#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮
আমেনা আহমেদ রান্নাঘরের জানালাটা দিয়ে অদূরে তাকিয়ে বলা শুরু করলো,
‘মিথিলা যখনই এই ঘরে প্রবেশ করেছিল তখন থেকেই এই ঘরটা পরিপূর্ণ পরিপূর্ণ মনে হতো। আমার একটা মেয়ের শখ ছিল কিন্তু সেটা পূর্ণ হয়নি। আমার ইচ্ছে ছিল এই ঘর আলোকিত করে একটা মেয়ে আসবে, যে হবে অনেক বেশি চঞ্চল। সে মেয়েটা তার চঞ্চলতায় পুরো ঘর মাতিয়ে তুলবে। সেই ইচ্ছেটা নিহানের বউ আসার পর পর পূর্ব হয়েছিল। মিথিলা আসার পর ঘরটা পূর্ণ পূর্ণ মনে হতো কিন্তু আমেনা আহমেদ মনে করেছিল মিথিলা আবারও তার পেশায় ফিরে যাবে। অবশ্য, তিনি রাজিও ছিলেন। তিনি মনে করেন, মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট খুটি থাকা উচিত। কিন্তু মিথিলা আমার ভাবনা থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে ছিল। বিয়ের পর পর সবসময় ঘরটাকে নিজের রঙের ছোঁয়াতে রাঙিয়ে তুলেছিল। মাত্র কয়েকদিনের ভেতর বাড়ির সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। বিয়ের আগেই ডাক্তারি পুরো কোর্স শেষ করেছিল। কথা ছিল বিয়ের পর নিহানের সাথে একসাথে মিলেই পেশায় নিয়োজিত হবে, নিহানের হাসপাতালেই কিন্তু মেয়েটা বিয়ের পর পর আর পেশাটাতে নিয়োজিত হয়নি। নিহানও কত্ত করে বলেছিল কিন্তু মিথিলার একটাই কথা,সে এতো সুন্দর একটা পরিবার পেয়েছে, পুরো দমে সেটাতেই সংসার করতে মনোযোগ দিবে। আমরাও এতো করে বললাম সে গেল না। অনেক লক্ষী একটা মেয়ে ছিল আমার।’ বলেই আমেনা আহমেদ মলিন চোখে জানালা দিয়ে অদূরে তাকিয়ে রইল।
আরোহীরও বড্ড মায়া হলো।
‘জানো? রুহান হবে যে তখন আমার ছেলে-মেয়ে দুইটার কী যে খুশি!’
‘ছেলে-মেয়ে বলতে!’ আরোহী সুধালো।
‘মিথিলা আর নিহানের কথা বলছি। মিথিলাকে আমি মেয়েই ডাকতাম। মেয়েটা এই সংসারে আসার পর থেকে আমার মেয়ের শখটা পূর্ণ হয়েছিল।’
‘মিথিলা আপু রুহানকে দেখেনি খালা তাই না!’
‘না রে। মেয়েটার সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো না। দেখে যেতে চেয়েছিল। হাসপাতালে রুহান হওয়ার পর বাচ্চাকে নিহানের কোলে দিতেই নিহান হাসিমুখে চুমু একে দিল। সে বাচ্চাটিকে নিয়েই বলেছিল,’আগে আমার মিথিকে দেখিয়ে আসি।’ কিন্তু ডাক্তাররা তখন এসে মিথিলার অবস্থা জানাতেই নিহান রুহানকে আমার কোলে দিয়ে থিয়েটারের সামনে দৌড়ে গিয়েছিল। ওই হাসপাতালে নিহান কর্মরত ছিল আর বেশ জনপ্রিয় তাই ডাক্তাররা অপারেশন থিয়েটারে নিহানকে ঢুকতে দিয়েছিল। নিহানের চোখের সামনেই মিথিলা আমার মেয়েটা চলে গেল। নিহান মেয়েটাকে তার থেকে একটা ফুটফুটে বাচ্চা হওয়ার খবর দিল ঠিকই কিন্তু মেয়েটা ততক্ষনে হারিয়ে গেল। নিহান নিজে ডাক্তার হয়েও সে বিশ্বাস করেনি যে মিথিলা হারিয়ে গিয়েছে। সে ভেবেছিল, মিথিলা বুঝি জ্ঞান হারিয়েছে হয়ত। সেদিন নিহানের কী যে পাগলামি! জীবনের সেই প্রথম আমার ছেলেটাকে এভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। এরপর প্রায় দুই মাস হয়ে যাওয়ার পরেও নিহান স্বাভাবিক হতে পারেনি। ধীরে ধীরে আস্তে আস্তে রুহানের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। সেই দিন গুলো মনে পড়লে এখনো খারাপ লাগে। আমার লক্ষী মেয়েটা হুট্ করে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল, এরপর থেকে এই বাসায় সবাই এমনি মুখের উপর হাসি আনতো শুধুমাত্র রুহানের জন্যই আর আমার ছেলেটা! একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল আর কোনোকিছুর বায়না ধরে না!গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। ছেলেটাকে কত করে বললাম যে আমাদের শেষ বয়স এসে যাচ্ছে একটা বিয়ে কর কিন্তু ছেলেটা কিছুই বলে না, চুপচাপ রুহানের দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে তোমাদের জন্য বিয়ে করলেও আমার ছেলে মা পাবে না।’বলতে বলতেই আমেনা আহমেদের চোখের কার্নিশ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
আমেনা আহমেদের কথা শুনে আরোহীরও চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আপুটার কপালে সুখ বুঝি বেশি সময়ের জন্য ধরা দেয়নি। খালার কথা শুনে বুঝলো, মেয়েটা টানা দুইবছর এক তরফা ভালোবেসে নিহান নামক মানুষটার পেছনে ঘুরঘুর করেছিল। যারও বিয়ের পর সব সুখ এসে ধরা দিল তখনই হুট্ করে চলে যেতে হলো! আহা জীবন!
আরোহীর হুট্ করে একটা ইচ্ছে হলো। সে ভাবলো, সেদিন মেয়েটার বদলে যদি তার জীবন চলে যেত! অন্তত আজকে একটা অনেক সুখের সংসার হতো। একটা প্রাণের বিনিময়ে যদি আরেকটা দিতে পারতো!
সেদিন সারাদিনটাই মাটি মাটি মনে হলো আরোহীর। কোনোকিছুতেই আর মন বসেনি। রুহানের সাথেও আর হেসে-খেলে কথা বলা হয়নি। রুহানকে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেই বাধ্য ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই ছেলেটাও হয়েছে একদম বুঝদার। হয়ত মা নেই, বাবা সবসময় কাছে থাকে না তাই নিজে থেকেই বুঝদার হয়ে উঠেছিল!
আরোহী জানালার কাছ থেকে এগিয়ে গিয়ে রুহানের পাশে বসলো। ঘুমন্ত ছেলেটার চেহারাতে কী যে মায়া! আরোহীর এই ছেলেটার জন্য ভীষণ মন পুড়ে। চাকরি নিয়ে এই বাসা থেকে চলে গেলে সবাই অনেক স্মরণে পড়বে। একটা অচেনা অজানা মেয়ের মুখের কথা বিশ্বাস করে এতদিন আপনের মতো রেখেছে সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ হয়ত কখনো শোধ করা হবে না। চাইলেও সেই ঋণ এর সমান শোধ হবে না। খালা আর আঙ্কেলকে বা কোনোমতেই মানিয়ে চলে যেতে পারবে কিন্তু এই ছেলেটা! এই ছেলেটাকে ছাড়া সে কিভাবে নিজেকে একা মানিয়ে নিবে! কিন্তু এটাই যে নিয়তি! কষ্ট হলেও যে মেনে নিতে হবেই!
‘মা?’
মাথায় কারো উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে কারো ডাকে আরোহী সম্বিৎ ফিরে পেল। সে দ্রুত চোখ তুলে তাকাতেই দেখল আমেনা আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন। তা দেখে সে নিজেও উঠে দাঁড়ালো।
‘জি বলুন খালা!’
‘বলছি কী! তোমার যদি আপত্তি না থাকে তোমাকে নিয়ে একটু শপিং এ যেতাম!’
আরোহী ঝটপট রাজি হয়ে গেল।
‘এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় খালা! আমি আপনাদের বাড়িতেই আছি, আপনাকে না করি কিভাবে বলুন!’
‘না, এটা বলে আমাকে লজ্জিত করো না। কতবার বলেছি, আমাকে তুমি খালা ডাকো, তাহলে আপনই ভেবো। তোমার ইচ্ছে থাকলে চলো! এখন রুহান ঘুমিয়ে আছে। চট করে গিয়ে চলে আসতে পারবো। আর উঠে গেলে রাহেলাকে ফোনে জানিয়ে দিতে বলেছি। তখন চলে আসবো। ততক্ষন তোমার আঙ্কেল আছেন ঘরে।’
আরোহী রুহানের ব্যাপারেই প্রশ্নঃ করতে নিচ্ছিলো। আর আমেনা আহমেদ ঝটপট তার সব প্রশ্নের উত্তর একনাগাড়ে বলে দিতেই সে জানালো সে যেতে পারবে।
এরপর দুইজনেই খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল কাছের একটা শপিং সেন্টারে। সেখানে গিয়ে আরোহী ঘুরে ঘুরে আমেনা আহমেদকে এটা-ওটা পছন্দ করে দিতেই তিনি সব প্যাক করে বিল পরিশোধ করে আরোহীর হাতে তুলে দিলেন।
আরোহী ভ্রু কুঁচকে খালার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি হাসিমুখে বলে উঠলেন,
‘এসব তোমার জন্যই মা। তোমার জন্য শপিং করবো বললে আসতে চাইতে না তাই এভাবে এনেছি তোমাকে। সব তোমার পছন্দের শাড়ি।’
আরোহী প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে আমেনা আহমেদের জোরাজোরিতে নিয়ে নিল। সে কৃতজ্ঞতা চোখে তাকালো। এখানে আসার পর খালায় নিজে থেকে দুইটা শাড়ি দিয়েছিলো, সেগুলোই একেকদিন একেকটা বদলে বদলে পড়েছিল। ইনাদের ঋণ হয়ত কখনো শোধ করতে পারবে না আরোহী।
————
রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে আরোহী রুমের ব্যালকনিতে এসে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এই দুনিয়া-দারি আর ভালো লাগছে না তার। দিন শেষে রাত আসলেই ওই মানুষটার কথা মনে আসতেই না চাইতেও চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু ঝরে পরে।
ঠিক সেসময়ে বাসার নিচে একটা কালো গাড়ি এসে থামতেই আরোহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে রুমের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল,’রাত দুইটা। এতো গভীর রাতে ইনি কে!’
মানুষটাকে বাসার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরোহী ভয় পেয়ে গেল। উপর থেকে বিধায় চেহারাটাও দেখা যাচ্ছে না ভালোমতো। এলোমেলো পায়ে মানুষটা পা বাসার দিকে পা বাড়ালো।
ঠিক সেসময় বাসার কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। একবার বাজতেই আর কোনো শব্দ এলো না। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে বিধায় একবারের শব্দটাও কেউ শুনলো না। আরোহী রুম থেকে বেরিয়ে ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি কয়েক ধাপ পেরিয়ে নিচে নামতেই কট করে দরজা খুলে গেল। আরোহী ওখানেই জমে গেল। কে ইনি!
#চলবে ইন শা আল্লাহ