#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫১
#Saji_Afroz
ইলারা জামান বারান্দায় বসে আছেন। আজ স্বামীর কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। এত তাড়াতাড়ি তাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবেননি কখনো। পৃথিবীতে তার আপন বলতে কে আছে এখন! একটা সন্তান। ইনতিসার। কিন্তু সেও তাকে পর করে দিলো একটা অবৈধ সম্পর্ক এর জন্যে।
ইলারা জামান জানতেন, তিনি কখনো মা হতে পারবেন না।এটা জেনেও ইলহাম শেখ তাকে বিয়ে করেন। আর কোনো সন্তান হবে না বলে নিজের সবটা উজাড় করে ইনতিসারকে ভালোবেসেছিলেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে উপলব্ধি করেছিলেন, যদি তার সন্তান হত তবুও ইনতিসারের স্থানটা থাকতো আলাদা। কারণ সে তার প্রথম সন্তান!
অথচ হায়! এভাবে করে ইনতিসার কখনো ভাবেনি। ভাবলে অতি সহজে এমন একটা কথা সে বলে ফেলতে পারতো না।
এসব ভেবে ইলারা জামানের চোখ ছলছলে হয়ে উঠে।
নাবীহা আসলো তার কাছে চা নিয়ে। ট্রে হাতে নাবীহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও কোনো কথা তিনি বললেন না। নাবীহাই বলল, চা এনেছি আপনার জন্য।
গম্ভীরমুখে তিনি বললেন, নিয়ে যাও।
-আপনি এই সময়ে চা খান।
-অবশ্যই। কিন্তু সেটা তোমার হাতের চাই না। কোনো বুয়াকে দিয়ে পাঠাও।
বেশ কয়েক দিন একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে থাকার পরেও ইলারা জামানের মন জয় করতে পারছে না নাবীহা। ইলারা জামানের পছন্দের খাবার রান্না করেছে, তার জন্য পছন্দের রঙের শাড়ি এনেছে, তাকে তাদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে বলেছে আরও কত কী! কিন্তু ইলারা জামান নাবীহার সবকিছুই প্রত্যাখান করেছেন। ইলারা জামানকে শ্রদ্ধা করে নাবীহা। অসময়ে স্বামী হারিয়েছে বলে ইলারা জামানের জন্য তার মনও কাঁদে। একসঙ্গেই বাকিটা পথ চলতে হবে। তবে কেন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে! এই ভেবেই তাকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল নাবীহা। কিন্তু তার প্রতি ইলারা জামানের এরূপ আচরণ দেখে হতাশ সে। আজ বাধ্য হয়ে বলেই বসলো, বুয়ার হাতে খাবেন তবুও আমার হাতে নয়!
-হু। কেন জানো? তোমার হাতে কিছু খেলে মনে হবে আমি বিষ খাচ্ছি! এতটাই জঘন্য লাগে তোমাকে আমার।
একথা শুনে কান্না আঁটকে রাখতে পারলো না নাবীহা। চা এর ট্রে টা রেখে ছুটে চলে যায় সে। পথিমধ্যে ধাক্কা লাগে তার ইনতিসারের সঙ্গে। তাকে এভাবে দেখে ইনতিসার বিচলিত হয়ে জানতে চাইলো, কী হলো তোমার?
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাবীহা তাকে সব জানায়। ইনতিসার বারান্দায় এসে মা কে বলল, নাবীহার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তুমি ভালো থাকবে ভেবেছ?
ইলারা জামান দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা তাই! তা কী খারাপ থাকব আমি?
-দেখো মা! বাবার অবর্তমানে তোমার সব দায়িত্ব আমার। তাই এমন কিছু করো না যাতে করে আমি সেই দায়িত্ব টুকুও পালন না করতে পারি!
আজকের আচরণের জন্য অবাক হলেন না ইলারা জামান। বরং তিনি কোনো কথাই বললেন না। মৃদু হেসে আবারও বসে পড়লেন চেয়ারে।
ইনতিসার তাকে এভাবে নিশ্চুপ দেখে বেরিয়ে পড়ে৷ নাবীহা এসে বলল, আপনাকে আমি বলেছি উনাকে কিছু বলতে! আমার খারাপ লাগাটা শেয়ার করাটাও কী ভুল?
-আমি তোমার জন্যই…
-ওহ প্লিজ! সম্পর্ক গুলোকে আর বেশি জটিল করবেন না।
এই বলে নাবীহা রুমে আসলো৷ ইলারা জামান যাতে সন্দেহ না করেন তাই তাদের একই রুমে থাকতে হচ্ছে। যদিও ইনতিসার সোফায় থাকে। তবুও এসব নাবীহার ভালো লাগছে না। মাঝেমধ্যে মনেহয় সে অনেক বেশি খারাপ কাজ করছে। আবার মাঝেমধ্যে মনেহয় মোটেও এমনটা না! তার সাথে যখন ভালো কিছু হয়না সে কেন অন্যের ভালোটা দেখবে! তাই যেটা যেমন চলছে চলুক।
এখন শুধু ইলারা জামানের অপেক্ষা। তিনি একবার নরম হলেই বিয়েটা সেরে নেবে। একেবারে সবটা পাকাপোক্ত করে তবেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সারতে চায় নাবীহা।
.
.
.
ইদানীং পড়ন্ত বিকেলে ছাদে এসে সময় কাটায় আজরা। এই সময়টা ভালোই উপভোগ করে সে। তার কাছে মনেহয় দিনের এই শেষ অংশটা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গোধূলি মাখা এই সময়টাই যে তার বেশ ভালো লাগে!
আজও ছাদে বসে গাঢ় কমলা রঙের অস্তায়মান সূর্যটা দেখছে আজরা। সূর্যের তাপ কমে গেছে বিধায়
চোখে বিন্দু মাত্র আঁচ লাগছে না ওর। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে এর সৌন্দর্য অবলোকন করলো আজরা৷ এরপর চোখ ঘুরিয়ে মনযোগ দিলো এক ঝাক ঘরে ফেরায় ব্যাস্ত পাখিদের দিকে । যারা উড়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে ! পাখিদের জীবনের নিয়মটা কত সুন্দর! ভোর হতেই জেগে উঠে, খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে এরপর নিজ গন্তব্যে ফিরে যায়।
আজরাও জীবনও এমন গোছালো ছিল। অথচ এখন! সামনে কী হতে চলেছে এ নিয়ে সে হতাশায়। জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহুর্তটা সে পার করছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ অন্ধকার জেনে সারাক্ষণ মনমরা থাকতে হয় তাকে৷
কেন ইনতিসার এমনটা করলো! নাবীহার মাঝে কী রয়েছে যা আজরার মধ্যে নেই! বরং আজরা তার সবটা দিয়েই ভালোবেসেছিল তাকে। এরপরেও ইনতিসারের মন নাবীহাতেই আঁটকে ছিল! আজরা এটা কখনো বুঝতে পারেনি। পারলেও কী এই সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারতো নিজেকে!
হঠাৎ আজরার খারাপ লাগে। প্রচুর বমি হয় তার। বমি অবস্থা কাহিল হওয়ায় ছাদের মেঝেতেই বসে পড়লো সে। আজিজা বানু এসে তার এমন অবস্থা দেখে বললেন, ঠিক আছিস?
হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়ে আজরা। আজিজা বানু বললেন, তোর বাবার কথা শুনলেই পারতি! এই পথ একা চলবি কিভাবে?
-তোমরা আছ না?
-তাও!
-তুমিও তো একজন মা। তবুও এটা বলো কিভাবে?
এই প্রসঙ্গে কথা বলে লাভ নেই জেনে আর কথা বাড়ালেন না তিনি। শুধু বললেন, নিচে চল। আচার খেলে ভালো লাগবে।
.
.
.
-দেখো তো খালামনি? রুমের সবকিছু ঠিক আছে কিনা?
সাদের কথা শুনে ইলারা জামান বললেন, একদম পারফেক্ট। তুই বাচ্চাদের এতসব কিছু চিনিস কিভাবে?
-ইউটিউব দেখে! তোমাকে বললাম কী আনব। নিজের জন্য কিছু চাওনি। চেয়েছ নাতি বা নাতনির জন্য। তাই সামান্য কিছু নিয়ে এলাম।
-সামান্য কিছু! আমার তো মনে হচ্ছে পুরো একটা দোকান নিয়ে এসেছিস!
-কী যে বলো না।
সাদ আবারও রুম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইলারা জামানের বোনের ছেলে সাদ। ইনতিসারের পিঠাপিঠি তার বয়স। ইনতিসারের বিয়ের সময় সে দুবাই ছিল। এরপর অন্যদেশে। ভ্রমণ করা ওর পেশা।
দেশে এসেছে কিছু দিন হলো। ইলারা জামানকে আজ দেখতে আসার কথা জানায়। সাথে কী আনবে জিজ্ঞাসা করে। তিনি বাচ্চার রুম সাজানোর জন্য কিছু জিনিস আনতে বলেন। আর সাদ কিনা কতকিছু নিয়ে হাজির হলো! শুধু তাই নয়। সে নিজে পুরো রুমটা সাজিয়ে দেয় সেসব জিনিস দিয়ে।
সন্ধ্যা হতেই অফিস থেকে বাসায় আসে নাবীহা ও ইনতিসার। সাদের সঙ্গে নাবীহাকে পরিচয় করিয়ে দেয় ইনতিসার। সাদ বলল, ভাবীর এই সময়ে অফিসে যাওয়ার কী প্রয়োজন? রেস্ট নেবে সারাক্ষণ।
দু’জনেই অবাক হয় তার কথা শুনে। ইনতিসার বলল, কোন সময়?
-বারেহ! ভাবী না প্রেগন্যান্ট?
-তোকে কে বলল?
-খালামনি। আমি ভাবীর জন্য অনেক উপহার এনেছি। পুরো রুমটা সাজিয়েছি তার।
নাবীহা রুম দেখতে চাইলে সেখানে তাকে নিয়ে যায় সাদ। সে এসব দেখে দাঁতে দাঁত চেপে ইনতিসারকে বলল-
এসবের মানে কী? আমি তো প্রেগন্যান্ট নই! তবে কী আপনার মা আজরাকে ফিরিয়ে আনবে?
তার কথার মানে বুঝতে না পেরে সাদ বলল, বুঝলাম না? আজরা কে?
ইলারা জামান এসে বললেন, আজরা হলো ইনতিসারের প্রথম স্ত্রী। যাকে ঠকিয়ে নাবীহাকে বিয়ে করে সে। আর আজরাই প্রেগন্যান্ট।
সাদ অবাক হয়ে বলল, কীসব বলছ?
-হ্যাঁ। শুধু ইনতিসার নয়। নাবীহাও তাকে ঠকায়। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল নাবীহা।
ইনতিসার গম্ভীরমুখে বলল-
সেসব পুরাতন কথা কেন তুলছ? তাছাড়া এই রুমটাও বা কেন সাজালে তুমি?
নাবীহা বলল, বুঝতে পারছেন না কেন? আজরাকে আনবে বলে।
ইলারা জামান শান্তস্বরে বললেন, তাই করব!
ইলারা জামানের প্রতি নাবীহার যা সহমর্মিতা ছিল সবই নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল এসব দেখে। বরং তার প্রচন্ড রাগ হলো। সে বলে বসলো, এই বাসায় কে আসবে না আসবে আপনি ঠিক করার কে? কী অধিকার আপনার! এসব ঠিক করবে ইনতিসার।
তিনি হেসে বললেন, তাই! ও ঠিক করবে?
-অবশ্যই! বাবার মৃত্যুর পর সবকিছু তো তারই। তাইনা?
তিনি হেসে ইনতিসারের দিকে তাকালেন। সে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইনতিসারকে এভাবে দেখে নাবীহা বলল, কিছু বলছেন না কেন? আজরার সঙ্গে একসাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ইলারা জামান বললেন, তবে চলে যাও! তুমি আর ইনতিসার দু’জনেই চলে যেতে পারো।
-আপনার কথাতে সব হবে?
-হ্যাঁ হবে!
নাবীহা ইনতিসারের দিকে তাকালে সে বলল, ওই আজরার জন্য নিজের ছেলের সঙ্গে এমন করছ?
-কে নিজের ছেলে! তুই আমার ছেলে না। চলে যেতে পারিস তোরা এই বাড়ি ছেড়ে।
তার কথা শুনে নাবীহা বলল, আমরা যাব না। যাবেন আপনি। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলে মজা বুঝবেন।
সাদ বলল,এসব কী ইনতিসার ভাই? তোমার সামনে খালামনির সাথে কিভাবে কথা বলছেন উনি?
ইনতিসার নাবীহার হাত ধরে তাকে অন্যরুমে নিয়ে যায়। নাবীহা বলল, আপনি কিছু বলছেন না কেন? এই বাড়ি যেমন তার স্বামীর তেমন আপনার বাবার। বরং আপনার অধিকার বেশি।
ইনতিসার বলল, আমি দেখছি বিষয়টা।
এই বলে সে মা এর কাছে আসলো। ইনতিসার বলল, তুমি কী চাও?
-এখনো বুঝতে পারছিস না?
-নাহ!
-আমি চাই তুই নাবীহাকে ছেড়ে দিবি। নতুবা এই বাড়ি!
-এসব করলে আজরা কী আমায় মেনে নেবে?
-সেটা আমি চাইও না।
-তবে?
– পরবর্তীতে কী হবে আমি জানিনা। কিন্তু আমি চাইনা না নাবীহার সঙ্গে তুই থাকিস। আর যদি থাকিস..
-কী?
-এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। আর এটাই আমার শেষ কথা। তুই তোর সিদ্ধান্ত আমার জানিয়ে দিস।
ইনতিসার নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। প্রয়োজনে সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত সে। কিন্তু নাবীহা! সেও কী তার সঙ্গে এভাবে পথ চলতে রাজি হবে!
এদিকে সাদ ইলারা জামানকে বলল, এটা কিভাবে সম্ভব হলো খালামনি? না মানে ইনতিসার ভাই কোনো কথাই বলল না!
মুচকি হেসে তিনি বললেন-
এসব সব আমার আগের স্বামীর। যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে তার তখনি সব আমার নামে করে দেন তিনি। কারণ তার মা বাবার আচরণ আমার প্রতি ভালো ছিল না। উনাদের সম্পদ কম ছিল না! সেইজন্য তিনি আমার চিন্তাই করেছেন। এদিকে ইনতিসারের বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে আমার ব্যবসা সামলান। যদিও এসব বড়ো হওয়ার পেছনে তার অবদান আছে। কিন্তু সবই আমার নামে আছে এখনো। ভেবেছিলাম সব ইনতিসারের হবে। কিন্তু ইনতিসার কী করলো! ওর কর্মের ফল ওকে ভোগ করতে হবে। আর সেটা আমিই করাব।
-আপনি এত ভালোবাসেন আজরাকে?
-ও সেটার প্রাপ্য। তাছাড়া আমার কোনো শশুর শাশুরীর আচরণ আমার প্রতি ভালো ছিল না। তাই আমি সবসময় ভাবতাম, পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতন দেখব। আর আজরা আমার মেয়ের মতোই চলেছে। এতকিছুর পরেও বাচ্চাটিকে পৃথিবীতে আনবে বলেছে। আর সেইজন্য পুরষ্কার সরূপ আমার সবকিছু হবে আজরার!
আজরা সম্পর্কে সব শুনে তার ছবি দেখতে চাইলো সাদ। আজরার ছবি দেখে আপনমনে বলল সে-
কী মায়াবী মেয়েটা! আর কত ভালোও। এমন কাউকে কিভাবে ভালো না বেসে থাকলো ইনতিসার ভাই!
.
চলবে#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫২
#Saji_Afroz
কোরআন তেলাওয়াত করছে আজরা। আজিজা বানু এসে জানালেন ইলারা জামান এসেছেন। আজরা উঠে ড্রয়িংরুমে আসলো। ইলারা জামানের পাশে একটি ছেলেকে দেখতে পেল সে। ইলারা জামানকে সালাম জানাতেই
তিনি জড়িয়ে ধরলেন আজরাকে। এরপর তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সাদের সঙ্গে।
সামনাসামনি আজরাকে দেখে আরও বেশি মুগ্ধ হলো সাদ। ছবির চেয়েও বাস্তবে সুন্দর আজরা। বিশেষ করে তার চোখ গুলো! চোখের ভাষা যেন পড়তে পারা যায়! এই যে এখন সাদ বুঝতে পারছে, আজরা জানতে চায় তারা এখানে কেন এসেছে।
ইলারা জামান বললেন, আমি তোমাকে নিতে এসেছি আজরা।
একথা শুনে অবাক হয়ে আজরা বলল, মানে?
-হুম। ও বাড়িতে আমার সঙ্গে থাকবে তুমি।
পাশ থেকে আজহার শেখ বললেম, কী অধিকারে আজরা ওখানে থাকতে যাবে? কোন ধরনের কথাবার্তা বলছেন আপনি?
ইলারা জামান একটু থেমে বললেন, ওই বাড়ির মালকিন হওয়ার অধিকারে।
-মানে?
আজহার শেখকে সব খুলে বললেন ইলারা জামান। তিনি খুশি হলেও একই বাড়িতে ইনতিসার ও নাবীহা থাকবে বিষয়টা মানতে পারলেন না। সাদ বলল, থাকবে না! ওরা চলে যাবে।
ইলারা জামানের শর্তের কথাও তাদের জানানো হয়। আজরা বলল, কিন্তু মা! এতসব কিছু আমার প্রয়োজন নেই। আমি এসব চাইনা! আপনি মাঝেমধ্যে আমাকে দেখতে আসবেন। এটাই যথেষ্ট।
-তবে আমার মৃত্যুর পর এসবের দায়িত্ব কে নেবে? আর তুমি চাওনা? যারা তোমাকে ঠকিয়েছে তাদের যোগ্য জবাব দিতে?
শেষের কথাটা বুকে গিয়ে লাগে আজরার। কখনো এভাবে ভেবে দেখেনি সে। কিন্তু ভাবার প্রয়োজন ছিল। নাবীহার জন্য কত কী না করলো সে! আর সেই নাবীহাই তাকে ঠকালো। অপরদিকে ইনতিসার! তার প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না আজরার। তবুও তাকে ঠকালো।
ছবি দেখে পছন্দ হওয়া মেয়েটা নিজের বউ এর থেকে বেশি আপন হয়ে গেল! টাকার জোরে ডিভোর্সও কার্যকর করে ফেলল। আর সেই টাকার জোরটা যখন ভাঙার সুযোগ এসেছে তবে কেন আজরা পিছপা হবে!
সাদ বলল, কিছু তো বলুন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আজরা বলল, আমি রাজি।
দলিল রাখা হয় আজরার সামনে। সেখানে সাক্ষর করে সে। এরপর আপনমনে বলল, তোমাদের খারাপ সময় শুরু হতে চলেছে!
.
.
অফিস সেরে বাসায় এসে আজরাকে দেখে চোখ কপালে উঠলো নাবীহার। আজরা ড্রয়িংরুমে বসে সাদ ও ইলারা জামানের সঙ্গে কথা বলছে। ইনতিসারও তাকে দেখে অবাক হয়। তার মানে ইলারা জামান যা মুখে বলেছেন তা করেই ছাড়ছেন!
নাবীহা ও ইনতিসার একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তাদের দেখে সাদ বলল, এসেছ তোমরা!
নাবীহা বলল, এখানে অবশ্যই আমরাই আসব। তাই নয় কী?
-তা বটে তা বটে।
এই বলে নাবীহা নিজের রুমের দিকে চলে যায়। ইনতিসার একবার আজরার দিকে তাকালো। বেশিক্ষণ তাকানোর সাহস সে পেল না। নাবীহার পিছু নেয় সে।
রুমে এসেই নাবীহা বলল, আজরা এখানে কী করছে?
-মা এনেছে তাকে।
-সেটাই তো! উনি কেন আজরাকে এখানে আনলো?
-উনার ইচ্ছে হয়েছে তাই।
-উনার ইচ্ছের এত গুরুত্ব কেন এই বাড়িতে? আর আপনিও কিছু বলতে পারলেন না! চুপচাপ এখানে চলে এলেন।
-কী বলতাম?
-কী বলতেন! আজরাকে চলে যেতে বলতেন।
-মা এনেছে। আমি কিভাবে বলি বলো?
-মা এর কথাতে যেন আপনি উঠবস করেন!
নাবীহাকে সত্যিটা বলতে পারলো না ইনতিসার
শুধু বলল, একটু সবুর করো। সবটা ঠিক হয়ে যাবে।
-সবুর আপনি করেন! ঠিক না হলে কিন্তু…
আর কিছু বলল না নাবীহা। ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
এদিকে আড়াল থেকে তাদের কথা আড়ি পেতে শুনেছে আজরা। নাবীহার অসম্পূর্ণ কথাটির মানে কী!
হঠাৎ তার কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো আজরা। পেছনে ফিরে সাদকে দেখে ফিসফিস করে বলল, আপনি!
সাদও ফিসফিসিয়ে বলল, খারাপ অভ্যাস! অন্যের কথা কান পেতে শোনা হচ্ছে?
আজরা লজ্জা পায়। সে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তার পিছু নেয় সাদ। পেছনে সাদকে আসতে দেখে সে বলল, কিছু বলবেন?
-রুম কেমন লাগলো বললেন না যে?
-মা করেছেন সবটা। অবশ্যই ভালো হয়েছে।
সাদ হালকা কেশে বলল, জি না! সব আমি এনেছি এবং আমি সাজিয়েছি।
আজরা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ওহ তাই! এইজন্যই তো বলি! এমন কেন এসব।
-কেমন?
-বিশ্রী!
এই বলে আজরা রুমে চলে আসে। রুমটা দেখে আবারও মুগ্ধ হলো আজরা। সবকিছু কতটা সুন্দর ভাবে গোছানো! অদ্ভুতভাবে আজরার প্রিয় জিনিস ও প্রিয় রঙ দিয়েই রুম সাজানো হয়েছে। অবিবাহিত কেউ
বাচ্চার মা এর জন্য এভাবেও রুম সাজাতে পারে ভেবে হাসলো আজরা। দরজার পাশে দাঁড়ানো সাদ বলল, পছন্দ হয়েছে তাইনা?
পাশ ফিরে সাদকে দেখে আমতাআমতা করে আজরা বলল-
মোটেও না।
-তাহলে এই হাসির রহস্য কী?
-এমন আবুলমার্কা কাজের জন্য হাসলাম।
সাদ আর কিছু বলল না। মুচকি হেসে সে চলে যেতে চাইলে আজরার ডাকে থেমে গেল। আজরা বলল, পছন্দ না। অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে আমার। ধন্যবাদ আপনাকে।
-আপনার ভালো লেগেছে শুনে আমারও ভালো লাগলো। আর শুনুন, কখন কী খেতে মনে চায় আমায় জানাবেন। ঘুরতে ইচ্ছে হলে বলবেন। আমায় ফ্রেন্ড মনে করবেন আপনার। এই বান্দা আপনার জন্য সর্বদা হাজির হব।
-তাই! আপনি কী এখানেই থেকে যাবেন?
-কেন? আপনার বাড়িতে থাকতে পারব না বুঝি?
-কেন নয়! জানতে চাইলাম।
-আছি কয়েকটা দিন। পরবর্তীতে ফোন তো আছেই।
-হুম।
.
.
স্টাডি রুমে বসে আছে ইনতিসার। চিন্তায় মগ্ন সে। কিভাবে কী সামলাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এমন দিনও আসবে জানলে নিজের ব্যাংক একাউন্ট এ অনেকখানি টাকা জমাতো সে। ব্যবসার সবকিছুই যে বাবার একাউন্ট এ যেত। আর ওসবের কিছুই যে তার হাতে থাকবে না, এমনটা কখনো ভাবেনি সে।
না না! ইনতিসার একটু বেশিই ভাবছে। তার মা এমনটা করতে পারে না। আজরাকে এনেছে নাতি বা নাতনির জন্য। ইনতিসারকে বেরুতে বলবেন না তিনি নিশ্চয়!
ইলারা জামানকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ইনতিসার। কফির মগটা টেবিলের উপরে রেখে বলল, এসো মা।
তিনি কাছে এসে বললেন, কী সিদ্ধান্ত নিলি?
-কী বিষয়ে?
-নাবীহাকে ছাড়বি নাকি এই বাড়ি?
ইনতিসার মৃদু হেসে বলল, তুমি এখনো এখানেই আঁটকে রয়েছ? দেখো মা! আজরাকে এনেছ তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ও থাকতে পারবে এখানে।
-তোর সমস্যা থাকার কথাও না। বাড়িটা কার ভুলে যাস না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনতিসার বলল, তবে তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে বলছ?
-হুম।
একটু থেমে ইনতিসার বলল, নাবীহাকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার ভালোবাসা সে।
-বেশ! তবে এখুনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে যা এই বাড়ি ছেড়ে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইনতিসার দেখলো, রাত বারোটা বাজতে চলেছে।
সে বলল, এত রাতে আমরা কোথায় যাব মা? অন্তত কয়েকটা…
তার চোখের দিকে তাকিয়ে ইনতিসার বলল, একটা দিন সময় দাও মা।
-কথায় কথায় মা ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই।
ছলছল নয়নে ইনতিসার বলল, এতদিনের অভ্যেস হুট করে কিভাবে বদলাই?
-যেভাবে সম্পর্ক গুলোকে বদলেছিস!
নিশ্চুপ ইনতিসারের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, আসতে পারিস তোরা। আর হ্যাঁ, শুধুমাত্র কাপড় চোপড় নিতে পারবি। আর কিছু নয়।
এই বলে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। ইনতিসার তাকিয়ে রইলো তার পথের দিকে।
.
.
নাবীহা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অফিসে কাজের ধকল ছিল বিধায় ক্লান্ত সে। হঠাৎ ইনতিসারের ডাকে ঘুম ভাঙে তার। ইনতিসার বলল, উঠে ব্যাগ গুছাও।
নাবীহা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে চোখ কচলিয়ে বসে বলল, ব্যাগ? কেন?
-আগে গুছিয়ে নাও। পরে বলছি।
একটু গম্ভীরমুখে নাবীহা বলল, বিয়ের আগে আপনার সাথে কোথাও যাব না আমি। যা প্লান করেছেন সব বাতিল করুন।
ইনতিসার বলল, এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা।
নাবীহা এক লাফে দাঁড়িয়ে বলল, মানে!
-হুম।
-কী হুম? কোথায় আজরাকে বের করবেন তা না। আমরাই বেরিয়ে যাব। কেন?
মিথ্যে বলল ইনতিসার, ওদের শিক্ষা দিতে। থাকুক না ওরা ওদের মতন!
-আর আমরা? যাব কোথায়?
-এর চেয়েও বড়ো বাড়ি তোমার নামে কিনে নেব আমি।
লোভে নাবীহার চোখ চিকচিক করে উঠে। ইনতিসার বলল, এখন তো চলো?
নাবীহা বলল, কিন্তু এখনই যাওয়ার কী প্রয়োজন?
-দম আঁটকে আসছে এই বাড়িতে। আজরার সাথে একই ছাদের নিচে থাকা সম্ভব না। তুমিও তো এটা চাওনা তাইনা?
-হুম।
-এখুনি বেরিয়ে গিয়ে ওকে এটা বুঝাব যে, আমরা কতটা অপছন্দ করি ওকে।
বোকা নাবীহা সবটা বিশ্বাস করে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এদিকে ছেলে হয়েও ইনতিসার যেন কান্না আঁটকে রাখতে পারছে না। ওয়াশরুমে গিয়ে কয়েক ফোটা চোখের পানি ফেলল সে। যে বাড়িতে এতটা সময় কাটিয়েছে সে, আজ সেই বাড়িই ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে!
ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নেমে আসলো তারা। ড্রয়িংরুমেই তাদের অপেক্ষায় আছে আজরা, সাদ ও ইলারা জামান। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলল না। তারা নীরবে বেরিয়ে যেতে থাকলে আজরার ডাকে থামলো। আজরা নাবীহার দিকে একটি খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এখানে কিছু টাকা আছে। রাখ সাথে। পরবর্তীতে লাগতে পারে।
তার কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় নাবীহা। সে বলল, টাকার মালকিনকে টাকার লোভ দেখাস?
-নিবি না বলছিস?
-তুই রাখ এইটা। ডেলিভারির খরচে কাজে দেবে।
এই বলে বেরিয়ে পড়ে নাবীহা। ইনতিসারের দিকে তাকিয়ে আজরা বলল, আপনার লাগবে নাকি?
হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে নিলো ইনতিসার। সাদ ইলারা জামানের উদ্দেশ্যে বলল, ইনতিসার ভাই এর খারাপ সময় শুরু হয়ে গেছে খালামনি!
.
চলবে