#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
মৃদু জলের ছিঁটায় জ্ঞান ফিরলো আদিরার। আদিরার পাশে বসা দু’টো মেয়ে। দু’জনেই উৎকণ্ঠিত হয়ে আদিরার চোখ খোলার আশায় আছে। পিটপিট করে মুদিত আঁখিজোড়া মেলল আদিরা। আদিরাকে চোখ মেলতে দেখে মেয়ে দুটোর থেকে সুমি নামে একজন উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠে,
–যাক আলহামদুলিল্লাহ চোখ মেলেছে। মারসাদকে ডাক দে তো মৌমি।
মৌমি মারসাদকে ডাক দিতে যায়। সুমি আদিরার ওড়না ঠিক করে দেয়। আদিরা কোথায় আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে তারপর উঠে বসে। মৌমির থেকে খবর জানতে পেরে মারসাদ অডিটোরিয়ামের ভিতরে যেতে নিলে আহনাফ মারসাদের হাত ধরে আটকিয়ে বলে,
–ভিতরে গিয়ে শান্ত হয়ে কথা বলবি। মেয়েটা তোর কারণেই অসুস্থ হয়েছে মনে রাখবি। চল।
মারসাদ মৌন সম্মতি দেয়। ভেতরে গিয়ে মারসাদ সহ আহনাফরা আদিরার সামনে দাঁড়ায়। মারসাদ পকেটে হাত গুঁজে নম্র কন্ঠে বলে,
–এখন ঠিক আছো?
আদিরা মাথা নিচু করে আছে। মারসাদের কথার প্রতিউত্তর সে ঘার এলিয়ে দেয়। মারসাদ কন্ঠের স্বাভাবিকতা রক্ষা করে সুধায়,
–আমার সাথে ডান্সে পার্টিসিপেট করলে সমস্যা কী?
আদিরা জড়োসরো হয়ে বসে আছে। নতমস্তকে আড়চোখে একবার মারসাদকে দেখে নিলো অতঃপর মৌন রইল। কিন্তু মারসাদের অতীব উৎসুক ও অধৈর্য মনভাব কি আর মৌন থাকতে দেয়? আদিরা ভীত স্বরে বলল,
–আমি গ্রাম থেকে এসেছি পড়াশোনার জন্য। আমি নাচ জানি না। জীবনে ভেজাল নামক পরগাছাকে আর যুক্ত করতে চাই না।
মারসাদ ধাতস্থ হলো। একটা বেঞ্চ টেনে বসে খুব শান্ত স্বরে বলে,
–ঝামেলাহীন জীবন হয় না আদিরা। প্রতিটা মানুষের জীবনে বহু চড়াই উৎরাই পার করতে হয়। এরপর সফল হলে সেই সফলতাতে অন্যরকম এক জয়ের আভাস পাওয়া যায়। কারও জীবন ভেজালহীন হয় না। তুমি জড়াতে না চাইলেও সেটা নিজ থেকে জড়িয়ে যাবে।
আদিরা চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। আদিরার পাশে সুমি চুপচাপ আদিরার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছে। মারসাদ উঠে দাঁড়িয়ে কপালে পরে থাকা চুল গুলো নাড়তে নাড়তে বলে,
–তোমাকে আমার সাথে দুই মিনিটের জন্য হলেও ডান্স করতেই হবে। তোমার জন্য আমি সবচেয়ে সহজ ডান্স স্টেপ চুজ করবো। আর এতে হার-জিতের কোনো প্রশ্ন নেই। সো বি রেডি। তোমার ক্লাস সকাল দশটায় তাই না? এখন বাজে নয়টার মতো। আধঘণ্টা প্র্যাকটিস করে তারপর ক্লাসের জন্য বের হবে। দশ মিনিট রেস্ট করো। এরপর বিকেলে আবার কিছুক্ষণ প্র্যাকটিস করবে।
সুমি, মৌমিকে ও রাত্রীকে আদিরার কাছে রেখে মারসাদরা বেরিয়ে যায়। আহনাফ বাহিরে গিয়ে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে মারসাদের মুখোমুখি হয়ে বলে,
–যাক তোর রাগে কন্ট্রোল ছিল। নাছোড়বান্দা তুই যে ওই মেয়ের সাথেই ডান্স করবি সেটা তোর জেদ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আজ যেমন সুন্দর করে বলেছিস তেমনি সুন্দর ব্যাবহার করবি। তাহলে কেউ তোকে ভয় পাবে না আর আমিও একটু শান্তিতে প্রেম করতে পারবো!
শেষের লাইনটা আহনাফ বিড়বিড় করে বলে। আহনাফ কাউকে ভালোবাসে অনেকগুলো বছর ধরে। সেই মেয়েটির সকল বেখেয়ালি মনোভাব সে ভালোবাসে। সকল দুষ্টুমি সে ভালোবাসে। এলোকেশী মেয়েটি তার অর্ধ যুগের প্রেম।
মারসাদের আরেক বন্ধু মৃদুল চিন্তিত স্বরে বলে,
–কিন্তু দোস্ত ওই সামিরা? তোদের ডান্স পার্টিসিপেট নষ্ট করতে আদিরাকে কিছু করবে নাতো? মেয়েটা অনেক সরল। সামিরা আবার কী করবে কে জানে!
রিহান হাই তুলতে তুলতে বলে,
–কী আর করবে! একটু পর মারসাদ বেবি! মারসাদ বেবি! করতে করতে এখানে এসে ঝুলে পরবে। শা*লি চিপকু কাহিকা।
মারসাদ সহ সকলে হেসে উঠে কিন্তু একজন বাদে। বেচারা মুখ দিয়ে নখ কাটছে খুব অস্থিরতার সাথে। মৃদুল ওকে ধা’ক্কা দিলে সে হকচকিয়ে উঠে। মৃদুল মুখ লটকিয়ে বলে,
–কি-রে ভাবুক ভদ্র ছেলে রবিন? এতো সুন্দর করে মুখকে নেইলকাটার বানাতে কে বলছে? নখ গুলোকেও কী সুন্দর ক্যাটরিনা কাইফ শেইপ দিচ্ছিস। তা বলি আপনি কী এই গ্রহে আছেন না-কি চলিয়া গিয়াছেন?
রবিন ভয়ে ভয়ে বলে,
–সাগরর! সামিরা যদি সাগরকে দিয়ে কিছু করায়? মারসাদ তো সেচ্ছায় ভিপির জন্য দাঁড়াবে না। সাগর কিন্তু দাঁড়াবে। আর আশিক ভাইয়ের সাথে সাগরের ভালোই সখ্যতা।
রবিনের ভাবনা অহেতুক নয়। ভিপি আশিকের সাথে সাগর ভালোই ভাব জমাচ্ছে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে (ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে গেলে ভিপির পদ অন্যকাউকে দিতে হয় এটাই জানি)। আর সাগর সামিরাকে পছন্দও করে। আহনাফ ডোন্টকেয়ার মুডে বলে,
–মারসাদের বদলে আমি দাঁড়াবো। মারসাদ একেবারে দাঁড়াবে না এটা বলে নি। মারসাদ শুধু ভিপি হতে চায় না। কিন্তু আমি দাঁড়াবো। সাগর যদি ভিপি হয় তবে মেয়েদের জীবন শেষ করে দিবে। সাইন্সের সকল বিভাগ থেকে আমি দাঁড়াবো। বাকিগুলো থেকে কে দাঁড়াবে জানি না। মারসাদকে সাইন্স গ্রুপ থেকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। এরপরই সে জানায় দেয় সে হবে না। তবে ব্যাপারটা সাগর পর্যন্ত কে নিলো বুঝলাম না। সামিরা নয়তো?
মারসাদ সামনের ছোট দেয়ালের উপর উঠে বসে মুক বাঁকিয়ে বলে,
–উহু। সামিরা এই ব্যাপারে জানে না। আর আশিক ও রাসেল ভাইয়ের বলার কথা না। যেই বলুক আর সাগর জানলেও আমাদের সমস্যা নেই। আশিক ও রাসেল ভাই রাজি হয়েছেন তোকে আমার জায়গায় দিতে। সো চিল। কাল তো আর্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে দ্বিতীয় বর্ষের কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসে সাগরের নামে বিচার দিলো। ওরা এখনও জানে না আমি তোকে আমার জায়গা দিবো। তবে ব্যাপার না। আমার বেস্টফ্রেন্ড আমার চেতনার প্রতিচ্ছবি।
পনেরো মিনিট পর মারসাদ অডিটোরিয়ামের ভিতরে যায়। আদিরাকে প্রথমে ডান্স স্টেপ সুমি ও মৌমি দেখায়। খুব সহজ স্টেপ। আদিরাকে এতক্ষণ ওরা বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করিয়েছে। ডান্স স্টেপের জন্য মারসাদ আদিরার হাত ধরলে আদিরা কেঁপে উঠে যা দেখে মারসাদ বাঁকা হাসে। এরপর খুব কম ছুঁয়ে প্র্যাকটিস করে। আদিরা ততোক্ষণ দম আটকে ছিল। প্রতিটা স্টেপে সে চোখ মুখ খিঁচে ছিল। স্টেপ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আদিরা অডিটোরিয়াম থেকে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। মারসাদ বাঁকা হেসে জোড়ালো স্বরে আদিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–বিকেলে যদি তোমাকে এখানে না পাই তবে তোমার মেস থেকে তোমাকে তুলে আনবো মেয়ে। মনে রেখো। ভদ্র মেয়ের মতো চলে আসবা।
আদিরা কথাটা শুনলো। তার হৃৎপিন্ড দ্রুত গতিতে চলছে। অডিটোরিয়ামের বাহিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দশটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি। আদিরা ক্লাসেই যায়। লাইব্রেরীতে আর যাওয়া হলো না। ক্লাসে গিয়ে মাঝামাঝি সিটে বসে। হাতে গোনা দশ-বারো জন বাদে সবাই ক্লাসের বাহিরে। ক্লাসের আগে দিয়ে আসবে। আদিরা জানালা দিয়ে অদূরে কড়ই গাছটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কড়ই গাছে সাদা গোলাপির মিশ্রণে ফুলগুলো তার বরাবর ভালো লাগে। ছোটোবেলার বহু স্মৃতি আছে এগুলো নিয়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই ক্লাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কেউ একজন তার পাশে এসে হড়বড়িয়ে বসে তাকে স্পর্শ করে ডাক দিয়ে বলে,
–হেই তুমি আদিরা? কেমন আছো আদিরা?
আদিরা চমকে তাকালো। ভাবনার ব্যাঘাত ঘটায় চমকে গিয়েছিল। নিজেকে আত্মস্থ করে হাসি মুখে জবাব দেয়,
–আসসালামু আলাইকুম আমি আদিরা। আপনি কে?
মেয়েটা তার স্বভাবসুলভ হাসলো। তারপর আদিরার গাল টেনে বলল,
–তুমি তোমার নামের মতোই কিউট। একদম পিচ্চি পিচ্চি মায়াবি। ফর্সা না হলেও তোমাকে পুতুলের মতো লাগে। উজ্জ্বল বর্ণে চিকচিক করে। তোমাকে আমি আমার ক্যানভাসে আঁকবো। তোমাকে দেখাবো। সোনালি আভা তোমার মুখশ্রীতে।
আদিরা অবাক হয়। এভাবে তার প্রশংসা কেউ করে নি। তার মা বলতো, আদিরাকে নাকি রোদ ও বৃষ্টিতে পরীর মতো লাগে। কিন্তু মায়েদের কাছে তো নিজের সন্তান সবসময় সুন্দর। আদিরা মেয়েটিকে মুচকি হাসি উপহার দেয়। পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলে উঠে,
–মাহি, আমাকে একটা এঁকে দিবে? আমার তোমার ছবি গুলো খুব ভালো লাগে।
মাহি খুশি মনে বলে,
–অবশ্যই কেন নয়। তবে আমি কিন্তু আমার ফ্রেন্ড ও ক্লোজ ছাড়া কারওটা আঁকি না। আর সবাইকে ফ্রেন্ড বানাইও না। তবে তোমাদের আমার খুব খুব ভালো লেগেছে। লেটস ফ্রেন্ডস।
ওরা ফ্রেন্ডশিপ করে নেয়। ক্লাসে টিচার আসলে ওরা ক্লাসে মনোযোগ দেয়।
#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
অডিটোরিয়ামের ভেতর ঢুকবে কি ঢুকবে না, তাই ভাবছে আদিরা। অস্বস্থি ও ভয় হচ্ছে তার। নাচের সময় মারসাদের করা বাধ্যগত স্পর্শগুলোও তার স্নায়ুতন্ত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এখনও ভাবলে তার শুভ্র কায়া কেঁপে উঠে। প্রায় পাঁচ মিনিট হলো আদিরা অডিটোরিয়ামের বাহিরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি করছে। হঠাৎ একজোড়া হাত তার কাঁধ স্পর্শ করে বার দুয়েক ডাক দিলো। আদিরা হকচকিয়ে গিয়ে পেছোনে ফিরে ভূ’ত দেখার মতো চমকে গেলো। পেছোনে মারসাদ হাস্যজ্বল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। মারসাদ নিজেও অডিটোরিয়ামের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে বলল,
–আমাকে দেখা যাচ্ছে না কেনো? কতো চেষ্টা করছো দেখতে যে আমার মতো ব’দ লোকটা ভেতরে আছে কী-না? কিন্তু আফসোস! ব’দ লোকটা একটু চোখ-মুখ ধুতে গিয়েছিল। কী করবে এখন?
আদিরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। লোকটা নিজের মতো করে প্রলাপ বকে যাচ্ছে। ওর মনের কথাগুলোও বলে দিচ্ছে। আদিরা মনে মনে ভাবে,
“সে জানলো কী করে যে আমি কী করছিলাম?”
মারসাদ হাই তুলতে তুলতে বলে,
–তুমি বড্ড জোরে জোরে চিন্তা করো মিস পার্পল কুইন। উপস রেড কুইন! অসাধারণ কিছু চিন্তা করোই না যা আমি ধরতে পারবো না। যাইহোক। চলো। প্রতিটা স্টেপ কয়েকবার করে মেমোরাইজ করবে। তোমার মার্কশিট দেখলাম। কোয়াইট ব্রিলিয়ান্ট তুমি। ডান্স স্টেপ গুলো তো আর অতো কঠিন না তোমার ফেভারিট সাবজেক্ট বায়োলজির ঘাসফড়িং, রুইমাছ ও শ্বশনের চাপ্টারের মতো। আয়ত্তে চলে আসবে। লেটস গো।
আদিরা মারসাদের দেওয়া অদ্ভুত উদাহারণটা ঠিক মেলাতে পারলো না। সে তাও কিছু বলল না। মারসাদ অডিটোরিয়ামের ভেতরে ঢুকে পিছু পিছু আদিরাও ঢুকে। মৌমিরা নাচের স্টেপ আবারও দুয়েকবার দেখিয়ে দিয়ে ওরা প্র্যাকটিস করে।
________
ঝড়ো হাওয়ায় দুলছে প্রকৃতি। সন্ধ্যা নামতেই ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির ছাঁট। আদিরা মেসের জানালার গ্রিল ধরে একটা কপাট খোলা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ তো সেই কখন চলে গেছে। অন্ধকারে সে বৃষ্টি দেখছে। খুব করে মন চাচ্ছে বাহিরে গিয়ে এই বর্ষণে নিজেকে বিলীন করতে। আদিরার গ্রামের কথা মনে পরছে। জৈষ্ঠ মাসের শুরু। এখন ঝড়বৃষ্টিতে ঘরের চালে টুপটুপ করে কাঁচা-পাকা আমি পরতো বৃষ্টির সাথে সাথে। টিনের চালে বৃষ্টির অনবরত টুপটুপ করে পরা এক ছন্দ তৈরি করে সাথে হঠাৎ হঠাৎ আম পরলে সেই ছন্দে ভিন্নতা আনতো। আদিরা ও তার ভাই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে বাড়ির পেছোনের আম গাছ দুটোর কাছে চলে যেতো। উঠোনে পানি জমে ছলাৎছলাৎ দৃশ্য। দুই ভাই-বোনের দুষ্টুমি আর মায়ের বারণ করা চিৎকার চেঁচামেচি খুব খুব মিস করছে সে।
আদিরার এক রুমমেটের চিৎকার তার কানে আসলো,
–এই মেয়ে জানালা বন্ধ করো। কতক্ষণ ধরে বলছি সে তো শুনছেই না। বৃষ্টির পানিতে পুরো রুম ভিজে যাচ্ছে আর সে জানালা দিয়ে বৃষ্টিবিলাশ করছে। এই মেয়ে দেখতে পারছো না? এটা পশ্চিমা বৃষ্টি আর জানালাটাও পশ্চিম দিকে। বন্ধ করো এখুনি।
আদিরা মলিন হেসে জানালার কপাট লাগিয়ে দিলো। নিজের জন্য বরাদ্ধ করা খাটে বসে। প্রকৃতির রুদ্ররূপ এখন বন্ধ জানালা দিয়ে অবলোকন করছে আদিরা। আদিরা মনে মনে আওড়ায়,
“এই শহর যান্ত্রিক। প্রকৃতির হাসি কান্না কিছুই তাদের হৃদয় ছোঁয় না। প্রেম তো হারিয়েই গেছে। ব্যাস্ত যার যার জীবন নিয়ে। এই শহর কী আমায় আপনা করবে?”
_________
ভার্সিটিতে স্টেজ সাঁজানো হচ্ছে। গতকালের বৃষ্টিতে মাটি কিছুটা কর্দমাক্ত। এখন হালকা বালি দিয়ে দিয়ে কাঁদামাটি শুকানোর চেষ্টা চলছে। আদিরা গেট দিয়ে ঢোকার পর কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে শয়ে শয়ে ভেজা কৃষ্ণচূড়া বৃষ্টিতে সিক্ত রাস্তায় বিছিয়ে থাকতে দেখেছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল তুলে নিয়েছিল এখন গেছে বড়ো কড়ই গাছটার কাছে। কড়ই গাছটার নিচে চাদরের মতো ভেজা ফুল ছড়িয়ে আছে। আস্ত ফুল পাওয়াই মুশকিল। কড়ই গাছটার কাছে মাটিও কর্দমাক্ত। পা টিপে টিপে গিয়ে দুই-তিনটা ফুল তুলে নিলো আদিরা। এখন ব্যাগ থেকে সুতা বের করে বেঁধে নিলো। আদিরা বাম পাশে তাকাতেই দেখলো একটা মেয়ে কাঠের তৈরি ছবি আঁকতে সাহায্য করে এমন কিছুতে কাগজ সেঁটে কিছু আঁকছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আদিরার কৌতুহল হলো। সে একটু এগিয়ে গিয়ে মাহিকে দেখতে পেলো। আদিরা মাহির পেছোনে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে মাহি কী আঁকছে।
আচমকা মাহি ক্যানভাসে রঙ তুলির সামাঞ্জস্য করতে করতে বলে উঠলো,
–কী দেখছিস আদু?
অবাক হয় আদিরা। তারপর বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–তুমি বুঝলে কি করে?
মাহি মুচকি হাসে। ধ্যান তার চিত্র আঁকাতে। হেয়ালি করে বলে,
–কড়ই ফুলের সমারোহে এক পার্পল ফেইরি! সুন্দর না?
আদিরা ক্যানভাসে চিত্রটা দেখে অবাক হয়ে যায়। তারপর বলে,
–তুমি এতো সুন্দর করে কী করে আঁকলে? চিত্রটা অসম্ভব সুন্দর।
মাহি আঁকতে আঁকতে বলে,
–তুমি আমার ক্যানভাসে এসে এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছো। আমি তো সিক্ত কড়ই গাছটার নিচে ফুলের সমারোহ চিত্রে ফুটিয়ে তুলছিলাম মাত্র। তখনি এক বেগুনী পরীর আবির্ভাব। এই যান্ত্রিক শহরে গোলাপ, বেলির মতো কিছুটা কৃষ্ণচূড়াকেও প্রাধান্য দেওয়া হয় কিন্তু কড়ই ফুলের সৌন্দর্য সবাই বুঝতে পারে না। কড়ই ফুলও যে মুগ্ধতা ছড়াতে পারে তা সবাই বুঝে না। অবশ্য গোলাপ ছাড়া অন্য ফুলের প্রাধান্যও কম দেখা যায়।
আদিরা চিত্রর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহি আদিরার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে বলে,
–আমি তো চিত্রটা দেখে দেখে আঁকলাম। তবে দাভাই এটা না দেখেও শুধু ফিল করে আঁকতে পারবে। চেহারা আঁকতে ছবি দেখতে হয় কিন্তু প্রকৃতি আঁকতেও আমার সেটাকে সামনে রেখে আঁকতে হয় নয়তো খুঁতখুঁত লাগে। দাভাই এটা আঁকলে কল্পনা করে বা মাত্র এক-দুইবার দেখে এঁকে ফেলতে পারতো।
আদিরা উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
–তুমিও দারুন আঁকো। চিত্রটা দেখে আমি অনেক অবাক হয়ে গিয়েছি। এতো সুন্দর হচ্ছে বলার মতো না। তোমরা কী ছবি আঁকা শিখেছো?
মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–নাহ! আমি দাভাইকে দেখে শিখেছি। আমার বাবাও খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। কিন্তু তার রঙ হারিয়ে গেছে। তার ক্যানভাস শূণ্য থাকে এখন। দাভাই ছোট বেলায় অনেক আঁকতো। আর বড় হয়েও তার আঁকা অনেক চিত্র দেখেছি। দাভাই এখন ছবি আঁকে খুব কম। সে নিরালায় ছবি আঁকে। যাইহোক। আমার আর একটু বাকি আছে। ফুলগুলোতে আরেকটু রঙ দিবো।
আদিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাকিটুকু আঁকা দেখে। ছবি আঁকা হলে মাহি ও আদিরা ডিপার্টমেন্টের একটা রুমে ছবিটা শুকাতে রেখে আসে। তারপর ওরা স্টেজ যেখানে সাঁজাচ্ছে সেখানে যায়। ওরা ঘুরে ঘুরে দেখছিল তখনি সেখানে মৌমি এসে হড়বড়িয়ে বলে,
–তোমাকে আমি কতো খুঁজলাম জুলোজি ডিপার্টমেন্টে আদিরা! কই ছিলে? জলদি চলো। তোমাকে লাস্ট টাইম প্র্যাকটিস করতে হবে তো। কোনো ব্লান্ডার করা যাবে না।
মাহি মৌমিকে হুট করে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আপিইইই! ইশ তোমাকে ব্লু শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে গো। আমিই তো ক্রাশ খেয়ে গেলাম তাহলে জিজু কী পরিমান ফিদা হবে ভাবতো?
মৌমি মাহিকে জড়িয়ে বলে,
–থাংকু মাহি বাচ্চাটা। তোমাকে তো পুতুলের মতো লাগছে। শাড়ি পড়লে না কেনো?
মাহি মুখ লটকিয়ে বলে,
–শাড়ি! কে পড়িয়ে দিবে বলোতো? আমার মা! বাদ দেও। আদু কী ডান্স করবে নাকি?
মৌমি হাস্যজ্বল প্রতিউত্তর করে,
–হ্যাঁ। তোমার ভাইয়ের সাথে।
মাহি উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
–ওয়াও গ্রেট।
আদিরা তো হতভম্ব।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,