কল্পকুঞ্জে কঙ্কাবতী পর্ব -৩১

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩১|

পৌষের হিমশীতল বাতাসে একটু পর পর কাঁপুনি উঠে যাচ্ছে। চারপাশটা খুব নির্জন, কেমন যেন মন মাতওয়ারা সুর কানে ভেসে আসছে। চুপি চুপি কে যেন বলে উঠছে, “নবনী! তুই দুঃখী নোস। তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সেরা সৌভাগ্যবতী মেয়ে। কেননা তোর কুঞ্জ ভাই আছে।”

আমি ডানে তাকিয়ে অপলকভাবে ওঁকে দেখলাম। গভীর মনোযোগে ফোনে কিছু একটা করছেন। লক্ষ করলাম– ওঁর চুলগুলো আগের চেয়ে বেশ বড়ো হয়েছে। সামনের চুলগুলো নাক ছুঁয়েছে, বাতাসে মাঝে মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে। উনি হাতের আঙ্গুলগুলো দ্বারা চুলগুলো বারেবারে পিছে ঠেলে দিচ্ছেন। তবুও অবাধ্য চুলগুলো ভারি দুষ্টুমি করছে, খেলছে, নাচছে।

হঠাৎ উনি আমার দিকে তাকালেন। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে ভ্রু-যুগল উঁচু করে বোঝালেন, “কী?”

আমি দু-ধারে মাথা নেড়ে বললাম, “কিছু না।”

উনি এবার ফোন রাখলেন। তারপর, সম্পূর্ণ ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিছুই না?”

আমি কিঞ্চিত আওয়াজে বললাম, “উঁহু।”

“কেন?”

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী– কেন?”

ওঁর সাবলীল জবাব, “কিছু না– কেন? কিছু হওয়া উচিত ছিল।”

“কী হবে?”

“কত কিছু হওয়ার আছে। এই ধরো, প্রেম হওয়ার আছে।”

মিহি হেসে বললাম, “হতে এখনও বাদ আছে?”

“তা অবশ্য ঠিক। তবে ‘কিছু না’– বললে কেন?”

“ও এমনিই বলেছি।”

“আচ্ছা, বুঝলাম।”

“শুনুন।”

“হুম, বলো।”

“কাল সকালে, ভার্সিটিতে ওমন করলেন কেন?”

“কেমন?”

“ওই যে, দেখেও না দেখার ভান করলেন!”

“ওখানে অনেক সো-কল্ড ভালো মানুষ আছে তো, তাই। তোমার সাথে পরিচয় করাতে চাচ্ছিলাম না।”

মুখে ভেঙচি কেটে বললাম, “করালে বুঝি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত!”

উনি তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন, “আজ্ঞে, হ্যাঁ। হতো।”

“হুহ! সে আমি বুঝি না– ভেবেছেন?”

“আন্ডা বোঝো তুমি।”

“কুঞ্জ ভাই, আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন কিন্তু!”

“এ-মা! তাই?”

“উহ! ভারি জ্বালাচ্ছেন তো!”

“তোকে জ্বালাতে বেশ লাগে, নবু!”

আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাতেই উনি সশব্দে হেসে উঠলেন। নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে তা বিরাট আওয়াজ তুলছে। আমি কিছুক্ষণ পর আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, উনি ঠোঁট কামড়ে হেসে যাচ্ছেন। মন বোধহয় সামান্য গলল বলে! আমি একেবারে মুড়লাম। একটু এগিয়ে পাশাপাশি বসলাম, বড্ড কাছাকাছি। কুঞ্জ ভাই আমার ডান পাশে। আমি ওঁর বা হাতটা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে হাসলাম। উনি ওঁর ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলটি দিয়ে আমার মুখের উপর পড়া চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলেন।
ঘড়িতে এখন আনুমানিক সাড়ে তিনটে বাজে। ঘুম পাচ্ছে বড্ড। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।

ওমনিই কুঞ্জ ভাই ডেকে উঠলেন, “নবনী!”

ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে জবাব দিলাম, “হুঁ?”

“পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটিও কারো না কারো ভালোবাসায় থমকে গিয়েছে। নবনী, শুনছিস?”

“হুঁ?”

“আমি অতটাও খারাপ নই, না?”

চিৎকার করে খুব বলতে ইচ্ছে হলো, “না, কুঞ্জ ভাই। আপনি একটুও খারাপ নন। আমার প্রিয় পুরুষ আপনি, খারাপ কী করে হতে পারেন?”

কিন্তু ঘুমের তীব্র রেশে কথা বলার মতো পরিশ্রমী কাজটি আপাতত করলাম না। গুঙিয়ে বললাম, “উঁহু…”

সেকেন্ড ক’টা যেতেই কুঞ্জ ভাই ডেকে উঠলেন, “নবু! এই নবু, ওঠ! ঘুমোস না।”

বড্ড কষ্টে চোখের পাতা খুলে বিরক্তিকর চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম। আমার এই চোখ দিয়ে একটা প্রশ্নই বেরোচ্ছে, “ব্যাটা, সমস্যা কী তোর?”

তবে তা যদি উনি শুনতে পেতেন, এখনই দু-চারটে চড়ে আমার গাল সিঁদুর লাল হয়ে যেত! বড্ড বাঁচা গেল। হঠাৎ হাতে হ্যাঁচকা টানে উঠে দাঁড়ালাম। কুঞ্জ ভাই দাঁড়িয়ে হুডির স্লিভ ঠিক করছেন। এরপর আমার হাত ধরে বললেন, “চল। ফিরতে হবে। অনেক রাত হয়েছে।”

আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আশপাশটা আবারও দেখে বললাম, “থেকে যাওয়া যায় না?”

উনি মুচকি হাসি হেসে বললেন, “না, ম্যাডাম! কাউকে বলে আসিনি। সকাল হলেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং এগোই।”

আমি কুঞ্জ ভাইয়ের সাথে এই জায়গা থেকে বেরোচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে শুধালাম, “কয়দিন থাকবেন?”

কুঞ্জ ভাই হাঁটা না থামিয়েই আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে বললেন, “আমি থাকব না। কিছু কাজ আছে। তোকে দিয়েই হলে ফিরব।”

তবুও জেদ ধরলাম, “একদিন থাকুন না, কুঞ্জ ভাই!”

কুঞ্জ ভাই শুনলেন না। বললেন, “কাল রাতে আসব, ঠিকাছে?”

“সত্যি তো?”

“হ্যাঁ রে, বাবা! সত্যি।”

আমি এবার খানিকটা শান্ত হলাম। মাঝে হুট করে হাতে চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো। উফ! পেইন কিলার তো নিচ্ছিই, তবুও কেন ব্যথা হবে? ভাই ব্যথা, জলদি সেরে যাস না কেন? আমার ঝামেলা হয় রে! বুঝিস না? মে-বি ওরা সত্যিই বোঝে না।

“নবনী!”

আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, “হুঁ!”

হুট করেই উনি আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। চাঁদের ঝলমলে আলোয় ওঁকে দারুণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। উনি ঝুঁকে আমার পায়ের কাছে এলেন। তড়িঘড়ি করে পিছিয়ে যাওয়ার আগেই ধরে ফেললেন। শানিত কণ্ঠে বললেন, “রাত্রিপ্রিয়া, রাতকে সাক্ষী করেই তোমায় নিজের প্রিয়া হিসেবে চাইছি। পাব কি?”

এটা কি কোনো প্রপোজাল ছিল? বুঝে ওঠার আগেই পায়ে হালকা কিছু অনুভব করলাম। ততক্ষণে কুঞ্জ ভাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি স্কার্টটি উঁচু করলেই দেখতে পেলাম, পায়ে একজোড়া নূপুর!

ঠোঁটে দারুণ কিছু পেয়ে যাওয়ার খুশি নিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখে হাসছেন…

________
বাইক এসে থেমেছে বাড়ির কাছে। ঘণ্টাখানেক বাদেই আজান দেবে। আমি নামতেই, কুঞ্জ ভাই নেমে হেলমেটটা খুলে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন।
দুজনের ঠোঁটেই বিশ্বজয়ের হাসি। উনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। বলে উঠলেন, “দুষ্টুমি করবি না।”

আমি হেসে বললাম, “করব না।”

“এদিক-ওদিক যাবি না।”

“যাব না।”

“পড়াশোনা করবি ঠিকঠাক।”

“করব।”

“মনে পড়লে পরপর মিনিট খানেকের গ্যাপ রেখে দুটো মিসড কল দিবি। কেবল মাত্র সিরিয়াস কিছু হলে, মিনিট গ্যাপ রেখে পরপর তিনটি কল দিবি। মনে থাকবে?”

“থাকবে। কিন্তু, তা কেন?”

“কারণ, আমি ইদানীং ব্যস্ত থাকব। চাই না, তোর ব্যাপারে বাকিরা জানুক।”

“কেন? অরুণ ভাইয়া, আর বাকিরাও জানে।”

“ওরা কেবল আমার টিমের লোক না, আমার কলেজ ফ্রেন্ডও। আগে থেকেই তোকে চেনে।”

“ওও…”

“হুম, শোন।”

“বলুন।”

উনি বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবে কিছু বললেন না। আমি তাগিদ দিয়ে বললাম, “কী হলো, বলুন?”

উনি মাথা নেড়ে বলল, “না, কিছু না।”

বুঝলাম! অবুঝ নই আমি। তবুও বলতে জোর করলাম না। যা করবেন, ভেবে চিন্তেই করবেন। কতক্ষণ উনি আমায় দেখে বললেন, “যা। ভেতরে যা।”

আমি এগিয়ে গেলাম ভেতরের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। দো’তলায় উঠতেই মনে হলো, ঠিকমতো বিদায় নেওয়া হয়নি। আমি তাই দৌড়িয়ে নিচে নামলাম। উনি এখনও ওখানেই আছেন। বাইকে হেলান দিয়ে, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলেন। আমায় বোধহয় দেখেননি। সিগারেট জ্বালানোর আগেই আমি ওঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমায় দেখেই তা অতিব্যস্ত হয়ে পকেটে পুরলেন। হাসলাম আমি। মুখোমুখি দাঁড়াতেই ওঁকে চমকে দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। মিনিট পাঁচেকের আলিঙ্গন, সাথে শরীর জারিয়ে দেওয়া বাতাস, মাতাল করা অদ্ভুত সেই পুরুষালি ঘ্রাণ, তীব্রাকাঙ্ক্ষা, প্রিয়তমকে দেখার অসুখ– সব মিলিয়ে সুখের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে শুধালাম, “আমায় বিয়ে করবেন কবে?”

চলবে…

(বেশি ছোটো হলো কি? দুঃখিত আমি! গল্পের রিচ কম। সবাই রেসপন্স করবেন। আর হ্যাঁ! ভালোবাসা❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here