কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব -৩০

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী

কান্তা ফোনে আরমানের ছোট মামাকে সবটা জানিয়েছে। সে খবরটা শোনামাত্রই আরমানের গ্রামে হাজির হয়েছে। তার সাথে আছে তার মেজো ভাই। একে একে তার ভাই-বোনেরা সকলেই পৌঁছে আরমানের গ্রামে।

আরমানের কান্না কিছুতেই থামছেনা। ওর দুই মামা অনেক চেষ্টা করেও ওকে থামাতে পারেনি।

আইরিনের ভাই-বোন এসে কেঁদেই চলেছে। তারা কল্পনাই করতে পারেনি, তাদের বোনের সাথে এত খারাপ ঘটনা ঘটেছে।

আরমান একসময় শান্ত হয়। সে পুলিশের সাথে থানায় গেছে। সাথে ওর তিন মামাও আছে।

শহিদ আহমেদকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে। তার শারিরীক অবস্থা খুব একটা ভালো নেই।
স্বামীর পাশে বসে আকলিমা খানম আকাশপাতাল চিন্তা করছে। সে কখনও ভাবতেই পারেনি, যাকে নিজের ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিল সে-ই তার নিজের ভাইকে খু’ন করেছে! কেন এমনটা হল, সে ভেবেই পায়না।
এত বছর কারনে-অকারনেই স্বামীর কাছে আরমানের মা’য়ের সম্পর্কে নানান কথা বলে উস্কে দিয়েছে। তার মনে আইরিনের জন্য ঘৃণা সৃষ্টি করিয়েছে । এভাবেই হাতে রেখেছিল তার স্বামীকে। সে ভাল করেই জানত আইরিনকে তার স্বামীর মন থেকে না সরালে সে কিছুতেই স্বামীর ভালোবাসা পাবেনা। অবশ্য সে সফলও হয়েছিল। কিন্তু আজ কি থেকে কি হয়ে গেল! তার স্বামীর মনে আইরিনের জন্য জমে থাকা ঘৃ’ণা এক লহমায় মুছে গেছে। মানুষটা আবার আইরিন আইরিন করছে। যেমনটা করত আইরিন হারিয়ে যাবার পর।
কাল থেকে কিভাবে স্বামীর সামনে দাঁড়াবে সেই চিন্তা তার মাথা থেকে যাচ্ছেনা।

রাজিয়া খানম স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে আছে। আজ কিছুতেই তার চোখে ঘুম নামছেনা। সে ভাবতেই পারেনি তার সংসারে এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। অথচ কত অপমানজনক কথাই না সে বলেছে ঐ মৃ’ত মেয়েটার সম্পর্কে। সে আইরিনকে পছন্দ করতনা এটা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে সে কখনোই আইরিনের মৃ’ত্যু চায়নি। তার সকল আয়োজন ছিল আকলিমাকে ঘিরে। সে অনেক আগে থেকেই মনেপ্রাণে আকলিমাকে ছেলের বউ রূপে দেখতে চেয়েছিল। তাই আইরিনকে ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারেনি। তাইতো আইরিন হারিয়ে যাবার পর, তার ছেলে যখন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল, তখন ছেলের কানে আইরিনের সম্পর্কে বিষ ঢেলে ছেলেকে নিজের কবজায় করে নিয়েছিল। এবং ধীরে ধীরে আরমানকেও তার ছেলের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এবং আকলিমাকে ছেলের বউ করে নিয়ে এসে তার দুরভিসন্ধিকে সফল করেছিল। কিন্তু হায় আজ তার এত বছরের পরিশ্রম বৃথা হল। তার ছেলে এত বছর পরও আইরিনের জন্যই পাগলামি করছে।
কাল যদি তার ছেলে সবকিছুর জন্য জবাবদিহিতা করে, তখন সে কি উত্তর দিবে!

কান্তা ওর খালা শ্বাশুড়ির সাথে ঘরে বসে আছে। তারা আরমানদের জন্য অপেক্ষা করছে। আরমানের খালারা বোনের জন্য থেকে থেকেই কেঁদে উঠছেন। বারবার বলছেন, এমনটা না হলেও পারত।
কান্তা চিন্তাকরছে আরমানের জন্য। মানুষটাকে ও কিভাবে সামলাবে, তা ওর জানা নেই।
শ্রীজাও আছে কান্তার সাথে। ওর চিন্তা হচ্ছে ভাইয়ের জন্য। এতদিন সবাই ওর ভাইকে কতইনা কথা শুনিয়েছে। একজন ছেলের সামনে যখন তার মা’কে নিয়ে আজেবাজে কথা বলা হয়, তখন সেই ছেলের কষ্ট কি কেউ আঁচ করতে পারে? তার ভাই দিনের পর দিন নিজের মা’কে নিয়ে আজেবাজে কথা শুনেছে। হয়তো সে-ও আশায় ছিল, তার মা একদিন ফিরে আসবে। তখন সে সবার কটুকথার জবাব দিবে। কিন্তু একি হয়ে গেল! তার ভাইয়ের জবাব দেয়ার রাস্তা ঠিকই হয়েছে, কিন্তু তার মা আর ফিরে আসবেনা।

সবাই নানান চিন্তায় অস্থির থাকলেও শুভর মধ্যে কোন অস্থিরতা নেই। এসবে তার কিছুই যায় আসেনা। সে-তো ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। বাবার হঠাৎ করেই অসুস্থ হওয়াকে ওর আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। আবার শ্রীজার বড় ভাইয়ের জন্য এত দরদ দেখেও রা’গ হচ্ছে। এত হাইপার হওয়ার কি আছে! যার যেটা ভাগ্যে আছে সেটা হবেই। ও সিদ্ধান্ত নেয় সকাল হলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে।

পরদিন দুপুরে ওরা ফিরে আসে। সবার মুখ থমথমে।
কান্তারা আরমানের চাচার বাড়িতেই আছে। আরমান সেখানে ঢুকতে চাইলে ওর ছোট মামা ওর হাত ধরে নিয়ে যায় শহিদ আহমেদের বাড়িতে। ওরা বাড়িতে ঢুকতেই রাজিয়া খানমকে দেখতে পায়। রাজিয়া খানম বারান্দায় বসে ছিল।
আরমানের মামা আতিক সোজা যেয়ে দাঁড়ায় রাজিয়া খানমের সামনে।

” আপনি আজ পর্যন্ত আমার আপাকে যা যা বলেছেন, তার সবটাই আমার মনে আছে। আমি সবসময়ই আপনার অপমান সহ্য করে বাড়িতে ফিরেছ। কিন্তু আজ সেসব অপমানের জবাব দেয়ার সময় এসেছে। আমার আপা চরিত্রহীনা ছিলনা সেই প্রমান নিশ্চয়ই পেয়েছেন? এতকিছুর পরও আপনি বেঁচে আছেন কিভাবে! আপনার লজ্জা করছেনা নিজের মুখ সবাইকে দেখাতে? নিজের বলা কথাগুলোর জন্য অনুশোচনা হচ্ছেনা? ধিক জানাই আপনার মত মহিলাদের যারা সংসারে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। ”

” মামা, কাকে কি বলছেন আপনি! এই ভদ্রমহিলার মনুষ্যত্ব আছে বলে আপনার মনে হয়! এই মহিলা নারীজাতির ক’ল’ঙ্ক। যে মহিলা এতদিন শুধু নিজের স্বার্থই দেখেছে, তার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশা করা বৃথা। আজতো তার সাথে আমার মা’কে নিয়ে কথা বলারই রুচি হচ্ছেনা। ইভেন আজকের পর থেকে কোনদিও আমার মা’য়ের বিষয়ে এই মহিলার সাথে কথা বলবনা। এদের মুখ দেখতেও আমার ঘৃ’ণা হয়। এরা যদি বুঝত, আমার মা’য়ের নাম মুখে নেয়ার মত যোগ্যতা এদের নেই। তবে কখনোই সেসব কথা বলতনা। এখান থেকে চলুন মামা। এদের পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তা আছে। আর আমার তরফ থেকে এদের জন্য শাস্তি বলতে শুধু ঘৃ’ণা’ই আছে। আর আমার ঘৃ’ণা যে কত ভয়ংকর এরা এবার তা দেখবে। ” আরমান একটিবারও রাজিয়া খানমের দিকে তাকায়না। সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

রাজিয়া খানম এই অপমানে কাঁপতে থাকে। এই বয়সে এত অপমানও তার ভাগ্যে ছিল। তবে সে ভয় পাচ্ছে ছেলের কথা ভেবে। তার ছেলে সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলে কি উত্তর দেবে?

সেইদিন বিকেলে আরমানরা গ্রাম ছাড়ে। আরমান কান্তাকে নিয়ে ওর কর্মস্থলে ফিরে। তবে শ্রীজার জোড়াজুড়িতে ওকেও সাথে নেয়।

পনের দিন কেটে গেলেও আরমান স্বাভাবিক হতে পারেনা। এখনও ওর মায়ের ডিএনএ রিপোর্ট আসতে অনেক দেরি। রিপোর্ট আসলেই ও রশিদ বেগের বিরুদ্ধে একে একে মামলা সাজাবে। ওর কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবে।

আজ সকালে শ্রীজা ঢাকায় ফিরে গেছে। এই কয়টা দিন মেয়েটা ভাইয়ের পাশে ছায়ার মত থেকেছে। ভাইকে সাহস দিয়েছে, শান্তনা দিয়েছে। যাওয়ার সময় মেয়েটা ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভিষণ কাঁদছিল।

রাতে ডিউটি থেকে ফিরে আরমান না খেয়েই শুয়ে পরে। কান্তা ওর জন্য খাবার নিয়ে এসে দেখল আরমান কপালে হাত রেখে টানটান হয়ে শুয়ে আছে।

” উঠুন, একটু খেয়ে নিন। এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ” কান্তা আলতোভাবে আঙুল চালায় আরমানের চুলে। ওর কন্ঠে কোমলতা খেলা করছে৷

” আমার ক্ষুধা নেই। তুমি খেয়ে নাও। ”

কান্তা বেশ বুঝতে পারছে আরমান আজও খাবেনা। ও একটু নড়েচড়ে বসে। আজ সময় এসেছে সেই কথাগুলো বলার।

” জানেনতো, আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, আমার এত সুখের একটা সংসার হবে, দ্বায়িত্ববান স্বামী পাব। আমি সব সময়ই ভেবেছিলাম, আমার ভাই-ভাবী কোন একটা ছেলের সাথে ধরে বেঁধে বিয়ে দিবে। সেখানে আমাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর পঁচে ম’র’তে হবে। কেমন আছি এই খোঁজটা নেয়ার কেউ থাকবেনা। আবার হয়তোবা যার সাথে বিয়ে হবে সে-ও ভাইদের মত অবহেলা করবে, দূরদূর করবে। কিন্তু আপনাকে দেখেই আমার সেই ধারনা পাল্টে গেল। আমি ভাবতে শুরু করলাম আপনি আমার #কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন। যে ধন আমি অনেক ভাগ্য করে পেয়েছি। আমার মত এতিম মেয়ের যেখানে আরেকটা সংসারে পঁচে ম’রা’র কথা ছিল, সেখানে আপনি আমাকে মাথায় তুলে রেখেছেন। হঠাৎ করেই আপনি আমার জীবনে আসলেন। আমার জীবনটাকে ভালোবাসার চাদরে ঢেকে দিলেন। আমি জানি আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তাই নিজেকে শক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে এটা পুরোটাই ব্যাতিক্রম। এত বছর পরও আপনি মা’কে দেখার আশায় ছিলেন। আপনার এই কষ্ট আমি উপলব্ধি করতে পারছি। এবং আপনার অংশীদারও আমি হতে চাই। কিন্তু আপনি আমাকে তা হতে দিচ্ছেননা। এভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলে আপনি কখনোই সবকিছু সামাল দিতে পারবেননা। কেন আমাকে আপনার দুঃখের সাথী করছেননা! আপনার দুঃখবিলাসের সাথী হয়ে আমি আজন্ম থাকতে চাই। আজ আপনি একা নন। অনেকেই আপনার পাশে আছে। আমি আছি। আরেকজন আসছে। যে আপনার সকল দুঃখ বিনাশ করবে। যে আপনারই অংশ। সে যখন বড় হয়ে সবকিছু জানবে, তখন যদি বলে তার বাবার দুঃখের সাথী হইনি কেন? তখন আমি কি জবাব দিব? আমিতো তাকে বলতে পারবনা, তোমার বাবা আমাকে তার পাশে রাখেনি। সে নিজে পু’ড়ে আমাকে জ্বা’লি’য়ে’ছে। একাকিত্বতেই তার দুঃখ ধুয়েছে। ”
কান্তা আর কিছু বলার আগেই এক ঝটকায় উঠে বসে আরমান।

” কি বললে তুমি! কে আসছে! আমি কি ঠিক শুনেছি? ”

” আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমি চাই সে আপনার মা হয়ে আসুক। যে অনেক বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। সে এবার নতুন পরিচয়ে আসুক। ”

আরমান কান্তাকে জড়িয়ে ধরে। ওর সমস্ত মুখে চুমু দেয়।

” আগে বলনি কেন? আমি তোমাকে মোটেও দূরে সরিয়ে রাখিনি। আমি চাইনি তুমি আমার জন্য কষ্ট পাও। বাবার বাড়িতে অনেক কষ্ট করেছ। আমি চেয়েছি আমার কাছে তুমি শুধুই সুখে থাক। কোন কষ্ট তোমাকে যেন না ছুঁতে পারে। ব্যস এজন্যই তোমাকে এসবে জড়াইনি। আচ্ছা, তুমি কবে জেনেছ, সে আসছে? ”

” দশদিন আগে। কিন্তু এবার আমার কাছে প্রমিজ করুন, আপনি এভাবে মনমরা হয়ে থাকবেননা? নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করবেন? এই কয়েকদিন না খেয়ে থেকে আমার ভিষণ কষ্ট হয়েছে। আপনি না খেয়ে থাকলে, আমিও খেতে পারিনা। ”

” আচ্ছা, আর না খেয়ে থাকবনা। এবার খাবারগুলো দাও। আজ তোমাকে আমি খাইয়ে দিব। ” আরমান বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুম থেকে চোখমুখে পানি দিয়ে এসে কান্তাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেয়।

এরপর নিজে খাবারের প্লেটসহ সবকিছু রান্নাঘরে রেখে আসে।
কান্তা ততক্ষণে বিছানা ঠিক করে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরমান রুমে এসে কান্তাকে নিয়ে শুয়ে পরে। আজ ওর কান্তার সাথে অনেক গল্প করার আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here