#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: সপ্তম
# Tuhina pakira
৭.
-” ঐরকম করে না পিয়াল, একটু খেয়ে দেখ ভালো লাগবে।”
-” না, আমি এই সব সুপ টুপ খাবো না। প্লিজ সরাও এটা।”
পিয়াল এক হাত বাড়িয়ে অভির হাতের বাটিটা দূরে সরানোর চেষ্টা করলো। পিয়ালের পক্ষে কোনো মতেই এই সব খাওয়া পসিবেল না। কী এক জিনিস। পনেরো মিনিট ধরে অভি পিয়ালকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পিয়াল কিছুতেই তা মুখে নিচ্ছে না।
-” বোন আমার ওইরকম করে না, এটা খেয়ে নে। পড়ে তোকে তোর পছন্দের খাবার খাওয়াবো ঠিক আছে। ”
-” না আমি খাবো না বলছি তো। ”
সাম্য এতক্ষণ ঘরের কোণের দিকের একটা সোফায় বসে দুই ভাই বোনকে পর্যবেক্ষণ করছিল। পিয়াল যে খাবে না তা সে ভালই বুঝেছে। তাই সে পিয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পিয়ালের সঙ্গে চোখে চোখ পড়তেই পিয়াল চোখ সরিয়ে নিলো।
-” অভি দা আমাকে দাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
অভি সুপের বাটিটা সাম্যকে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এক চামচ সুপ নিয়ে সাম্য যেই পিয়ালের মুখের সামনে ধরলো, সঙ্গে সঙ্গে পিয়াল মুখ ফিরিয়ে নিলো। সাম্য শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, ” পিয়াল অনেক হয়েছে, এবার তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। নাও হাঁ করো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
সাম্যের কথায় পিয়াল ভয় পেলো কিনা কে জানে। কিন্তু সাম্যের হাতে পিয়াল খেলো না, সাম্যের হাত থেকে সুপের বাটিটা টান দিয়ে নিজের কাছে এনে ফেলে দিতে গেলো। কিন্তু পারলো না, তার আগেই সাম্য ওর হাতটা টেনে ধরলো।
-” খাবার টা ফেলবে না পিয়াল। ঈশ্বর কে ধন্যবাদ দাও যে, তুমি এই খাবারটা অন্তত পেয়েছ। কতো মানুষ সামান্য নুন ভাত জোগাড় করতে পারে না। আর আমরা প্রতিদিন কতো খাবার নষ্ট করে চলেছি। ”
পিয়াল আর কিছু করলো না। মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। সাম্য কিছুক্ষণ চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে আবারও পিয়ালের মুখের সামনে খাবার ধরলো। পিয়াল মাথা তুলে একবার সাম্য কে দেখে সুপের বাটিতে চুমুক দিয়ে পুরো খাবারটা শেষ করলো। কিন্তু একবারে খাওয়ায় গলায় ঝাঁজ লেগে পিয়াল কেশে উঠলো। সাম্য জলের গ্লাসটা টেবিল থেকে নিয়ে পিয়ালের সামনে ধরলো।
-” আমি এতটাও খারাপ না পিয়াল। পরিস্থিতির কাছে বাঁধা পড়েছিলাম আমি। ”
সাম্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিয়াল মলিন মুখে সাম্যের যাবার দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে ফেললো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল।
¶¶¶
-” এই কে আছো, আমাকে এক কাপ কফি দিয়ে যাও।”
শায়ন মৈত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে কাজের মেয়েটা কে বললো, -” মেনি আজ থেকে তোর ছুটি, তুই বাড়ি চলে যা। আর এই নে কিছু টাকা।”
মেনি শায়নের হাত থেকে টাকা কটা নিয়ে অবাক চোখে একবার শায়নকে দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
-” এই তুমি কি করলে এটা? ওকে ছাড়িয়ে দিলে কেনো? কে আমাকে কফি করে দেবে? তুমি!”
শায়ন এতক্ষণ সোফায় বসে পেপার পড়ছিল। মৈত্রীর তীক্ষ্ম গলার আওয়াজ শুনে উঠে দাঁড়ালো। মৈত্রীর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে গেল। মৈত্রী ও ভয় পেয়ে পিছিতে পিছতে একসময় পিছনে সোফায় ধাক্কা খেয়ে একেবারে নীচে পড়ে গেল। কোমরে লাগায় কপাল কুঁচকে কেঁদে উঠলো। বেশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ও কাঁদছে, কিন্তু শায়নের কাছে এই কান্নাটা কেমন যেন ন্যাকামি মনে হচ্ছে। তাই বেশ চিৎকার করেই একটানে মৈত্রী কে নীচ থেকে তুলে বললো,
-” একদম আমার সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলবে না তুমি। এটা আমার বাড়ি, তোমার বাবা এটা তৈরি করে দিয়ে যায়নি। কাজেই গলা নামিয়ে কথা বলো। ”
-” শায়ন তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো। আমার বাবা তোমার যে কী হাল করবে তুমি তা জানো না!”
-” ওহঃ, জানু ওইভাবে বলো না। কেউ শুনলে তোমার উপর হাসবে। ”
-” শায়ন, তুমি কিন্তু, ”
মৈত্রী কে আর কিছু বলতে না দিয়ে শায়ন ওর হাত শক্ত করে ধরে বললো, ” তোমার বাবা তো বলেই দিয়েছে, নিজের প্রাণ প্রিয় মেয়েকে তিনি তার চোখের সামনে দেখতে চায় না। তার উপর তোমার সব আত্মীয়রাও তো তোমার কীর্তিকলাপ এর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আমি যদি তোমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিই, কেউ তোমাকে জায়গা দেবে না। তাই আমার সঙ্গে যখন কথা বলবে সম্মান দিয়ে গলা নামিয়ে কথা বলবে। কথাটা যেনো মনে থাকে।”
মৈত্রীর চোখ ছলছল করে উঠলো। সেই দিন তার বাবা ওর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সম্মান অর্জন করতে মানুষের অর্ধেক জীবন চলে যায়। কিন্তু শেষ করতে কয়েক মিনিট ও লাগে না। মৈত্রীর বাবার সম্মান তার মেয়ে কতো ইজিলি শেষ করে দিল।
-” কী হলো মনে থাকবে?”
শায়নের ধমকে রীতিমতো কেঁপে উঠল মৈত্রী, ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে বললো, ” মনে থাকবে।”
শায়ন আর কিছু না বলে ঘরে চলে গেল। মৈত্রী নিজের চোখের জলটা মুছে ফেললো। এই জলটা মিথ্যে না। ওর বাবার জন্যে খুব মন খারাপ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শায়ন ওর কয়েকটা জামা এনে মৈত্রীর দিকে ছুঁড়ে মারলো।
-” এই কয় দিন তোমাকে কিছু বলিনি, কারণ আমার মনে হয়েছিল তোমাকে একটা সুযোগ দিই। কিন্তু না তুমি তো শোধরানোর মেয়ে না। তাই আজ থেকে বাড়ির বউয়ের সব কাজ তুমি করবে। ”
শায়নের কথায় যেনো আঁতকে উঠল মৈত্রী। বাবার আদরের দুলালী কিনা কাজ করবে। কখনো একগ্লাস জল গড়িয়ে খেয়েছে কিনা তাই সন্দেহ।
-” আমি পারবো না।”
-” কী পারবে না, পারতেই হবে। যাও এই জামাগুলো সাবান জলে ভিজিয়ে আগে আমাকে এক কাপ চা দেবে, তারপর সকালের জল খাবার তৈরি করো। তারপর সব বাসন মাজবে। যদিও বা মেনি সকালের বাসন কটা মেজে দিয়ে গেছে। তারপর কাপড় কেঁচে দুপুরের রান্না করবে। তারপর,”
শায়নের কাজের লিস্ট শুনে মৈত্রী হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
-” আর কিছু!”
-” আপাতত এইটুকু, বাকিটা পরে বলবো। যাও তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়ো। ”
-” হ্যাঁ।”
মৈত্রী রান্নাঘরে চলে গেল। পিছন থেকে শায়ন চেঁচিয়ে বলল , ” আর মনে করে ঘর পরিষ্কার করে মুছে দেবে আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ”
—————
মৈত্রী কোনমতে এক কাপ চা করে শায়নের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
-” এই যে তোমার চা।”
-” বাবা, এতো তাড়াতাড়ি। আচ্ছা দাও।”
শায়ন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে চায়ের স্বাদ অনুভব করে বললো, ” খুব ভালো হয়েছে। ”
মৈত্রীর কেনো যেনো কথাটা খুব ভালো লাগলো। বেশিক্ষণ শায়নের পাশে দাঁড়ালো না আবার রান্নাঘরে চলে গেল। বেশ লজ্জা লাগছে ওর। শুধু কি নিজের স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে এইরকম আনন্দ হচ্ছে, হয়তো!
মৈত্রী এবার নিজের জন্যে রাখা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তা থু থু করে ফেলে দিল। ওর আগেই ভাবা উচিত ছিল, ওর দাঁড়া এই সব রান্না হবে না।
-” এই তুমি মিথ্যে বললে কেনো? ”
শায়ন অদ্ভুত ভাবে মৈত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-” আমি আবার কি মিথ্যে বললাম?”
-” এই যে চা খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু এ তো তেতো।”
-” কোথায়, আমার তো ভালোই লেগেছে। আমার বউ প্রথম কিছু করে খাইয়েছে বলে কথা। আর এমনিতে আমার তেতো খাবার ভালোই লাগে। ”
শায়ন আর কিছু বললো না, নিজের রুমে চলে গেল। এই মেয়েটাকে ও খুব ভালোবাসে, আগেও বাসতো। আর এখনও ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটা বোঝে না। কিন্তু সম্পর্কের শুরুতে মেয়েটা ওর কতো কেয়ার করতো।
শায়নের যাবার দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো মৈত্রী। তারপর শায়নকে দেওয়া কাপটা হাতে তুলে নিলো। একদিন ও সাম্য কে এক কাপ চা দিয়েছিল, কিন্তু সাম্য তো তা ছুঁয়েও দেখেনি। চলে গিয়েছিল সেখান থেকে।
——-
সন্ধ্যে ৭ টা।
বিকেলের দিকে মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল পিয়াল। ঘুম ভাঙতেই দেখলো ওর পাশে সাম্য শুয়ে আছে, খানিকটা দূরত্বে। পাছে পিয়ালের মাথায় চোট লেগে যায়। পিয়াল আস্তে আস্তে উঠে বসলো। সাম্য বেশ শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। বেচারা অনেকদিন ঠিক মতো ঘুমাতে পারে নি। পিয়াল আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামতে যেতেই কিছুতে বাঁধা পেলো। পিছন ফিরে নিজের আঁচল বরাবর দেখলো, সাম্য ওর আঁচলের কোনাটা ওর হাতের আঙুলে আংটির মতো করে বেঁধে রেখেছে। না চাইতেই পিয়ালের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
পিয়াল আস্তে করে সাম্যের হাত থেকে নিজের আঁচলটা খুলে সাম্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
-” পাগল টা। ”
-” ওই আমাকে পাগল বলবে না। ”
বিরবির করে কথাটা বলেই সাম্য ঘুরে আবারও ঘুমিয়ে গেল। সাম্যের কাছে থাকায় পিয়াল পুরো কথাটাই শুনলো সাম্যের। এই ছেলের নিজেকে কেউ পাগল বললে হুট করে রেগে যায়। ওর মতে, নিজের মানুষের জন্যে কিছু করলে সে কখনোই পাগল হয় না। আর ও তো নাই। ওর মতে প্রিয়কে হারিয়ে পাগল ও হতেই পারবে না। পাগল প্রেমী ও হতে পারবে না। কিন্তু সারাজীবন প্রিয়কে নিজের বাঁধনে বেঁধে রাখবে। যাতে দিন শেষে #ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে কাউকেই কষ্ট পেতে না হয়।
বাইরে কেমন সব শান্ত। ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ। পিয়াল আস্তে আস্তে ঘরে চলে গেল। এতক্ষণ ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যেটা উপভোগ করছিল। সাম্য এখনও ঘুমিয়ে রয়েছে, আজ আবার অভিও বাড়িতে নেই। আজ ফিরবে বলে পিয়ালের মনে হয় না।
পিয়াল খুব আস্তে করে ঘরের দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। মুডটা ওর এখন বেশ ফ্রেশ, কিছু একটা করতে হবে। হঠাৎই ওর মাথায় এলো রান্নার কথা।
যেমন ভাবা ও রান্নাঘরে গিয়ে পিয়াজ , বিনস কাটতে লাগলো, চাউমিন বানাবে। চটজলদি চাওমিন বানিয়ে পিয়াল ওর মাথার কাছের কাবার্ডটা খুললো, ওখান থেকে টমেটো সস বের করে যেই ঘুরলো, সঙ্গে সঙ্গে মাথায় তীব্র বেদনা অনুভূত হলো। কাবার্ড এর কোণাটা বেশ জোরেই পিয়ালের কপালের পূর্ব আঘাতের উপর গিয়েই লেগেছে। পিয়াল দু হাতে কপালটা চেপে ধরলো। আস্তে আস্তে ওর হাত রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো।
( চলবে)
{বিঃ : ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।। }