‘ বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে তাহলে এখন পাগলামোর মানে কী? পাগল পেয়েছেন আমায়?’
‘ আদৌও হওয়া না হওয়ায় কারো কিছু আসে যায়?’
রাফসানের কথার প্রতিউত্তরে রূপার জবাব। গলার স্বর একটু বড়ো করেই বলল সে। রাফসান কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রূপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গায়ের শালটা বিছানার এক কোণে রেখে তার পাশেই বসলো। রাফসান ওর পানেই তাকিয়ে আছে।
‘ পানি দেবো? দাঁড়িয়ে আছেন যে?’ রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলল রূপা। রাফসান উত্তর দিলো না কোনো। গায়ের ব্লেজার খুলে বিছানায় ছুড়ে মারলো। তারপরে রূপার বিপরীতে বসলো। চোখের দৃষ্টি রূপার মুখপানে।
‘ কিছু বলবেন?’ রাফসানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল রূপা। রাফসান এবারেও জবাব দিলো না কোনো। রূপাও কোনো উত্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়ালো৷ অকস্মাৎ হাত ধরে রাফসান বলল,
‘ সত্যিই চলে যাবেন?’
রূপা উত্তর দিলো না কোনো। রাফসানের থেকে হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। রাফসান তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার দিকে।
এই শীতেও গরম লাগছে রূপার। ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে ঢকঢক করে গিললো। হঠাৎই এমন হল কেন ওর? রাফসানের কথার জন্য? নাকি অন্যকিছু? এসব ভাবনায় রূপার থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। তারপরে স্বাভাবিক পানি কাঁচের গ্লাসে ঢেলে তাতে একটু লেবু চেপে রস ছাড়লো। একটু চিনিও দিলো। বাহির থেকে এসেছে এখন রাফসানের নিশ্চয়ই ভীষণ পানির পিপাসা পেয়েছে। না হলে ক্লান্ত লাগছে খুব। একটু শরবত খেলে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। এই লেবু শরবতটা রূপার খুব প্রিয়। তাই ভেবে নিয়েছে রাফসানেরও পছন্দ হবে। কিন্তু রাফসানের জন্য এত ভাবনার কী আছে? সে তো তার ইচ্ছেয় অনড়। তাহলে এত ভাবাভাবির আদৌও কোনো মানে আছে কী?
বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। তারপরে পা বাড়াল রুমের দিকে। কী এক কাণ্ড! এই শীতেও রূপা ঘামছে। বারবারই ঘেমে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এসব? উত্তর নেই কোনো।
দোতলার একটা সাদা বাঙলো। নাম ‘প্রিয়তা’। বাঙলোর নামটা বেশ মনে ধরেছে রূপার। কত অনুভূতি জড়ানো একটা নাম। কিন্তু একটা বাড়ির নাম যে এমনকিছু হতে পারে, জানা ছিল না রূপার। অবশ্য এখন তো জানা হল! মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে রাফসানকে জিজ্ঞেস করবে সে, ‘প্রিয়তা’ নাম কেন রেখেছে? শ্বশুর মশাই রেখেছিল? নিশ্চয়ই শাশুড়ীর নাম এমনকিছু ছিল। অথবা ভালোবেসেই রেখেছে। আবার মনে হয়, রাফসান শৌখিন মানুষ। তাই এমন ইউনিক নাম রেখেছে। হতেই পারে এমন। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন তার। কিন্তু মুখ ফুটে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যায় না। খুব ইচ্ছে করে হাজারো কিছু জানতে৷ তবুও নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখে৷
বাঁ পাশের করিডোর পেড়িয়ে রাফসানের রুম। অবশ্য সে রুমে তো রূপাও থাকে৷ এতবড়ো বাড়ি। আর থাকে কিনা দুজন মানুষ! তাও রাফসান যখন অফিসে যায় আর রূপা স্কুলে যায় তখন বাড়ি তো একদম ফাঁকা থাকে।
বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা রূপা। শিশু শ্রেণির বাচ্চাদের পড়ায় সে।
রাফসানের নিজস্ব অফিস৷ বাবার গড়া ব্যবসা এখন সে সামলাচ্ছে। একটা এক্সিডেন্টে পরিবার হারায় সে। ফুফু, কাকা, খালা, মামা থাকলেও অতিথি হিসেবে তাদের কাছে থাকে৷ তাছাড়া নিজের বাড়িতেই সময় পাড় করতো। এখন তো তবুও রূপা হল। তাও রূপা থাকা আর না থাকা একই।
না আছে কোনো সম্পর্ক, না অন্যকিছু! শুধুই দুজনের প্রতি দুজনের চাপা দায়িত্ববোধ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সে অফিসে থাকবে। আর রূপা তার স্কুলে। এভাবে চলছে দিন।
*
রাফসান এখনও সেভাবেই বসে আছে। রূপা সামনে গিয়ে শরবতের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো। রাফসান ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গ্লাস হাতে নিলো। তারপরে বলল,’ কিছু ভাবলেন এখনো?’
‘ হ্যাঁ। যা হবার তাই হবে।’ রূপার শান্ত কণ্ঠে শান্ত স্বর।
‘ কী ভাবলেন?’ বলল রাফসান।
‘ শরবতটা খেয়ে নিন। আমার রান্না আছে। ‘
‘ আজ ছুটির দিন। বাহিরে যাই?’
‘ আপনি যান৷ আমার ইচ্ছে করছে না।’
‘ প্লিজ।’
‘ উহু। একটা দিনেই বন্ধ পাই। এখনো বাইরে ঘুরাঘুরি করবো? একটু বাসায় থেকে রেস্ট নেই।’
‘ আচ্ছা৷’ রাফসানের ছোটো জবাব।
রূপা কিছু ভাবলো। পরক্ষণেই বলল,
‘ কখন যাবো? রেডি হতে হবে তো।’
‘ সত্যিই যাবেন?’
‘ হুঁহ।’
‘ দুপুরেই যাই। শুনুন, একটা কথা ছিল।’
‘ জি বলেন।’ বলল রূপা।
‘ আজ তো বন্ধের দিন ছিল। বাহিরে কেন গিয়েছিলেন? কোনো কাজ ছিল কি?’
‘ হ্যাঁ, একটু।’
‘আচ্ছা।’ বলল রাফসান। আর কথা বাড়াতে চায় না। সকালে অফিসের কাজের জন্য বের হয়েছিল। তখনই রাস্তায় রূপাকে দেখলো কারো সাথে। সম্পর্কে কী ছিল তা জানা নেই। অবশ্য রূপার ব্যপারে কোনো খবরদারি করলেই না জানা যাবে!
বিয়েটাই হল কেমন করে।
________________________________________
বৃষ্টিমুখর দিন ছিল। শহর থেকে খানিকটা দূরে বেড়িয়েছিল রাফসান। কতদিন গ্রামের আলোবাতাস পায়নি। এজন্য গ্রামের পথ ধরে সে। গন্তব্য ফুফুর বাড়ি। তবে রাস্তার মাঝপথেই বৃষ্টি শুরু হয়। কাঁদা মাটি, পানিতে একাকার ছিল গ্রামের রাস্তা। ইটের রাস্তা থাকলেও বেশ ঝামেলায় পরতে হয়। তারমধ্যে যদি গাড়িটা নষ্ট হয়? তখন এর থেকে মসিবত আর কিছুতে মনে হয় না। খানিকক্ষণ সে গাড়িতেই অপেক্ষা করলো। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় বাইরে বের হওয়াও সম্ভব নয়। তাই গাড়িতেই বসে রইলো। তবে বৃষ্টি থামার নাম নেই। রাফসান হতাশ হল। যেই খানিকটা বৃষ্টি থামার পথে তখনই গ্লাস দিয়ে আশেপাশের দিকে চোখ বুলালো। বেশ দূরে ছোটো গ্রাম। তাছাড়াও রাস্তার পাশেও দুই-একটা ঘর আছে। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়। এই মুহূর্তে এই জনবলে গাড়ি ঠিক করার মতোও কিছু পাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে এখানেই কারো সাহায্য নিয়ে থাকতে হবে। না পারবে ফুফু বাড়ি যেতে আর না পারবে শহরে ফিরতে।
বটগাছের নিচে রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড়ানো ছিল। আর রাফসান তার থেকে কিছুটা দূরে যাওয়া মাত্রই বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে শুরু করলো। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সামনের বাড়িটার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
‘ কেউ আছেন? হ্যালো…কেউ আছেন?’ দরজায় করাঘাত করে ডাকলো। তবে কোনো সাড়াশব্দ নেই।
রাফসান হতাশ এবারেও। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে আবারও বলল,
‘ কেউ আছেন? সমস্যায় পরেছি। একটু সাহায্য করবেন?’
এবারে মধ্যবয়সী একজন মহিলা আসলো। কাঁপা স্বরে বলল,
‘ কে? ‘
‘ বৃষ্টি নামছে। গাড়িটাও চলছে না। কাছাকাছি তো কোনো গ্যারেজও পাবো না। আসলে… ভীষণ বিপদে পরেছি।’ আমতা আমতা করে বলল রাফসান।
মহিলাটি কিছু ভাবলো। তার ভীষণ মায়া হলো রাফসানের জন্য। আবার ভয়ও লাগছে। আশেপাশে কতশত কাহিনী শুনে। তারমধ্যে নাতনিও ঘরে থাকে। এরমধ্যে একটা পুরুষকে কীভাবে ঘরে তুলে বসতে বলবে? তবুও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে বললেন,’ বারান্দায় চেয়ার পেতে দিচ্ছি, বসো। ‘
রাফসান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আবার ভেতরে ভেতরে চরম পর্যায়ের অস্বস্তিও লাগছে। এ সময়ে এমন বিপাকে ফেলা! ওর মনুষত্বে নাড়া দিচ্ছে। শালীনতা রেখে বলল,
‘ ধন্যবাদ। বৃষ্টিটা থামলে দেখি কিছু করা যায় কিনা।’
মহিলাটি কিছু বলল না। সে ঘরের ভেতরে গেল। কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ রূপা, চা বানাতো একটু।’
‘ এখন?’
‘ হ, একটা ছেলে আসছে তার জন্য।’
‘ কে? ‘
‘ কথা না বাড়াইয়া যা।’
অপরপাশ থেকে আর কোনো কথা শুনলো না। হয়তো মেয়েটা চা বানাতে গেল৷ কিছুক্ষণ পরে মহিলাটি আসলো রাফসানের কাছে৷ হাতে চা, মুড়ি ছিল। যাই হোক, এই সময়ে চায়ের দরকার ছিল। রাফসান হাসিমুখে কাপ ধরলো। বৃষ্টিও কমার পথে তখন। বেশ ভালোই হল৷ এতক্ষণে যা বুঝতে পেরেছিল যে, এই ঘরে জনমানব কম। দুজন ছাড়া আর কারো তো সাড়াশব্দ পেল না।
তাই এখানে যত কম সময় থাকবে ততই তার পক্ষে ভালো৷ মানুষ বিপদে যে কখন পরে তার ঠিক ঠিকানা নেই৷ হঠাৎই পরে যায়। আজ ঠিক রাফসানের সাথে যা হল। অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। সে বরাবরই বিপদকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে৷ আজও তাই করবে।
একটু পরে যখনই বাড়ির গন্ডি পেড়োবে। ঠিক তখনই কিছু ভেসে আসলো। চারিপাশে গ্রামের লোকজন। কানাঘুঁষা হচ্ছে, ‘ বৃষ্টির দিনে মাইয়া মানসের ঘরে পোলা মানুষ আনছে। কোনো বেডা মানুষ নাই তাই এই অবস্থা!’
এমন কটাক্ষ কথায় রগ দপদপ করে উঠলো রাফসানের। বুঝতে পারলো, তার আসাটা ভালো চোখে দেখেনি কেউ। অবশ্য দেখার কথাও নয়। যে দিনকাল! তবুও কেমন যেন লাগলো। সে তো পুরুষ মানুষ। এখানের কাউকেও তেমন চিনে না। তবুও যারা আশ্রয় দিল, পাশে থাকলো তাদের এমন অবস্থায় ফেলে চলে যাবে? এতটা নিচে নামেনি সে। সে এগিয়ে গেল জনসম্মুখে।
মুরব্বিরা বলছে,’ এই অন্ধকারে আইছে। নিশ্চয়ই কিছু হইছে। বিয়া পড়াও নাতনির লগে ৷ না হলে গ্রাম দিয়া নামো হাজেরা বানু। এতবড়ো জোয়ান নাতনি, আর এই সময়ে একটা জোয়ান পোলা মানুষ আইছে, আমরা কি বুঝি না কিছু?’
হাজেরা বানু বাকশূণ্য হয়ে গেলেন। রাফসান তখন সবকথাই শুনছিল। অনেকে ভেবেছিল সে বোধহয় কেটে পড়বে। তবে রাফসান আগ বাড়িয়ে বলল,’ ব্যবস্থা করেন, এখনই বিয়ে হবে।’
ব্যস! তখনই কেউ কাউকে না জেনেশুনেই তিন কবুলে বাঁধা পড়লো।
নিয়মমাফিক সেদিন তো দূরের কথা পরেরদিনও আসা হল না রাফসানের। বউয়ের মুখ দেখলো দুইবার মাত্র। নিজের মধ্যেও একটা অপরাধবোধ কাজ করেছিল৷ তবুও কী আর করার! যা হবার তো হয়েই গেছে। দিনের বেলা ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি ঠিক করার কথা বলল। স্থানের নাম বলল।
যত দ্রুত এখান থেকে যাওয়াই ভালো। কোনোদিক থেকেই শান্তি, স্বস্তি পাচ্ছে না। কী থেকে কী হয়ে গেল। তার জন্য একটা মেয়েকেও বিপাকে পরতে হল। এত অপরাধবোধ নিয়ে থাকা যায়!
দুপুরে যখন রূপা ওর সামনে আসলো তখন আমতাআমতা করে বলল,’ বিকেলে চলে যাব, আপনি যাবেন?’
রূপা রাগে ক্ষোভে জবাব দেয়নি কোনো। রাফসান হতাশাগ্রস্ত হয়।
মনে মনে ভাবলো,’ যেহেতু বিয়ে হয়েই গেছে, তখন রাগ দেখিয়ে তো কোনো লাভ নেই। যা হবার হবেই।’
তাই বিকেলে রওনা হওয়ার পরে বাধ্যতামূলকই রূপাকে যেতে হয় ওর সাথে। হাজেরা বানুর নাতনিকে এভাবে বিদায় জানাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তবুও কোনো উপায় ছিল না তার।
অবশ্য রাফসান তাকেও নিতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি যাননি।
সময়টা সেভাবেই চলতে থাকে। দিনের পরে রাত। আর রাতের পরে দিন। আর সাথে চলতে থাকে রাফসান, রূপার ছন্নছাড়া সম্পর্ক।
_________________________________
পুরনো ভাবনা ফেলে গোসলের উদ্দেশ্যে গেল। সম্পর্কটা যেভাবেই শুরু হোক, হয়েছে তো! এটাকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যদি মাঝপথে ছেড়ে দেয়, তাহলে মেয়েটার কী হবে? তার জন্যই তো এই বিপাকে পড়তে হল।
#চলবে
#একদিন_বৃষ্টিতে_বিকেলে
#লেখায়_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
#পর্ব_১
( কয়েকমাস পরে লেখা শুরু করলাম। ভূল হতে পারে। মন্তব্যে জানাবেন নিশ্চয়ই।)