#আসক্তি২
পর্বঃ৪১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
দিন চলে যায় নিজস্ব গতিতে।কারো দূঃখ-সুখে তার স্থায়িত্বের হেরফের হয় না।মানুষ বরাবরই মনে করে সুখের সময় গুলো তাড়াতাড়ি কাটে ;আদৌ কি তাই!
সে তো আপন গতিতে অগ্রসর হয়েই চলেছে।
শীতের চাদরে ঢেকে উঁকি দেয় একটা মিষ্টি সকাল।গ্রামে শীতের পরিবেশ টা অনেক সুন্দর হয় শহুরে জীবনের তুলনায়।ঘাসের উপর শিশির বিন্দুর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা নজর কারে প্রতিটা প্রকৃতিপ্রেমীর।গ্রামে থাকাকালীন এই সময়টা বেশ উপভোগ করতো পাখি।সকাল সকাল বাড়ির পাশের খোলা মাঠটায় কিছুক্ষন খালি পায়ে না হাঁটলে তার দিনই শুরু হতো না।শহরের যান্ত্রিক জীবনে সেসব না থাকলে কি হবে শখ তো ঠিকই আছে।তাই শখ পূরনে পাখি সকালে উঠেই আজ ছাদে এসেছে।এতো সকালে ইদানিং শানও আর ঘুম থেকে ওঠে না।
ছাদে কয়েক প্রজাতির গাছ লাগিয়েছে পাখি।শানও খুশি খুশি সেসব এনে দিয়েছে।একটু হেঁটে এগিয়ে যায় গাছ গুলোর কাছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই পাতায় জমে থাকা পানিগুলো ভালোবেসে ভিজিয়ে দেয় পাখির হাত।বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি জেগে ওঠে।একটু এগিয়ে রেলিং এর কাছে যেতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে,চোখের দুই কোণ কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়।মাথাটা চেপে ধরে সোজা বসে পরে পাখি।এই সমস্যা আজ কয়েকটা দিন ধরেই হচ্ছে তার। শানকে যদিও বুঝতে দেয় নি তবুও দিনে কয়েকবার করে জানতে চেয়েছে শরীর খারাপ কিনা।
আর পাখি বরাবরই ব্যপারটাকে এড়িয়ে যায়।
ইদানিং খাবার দেখলে কেমন যেন বমি বমি পায় পাখির।বেশি কোলাহল পছন্দ হচ্ছে না।খাবারে রুচি নষ্ট হওয়াতে শরীরেও তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।দিনকে দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে।কারো সঙ্গ ভালো লাগছে না।যদিও ব্যপারগুলোর সাথে পাখির পূর্বপরিচয় ছিলো না তবুও এ ছোটখাটো ব্যপার শানকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করে নি।কারণ জানালেই একগাদা ঔষধ এনে ঘরে রাখবে।
🌸🌸
আজ রনি-রাখির বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হবে।আবারও বৈঠকে বসেছে সকলে।পাখি, রাখির পাশে বসে বসে সবার কথা শুনছে।কেমন যেন সবকিছুই বিরক্ত লাগছে পাখির।বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ মুখেও দেখা যাচ্ছে।শান সেদিকে আড়চোখে চেয়ে ভ্রুকুটি করে নেয়ে।তবে কিছু বলে না।
অনেক আলোচনার পর আগামী মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার অর্থাৎ ১৪ তারিখে বিয়ের দিন নির্ধারন করা হয়।
শানের ফোনে কারো কল আসায় শান উঠে চলে যায়।হঠাৎ বমির উপক্রম হয় পাখির।মুখ চেপে ধরে সংবরনের চেষ্টা করে। সবাই আতঙ্কিত চোখে তাকায় পাখির দিকে।সকলের দিকে একবার তাকিয়ে পাখি ওয়াশরুমের দিকে ছোটে।শর্মিলা, রাহেলা, রাখি সবাই পাখির পিছনে ছুটে আসে।
কিছুক্ষণ পর পাখি বেরিয়ে আসলে শর্মিলা কপালে, গালে হাত দিয়ে ভয়ার্ত মুখে প্রশ্ন করে,”বউ মা তোমার কি শরীর খারাপ?”
“না মা,সেরকম টা নয়”, কন্ঠের স্বর খাঁদে ফেলে জবাব দেয় পাখি।
রাহেলা শর্মিলাকে কি যেন ইশারা করে।শর্মিলা চট করে বলে, ” মা পিরিয়ড হয়েছে লাস্ট কবে?”
পাখি লজ্জায় এদিক সেদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয়।রাখি এসে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,”আন্টি আমি দেখছি”
রেহানা হক বেশ বিচক্ষণ মানুষ।তিনি একদৃষ্টে পাখির আগা-গোড়া দেখে চট করে বলেন, “না, আমি কথা বলছি পাখির সাথে”
বলেই হাত টেনে নিয়ে যায়।পাখি হকচকিয়ে পিছন ফিরে সবার দিকে দেখে নেয়।ঠোঁট উল্টিয়ে রাখির দিকে তাকায়।
“পাখি বমি কি আজই প্রথম হলো?”, পাখির দিকে ঝুঁকে এসে বলে রেহানা।
চকিতে মাথা তুলে কম্পিত দৃষ্টিতে চেয়ে পাখি বলে,” না, আজ কয়েকদিন ধরেই এমন হচ্ছে”
“আরো কোন সমস্যা? ”
“সমস্যা বলতে, খাবার দেখলেই কেমন যেন উল্টি আসে,বমি বমি লাগে,গা গুলিয়ে আসে।”
“আর?”, আগ্রহ ভরা চোখে প্রশ্ন করে রেহানা।
পাখি একবার তাকিয়ে রেহানাকে দেখে নিয়ে বলে,” মাথাটাও চক্কর দিচ্ছে ক’দিন ধরে”
“গত মাসে কি মিস গেছিলো মা?”
পূনরায় লজ্জায় পরে যায় পাখি।রেহানা ওর হাত দুটো ধরে আশস্ত করে বলে,”তুমি তো আমার মেয়ের মতো।আর মাকে সব কথাই বলা যায়”
“না, মিস যায় নি।হয়েছিল তবে বরাবরের মতো না”
রেহানা হেসে ওঠে।পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”নতুন কিছুর জন্যে তৈরী হও মা”
পাখি বুঝতে পারে না রেহানা ঠিক কি বোঝাতে চাইছে।অবুঝের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
রেহানা সেখানে আর এক মূহূর্ত দেরি না করে সবার মাঝে চলে আসে।
“আপা মিষ্টি নিয়ে আসেন”, শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে রেহানা।
শর্মিলার চোখমুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে।রনি আর খান সাহেব একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।কারণ তারা কিছুই বুঝতে পারছে না।ইনায়াহ্ রনির কোলে বসে সবার দিকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে সবটা।
একটু পরে পাখি চলে আসলে রাখি গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,” কংগ্রাচুলেশনস ডার্লিং ”
পাখি মুচকি হাসি দিয়ে রাখির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
শর্মিলা উঠে এসে পাখিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।ছলছলে চোখে বলে,”আমিও ধারনা করেছিলাম আমি দাদি হতে চলেছি”
বুক কেঁপে ওঠে পাখির।সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় মূহূর্তে।এইখানে উপস্থিত কেউ না জানুক সে তো জানে এটা আদৌ সম্ভব নয়।চোখে মুখে বিষাদের তিক্ত বলিরেখা স্পষ্ট হয় পাখির।আনমনে বিড়বিড় করে,”এটা কি করে সম্ভব?কোথাও কোন ভুল নিশ্চই হচ্ছে।আমি কোনদিনও মা হতে পারব না”
“আমরা তো অভিজ্ঞতা থেকে বললাম। তবে তুমি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে টেষ্ট করিয়ে নিও পাখি”,রেহানার কথায় পাখি সম্বিৎ ফিরে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়।রাহেলা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বলে,” অনেক সুখী হও মা”
শর্মিলা একটু এগিয়ে এসে সোফায় বসা রনি আর খান সাহেবকে খবরটা দিতেই খুশিতে লাফিয়ে ওঠে রনি।ইনায়াহ্’র কাছে গিয়ে শর্মিলা বলে,”দাদুভাই তোমার একটা ছোট্ট বোন আসতে চলেছে”
ইনায়াহ্ দৌঁড়ে গিয়ে পাখির কোমড় জড়িয়ে ধরে।খুশি হয়ে বলে,”আমার ফ্রেন্ডদের সবার ছোট বনু, ভাই আছে।আমারই ছিলো না মুন সাইন।এখন আমারও হয়ে গেছে…..ইয়েএএএ”
এতোসবের কোন প্রভাবই পাখির উপর পরছে না।সে জানে সে কখনোই মা হতে পারবে না।তাহলে তার শরীর খারাপের কারণ কি?
“মা আমি একটু ঘরে যাই।শরীর খারাপ লাগছে”, দূর্বল চিত্তে জানিয়ে পাখি উপরে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হয়।
খান সাহেব বলে ওঠেন,” হ্যা মা তুমি উপরে যাও।আর বেশি উঠা নামা করো না।রেষ্ট করো তুমি”
পাখি স্মিত হেসে মাথাটা হালকা বামে হেলিয়ে উপরে চলে যায়।
🌸🌸
“আমার একটা হেল্প করতে পারবি?”
“কি হেল্প, বল না”
“আজ আসার সময় একটা প্রেগন্যান্সি স্ট্রীপ নিয়ে আসতে পারবি?”
“সেটা তো তোর ডাক্তার সাহেবও এনে….. ”
“আমি তোকে বলেছি না, তুই নিয়ে আসবি”
“ওকে ”
বলেই কল কেটে দেয় রাখি।
পাখি সমানে ঘরের মেঝেতে পায়চারী করছে।
এমডি’র পদে প্রোমোশন হওয়ার পর শানের ব্যস্ততা বহুগুনে বেড়ে গেছে।খুব একটা সময় এখন আর বাসায় দিতে পারে না সে।গত রাতে শানকে সবটা বলতে চেয়েছিলো পাখি কিন্তু শান রাতে বড্ডো ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে।পরে আর কিছু বলা হয় নি।আর আজ সকালেও বেশ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় ।
সকাল ১১ টার দিকে রাখি চলে আসে।পাখি হন্তদন্ত হয়ে রাখির থেকে কীটটা নিয়ে নেয়।অবাক চোখে চেয়ে পাখির কান্ড দেখে রাখি।
কিছুক্ষন পর ওয়াশরুম থেকে থমথমে মুখে বের হয় পাখি।
“কিরে…..না?”
পাখি কিছু না বলে কীটটা এগিয়ে দেয় রাখির দিকে।খুশিতে ঝলমল করে ওঠে রাখির চোখ মুখ।পাখি বিরসবদনে সিঙ্গেল সোফাটায় গিয়ে বসে।হাতে কপালে ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
“আমি কালও দেখেছি তোর মন খারাপ ছিলো,আজও দেখছি মন খারাপ।ব্যপার কি বলতো?তুই কি এখনি বাচ্চা নিতে চাস না?”, পাখির পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে রাখি।
পাখি মাথা তুলে তাকিয়ে রাখির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলে,” এটা কোনভাবেই সম্ভব না রে রাখি।আমি কোনদিনও মা হতে পারব না।কারণ ডাক্তার সাহেব কোনদিনও বাবা হতে পারবেন না”
রাখির মাথায় বাজ পরে যায়।পায়ের তলার মেঝেটা নড়বড়ে মনে হচ্ছে।হাঁটু গেড়ে বসে বলে,”এসব কি বলছিস তুই?”
“হুমম, ঠিকই বলছি।এক্সিডেন্টে উনি বাবা হওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে”
“আগে জানতি?”
“হ্যা সবটা জেনেই বিয়ে করেছি আমরা”
অবাক হয় রাখি।সবটা জেনে কি করে কোন মেয়ে বিয়েতে জড়াতে পারে এটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর পাখি ছলছলে চোখে বলে,”এটা কি হলো রে রাখি।উনি কি আমায় ভুল বুঝতে চলেছেন?”
রাখি বুঝতে পারে না এই সময় পাখিকে কি বলে শান্তনা দেয়া উচিত।রাখিকে নিরুত্তর দেখে পাখি আবারও বলে,”আমার তো নিয়মিত…..”
“শোন, মা বলেছে অনেকের নাকি নিয়মিত পিরিয়ডের পরেও প্রেগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।তবে প্রেগন্যান্সির তিন চার মাসে এসে সেটা টোট্যালি বন্ধ হয়ে যায়।”
পাখি মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে।
“বিশ্বাস কর রাখি, ডাক্তার সাহেব ছাড়া আমি কোন পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই নি”, কেঁদে কেঁদে বলে পাখি।
কপোট রাগ দেখিয়ে রাখি বলে,” এসব কেউ তোকে বলেছে?এতো নোংড়া চিন্তা তোর ব্যপারে কেউই মাথায় আনবে না”
“আমি কি করব রে?”, অসহায় চাহনীতে তাকায় রাখির দিকে।
রাখির মনে এখন আরেকটা দূঃচিন্তা ছেঁয়ে যায়,” পাখি যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে গর্ভে কি?অন্য কোন রোগ বাসা বেঁধে নেই তো?”
“কিছু বলছিস না কেন!কি করব আমি?”
পাখির ডাকে ভাবনায় ছেঁদ পরে রাখির।হকচকিয়ে নজর ঘুরিয়ে বলে,”আচ্ছা ভাইয়ার যে এই প্রবলেম সেটা কিভাবে জানলো?”
“এক্সিডেন্টের পর তার বাবা নাকি বলেছে।”
“রিপোর্ট গুলো কোথায়?দেখাতে পারবি?”
“কেন?কি করবি সেসব দেখে”
রাখি উঠে দাঁড়িয়ে ভাবুকের মতো বলে,”শোন, যে মানুষটা গুছিয়ে এতোটা মিথ্যে বলতে পারে আর সে মিথ্যেকে ষোল টা বছর সত্যি বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারে তার কাছে এটা কোন ব্যপারই না।এমনও তো হতেই পারে নীরাকে বিয়ে করার জন্যেই তিনি তোর ডাক্তারকে মিথ্যে বলেছে”
“উুহু,উনি নিজেই রিপোর্ট দেখেছে আর আমাকেও দেখিয়েছে।সেখানে স্পষ্ট লেখা তিনি বাবা হওয়ার এবিলিটি হারিয়ে ফেলেছে।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কিভাবে কি হলো রাখি!তাকে কি জবাব দেবো আমি? “, শেষের কথাটা বেশ আতঙ্কিত ও ভয়ার্ত কন্ঠে বলে পাখি।
🌸🌸
সারাদিনের দূঃচিন্তায় শরীরের অবস্থা আরো খারাপের দিকে এগিয়েছে পাখির।বিছনা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছে না ।কেমন যেন অবসাদ অবসাদ লাগছে।রাহেলাও পাখির কাছে ইনায়াহ্’কে তেমন একটা ঘেঁষতে দেয় নি।প্রথম প্রথম সবকিছুই খারাপ লাগে ভেবে পাখিকে একা থাকতে দিয়েছে।
শান আজ সন্ধ্যেবেলা বাড়ি চলে আসে।ড্রয়িংরুমে ইনায়াহ্ পড়ছে আর রাহেলা বসে বসে সেসব দেখছে।
” পাখি কোথায় চাচি?”
সহাস্যে রাহেলা জবাব দেয়,”ঘরে শুয়ে আছে বাবা”
“এই অবেলায় শুয়ে…!”, ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে শান।
রাহেলা হয়ত বুঝতে পারলো,পরোক্ষনে জবাব দিলো,” এ সময় এরকম একটু আকটু হয়।তুমি ঘরে যাও বউ মা’র সাথে থাকো সবসময়।”
শান কিছুই বুঝতে পারলো না।
“কি হয়েছে চাচি, ওর কি শরীর খারাপ?”
“ঘরে যাও বুঝতে পারবে”, মিটমিট করে হেসে জবাব দেয় রাহেলা।
শান আর কিছু না বলে উপরে চলে যায়।ঘরের দরজায় পা ফেলে সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই বুঝতে পারছে না।ফোনের লাইট জ্বালিয়ে ঘরের সুইচ টিপতেই পাখি ফট করে শানের দিকে ফেরে।হতবাক হয়ে যায় শান।দৌঁড়ে পাখির কাছে চলে যায়।
” এই কি হইছে তোমার, পাখি….দেখি এদিকে ঘোরো দেখি ” হন্তদন্ত হয়ে বলে পাখির মুখটা ঘুরিয়ে দেয়।চোখ মুখে ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। চোখের পাতায় এখনো পানির কয়েকটা বিন্দু।
শান সেগুলো দুহাতে মুছে করূন চাহনীতে বলে ,”কি হইছে তোমার? এভাবে কেন কেঁদেছো?”
পাখি নিজেকে ধাতস্ত করে সাবধানে একটু সরে আসে শানের থেকে।শান ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে আবারও নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়।
“ক’দিন ধরে খুব ব্যস্ততার মাঝে আছি জান।তোমার দিকে খেয়াল করার সময়ই পাই নি।সরি আর কখনো এমন হবে না”,বলতে বলতে পাখিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
শানের বুকে মুখ গুঁজে হুহুস্বরে কেঁদে ওঠে পাখি।যে কান্না শানের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে তোলে।মাথা বরাবর চুমু দিয়ে বলে,” বলছি তো আর কখনো হবে না”
পাখির কান্নার বেগ দ্বিগুন বেড়ে যায়।মনে মনে বলে,”সত্যিটা জানলে আমায় ভুল বুঝবেন নাতো?এই বুক থেকে আমায় সরিয়ে দিবেন নাতো?”
ভাবতে ভাবতে শানের কলার শক্ত করে চেপে ধরে পাখি কেঁদে ওঠে।
একটু পরে শান ওকে বুক থেকে সরিয়ে সামনে বসিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।হাসির রেখা ঠোঁটে এনে বলে,”এতো সামান্য কারনে মন খারাপ করে কেউ হুমমম”
পাখি পানিতে টইটম্বুর চোখ দুটো তুলে তাকায় শানের দিকে।
“ওকে ওকে সরি, এটাই বিরররররাট কারণ মন খারাপ করার”, দুই হাতে কানে চিমটি কেটে বলে শান।
পাখি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠে।শান কপালে একটা চুমু দিয় বলে,” এভাবে কেঁদো না। আমার খুব কষ্ট হয়”
“একটা কথা বলব?”, কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে পাখি।
শান পাখির দুইহাত হাতের মুঠোয় ভরে বলে,” হাজার টা”
ইতস্ততভাবে পাখি নজর এদিক সেদিক করে।
“কি হলো, বলো না কি বলবা?”
“আপনি কি কখনোই বাবা হতে পারবেন না?”, চোখ মুখ খিঁচে কথাটা উগড়ে দেয় পাখি।
শান চট করে ওর হাত দুটো মুক্ত করে উঠে দাঁড়ায়।শুকনো ঢোক গিলে বলে,” সেদিন না বললে এ কথার পুনরাবৃত্তি হবে না কখনো।আজ আবারও…..!এই কারণেই আমি বিয়ে নামোক সম্পর্কে জড়াতে চাই নি পাখি”
পাখি একরাশ বিব্রতবোধ নিয়ে শানের কাঁধে হাত রেখে বলে,”কোথাও কোন ভুল হচ্ছে নাতো!”
“কি রকম?”,পাখির দিকে মুখ করে বলে শান
পাখি শুকনো ঠোঁটটা জিহ্বায় ভিজিয়ে বলে,” এমনও তো হতে পারে আপনার মেডিকেল রিপোর্টটা ভুল।”
ভ্রুকুচকে পাখির দিকে তাকায় শান।পরোক্ষণে হেসে বলে,”আমরা মিরাকলে বিশ্বাস করি।তুমিও তাই চাইছো আমি বুঝতে পেরেছি”
“না মানে, সেরকম টা নয়।আপনার বাবা যেমন এতো বড় একটা সত্যি হাজার হাজার মিথ্যে দিয়ে এতোগুলো বছর লুকিয়ে রাখতে পেরেছেন তেমন যদি আপনার মেডিকেল রিপোর্টের ব্যপারেও হয়!”
কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া সোজা করে শান বলে,”তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি”
“যদি জানতে পারেন আপনার বাবা মিথ্যে বলেছে যে, আপনি কোনদিনও বাবা হতে পারবেন না তখন কি কর……”
“যদি এরকম টা হয় তাহলে পৃথিবীতে আমার থেকে খুশি মনে হয় না আর কেউ হবে।কিন্তু সেটা হবে না জান”, পাখির মুখটা দুইহাতে তুলে বলে শান
একটু সরে এসে হাতের ঘরিটা, চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে,” রিপোর্টে আমি নিজেও চোখ বুলিয়েছি।ফলাফল শূন্য।রিপোর্টে স্পষ্ট সবটাই লেখা আছে”
বলেই পাখির নাকটা টেনে দেয় শান।সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলে দিতে ইশারা করে বলে,”এক্সপেকটেশন কিলস হ্যাপিনেস….তাই এই আশাটা রেখো না।তবে তুমি চাইলে আমরা অন্য ব্যবস্থা নিতে পারব”
পাখি শার্টের বোতাম খুলে শার্টটা খুলে দেয়।চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ তার।ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে,”আমি তো কোন অন্যায় করি নি তাহলে ভয় কেন পাচ্ছি?”
আপনাআপনি হাতটা পেটের উপর চলে যায় পাখির।একদৃষ্টে মেঝের দিকে তাকিয়ে ভাবে,”তাহলে আমার পেটে কি!”
“কিসের এতো দূঃচিন্তা করছো?দেখেছো শরীরের অবস্থা কি হয়েছে তোমার?কিছু জিজ্ঞেসা করলেও বলছো না।আমায় কাছে ঘেঁষতেও দিচ্ছো না তেমন”
শানের কথায় চমকে ফিরে স্মিত হেসে পাখি বলে,”কিছু না”
🌸🌸
আধাঘন্টা পর শান ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়।তোয়ালে টা এগিয়ে দেয় পাখির দিকে।বিছানায় বসে মাথা এগিয়ে বলে,”আমি একজন ডাক্তার পাখি।ভুলে যেও না।কোন সমস্যা হলে তোমার আমার সাথে শেয়ার করা উচিত”
পাখি মাথাটা মুছিয়ে এগিয়ে যায় ড্রয়ারের কাছে। ভাবতে থাকে কিভাবে সে কি করবে?কিভাবে জানাবে শানকে।
শান যদি ভুল বোঝে!ভুল বুঝে সারাজীবনের মতো ত্যাগ করে!
এমন হাজারও দ্বিধাদ্বন্দে পরে যায় পাখি।
শান একটু এগিয়ে এসে দেখার চেষ্টা করতেই পাখি শানের মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ায়।
কাপা কাপা হাতে স্ট্রিপ নিয়ে আবারও ওয়াশরুমে চলে যায়।তখনও প্রেগন্যান্সি পজিটিভই আসে।আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরে পাখি।দরজা চাপড়িয়ে শান উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,”পাখি কি হলো তোমার?দরজা খোল?”
দুই তিন বার দরজা ধাক্কাতেই ফট করে দরজা খোলে পাখি।
চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে পুরো।থমথমে মুখে হাতের স্ট্রিপ টা এগিয়ে দেয় শানের দিকে।শান হাত বাড়িয়ে সেটা নেয়।
#আসক্তি২
পর্বঃ৪২(বোনাস)
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
“কি এইটা?”,মুখে হাসি, মনে সংশয় দ্বিধান্বিত মিশ্র অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে শান।
পাখির পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শানের দিকে একবার দেখে চোখ মুখ কুচকে নেয়।আবারও বমি বমি আসে পাখির;কিন্তু বমি হয় না।
মুখটা কুচকানো রেখে কম্পিত স্বরে বলে,” আআমি প্রেগন্যান্ট ”
কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে শানের দিকে তাকায়।এদিকে চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে পাখির। একটু পরে কি হতে চলেছে সেটা ভেবেই পাখির হাত পা হিম হয়ে আসে।হাত দুটো মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিজেকে সংবরনের চেষ্টা করে ।
ভয়ে ভয়ে শানের দিকে দ্বিতীয় দফায় তাকায়।বোঝার চেষ্টা করে এই মূহূর্তে শানের মনে কি চলছে!
“কি বলছো?বুঝতে পারি নি তো জান”, খুব শান্ত কন্ঠে দৃষ্টি স্থীর রেখে প্রশ্ন করে শান।
পাখি আগেপিছে না ভেবে পা উচিয়ে শানের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।হারানোর ভয় বড্ডো জেঁকে ধরেছে তাকে।এদিকে শানের কোনই প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারছে না সে।
কাঁধ ভিজিয়ে গলা জড়ানো অবস্থাতেই বলে,”আমি কারোর সাথে কিচ্ছু করি নি ডাক্তার সাহেব।আপনি ব্যতিত কারোর সংস্পর্শে আসি নি আমি।কিভাবে কি হলো আমি কিচ্ছু জানি না।আমার খুব ভয় করছে,খুউউউব”
শান খুব সন্তোর্পনে পাখিকে এনে সোফায় বসায়।পা যেন চলছে না তার তবুও জোড়পূর্বক হেঁটে পট থেকে পানি ঢেলে গ্লাস এগিয়ে দেয় পাখির দিকে।অনবরত চোখের পানি মুছে চলেছে পাখি।সামনে আগত গ্লাস টা থাবা মেরে নিয়ে পুরো পানি টা গিলে ফেলে।
“এবার, বলো তো জান একটু আগে কি বলছিলে?প্রেগন্যান্ট না কি যেন বলছিলে?কে প্রেগন্যান্ট? “, পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় দিয়ে বলে শান।
মাথা তুলে পাখি শানের চোখে চোখ রেখে বলে, ” আআমি”
হঠাৎ বুঝতে পারে মাথার উপর থেকে হাতটা খুব সাবধানে নেমে গেলো।পাখি হাতের দিকে দেখে শানের দিকে চোখ রাখে।শান একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে,আরেকবার বিছানার দিকে তো কখনো কাবার্ডের দিকে।এক কথায় সে কোনদিকেই দৃষ্টি স্থীর রাখতে পারছে না।ঠোঁট দুটো গোল করে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ছাড়ে।ডান হাত দিয়ে পুরো মুখটা মুছে নেয়।এরপর পাখির দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকায়।
এই দৃষ্টি যেন ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে প্রস্তুত পাখির জরাজীর্ণ তনুমন।
ডান হাত টা বাড়িয়ে শানের বাম গাল ছুঁতেই শান উঠে দাঁড়ায়।পাখি চট করে সোফা থেকে নেমে শানের পায়ের কাছে বসে পরে।
“বিশ্বাস করুন,আমি কারোর সংস্পর্শে যাই নি”
কান্নার শব্দ টা আর মুখ ফুটে বের হচ্ছে না পাখির। কেমন যেন কন্ঠনালীর কাছে দলা পাকাচ্ছে আর গা গুলিয়ে বমি আসছে।হঠাৎ বুঝতে পারে সে হাওয়ার উপর ভাসছে।হকচকিয়ে নিজের দিকে তাকায়।বুঝতে পারে শান তাকে কোলে তুলে নিয়েছে।পাখি কিছু জিজ্ঞেসা করার পূর্বেই শান ওকে বিছানায় খুব সাবধানে শুইয়ে দেয়।
কোন প্রকার কোন বাক্য ব্যয় না করে আদ্র ঠোঁট দুটো ঠেকিয়ে দেয় পাখির কপালে।পাখি ভয়ে বিছানার চাদর খামছে চোখ মুখ খিঁচে রাখে।কপালের উপর দুফোটা গরম জল পরতেই চোখ মেলে তাকায় পাখি।শান তখনও নিশ্চুপ থাকে।এভাবেই চলে যায় কিছুটা মূহূর্ত।
শান উঠে বাম হাতের উল্টো পিঠে নাকটা মুছে নেয়।চোখ দুটো মুছে নেয় খুব সাবধানে।লাল টসটসে চোখ দুটো দেখে অবাক হয় পাখি।বুঝতে অসুবিধা হয় না কান্না সংবরন করছে তার ডাক্তার সাহেব।কিন্তু শানের কোন অনুভূতিই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
হঠাৎ করে শান এগিয়ে গিয়ে পাখির সারামুখে অজস্র চুমু এঁকে দেয়।সদ্য গোসল নেয়া চুল গুলো থেকে শ্যাম্পুর ঘ্রান পাখির নাকে গিয়ে ঠেকে।সে গন্ধে ভিতর থেকে উল্টি আসে।নিঃশ্বাস আটকে রাখে কিছুক্ষন।
“আআপনি এএমন ককরছেন…..?”,কম্পিত দ্বিধান্বিত কন্ঠে মাত্র তিনটা শব্দই মুখ দিয়ে বের করতে পারে পাখি।বাকি কথা শেষ না হতেই শান একটা কান্ড করে বসে।
পাখির বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে;চুপচাপ থাকে।
” আমার কেমন যেন লাগছে জান!আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, ওহহ না না খুব হাসতে ইচ্ছে করছে….উফফ আমার কি যেন করতে ইচ্ছে করছে”,নিজের মাঝে এই মূহূর্তে কোন অনুভূতির উদয় হয়েছে তা শান বুঝতে পারছে না।আবোল তাবোল বকে চলেছে।
পাখি হাত উঠিয়ে শানের চুলে হাত দিতেই মাথাটা তোলে শান।
“সরি সরি সরি, আমি তো বুঝতে পারি নি, এখন তো এখানে কেউ একজন আছে”, অপরাধীর মতো দৃষ্টি করে পাখির পেটে হাত রেখে বলে শান।
ঠোঁটে হাসি অথচ চোখের কোণে চিকচিক করছে জলের কণা, দুই তিনবার নাকে ছিঁচকে শব্দ করে শান পাখির দুই বাহু ধরে খুব সাবধানে উঠিয়ে বসায়।পাখি যেন একদলা তুলোর স্তুপ।
পাখি কিছুই ঠাওর করতে পারছে ন। শুধু অবুঝের মতো শানের পাগলামি দেখে চলেছে।
” কি দেখছো ওভাবে?আরে আমি আজ পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তি।তুমি জানো না পাখি আমার মনের মাঝে আজ কতো আনন্দ ঢেউ খেলছে।আমি বাবা হবো জানপাখি, এর থেকে আনন্দের আর কি আছে”,বলতে বলতে পাখিকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।
পাখি তখনো নির্বাক।এতোক্ষনের আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাস টা ছেড়ে পাখি মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,”আপনার রিপোর্ট যে…..”
“ওসব ভুয়া ”
“জানতেন?”
“এই যে এখন জানলাম”
“মানলেন,আর বিশ্বাস?করলেন?”
“এ পৃথিবী মিথ্যের আবরনে ঢেকে যাক, তোমার তুমিটা শুধু সত্যি হয়ে বেঁচে থাক।এই আমি তুমিটাই বেছে নেবো।”
স্বগতোক্তি করে শান বলে,”পূর্বেই বোঝা উচিত ছিলো রিপোর্টে হয়ত কোন প্রবলেম আছে।জানো পাখি বাবাটাকে এতো ভালোবাসতাম, এতো বিশ্বাস করতাম যে আর কখনোই নিজের অক্ষমতাটা খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করি নি।তবে আজকের মিথ্যেটা আমায় পৃথিবীর সর্বসুখ এনে দিয়েছে।”
পাখি শক্ত করে শানের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
“আরে আরে কাঁদছো কেন? এই সময় কান্না করা যাবে না তো….দেখি তো মুখটা “, বলতে বলতে শান পাখিকে নিজের থেকে ছাড়াতে নিলে পাখি আরো শক্ত করে ধরে নেয়।
শান আর কিছু না বলে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
” আমি আমি মনে করেছি, আপনি আমায় ভভুল বুঝবেন।আর তারপর, তারপর আমায় আপনার থেকে আলাদা করে দিবেন”,হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে পাখি।
“এতোটা নোংড়া মাইন্ডের ভেবেছো আমায়?অবিশ্বাস করব! তাও তোমায়?
আরে জান তুমি তো আমার মরুর বুকের তপ্ত বালিতে এক পশলা বৃষ্টি,
তুমি যে স্রষ্টার অনন্য এক সৃষ্টি।
যে সৃষ্টিতে আমার সকল সাধনার তুষ্টি
আমার মতো পথহারা পথিকের অন্ধকার রাতের আলোকবর্তিকা হাতে মহীয়সী নারী তুমি…..তুমি ভুল হলে তো আমার পুরো জীবনের মানেটাই ভুল”
শানের কথায় যেন কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায় পাখির।শান মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,”এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে পাখি।এভাবে কান্না করা যাবে না তো”
পাখি খুব কষ্টে নিজেকে সংবরন করে নেয়।কান্নার বেগ কমে এলে শান ওকে আস্তে করে আগের স্থানে বসায়।দুহাতে চোখ মুছিয়ে বলে,”এই কারণেই চেহারা খারাপ হচ্ছে,আমাকেও কাছে সহ্য করতে পারো না, তাই না?ইশ!প্রেগন্যান্সির এতো স্পষ্ট সিমটম গুলো কি করে আমার নজর এড়ালো?”
বলতে বলতে শান নিজেকে দোষারোপ করে।
কি যেন একটা মনে হতেই শানের ভ্রুতে ভাঁজ চলে আসে।পাখির মুখটা তুলে বলে,”এই তোমার না গত মাসে….. ”
“সবাই বলেছে এরকমও নাকি হয় কারোর কারোর ক্ষেত্রে”, হেঁচকি তোলা কন্ঠে বলে পাখি।
” সবাই বলতে!”
“মা, চাচি,রাখি,রেহানা ম্যাম ”
“তারমানে সবাই জানে! ”
“কাল বৈঠকের পর আপনি হসপিটালে চলে যান। তখন আমার খুব বমির চাপ আসে। মা চাচি বুঝে যায় সবটা।তার পর বাকি আরো অনেক কিছু আমার থেকে জেনে নেয়”
শান উঠে দাঁড়ায়। একহাত কোমড়ে আরেকটা হাত কপালে স্লাইড করতে করতে বলে,”আমার বাচ্চা আমি জানি না অথচ বাড়ির সবাই জানে।ছিহহ, কতোটা কেয়ারলেস হয়ে গেছি আমি”
চট করে পাখির পাশে বসে বলে,”এরকম টা যে হয় না তা নয়, হয় তবে অনেক রিস্ক হয় জান”
পাখি জবাবে একটা অনুভূতিহীন চাহনী উপহার দেয়।
শান আবারও বলে ওঠে, “কাল তোমায় ডাক্তারের কাছে নিবো”
ভ্রু কুচকে যায় পাখির।
“কি ভাবছো? তোমার বর ডাক্তার অথচ অন্য ডাক্তারের কাছে কেন নিতে চাইছে!তাই তো?”,পাখির মুখোভাব দেখে বলে শান।
মাথা উপর নিচ করে পাখি হ্যা সূচক জবাব দেয়।
” একজন ডাক্তার হিসেবে না, একজন পেশেন্ট হিসেবে তোমায় অন্য ডাক্তারের কাছে নিবো।ইদানিং ডাক্তারের দায়িত্বে বেশি সময় দিতে দিতে এটাই ভুলে গেছি আমিও কারো হাজব্যান্ড।শেইম অন মি”,মুখটা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে একা একাই বিড়বিড় করে শান।
পাখি উঠে এসে কাঁধে হাত রাখে।শান পিছু ফিরে হন্তদন্ত হয় বলে,”আরে নামছো কেন তুমি?এ সময় তোমার পুরো বেড রেস্টে থাকতে হবে।নিয়মে কোন গাফিলতি আমি সহ্য করব না পাখি।”
পাখিকে আবারও বিছানায় বসিয়ে দেয়।হাত দুটো মুঠোভরে নিয়ে পর পর কতো গুলো চুমু খেয়ে বলে,”আমার লাইফের বেষ্ট ডে ছিলো তোমায় আপন করে পাওয়া আর আজকের পর থেকে আজকের দিনটা বেষ্ট দিন হিসেবে স্মৃতির পাতায় লেখায় থাকবে।আমার কিছুই চাই না পাখি শুধু বাবা ডাকটা শুনতে সহায্য করো আমায়”
শেষের কথাটা বেশ অনুনয়ের স্বরে বলে শান।
পাখিকে কিছু বলতে না দিয়ে আবারও বলে ওঠে,”এই চাওয়াটাকে দাফন করে রেখেছিলাম আজ আবারও সেটার জানান দিচ্ছে মনের মাঝে।প্লিজ জান আমার বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনো”
বলতে বলতে কন্ঠ ভারী হয়ে আসে শানের।
পাখি শানের দিকে তাকিয়ে বলে,”ইন শা আল্লাহ্”
🌸🌸
“হ্যা আম্মা, ঘুমাইছো?”
“নারে বাবু… বল”
“আম্মা আমি বাবা হবো আম্মা”,উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে শান।
শর্মিলা ছেলের খুশিতে ভীষণ খুশি আজ।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,” জানি বাপ।”
“আম্মা আমার কি যে খুশি লাগছে কি করে বোঝাই!”
“শোন, বউ মাকে বিশ্রামে রাখবি সবসময়।সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠানামা করতে দিস না”, ধমকের স্বরে বলে শর্মিলা।
” আম্মা আমি ডাক্তার।ভুলে গেছো?”
শর্মিলা নিঃশব্দ হেসে দেয়। এরপর টুকিটাকি কথা বলে কল কেটে দেয় শান।
পাখির দিকে এগিয়ে শান বলে, “সকালটা তোমার জন্যে অনেক উপহারের ডালা নিয়ে বসে আছে জান।”
পাখি প্রশান্তি ভরা চিত্তে শানের দিকে তাকায়।
চলবে…..
[.