কাঁচের সংসার পর্ব -১০

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১০

বেলা বারোটা বাজতেই স্নেহা ঘুম ছেড়ে আড়মুড়া ভেঙে উঠে বসলো। কিছুক্ষন থম মেরে বসে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ফ্রেস হয়েই রান্নাঘরে পা বাড়ালো।

রান্নাঘরে লুৎফা বেগম দুপুরের রান্না বসিয়েছেন। স্নেহাকে দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,
‘এভাবে চললে তো হবে না। তুমি এই বাড়ির বউ। এটা তোমারই সংসার আর যেটার জন্যই তোমাকে আনা! আশা করছি যে যে কথাগুলো বুঝাতে চাচ্ছি বুঝে নিয়েছো।’

লুৎফা বেগমের কথা শুনে স্নেহা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় হাত নাড়লো। নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে রান্নাঘর ছাড়তে ছাড়তে বললো,
‘ওহ খালা, আমি এই বাড়ির বউ হলে তুমি কী! আর এ সংসার আমার বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছ? কাজ করতাম? তাহলে সেদিক দিয়ে তোমার সব কাজই করা উচিত কারণ এ সংসার তোমারো। আমাকে আরোহী ভাবলে ভুল করবে। আর কী বললে যেন!আমাকে যেটার জন্য আনা মানে টা কী! আমি কী মেশিন না-কি! পড়াশোনা না করার জন্য ভুল-ভাল বলো। মানুষ আর মেশিন গুলিয়ে ফেলেছো। রাতে রান্না-বান্না শেষ করে আমার কাছে এসো মানুষ আর মেশিনের মধ্যে তফাৎ বুঝিয়ে দিবো। আশা করি কী বুঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পেরেছো।’ বলেই হাই তুলে লুৎফা বেগমের জবাবের অপেক্ষা না করে নাস্তার প্লেট নিয়ে স্নেহা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

লুৎফা বেগম বোকা বনে গেলেন। এই মেয়ে তো এমন ছিল না! রূপ এমন উল্টো হয়ে গেল! কথার জালে তাকেই ফাঁসিয়ে দিল! লুৎফা বেগম স্নেহার যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নায় মনোযোগ দিলেন। এই মেয়ের রূপ বিয়ের আগে যত ভালো ছিল কিন্তু বিয়ের পর পুরোই উল্টো। কিভাবে এতো বড়ো ভুল করলো লুৎফা বেগম!

স্নেহা খাওয়া শেষ করেই প্লেটটা রান্নাঘরের বেসিনে রেখে মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল।
লুৎফা বেগম সবজি কাটছিলেন। একবার স্নেহার রেখে যাওয়া প্লেটটার দিকে তাকিয়ে মলিন শ্বাস ফেলল। তার শরীর আর সইছে না এসব। আরোহী থাকতে রান্নাঘরে কোনোদিন পা দিতে হয়নি। সবকিছু সময়মতো তার জায়গায় চলে যেত। তবুও সে মেয়েটাকে কথা শুনাতো। এখন বড্ড আফসোস হচ্ছে তার! এতো বছরের জীবনে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বড়ো ভুল আর করেনি!

———–

দেখতে দেখতে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। আরোহীর সারাটা দিন রুহানকে নিয়েই কাটায়। রুহানের বাবা সারাদিন হাসপাতালেই থাকে। মাঝে মাঝে তো আসতে গভীর রাত হয়ে যায়। মানুষটার সাথে এর মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। আরোহীও মানুষটা বাসায় থাকলে রুম থেকে বেরোই না কারণ তাদের পূর্ণ পরিবারের মাঝে আরোহীকে দেখলে মানুষটা বিরক্ত হয়। প্রায় সময় মানুষটা বাইরে বাইরেই থাকে। আরোহী রাতে ব্যালকনিতে প্রায় সময় কাটাই বলে দেখতে পায় মানুষটা গভীর রাতে এলোমেলো পায়ে বাসায় ঢুকে।
আরোহী বুঝতে পারে, মানুষটা হয়ত এখনো মিথিলা আপুকে ভুলতে পারেনি। হয়ত তাই ব্যস্ততায় দিনগুলো পার করিয়ে দেয়!

গভীর রাত। আজ রুহানের জ্বর ছিল অনেক। রুহানের বাবা দুইদিন ধরে শহরের বাইরে একটা সার্জারির জন্য না-কি গিয়েছে। এটা আমেনা আহমেদের কাছ থেকেই শুনেছিল আরোহী। বাইরে বিধায় রুহানের ব্যাপারটা আর বলা হয়নি। অবশ্য সারাদিন আরোহীর সেবায় রুহানের জ্বর এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে।
রুহান বায়না ধরেছিলো সে আজ আরোহীর সাথেই ঘুমাবে। জ্বরের ঘোরে ছেলেটা আজেবাজে বকছে। মাকে ডাকছে শুধু। তাই আরোহী নিজের কাছে রেখে দেয়। এতক্ষন আমেনা আহমেদ ছিল। রুহান ঘুমিয়ে পড়ার পর আরোহী জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে উনাকে কারণ বেশি রাত জাগলে উনিও অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাতে রুহানের জ্বর আবার বাড়লে উনাকে ডাকতে বলে গিয়েছে। উনি এসে ফাঁকে ফাঁকে দেখে যাবে বলায় আরোহী রুমের দরজা খোলাই রাখলো।
রাত জাগার অভ্যাস আরোহীর আছে। রুহানকে ঘুম পাড়িয়ে সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। কেন জানি রাতটাতে তার জানালার ধারে একবার না আসলে হয় না। রাতের আকাশ দেখতে হবেই হবে । অভ্যাসটা এখানে এসেই হয়েছে। বিয়ের পর ওই বাড়িতে থাকতে হয়নি। ওখানে থাকতে কোনোদিন মন দিয়ে রাতের অজস্র নক্ষত্রের আকাশ দেখা হয়নি কিন্তু আশ্রমে থাকাকালীন প্রায় সময় জানালার ধারে এসে দেখত। আরিয়ানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর আর কোনোদিন দেখা হয়নি, অবশ্য দেখবেই বা কী করে ওখানে সারাদিন এটা ওটা করতে করতে রাত আসলেই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতো। তাই তো এই একবছর আর দেখা হয়নি।

হঠাৎ কারো গোঙানীর শব্দে আরোহী বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখতে পেল রুহান ঘুমের ঘোরে হাতড়িয়ে কাকে যেন খুঁজছে। আরোহী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখলো জ্বর আবার বেড়েছে। আরোহী দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খোলাই রেখেছে। আমেনা আহমেদকে ডাকার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে গিয়ে আবার পিছিয়ে আসলো। থাক না, মাত্রই তো গেল মানুষটা। সে নিজেই না হয় একটু গা-টা মুছে দিক। তাই সে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে পানি এনে রুহানের গা মুছে দিল। তাতেই রুহান একটু শান্ত হলো। সে আরোহীর একহাত জড়িয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। আরোহী পাশেই খাটের সাথে মাথা হেলান দিয়ে রুহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। গভীর রাত হওয়ায় তার নিজেরও ক্লান্ত লাগছে। গা-টা ম্যাচ ম্যাচ করছে। আস্তে আস্তে বসা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে ফেলল।

আরেকটু রাত হতেই দরজা ঠোকা দেওয়ার শব্দ হলো। আরোহীর চোখ মাত্রই ঘুমে বুজে আসছে বলে আর চোখ খুলে দেখতে হলো না। ঘুমের ঘোরে দরজার সেখানে আর যেতে ইচ্ছে হলো না। হয়ত আমেনা আহমেদ রুহান ঘুমিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে এসেছে। দরজা তো খোলায় আছে। অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরও যখন কারো সাড়া-শব্দ পেলো না তখন আরোহী আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই নিহান নামক মানুষটাকে দেখতে পেল। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। এই বাসায় আসার এই প্রথম বোধহয় উনি এই রুমে।

‘আপনি!’

‘রুহানকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ নিহানের সোজাসাপ্টা উত্তর।

‘কিন্তু…’ আরোহী কিছু বলতে নিতেই নিহানের কথায় থেমে গেল।

‘এখন তো সে ঘুম। বুঝতে পারবে না।’ বলেই এগিয়ে এসে রুহানকে কোলে নিতে গিয়েই বুঝতে পারলো রুহান তার এক হাত দিয়ে আরোহীর হাত আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন আরোহীকে ছাড়লেই হারিয়ে যাবে। আরোহী তা বুঝতে পেরে কিছু বলতে নিতেই নিহান নিজেই এগিয়ে এসে রুহানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কোলে নিয়ে ফেলল। আরোহীর মন খারাপ হলো। সে ভেবেছিল, রুহানের হাত আঁকড়ে ধরা দেখে নিহান আর নিয়ে যাবে না কিন্তু তবুও নিয়ে ফেলল। তার কেন যেন মনে হয়, আরোহীর এই বাসায় থাকা মানুষটা অপছন্দ করে কিন্তু কোনোমতেই একটা চাকরি পেলেই সে বেরিয়ে যাবে। আজ অনলাইনে একটা চাকরি দেখতে পেয়েছিল। কালই গিয়ে কথা বলবে। আরোহী মলিন শ্বাস ফেলল।
নিহান বেরিয়ে যাওয়ার আগ-মুহূর্তে দরজার এখানে গিয়ে থেমে পেছনে ফিরে আরোহীর দিকে তাকালো।

‘সারাদিন অনেক করেছেন আর গভীর রাত পর্যন্ত অনেক সেবা দিয়েছেন সেজন্য ধন্যবাদ।’

আরোহী খাটের দিকেই মন খারাপ করে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে দরজার দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো নিহান রুহানকে কোলে নিয়ে অবস্থায় দরজার এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে কথাটা হয়ত বলেছে। আরোহী সেদিকে তাকাতেই রুহান চোখ ফিরিয়ে নিল। এই বাসায় এতদিনে মনে হয় এই প্রথম মানুষটা তার দিকে তাকিয়েছে।

‘রুহান এখানে থাকলে আপনি হয়ত আর ঘুমাতেন না। এতো রাত জাগবেন না। ঘুমিয়ে পড়ুন।’ বলেই নিহান বেরিয়ে গেল। আরোহী সেদিকে তাকিয়ে রইল। যাক, মানুষটাকে যতোটা খারাপ মনে করেছে উনি এতটা খারাপ নয় হয়ত।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here