#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২৪তম_পর্ব
অভিনব সিংহ এবার চোখ মেললেন, পাইপ রেখে নড়ে চড়ে বসলেন। ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে তীর্যক চাহনী প্রয়োগ করলেন রুদ্রের দিকে। কিন্তু রুদ্র নির্বিকার। অভিনব বাবু গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“তুমি কি সেদিনের ব্যাবহারে গোসা করেছো?”
“গোসা কেনো করবো বাবা?”
“না আসলে সেদিন একটু বেশি ই বলেছিলুম কি না। গোসা করে যদি আমার থেকে দূরে যেতে চাও তবে বলবো। এমন টা করো না। আমি তো বারো ঘাটে জল খেয়েছি। মানুষ ধরতে আমার সময় লাগে না। এসব অজুহাত দিলে কি আমি শুনবো। পুলিশ কেস এমনটা এই জীবনে কম সামলাই নি। এই আবদুল্লাহ এর জন্য তোমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই আমার। তুমি এবার ঝেড়ে কাসো তো বাছা”
“সত্যি বলবো বাবা?”
“বলো”
“আমি উমাকে আপনার এই বন্দিশালা থেকে মুক্ত করতে চাই, যেখানে আপনার কোনো কালোছায়া ওর কোনো ক্ষতি করবে না“
“তোমার কেনো মনে হলো আমি উমার কোনো ক্ষতি করবো?”
বাকা হাসি দিয়ে রুদ্রের চোখে চোখ রেখে কথাটা জিজ্ঞেস করে অভিনব সিংহ। রুদ্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে শান্ত কন্ঠে বলে,
“বাবা, আমার ইহজীবনটাই কেটেছে আপনাকে দেখে। আমি আপনার শিরা উপশিরার সাথে পরিচিত। আপনির আতে ঘা লাগলে আমাকে সরিয়ে ফেলতেও আপনি দু বার ভাববেন না। পিসে মশাই তো আপনার ই শিকার ছিলো। একমাত্র বোনের সোহাগ কাড়তে যেহেতু দুবার ভাবেন নি, সেখানে উমা তো একটা তুচ্ছ প্রানী মাত্র। একটা ঢলা দিলেই শেষ। তাই উমাকে আপনার নোংরা খেলা থেকে দূরে রাখতে চাই আমি। যে চো্রাবালিতে আমার পা আমি জানি আমার নিস্তার নেই। কিন্তু উমা তো শ্বেত কোমল মাত্র। ওকে এই নোংরামি থেকে দূরে রাখাটাই শুভ। আর একটা কথা, আমি বট গাছের নিচে পিসে যাওয়া চারাটি হতে চাই না। আমি সেই বট গাছ হতে চাই যেখানে হাজারো পক্ষী বসতি গড়বে। আসি”
রুদ্র যেতে ধরলে অভিনব সিংহ আয়েশী কন্ঠে বলেন,
“আমার বন্দিশালাটা কি শুধু এই বাড়ি বা গ্রাম অবধি ই আবদ্ধ? তোমার মনে হয় না আমার হাত ওখানেও যেতে পারবে?”
“আমার প্রাচীর ভেঙ্গে যদি আপনার কুছায়া ঢুকতে পারে তবে আমি নিজেই হাটু গেড়ে নিবো।“
বলেই রুদ্র ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। অভিনব সিংহের মুখোভাব গম্ভীর হয়ে উঠে। যে ছেলের হাটু ভেঙ্গে তাকে পঙ্গু করে দিয়েছিলো অভিনব সিংহ সেই ছেলে আজ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। এতোকাল রুদ্র কেবল ই তার হাতের পুতুলটি ছিলো। যে তার কথায় উঠতো আর বসতো, কিন্তু এখন রুদ্র কাঠপুতুলটি নেই। অভিনব সিংহ এর মনের কোনে আশ্বিনের কাল মেঘ জমলো। এই মেঘ ভয়ের। রুদ্র এমন একজন ব্যক্তি যে তার সকল কাজের জীবন্ত সাক্ষী, অভিনব সিংহ এর কালো কারবাড়ি, অন্যায়, দুষ্টতার প্রাসাদের কোথায় কোন সুরঙ্গ রয়েছে এই জ্ঞান রুদ্র ব্যাতীত সবার অজানা। নিজেকে গড়তে যেয়ে না তাকেই গুড়িয়ে ফেলে সেই ভয় ই তাকে গিলে খাচ্ছে। নিজের নিয়ন্ত্রন হারা্তে লাগলেন অভিনব সিংহ, পাইপ টানতে বিছ্রি লাগছে। মুখ তেতো হয়ে আসছে। তাই ছুড়ে ফেললেন পাইপটি। এভাবে হেরে গেলে চলবে না, খুব দ্রুত কিছু একটা করতেই হবে। এবং সেটা অতিসত্তর_____________
১৪.
কালীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উমা এবং রুদ্র। এই প্রথম গ্রাম থেকে বের হয়েছে উমা। তার টানা টানা চোখে পৃথিবীর নতুনত্বকে বন্দী করতে ব্যাস্ত ছিল সে। গ্রাম থেকে বেশ দূরে কলেজটি। যদিও তারা রুদ্রের মোটর সাইকেলে এসেছে তবুও কম সময় লাগে নি। পুরোটা রাস্তা দুচোখ ভরে সে অজানা অচেনা আকাশের কাব্য পড়েছে সে, অজানা বাতাসের গল্প শুনেছে। ইট পাথরের শত শত দালান সাক্ষী রেখে মোটর সাইকেল চলছে কালো পিচের রাস্তায়। এক আকাশ নীলচে রঙ্গ এবং একমুঠো সোনালী রোদ্দুর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে উমার চোখের সামনে। অজান্তেই ঠোট চিরে উচ্ছ্বাসের মুক্তোদানা পরিস্ফুটিত হচ্ছে। মোটর সাইকেলের আয়না দিয়ে আড়চোখে রুদ্র তাকে দেখে নিলো। ষোড়শীর চোখে না জানে কত কৌতুহল। এই কৌতুহলের সাক্ষী আর এই কালো পিচের কালীগঞ্জের সড়ক। মোটর সাইকেল থামলো কালীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের সামনে। কলেজ টি ১৯৬৯ সালে স্থাপিত। বেশ পুরোনো দালান গুলো। বিশাল মাঠ পেরিয়ে প্রিন্সিপালের রুম। উমা অবাক নয়নে দেখে যাচ্ছে কলেজটিকে। এই প্রথম এত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখেছে সে। তার মনে হলো মনের আঙ্গিনায় নতুন প্রভাতের সূচনা হয়েছে, কালো মেঘের দল সেই সোনালী কিরণে যেনো উধাও হয়ে গিয়েছে। রুদ্র মুচকি হেসে বলল,
“শুধু দেখলেই হবে, ভর্তি হতে হবে তো। সাতক্ষীরার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠিত কলেজ এটা। বেশ পুরোনো। আমি আর শাশ্বত ও এখানেই পড়েছি।“
“তাই?”
“কেনো আমাকে দেখলে কি মূর্খ মনে হয়?”
“তা মনে হয় না, তবে শিক্ষিত ও মনে হয় না। কেমন যেনো গা ছাড়া ভাব। বইতে বলে শিক্ষিতরা নাকি মার্জিত হয়।“
“আমি অমার্জিত?”
রুদ্র ঝাঝালো কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় উমার দিকে। অন্য সময় হলে উমা দমে যেতো, কিন্তু আজ দমলো না। নির্ভীক কন্ঠে বললো,
“মার্জিত মানুষ এরুপ কর্কশ কন্ঠে কথা বলে না।“
উমার উত্তরে হেসে উঠে রুদ্র। সে কথা বাড়ায় না। উমার হাত নিজের মুঠোতে নেয়, তারপর হাটতে লাগে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে। উমার মুখেও এক স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠে, এ যেনো অকৃত্রিম সুখ। উমা চায় চিরটাকাল যেনো এই সুখটাই তার কাছে থাকে। আবার ভয় ও হয়, এতো সুখ কি সইবে তার কপালে।
দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরে উমা এবং রুদ্র। বাড়ি পুরোই শূন্য। ফুলির মাকে ডাক দিলে সে হাত মুছতে মুছতে আসে। রুদ্র কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে মনমরা হয়ে বলে,
“নিখিল দা বুকে বেদনা উঠছে, সক্কলে ওখানেই গেছে। তারে নাকি হাসপাতালে লয়ে যাইতে হবে।“
বাবার শরীরের অবস্থা শুনেই কলিজায় কামড় পড়ে উমা। এমন একটা কথা শুনবে কল্পনাও করে নি সে। মুখ ফেটে এক দলা কান্না জড়ো হলো চোখের কোনায়। গলা আটকে আসছে। আপন বলতে তো এই বাবা আর ভাইবোন গুলোই আছে। সেই দুমাস পূর্বে দেখেছিলো বাবার অসহায় মুখখানা। কি বাজে ভাবেই না অপমান করেছিলো রুদ্র। এর পর থেকে ওই বাড়ি যাওয়া হয় নি তার। শুধু শুধু তাদের যন্ত্রনার কারন হতে চায় নি উমা। অথচ আজ সেই বাবার অসুস্থতা শুনে কিভাবে শান্ত থাকবে সে। নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে তার। ছলছল নয়নে জড়ানো কন্ঠে রুদ্রকে বলে,
“আমি যাবো, হাসপাতালে। দয়া করে মানা করবেন না”
উমার আবেগী আকুল নিবেদন ফিরিয়ে দেবার মতো নিষ্ঠুর নয় রুদ্র। মেয়েটিকে সুখের চাদরে মুড়য়ে রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে সে। তাই সব ভুলে তাকে আশ্বত করলো,
“আমি নিয়ে যাবো”
আধ ঘন্টা বাদে হাসপাতালে পৌছালো উমা। ছুটে গেলো ভেতরে, সারাটা রাস্তা হু হু করে আর্তনাদ ই করেছে মেয়েটি। আজকের দিনটি সবথেকে আনন্দের ছিলো অথচ কি হয়ে গেলো। সরকারী হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রতী, রাজশ্বী, গোপাল, শাশ্বত, লক্ষী, এবং অভিনব সিংহ। উমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো রাজশ্বী। দিদিকে জড়িয়ে জল ছেড়ে দিলো ছোট মেয়েটি। গোপাল অবস্থার গভীরত্ব বুঝতে পারছে না। তাই ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছে। রতী একটু পর পর কেঁদে উঠছে। লক্ষী তাকে সান্তনা দিচ্ছে। শাশ্বত ই দ্রুত এখানে নিয়ে আসে। ডাক্তার দেখছে নিখিলকে। উমাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখে শাশ্বত বলে,
“চিন্তা করো না উমা, সব ঠিক হয়ে যাবে।“
শাশ্বতের শান্তনা আদিক্ষেতা ঠেকলো রুদ্রের কাছে। সে তাকে কিছু বলার পূর্বেই………………
চলবে
[ /