#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১১
প্রভাত বেলা। মেঘের কারণে সূর্যের দেখা নেয়। আকাশ টা ঘুমোট ভাব নিয়ে আছে। যেনো ভয়ংকর কোনো কিছুর আভাস দিচ্ছে। রাফাতকে আইসিইউ থেকে বেডে শিফট করা হয়েছে। তবে এখনো জ্ঞান ফিরে নি। বনুলতা রাতে অসুস্থ হয়ে পরায় এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখন সুস্থ আছে। রিয়ান হাসপাতালের করিডোরে বসে আকাশ পাতাল চিন্তা করছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। কত সুন্দর সংসার এক ঝটকায় ভেঙে গুরিয়ে গেলো। বাকি সবাই বাড়ি চলে গিয়েছে।।বনুলতার সাথে সাবা আছে। হঠাৎ নার্স এসে বলে,
– আপনার ভাইয়ের জ্ঞান ফিরছে।
রিয়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে। পরক্ষণেই আবার তা মিলিয়ে যায়। বনুলতা তার কেবিন থেকে ছুটে আসে। রিয়ানের কাছে গিয়ে বলে,
– রাফাতের জ্ঞান ফিরছে।
– জ্বি মম।
সাবা বলে,
– রিয়ান ভাই আমরা দা ভাইকে দেখতে ভেতরে যাচ্ছি না কেন?
রিয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
– ভাইকে কি বলবো আমি। কি জবাব দিবো। আমার ভালোবাসা তার ভালোবাসাকে জেলে বন্দি করে রাখছে। মম তুমি বলে দাও আমি কি করবো।
বনুলতার চোখে পানি। সে রিয়ানের হাত ধরে রাফাতের কেবিনে নিয়ে যায়। রাফাত চোখের উপরে ডান হাত উল্টো করে দিয়ে শুয়ে ছিলো। হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে চোখ মেলে তাকায়। দেখে মা ভাই দাড়িয়ে আছে। রাফাত উঠে বসতে নিলে বনুলতা ধরে ফেলে বলে,
– থাক বাবা উঠতে হবে না। তুমি আরাম করো।
রাফাতের চোখ অন্যকিছু খুজছে। বনুলতার দিকে তাকিয়ে বলে,
– মম পূর্ণা কোথায়?
বনুলতার মুখ চুপসে যায়। চোখে জমা হয় নোনাপানি। মায়ের এমন মুখশ্রী দেখে রাফাত উতলা হয়ে পড়ে। মনে জাগে ভীষণ ভয়।সে উঠে বসে। মায়ের হাত ধরে বলে,
– মম বলো পূর্ণা কোথায়? আমার পূর্ণা ঠিক আছে তো।
রিয়ান রাফাতের কাধে হাত রেখে বলে,
– ভাই কুল ডাউন। তোমার সবে মাত্র জ্ঞান ফিরছে। তুমি অনেক উইক ভাই। প্লিজ উত্তেজিত হয়েও না।
রাফাত রিয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
– মম লুক এট মি। আমার দিকে তাকাও মম।
বনুলতা ছলছল নয়নে ছেলের দিকে তাকায়। মায়ের এমন দৃষ্টি রাফাতের বুক এফোরওফোর করে দিচ্ছে। সে বনুলতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
– এই চোখের জলের কারণ কি? আমার খুব টেনশন হচ্ছে মম। প্লিজ আমাকে আর টেনশনে রেখো না। বলো পূর্ণা কোথায়?
বনুলতা ছেলের পাশে বসে তার হাতে হাত রেখে বলে,
– যা বলবো সত্য বলবো তোমাকে ধোয়াশার মধ্যে রাখবো না। পূর্ণা আমাদের মাঝে নেয়।
রাফাত অবাক নয়নে বলে,
– নেয় মানে কোথায় ওহ।
বনুলতা ছেলের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
– রাফাত রাফাত রাফাত আমার দিকে তাকাও কুল ডাউন। পূর্ণা বেঁচে আছে। ভয় পেয়ো না তোমাকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে যায় নি।
– তাহলে আমার পূর্ণা কোথায়?
বনুলতা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে,
– ওহ ওহ জেলে আছে। আমার পূর্ণাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।
কথাটা শোনা মাত্র রাফাতের যেনো দুনিয়া উল্টে যায়। সে ঘামস হয়ে যায়। চোখের পলক পড়া যেনো বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাস নেওয়া আটকে যায়। বনুলতা ছেলের এমন অবস্থা দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভয় পেয়ে যায়। বলে,
– রাফাত রাফাত কি হলো। রিয়ান রিয়ান ডাক্তার কে ডাকো। রাফাত তাকাও আমার দিকে। এমন করছো কেন?
রাফাত জোরে শ্বাস নেয়। ডাক্তার আসে। রাফাতের পালস চেক করে বলে,
– ওহ মাই গড। নার্স ইনজেকশন নিয়ে এসো।
নার্স ইনজেকশন নিয়ে এলে রাফাত ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। চিৎকার করে বলে,
– কোনো মেডিসিনের প্রয়োজন নেয় আমার।
ডাক্তার রাফাতকে আটকে বলে,
– মি চৌধুরী আপনার প্রেশার ফল করছে।
– ডাক্তার আপনাকে আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ঠিক হয়ে যাবে। আর নয়তো অলয়েস এমন রবে।
– হোয়াট আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। আপনি কতটা অসুস্থ আপনার খেয়াল আছে। আপনার স্ট্রোক হতে পারে মেডিসিন না নিলে। প্লিজ রিয়ান তোমার ভাইকে বোঝাও।
রিয়ান রাফাতকে আটকে বলে,
– ভাই প্লিজ পূর্ণার জন্য নিজেকে সুস্থ করো। সবটা শুনতে হবে তোমায়। ভাই মেডিসিনটা নাও তুমি বসে থাকতে পারছো না। কথা আটকে যাচ্ছে তোমার প্লিজ ভাই।
বনুলতা এই ভয় টাই পাচ্ছিলো। সে রাফাতের হাত ধরে বলে,
– বাবা আমার মেয়ে আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে। তুই এমন পাগলামি করিস না যাতে করে তোকেও আমাকে হারাতে হয়।
রাফাত মায়ের কথা শুনে বেডে শুয়ে পড়ে। ডাক্তার ইনজেকশন পুশ করে। একটু পর রাফাত ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু মনের ভেতরে যে দহন চলছে সেই দহন যে আগের থেকে দ্বিগুন পরিমাণে বেড়েছে। এইখান থেকে সে কীভাবে রক্ষা পাবে তার মেডিসিন তো কয়েদিখানায় বন্দি। রিয়ান রাফাতকে বলে,
– ভাই এখন কেমন লাগছে।
রাফাত জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমার পূর্ণা কি করেছিল যার জন্য তাকে জেলে যেতে হলো। তুই আটকাতে পারলি না। জামিন আনতে পারলি না। মেয়েটা ঐ রকম একটা পরিবেশে কীভাবে থাকবে।কী খাবে।
– ভাই তুমি শান্ত হও। আমি সব বলছি। তোমাকে আঘাত করে যেদিন পূর্ণাকে ওরা নিয়ে গেলো। জানো কে নিয়ে গিয়েছিল।
– আন্দাজ করতে পারি।
– বলোতো কে?
– আহির।
– শুধু আহির না ভাই। শত্রু আরও একজন বেড়িয়েছে। ঘর শত্রু। আপনজন।
রাফাত বিস্ময় নিয়ে বলে,
– কৌশিক ভাই। তোমার আমার আদরের ছোট ভাই। যাকে তুমি না খেয়ে খায়িছো। মা বকলে নিজে বুকে নিয়ে ঘুম পারিয়েছো। যে কোনো বায়না করলে তুমি নিজের রক্ত বির্সজন দিয়েও পূরণ করার চেষ্টা করেছো। যার জন্য তোমার জীবন হাজির ছিল। আব্বুর রাগ মমের অবহেলা সবকিছু থেকে যাকে তুমি আগলে রেখেছো। জানো ভাই তোমার আদরের ভাই তোমার মাথায় বন্দুক ধরেছে। জানো ভাই তোমার আদরের ভাই তোমাকে প্রতিদিন ঘুমের ঔষধ দিয়েছে যাতে তুমি ধীরে ধীরে মারা যাও। তোমার নার্ভ কাজ করা বন্ধ হয়ে পড়ে। তোমার প্রোপ্রাটী নিজের নামে করতে চেয়েছে। আমি আর বলতে পারছি না ভাই।
রিয়ান কাঁদছে।গলা আটকে আসছে তার। নিজের ভাই যাকে এত ভালোবাসলো যাকে এত বিশ্বাস করলো সে যখন বেইমানি করলো তখন কেমন লাগে। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার।বার বার কৌশিকের বলা কথা কানে বারি খাচ্ছে। আর রাফাত যেনো মূর্তি হয়ে গিয়েছে। রাফাতের সামনে এখনো কৌশিক বা আহির আসে নি। মুখোশ পড়ে আসতো। একের পর এক ঝটকা রাফাতকে ভেতর থেকে গুরোগুরো করে দিচ্ছে। রাফাত খুব কষ্টে গলা ভিজিয়ে বলে,
-তারপর।
রিয়ান চোখের পানি মুঝে বলে,
– ওরা পূর্ণাকে বাইজি গৃহে নিয়ে যায়।
কথাটা শোনার পর রাফাতের শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। রাগী কন্ঠে বলে,,
– কী হয়েছিল বাইজি গৃহে।
– ভাই ওরা পূর্ণাকে একটা ছেলের সাথে থাকতে দেয়। সেখানে কৌশিক ছিলো। পূর্ণা ভাবে কৌশিক ওকে সাহায্য করতে এসেছে। কিন্তু না কৌশিক ওকে ঐ ঘরে তালা বন্দি করে চলে যায়।পূর্ণা নিরুপার হয়ে পড়ে। লোকটা ওকে আক্রমণ করে পূর্ণা উপায় না পেয়ে লোকটাকে আঘাত করে লোকটা মাটিতে পড়ে যায়।পূর্ণা ভাঙা ফুলের টপের কাঁচের টুকরো লোকটার দিকে ছুড়ে মারে লোকটার চোখে গিয়ে লাগে। লোকটা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে। সে পূর্ণার দিকে ছুড়ি নিয়ে আসে। পূর্ণা সে ছুড়ি দিয়ে লোকটার বুকে আঘাত করে। বার বার আঘাত করে যতক্ষণ না লোকটা মারা যায়।
কথাটা বলে রিয়ান জোরে শ্বাস নেয়। আর রাফাত চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাফাত জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
– তারপর।
তারপরের কথা রিয়ান সব বলে রাফাতকে। সব শোনার পর রাফাত বলে,
– তাই বলে ওতো ইচ্ছে করে খুন করেনি। ওর হাতে অন্য কোনো অপশন ছিলো না। ঐ মুহূর্তে ঐ কাজ ওহ না করলে ওর সতিত্বে দাগ পড়তো। যার জন্য ওর জীবনে এত লড়াই।
– কিন্তু ভাই আইন তো এইসব মানবে না।
রাফাত রেগে বলে,
– কেন মানবে না শুনি। মিহু চাইলে ঘটনাটা মাটি চাপা দিতে পারতো। খুন নয় দিস ইজ এক্সিডেন্ট। মিহু এইটা বলতে পারতো খুনটা কে করেছে সে জানে না অপরাধীকো খুজে পায়নি সে।
বনুলতা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে,
– মুহাব্বাত তোমার চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। এখন তোমার কাছে মনে হবে পূর্ণা যা করেছি সব ঠিক করেছে। কিন্তু তোমার মতো সবাই তো পূর্ণাকে ভালোবাসে না তাই ওরা ভেবে নিয়েছে পূর্ণা দোষী। একবার মাথা খাটিয়ে চিন্তা করো।
রাফাত মায়ের হাত সরিয়ে বলে,
– কেন মম। তুমি পূর্ণাকে ভালোবাস না বলো। তোমারও কি মনে হয় পূর্ণা ইচ্ছে করে সব করছে।
– দেখো রাফাত দুনিয়াতে তোমার পরে যদি কেউ পূর্ণাকে খুব বেশি ভালোবেসে থাকে সেটা আমি। আমার ছেলের ভালোবাসা ভেবে ওকে ভালোবাসিনি। নিজের মেয়ে ভেবে ভালোবেসেছি। তাই আমি চাই না ওর সাজা হোক। কিন্তু কোন উকিল ওর কেসটা লড়বে তুমি বলতে পারো। যেই জায়গা ওহ নিজে জবান দিচ্ছে যে ওহ স্টিফেন নামের ঐ বিদেশীকে নিজে হাতে ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করেছে বলো।
রাফাতের চোখে পানি টলমল করছে। সে তার মাকে জরিয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। কান্না করে বলতে থাকে,
– কেন মম। কেন বার বার আমার সাথে এমন হয়। আমি কেন বার বার পূর্ণাকে পেয়ে হারিয়ে ফেলি। কেন মম সেদিন ওর মায়ের কথা শুনে চলে আসলাম। কেন একটু সাহস করে নিজের সাথে পূর্ণাকে নিয়ে আসলাম না। কেন মম সেদিন আমি পূর্ণাকে খুজে পায়নি কেন কৌশিকের হাতেই ওকে পড়তে হলো।মম আমি কেন সেদিন নিজের সাথে করে পূর্ণাকে ঐখানে নিয়ে গেলাম কেনো ওর হেফাজত করতে পারলাম না। কেন নিজের ইজ্জত বাঁচাতে ওকে কাউকে খুন করতে হলো। কেন ঐ খুনটা আমার হাতে হলো না। মম আই লাভ হার মম। আই লাভ হার। পাগলের মতো ভালোবাসা ঐ মেয়েটাকে আমি। ছোট্ট বেলা থেকে বুকের মধ্যে ওর জন্য ভালোবাসা জমিয়েছি। এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ওর জন্য আমি আমার রাজ্য তৈরি করেছি।নিজেকে তৈরী করেছি। কত ভালোবাসি আমি ওকে আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না মম।দিন দিন এই ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। এই মেয়েটাকে ছাড়া আমার শ্বাষ নিতে কষ্ট হয় মম। দুম আটকে আসে। মনে হয় আমার জন্য এই পৃথিবীতে অক্সিজেন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।মম আমি পাগল হয়ে যাব মম। আমার ওকে চাই। আমার ওকে চাই।
বনুলতা চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। রিয়ান ভাইয়ের পাগলামি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। সাবা হেচকি তুলে কাঁদছে। ছোটবেলা থেকে যেই মানুষ টাকে শক্ত পাথরে গরা মূর্তি ভেবে এসেছে। সে আজকে একটু ভালোবাসা পাবার জন্য পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। বনুলতা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
– আমি তোমাকে পূর্ণার কাছে নিয়ে যাব। তুমি এইভাবে কান্না করো না রাফাত।। বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যায় আমার।
রাফাত চোখ মেলে তাকায়। মায়ের বুকে থেকে উঠে বলে,
– কাঁদের জন্য আমার পূর্ণাকে জেলে যেতে হলো মম। কোন পুলিশ ওকে গ্রেফতার করেছে।
রাফাতের এমন শান্ত দৃষ্টি ভয়াবহ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই রিয়ান রাফাতের পায়ে পড়ে বলে,
– ভাই প্লিজ মিহুর কোনো ক্ষতি করো না। ওহ একজন সৎ পুলিশ।ওহ শুধু ওর ডিউটি পালন করছে। তুমি ওকে ছেড়ে দাও।
– তুই কেন ওর জন্য মরছিস।
সাবা হেচকি তুলা অবস্থায় বলে,
– রিয়ান ভাই যে মিহু আপুকে ভালোবাসে। মিহু আপুও রিয়ান ভাইকে ভালোবাসে। মিহু আপু রিয়ান ভাই পূর্ণা এরা সবাই মিলে তোমাকে খুজে বের করছে দা ভাই।
রাফাত রিয়ানের মাথায় হাত রেখে বলে,
– চিন্তা করিস না। তোর ভালোবাসা আমি কেড়ে নিবো না। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা অনেক। আমি চাইনা আমার ভাই সেই যন্ত্রণা ভোগ করুক। এখন বল তোর মিহু কি আমায় একবার আমার পূর্ণার সাথে দেখা করতে দিবে।
– ভাই আজ পূর্ণার কেসটা কোর্টে উঠছে। তাই ওকে নিয়ে সবাই কোর্টে যাবে। তুমি চাইলে কোর্টে যেতে পারো।
– ওর কেসটা কে দেখছে?
– ভাই দেশের বিখ্যাত উকিল এ্যাডভোকেট জলিল।
– ঠিকাছে তোরা সবাই উপস্থিত থাকিস। আমি থাকলে মেয়েটা হিম্মত হারাবে। ভয় পাবে। আমার সামনে যে খুবই দুর্বল। দুনিয়ার সামনে সে বাঘিনী হলেও আমার কাছে খোরগোশের বাচ্চা। আচ্ছা আজ কি ঝুমুর বাইজির কেসও কোর্টে উঠছে।
– জ্বি ভাই।
– আচ্ছা তোরা যা।
– হুম।
রাফাত একা একা কেবিনে বসে চিন্তা করছে। একজন বাইজির কি শাস্তি হতে পারে। সে কি একবার ঝুমুর বাইজির সাথে দেখা করবে। রাফাত মোবাইল হাতে নিয়ে একজনকে কল করে। কল রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে সে বলে,
– জবা মা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– আমি জানতাম রাফাত তুই আমায় কল করবি। বল কি জানতে চাস।
– যেহেতু যান আমি কল করবো। তাহলে এইটাও জানো কেন করবো। বলে ফেলো আমার প্রশ্নের জবাব।
– ঝুমুর সম্পর্কে জানতে চায়ছিস।
– হ্যা গত বিশ বছর আগে যেই সত্য মাটি চাপা ছিলো এই ঝুমুর কি সেই ঝুমুর।
– হ্যা এইটাই আমার ছোট বোন ঝুমুর।
– ওহহ। তাহলে আমি রাখি।
– রাফাত হ্যালো তুই কিন্তু কিছু করবি না। রাফাত হ্যালো শুনছিস রাফাত।
জবা বেগম মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে রাফাত কল কেটে দিয়েছে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে,
– আল্লাহ্ সবকিছু যেনো ঠিক থাকে ঝুমুরের কিছু যেনো না হয় ওর শাস্তি আদালত দিক আমার কোনো সমস্যা নেয় কিন্তু রাফাত যেনো কিছু না করে।
রাফাত হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে সোজা পুলিশ স্টেশন আসে। এসেই মিহুর সাথে দেখা হয়। মিহু রাফাতকে দেখে বলে,
– আরে দা ভাই প্লিজ সিট। আপনি পূর্ণার সাথে দেখা করতে আসছেন। কিন্তু দা ভাই ওহ চাইনা আপনার সামনে দাড়াতে। ওর সেই শক্তি নেয়। আপনার মুখের যেই অবস্থা তা দেখলে ওহ আরো শেষ হয়ে যাবে দা ভাই। ওহ আমাকে সোজাসুজি বলছে রাফাত আসলে চলে যেতে বলবেন।ওর সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা আমার নেয়।
– আমি জানি। তুমি ঝুমুর বাইজির সাথে আমার দেখা করানোর ব্যবস্থা করো।
– কিন্তু দা ভাই।
– যা বলছি করো।
– সরি দা ভাই একটু পরে আদালতে যাব। তখন কথা বলে নিবেন।
রাফাত ধমকে বলে,
– তুমি আমায় সরি বলছো।দেখো মিস মিহু আমার ভাইয়ের ভালোবাসা বলে তোমায় আমি কিচ্ছু বলছি না। এমিডিয়েটলি দেখা করানোর ব্যবস্থা করো।
মিহুও ধমকে বলে,
– সরি মিস্টার রাফাত চৌধুরী এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আপনি আসুন।
– হোয়াট। ওকে দেখো আমি কি করি।
রাফাত মোবাইল বের করে একজনকে কল করে কিছু কথা বলে। একটু পর মিহুর মোবাইলে কল আসে। সে বলে,
– ওকে ওকে স্যার আমি করে দিচ্ছি। নো প্রবলেম স্যার নো প্রবলেম।
কলটা কেটে মিহু রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
– এত ক্ষমতা তাহলে পূর্ণাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান। ওহ যে কষ্ট পাচ্ছে।
– ওহ সেচ্ছায় থাকছে। ওহ শাস্তি পেতে চায় তাই।এখন বলো কোথায় ঝুমুর বাইজি।
মিহু রাফাতকে নিজের সাথে নিয়ে যায়। ঝুমুর বাইজি উল্টো দিকে ঘুরে দাড়িয়ে আছে। এইখানে আর কোনো কয়েদি নেয়। শুধু ঝুমুর বাইজি একা। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে জেলখানার ছোট্ট ভেন্টিলাইটারের আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মিহু রাফাতকে রেখে চলে যায়। রাফাত ঝুমুর বাইজির দিকে তাকিয়ে ডাকে,
– মামনি।#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১২
রাফাত ঝুমুর বাইজির দিকে তাকিয়ে ডাকে,
– মামনি।
কারো ডাকে ঝুমুর বাইজি পেছন ফিরে তাকায়। চোখের সামনে দেখতে পায় রাফাতকে। রাফাত পাঞ্জাবি পড়ে পেছনে দুহাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঝুমুর রাফাতের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– রাফাত চৌধুরী।
– হ্যা।
– তা হঠাৎ ঝুমুর বাইজির কাছে।
– মামনি তুমি নিজের পরিচয় ঢেকে রাখলেও আমি কিন্তু তোমাকে চিনতে ভুল করেনি।
রাফাতের কথায় ঝুমুর বাইজি কেপে উঠে। সে রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কে কইছে আমার পরিচয়?
রাফাত দাম্ভীকতার সাথে বলে,
– রাফাত চৌধুরী চাইলে সব জানতে পারে। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তুমি। আর এইসব আঞ্চলিক ভাষা ছাড়ো আমি জানি তুমি শুদ্ধ ভাষা পারো।
– এমন কোনো প্রশ্ন করিস না রাফাত যার উত্তর আমি তোকে দিতে পারবো না।
রাফাত রেগে বলে,
– কেন পারবে না। জবাব তোমাকে দিতে হবে। কেন তুমি বাইজি। কেন তুমি হারিয়ে গিয়েছো? কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছো? কেন আমার পূর্ণার ক্ষতি করার ট্রাই করছো? আমাকে জানে মারতে চাইছো? মামনি আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। ছোট বেলায় মায়ের কাছে না গিয়ে আমি তোমার কাছে ঘুমাতে। তোমার হাত ছাড়া আমার খাওয়া হতো না। তুমি বুকে না নিলে আমার ঘুম আসতো না। তুমি জামা পড়িয়ে না দিলে আমার পড়া হতো না। শত মান অভিমান তো তোমার সাথে ছিলো। সবথেকে ভালো তো তুমি আমায় বুঝতে। আমার জেদ আমার রাগ তুমি সহ্য করতে তাহলে আজ কেন তুমি এইখানে। কোন যন্ত্রণায় আজ তুমি বাইজি। বলো স্পিক আপ ডেমেট।
ঝুমুর রাফাতের হুকারে কেপে উঠে। ছেড়ে দেয় চোখের পানি। অশ্রু শিক্ত নয়নে তাকায় রাফাতের দিকে। ছোট্ট রাফাত আজ কত বড়। সেই ছোট্ট ছোট্ট হাত পা আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। ঝুমুর বলে,
– এইসব প্রশ্ন গিয়ে নিজের মমকে কর।
– কেন মমকে কেন করবো তুমি বলবে। তুমি জানো তুমি চলে যাওয়ার পর আমি এক মাস জ্বরে ভুগছি। আমার খাওয়া হয়নি ঠিক মতো। তুমি কি এইসব জানো। আর জানলেই বা কি তুমি তো পাষাণ হয়ে গিয়েছো। তুমি তো জানতে না আমি তোমার মেজো আপার ছেলে তাহলে কেন আমাকে ঐভাবে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছিলে বলো।
ঝুমুর রাফাতের হাত ধরে বলে,
– বিশ্বাস কর রাফাত আমি তোকে মারতে চায়নি।
রাফাত এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বলে,
– ডোন্ট টাচ। আমি কোনো বাইজির হাতের স্পর্শ চায় না।
– রাফাত। তুই আমাকে এইভাবে বলতে পারিস না।
– কেন পারি না। বাইজি কে বাইজি বলবো না তো কি বলবো।
– স্টোপেট রাফাত। আমি ইচ্ছে করে বাইজি হয়নি। আমাকে বাইজি বানানো হয়েছে। বাধ্য হয়ে আজ বাইজি হয়েছি।
– তাহলে শুনি কে তোমায় বাধ্য করলো।
– এতই যেহেতু পুরান ঘা নতুন করার শখ জেগেছে তোর তাহলে বলছি শোন। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন মেজো আপার বিয়ে হয় রশীদ ভাইয়ের সাথে। বড় আপার দুইবছর আগে বিয়ে হয়েছে কিন্তু কোনো সন্তান হয়নি। তাই মেজো আপার বিয়ের বছরই সন্তান নেয়। তুই জন্মগ্রহণ করিস। তখন আমি দশম শ্রেণিতে উঠেছি। তোদের বাড়ি আগে থেকেই অনেক নামকরা ছিলো। চৌধুরী বাড়ি। তোর দাদা আমাদের এলাকায় বিচার সভা করতো। তাই তাদের অনেক নামডাক ছিলো। একদিন আম্মা বললো মেজো আপার নাকি জ্বর হয়ছে। তাই সবকিছু সামাল দিতে পারছে না। এইদিকে রশীদ ভাই কাছে ব্যস্ত তাই আসতেও পারছে না। তাই আমারে আম্মা তোদের বাড়ি পাঠাইলো নেমে আসলো আমার জীবনে অন্ধকার। আমি তোদের বাড়ি যাই। তুই তখন এক মাসের। আপা অসুস্থতায় শরীর টা বিছানার সাথে লেগে গিয়েছে। তাই আমিই তোর দেখভাল করতাম। যেই সময়টা তোর মায়ের কাছে থাকার কথা ছিলো সেই সময়টা তুই আমার সাথে থাকলি। তাই আমার অনেক বাধ্য হয়ে গেলি তুই। তোর বাপ খুব ভালো মানুষ নারে রাফাত। ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকে। এখন অবশ্য বয়স হয়ছে ভালো পথে আসছে। তবে ব্যবসায় লোস আর চাকরি চলে যায় তিনি ভেঙে পড়ছেন। নাহলে কোনো সময়ই তোর মায়ের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো না। এক রাতে আপা খুব অসুস্থ। আমি আপার পাশে বসে ছিলাম। আপা ঘুমায় ছিলো। তুই আমার ঘরে ছিলি। রশীর ভাই বাড়ি ছিলো না। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠে। আমি গিয়ে দরছা খুলে দেখি রশীদ ভাই আসছে। আমি বলি ভাই আসছেন আপা অনেক অসুস্থ। সে ঢুলতে ঢুলতে আমার উপরে পড়ে যায়। বুঝতে পারি ভাই নেশা করে বাড়ি ফিরছে। তাই তাকে ছেড়ে নিজের ঘরে চলে আসতে যায়। কিন্তু সে সেদিন আমায় ছাড়েনি। তার দৃষ্টিতে ছিলো কিছু না পাওয়ার তৃষ্ণা। উনি আমাকে আমার ঘরে নিয়ে আসে। জোরজবরদস্তি আমার সাথে।
কথাটা বলে ঝুমুর আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে। রাফাত ঘেন্নায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঝুমুর আবার বলতে শুরু করে,
– রাফাত তুই ছোট ছিলি আমার পাশেই ছিলি কিন্তু কিছু করতে পারিসনি। খুব কেঁদেছিলি তুই।
রাফাতের খুব কষ্ট হয় নিজের বাবার নামে এইসব শুনতে তাও বলে,
– কতদিন চলে এইসব?
– যতদিন আমি তোদের বাড়ি ছিলাম। একসময় আমি সবটা মেনে নেয়। উনি আমাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখায়। আবার ভয়ও দেখায় সবাইকে সব বলে দিবে। তাই মুখ বুজে সব সহ্য করি। কখনো আপা কিছু বুঝতে পারেনি। অসুস্থ ছিলো সারাদিন ঘরে থাকতো। বেঁচে থেকেও কেমন জানি একটা লাশে পরিণত হলাম। বাড়ি চলে আসি। কয়েকদিন পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। বার বার বমি হয় মাথা ঘুরায়। আম্মা একদিন খুব বকে। বলে কার সাথে কি করে আসছোস। মুখে তো চুন কালি লাগায় দিলি। বড় আপা মারে। মেজো আপা বাড়ি থেকে বেড় করে দিতে চায়। আব্বা বটি নিয়ে উঠছিল মারার জন্য। আমি রশীদ ভাইয়ের কাছে যায় বলি,
– কেন এমন করলেন এখন আমায় বিয়ে করেন।আমি তো কাউকে বলতেও পারছি না। আপনি আমায় বিয়ে না করলে আমি সবাইরে সব বলে দিবো।
সেদিন সে আমায় অনেক মারে। বলে আমি কি জানি তোর যা ইচ্ছা তাই কর। বাড়ি আসি বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে। মেজো আপার কাছে যায় সব খুলে বলি। মেজো আপা প্রথমে রেগে গেলেও পড়ে খুব কাঁদে। কারণ সে তো জানে তার স্বামী কেমন। আপা আমার হাত ধরে বলে,
– কাউকে কিছু বলবি না। আমি সব ঠিক করে দিবো। দরকার পড়লে বাচ্চা নষ্ট করে দিবো।
আপার কথা শুনে সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম। বাচ্চা আসলো আমাদের দোষের কারণে অথচ সে না দোষ করে পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। মানলাম না আপার কথা বললাম,
– আপা বাচ্চা আমি নষ্ট করবো না। আমার তো মান সম্মান গেছেই দরকার পরলে তোর জামাইয়ের মান সম্মানও আমি ধুলোয় মিশাবো। আমি পুলিশের কাছে যাব। বিচার চাইবো।
সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম চৌধুরী বাড়ি। তোর দাদার কাছে সব বলেছিলাম সাহস করে। সে আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
– সব ঠিক করে দিবে। রশীদকে বলবে আমাকে বিয়ে করার জন্য।
ভরশা পেলাম। খুব খুশী লাগছিলো সেদিন। কিন্তু তার ভালোমানুষীর আরালে যে অন্য কিছু ছিলো সেটা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ রাস্তায় একটা গাড়ি থামে। কিছু বুঝার আগে আমাকে তুলে নেয়। নিয়ে আসে এই বাইজি গৃহে। বন্দি হয়ে যায় বাইজি গৃহে। কত নির্যাতন অত্যাচার সহ্য করেছি আমি। তবুও বাচ্চাটাকে আগলে রেখেছিলাম। একদিন আমার বাচ্চা হয়। তবে ছেলে সন্তান হয়। যা বাইজি গৃহের কোনো কাজে আসবে না। তাই আমার সন্তানকে বিক্রি করে দেয় এক বড়লোক ব্যবসায়ীর কাছে। খুব কেঁদেছিলা জানিস। সন্তান হারিয়ে বাবা মা হারিয়ে প্রিয়জন হারিয়ে কি দোষ ছিলো আমার কেন হারালাম আমি এইসব। কেন হলো আমার সাথে এইসব। তারপর থেকে নিজেকে পাল্টে ফেলি। নিজের ভালো মানুষের রূপটাকে খুন করে অমানুষ রূপ টা তৈরি করেছি। জানিস আমাকে সেদিন কে বাইজি গৃহে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল তোর মা। তোর মা ওর দাদা পরিকল্পনা করে আমাকে আটকে দিয়েছে। আমি নাকি তোর মার সংসার নষ্ট করতে চেয়েছি। কত বড় কথা ভাব। আমার জীবন টা নষ্ট হয়ে গেলে তাতে কারো কিছু হলো না। অথচ আমার জন্য নাকি তার স্বামী শেষ হয়ে গেলো। আমি কী দোষ করেছিলাম বল যার জন্য এত বড় শাস্তি। আমার সতেরো বছরের জীবনে কেন এত বড় ঝড় এসেছিল বল।
ঝুমুর কাঁদছে। রাফাত মাথা নিচু করে সব শুনছে। এর অনেক কিছুই সে জানতো না। ছোটবেলায় ঝুমুর ছিলো তার প্রাণ। সে নিজের মায়ের কাছে যতটুকু না ছিলো তার থেকে বেশি থাকতো ঝুমুরের কাছে। রাতে ঘুমাতো ঝুমুরের কাছে। সবকিছু ঝুমুরের কাজে করতো। একদিন ঘুম থেকে উঠে সে আর ঝুমুর কে পায়নি। ঝুমুরের জন্য সে অনেক কেঁদেছিলো। কাঁদতে কাঁদতে জ্বর বাধিয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি ছিলো এক মাস। জ্ঞান ফিরলেই মামনি মামনি করতো। একদিন ওর জবা মা এলো এসে বললো,
– ঝুমুর চলে গিয়েছে। ঝুমুর খুব বাজে। ওহ খারাপ কাজ করেছে। তাই ওহ চলে গিয়েছে।
ছোট্ট রাফাত সেদিন কিছু বুঝতো না। শুধু জানতো তার মামনি খারাপ কাজ করেছে। যে খারাপ কাজ করে সে কখনো ভালো হয় না। এই একটা কথা তার মনে গেথে দেওয়া হয়েছিলো। যেখান থেকে সে ঝুমুর কে ঘৃণা করতে শুরু করে। কিন্তু আজ সেই ঘৃণার পাল্লা ভেঙে চুরে শেষ হয়ে যায়। রাফাত ঝুমুরের হাত ধরে বলে,
– আচ্ছা মামনি আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। আমি তো তোমাকে ভালোবাসতাম। তোমার ছেলে হিসেবেই ছিলাম। তাহলে আমাকে কেন প্রাণে মারতে চায়লে বলো। পূর্ণার কেন এত বড় ক্ষতি করলে। আজ তোমাদের জন্য ওহ জেলে। এইখানে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কে হলো আমি আর আমার ভালোবাসা। এইটা করে তুমি কিসের শান্তি পেলে বলো। না রশীদ চৌধুরী কষ্ট পেলো না বনুলতা চৌধুরী। ওদের তো সব ঠিক আছে। শুধু আমি ঠিক নেয়। আমার কলিজাটা এইখানে পড়ে আছে। আমার সাথে কেন এমন হয়। ছোট বেলায় তোমায় হারালাম।এখন আবার পূর্ণা। আমার উত্তর দাও।
ঝুমুর চোখ মুঝে বলে,
– আমি জানি তুই কোনো অন্যায় করিসনি। না করেছে পূর্ণা কোনো অন্যায়। কিন্তু আমি তোর মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এইসব করেছি। দূর থেকে খবর রেখেছি বনুলতার প্রিয় ছেলে কে? খবরটাও পেয়ে গেলাম তার প্রিয় ছেলে তার বড় ছেলে। সে নাকি বড় ছেলে ছাড়া কিছু বুঝে না। তাই ভাবলাম এইটা সুযোগ। তবে রশীদ চৌধুরীকে অনেক আগেই শাস্তি দিয়েছি। আমার এই ক্লায়েন্টকে দিয়ে ওর চাকরি কেরেছি। ব্যবসায় ধ্বংস করেছি। তারপর রইলো বনুলতা তাই এইবার তার পালা। কি করে তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। তাই ভাবলাম সে যেমন আমার ছেলে কেড়েছে আমি তার ছেলে কেড়ে নিবো। ভাবলাম কি করে সম্ভব। তখন দেখলাম বড় আপার ছেলে একটু এইসব লাইনে আছে। ওকে আমার দলে টানলাম। ওকে দিয়ে কৌশিককে আমার দলে আনলাম। আনার পর শুনলাম কৌশিকের তোদের প্রতি অনেক রাগ। বিশেষ করে তোর উপর। ওহ তোকে খুন করতে চায়।কারণ একটায় বনুলতার চোখের মনি তুই। মনে মনে ভাবলাম যদি বনুলতার চোখের মনি উপরে ফেলি। কিন্তু আবার কষ্টও হয়েছে বিশ্বাস কর। এক সময় তো তুই আমার প্রাণ ছিলি। কিন্তু প্রতিহিংসার জ্বালায় তোকে বন্দি করতে চায়লাম। কিন্তু রাফাত চৌধুরীর যে অনেক ক্ষমতা তাকে বন্দি করা খুব কঠিন। তাহলে তার দুর্বল স্থান কোথায় কীভাবে তাকে বন্দি করা যায়। খুজে পেলাম পূর্ণাকে। কে এই পূর্ণা খোজ নিয়ে দেখি আমাদের আসমার মেয়ে। এ তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পেয়ে গেলাম। আসমা আমাদের ডেরা থেকে পালিয়েছিল মেয়ে নিয়ে। আসমা অনেক সুন্দর ছিলো ওর ছন্য আমাদের অনেক ইনকাম হতো। ভেবেছিলাম ওর মেয়ে দিয়েও অনেক ইনকাম করবো। কিন্তু আসমা পালালো ওকে খুজে পাওয়া যায়নি। শেষমেষ খুজে পেলাম। তোর দুর্বল স্থান খুজতে গিয়ে। প্রথমে পূর্ণাকে তুলে আনতে গেলাম পারলাম না আসমা বাধা হয়ে দাড়ায়। আহির খুন করে আসমাকে। পূর্ণা পালায়। প্লান করি অন্যভাবে। পূর্ণাকে নিয়ে আসে কৌশিক তবে বন্ধু সেজে তোদের বাড়ি। কাজটা আরো সোজা হয়ে গেলো। তোকে আটকানো যাবে সাথে পূর্ণাকেও পাওয়া যাবে। ঠিক তাই হলো। কিন্তু মেয়েটা বড্ড চালাক। আমি ভাবিনি ওর মতো বাচ্চা মেয়ে ওমন একটা পুরুষ মানুষকে খুন করতে পারে। এই ক্ষমতা ঐ মেয়ের কাছে। স্টিফেনকে খুন করে পূর্ণা পালায়। মাঝ পথে আহিরকে আঘাতও করে। খুব অবাক হয় এই মেয়ের অস্ত্র চালানোর হাত এত পাকা। আসলে মানুষ বিপদে পড়লে রুখেই দাড়ায়। পূর্ণাও তাই করেছে। কৌশিক তোর সই নিয়ে নিজে সম্পত্তির মালিক হতে চেয়েছিলো। তারপর তোকে মেরে গুম করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে বাধা হয়ে দাড়ায় পূর্ণা। আজ ঐ মেয়ের জন্য আমি জেলে। ওকে আমি ছাড়বো না। একবার জেল থেকে বের হয়।
ঝুমুরের চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। এইদিকে রাফাত উচ্চস্বরে হেসে দিয়ে বলে,
– আল্লাহর কাছে দোয়া করো যাতে তোমাকে জেল থেকে বেরুতে না হয়।কারণ তুমি বের হলে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না।
– তুই কি আমায় হুমকি দিচ্ছেস।
রাফাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– হুমকি না সাবধান করছি।
কথাটা বলে রাফাত চলে যাওয়ার জন্য দুপায় বেড়িয়ে আবার ঝুমুরের দিকে ঘুরে তাকায় তারপর বলে,
– ঝুমুর বাইজি সব ঠিক ছিলো একটা চাল তুমি ভুল চেলেছো।
– মানে।
– তোমার ছেলে বেঁচে আছে। কোথায় আছে জানো।
ঝুমুর উৎসাহিত হয়ে বলে,
– কোথায়?
– এই জেল খানায়। তোমার ছেলে আর কেউ নয়। যাকে তুমি খারাপ পথে আনছো সেই কৌশিক চৌধুরী। হ্যা রশীদ চৌধুরী অন্যায় করছে। বনুলতা চৌধুরী তোমায় বাইজি গৃহে পাঠিয়েছে। কিন্তু তোমার ছেলেকে ভদ্র সমাজেই বড় করেছে। মা বাবার পরিচয় দিয়ে বড় করিয়েছে। কিন্তু তুমি আর তোমার ছেলে তা বুঝলে না। অবুঝের মতো নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করলে।
কথাটা বলে রাফাত বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। এইদিকে ঝুমুর পা ভেঙ্গে মাটিতে বসে পড়ে। চিৎকার করে বলে,
– পাপের শাস্তি ভোগ করছি। আমার ছেলেকে আমি নিজেই…
কথাটা বলে ঝুমুর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
রাফাত চলে আসলে মিহু বলে,
– কথা শেষ।
– জ্বি পূর্ণা কোথায়?
– পূর্ণাকে এখন কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে। গাড়িতে উঠানো হয়েছে।
রাফাত দৌড়ে বাহিরে আসে। পূর্ণা মাথা নিচু করে মাথায় ঘোমটা টেনে গাড়িতে বসে আছে। পরিস্থিতি এমন সবাই পূর্ণাকে ঘিরে ধরেছে। সাংবাদিকরা পারছে তো গিলে খাচ্ছে। পূর্ণা চুপ করে বসে আছে। রাফাতে কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। শ্বাষ নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রেয়শিকে এইভাবে দেখতে হবে কখনো সে ভাবেনি। এর থেকে হয়তো মৃত্যুও সহজ। রাফাতের কাছে এই মুহূর্তে এইটাই মনে হচ্ছে। মিহু আসলে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যায়। মিহু গিয়ে গাড়িতে বসে। গাড়ি স্টার্ড দেয়। হঠাৎ পূর্ণার কি যেনো মনে হয় সে ডানদিকে তাকায়। দেখে রাফায় অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাফাতের এমন চেহারা দেখে পূর্ণার গলাটা শুকিয়ে আসে। চোখে নোনাপানির দেখা মিলে। চোখের ভাষায় অনেক কিছু বুঝায়। রাফাত দূর থেকে চোখের ভাষায় বুঝায়,
– আমি পারছি না পূর্ণা খুব কষ্ট হচ্ছে। এইভাবে চলে যেও না।
পূর্ণার গাড়িটা চলে যায়। পূর্ণা মাথা নিচু করে নিরবে চোখের পানি ঝড়ায়। রাফাত এখনো কাঁদছে। হঠাৎ সাংবাদিকরা তার দিকে যায়। তার দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে বলে,
– মিস্টার চৌধুরী। আপনার শরীরের অবস্থা এখন কেমন? আপনি এইখানে কি করছেন? পূর্ণা আপনার কি হয়? আপনার সাথে কি তার কোনো গভীর সম্পর্ক আছে। আচ্ছা আপনি কি তার সাথেই এইখানে দেখা করতে আসছেন?
রাফাতের রাগ হয়। সাংবাদিকদের এত কথা তার গায়ে লাগে।সে সহ্য করতে পারে না। রেগে গিয়ে এক সাংবাদিকের কলার চেপে ধরে। রাগী কন্ঠে বলে,
– রাফাত চৌধুরীকে ঘাটতে আসবেন না। ফলাফল ভালো হবে না।
কথাটা বলে রাফাত সাংবাদিককে ছুড়ে মাটিতে ফেলে। তারপর গাড়িতে উঠে চলে যায়। গাড়িতে উঠে একজনকে কল করে ওপাশ থেকে কল রিসিভ করেই বলে,
– স্যার স্যার আপনি কোথায় ছিলেন? পাগলের মতো আপনাকে খুজছি স্যার। কোথাও পায়নি? আপনি কোথায় ছিলেন স্যার?
রাফাত বিরক্ত হয়ে বলে,
– ওহ সিয়াম স্টোপ। এই তোমাদের কাজের নমুনা। আমি যে চারদিন মিসিং ছিলাম খুজে বের করতে পারলে না।
সিয়াম মাথাটা নিচু করে বলে,
– স্যার বিশ্বাস করেন আমাদের সব ফোর্স কাজে লাগিয়েছি কিন্তু কোনো তথ্যই পায়নি। জানেন আপনার সব থেকে বড় শত্রুকে এইখানে ধরে আটকে রেখেছি। কিন্তু সে বার বার বলছে সে জানে না আপনি কোথায়?
– সিয়াম ওর কোনো দোষ নেয় ওকে ছেড়ে দেয়। আমার নতুন শত্রু আমায় কিডন্যাপ করে রেখেছিল। নিজের বাড়িতেই আমি ছিলাম।আচ্ছি বাদ দাও এইসব শোনো একটা কাজ দিবো তোমায় করে দেখাতে হবে।
– জ্বি স্যার বলুন আপনার জন্য জান হাজির।
– ওহ ওভার একটিং বন্ধ করো। কাজের কথায় আসো।
– বলুন স্যার।
তখন রাফাত ওদেরকে বুঝিয়ে দেয় কীভাবে কি করবে কাজটা কি। সিয়াম মুখটা হা করে বলে,
– স্যার ওদের সাথে আপনার কিসের শত্রুতা।
– সেটা তোমায় জানতে হবে না। যেটা বলছি সেটা করো।
– ওকে স্যার।
– আচ্ছা রাখছি
#চলবে