে এগিয়ে এলো।
‘হ্যালো ইয়াং বয়’স, কি অবস্থা তোমাদের?’
আবরার, অভ্র এক গাল হেসে হোসেনের সাথে কোলাকোলি করলো। উত্তরে বললো, ‘এইতো ভালো। তোমার?’
‘ভালো!’
অতঃপর হোসেনেত সাথে অভ্রের পরিচয় করিয়ে দিলো আবরার। অভ্র নম্রতার সাথে দুজনের সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ শেষ করলো। অভ্রের সাথে আলাপ শেষে আবরার রোশানের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে সালাম দিয়ে বললো, ‘কেমন আছেন?’
রোশান গম্ভীর মুখে সালামের উত্তর নিয়ে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’
আবরারের আপনি সম্মোধন টা রোশানের পছন্দ হয় নি। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় আদর বেশি পেয়েছে আবরার। অন্যরা তাদের দুই জনকে আপনি করে সম্মোধন করলেও আবরার তুমি করে ডাকতো। আর বাবা ছেলের মাঝে বন্ধুত্বসুভল সম্পর্ক ছিলো একসময়। কিন্তু ছোট্ট একটা ঘটনা কেন্দ্র করে বাবা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে বহু বছর আগে। ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেলে রোশান। আবরারও আর কথা বাড়ায় নি।
হোসেন বাবা ছেলের অবস্থা বুঝতে পেরে কথার প্রসংজ্ঞ বদলাতে আবরারকে বলে উঠে, ”তোর গায়ে সেলেব্রিটি সেলেব্রিটি গন্ধ আসছে। ঢাকা গিয়ে বদলে গেছিস একদম।”
কাকা ভাতিজার মাঝে কিছুক্ষণ রশিকতা চললো। অতঃপর রোশান হোসেন অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো। এর কিছু সময় পর আরিয়ান সাবিত নিচে নামলো। চারজন মিলে কথা কিছুক্ষণ আলাপ করলো। রাইমা নিচে নামতেই সবাই নাস্তা করতে টেবিলে বসলো।
_______________
দীবার ওয়াশরুমের দরজার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিমি ও নুরা। দুইজনই বিরক্ত, রাগান্বিত। দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে আছে তারা। সেই কখন থেকেই ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছে দীবা। সময় চলে যাচ্ছে অথচ দীবা বের হচ্ছে না। সহ্য হলো না আর। ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নুরা চেঁচিয়ে উঠলো, ‘সমস্যা কি রে বইন? ওয়াশরুমেই কি সংসার পেতে বাচ্চা পয়দা করবি তুই?’
রিমিও রাগে দরজায় লাথি দিয়ে বলে উঠলো, ‘দীবানির বাচ্চা, তুই কলেজ যাবি না তো তোর ১৪ গোষ্টি কলেজে যাবে। এক্ষুনি বের হ তুই।’
নুরা কপাল কুঁচকে রিমির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘১৪ গোষ্টি কলেজ যাবে কেন? আমরা তিন জন যাবো শুধু।’
রিমি নুরার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। তারপর আবারো দরজায় ধাক্কা দিল। ওয়াশরুমের ভিতরে দীবা হাই-কমোডে পা তুলে কাচুমুচু হয়ে বসে আছে। গায়ে কলেজ ড্রেস পরা, চুল গুলো এক পাশে এনে ঝুটি করে রেখেছে। বের হবে না কিছুতেই। নাস্তার টেবিলে গেলে ওই লোকটার সাথে দেখা হবে। তার থেকে থেকে হাজার গুণ ভালো কলেজেই যাবে না দীবা। সারাদিন রুমে বসে থাকবে। তাই দরজা খুলছে না। কিন্তু রিমি ও নুরা যে নাছোড়বান্দা। তারা দুইজন দীবাকে নিয়ে নাস্তা করবে, কলেজেও যাবে। কিছুতেই দীবাকে রেখে যাবে না তারা। তাই বারবার দরজা ধাক্কাতে লাগলো। কিছুটা বিরক্ত হলো দীবা। ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বললাম তো যাবো না আমি। তোরাই যা।’
রিমি জানতে চাইলো, ‘কেন যাবি না? কারণ বল আগে।’
দীবা পূর্বের ন্যায় চেঁচিয়ে বললো, ‘বলবো না।’
নুরা বললো, ‘তুই বের হ বলছি।’
হতাশ হলো দীবা। উঠে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনুনয় স্বরে বললো, ‘যাবো কিন্তু একটা শর্তে।’
নুরা রিমি আগ্রহপূর্ণ চোখেমুখে দ্রুত দরজার একদম কাছে এসে বললো, ‘কি?’
‘আমাকে নাস্তা করার জন্য জোড় করবি না। আমি ডিরেক্ট গাড়িতে গিয়ে বসে থাকবো। তোদের নাস্তা শেষ হলে চলে আসবি।’
নুরা রেগে কিছু বলতে যাবে তখুনি তার হাত ধরে থামিয়ে দিলো রিমি। চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললো। তারপর দীবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘ঠিক আছে। আমরা নাস্তা করতে যাচ্ছি। তুই বেড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে বস।’
বলেই পা দিয়ে একটু শব্দ করলো। সাথে নুরাও। কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ থামিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমের দরজার দুই পাশে দাঁড়িয়ে রইলো দুইজন। বেশকিছু সময় ধরে রিমি নুরার সাড়াশব্দ না পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। লম্বা দম নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো। তখুনি পাশ থেকে নুরা দীবার হাত ধপ করে ধরে বললো, ‘এবার কোথায় যাবে বাবু?’
চলমান…
চলমান..
নোট : ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি