এ তুমি কেমন তুমি পর্ব -০৬

#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৬

লিজার বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করছে ফারহানের নামের ডায়মন্ড রিং। এদিকে অনামিকার চোখে চিকচিক করছে নোনাজল। হাতের উল্টো পিঠে গাল মুছে নিলো অনু। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেলো নিজের জায়গা থেকে। উল্টো ফিরে এক দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। সবাই বাইরে থাকায় তার ভেজা চোখ কেউ দেখতে পেলো না। অনু নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। দু’চোখের বাঁধ ভেঙেছে আজ, কোনো বাঁধা যে মানবে না সেটা ঠিক বুঝতে পারছে অনু। কিছুটা সময় পর নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো। যত্নে আঁকড়ে রাখা নীল রঙের ডায়েরিটা বের করে হাতে নিলো। ডায়েরিটা ফারহান তাকে গিফট করেছিলো এসএসসির রেজাল্টের পর, মোটামুটি ভালো জিপিএ পেয়ে পাশ করায়। ডায়েরি ওড়নার নিচে লুকিয়ে কিচেনে চলে গেলো। পুরো বাড়ি ফাঁকা তাই কারো সামনে পরতে হলো না, লাইটার হাতে চলে গেলো ছাঁদে। চিলেকোঠার উল্টো দিকে চলে গেলো যাতে কেউ ছাদে এলেও তাকে দেখতে না পায়। ডায়েরির ভেতর থেকে ফারহানের ছবি বের করে আগুন জ্বালিয়ে দিলো তাতে। সেই আগুনে একটার পর একটা ছবি ফেলতে লাগলো। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন ঠিক অনুর বুকের ভেতরটার মতো। এবার একটা একটা ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে আগুন ফেলতে লাগলো।

অনু বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “এই আগুনের সাথে এই সত্যিটাও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন জানবে না অনামিকাও কাউকে ভালোবেসেছিলো। অনামিকার জীবনেও বসন্ত এসেছিলো।”

অনু হাঁটুতে থুতনি রেখে সামনে পড়ে থাকা তার অনুভূতির ছাই দেখছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সময় পেরিয়েছে অনেকটা। এতক্ষণে হয়তো অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলেও গেছে। আচ্ছা অনুকে কী কেউ একটু খুঁজেছে? এসব ভাবনায় অনু তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। তাকে আবার কে খুঁজবে? অনুকে খোঁজার মতো কেউ আদৌও আছে এই পৃথিবীতে? নাহ্ নেই, কেউ নেই।

ছাদে কারো আসার শব্দ পেয়ে অনু সামনে তাকালো। কৃত্রিম আলোয় চারপাশ আলোকিত থাকায় তানিশাকে দেখতে অসুবিধা হলো না তার। নিজের যন্ত্রণায় ডুবে অনু তো ভুলেই গিয়েছিলো তানিশার কথা। অনু খেয়াল করলো তানিশাকে। ছাদে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা রেলিঙের কাছে চলে গেলো। উঁকি দিয়ে নিচে কিছু দেখে নিলো। তানিশার কাজে আঁতকে উঠলো অনু।

বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “কী করতে চাইছে তানিশা?”

অনু উঠে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো তানিশার দিকে। তানিশা রেলিঙের উপর উঠার চেষ্টা করতেই অনু একটানে পিছনে নিয়ে এলো।

অস্থির গলায় বললো, “এসব কী করছিস তুই?”

তানিশা হতভম্ব হয়ে তাকালো অনুর দিকে। এখন অনুকে এখানে একটুও প্রত্যাশা করেনি তানিশা। কী বলবে বুঝতে পারছে না?

অনু ধমক দিয়ে বললো, “কী হলো কথা বলছিস না কেনো বেয়াদব?”

তানিশা কিছু না বলে মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলো, “আপু আমি সত্যি ফারহান ভাইয়াকে ভালোবাসি। তাকে লিজা আপুর সাথে সহ্য করতে পারবো না।”

মলিন হাসলো অনু, “জীবনের কতটুকু দেখেছিস? বাবা-মায়ের অতি আদরে বড় হয়ে জীবন সংগ্রামের কিছুই দেখিসনি। বাড়ির বাইরে বের হলে একটু আশেপাশে তাকিয়ে দেখিস কত অসহায় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। একটু হসপিটালে নজর বুলিয়ে দেখ, একটা দিন বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে নিজের সাথে। আর তোদের মতো কিছু পাগল সামান্য একটু আঘাতে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলছে।”

তানিশা চিৎকার করে বললো, “তুমি তো কখনো কাউকে ভালোবাসোনি তাই আমার কষ্ট বুঝতে পারছো না।”

অনুর প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে তানিশার কথা শুনে। তানিশা কতদিন ধরে ভালোবাসে ফারহানকে। অনু তো সেই ছোটবেলা থেকেই ফারহানে বিভোর হয়ে আছে। আর তানিশা বলছে অনু বুঝতেই পারছে না তার কষ্ট। অনু খানিকটা হেসে নিলো।

চোখের পানি মুছে বললো, “তুই ফারহান ভাইয়াকে কতদিন ভালো বাসিস? তোর জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই? আর তোর বাবা-মা তোকে ভালোবাসে তোর জন্মের আগে থেকে। যেদিন তোর অস্তিত্ব তোর মায়ের মাঝে অনুভব করেছে তখন থেকে। তোর জন্য তোর মা নিজের জবটাও ছেড়ে দিয়েছে যাতে তোকে সময় দিতে পারে। সেই ভালোবাসা গুলোর কোনো মূল্য নেই? তাদের কথা একবার মনে হলো না? তাদের কী অবস্থা হবে তোকে ছাড়া? তোর কী মনে হয় তুই মরে গেলে ফারহান ভাইয়া তোর শোকে পাগল হয়ে যাবে? ভুল ভাবছিস তুই তানিশা। বিয়ে করে সুখের সংসার করবে। সময়ের সাথে সাথে তোর নামটাও ভুলে যাবে। ভুলতে পারবে না কেবল তোর বাবা-মা। যতদিন বেঁচে থাকবে, তাদের বুকের ভেতর থাকবে গভীর এক ক্ষত।”

তানিশার চোখে ভেসে উঠলো নিজের বাবা-মায়ের সাথে কাটানো মিষ্টি মুহূর্তগুলো। তার বাবা তো তাকে বলতে পাগল। দুই মেয়ে বলে তার বাবা কখনো আফসোস করে না। সবসময় বলে আল্লাহ আমাকে দুইটা জান্নাত দিয়েছে। সে কীভাবে ভুলে গেলো এতো ভালোবাসা? সামান্য একটা ছেলের জন্য এতো এতো ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দিচ্ছিলো। তানিশা দু’হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কান্না করে দিলো। অনু এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তানিশাকে। তানিশাও বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে গেলো।

কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আমার ভুল হয়ে গেছে আপু।”

অনু তানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আর কখনো যেনো এমন ভুল না হয়। আজকের কথা তোর আর আমার মধ্যেই থাকবে।”

তানিশা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অনেকটা সময় কান্নার পর তানিশা শান্ত হলে অনু ওকে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে এলো।

১০.
ঘড়ির কাটা রাত তিনটায়। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টিতে খোলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভিজছে অনু। রুমে বেডে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে তানিশা। আচ্ছা তানিশা নাকি ফারহানকে ভালোবাসে তাহলে এতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে কীভাবে? অনু তো হাজার চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলো না আজ। তানিশা সত্যি ভালোবাসে তো ফারহানকে? নাকি কিছু সময়ের মোহ? অনু চায় তানিশার অনুভূতি যেনো নিছক মোহ ছাড়া কিছু না হয়। তাহলে মেয়েটা সহজেই ভুলতে পারবে ফারহানকে। অনুর মতো ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে না। অনু চায় না তার মতো কষ্ট আর কেউ পাক। বাজ পড়ার শব্দে অনু কেঁপে উঠলো। বৃষ্টির গতি যেনো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, শীতে শরীর কুঁকড়ে আসছে। আর থাকতে না পেরে অনু রুমে চলে গেলো। ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে এসে বেলকনির দরজা বন্ধ করে দিলো। কাঁপতে কাঁপতে তানিশার পাশে শুয়ে পড়লো কম্বল মুড়ি দিয়ে। ফোনটা কেঁপে উঠলে হাতে নিয়ে দেখলো অয়নের ম্যাসেজ। অনু অবাক হয়ে গেলো এত রাতে অয়নের ম্যাসেজ দেখে।

অনেকক্ষণ আগের ম্যাসেজে লেখা, “এতো রাতে বেলকনিতে কী করো ধুলাবালি? বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে তো।”

ম্যাসেজ দেখে অনুর অবাক হওয়ার পরিমাণ বাড়লো। এরপর বেশ কয়েকটা কল দিয়েছে।

এখনকার ম্যাসেজে লিখেছে, “এক কাপ কফি বানিয়ে খেয়ে তারপর ঘুমাও ধুলাবালি। নাহলে জ্বর হবে, ঠান্ডা লাগবে।”

অনু অয়নের নাম্বারে কল দিতে গিয়ে দেখলো ফোন বন্ধ। অনু আর কিছু চিন্তা করতে পারলো না, তার আগেই মাথা ভারী হয়ে এলো।

সকালে তানিশার ঘুম ভাঙলো উত্তপ্ত কিছুর স্পর্শে। ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারলো সেটা ছিলো অনুর হাত। তানিশা চমকে উঠে বসলো। অনুর কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো ধুম জ্বর এসেছে। কিছু না ভেবে বেড থেকে নেমে বাইরে চলে গেলো। ওর মায়ের রুমে দরজা ধাক্কা দিলো। মোমেনা ফজরের নামাজ শেষে কোরআন তিলাওয়াত করছিলো।

তানিশা দরজা ধাক্কা দিয়ে বললো, “মা দরজা খোলো তাড়াতাড়ি।”

মোমেনা কোরআন তিলাওয়াত শেষ করে তাড়াতাড়ি এসে দরজা খোলে দিলো, “কী হয়েছে এতো সকালে এভাবে কেনো ডাকছিস?”

মা, অনু আপুর ধুম জ্বর এসেছে।

কী বলিস, জ্বর এলো কীভাবে?

সেটা আমি কীভাবে বলবো? তুমি চল তো, আপুর শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।

মোমেনা কথা না বাড়িয়ে ছুটলো অনুর রুমের দিকে। গিয়ে দেখে জ্বরে অনু কেঁপে কেঁপে উঠছে।

মোমেনা ব্যস্ত গলায় বললো, “তুই তো ছোট মামাকে ডেকে নিয়ে আয় আমি ওর মাথায় পানি দিচ্ছি।”

তানিশা ঠিক আছে বলে চলে গেলো জুনায়েদকে ডাকতে। মোমেনা মাথায় পানি দেওয়ার জন্য ওয়াশরুমে গেলো বালতি আনতে। সেখানে গিয়ে অনুর ভেজা পোশাক দেখে বুঝতে পারলো অনু রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছে আর তার জন্য এই অবস্থা। অনুর মা জানতে পারলে ওকেই বকবে তাই মোমেনা তাড়াতাড়ি ভেজা পোশাক ধুয়ে বেলকনিতে মেলে দিলো আর তখনই জুনায়েদ এসে ঢুকলো অনুর রুমে।

থার্মোমিটার মুখে দিয়ে কপালে হাত রেখে বললো, “এতো জ্বর এলো কীভাবে?”

মোমেনা বললো, “মনে হয় রাতের বৃষ্টিতে ভিজেছে। এই মেয়ে তো আবার বৃষ্টি দেখলে রাত দিন মানে না।”

জুনায়েদ থার্মোমিটার বের করে দেখলো ১০৪° তাপমাত্রা, “মুমু ওর তো অনেক জ্বর দেখছি। আমি একটা মেডিসিন আনাচ্ছি ড্রাইভারকে দিয়ে তুই ততক্ষণে মাথায় পানি দিয়ে গা মুছিয়ে দে। বৃষ্টিতে ভেজার কথা ভাবিকে বলিস না, দেখা যাবে অসুস্থ মেয়েকে মারতে শুরু করেছে।

ঠিক আছে, আমি দেখছি।

জুনায়েদ চলে গেলে মোমেনা অনুর মাথা পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করলো। তানিশা চুপচাপ বসে রইলো অনুর মাথার কাছে। হাত মুছিয়ে দেওয়ার সময় মোমেনা খেয়াল করলো হাতে ফোসকা পরে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে আগুনের ছেঁকা খেয়ে এমন হয়েছে, অনেকটা জায়গা লালও হয়ে আছে।

মোমেনা চিন্তিত গলায় বললো, ” হাত পুড়লো কীভাবে ওর?”

অনু পিটপিট করে তাকালো মোমেনার দিকে। মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার।

মোমেনা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “কষ্ট হচ্ছে ফুপ্পি?”

অনু ঠোঁট ফুলিয়ে ভেঙে ভেঙে বললো, “খুব কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ফুপ্পি। বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। অনুকে কেনো কেউ ভালোবাসে না ফুপ্পি?”

কে তোকে ভালোবাসে না? আমরা সবাই তোকে ভালোবাসি।

অনু কেঁদে দিলো, “মিথ্যে কথা। অনুকে কেউ ভালোবাসে না, ফা,,,”

যে সত্যিটা সবার থেকে লুকাতে চাইছে জ্বরের ঘোরে অনু নিজেই কী বলে দিবে সেই সত্যি?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here