#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩৭|
“এরপর তোর মামা একদিন হুট করেই, আবারও আমার বাসায় চলে আসেন। ভারি অবাক হই এবার। পার্টি অফিস থেকে বাসায় ফিরেই এরকম কিছুর মুখোমুখি হব, ভেবে পাইনি।”
“তারপর?”
“তারপর তোর মামা আমাকে বলেন, ‘নিজের লাইফের গ্যারান্টি দিতে পারবে?’
আমি বললাম, পারব না। আল্লাহ যেভাবে মৃত্যু লিখেছেন, সেভাবেই হবে। সেটা আমার পলিটিক্সে থাকলেও, কিংবা বাসায় বসে রান্না করলেও।
তারপর উনি চুপ করে ছিলেন অনেকক্ষণ। আমি উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম।
এরপর বললেন, বাড়ি ফিরতে।
আমি শুধালাম, ‘এতে আমার লাভ?’
উনি জানালেন, ‘বিয়ে-শাদি করার ইচ্ছা নাই?’
ট্রাস্ট মি, এই কথার জন্য রেডি ছিলাম না। উনি আবারও বললেন, তুই নাকি বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছিস। আরও কত কী! আমি যেন জলদি আসি। এরপর ইচ্ছে হলে তার বাসায় থাকব, না হলে নিজের বাসায় থাকব।”
“আপনাকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছি আমি?”
“তা নয়তো কী?”
আমি পরপর ক’টা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলাম। এরপর হাতের আঙুল তুলে বললাম, “দেখুন, কুঞ্জ ভাই…”
“কী দেখাবি? জলদি দেখা। অত সময় নেই আমার। একটু কাজ আছে।”
আমি আঙুলসহ নিজে আরও কিছুটা সামনে এগোলাম। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বললাম, “আপনি!”
“হ্যাঁ, আমি?”
“আপনি একটা বদ লোক।”
“হ্যাঁ, সেটা জানি। তারপর?”
আমার রাগ হৈহৈ করে বাড়ল। বেড়ে তুঙ্গে চড়ল। এত বিরক্তিকর মানুষ আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। হাত শক্ত করে তার মাথার চুল টেনে ধরার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গিয়েও, ফিরিয়ে আনলাম। নেহাতই প্রেমিক ক্যাটাগরির মানুষ। নয়তো কবে যে খুন হয়ে যেতেন। আড়চোখে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি হাসলেন। আজিব! হাসির কী আছে।
হঠাৎ উনি হাসি থামালেন। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন,
“তাকাস কেন? আঁকাস কেন?
আমার বুকে আকাশ!
তুই তাকালে, থমকে থাকে—
আমার বুকের বাঁ পাশ..”
রাগী চেহারায় মুচকি হাসির ভাব চলে এলো। বুকে হাত গুঁজে বললাম, “অন্যের কবিতার কপি হচ্ছে?”
উনিও ঝুঁকে মাথা চুলকাতে চুলকাতে হাসলেন। ওভাবেই নতমুখী দৃষ্টি উঁচুতে তুলে বললেন,
“মনোহারিত্ব বলি তারে, যে অক্ষি-অনলে মরণ ঘনায়।
চিত্ত বলি তারে, যে থেকেও থাকে অন্য অন্তরায়।
প্রিয়া বলি তারে, যে ডাকলে লাগে— ‘সুখ বুলায়’।
প্রেম বলি তারে, যে গোপনেতে ‘প্রেম’ শুধায়।”
মুচকি হাসি অধরে লেপ্টে গেল। ভ্রু উঁচিয়ে হাসি-সহ জিজ্ঞেস করলাম, “এসবও জানেন?”
উনি কেবল হাসলেন। আমি কোমরে দুই হাত গুঁজে বললাম, “ফ্লার্টিং লেভেল তো হাই।”
কুঞ্জ ভাই চোখ মেরে বললেন, “ওনলি ফর ইউ, বেইব।”
আহ্লাদে আটখানা হয়ে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওঁর বুকের দিকটায়। কুঞ্জ ভাই খানিকটা সরে গিয়ে বললেন, “ওহ নো! কী করতে যাচ্ছিলি?”
আমি হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমুঢ়! আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি আবারও বললেন, “ছি! নবু, ছি! শ্যেইম অন ইউ। এভাবে একটা নিরিহ ছেলের লজ্জাহরণ করতে, তোর লজ্জা লাগে না?”
আমি কথাটি শুনেই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। এই লোকটা এত্ত খারাপ কেন? আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি এগিয়ে এলেন জড়িয়ে ধরতে। আমি উলটো ঘুরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। এবার ব্যাটা কুঞ্জ আমাকে ছাঁই দিয়েও ধরতে পারবে না।
মুচকি হেসে মণিকে বলে বাসায় চলে এলাম। আজ আমার খুশির সীমা নেই। জানি না, ভাগ্যে কী আছে। তবে, আমার একমাত্র চাওয়া কেবল উনি-ই। যাকে ভালোবাসি, তাকে সবটা দিয়েই ভালোবাসতে জানি আমি। তাকে অভিমানে দূরে ঠেলতেও জানি, আবার জীবন ভরের জন্য নিজের করে নিতেও জানি।
_______
রাতে আমি নিজের বাসাতেই রইলাম। ভুল করেও বের হইনি। কুঞ্জ ভাইয়ের কল/ম্যাসেজের জ্বালায় ফোনটাও সুইচ অফ করে রেখেছিলাম। এই অভিমান মিটতে মিটতে লেগে গেল দু’দিন। পরদিন আপিও চলে এলো আসিফ ভাইয়ার সাথে। মাসখানেকের মাঝে গ্রাম থেকে শ্যামা দিদি, নীতি, সুপ্তি, দিয়া, আকাশ ভাইয়া, তৃপ্তি আপু চলে এসেছে। ক’মাস আগেই আকাশ ভাই এক সাহসী কাজ করে ফেলেছে। তৃপ্তি আপুর বাড়িতে বিয়ে ঠিক করায়, আপুকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলে। এরপর বাড়ি নিয়ে আসে। কুঞ্জ ভাইয়ের রেফারেন্সে, কেউ কিচ্ছুটি বলেনি।
বাড়ি ভর্তি মেহমান। শুক্রবার আকদ হবে। সব মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে! প্রচুর খরচ করবে। দামী জুয়েলারি-ল্যাহেঙ্গা পরবে। বিয়েতে আসবে হাজার হাজার মানুষ। অথচ আমার স্বপ্ন অন্যরকম। ইচ্ছে ছিল, খুব কম মানুষ নিয়ে বিয়েটা হবে, ঘরোয়াভাবে। বাবার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও আমি চাইনি, বিয়ে নিয়ে এত খরচ হোক। আমার ইচ্ছেকে কুঞ্জ ভাই সম্মান জানালেন। তবে আপত্তি করে বসলেন মামা। তাঁর মতে, বিয়ে একবারই হবে। তাই আমার কথাও রেখে, সামান্য আয়োজনের ব্যবস্থা করলেন। আজ হলুদ ছিল আমার। রাত পোহালেই বিয়ে। কাজিনদের নিয়ে ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছি।
দিদি হাসতে হাসতে বলল, “আল্লাহ! এই নবুর সাথে ফাইনালি কুঞ্জর বিয়ে হচ্ছে! আমি ভেবেছিলাম, আজীবন সিঙ্গেল থাকবে দুইটাই। কী নাটক জুড়ে বসে, বাপ্ রে!”
আপিও বলল, “হ্যাঁ। ওদের কাহিনি কিছুই বুঝে আসত না আমার। কীভাবে কীভাবে সবটা হচ্ছে!”
রাহী আমার কাঁধে মাথা রেখে হাতটা জড়িয়ে বসে আছে। আজই ফিরেছে। ফেরার পর থেকেই এভাবে বসে আছে। ছাড়ার নামই নিচ্ছে না। এক ফাঁকে অবশ্য বলেছে, “নবু! আমার না বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
এদিকে নৌশিও এসেছে। আসার পর থেকে বিভিন্ন কাজে হাত লাগিয়ে চলেছে। এক বিন্দু বসার অবসর পায়নি। আমি হাসলাম। তবুও মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। প্রচুর প্রচুর বেশি মিস করছি একজনকে। মেডিকেলে আমার ফ্রেন্ড হয়েছে। তবে স্কুল-কলেজের ফ্রেন্ডদের মতো ফ্রেন্ডশিপ না।
ইশ! যদি আমার চিতি থাকতো! কী করত ও! চিত্রা বেশ ভালো মেহেদি দিতে পারে। ওর ইচ্ছেও ছিল, আমার হাতে মেহেদী দিয়ে দেওয়া। কিন্তু হলোই না! আমার বিয়ে নিয়ে ওর কত্ত প্ল্যানিং ছিল! সব কয়টা সেই ক্লাস টেন থেকেই নাচ তুলে রেখেছিল, আমার বিয়েতে নাচবে বলে।
চিত্রা বলত, “নবু রে! তুই বউ সাজবি। তোকে পুরাই পেত্নী লাগবে, জান। তুই এক কাজ কর। তোর বিয়ের শাড়ি আমাকে দিস, তুই বরং একটা সিম্পল কিছু পড়িস। তারপর তোর বাসর ঘরে, দুলুকে চমকে দেব। নৌশি আর রাহী খাটের নিচে থাকবে। এরপর.. উফফ! ভাবতেই এক্সাইটেড লাগছে। নবু, রে! বিয়ে করে ফেল জলদি।”
আজ বিয়ে তো হচ্ছে, কিন্তু পাশে ও নেই। মাথা নিচু করে বসে এসবই ভাবছি। হুট করে পরিবেশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই খানিকক্ষণ আগেও যেরকম ননস্টপ বকবকিয়ে যাচ্ছিল, তার রেশ মাত্র নেই। নিস্তব্ধতায় কেবল মেয়েদের চুড়ি-ঝুমকোর আওয়াজ আসছে। চোখে তুলে দেখলাম আলোটাও নেভানো। অন্য খেয়ালে থাকার কারণে কখন আলো নিভে গিয়েছে, তা আর খেয়াল করিনি।
কোত্থেকে যেন একটা স্পটলাইট এসে পড়ল ঠিক ছাদের মাঝ বরাবর। শুভ্র গায়ে কালো পাঞ্জাবি পরিহিত কুঞ্জ ভাই। স্লিভস কনুই অবধি ফোল্ড করা। বাঁ হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ। আর ডান হাতে মাইক। বাতাসে এলোমেলো হওয়া চুলগুলো বাঁ হাত দিয়ে পিছে ঠেলে অযথা গুছিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি হা হয়ে গিলছি। ইশ! বলির পাঠাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! মুখ ফুঁটে উচ্চারণও করে ফেললাম, “উফ! উফ! কী গরম!”
কোত্থেকে যেন এসে নৌশি ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে বলল, “নষ্ট মস্তিষ্কের মহিলা! তোরই জামাই হবে রে, ভাই।”
আমি নৌশির দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি দিয়ে আবারও কুঞ্জ ভাইকে দেখতে লাগলাম। উনি আমার এরূপ বিহেভিয়ার দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। তারপর বলা শুরু করলেন,
“কখনও একটা বাচ্চা মেয়ের প্রতি অনুভূতি জন্মাতে দেখেছ কেউ? লজ্জার বিষয়! আমিও নিজের অনুভূতি টের পেয়ে লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিলাম। এই অনুভূতিকে সঙ্গায়িত করতে চাইছিলাম না। কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলতে চাইছিলাম না। তাই নিজ মনকে সান্ত্বনার সুরে বললাম, একটা মোহ কেবল। একসাথে থাকলে তো পোষা বেড়ালটার উপরও মায়া জন্মে যায়। সেখানে সে জলজ্যান্ত রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ! তাকে যত এড়িয়ে যেতে চাইতাম, সে ততই আমার দিকে চলে আসত। এরপর আমি সবটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিরপেক্ষ থাকি। দিন গড়ায়, মাস গড়ায়, বছর গড়ায়, বড়ো হয় আমার পিচ্চিটা। বাচ্চা স্বরে ডাকা ‘কুনজো বাইয়া’ থেকে সে মিষ্টিমুখে ‘কুঞ্জ ভাই’ ডাকা শিখে যায়। আমার মন ভালো রাখার একমাত্র রিজন হয়ে যায়। অদ্ভুত! আমি তো এগোতে চাইনি। কী করে এভাবে মিশে গেলাম— ডোন্ট নো! এরপর আর তার চেয়ে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও পারলাম না। এক মুহূর্ত না দেখলে অস্থির লাগত। বড্ড ফিল্মি শোনাচ্ছে? হয়তো হ্যাঁ। কিন্তু, এটাই সত্যি। আমি তখনও সবটা অস্বীকার করে গেলাম। এরপর পিচ্চির পরিবর্তন লক্ষ করি। সে আর আগের মতো রয় না। পালটে যায়। আমার কাছে আসার আগে নিজেকে সম্পূর্ণ পরিপাটি রাখার চেষ্টা করে। লজ্জা পায়। অভিমানে নাক ফুলায়। রজনীর কাছে ওর উদাসীনতা সম্পর্কে জানতে চাইলে, সে ওর ডায়েরি এনে দেয়। সেখানে আমাকে নিয়ে হাজার কাব্য! বুঝলাম! পিচ্চি মজেছে আমার প্রেমে। কিন্তু আমি তা চাইনি। সারটাক্ষণ আমার কল্পনায় বিভোর হয়ে থাকত। তাকে আর পিচ্চি বলে ডাকতে পারলাম না। গতদিন ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসটা পড়ছিলাম। ফট করে ওকে ডেকে ফেলি, কঙ্কা! আমার কঙ্কা! ওকে পড়াশোনায় মনোযোগী করার চেষ্টা করি। যেখানে অসুখ আমি নিজেই, সেখানে ওষুধ কী করে আমি হব? ভেবে পেলাম, আমিই ওর এই অসুখের একমাত্র মেডিসিন। আমি রোজ নিয়ম করে পড়িয়ে যাই, পড়ার বাহানায় ওকে দুচোখ ভরে দেখে যাই। এভাবেই দিন এগোয়। নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হই। এরপর সম্পর্কের পরিণতির কথা চিন্তা করি। বাবা নিশ্চয়ই অমত করবে না। এরপর আমার রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়ায়, বাবা বিরিয়ানিতে এলাচ হয়ে যায়। এরপর এত এত কাহিনির পর আজ এখানে। তো মিস কঙ্কা, ওয়ানা বি মাইন?”
আমি দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে চিল্লিয়ে বললাম, “এগুলা পাবলিক করার আছে? বলদামি কবে ছাড়বেন? বিয়ের পর কপালে শনি আছে কিন্তু বলে রাখলাম।”
আমার কান্না করতে করতে বলা কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। জীবন মেবি এখানটাতেই সুন্দর। ঠিক এই সময়টাতেই। ইশ! যদি সময় থমকে যেত! কিন্তু, আমাদের এখনও অনেকটা জানা-দেখা-বোঝা বাকি আছে।
চলবে…
পরবর্তী পর্ব সেহেরির আগে দেব। ❤️