#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
মারসাদ শিস বাজাতে বাজাতে পকেটে হাত গুঁজে চলেও গেছে কিন্তু রেখে গেছে হতভম্ব আদিরাকে। আদিরা চোখ বড়ো বড়ো করে সম্মুখপানে চেয়ে আছে। কয়েকমিনিটের মধ্যে ক্লাসে স্টুডেন্ট আসতে শুরু করেছে। মাহি ও রিন্তি এসে আদিরাকে অন্যমনষ্ক দেখে ওর দুই পাশে দুইজন বসে। রিন্তি আদিরাকে বলে,
–দোস্ত পড়া কতোটুকু শেষ করলি? কম্পিলিট তোর? প্রিপারেশন কেমন?
আদিরার থেকে কোনো জবাব পেলো না বিপরীতে। রিন্তি মাহির দিকে তাকিয়ে আদিরাকে দেখিয়ে ইশারা করে। মাহিও কিছু জানে না এই ব্যাপারে। এবার আদিরার হাতে ঠেলা দিলে আদিরার হুঁশ ফিরে। রিন্তি জিজ্ঞেস করে,
–কী-রে? কোথায় হারিয়েছিস? তোর সাথে কথা বলছি আর তোর কোনো ভাবান্তর নেই!
আদিরা অপ্রস্তুত হয়। অপ্রতিভ কন্ঠে বলল,
–কিছু না। এমনিতেই। তুই পড়তে থাক। আমার একটু মাহির থেকে কিছু জানার ছিল।
আদিরা আর কোনো বাক্যব্যয় না করে মাহির হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এলো। মাহি আদিরার চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। আদিরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বলল,
–দেখ মাহি, কিছু মনে করো না। তোমার দাভাই কেমন উদ্ভট ভাবে কথা বলে। আমাকে কী বলে আমি বুঝে উঠতে পারি না। আর অপ্রাসঙ্গিক অনেক কিছু বলে যা কখনোই সম্ভব না।
মাহি অবাক হয়। মাহি জানে তার দাভাই কারো সাথে অহেতুক অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলে না। তার দাভাই কেমন তা তার জানা। মাহি সন্দিহান কন্ঠে বলে,
–কী বলে দাভাই?
আদিরা আবারও অপ্রস্তুত হয়। মারসাদ যাওয়ার পর মারসাদের বলা কথা গুলো পুনরায় পর্যালোচনা করে তার এটাই বোধগম্য হয়েছে যে, মারসাদ কোনো ভাবে তাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। তাছাড়া বিগত একমাসের বেশি সময় ধরে করা প্রতিটা কাজ ও ঘটনাও আদিরাকে ভাবতে বাধ্য করছে।
এইতো চার দিন আগে মারসাদ সপ্তাহে অন্য দুই দিনের মতো সেদিনও রাতের বেলা আদিরাকে টিউশনের জন্য নিয়ে যেতে এসেছিএ। আদিরার নাম্বারে কল করে আসতে বলার পর আদিরা জানিয়েছিল যে সে দুই দিন রাতে আর দুই দিন দিনের বেলা পড়ায়। মারসাদ এটা শুনে প্রচণ্ড রেগে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। কেনো তাকে না জানিয়ে এটা করা হলো? দিনের বেলা টিউশনির সময় নেওয়ার কী দরকার ছিলো? এসবই উচ্চস্বরে বলেছিল যা শুনতে রুড লাগছিল। আদিরাকে নিজের দিকটা ব্যাখ্যা করার সুযোগটাই দেয় নি সেদিন। রে*গে-মেগে মারসাদ চলে গিয়েছিল।
মাহি আদিরাকে আবারও অন্যমনষ্ক দেখে আদিরার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
–তোর কী হয়েছে বলতো? অনেকক্ষণ যাবত বেখায়ালি লক্ষ্য করছি। আর দাভাই কী করেছে সেটাও বল।
আদিরা মলিন হেসে বলে,
–পরীক্ষার পর বলি। স্যার চলে আসতেছে।
মাহিও রাজী হয়। ওরা ক্লাসে গিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। পরীক্ষার পর আদিরা ও মাহি, সাবিহা ও রিন্তিকে বলে একটু আলাদা কথা বলতে যায়। গোলাপি সাদা ফুল বোঝাই কড়ই গাছটার নিচে মাহি ও আদিরা দাঁড়িয়ে আছে। আদিরা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,
–আমি গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে। কতোটা যু*দ্ধ করে গ্রাম থেকে এই অচেনা শহরে এসেছি আমিই জানি। মা ঋণ করে আমার ভর্তির টাকাটা দিয়েছে। শহরে থাকার মতে জরুরী জিনিসপত্র ক্রয় করার পর হাতে টাকা ছিলো না। বাবা তো চায়ই নি আমি আর পড়ালেখা করি। গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছেও বাবার ঋণ আছে। বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছিল কিন্তু মা ও শিক্ষকদের সহায়তায় আজ আমি এখানে। মায়ের স্বপ্ন আমি পূরণ করবোই। কিন্তু এখানে এসে একের পর এক ঝামেলাতে জড়িয়ে যাচ্ছি। কারও কারও চোখের বি*ষে পরিণত হয়েছি। সেই সংখ্যাটা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে যদি তোমার ভাই নিজেকে না থামায়।
মাহি বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে বলল,
–দাভাই কী করেছে?
আদিরা হতাশ স্বরে বলে,
–তোমার দাভাই নাকি আমাতে নিজের মন হারিয়েছে! এটা কতোটা যুক্তিবহ তুমিই বলো? সে তার প্রেমিকাকে ধোঁকা দিচ্ছে! আর তার প্রেমিকা ভাবছে আমি তোমার দাভাইকে বশ করে নিয়েছি। কিন্তু আমি এসবের কিছুই করি নি। আর আমি এসবের ইচ্ছে নিয়েও আসি নি।
মাহি জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,
–দাভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড কে? আমার দাভাই তো কোনো রিলেশনে জড়ায়ই নি!
আদিরা থমকালো তারপর বলল,
–সামিরা আপু! সে তো তোমার দাভাইয়ের প্রেমিকা। তুমি জানো না?
মাহি বিদ্রূপাত্মক এক্সপ্রেশন দিয়ে বলে,
–কই জানতাম না তো! তা তুই জানলি কী করে? দাভাই বলেছে বুঝি!
আদিরা কনফিউজড হয়ে বলল,
–সবাই তো তাই জানে। সামিরা আপু ও তোমার দাভাইয়ের প্রেমের সম্পর্ক আছে।
মাহি হুট করে হাসতে শুরু করে। পেটে হাত দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ সে। কড়ুই গাছটার গোড়ার কাছে বসে হাসি থামানোর চেষ্টায় আছে সে। আদিরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। হাসির কারণটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। ভাই-বোন দুইটাকেই কেমন অদ্ভুত লাগে আদিরার কাছে। আদিরা মাহির কাছে গিয়ে কনফিউজড হয়ে বলে,
–হাসছো কেনো?
মাহি হাসতে হাসতেই থেমে থেমে বলে,
–তো হাসবো না! একটা কথা আছে জানো? চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে তা পরীক্ষা না করেই চিলের পেছোনে দৌঁড়ানোটা একটা অভ্যাস হয়ে গেছে মানুষের। মানুষ বিচার বিবেচনা না করেই উঁড়ু কথায় এতোটা গুরুত্ব দেয় যে নিজেদের টাইম ও এনার্জি অযথাই নষ্ট করে। আরে ভাই, নিজের কানে হাত দিয়ে তো দেখবে! তোমার কান আছে নাকি গেছে! কার না কার কান গেছে আর সেটার বার্তা বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পরেছে আর তুমিও সেটাই সত্য মানতে শুরু করে দিয়েছো!
আদিরার মুখ লটকে তাকিয়ে আছে। মাহি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–আরে সামিরা আপু দাভাইয়ের উপর ক্রাশড। দাভাই ওকে পছন্দ করে না। সামিরা আপু এতো বাড়াবাড়ি করে কারণ সামিরা আপু আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়। দাভাইয়ের স্কুল লাইফ থেকেই সামিরা আপু যেনো দাভাইয়ের পেছোনে আঠার মতো লেগে আছে কিন্তু দাভাই সামিরা আপুকে ততোটা পাত্তা দিতো না। সামিরা আপুর বিহেভিয়ারে সম্মান শব্দটা নেই দাভাইয়ের ভাষায়। এখন একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে সামিরা আপু নিজেকে দাভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিচ্ছে। দাভাই কিন্তু এক বছর আগে সামিরা আপুর প্রচণ্ড রকম বাড়াবাড়িতে ভরা অডিটোরিয়ামের মধ্যে সামিরা আপুকে চ ড় দিয়েছিল।
চ ড়ের কথা শুনে আদিরার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। মাহি হাসতে হাসতে বলল,
–আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম না তবে আহনাফ বলেছিল, সামিরা আপু নাকি ভার্সিটির সবার কাছে রটাচ্ছিল সে ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আর তারা কয়েকবার ডেটিং করেছে। ভাইয়া প্রচুর রেগে গেছিলো এতো বড়ো মিথ্যা শুনে। টিচাররা পর্যন্ত ভাইয়াকে ডেকে বলেছিল যে পার্সোনাল কথা মানে ডেটিং এসব সবার সামনে ঢোল পি*টিয়ে না বলতে। ভাইয়া টিচারদের কাছে প্রিয় তাই তারা ডেকে বলেছিল। তারপরেই দাভাইয়ের একশন। সেসব পুরোনো কথা। সামিরা আপু সেসব নিয়ে কনসার্ন না তাই সে একই কাজ বারবার করে। সামিরা আপু আব্বুর কাছে দাভাইয়ের নামে নালিশও জানিয়েছিল কিন্তু আব্বু তা পাত্তা দেয় নি। ভাইয়া তো আব্বুর নাগালের বাহিরে!
আদিরা শেষের কথাটা ধরে বলে,
–নাগালের বাহিরে কেনো? তাদের মাঝে কী ঝামেলা হয়েছে?
মাহি হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে,
–আপিলির মৃ*ত্যুর পরোক্ষ কারণ বাবাকে ভাবে দাভাই। কিন্তু বাবা খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে দিয়েছিল তবে আমার মায়ের তাড়াহুড়োতে খুব কম সময়ের মধ্যে বিয়ে দিয়েছিল। কথায় আছে না? হারানো কিছু খুঁজে পাওয়া গেলেও যা স্বেচ্ছায় হারায় তা পাওয়া যায় না! যদি আপিলির শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিজেরা কিছু না লুকাতো তবে বাবা সেখানে আপিলিকে কখনওই বিয়ে দিতো না। এতে বাবার দোষ না তবে বাবার খামখেয়ালিপনা পরোক্ষভাবে দৃশ্যমান হয় ভাইয়ার নজরে।
আদিরা মলিন হেসে বলল,
–তার ভাগ্যে এমনটাই লিখা ছিল। নাহলে তো এরকম হতোই না।
মাহি তাচ্ছিল্য হেসে ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–আমার মা যদি আপিলির বিয়ে নিয়ে এতো তোড়জোড় না করতো তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। আপিলির মাস্টার্সের শখ ছিল অনেক। মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল তো। বাবা তো আপিলির জন্য কানাডাতে মাস্টার্সের এপ্লাইও করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত তাড়াহুড়োতে সেসব আর হয় নি।
আদিরা মাহির হাত ধরে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
–মা তো। মায়েদের চিন্তা থাকে মেয়ের বিয়ে নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাই হয়তো তিনি বিয়ের কথা বলেছেন।
মাহি আদিরার সরল কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসতে থাকে। আদিরা মাহির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মাহি তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
–হ্যাঁ। খুব চিন্তা হতো তার। আপিলির মাস্টার্সের খরচ, তারপর বিয়ের সময় খরচ এসবের কারণে তো আমার জন্য ভাণ্ডার কম পরে যেতো আর তার লাক্সারিয়াস লাইফের জন্য কম পরে যেতো। আসলে আমাকে তিনি যতোটা ভালোবাসেন, আপিলি বা দাভাইকে তার বিন্দু পরিমানও ভালোবাসেন না। কী করবে বলো? নিজের সন্তান না তো তারা!
আদিরা এতোবড়ো সত্যটা জেনে হতভম্ব হয়ে যায়।
#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
আদিরার মুখশ্রীর অভিব্যক্তি দেখে মাহি আলতো হাসে অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলে,
–আমাদের মা এক না হলেও আপিলির, দাভাই ও আমার মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার কোনো পার্থক্য হয় নি। আচ্ছা, তোকে দাভাই পছন্দ করে এমন কিছু ডাইরেক্টলি বলেছে? যদি বলে থাকে তবে আমি অনেক অনেক খুশি। ফাইনালি দাভাই কাউকে নিজের মনে জায়গা দিয়েছে।
আদিরা মাহির উচ্ছাসিত মনোভাব দেখে হতাশ হলো। মাহিদের কাছে ব্যাপারটা যতোটা সহজ ও সাবলিল, আদিরার কাছে তা ততোটাই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। আদিরা মারসাদের বলা কথা মতো মিনারের কাছে গেলো। আদিরা ভেবেছিল যাবে না কিন্তু মারসাদের ভীতিপ্রদর্শন মূলক কথার বিপরীতে কিছু করতে সাহস পেলো না। সেখানে যাওয়ার পর বুঝা যাবে। আদিরা মিনারের কাছে গেলে দেখতে পায় মারসাদ ও তার বন্ধুরা হাসি-তামাশা করে আড্ডা দিচ্ছে। আদিরা কী করবে বুঝতে পারছে না। মারসাদদের সাথে সুমি, মৌমি ও রাত্রীকে দেখে মনে সাহস পেলো। নাহলে চার-পাঁচটা সিনিয়র ছেলের সাথে একা একটা জুনিয়র মেয়ে গিয়ে কথা বলাটা আদিরার নিজের কাছেই দৃষ্টিকটু লাগছিল। আদিরা ওদের কাছে গেলে। মৌমি উৎফুল্লিত কন্ঠে বলল,
–আরে আদিরা যে। কেমন আছো?
আদিরা বিনিময়ে মুচকি হেসে সেও কুশল বিনিময় করে। মারসাদ ঠোঁট চোখা করে কুটিল মুখাবয়বে আদিরার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। আহনাফ ও মৃদুলরা পাশ থেকে মারসাদের কাঁধে হাত রেখে মারসাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে। রিহান ফিসফিসিয়ে বলল,
–মামা, এই মেয়েরে আবার ডাকছিস নাকি? সে এখানে কেন আসছে?
আহনাফ বলল,
–হ্যাঁ। মারসাদ ওকে আসতে বলছে। চুপ থাক। দেখি মারসাদ কী বলে।
মারসাদ ওদের কথাবার্তা পাত্তা না দিয়ে ওদের থেকে সরে গিয়ে আদিরার সামনে যায়। তারপর পকেটে দুই হাত গুঁজে ঠোঁট কা*মড়ে আদিরাকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটার ভীত ও মায়াময় মুখশ্রী অনন্তকাল দেখতে ইচ্ছে করে। মারসাদ মৌমিদের ইশারায় আদিরার কাছ থেকে যেতে বলে। মারসাদ ঘার কাত করে আদিরাকে বলে,
–আই ওয়ান্না গিভ ইউ এ মিউচুয়াল প্রোপোজাল! এন্ড ইউ হ্যাভ টু এক্সেপ্ট ইট।
আদিরা ভড়কে যায়। আবার কিসের প্রোপোজাল দিবে? তাছাড়া প্রেমের প্রোপোজাল আদিরা এক্সেপ্ট করতে অপরাগ। মারসাদ আদিরাকে ভড়কে যেতে দেখে জোরালো হাসলো। তারপর রম্যস্বরে বলল,
–তোমাকে প্রেম করতে বলবো না। সো চিল। জাস্ট নাথিং বাট ফ্রেন্ডশিপ করতে হবে। তাও আমাদের সাথে। নিজেকে মডিফাই করতে হবে। মাহির সাথে ফ্রেন্ডশিপের পর তোমার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে লক্ষ্য করেছি। যেমন তোমার ভীত মুখশ্রীর আড়ালে প্রাণোচ্ছল হাসি। তুমি মেস ছেড়ে দিবে কয়েকমাস পর। মৌমিরা তোমাকে চারজনের রুম ম্যানেজ করে দিবে তুমি, মাহিসহ তোমাদের বাকি দুই ফ্রেন্ডকে। এতো জলদি চারজনের রুম পাওয়া যায় না তবে পেয়ে গেলে তোমরা থাকবে। তোমাকে গণরুমে উঠতে কখনওই বলবো না। এখন বলো? শর্ত মনজুর?
আদিরা ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা স্বরে বলে,
–কেমন শর্ত?
মারসাদ আদিরার দিকে ঝুঁকে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,
–মন হারানোর শর্ত! এমন ভাবে হারাবে যে সামনের মানুষটার ভিতর তোমার জন্য এক শহর প্রেম দেখতে পাবে।
লজ্জায় আরক্তিম হলো মুখশ্রী। মারসাদের আর কোনো কথার তোয়াক্কা না করে দৌঁড়ে চলে গেলো আদিরা। মারসাদ ঠোঁট কা*মড়ে মাথা চুলকে হাসলো। কিছুটা দূরে মারসাদদের আড়াল হয়ে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে আদিরা বুকে হাত দিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে হাঁপাতে লাগলো। আদিরা নিজে নিজেই বলতে থাকে,
–আপনাতে মন হারানো বারণ। এখন যাও নিঃশ্বাস নিতে পারি কিন্তু তখন আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ম*রেই যাবো!
তখনই পাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ধ্বনিত হয়।
–কেনো? আমার দাভাই কী কার্বন ডাই অক্সাইড? যে ইনহেল করলে অক্সিজেন স্বল্পতায় প্রাণ হারাবি?
আদিরা চমকে পাশে তাকিয়ে দেখে মাহি দাঁত কে*লিয়ে হাসছে। মাহির সাথে সাবিহা ও রিন্তি। সাবিহা আদিরার পেছোনে গিয়ে কাঁধ জড়িয়ে বলে,
–ইশ! কেউ যদি আমাতেও মন হারাতো! তাহলে আমি এক লাফে তার প্রেমের সাগরে ডুব দিতাম। কিন্তু আফসোস! এই পো*ড়া কপালির ভাগ্য ফাঁকা শব্দে ঠনঠন করে।
রিন্তি সাবিহাকে পিঞ্চ করে বলে,
–তো আহিন কে? শুধু তোর মামাতো ভাই? যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক!
সাবিহা মুখ ঘুরিয়ে বলে,
–হুহ! একটা খারুস। আমি ওই আহিন বেটাকে বিয়ে টিয়ে করবো না। ছোটো থেকে জীবনটা তেজপাতা করে রেখেছে। বেটা নাকি এখানে জব ট্রান্সফার করবে। ভাবা যায় এসব অ*ত্যা*চার!
ওরা হেসে ফেলে। রিন্তি আদিরার হাতে খোঁচা দিয়ে বলল,
–কুছ তো হ্যায়! তেরি দিল পে ভি! হা?
আদিরা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
–মোটেও না। আমি এখানে পড়তে এসেছি। এসবে জড়াতে না। আর আমার মতো পরিবারের মেয়ের জন্য এসব বি*ষ সমতূল্য।
আদিরার মন খারাপ হচ্ছে দেখে মাহি চতুরতার সাথে বিষয়টা সামলে নিয়ে বলে,
–যখন হবে তখন দেখা যাবে। সময়ের সাথে কতোকিছুই তো বদলায়। এখন আমরা আজ আদুর হোস্টেলে যাবো। আজ আর ক্লাস নেই। আজ আদু আমাদের রান্না করে খাওয়াবে। আনন্দ হবে অনেক আজ।
সাবিহা ও রিন্তি আনন্দ প্রকাশ করে। আদিরার মুখ ভাড় হলো। লজ্জায় মুখ ছোট করে বলে,
–মেসে বেশি কিছু বাজার নেই। তোরা খেতে পারবি? মাছ-মাংস তো আনা হয় না।
রিন্তু আদিরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আদিরার গালে হাত দিয়ে বলে,
–আমি ও সাবিহা গণরুমে থাকি। সেখানে ক্যান্টিনের খাবার অতোটাও ভালো না। আর মাছ-মাংসের থেকে আমরা আজ অন্য কিছু খাবো। প্রতিদিন তেল মশলা কম দেওয়া মুরগির মাংস খেয়ে খেয়ে অতীষ্ঠ হয়ে গেছি।
মাহি বলল,
–আর আমি মাছ খাই না। চিংড়ি, ইলিশ ও কিছু সামুদ্রিক মাছ ছাড়া বাকি মাছ আমি খাই না। আর মাংস তো প্রায়ই খাওয়া হয়। তাই তোকে সেন্টি খেতে হবে না। চল এখন।
আদিরা স্বস্থি পায় কিছুটা। মাহিদেরকে নিয়ে মেসে গেলে আদিরা চারজনের জন্য ও তার রাতের জন্য ভাত বসিয়ে দিয়ে। পটল কাঠিতে ঢুকিয়ে হালকা তেল মাখিয়ে ভাতের পাতিলের নিচে চুলার উপর রেখে দেয়। মেসে আসার সময় আরও কিছু সবজি ও ডিম কিনে এনেছিল। পেয়াজ, রসুন, মরিচ, কহি/চিচিঙ্গা ও ঢেঁড়স কেটে নেয়। মাহি এসব কাজে একদমই অপটু। মাহি বসে বসে আদিরার কাজ দেখছে। সাবিহা ও রিন্তি সবজি কাটতে আদিরাকে টুকটাক হেল্প করছে। ভাত হয়ে এলে কড়াইতে গ্রাম থেকে আনা চিংড়ি শুঁটকি টেলে নেয় তারপর শুকনো মরিচ কয়েকটা ভেজে নেয়। শুকনো মরিচের সাথে ভর্তার জন্য কিছু পেঁয়াজ, রসুন ও ধনিয়াপাতা গরম তেলে দিয়ে সাথে সাথে তুলে নেয়। এরপর ঢেঁড়শ ভাজি বসিয়ে দিয়ে লোহার হামালদিস্তাতে পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়াপাতা ভালো করে ছেঁচে তাতে লবন, মরিচ ও সরিষার তেল দিয়ে রসুনের ভর্তা বানায়। এরপর চিংড়ি শুঁটকি গুলো ভালো করে পিষে নেয় পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচ দিয়ে। পটল পোড়াগুলোকেও ভর্তা করে নেয়। ঢেঁড়স ভাজি হয়ে এলে ডিম দিয়ে কহি/চিচিঙ্গা ভাজি করে নেয়।
দেড় ঘন্টার মধ্যে সকল রান্না শেষ। মাহি অবাক হয়ে পুরোটা দেখেই গেলো। ভর্তার ঘ্রাণে ওর জিভে জল চলে এসেছে (আমার তো লিখতে গিয়েই)। তারপর ভর্তা গুলোকে একটা বাটিতে নিয়ে নেয় আর ভাজি গুলোকে আরেকটা বাটিতে। এখন খাবার প্লেটের সংকটে আদিরা মেসের ক্যান্টিনে গিয়ে তিনটা প্লেট ধার করে নিয়ে আসে। মাহি সামনে সাঁজানো খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে দেয়। আদিরার রান্না সেটাও উল্লেখ করে। মাহি, রিন্তি ও সাবিহা খাচ্ছে আর আদিরা অধীর আগ্রহে বসে আছে ওদের রেজাল্ট বলার আশায়। তার ছোটোবেলা থেকে অভ্যাস এটা। কিছু রান্না করে সবার কেমন লেগেছে তা জানতে চায়।
মাহি প্রতিটা আইটেম টেস্ট করে বলল,
–দাদী মাঝে মাঝে ভর্তা বানাতে বলে। যেমনঃ চিংড়ি, শিম ও বেগুনের। বাবারও ভর্তা অনেক পছন্দের। আমারও ভালোই লাগে। তোর বানানো ভর্তাও অনেক মজা হয়েছে। তুই খাচ্ছিস না কেনো? খা। সবগুলা রান্নাই অসাধারণ।
মাহির সাথে রিন্তি ও সাবিহাও তাল মিলায়। আদিরা খুশি মনে খাওয়া শুরু করে।
……….
এদিকে মারসাদ মাহির পোস্ট দেখে ভ্রুঁ উঁচালো। তারও খাবার গুলো টেস্ট করতে মন চাচ্ছে। কিন্তু কিভাবে সেটা ভাবতে ভাবতে মারসাদের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,