একটু ভালোবাসা পর্ব ৬+৭

#একটু_ভালোবাসা
#পর্ব_৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________

প্রিয়ু নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যা শুনল তা কি সত্যিই শুনল? নাকি ভুল শুনল? নিজের কানকেই এই মুহূর্তে প্রিয়ুর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা রিশাদ বিয়ে করলেই বা কী? এত কষ্ট কেন লাগছে? এটা কষ্ট নাকি খারাপ লাগা? প্রিয়ুকে চুপ থাকতে দেখে রিশাদ প্রিয়ুর চোখের সামনে তুড়ি বাজায়। প্রিয়ু আঁৎকে ওঠে। রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো? হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেলেন যে?”
আমতা আমতা করে প্রিয়ু বলে,
“আপনি সত্যিই বিয়ে করেছেন?”
“আপনার কী মনে হয়?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে রিশাদ।
প্রিয়ু ঘামছে। অনবরত ঘামছে। পায়ের নিচের মাটিকেও নড়বড়ে মনে হচ্ছে। রিশাদ বলে,
“শীতের মধ্যেও দেখি ঘামছেন। আসুন ভেতরে আসুন।”

রিশাদ সরে গিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দেয়। প্রিয়ু গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে। ওড়না দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নেয়। বসার পর বুঝতে পারে শুধু পা-ই নয় বরং পুরো শরীর কাঁপছে প্রিয়ুর। প্রিয়ুর মুখোমুখি বসে আছে রিশাদ। পানির গ্লাস প্রিয়ুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“কী সমস্যা?”
“ক..ই? কোনো সমস্যা নেই তো।”
“তাহলে এভাবে কাঁপছেন কেন?”
“বোধ হয় শীতে!”
“আজ শীত একেবারে কম। তাছাড়া আপনি ঘামছেন। এতেই স্পষ্ট আপনি শীতে কাঁপছেন না।”

হাতের গ্লাস টেবিলের ওপর রেখে কথা এড়িয়ে প্রিয়ু বলে,
“আপনি কিন্তু বললেন না।”
“কী?”
“এইযে সত্যিই বিয়ে করেছেন কী না?”
“আপনার কী মনে হয় বললেন না তো।”
“আমার মনে হওয়া দিয়ে কী আসে যায়?”
“শুনতে চাই।”
“হেয়ালি না করে বলেন প্লিজ!”
“না।”
“কী না?”
“বিয়ে করিনি।”
মুহূর্তেই চেহারার বর্ণ পাল্টে যায় প্রিয়ুর। চোখেমুখে খুশির ছড়াছড়ি। রিশাদ বুঝতে পারে প্রিয়ুর খুশি হওয়ার পেছনে থাকা কারণটা। কিন্তু প্রিয়ু কি কাজটা ঠিক করছে?
“তখন মিথ্যে কেন বললেন?” জিজ্ঞেস করে প্রিয়ু।
“মজা করলাম। আপনার রিয়াকশন টা দেখার জন্য।”
“আমার প্রাণটাই বুঝি বের হয়ে গেছিল।”
“কেন?”

প্রিয়ু থতমত খেয়ে যায়। কী বলতে কী বলে ফেলল এটা? এখন কী বলবে?
“খাব! খিদে পেয়েছে আমার।”
প্রসঙ্গ পাল্টাতে খাওয়ার কথা ছাড়া আর কোনো কথা মাথায় আসলো না। এখন এই ব্যাপারেই বা রিশাদ কী ভাববে কে জানে!
“আমি তো একটু আগেই এসেছি। রান্না করতে হবে। বাহির থেকে খাবার অর্ডার করি?”
“উম! না। আপনার হাতের রান্নাই খাব। আপনি রান্না করেন। আমি আছি।”
“ভার্সিটিতে যাবেন না?”
“না। ভার্সিটিতে গেলে আগেই যেতাম।”
“আচ্ছা। আপনি তাহলে বসেন। আমি রান্না করি।”
“শুনুন।”
“শুনছি।”
“আমি তো আপনার থেকে ছোট। তাহলে এমন আপনি আপনি করে বলেন কেন?”
“কী বলব?”
“তুমি করে বলবেন।”
“আপনি ডাকটাই সুন্দর।”
প্রিয়ু মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“না। তুমি বলতে বলেছি আপনি আমায় তুমি করেই বলবেন।”
“আচ্ছা চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা নয়। পারতে হবে। দেখি এখনই একবার বলুন তো।”
“কী বলব?”
“তুমি করে বলেন।”
“আপনি তুমি কী খাবেন?”
প্রিয়ু ফিক করে হেসে ফেলে। রিশাদ ইচ্ছে করেই প্রিয়ুকে হাসানোর জন্য এমন জগাখিচুড়ী বানিয়ে বলেছে। হাসুক না একটু! ভালোই তো লাগে। প্রিয়ু হাসছে। রিশাদ রান্না করতে চলে যায়। হাসি শেষ হলে প্রিয়ু একবার রান্নাঘরে উঁকি দেয়। তারপর রিশাদের বেডরুমে যায়। টেবিলের ওপর বই নাড়াচাড়া করতে গিয়ে প্রিয়ুর চুলের কাটা খুঁজে পায়। সাথে ভীষণ অবাকও হয়। রিশাদ কোথায় পেল এটা? রিশাদ রুমে এসে দেখে প্রিয়ু চুলের কাটার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ওটা আপনারই। মুহিতদের বাড়িতে পেয়েছি। আপনাকে ফিরিয়ে দেবো দেবো করেও ভুলে গেছিলাম।”

প্রিয়ু কোমরে হাত দিয়ে বলে,
“আবার আপনি?”
“আচ্ছা স্যরি।”
“আমার সাথে কথা বলার সময় এত ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হবে না। আমায় তুমি করে বলবেন। যখন আমি ডাকব, তখন ‘হ্যাঁ’, ‘শুনছি’, ‘বলেন’ এসব বলবেন না। সুন্দর করে বলবেন বলো।”
“আর কিছু?”
“না। আপাতত এতেই চলবে।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হ্যাঁ।”
“গায়ে হলুদের দিন মুহিতদের বাসায় গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন কেন?”
“আবার আপনি?”
“স্যরি। ঘুমিয়েছিলে কেন? আর আমায় কি দেখোনি?”
“বাড়িতে সৎ মায়ের জ্বালায় ঘুমাতে পারি না। একটা ফুলের বাগান আছে আমার। কয়েকটা তাজা গোলাপ চেয়েছিল সকালে মিনার মা। এজন্যই গিয়েছিলাম। আন্টি বলেছিল পরে বাসায় যেতে। ভাবলাম যে তাহলে একটু ঘুমিয়ে নিই। কিন্তু আপনাকে দেখব মানে? আপনি সেই রুমে ছিলেন?”
রিশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“তার মানে তুমি জানোই না আমি ছিলাম? তোমার জন্যই তো আমার এত সুন্দর ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেছিল।”
“আমি কী করেছি?”
“কী করেছ মানে? একা রুমে আমার পাশে শুয়েছিলে। যদি কেউ দেখে ফেলত? আবার ঠান্ডা হাত আমার গায়ের ওপর রেখেছ।”

শেষের কথায় প্রিয়ু লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে যায়। সেদিন কোনোকিছুই জানতো না প্রিয়ু। আজ জেনেছে তাও আবার সেই মানুষটাই জানালো যাকে ছাড়া সময়গুলো এখন কাটতেই চায় না। টিউশানির সময় রিশাদের বাড়ি থেকে বের হয় প্রিয়ু। সন্ধ্যার দিকে টিউশনি থেকে বাড়ি ফেরার সময় চায়ের দোকানে রিশাদকে দেখতে পায়। রিশাদ একা নয়। সাথে একটা মেয়েও আছে। একবার মনে হলো বাস থেকে নেমে দেখবে। পরে ভাবলো না, থাক! কালই জিজ্ঞেস করে নেবে। কিন্তু মনকে মানানো যাচ্ছে না। মেয়েটার সাথে চা খেতে খেতে হেসে কথা বলার দৃশ্যটা চোখে ভাসছে শুধু। অযথাই কষ্ট হচ্ছে। বাড়িতে ফিরে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আশা এসে জিজ্ঞেস করে,
“কীরে কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“মন খারাপ কেন?”
“মন খারাপ না।”
আশা প্রিয়ুর পাশে বসে বলে,
“কী লুকাচ্ছিস বল তো?”
“লুকানোর কিছু নাই।”
“আহা! বল না।”

প্রিয়ু এবার কেঁদেই ফেলে। কেন কাঁদে তা জানে না। শুধু জানে অসহ্যকর কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ করে কেঁদে ফেলায় আশা ভড়কে যায়। প্রিয়ুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আমায় বল কী হয়েছে?”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আপু।”
“কেন বনু? মা কি বকেছে আবার?”
“না।”
“তাহলে অন্য কেউ কিছু বলেছে?”
“কেউ কিছু বলেনি।”
“তাহলে?”
“আমি রিশাদকে অন্য একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখেছি।”
“তাতে কী?”
“ওরা খুব হেসে হেসে কথা বলছিল।”

আশা এবার প্রিয়ুর মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে। মুচকি হেসে বলে,
“আমার বোনটা কি প্রেমে পড়েছে?”
“জানি না আমি। রিশাদের সঙ্গ আমার ভালো লাগে। ও যখন আমায় হাসায় তখন আমার ভালো লাগে। ও যখন বোঝায় তখন আমার ভালো লাগে। ও যখন গান শোনায় তখন আমার ভালো লাগে। আমার মনে হয় ও আমার সুখের ঠিকানা।”
“ও জানে?”
“কী?”
“এইযে তুই ও’কে ভালোবাসিস।”
“এটাই কি ভালোবাসা?”
“তাই তো বলে মন।”
“এত অল্প পরিচয়েও ভালোবাসা হয়?”
“বোকা মেয়ে! ভালোবাসা কি সময় ধরে হয় নাকি? ভালোবাসা কারো ইচ্ছাধীন নয়। মনের অধীনে থাকে ভালোবাসা। আর মনের ওপর কারো কোনো হাত থাকে না।”
“আমি এখন কী করব?”
“সময় থাকতে ও’কে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিবি। আর পারলে কালই। এখন আয় খেয়ে ঘুমাবি।”
“খিদে নেই।”
“ভাতের ওপর রাগ করবি না একদম। চল বলছি।”
রাতের খাবার খেয়ে দু’বোন পাশাপাশি শুয়ে আছে। মাথা থেকে কিছুতেই দূর হচ্ছে না দৃশ্যটা।
“আপু!”
“হু।”
“মেয়েটা কে হতে পারে? গার্লফ্রেন্ড?”
“বোন হতে পারে, বন্ধু হতে পারে।”
“অন্য কেউও তো হতে পারে?”
“হুম পারে। তবে কখনো নেগেটিভ কিছু ভাববি না। সবসময় পজেটিভ ভাববি।”
“এই কথাটা রিশাদও বলে।”
“তাই নাকি? কী বলেছে শুনি?”
“আমি বলেছিলাম, ছোট থেকে যখন সুখ দেখিনি। তখন আমার কপালে আর সুখ নেইও। ও বলেছিল, ভাগ্যে কী আছে আর কী নেই তা আমরা জানি না। তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি ভালো থাকার। আর সবসময় যেটাই ভাববেন পজেটিভ ভাববেন। নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করা মানেই সেধে সেধে পেইন নেওয়া। ডিপ্রেশনে ডুব দেওয়া। পজেটিভ ভাবলে ভালো কিছুই হয়।”
“ঠিকই তো বলেছে। এখন তুইও নেগেটিভ কিছু ভাববি না। শুয়ে শুয়ে রিশাদের সাথে কাটানো ভালো ভালো মুহূর্তের কথা ভাব। দেখবি ঘুম এসে পড়বে।”
“আচ্ছা।”

———————————

তিতলিদের বাড়িতে এখন খুশির আনন্দ। তিতলি বিয়েতে রাজি হয়েছে। অরণ্যর ওপর পাহাড় সম রাখা অভিমান, জেদের বশেই এই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তিতলি। রাতে অরণ্যকে শেষবারের মতে কল করে তিতলি। অরণ্য ফোন রিসিভ করে স্বাভাবিকভাবেই বলে,
“কী খবর?”
“খুব ভালো। আমি বিয়েতে রাজি। সময়মতো ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়ে দেবো। পরিবার নিয়ে চলে আসবে।”
“আমি আসলে তুমি বিয়ে করতে পারবে?”
“তুমি যদি নিজে দাঁড়িয়ে আমার বিয়ে দেখতে পারো তাহলে আমিও পারব।”
“এইতো শক্ত মনের মেয়ে!”
“তুমিই বানিয়েছ।”
“তিতলি!”
তিতলি চুপ।
“ভালো থেকো তুমি তিতলি। সুখে থেকো।”
এতটুকু বলে ফোন কেটে দেয় অরণ্্য। কান্নারা আর বাঁধা মানছে না। দু প্রান্তে বসে দুজনে চোখের পানি ফেলছে। অন্ধকার সবার থেকে আড়াল করে ফেলছে দুজনের এই নিরব কান্না।
.
.
ভার্সিটি থেকে ফিরে রিশাদের বাসায় যায় প্রিয়ু। পুরো দুটো দিন রিশাদের সাথে দেখা করেনি প্রিয়ু। ভেবেছিল এটা হয়তো ক্ষণিকের ভালোলাগা। ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় রিশাদ আর কোথায় প্রিয়ু! বামণ হয়ে আকাশের চাঁদ ধরতে চাওয়ার আশা করতে নেই। নিজের মনের সাথে এই দুটো দিন যুদ্ধ করে থাকলেও আর পারছে না। এত অসহায় প্রিয়ুর কখনো লাগেনি। রিশাদের সাথে দেখা না করে, কথা বলে নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল।
রিশাদ বাড়িতে নেই। অফিসে গেছে। আসবে সন্ধ্যার পর। সালাম চাচার থেকেই এসব ইনফরমেশন যোগার করেছে। এই সুযোগে টিউশনিগুলো করিয়ে আসে প্রিয়ু। ক্লান্ত হয়েও যায় রিশাদের বাসায়। আজকেই সব জানাতে হবে। মনের কথাগুলো আর চেপে রাখা যাচ্ছে না।
মাত্রই অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে রিশাদ। আর তখনই কলিংবেল বাজে। শরীরের আরাম করাও হয় না আর। গেট খুলে প্রিয়ুকে দেখে। প্রিয়ু বলে,
“কথা আছে কিছু।”
“ভেতরে আসো।”
ভেতরে গিয়ে দুজনে ড্রয়িংরুমে বসে। এক হাত আরেক হাতের মুঠোয় নিয়ে আঙুল ফুঁটাচ্ছে প্রিয়ু। রিশাদ সোফার সাথে হেলান দিয়ে প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ ইতস্তত করে প্রিয়ু বলে,
“আমি যা বলার সোজাসুজিভাবেই বলছি।”
রিশাদ মজা করে বলে,
“কথা বুঝি আবার আঁকাবাঁকাও হয়?”
“উফফ! সিরিয়াস আমি।”
“আচ্ছা বলো।”
“সেদিন সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে যে মেয়েটার সাথে কথা বলছিলেন সে কে?”
“কলিগ।”
“বিবাহিত?”
“না। কেন?”
“আপনার তাকে কেমন লাগে? তারই বা আপনাকে কেমন লাগে?”
“এসব প্রশ্ন কেন?”
“আমি জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর দিন।”
“আমি তাকে কলিগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না।”
“আর সে?”
“তার কথা জানি না।”
“তার মানে সে আপনায় পছন্দ করে?”
রিশাদ এবার সোজা হয়ে বসে বলে,
“করতেই পারে। তাতে কী?”
“না পারে না। কেউ পছন্দ করবে না আপনাকে। কারণ…”
“কারণ?”
“কারণটা আপনি জানেন।”
“কী জানি?”
“আমি যে আপনার মায়ায় জড়িয়ে গেছি আপনি বুঝেন না?”
“বুঝি।”
“আপনাকে যে আমি ভালোবেসে ফেলেছি আপনি জানেন না?”
“জানি।”
“তাহলে সব জেনেবুঝেও অবুঝের মতো করেন কেন?”
“কারণ সম্পর্কে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
ভাঙা গলায় প্রিয়ু বলে,
“আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন?”
“না। কাউকেই ভালোবাসি না আমি। ভালোবাসা, রিলেশন এসব নিয়ে আমার মাথায় কোনো চিন্তাভাবনা নেই।”
“বাট আই লাভ ইউ রিশাদ!”
“ভুল কোরো না প্রিয়ু। ভুল মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পাবে।”
“আমি আমার জন্য সঠিক মানুষটাকেই বেছে নিয়েছি। আমি আপনায় ভালোবাসি। আমার আপনাকেই চাই।”
“পাগলামি করে কোনো লাভ নেই।”
“প্লিজ বোঝার চেষ্টা করেন প্লিজ!”
“খাইছ তুমি?”

বসা থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয়ু চেঁচিয়ে বলে,
“কথা ঘুরাবেন না একদম। আমি আমার উত্তর চাই।”
“উত্তর দিয়ে দিয়েছি আমি। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি পারব না ভালোবাসতে।”
“কেন পারবেন না? আমি আপনার যোগ্য নই বলে? আমার কেউ নেই এজন্য? ঠিকই তো আছে। যেখানে পরিবারের ভালোবাসাই আমি পাই না সেখানে আপনার ভালোবাসা পাব এটা ভাবাও তো বোকামি! কোথায় আপনি আর কোথায় আমি! আমি সত্যিই বোকা সত্যি।”

কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় প্রিয়ু। রিশাদের ডাকও শোনেনি। রিশাদকে দেখে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে।
.
.
বাড়িতে গিয়ে মায়ের কবরের কাছে যায়। বাঁশের বেড়া ধরে কাঁদতে থাকে ইচ্ছেমতো। এত কষ্ট কেন হচ্ছে প্রিয়ু জানে না। রিশাদকে ওর চাই! না হলে প্রিয়ুর ভালো থাকা সম্ভব নয়। একদম নয়। ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়ু বলে,
“মা! কেউ আমায় ভালোবাসে না কেন? আমি কি এতই খারাপ? এতই বাজে? ও মা! আমি এত অভাগী কেন মা? আমার জীবনে কি আমি সুখের দেখা কখনোই পাব না? মা, ও মা আমি রিশাদকে চাই মা প্লিজ! প্লিজ তুমি রিশাদকে বোঝাও একটু। তুমি বললে রিশাদ আমায় ভালোবাসবে। বলবে মা? বলবে একটু ভালোবাসতে?”

কাঁধে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রিয়ু ফিরে তাকায়। আবছা অন্ধকারে আশাকে দেখতে পায়। আশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদে প্রিয়ু। ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
“রিশাদ আমায় ভালোবাসে না আপু! রিশাদ আমায় ভালোবাসে না!”
“একবার ফিরিয়ে দিয়েছে বলেই হাল ছেড়ে দিবি? তার সামনে তোর ভালোবাসা প্রমাণ কর। তাকে ছাড়া থাকতে পারবি তুই?”
“জানি না আমি! কিচ্ছু জানি না। আমি শুধু জানি, আমার রিশাদকে চাই।”
.
আকাশে মেঘ জমেছে। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে অন্ধকার সবকিছু আলোতে পরিণত হচ্ছে। আবার সবকিছু অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। আশা ঘুমিয়ে আছে। প্রিয়ুর চোখে ঘুম নেই। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার অবস্থা। মাথায় ভূত ওঠেছে এখনই রিশাদের কাছে যাবে। ছোট একটা কাগজে একটা চিরকুট লিখে আশার বালিশের নিচে রাখে। রাতের অন্ধকারে একাই বেরিয়ে পড়ে প্রিয়ু। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এবার বড় বড় ফোঁটায় পড়ছে। শীতের সময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর, ঠান্ডা নিশ্চিত। এসব নিয়ে প্রিয়ুর কোনো মাথা ব্যথা নেই। রিশাদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা কুকুরও পর্যন্ত নেই। একই তো শীত তারমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে। দৃষ্টি রিশাদের ফ্ল্যাটের দিকে। সিকিউরিটি রুমে সালাম চাচা এতক্ষণ ঝিমুচ্ছিল। হঠাৎ নড়াচড়া করতে গিয়ে সামনে তাকিয়ে প্রিয়ুকে দেখে। কিন্তু অন্ধকারে দেখে চিনতে পারে না। ছাতা নিয়ে বাইরে এসে প্রিয়ুকে দেখে চমকে যায়। অবাক হয়ে বলে,
“মা! এত রাতে তুমি?”
প্রিয়ু কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
“আমি রিশাদের কাছে যাব চাচা।”
“সকালে আসতে। এখন তো মনে হয় ঘুমায়।”
“না, আমি এখনই যাব।”

উপায় না পেয়ে তিনি রিশাদকে ফোন দেয়। রিশাদ জেগেই ছিল। ফেসবুকিং করছিল। এত রাতে সালাম চাচার ফোন পেয়ে অবাক হয়। রিসিভ করে বলে,
“বলেন চাচা।”
“নিচে আসো একটু।”
“কেন?”
“প্রিয়ু আসছে।”
“কী? এত রাতে?’
“হ্যাঁ।”
” এই মেয়ে দেখি পাগল হয়ে গেছে।” বলে দৌঁড়ে ব্যলকোনিতে আসে। প্রিয়ু এতক্ষণ ব্যলকোনির দিকেই তাকিয়ে ছিল। রিশাদের বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে। এমন পাগলামি করার কোনো মানে হয়? কল কেটে দিয়ে রিশাদ ছাতা নিয়ে নিচে নামে। প্রিয়ুর সামনে এসে দুজনের মাথায় ছাতা ধরে বলে,
“কেমন পাগল মেয়ে আপনি? শীতের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজতেছেন। আবার এত রাতে একা বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। ভয় করে না? দেশের কোনো খবর রাখেন? যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যেত?”
“ভালোবাসি রিশাদ! একটু ভালোবাসেন।” ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে প্রিয়ু।
রিশাদ কপাল চাপড়ায়। বলে,
“চলেন। বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“আমি যাব না। কোথাও যাব না।” বলে রিশাদের হাত চেপে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না আমায়। আমার কিচ্ছু চাই না। শুধু একটু ভালোবাসেন আমায়।” বলে মাটিতে বসে রিশাদের পা ধরে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ুর হাত ধরে দাঁড় করায়। প্রিয়ুর বর্তমান কন্ডিশন বুঝতে পারে রিশাদ। তাই আর কিছু না বলে প্রিয়ুকে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে যায়। মেয়েদের কোনো কাপড় তো রিশাদের কাছে নেই। এই ভেজা অবস্থায় থাকলে ঠান্ডা আরো বেশি লাগবে। একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার দিয়ে প্রিয়ুকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়। প্রিয়ুর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে। রিশাদের টি-শার্ট প্রিয়ুর হাঁটুর একটু ওপরে ছুঁই ছুঁই করে। সঙ্গে তো প্রচুর ঠিলে। ট্রাউজারও ভীষণ বড়। রিশাদের সামনে কাকতাড়ুয়ার মতো দু’হাত করে দাঁড়িয়ে বলে,
“এটা কী? আরো দুজন ঢুকতে পারবে।”

রিশাদ হেসে ফেলে। প্রিয়ু মিথ্যে বলেনি। দুজন না হলেও একজন তো অনায়াসেই এই টি-শার্টের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে। হাস্যকর দেখাচ্ছে। প্রিয়ু ভাবলেশহীন। চোখগুলো ঘোলা ঘোলা লাগছে। জ্বর যে আসবে তা তো শিওর। রিশাদকে হাসতে দেখেও প্রিয়ু কিছু বলে না। সোফায় গিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে। এই বুঝি চোখের পাতায় ঘুম এসে পড়ল। ওষুধ এনে প্রিয়ুকে শুয়ে থাকতে দেখে রিশাদের মায়া হয়। জীবনে এত কষ্ট সহ্য করেও আবারও নতুন করে ভালোবেসে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা। আচ্ছা রিশাদ কি হার মানবে কখনো প্রিয়ুর এই পাগলামি ভালোবাসার কাছে?
#একটু_ভালোবাসা
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________

ঘুমের মধ্যে জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে প্রিয়ু। এই অভ্যাসটা ওর ছোটবেলা থেকেই। জ্বর আসলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে উল্টাপাল্টা বকবে। মনে যা আসবে তাই বলবে। অপর সোফায় বসে ফোন চাপছে রিশাদ। প্রিয়ুর ঘুম ভেঙে যায়। প্রিয়ুকে উঠতে দেখে রিশাদ বলল,
“ঘুম ভাঙল তাহলে?”
“আমার খিদে লেগেছে।” চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলে প্রিয়ু।
“খাবার তো আবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম করতে হবে। একটু অপেক্ষা করেন।”

রিশাদ ফোন রেখে রান্নাঘরে চলে যায়। প্রিয়ুর চোখেমুখে বিরক্তি। ও সোজা ফ্রিজের কাছে চলে যায়। গরম খাবার খাবে না প্রিয়ু। কেন শুনবে রিশাদের কথা? রিশাদ কি প্রিয়ুর কথা শোনে? শোনে না তো! ফ্রিজ থেকে কোকের বোতল বের করে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলে। মাথা ঝিম মেরে ওঠে। রিশাদ খাবার নিয়ে এসে দেখে প্রিয়ু কোকের বোতল হাতে নিয়ে বসে আছে।
“একি! আপনি ঠান্ডার ভেতর ঠান্ডা খাচ্ছেন?” জিজ্ঞেস করে রিশাদ।
“একশো বার খাব! হাজার বার খাব। আপনার কথা কেন শুনব আমি?”

রিশাদ তাড়াতাড়ি এসে প্রিয়ুর হাত থেকে বোতল নেয়। একটা বিশ্রী গন্ধও পায়। মদের গন্ধ। মাঝে মাঝেই অনিক ড্রিঙ্কস করে আর বাকিটা এখানে রেখে যায়। তার মানে প্রিয়ুও এখন ড্রিঙ্কসই করল! একই তো জ্বরের ঘোরে পাগলামি করছিল আবার এখন ড্রিঙ্কস! শিট! অনিকটার ওপর এখন রাগ হচ্ছে খুব। বোতল নেওয়ায় প্রিয়ু ক্ষেপে যায়। রিশাদের হাতে খামচি দিয়ে বলে,
“মেরে ফেলব একদম!”

রিশাদ ব্যথা পেয়েও কিছু বলে না। বোতলটা নিয়ে লুকিয়ে ফেলে। প্রিয়ু একা, একাই গান গাচ্ছে। নাচছে। মহা মুসিবতে পড়ল রিশাদ। টেবিলের ওপর গালে হাত দিয়ে বসে রিশাদ। চেয়ারের ওপর পা রাখে। গালে হাত দিয়ে বসে বসে প্রিয়ুর পাগলামি দেখছে। এছাড়া আর কী-ই বা করার আছে? কিছু কিছু কাণ্ডে ভীষণ হাসিও পাচ্ছে। কিছুক্ষণ একা একাই বকবক করে, নাচানাচি করে শুয়ে পড়ে। রিশাদ প্রিয়ুর গায়ে লেপ দিয়ে দেওয়ার সময় শুনতে পায় প্রিয়ু বলছে,
“ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে রিশাদ! এতটাই ভালোবাসি যে আপনাকে আমার ভীষণ আপন মনে হয়। নিজের মানুষ বলতে আমার তো কেউ নেই। হয়ে যান না আমার। একটু ভালোবাসেন।”
.
হিমশীতল বাতাসে শরীরে কাঁপুনী ধরার মতো অবস্থা। রাতে ড্রয়িংরুমে ঘুমিয়েছিল রিশাদ। ভেতরের রুমে প্রিয়ু। কলিংবেল বাজায় ঘুম ভেঙে যায় রিশাদের। আজকে অফিসও মিস গেল। অনিক এসেছে বাড়িতে। রিশাদের উদ্দেশ্যে বলে,
“কীরে আজ অফিসে গেলি না কেন?”
“প্রিয়ু বাসায়।”
“কে বাসায়?”
“প্রিয়ু।”
“এ্যা? কেন?”
“বোস তুই। আসছি।”

রিশাদ রান্নাঘরে গিয়ে দু মগ চা বানায়। অনিক দরজায় দাঁড়িয়ে একবার বেডরুমের দিকে উঁকি দেয়। সত্যিই প্রিয়ু ঘুমিয়ে আছে। রিশাদ চা নিয়ে আসার পর অনিক বলে,
“কাহিনী কী মামা?”
“কাহিনী লাভ কেস।”
“তার মানে? প্রেম হয়ে গেছে?”
“ফালতু বকবি না।”
“না বললে বুঝব কী করে?”
সব ঘটনা অনিককে বলার পর অনিক বলে,
“একটা সুযোগ মেয়েটাকে দেওয়া উচিত।”
“আমি পারব না রে! তুই তো জানিস আমার অতীতের কথা। আমি নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে পারব না আর। একবার ভেঙে যাওয়ার পর অনেক কষ্টে নিজেকে গড়েছি। আবার যদি ভেঙে যাই তাহলে আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারব না।”
“সবাই তো ঠকায় না রিশাদ।”
“জানি। কিন্তু আসে না আমার কারো প্রতি ভালোবাসা। প্রিয়ু ভালো। ওর লাইফটা অনেক কষ্টের জানি আমি। ও ভালো কাউকে ডিজার্ব করে। যে ও’কে ভালো রাখবে। আমার কাছে ভালো থাকবে না ও।”
“অতীত নিয়েই সারাজীবন থাকবি তুই? বিয়ে করবি না?”
“করব। তবে এখন তো এমন কোনো ইচ্ছে নেই। যতদিন না বাড়ি থেকে বিয়ে নিয়ে কোনো চাপ আসছে ততদিন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।”
“কিন্তু প্রিয়ু যে পাগলামি শুরু করেছে।”
“সেটা নিয়েই ভয় হচ্ছে আমার। যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলে। ওর মেন্টালিটি সিচুয়েশন এখন ভালো নয়। স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ওর সঙ্গ দিতে হবে। তার আগে একবার ও’কে বোঝাতে হবে।”
“দেখ! তোর যেটা ভালো মনে হয়।”
“হুম। তুই বোস তাহলে। আমি দেখি ঘুম থেকে উঠেছে কী’না।”

রিশাদ ঘরে গিয়ে দেখে প্রিয়ু ঘুম থেকে উঠে কাপড় পাল্টে নিজের কাপড় পরে নিয়েছে। বিছানার ওপর পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে।
“আপনি উঠে গেছেন ঘুম থেকে?”
প্রিয়ু একবার রিশাদের দিকে তাকিয়ে আবার আগের মতো করে বসে থাকে। রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
“চা নাকি কফি?”
“চা।”
“আচ্ছা বানিয়ে আনেন।”
প্রিয়ু অবাক হয়ে তাকায়। যেভাবে জিজ্ঞেস করেছে প্রিয়ু ভেবেছিল রিশাদ বানিয়ে দেবে।
“আমি বানাব?”
“হ্যাঁ।”
“পারব না।”
রিশাদ হেসে বলে,
“আমিই বানিয়ে দিচ্ছি। ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসেন। অনিকও আছে।”
“যাব না।”
“কেন?”
“আগে স্যরি বলেন।”
“স্যরি বলব কেন?”
“কারণ আপনি আমায় কষ্ট দিয়েছেন।”
“আচ্ছা স্যরি।”
“স্যরি বললেই কি সব সমাধান হয়ে যায়?”
“তাহলে স্যরি না।”
“কী?”
“না, স্যরি। এখন যাই?”
“কোথায়?”
“চা বানাতে।”
“আমার রাগ কমেনি।”
“কেন?”
“এখনো আমায় আপনি আপনি করে বলেন।”
“ভুলে যাই!”
“কবে জানি আমায়ও ভুলে যান।”
“ভুলতেও পারি।”

প্রিয়ু চুপ হয়ে যায়। রিশাদ গিয়ে চা নিয়ে আসে। প্রিয়ু এই ফাঁকে বিছানা গুছিয়ে ফেলে। জ্বর কমেনি এখনো। শরীর কাঁপছে। রিশাদ চা নিয়ে এসে প্রিয়ুকে দেয়। প্রিয়ু বলে,
“শুধু চা?”
“আর কী?”
“আর কিছু দেবেন না?”
“বিস্কুট?”
“না।”
“মুড়ি?”
“না।”
“রুটি?”
“না।”
“পরোটা?”
“তাও না।”
“তাহলে কী?”
“চুমু!”
“মানে?”
“মানের চায়ের সাথে চুমু চাই। চা-চুমু।”
“চা-চুমু?”
“হু! টি-কিস।”
“আমি এসব পারি না।”

প্রিয়ু বাচ্চাদের মতো করেই বলে,
“আমার চা-চুমু চাই মানে চা-চুমু চাই। টি-কিস দেন। দেন!”
“জ্বরের ঘোর কাটেনি। নাস্তা করবেন আসেন। তারপর ওষুধ খাবেন।”
“আমি কিছুই খাব না।”
“খাবেন না?”
“খাব।”
“তাহলে চা খান আগে।”
প্রিয়ু চায়ে চুমুক দেয়।রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
“এত রাতে একা আসতে আপনার ভয় করেনি? যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যেত?”
প্রিয়ু মিষ্টি হেসে বলে,
“আয়তুল কুরসী পড়তে পড়তে আসি।”
রিশাদ কপাল কুঁচকে বলে,
“ধরুন, আমিও তো আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারি। তখন?”
প্রিয়ুর নির্লিপ্ত উত্তর,
“আমি আপনার কাছে এসেও আয়তু্ল কুরসী পড়েছি।”

রিশাদের চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায়। মানে বিষয়টা কেমন হয়ে গেল! রাস্তাঘাটে বিপদের ভয়ের জন্য আয়তুল কুরসী পড়ে। আবার আমার সামনে এসেও পড়ে। মানে ভয় আমাকেও পায়। তবুও আসে!
.
নাস্তার টেবিলে রিশাদ, প্রিয়ু আর অনিক বসে আছে। রিশাদ সিদ্ধান্ত নেয় প্রিয়ুকে এখনই বোঝাবে। ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে বলে,
“প্রিয়ু।”
“হুম।”
“এসব পাগলামির কোনো মানে হয়?”
“বুঝলাম না।”
“আসলে কী বলব! এসব প্রেম, ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি চাই না, আপনি আমার জন্য কোনো কষ্ট পান। তাই সময় থাকতে নিজেকে সামলে নিন প্লিজ।”

রিশাদ আর অনিককে অবাক করে দিয়ে ফল কাটার ছুরি দিয়ে হাত কেটে ফেলে প্রিয়ু। দুজনই চমকে যায়। প্রিয়ু ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আর কিছু বোঝানো বাকি আছে?”
“পাগল তুমি?” হাত থেকে ছুরি নিয়ে বলে অনিক।
রিশাদ যেন কিছু বলতেও ভুলে গেছে। প্রিয়ুকে কিছু বলেই যে বুঝানো যাবে না এটা বুঝে গেছে রিশাদ। ফাস্টএইড বক্স এনে প্রিয়ুর হাত ওয়াশ করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। প্রিয়ু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। রিশাদ বলে,
“আর কোনোদিন আপনাকে আমি কিছু বলব না।”
“বলতে হবে না।”

রিশাদ অনিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আচ্ছা অনিক একটা কথা বল তো। কেউ যদি আমায় তুমি করে না বলে, তাহলে তাকে আমি কেন তুমি বলব বল?”
টলমল করা নয়নে প্রিয়ু রিশাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়। রিশাদও প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে বলে,
“কেউ আমায় তুমি বললে আমিও তাকে তুমি বলব।”
প্রিয়ু একটা ব্যান্ডেজ রিশাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
“আপনি ভীষণ বাজে। ভীষণ!”
“আপনি? ঠিক আছে, আমিও তাহলে আপনি করেই বলব। তখন যেন কেউ আবার অভিযোগ না করে।”

প্রিয়ু এবার রিশাদের গলা চেপে ধরে বলে,
“তোমায় খুন করতে পারলে আমার শান্তি লাগত।”
“সত্যিই? তাহলে খুন করে ফেলো। তাও শান্তিতে থাকো।”
“পারব না তো! তবে তোমায় শান্তিতে থাকতে দিতে পারব।”
“কীভাবে?”
“আমি মরে গিয়ে।”
“বাজে কথা ছাড়া আর কিছু বলতে পারো না?”
“পারি।”
“তাহলে বলো।”
“ভালোবাসি।”

রিশাদ নিশ্চুপ। প্রিয়ু বলে,
“এখন চুপ হয়ে গেলে কেন?”
“সবশেষে তুমি এই কথাটাই বলো। তখন আমার আর কিছু বলার থাকে না।”
“একটু ভালোবাসলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“এই টপিক বাদ দেই আমরা?”
প্রিয়ু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে যায়। বাড়িতে যেতে হবে। রিশাদ আর অনিকের থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। দরজার সামনে গিয়ে রিশাদকে বলে,
“আমায় যদি কখনো ভালোবাসো তবে আমি বেঁচে থাকতেই ভালোবেসো রিশাদ!”

————————————-

বাড়িতে গিয়ে দেখে আলেয়া বেগম উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। মনসুর আলী বাজারে গেছেন। আশা ভার্সিটিতে। প্রিয়ুকে দেখে আলেয়া বেগম বলেন,
“আশা বলল তুই নাকি আজ আগেই কলেজে গেছিলি?”
প্রিয়ু আমতা আমতা করে বলে,
“হ্যাঁ, যাদের প্রাইভেট পড়াই ওদের মধ্যে একজনের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাই প্রাইভেট পড়াতে গেছিলাম।”
“তোর বই-খাতা কই?”
“রেখে এসেছি। আবার যাব তো।”

ওড়না দিয়ে বাম হাতটা লুকিয়ে রেখেছে প্রিয়ু। একবার যদি দেখে ফেলে তাহলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। কোথা থেকে যেন আমিন হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে আসে। প্রিয়ুকে বলে,
“তুই ঐ ফ্ল্যাটে গেছিলি ক্যান?”
প্রিয়ু চমকে গিয়ে বলে,
“কোন ফ্ল্যাটে?”
“জানোস না তুই এখন? আমার বন্ধু তোরে ঐ বাড়ি থেকে বাইর হইতে দেখছে। লগে মুহিতের ভাই আর বন্ধুরেও দেখছে।”
“মুহিতের ভাই?” জিজ্ঞেস করেন আলেয়া বেগম।
“ঐযে মুহিতের বিয়েতে আসছিল। মুহিতের ভাই অনিক আর ওর সুন্দর কইরা বন্ধুটা। ঐ সুন্দর পোলাডার লগে কথা কইতে দেখছে।”

আলেয়া বেগম এবার প্রিয়ুর কনুইতে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“এত খারাপ হইয়া গেছস তুই? একটু আগে মিথ্যা বললি ক্যান? ঐ পোলার লগে তোর সম্পর্ক কীসের? বড়লোকের পোলার দিকে হাত বাড়াস মাইয়া। ব্যবহার কইরা যেদিন রাস্তায় ফালাইয়া দিব ঐদিন বুঝবি। প্রয়োজন যতদিন ততদিনই তোরে আদর-সোহাগ করব।”

প্রিয়ু ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে দেয়। ক্রোধ নিয়ে বলে,
“মুখ সামলিয়ে কথা বলো। সবাইকে নিজেদের লেভেলের ভাবো তাই না? রিশাদ তোমাদের মতো নয়। আর না ওর মানসিকতা তোমাদের মতো নিচু। তোমাদের সঙ্গে থেকেও আমি তোমাদের বিশ্বাস করতে পারি না। আর তাকে আমি চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করতে পারি। তার যদি খারাপ কিছু করার উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে আগেই সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারত।”
“দেখলি আমিন দেখলি? কেমনে কথা কয় এই মাইয়ায়?”

আমিন এবার প্রিয়ুর বাম হাত চেপে ধরে। প্রিয়ু ব্যথায় কুঁকিয়ে ওঠে। হাত মোচড় দিয়ে ধরে আমিন বলে,
“খুব সাহস হয়ে গেছে না? প্রেমিকে সাহস বাড়াইয়া দিছে?”
“হাত ছাড়ো আমার।”
জোরে মোচর দিতে গিয়ে হাত থেকে ওড়নাটা সরে যায়। তখন আলেয়া বেগম চেঁচিয়ে বলেন,
“ওর হাত দেখ।”
প্রিয়ু কাঁদছে। হাত লুকাতে চাইলেও লুকাতে পারে না। আমিন হাতের ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলে। হাতে জোরে চাপ দিয়ে বলে,
“আমাগো খাইয়া, পইড়া প্রেমিকের লেইগা হাত কাটোস? আজকে তোরে আমি প্রেম করার মজা বুঝাইতাছি।”

প্রিয়ুকে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে যায় আমিন। প্রিয়ু কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছে হাত ছেড়ে দিতে। আমিন ছাড়েনি। হলুদ-মরিচের ডালনা থেকে লবণের বাটি নেয়। এক মুঠো লবণ নিয়ে প্রিয়ুর কাটা হাতে মেখে দেয়। মরিচের মতো হাত জ্বলে ওঠে। প্রিয়ু চিৎকার করে কাঁদে। তৃপ্তির হাসি হাসে আমিন আর আলেয়া বেগম।
আপনার পছন্দের গল্প পড়তে ভালোবাসার রোমান্টিক গল্প পেইজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন এবং গল্পের লিংক পেতে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন। গ্রুপের লিংক কমেন্ট বক্সে দেওয়া আছে
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

ছবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here