#একাকী_বিকেল
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২
তৌহিদের কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে সেই মুহূর্তে আমার মাথা কাজ করছিলো না। শুধু মনে হচ্ছিলো চার বছরের সম্পর্ক, কীভাবে পারলো সে এরকম করতে? পরিবারের লোকজনদের মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যটা স্বীকার করার সাহসও হলো না আমার৷ ছাদে দাঁড়িয়ে অনবরত চোখের জল ফেলছিলাম। দুপুরের কড়া রোদে ঝকঝক করছিলো বিয়ে বাড়িটা। বাতাস বইছিলো মৃদুমন্দ। আমি একদৃষ্টিতে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছি। মুখের সাজগোজ সব লেপ্টে গেছে, হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে চোখের কাজলটা মুছলাম। গলা শুকিয়ে আসছিলো, পানি প্রয়োজন। চোখ মুছে নিস্তেজ পায়ে নিচে নামতে যাবো তখনই ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ালো রিনি আপু। ও হলো আমার মেজো চাচার মেয়ে, আমার আরেক কাজিন। এই একটা মেয়ে, যে আমার সব সিক্রেট জানে৷ আমাকে দেখে আপু বিস্ফোরিত গলায় বলল, ‘এই নুহা। তোকেই তো খুঁজছিলাম। ছিলি কোথায় তুই?’
রিনি আপুকে দেখে আমি থমকে দাঁড়ালাম। ওর কথা শুনে আমি বুঝতে পারছি, আপু কেন এমন ব্যবহার করছে। সে তো তৌহিদ আর আমার ব্যাপারে সবটা জানে। তাই অবাক হওয়াটা বড় ব্যাপার না। আমি নরম গলায় বললাম, ‘ এই তো ছাদেই ছিলাম। কেন বলো তো?’
রিনি আপু বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আরে নিচে কী ঘটেছে তুই দেখোস নাই? তুই তৌহিদকে দেখেছিস? ওর সাথে মিথিলা’র বিয়ে হচ্ছে!’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দেখেছি তো।’
আপু উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, ‘তুই জানতি তৌহিদের আজ বিয়ে? তোর সাথে ওর ব্রেকআপ হয়েছিল নাকি? জানি না তো আমি! এই বল না!’
আপুর কথা শুনে ভেতরের সব কষ্ট কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো, ‘না আপু। আমি কিছুই জানতাম না, তৌহিদ আমায় ঠকিয়েছে।’
রিনি আপু ভীষণ অবাক হয়ে আমাকে ছাদের একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন। রোদ যাতে গায়ে না লাগে সেজন্য ছায়া পড়ে সেই জায়গা বেছে আমাকে নিয়ে সেখানে দাঁড়ালেন। তারপর উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই আটকালি না কেন ওকে? সবাইকে জানালি না কেন তোর সাথে ওর সম্পর্ক ছিল?’
আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘এটা কী ভালো হতো? বাড়িভর্তি লোকজন, আর আমি কাকে কী বলতাম?’
রিনি আপু ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘মানে? তোকে ঠকিয়েছে তৌহিদ, এটা দেখেও তুই চুপ করে থাকবি? তোদের তো চার বছরের প্রেম!’
‘আর কোনো পথ খোলা রেখেছে ও? আর এটাকে তুমি প্রেম বলো না আপু! আমার থেকে পালাতে চেয়েছে, পেরেও গেছে। ভালো তাই না?’
রিনি আপু এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘তাই বলে মিথি’র জীবন নিয়ে তুই ছিনিমিনি খেলবি?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’
‘তুই যেহেতু তৌহিদের প্রেমিকা তাই সবাইকে না জানালেও মিথিলাকে জানানোর প্রয়োজন ছিল তোর। ওরকম একটা অমানুষের সাথে বিয়ে হয়েছে ওর, মিথিকে যে ঠকাবেনা তার কী গ্যারান্টি আছে? তুই জেনেশুনে এটা কেন করলি?’
আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে বললাম, ‘আপুর বিয়েটা ভেঙে যেতো৷ বড়চাচা কষ্ট পেতেন, পাড়া-প্রতিবেশিরা কথা শুনাতো! এসব ভেবেই তো আমি বলিনি।’
রিনি আপু আমার মাথায় ঠোকা মেরে ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘রাখ তোর পাড়া-প্রতিবেশির কথা। ওরা আগে না মিথিলা আগে? তৌহিদের মতো ওরকম ঠকবাজের সাথে ও কীভাবে সুখী থাকবে? না-হয় প্রতিবেশিরা ক’টা কথা শোনাতোই, ওদের স্বভাবই তো ওরকম। কিন্তু প্রতারকের সাথে বিয়েটা তো অন্তত হতো না! মিথি’টা বেঁচে যেতো।’
আমি মিনমিন করে বললাম, ‘তাহলে তুমি তো বলতে পারতে!’
রিনি আপু ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ‘পাগল! আমি ছিলাম না-কি ওখানে? ভিড়ভাট্টা ছিলো বলে আম্মার সাথে রান্নাঘরে ছিলাম। বিয়ে পড়ানো শেষ হবার পরে আমি জামাই দেখতে যাই, তখনি তৌহিদকে দেখলাম। আর তুই এসে আমাকে জানালি না কেন যে, তৌহিদই মিথির বর? আমি কিছু তো অন্তত ভাবতে পারতাম। কিন্তু এখন কী করব? বিয়ে তো হয়ে গেছে। ইশ, নুহা! তুই এটা কী করলি?’
আমি কান্না করে দিলাম। বললাম, ‘আসলে তৌহিদের ওপর আমার খুব ঘৃণা হচ্ছিলো। মাথায় তখন কিছুই আসেনি, কোনটা উচিৎ আর কোনটা উচিৎ নয়৷ কিন্তু এখন কী করবো? আমি চাই না মিথিলা আপু এরকম প্রতারকের সাথে সংসার করুক।’
রিনি আপু আফসোস করতে করতে বললেন, ‘এখন বলে কী হবে? বিয়ে পড়ানো, সাইন নেওয়া হয়ে গেছে। ইশ, আমি যে কেন আরেকটু আগে এলাম না। বজ্জাতটাকে সবার সামনে ধোলাই দিতাম। আর তুই বোকা এটা কোনো কাজ করলি? চার বছরের প্রেমিককে এভাবেই ছেড়ে দিলি? মনেই হচ্ছে না তোদের কোনো প্রেম ছিল। অন্য কোনো মেয়ে হলে এতক্ষণে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিতো!’
আমি মন্থর কন্ঠে বললাম,’রিনি আপু, আমি ওরকম মেয়ে নই যারা জোড় করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। যে থাকার তাঁকেই আমি ধরে রাখার চেষ্টা করবো। যে যাবার চলে যাক। হঠাৎ করে তো,সবটা এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এতদিনের চেনাজানা তৌহিদের ভন্ড রুপটা চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেলো। একটা কথাই বলবো, মানুষ চিনতে আমার বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। এই সুযোগই নিয়েছে তৌহিদ।
কিন্তু এখন আমার চিন্তা, মিথিলা আপুর জন্য কী করবো? আমার মাথায় কিছু আসছে না।’
রিনি আপু গোমড়া মুখে বললেন, ‘আব্বাকে জানাই? আর তো উপায় দেখছি না। কাউকে না কাউকে তো জানাতেই হবে।’
আমি ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম, ‘মেজো চাচা’কে?’
‘হুম, চল। আব্বা না-হয় বড়চাচাকে বুঝিয়ে বলবে। তারপর ওরা যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। আমাদের বড্ড ভুল হয়ে গেছে রে নুহা, বিয়েটা হতে দেওয়া উচিৎ হয় নি।’
আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। শূন্য দৃষ্টিতে উঠোনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বরপক্ষ চলে গেছে?’
রিনি আপু কঠোর গলায় বললেন, ‘না, যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। নিচে চল!’
‘এখনই বলবে?’
রিনি আপু একনজরে উঠোনটা অবলোকন করে আমার হাত ধরে এদিকওদিক তাকিয়ে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন, ‘আব্বাকে তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না এখন। বরপক্ষ বিদেয় হলে তবেই না হয় বলবো। চল!’
ক্লান্ত ভঙ্গিতে রিনি আপুর পেছন পেছন আমি নিচতলায় নেমে এলাম। ঘরভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে। খাবারদাবারের গন্ধে ঘরের ভেতরটাও গুমোট হয়ে আছে। ভিড় ঠেলে রিনি আপুর সঙ্গে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। মুরুব্বিরা যে যার সাথে কথা বলছে। তবে মেজোচাচা আর আব্বুকে কোথাও দেখা গেল না। অগত্যা আমাদের হতাশ হতে হলো। তৌহিদ দূর থেকে আমাকে দেখে তাকিয়ে রইলো। আমি ঘৃণায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। অতঃপর এলো বিদায়ের পালা। মিথিলা আপুকে তৌহিদের হাতে তুলে দিলেন বড়চাচা। সেই মুহূর্তে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো, কিছু করতে পারলাম না আপুর জন্য। স্বার্থপর মনে হচ্ছিলো নিজেকে। এদিকে কান্নাকাটি করে আপুর সাজগোজের অবস্থা বেহাল। আমি আর রিনি আপু মিলে ওকে তৌহিদের পাশের সিটে বসিয়ে দিলাম। আপুর হাতে মুঠোতে নিয়ে আমি নিস্তেজ গলায় বললাম, ‘স্যরি আপু।’
মিথিলা আপু আমার দিকে খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো। তৌহিদ মাথা নিচু করে বসে আছে পাশে। আমি ‘কিছুনা’ বলে একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। বিয়ে বাড়িটাকে নির্জন বানিয়ে আপু চলে গেলো, এক এক করে মেহমানরাও। বাড়িতে তখন খুব কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন, আর আমরা আমরাই রয়েছি। আমার মাথাব্যথা করছিল, বুক ভার হয়ে কান্না আসছিলো। কিন্তু কোনো ঘরদোর ফাঁকা না পেয়ে আমি বাড়ির পেছনে নদীরঘাটে গিয়ে বসে রইলাম। অনেক পুরোনো ঘাট, ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে। মাঝে মাঝে মাহাদ ভাই এখানে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরে। রিনি আপু কাজে ব্যস্ত। তাই সে আসেনি। আমি সিঁড়িতে অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিলাম। তৌহিদের সাথে কাটানো সোনালি বিকেলের কথা মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে। ওর ওপর রাগ করে আমি মিথিলা আপুকে ওর হাতে তুলে দিয়েছি ভাবতেই স্বার্থপর মনে হলো নিজেকে। চোখের জল গাল বেয়ে টুপ টুপ করে সিমেন্টের মেঝেতে পড়ছিলো। তখন গোধূলির লালচে আকাশে দূর থেকে দূরে উড়ে যাচ্ছিলো নীড়হারা পক্ষীরা। চারপাশের নিরবতার মাঝে কানে বাজে হাওয়ার শব্দ আর ঝিঁঝি পোকার কর্কশ চিৎকারে। নদীর স্বচ্ছ টলমল পানিতে শেষ বিকেলের সোনা রোদের টুকরো ঝিলমিল করে উঠছিলো। একাকী সেই বিকেলে, নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে আমি বোকার মতো ভয়ানক একটা কাজ করে বসলাম। গভীর সেই নদীতে আমি ঝাঁপ দিয়ে বসলাম। সাঁতার জানি না, ক্রমেই স্রোতের টানে আমি ভেসে যাচ্ছিলাম দূরে। নাকমুখ বন্ধ হয়ে আসছে, ভাবতে পারছি না কিছু। ডুবে যাচ্ছি অতল গভীরে.. তারপর, আর কিছুই মনে নেই আমার!
যখন আমি চোখ খুললাম নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমাদের শহরের বাসায়। মাথাটা ভার ভার লাগছিলো, বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সেই অনুভূতিটুকু যেন ভোঁতা ঠেকছিলো। মাথাটা উঁচু করার চেষ্টা করতেই পায়ের ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। উফ, রগে টান ধরেছে বোধহয়। আমার মৃদু চিৎকারে মা তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন কোথা থেকে যেন। এসে আমাকে দেখে আব্বুকে ডাকতে লাগলেন, আর নিজে এগিয়ে এসে আমাকে ধরলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘উঠার চেষ্টা করিস না। ভালো লাগছে তো তোর? কোথাও ব্যথা হচ্ছে?’
আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাইলো না। মা আমাকে ধরে পানি খাইয়ে দিলেন। গলা ভিজিয়ে আমি দুর্বল কন্ঠে বললাম, ‘পায়ের রগে টান ধরেছে, ব্যথা হচ্ছে।’
‘তেল মালিশ করে দেব রে নুহা?’
‘লাগবে না। একটু পর ঠিক হয়ে যাবে।’
মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এর মধ্যে রিনি আপু, বাবাও এলো। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে কেউ-ই কিছু বললো না৷ কেন নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম সে বিষয়ে একটা প্রশ্নও করলো না। অথচ আমি লজ্জায় কারোর দিকে তাকাচ্ছিও না। সবাই চুপ করে যে যার মতো আছে। এরকম পরিস্থিতিতে আমি অস্বস্তিবোধ করছিলাম। তাই মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা আমরা কী বাসায়?’
মা মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুম।’
‘কখন এলে?’
প্রশ্নটা করতেই বাবা এসে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই আমার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। সাথে সাথে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। আমার বাবা চিরকালই আমার বড় বাধ্য, কোমল মনের ও শান্তশিষ্ট। তিনি কখনোই আমার গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, উঁচু গলায় কথাও বলেননি। অথচ বাবা এখন রাগে কাঁপছেন। নিজের করা মস্ত বড় ভুলটা আমি তখনই বুঝতে পারলাম। ওই তৌহিদ ঠকবাজটার জন্য আমি নিজেকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, আমার জন্মদাতা পিতা-মাতা’কে কষ্ট দিয়ে? সিরিয়াসলি আমি এটা করেছি? ওদের একুশ বছরের ভালোবাসার চেয়ে চার বছরের মিথ্যে প্রেম আমার কাছে এতটাই দামি হয়ে গেলো? ছিঃ, নুহা! নিজের প্রতিই তখন আমার প্রচন্ডরকম বিতৃষ্ণা এসে যোগ হলো।
চলবে…
[নোট: কল্পনা আর বাস্তবের কিছুটা সংমিশ্রণে লেখা। ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং মন্তব্য জানাবেন।]