এক চিলতে রোদ ২ পর্ব -৩২+৩৩

#এক_চিলতে_রোদ- ২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ)

৩২.
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ইমা আপুর রুমে পেয়েছি। রাতে আমি শেষ ইহানের গান শুনতে ছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নাই। তারমানে উনিই আমাকে এখানে দিয়ে গেছে তাই হবে হয়তো।
সকালে কোন রকম খাবার খেয়েই আমি চলে এলাম। ইহান আমার সাথে এলো। রিকশায় উঠে বসলাম দুজন। ইহান গাড়ি আনতে চেয়েছিলো আমি মানা করে দিছি। ইহান আর অমত করে নি।
আমি ইহানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ আব্বু জেনে গেছে আমি আপনাদের বাসায় এসেছি। ইমা আপু আপনার বোন সব কিছু তাই না‌।’

ইহান আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ হ্যাঁ।’

‘ আমি বাবার সামনের কি করে দাড়াবো। মিথ্যা বলা আমার উচিত হয়নি।’

ইহান আমার দিকে বিরক্তকর চাহনী দিয়ে বললো, ‘গাল ফুলালে এক থাপ্পর মারব ইডিয়েট‌।’

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।

‘ মানে কি থাপ্পড় মারবেন কেন?’

‘ বাসায় কিছু বলবে না কাল আমি সব জানিয়েছি চাচু কে।’

‘ কিছু বলে নাই‌।’

‘ সেসব জানতে হবে না। কিছু বলবে না তাই চিন্তা করা অফ কর।’

‘ তো এমন গম্ভীর গলায় বলার কি দরকার? একটু নরম গলায় বলা যায় না।‌ আর আমার দিকে একটু তাকান। সামনে তাকিয়ে কি দেখেন? কাল থেকে তো আর আমাকে দেখতে পাবেন না। এখন আমায় দেখবেন তা না সামনে তাকিয়ে আছেন। আপনি কি আমাকে একটুও মিস করবেন না?’

‘ আরেকটা কথা বললে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো রিকশা থেকে। যতসব আজাইরা কথা বার্তা!’ ধমক স্বরে বলল ইহান।

ইহান অন্যদিকে তাকিয়ে বললো বিরবির করে, ‘ এজন্য এই গাধাটাকে জানাতে চাইনি ভালোবাসি। এখন সারাক্ষণ এসব নিয়ে পেছাল পারবে। এদিকে আমার যে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে অন্যরকম বাজে চিন্তা মাথায় আসে। তাকিয়ে থাকতে পারিনা। খারাপ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। এই যে আজ কমলা রঙের থ্রী পিস পরেছে এই রং টাতেও কি অপূর্ব লাগছে আমি চোখ সরাতে পারছি না।

ইহান আমার কথায় রাগ দেখালো তাই রাগ করে পরে বসে আছি। হঠাৎ ইহান আমার কাঁধ চেপে নিজের দিকে টেনে আনলো। আমি চমকে উঠে ইহানের হাঁটু খামচে ধরলাম। ঝাঁকুনিতে এই মুহূর্তে পরতে নিচ্ছিলাম। সময় মতো ইহান আমাকে নিজের দিকে না আনলে আমি শেষ।
বুক এখনো ধুকপুক করছে ভয়ে।

‘ ননসেন্স। এখনি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলছিলে।
এতো কিনারায় কেন বসেছো আমার সাথে গা ঘেঁষে বসলে কি গায়ে ফোসকা পড়বে নাকি হোয়াই?’

আমি নিচে দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছি। ইহানের রাগী কথা শুনে তখন আমি একদম কিনারায় ঘেঁষে বসেছিলাম। তার জন্য ই এমন একটা কান্ড ঘটছিলো। বাসার সামনে আসতেই নেমে পরলাম। ভেতরে ঢুকার পর ইহান তারা দেখিয়ে চলে গেলো। আমি মলিন মুখে তাকিয়ে র‌ইলাম।

বেলকনিতে গিয়ে তাকিয়ে র‌ইলাম। ইহান কাকে যেনো ফোন করছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কল করেছে। আমি ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে আছি।
আমার হাতের ফোনটা বেজে উঠলো। আমি তাকিয়ে দেখি ইহানের নাম জ্বলজ্বল করছে আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। তার মানে তখন আমাকে কল করছে। আমি তারা তারি রিসিভ করলাম।

‘ হ্যালো। পেছনে ঘুরেন আমি বারান্দায় দাড়িয়ে আছি।’

‘ জানি‌। আর তখনকার ধমকানোর জন্য সরি। ‘

‘ এখন ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে। আপনি আমাকে ধমকালেন কেন?’

‘তো কি করতাম। তখন ভালোবাসা দেখাতে কি চুমু খাওয়া দরকার ছিলো।’

‘ ছিহ কি সব বলছেন?’

‘এখন ছিহ বলছো কেন তুমি এটাই চাইছিলে আমি জানি। ওকে আবার দেখা হলে উসুল করে দিবো।’

‘ আরে আমি।’

ইহান কল কেটে দিয়েছে। আমি গোল গোল করে তাকিয়ে আছি।
ইহান সামনে নাই কোথায় গেলো কথা বলায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম কখন চলে গেছে টের পায় নি।

রাতে ডিনার টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছি। আব্বু কে মিথ্যা বলেছিলাম তাই খুব কষ্ট পাচ্ছি। আব্বু কিছু বলবে ভেবে কিন্তু এসব নিয়ে কিছুই বললো না তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললো। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

নানু বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত হলো আমি আর আম্মু যাবো। আব্বু বাসায় থাকবে তার অফিস আছে।
ইহানকে কল করে জানিয়ে দিয়েছি। এক সপ্তাহের মতো থাকবো।
এই এক সপ্তাহ ইহানের সাথে দেখা হবে না ভাবতেই খারাপ লাগছে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তা তো বলা যায় না কিছুদিন আগের যাওয়ার জন্য পাগল ছিলাম হঠাৎ না যেতে চাইলে কি বলবো।

নানু বাড়ি এসেই দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর এক ঘুম দিলাম‌। বিকেলে উঠেই আমি আর লিনার সাথে হাঁটতে বের হলাম। সন্ধ্যায় বেরিয়েছি তাই একটু গিয়ে ফিরে এলাম। তখন জানতে পারলাম তুষারের সাথে ওর কথা বলা অফ হয়ে গেছে। ও তুষারের কথা বলতে গিয়ে মলিন মুখে ছিলো। পছন্দ করত বুঝা যাচ্ছে। আম্মুকে কথা দেওয়ায় সে পথে আর পা বাড়ায় নি। আমি ঢোক গিলে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। ইহানের কথা বলেও জানতে দেওয়া যাবে না।
এখন সমস্যা হলো ওর সাথে থেকে আমি ইহানের সাথে কথা বলবো কি করে? চিন্তায় নখ কামড়াচ্ছি।
তা দেখে লিনা জিজ্ঞেস করলো আমি এতো কি চিন্তা করছি।’

আমি থতমত খেয়ে বললাম কিছু না।
লিনার পাশে আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। ও জানতে পারলে আম্মুকে জানাতে এক সেকেন্ড নিবে না। রাতে ইহানের কল এলো কিন্তু লিনার জন্য রিসিভ করতে পারলাম না। রাগে আমি দাঁত কিড়মিড় করে সামির রুমে এলাম‌। ছোট মামি ওকে বকা ঝকা করে পড়াচ্ছেন। আমি সেখানে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে দিনা নিসার রুমে গেলাম দুজনে কলম নিয়ে ঝগড়া করছে। আমি রুমে বড় কাউকে না দেখে সাথে পারত ইহান কে কল করলাম কিন্তু রিং হ‌ওয়ার আগেই দেখলাম মামা আসছে তারাতাড়ি ফোন লুকিয়ে ফেললাম। আর হাসার চেষ্টা করে মামাকে বললাম,

‘ এক কলম নিয়ে দু’জন কেমন ঝগড়া করছে দেখেন মামা‌।’

মামা বললো, ওদের ঝগড়ার কারণ নাই। শত এনে দাও তাও এরা ঝগড়া করবেই কিছু না কিছু নিয়ে। এই পাজির দল যা খেতে ডাকছে আম্মু খেয়ে আয়।’

দুজনেই মামার কথা শুনে ছুটে চলে গেলো। আমি ও বেরিয়ে এলাম। রাগ মাথায় নিয়ে শুয়ে আছি। লিনা বের হলে আমি কল করবো কিন্তু ও বের হলো না তুষারকে নিয়ে দুঃখের কথা বলছে আমি বিরক্ত হয়েই শুনছি কখন ঘুমিয়েছি জানি না।
সকালে উঠে অনেকগুলো মিসকল দেখলাম। আর সাথে সাথেই ঘুম ছুটে গেলো। আমি উঠে ফোন কানে নিলাম। কোন দিকে নজর না দিয়ে কল দিলাম কিন্তু নো রিসিভ। সামি দৌড়ে এসে বললো,

‘ বাইরে আসো তাড়াতাড়ি ঊষা আপু।’

আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখলাম সবাই খেতে বসে পরেছে। আটটা দশ বাজে সবাই খাওয়া শেষের দিকে। আমি যেতেই আম্মু বললো, খেয়ে নে ফ্রেশ হয়েছিস?

‘ হুম।’

খাওয়া হতেই দিনা নিসা আমার হাত ধরে বললো,

‘ আপু চলো পুকুর পাড়ে যাই। ছোটো কাকা মাছ ধরছে‌!’

আমি অবাক গলাতেই বললাম, ‘ কিহ? মামা মাছ ধরতাছে?’

‘ হুম চলো। দেখে আসি।’

‘ আচ্ছা।’

মামা মাছ ধরবে শুনে অবাক হয়েছি। নানু বাহির দক্ষিণ পাশে একটা পুকুর বেশি পানি নাই‌ কাঁদা পানি সেখানে ছোটো মামা সাথে আর অনেকে আছে তাদের আমি চিনি না। সামি এসেই লাফিয়ে পরলো কাঁদাতে তা দেখে এক ধমক দিলো মামা।
দিনা নিসা ও একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছে। আমি উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি। আগে কখনো নিজে চোখে মাছ ধরা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি। তখন ইহানের কল এলো আমি রিসিভ করেই উৎসাহিত গলায় বললাম,

‘ আমি মাছ ধরা দেখছি। ছোট মামা কাঁদায় নেমে মাছ ধরছে।’

‘ তাই আমিও তো দেখছি‌। তোমার ও ধরার ইচ্ছে আছে নাকি?

‘ ধুর আমি কেন ধরবো? ছিহ কি ময়লা নোংরা পানি আমার তো দেখেই কেমন লাগছে। এটা দেখতেই আমার ভালো লাগছে নামার শখ নাই। কিন্তু আপনি দেখলেন কি করে?’

‘ ইটস ম্যাজিক!’

‘ কি আবুল তাবুল বলছেন। আপনি মাছ ধরা কোথায় দেখেছেন বলেন? কে ধরেছে?’

‘ তোমার মামা।’

‘ আপনার মাথা গেছে।আমার মামাকে আপনি মাছ ধরতে দেখলেন কি করে? এখন আপনি কিন্তু আমার সাথে ফাজলামি করছেন!’

‘ তাই। আচ্ছা কাল ফোন রিসিভ করলে না কেন?? সকালের কল করলাম পাত্তা নাই। মামা বাড়ি এসে ভাব বেড়ে গেছে তাই না আমাকে ভাব দেখাচ্ছ?’

‘ অনেক ঝামেলায় আছি আমি। আর যতদিন আছি আপনার সাথে কথা বলা যাবে না। ওই লিনাটা সারদিন আমার সাথে চিপকে থাকে। ‘

বলতে বলতে সামনে পা বাড়াচ্ছি। আমার সামনে যে এতো বড় পুকুর আমার খেয়াল নাই। এই ইহানের সাথে কথা বলতে গেলে আমি সব ভুলে খেয়ে ফেলি। এখনো তাই হচ্ছে। আমি পাটা ফেললেই পুকুরে গরিয়ে যাব‌। তখন ইহান চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘ তারাতাড়ি পিছনে যাও। স্টুপিড পরে গেলে তো!’

আমি বুঝতে না পেরে পা রেখে কিছু বলতে যাব পেছনে থেকে একটা হাত আমাকে টেনে পেছনে নিয়ে বললো,

‘ এই তোর মাথা গেছে নাকি এখনি তো গড়িয়ে পুকুরে পরতি‌। এতো অন্যমনষ্ক হয়ে কার সাথে ফোনে কথা বলছিলি হ্যা।

লিনার কথা শুনে ফোন লুকিয়ে বুকে ফূ দিতে থাকি‌‌। এখানে থেকে পরলে মরতাম না কিন্তু ব্যাথা পেতে আর কাঁদায় নাকানিচোবানি খেতাম। ইহান আমাকে সাবধান হতে বললো কি করছ উনি আমার এই খবর পেলো কিভাবে? কি হচ্ছে এসব?

আমি ফোন কানে নিতেও পারছি না। কিন্তু বুঝতে বাকি রইলো না। হঠাৎ সামনে পুকুরের অপর পাশে চোখ যেতে হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ইহান দাঁড়িয়ে আছে কাঁধে একটা ব্যাগ আর মুখে হাসি আমি তাকাতেই হাই দিলো।
#এক_চিলতে_রোদ- ২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ)

৩৩.
আমি ইহানকে দেখে আর এক সেকেন্ড ওখানে দাঁড়ালাম লিনার হাত ধরে টেনে নানুর বাসায় চলে এলাম। এছাড়া তার উপায় ছিল না। লিনা যদি ইহানকে দেখে তাহলে তো ধরে ফেলবে ও এমনিতেই আমার বয়-ফ্রেন্ড মনে করত ইহানকে। আর এখন যদি এখানেই ইহানকে এখানে দেখে তাহলে তো ভাববে আমার জন্য ইহান এসেছে। আমি রিক্স নিতে পারলাম না। তাই বিস্ময়ের সাথে ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে এসেছি। ইহান পেছনে থেকে অবাক চোখে আমাদের যাওয়া দেখলো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো।

বাসায় আসতেই লিনা আমাকে চেপে ধরলো,

‘ এই তুই আমাকে এইভাবে টেনে আপনি কেন? কি হয়েছে?’

‘ আমার না খুব পানির পিপাসা লাগছিল তাই।’

‘ তো তুই আসতি আমাকে কেন টেনে আনলি। এমন ভাবে আনলি যেনো ভূত দেখছিস?’

‘ এমন না আসলে..

‘ এই তুই তোতলাচ্ছিস কেন?’

‘ ক‌ই না তো দাঁড়া পানি খেয়ে আসি।

রান্নাঘরে থেকে পানি খেয়ে আসতেই লিনার কথা থমকে গেলাম।

‘ এই ঊষা তারাতাড়ি চল তো‌ ওইখানে আমি ইহান ভাইকে দেখলাম মনে হলো। চল তো দেখি উনি এখানে কি করছে?’

‘ ক‌ই না তো আমি তো কাউকে দেখলাম না। কি দেখতে কি দেখছিস তুই তাকে ইহান বানিয়ে দিলি‌। চল রুমে যাই ফেসবুক একটা জিনিস দেখাবো নি। ওইখানে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ‘

বলেই আমি লিনার হাত টেনে ধরলাম। লিনা হাত ছাড়িয়ে বললো,

‘ না না আমি এখন কিচ্ছু টি দেখবো না। তুই যা রুমে আমি দেখে আসি আগে।’

‘ আরে দাঁড়া যাস না তুই ভুল দেখছিস ইহান এখানে কেন আসবে একবার ভাব।’

‘ সেটাই তো ভেবে যাচ্ছি। উনি এখানে কি করছে আমার জানতেই হবে।’

আমি চেয়েও লিনা কে আটকাতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি। এখন কি হবে উনি এখানে কেন এসেছেন? এখন কি হবে?
আমি পায়চারি করছি একবার যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছি তো পিছিয়ে নিচ্ছি। হঠাৎ আম্মু এসে আমাকে বললো,

‘ কিরে এমন হাঁসফাঁস করছিস কেন?’

‘ না মানে আম্মু!’

‘ কিসের মানে করছিস চল আমার সাথে’

বলেই হাত ধরে হাঁটতে লাগলো।

‘ আম্মু তুমি আবার আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?’

আম্মু কিছু বলবে তখন ই ইহানের আওয়াজ শুনে আমার পিল চমকে উঠলো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ইহান সামি আর লিনা এগিয়ে আসছে। আমমু্ ইহানের আওয়াজ শুনে আমার হাত ছাড়িয়ে হাসিমুখে চলে গেলো। ইহান আম্মুর সাথে হেসে কথা বলছে। আম্মু ইহানকে জিজ্ঞেস করছে,

‘ আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?’

‘ একটুও না এ তো সোজা রাস্তা।’

‘ তোমার চিন্তায় করছিলাম। চলো ভেতরে চলো ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিবে।’

ইহান মাথা দুলিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। লিনা সামি ও গেলো আমি বোকা চোখে তাকিয়ে আছি। কিছু আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি। ইহান কয়েক টা এগিয়ে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো। আমি চমকে এদিক ও দিকে তাকাতে লাগলো।

আমি দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছি আর ড্রাইনিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ড্রাইনিং টেবিলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। যেখানে বাসার সবাই একজনের আদর আপ্যায়নে বিজি। সেই মানুষটি আর কেউ না ইহান। যাকে দেখে আমার ভয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হতে যাচ্ছিল এখন সেই কিনা স্পেশাল গেস্ট হিসেবে খাবার ভর্তি টেবিলে বসে আছে। সবাই তার তদারকি করছে। সবাই যখন জানতে পেরেছে ইহান
আমার বড় চাচার ছেলে তখন থেকেই সবাই ইহানের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। খুব খেয়াল রাখছে। আম্মুর থেকে জানতে পারলাম। ইহান নাকি কাল কল করে আম্মু কে বলেছে ও কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছে কিন্তু কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। তখন আম্মু না কি অফার করেছে এখানে আসতে। আর ইহান তো এটাই চাইছিল তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেছে।আর সকাল সকাল চলে এসেছে। ভাবা যায় কি একটা অবস্থা। আমাকে আগে জানালে কি হতো? আমার কি অবস্থা হচ্ছিল। খাটাশ একটা।

আমি দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে আছি।

.
ইহান নানুদের শ্যাওলা পড়া ছাদে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে সন্ধ্যায়। আমি তা দেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে ইহানের পেছনে এসে দাঁড়ালাম। কান খাড়া করে কথা শুনছি ইহান ফারিয়ার সাথে কথা বলছে। রাগে আমার নাকের পাটা ফুলে উঠছে।

ইহান আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম,
‘ আপনি এতো খারাপ কেনো বলেন তো?’

ইহান মোবাইল পকেটে রেখে এক হাত পকেটে পুড়ে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে র‌ইল। কথা বলছে না।আমি কপাল‌ কুঁচকে আবার বললাম,

‘ কথা বলছেন না কেন? আপনি এইভাবে এখানে চলে এলেন! আর আমাকে একটু বললেন ও না!’

‘কেন বললে কি করতে? আমার জন্য সেজেগুজে অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে নাকি?’

‘ বাজে বকছেন কেন? আপনি জানেন তখন ওইভাবে আপনাকে দেখে আমি ভূত দেখার মতো চমকিয়েছি! আবার বাসায় এলে আম্মুর সাথে এতো প্ল্যান উফ কিচ্ছু টি আমি জানতে পারলাম না। সব আমার অগোচরে হলো!’

‘ এটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ ছিলো ঊষা। আগে থেকে বলে দিলে কি তুমি সারপ্রাইজ হতে?’

‘ এমন অদ্ভুত সারপ্রাইজ কে দিতে বলেছে আপনাকে? যত্তসব ফালতু কাজ।’

‘ তুমি অন্য কোন কারনে রাগ করেছো? আই মিন জেলাস ফিল করছো মনে হচ্ছে রাগটা আমার না বলে আসায় না অন্য জায়গায়!!’

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। হাত উঁচিয়ে চুল ঠিক করার বাহানায় জ্বিভে কামড় দিলাম। ইহান বুঝে গেল নাকি আমি ফারিয়ার সাথে কথা বলা শুনে জেলাস হয়েছি? এই মানুষটা সব বুঝে যায় কি করে?

‘ মুখ লুকিয়ে কি হবে? আমি তো যা বুঝার বুঝে গেছি।’

‘ কি বুঝলেন?’

‘ তুমি ফারিয়ার সাথে কথা বলাটা সহ্য করতে পারো না। বাট আমি তোমার জন্য ফারিয়ার সাথে কথা বলা অফ করতে পারবো না। শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। ও আমাকে নিয়ে যাই ভাবুক না কেন এসবের আগে আমরা বন্ধু। আর তোমার আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার কোন মানে দেখছি না। কারণ আমার যদি ফারিয়াকে গ্ৰহণ করার হতো আমি আগেই করতে পারতাম। কিন্তু…

‘ কিন্তু কি?”

‘ এখন তো আমি অন্য কারো মায়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছি। এখন আর কিভাবে ওর প্রতি আমার ফিলিংস আসবে।’

‘সেই অন্য কেউটা কে?’

আমার কথা শুনে এগিয়ে আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ধরা খেয়ে চোরের মত মুখ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। ইশ ইহান সব বুঝে যায় কিভাবে। ইহান ঝুঁকে পড়ে আমার কানের মুখ নিয়ে বলে উঠল,

‘এই যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।এই বাচ্চা মেয়েটা। যার জন্য এতো কষ্ট করে আমি এখানে চলে এলাম আর তুমি কিনা আমাকে দেখে পালিয়ে এলে। ইটস নট ফেরার ঊষা।’

আমি চোখ খিচে বন্ধ করে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। ইহান এতো কাছে আসছে কেন আমি তো মরে যাব এবার। ইহান আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো,

‘ এতো কাঁপছো কেন?’

‘ আপনি প্লিজ সরে দাঁড়ান আমার কেমন জানি লাগছে!’

‘ কেমন লাগছে?’

‘ জানি না। দূর থেকে কথা বলেন এতো কাছে আসেন কেন। আমি তো সহ্য করতে পারি না।’

‘ তাই তাহলে আরেকটু কাছে আসি।’

বলেই ইহান ফট করেই ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো আমার গলায়। আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। দুহাত উঁচু করে ইহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।
আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম।

.
বেরাতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার আর বেড়ানো হবে না। কারণ সামনে যে বড় বাসের একটা পুলের রাস্তা দেখছি। এটা পার হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় এটা দেখেই তো আমার হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। বাচ্চা সামি ও এটা পার করে ফেললো আর আমি পা রাখতে পারলাম না।
ইহান তো সবার আগে পার হয়েছে। আমি এ পাশে হাতল ধরে চেচিয়ে বললাম,
‘আমি রাস্তা পার হতে পারব না আমি বেড়াতে যাব না। লিনা তোরা চলে যা আমি বাসায় ফিরে যাব।’

আমার কথা শুনেই রেগে আগুন হয়ে আমার দিকে তাকাল। এতক্ষণ লোকটা আমার কথা ভুলে গেছো।
যাবে না কেন তিনি তো ছবি তুলছিলো‌। উনি যে এত ফটোগ্রাফি করে আগে আমার জানা ছিল না। কিছুটা মন ক্ষুন্ন ও হয়েছি ওনার এমন ব্যবহার। ইহান সাথে সাথে আবার পুল পেরে আমার কাছে চলে এলো।

‘হোয়াট ঊষা কি সব বলছো তুমি যাবে না মানে কি??’

‘যাব না মানে যাব না এটার আবার মানে কি আছে?’

‘যাবে না কেন? এত বড় রাস্তা করে রাখছে তাও তুমি ভয় পাচ্ছ এত ভীতু তুমি!’

‘একদম আমাকে ভীতু বলবেন না। কেমন বাঁশ নরবর করছে আমি এটার উপর যে কিছুতেই যাব না। একবার এটা ভেঙে গেলে আমি এই নদীতে পড়ে যাব।আর আমি সাতার পারি না তখন আমি নদীতে ডুবে মরব দরকার নাই ভাই আমার বেড়ানোর।’

‘কি বললে তুমি?’

‘আমি আবার কী বললাম! আপনি কালা নাকি। কানে শুনতে পান না এক কথা কতবার বলব?’

‘তুমি আমাকে আবার ভাই বললে! এবার কিন্তু থাপ্পর মেরে গাল লাল করে দেব চল আমার সাথে।’

বলে হাত ধরে বাশেরপুল এর উপর টেনে তুলল। আমি আঁতকে ওঠে চিৎকার করতে লাগলো।

‘আমি যাব না বললাম তো আমি পড়ে যাব মরে যাব। ‘

‘তুমি যেমন চেচাচ্ছো আর লাফালাফি করছো এমন করলে সত্যি পড়ে হয়ে যাবে। আর এইটা তো এক বাঁশের না। কতগুলা বাশ দিয়ে বড় রাস্তা তৈরি করেছে কত ছোট ছোট বাচ্চারা যাচ্ছে কিচ্ছু হচ্ছে না তুমি এখানে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে আছো।’

সামনে তাকিয়ে ছিলাম সত্যি কথা 3 বছরের বাচ্চার মায়ের হাত ধরে যাচ্ছে। আমি খানিক লজ্জা পেলাম। কিন্তু বাশ অনেকগুলো থাকলেও তো ফাঁকা ফাঁকা আমার মনে হয় আমার পা ওইখান দিয়ে ঢুকে যাবে।

দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে রাস্তা পার হলাম। নড়াচড়া হলেও সত্যি আমি সুস্থ মতোই এপারে আসতে পেরেছি। এই পাশে এসে আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমার অগোচরে ইহান অনেক গুলা পিকচার তুলে নিল। যা আমি জানতেই পারলাম না।

নদীর এই বছরটা বাগানের মত আছে। গাছগাছালি পরিবেশ টা দারুন। নিরিবিলি। অনেক মানুষ এখানে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মনটা ফুরফুর হয়ে ওঠে এখানে মুক্ত বাতাসে। আমার খোলা চুল তো এই বাতাসে শুধু দোল খাচ্ছিল। আমি সামলে উঠতে পারছিলাম না। দিনা নিসার পরীক্ষাগুলোর আসতে পারেনি। ওদের জন্য একটু মন খারাপ হয়েছিল।

লিনা কে নিয়ে আমি যে ভয় পেয়েছিলাম ও তেমন কোনো সন্দেহ করেনি। আরো আগে ওরকম সন্দেহ করেছিল বলে লজ্জা পেয়েছে কারণ ও এখন জানতে পেরেছি ইহান আমার চাচাতো ভাই। তাই এমন সন্দেহ আর করে না। ইহানের সাথে ওর ও অনেক ভাব হয়ে গেছে।

#চলবে….
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here