কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৫.
নসিব এই প্রথম শহরে এসেছে। সবকিছুতেই তার বিস্ময়ের অন্ত নেই। বারবার করে সে রৌদ্রুপকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে আর বিস্ময় প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে রৌদ্রুপ নসিবের কাজের ব্যাপারেও তাকে সব জানিয়েছে। নসিবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, বিধায় ছোটো-খাটো একটা চাকরি জোগাড় করতে পেরেছে রৌদ্রুপ। নসিব তাতেই খুশি। আসার পরদিন থেকেই নসিব কাজে জয়েন করেছে। নতুন জায়গা, নতুন কাজ, নতুন মানুষের ভীড়ে নসিব একটু দ্বিধায় পড়লেও, বেশ খুশি। এদিকে রৌদ্রুপ নিজের অবসর সময় বুঝে একটা-দুটো করে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনে। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই রৌদ্রুপ আর নৈঋতা নিজেদের মনের মতো করে সংসার সাজিয়ে তুলেছে। এর মাঝে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সরফরাজ চৌধুরী আর তিহানের সাথে দেখা করে এসেছে। বাড়িতেও ফোন করেছিল খবর নেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউই তার সাথে ভালোভাবে কথা বলেনি। সোজা কথায় বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা নৈঋতাকে বাড়ির ছেলের বউ মানতে নারাজ। রৌদ্রুপ আর এই নিয়ে বেশি কথা বাড়ায়নি। বাসার কাছাকাছি একটা কলেজে নৈঋতাকে ভর্তি করে দিয়েছে রৌদ্রুপ। নৈঋতার ভর্তির পর থেকেই তাদের সংসার চলে নিয়মিত রুটিনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দুজন নামাজ আদায় করে। একসাথে রান্না করে। নৈঋতার আগে-আগেই রৌদ্রুপ সব কাজ আগে করার চেষ্টা করে। এই নিয়ে নৈঋতা রাগ করে, গাল ফুলায়। রৌদ্রুপ হাসে। নৈঋতার গাল টিপে দিয়ে বলে,
“রাগলে তোমায় মিষ্টি লাগে, বউ। সবসময় রেগে থেকো তো। আচ্ছা, একটা হোটেল খুললে কেমন হয় বলো তো? তুমি আর আমি একসাথে সেখানে নিজ হাতে রাঁধব আর প্রেম করব।”
“প্রেমের হোটেলে লাভ কিছু নেই।”
“কে বলল? এই যে আমি সারাক্ষণ তোমার কাছাকাছি থাকতে পারব। এটাই তো লাভ। বাংলা লাভ হবে, ইংরেজি লাভ বাড়বে। ডবল লাভ।”
নৈঋতা গাল ফুলিয়ে থাকতে পারে না। রৌদ্রুপের উলটা-পালটা কথায় খিলখিল করে হাসে। সকালের নাস্তা সেরে নসিব তার কাজে চলে যায়, আর রৌদ্রুপ
নৈঋতাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজে অফিসে যায়। কলেজ থেকে ফিরে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নৈঋতা একাই সময় কা’টায়। রান্না করে, ঘুমায়, টিভি দেখে, ঘর গোছায়, ফাহাদের বউয়ের সাথে গল্প করে, আবার কখনও বই পড়ে। সন্ধ্যার পর নসিব আসে, আর রৌদ্রুপ আসে রাত দশটার দিকে। রাতের খাবারটা তিনজন একসঙ্গে খায়। সারাদিনের ব্যস্ততার ভিড়েও রৌদ্রুপ বাসায় ফেরার সময় নৈঋতার জন্য এটা-ওটা আনতে ভোলে না। এতকিছুর মাঝে দুজনের একটা অভ্যাস অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। আজও রৌদ্রুপ খাবারের শেষ অংশ না খেয়ে রেখে দেয়। নৈঋতা সেই অংশটুকু তৃপ্তি সহকারে খায়। রৌদ্রুপ সবসময় বলে,
“এই খাবারটুকু না খেলে কি পেট ভরে না?”
নৈঋতা স্পষ্ট স্বরে উত্তর দেয়,
“না। আপনে রাখেন ক্যান?”
“আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“আমারও।”
দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে অর্ধ বছর গড়ায়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দুজনের ছোট্ট সংসার চলছিল বেশ। নৈঋতা প্রথমদিকে পড়াশোনা নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ত। রৌদ্রুপের অবদানে তার সব সমস্যা কা’টিয়েও উঠেছে খুব সহজেই। রৌদ্রুপ নিজের কাজের ফাঁকে নৈঋতার পড়াশোনায় যথেষ্ট সাহায্য করে। মাঝেমাঝে নৈঋতা কোনো বিষয় নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেই রৌদ্রুপ বিজ্ঞের মতো তাকে নানাভাবে বোঝায়। বলে,
“ছোটোবেলায় যখন চক দিয়ে স্লেটে প্রথম লিখতে শিখেছিলে, তখন কি একবারের চেষ্টাতেই সুন্দর করে লিখতে পেরেছিলে? চক ভাঙেনি? কাঁচা হাতের লেখা ত্যাড়াবাঁকা হওয়ায় সেটা মুছে বারবার একই লেখা লেখনি?”
নৈঋতা দুচোখে প্রশ্ন নিয়ে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকায়। রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলে,
“তাহলে? তখন তো একবার ব্যর্থ হয়ে হাল ছাড়নি। এখন ছাড়বে কেন? কবি কালিদাস কী বলেছেন জানো?
পারো কি না পারো করো যতন আবার,
একবার না পারিলে দেখো শতবার।
বুঝলে? একবারে হাল ছাড়ে অলস ছাত্র-ছাত্রীরা। তুমি তো অলস নও। তাই তোমার অধ্যবসায়ের প্রতি যত্নশীল হও।”
নৈঋতা মুগ্ধ হয়। মানুষটার এমন বিজ্ঞের মতো কথা শুনলে সে মনে জোর পায়। নতুন করে শেখার সাহস পায়। মনেপ্রাণে চায়, একদিন সে এই মানুষটার মুখ উজ্জ্বল করবে। পড়াশোনা করে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। যাতে এই মানুষটা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।রৌদ্রুপ সময় করে সবসময় নিজের পরিবারের খোঁজ নেয়। মায়ের আদরের ছেলে সে। নৈঋতাকে মানতে না পারলেও শাহানা খানম ইতোমধ্যেই ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ম’রিয়া হয়ে উঠেছেন। কিন্তু নিদ্রা আর শশী নানাভাবে তার কানে বি’ষ ঢালে। তাদের আসল সমস্যা হচ্ছে নৈঋতা। নৈঋতা আবার এসে এ বাড়িতে আসন গেড়ে বসবে, এটা তারা মানতে নারাজ। তিহান রৌদ্রুপকে জানিয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে যেতে। অবশ্য রৌদ্রুপ এখনও এ বিষয়ে তেমন কিছু জানায়নি। নসিবের জন্য তার চিন্তা হয়। নৈঋতাকে নিয়েই সবার যা সমস্যা, এই ছেলেটাকে তো আরও আগে বাড়িতে জায়গা দিবে না। নসিব জানিয়েছে সে একা থাকতে পারবে। খাওয়া-দাওয়া হোটেলে করবে বা সময় পেলে নিজেই রান্না করে নিবে। তার কাজ নিয়ে সে বেশ আছে। প্রতি মাসে বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠিয়ে নিজের হাতখরচাও ভালোভাবেই চলে যায়। তবুও রৌদ্রুপ যখন সম্ভব হয় নৈঋতার বাবা-মায়ের একার সংসারের জন্য কিছু খরচ পাঠিয়ে দেয়। ছয় মাসে দুবার নসিব আর নৈঋতাকে নিয়ে সে গ্রামে ঘুরে এসেছে। অবশ্য অল্প সময়ের জন্যই। ছেলে-মেয়ের সুখ দেখে সামসুদ্দীন বেপারী আর আফিয়া বেগম বেজায় খুশি। অনেক ভেবেচিন্তে নসিব আর নৈঋতার সাথে কথা বলে রৌদ্রুপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই মাসটা শেষ হলেই তারা ভাড়া বাসা ছেড়ে দিবে। নসিবকে তার কর্মস্থলের কাছাকাছি বাসা ভাড়া করে দিবে। আর নৈঋতাকে নিয়ে রৌদ্রুপ নিজের বাড়ি ফিরে যাবে। মন কষাকষিতে বহুদিন কে’টেছে। যতই হোক, নিজের পরিবার ছেড়ে তো বেশিদিন এভাবে থাকা যায় না। দূরে বসে মায়ের আহাজারি শুনে খারাপ লাগে তার। ফিরে গেলে ধীরে-ধীরে নৈঋতাকেও হয়তো সবাই মেনে নিবে। রৌদ্রুপের এই পরিকল্পনার পর আরও দুমাস পার হলেও, তাদের বাড়ি ফেরা আর হয়ে ওঠে না। কেন জানি নৈঋতাকে নিয়ে তার খুব চিন্তা হয়, শ’ঙ্কা হয়। আবার পরিবারের জন্যও মন আঁকুপাঁকু করে। নৈঋতা অবশ্য সবসময়ই চায় রৌদ্রুপ বাড়ি ফিরুক। সে যতটা সম্ভব রৌদ্রুপকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রৌদ্রুপ বাড়ি ফেরার আগেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। হুট করেই একদিন তার কাছে নিদ্রার ফোন এল। রৌদ্রুপ বেশ অবাক হলো। কারণ সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর নিদ্রা ভুল করেও কোনোদিন তাকে ফোন করেনি। বরং সে ফোন করলেও দু-একটা কথা বলেই লাইন কে’টে দিয়েছে বা তুলির কাছে দিয়ে দিয়েছে। বিস্ময় রেখে রৌদ্রুপ ফোন রিসিভ করতেই নিদ্রার ম’রা কান্না শুনতে পেল। কান্নার তোড়ে সে কথাই বলতে পারছে না। রৌদ্রুপ খানিক বিচলিত হয়ে পড়ল। বারবার নিদ্রাকে প্রশ্ন করে চলল সে কেন কাঁদছে। বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। নিদ্রা নিজের কান্না সামলে অনেক কষ্টে দুটো বাক্য ব্যয়ে সক্ষম হলো।
“বাবা আর তিহান হসপিটালে ভর্তি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
রৌদ্রুপ কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ওপাশে নিদ্রার কান্নার গতি আরও বেড়েছে। রৌদ্রুপ কাঁপা গলায় দু-একটা প্রশ্ন করলেও নিদ্রা উত্তর দিতে পারছে না। শেষে রৌদ্রুপ লাইন কে’টে শশীকে ফোন করল। নিদ্রার মতো শশীও কাঁদছে। রৌদ্রুপের অস্থিরতা টের পেয়ে শশী নিজেকে সামলাল। জানাল, সরফরাজ চৌধুরী আর তিহান একসঙ্গে অফিস থেকে ফেরার পথে আচমকা একটা ট্রাকের সাথে তাদের প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ হয়। প্রাইভেট কার ছিটকে গিয়ে উলটে পড়েছিল। তাদের দুজনের অবস্থাই নাজুক। শশীর থেকে রৌদ্রুপ হাসপাতালের নাম জেনে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়েছে। নৈঋতাকে ফোন করে জানাবে ভেবেও জানায়নি। মেয়েটা এখন বাসায় একা আছে। এসব শুনলে একা-একা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করবে। হসপিটালে পৌঁছে রৌদ্রুপের গোটা পৃথিবীটাই দুলে উঠল। শশী বুকে আছড়ে পড়ে আ’র্ত’@৳*নাদ করে প্রথমেই জানাল তাদের বাবা আর নেই। মিনিট দশেক আগে চলে গেছেন তাদের পিতৃহীন করে। তার আ’ঘা’তটা মাথায় বেশি লেগেছিল। শরীরটাও বিভিন্ন স্থানে থেঁতলে গেছে। তিহানের অবস্থাও খুব বেশি ভালো না। সে এক পা হারিয়েছে। পা হারানো তিহান বাবার মৃ’ত্যু সংবাদ এখনও জানে না। শাহানা খানম এত শো’ক সহ্য করতে পারেননি। ছেলের পা হারানোর সংবাদ পেয়েও মনকে শান্ত রেখেছিলেন। ভেবে নিয়েছিলেন পা-ই তো হারিয়েছে, সন্তান তো হারায়নি। কিন্তু স্বামীর মৃ’ত্যু সংবাদ শুনেই তিনি পা’গলপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মুহূর্ত পা’গলের মতো কেঁদে শেষে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। নিদ্রা আর শশী নিজেদের সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিল। নিদ্রার বাবার বাড়ি থেকেও লোক এসেছে। নিদ্রাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে তিহানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে তার তিহানের কাছে থাকাটা জরুরি। সেই সাথে তাকে সাবধান করে দিয়েছে, যাতে তিহানকে এখনই সরফরাজ চৌধুরীর মৃ’ত্যু সংবাদ না জানায়। ছেলেটা পা হারিয়ে যতটা ভেঙে পড়েছে, এই সংবাদ পেলে সহ্য করতে পারবে না। রৌদ্রুপ আঁচ করল, জীবনের প্রথম এমন দিশেহারা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সময় নিয়ে সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়েছে। হসপিটালের সব ঝামেলা চুকিয়ে নিদ্রার ভাই আর নিদ্রাকে তিহানের কাছে রেখে, বাকিদের সাহায্যে সে বাবার লা’শ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। ছোট্ট তুলিকে তার নানাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন সবাইকে শো’ক সংবাদ জানানো হয়েছে। কাছের আত্মীয়রা সবাই এসেছে। দূরের আত্মীয়রা রওয়ানা দিয়েছে। বাড়িতে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেছে। সবদিক সামলাতে রৌদ্রুপকে তার মামাতো, চাচাতো ভাইয়েরা সাহায্য করছে। আগামীকাল সকালে সরফরাজ চৌধুরীর দাফন হবে। রাত বাড়ছে। নৈঋতা এরমধ্যে কয়েকবার ফোন করেছিল। রৌদ্রুপ একবার রিসিভ করে বলেছিল ফিরতে দেরি হবে। তারপর কথা বলতে ইচ্ছে করেনি বলে আর রিসিভ করেনি। মা-বোনকে সামলাতে গিয়েই তার সময় থমকে যায়। এদিকের সব ব্যবস্থা করে রৌদ্রুপ সবাইকে বলে বাড়ি থেকে বের হতে পারল রাত দুইটায়। কাল সকাল-সকাল নৈঋতাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে সে। বাসায় ফিরে নৈঋতাকে জাগাতে চায়নি সে। নিজের কাছে রাখা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। কিন্তু প্রথমেই চোখে পড়ল সোফায় বসে নৈঋতাকে ঝিমাচ্ছে। মেয়েটা ড্রয়িংরুমে বসে তার অপেক্ষা করছিল বুঝতে পেরে রৌদ্রুপের খারাপ লাগল। ঘুমে চোখ লেগে আসছে তার। দরজা লাগানোর শব্দ পেয়েই নৈঋতার ঘুম ভেঙে গেছে। রৌদ্রুপের ক্লান্ত, মলিন মুখটা দেখে নৈঋতা দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,
“আপনে আইছেন? হঠাৎ এত বেশি কাম পড়ল ক্যামনে? আপনের কি শইল খারাপ লাগতাছে?”
রৌদ্রুপ মাথা দুলিয়ে না-বোধক উত্তর দিলো। নৈঋতার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়তে বলেছিলাম না তোমায়? শুধু-শুধু এত রাত পর্যন্ত জেগে ছিলে কেন?”
“আপনে ফোন ধরতাছিলেন না ক্যান? আমার অনেক চিন্তা হইতাছিল।”
“অনেক ব্যস্ত ছিলাম। নসিব ঘুমিয়ে পড়েছে?”
নৈঋতা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। বলল,
“যান, জামা-কাপড় ছাড়েন। আমি তরকারি গরম করতাছি।”
রৌদ্রুপ রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“খাব না। তুমি খেয়ে এসো।”
“ক্যান খাইবেন না?”
“ইচ্ছে করছে না।”
নৈঋতা নিশ্চিত হলো রৌদ্রুপের শরীর খারাপ। সুস্থ থাকলে সে সবসময় বাসায় ফিরে রাতের খাবার খায়। ক্ষুধা সে একদম সহ্য করতে পারে না। নৈঋতা তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে বলে বাইরেও খায় না। কিন্তু আজ কী? অগত্যা নৈঋতা রৌদ্রুপের পেছন-পেছন রুমে চলে এল। রৌদ্রুপ হাতঘড়ি খুলছিল। নৈঋতা গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে কপাল, গাল, গলায় হাত ছুঁয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে লাগল। রৌদ্রুপ নৈঋতার মনের সন্দেহ আঁচ পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমি ঠিক আছি। চিন্তা কোরো না। যাও খেয়ে এসো তাড়াতাড়ি। বেশি রাত হয়ে গেছে।”
“তাইলে আপনে খাইবেন না ক্যান?”
“ইচ্ছে করছে না, নৈঋ। জোর কোরো না প্লিজ। খেয়ে নাও তুমি।”
“সত্যিই শরীর ভালো?”
“হ্যাঁ।”
“বাইরে কিছু খাইছিলেন?”
“না।”
“তাইলে ক্ষুধা লাগেনায়?”
“না।”
তোয়ালে হাতে নিয়ে রৌদ্রুপ বাথরুমে ঢুকে গেল। কিছু একটা হয়েছে তা নৈঋতা আঁচ পাচ্ছে। রৌদ্রুপ হয়তো সময় হলে বলবে ভেবে খেতে চলে গেল। মানুষটাকে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করছে না। প্রতিদিনের অভ্যসবশত খাবারটুকু যে পাবে না। কিন্তু পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে সে রুমে ছুটল। ততক্ষণে রৌদ্রুপ শুয়ে পড়েছে। চোখের ওপর হাত ঠেকিয়ে সটান শুয়ে আছে সে। নৈঋতা পাশে শোয়ার পরও রৌদ্রুপের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। অথচ প্রতিদিন তাকে বুকে না নেওয়া অবধি চোখ বন্ধ হয় না রৌদ্রুপের। আজ এমন কী হলো যে, মানুষটাকে এমন ছন্নছাড়া লাগছে? মিনিট দুয়েক পরও যখন রৌদ্রুপের সাড়া পাওয়া গেল না, তখন নৈঋতা নিজেই এগিয়ে গিয়ে রৌদ্রুপের বুকের কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। বুকের কাছের টি-শার্টে আস্তে করে টান দিয়ে ডেকে বলল,
“হুনছেন? ঘুমাই পড়ছেন?”
ডাকার সঙ্গে-সঙ্গেই রৌদ্রুপ হাত সরিয়ে তাকাল।
“আপনের কী হইছে কইবেন না আমারে?” মন খারাপ করে বলল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ এবারেও উত্তর দিলো না। নৈঋতাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বুক ফুলিয়ে বড়ো করে দম নিল। ব্যথিত গলায় বলল,
“বাবা নেই, নৈঝ। চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।”
নৈঋতা চকিতে ঝট করে মাথা তুলে অবাক দৃষ্টিতে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকাল। প্রশ্ন করল,
“কই গেছে?”
“আল্লাহর কাছে।”
নৈঋতা যেন আচমকা এক ঝটকা খেল। হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রৌদ্রুপের ছলছল চোখ জোড়ার দিকে। আলগোছে শোয়া থেকে উঠে বসল। জানতে চাইল কীভাবে কী হয়েছে। রৌদ্রুপ সবটা খুলে বলল। ততক্ষণে নৈঋতার দুচোখ অশ্রু বিসর্জন দিতে শুরু করেছে। সরফরাজ চৌধুরী তাকে অপছন্দ করেননি। কোনোদিন কোনো কটুক্তিও শোনাননি। হুট করে তার এভাবে চলে যাওয়া, আর তিহানের পা হারানোর সংবাদ তাকে বেশ কষ্ট দিলো। তিহান সবসময় তাকে ছোটো বোনের মতো স্নেহ করে। রৌদ্রুপের জন্যও তার কষ্ট হচ্ছে। মানুষটা সারাদিন ধরে মুখ বুজে সবদিক সামাল দিলেও, ভেতরের আ’র্ত’নাদ প্রকাশ করতে পারেনি। নীরবে পু’ড়েছে। অথচ এখন তার চোখ ভর্তি জল। সারাদিনের চাপা কষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে অনায়াসেই। এই মেয়েটার সামনে পাথর হয়ে থাকতে পারছে না সে। নৈঋতা ঝুঁকে পড়ে রৌদ্রুপের চোখের কোণের পানি মুছতে-মুছতে ধরা গলায় বলল,
“আইচ্ছা? বাবা কি আমগো থিকা মনে কষ্ট পাইছিল? আমরা তো মাফ চাইতে পারলাম না। আমগো ওপর রাগ নিয়া চইলা গেল?”
“না, নৈঋ। বাবা আমাদের ওপর কখনোই রেগে ছিল না। বিয়েটা করার আগে তো আমি তার অনুমতি নিয়েছিলাম। একটু অসন্তুষ্ট হলেও সে তখন অনুমতি দিয়েছিল। বাবা তো সবসময়ই চাইত আমরা বাড়ি ফিরে যাই, কিন্তু আমাদের আর ফেরা হলো না। যখন ফিরব, তখন সে দেখবেও না।”
নৈঋতা অশ্রুসিক্ত নয়নে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রুপের মুখের দিকে। স্পষ্ট দেখল মানুষটার চোখের টলমলে অশ্রু এতক্ষণে বাঁধ ভেঙে চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল। এই প্রথম সে এই শক্তপোক্ত মনের মানুষটাকে কাঁদতে দেখছে। হয়তো চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে, কিন্তু ছেলে বলে পারছে না। এসব ভেবে নৈঋতার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। ক্ষণকাল চুপ থেকে সে ব্যথিত কন্ঠে বলল,
“আপনের অনেক কষ্ট লাগতাছে, না?
রৌদ্রুপ এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। অন্য কথা বলল,
“জানো নৈঋ? বাবা খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিল। সবাই ভাবে বাবার চেয়ে আম্মা আমাদের বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আমি জানি, আম্মার চেয়েও বেশি ভালবাসত বাবা। শুধু সে মনের অনুভূতিগুলো খুব সহজে প্রকাশ করতে পারত না। কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশিতই সুন্দর। আর তার মধ্যে বাবাদের ভালোবাসা অন্যতম।”
নৈঋতা রৌদ্রুপের গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মানুষটার ভেতরের চাপা আ’র্ত’নাদ তার নিজের কান্নাও থামাতে দিচ্ছে না। রৌদ্রুপ একটু থেমে পুনরায় বলতে লাগল,
“আমার আজকের অবস্থানের জন্য বাবার ভূমিকা অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি বলা চলে। সে সবসময় আমায় অনুপ্রেরণা জোগাত। বলত, নিজের স্বপ্ন, কল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা যে করে, সে-ই সফল হয়। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার অনুভূতিটা কেমন হবে, সেটা চোখ বন্ধ করে অনুভব করো তো রৌদ্র। দেখবে, তোমার ইচ্ছাশক্তি আর ধৈর্যশক্তি দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আমি সেটাই করতাম। আশ্চর্যজনকভাবে বাবার কথা মিলে যেত। পড়াশোনার প্রতি সমস্ত অলসতা কে’টে যেত। চুপ থেকেও মানুষটা সবসময় আমাকে সমর্থন করত। অথচ তার শেষ সময়টায় আমি তার পাশে থাকতে পারিনি। শেষবারের মতো একবার কথা বলতে পারিনি।”
আবারও রৌদ্রুপের চোখের পানি গড়াল। নৈঋতা প্রসঙ্গ পালটে প্রশ্ন করল,
“কাইলকা সকালে আমারে নিবেন?”
রৌদ্রুপ হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকাল।
“জানাজা কহন হইব?”
“সকাল আটটায়।”
“তাইলে তো সকাল-সকাল যাইতে হইব। আর কাইন্দেন না, থামেন। আপনে কাঁনলে আমারও কান্না পায়। বাবার লাইগা দোআ করেন আল্লাহর কাছে। দেহি, চোখ মোছেন।”
নৈঋতা নিজেই ওড়না দিয়ে রৌদ্রুপের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“ঘুমানের চেষ্টা করেন। নইলে তো আপনের মাথা ব্যথা করব। ঘুমান, চুলে বিলি কা’ইটা দিই।”
নৈঋতা রৌদ্রুপের চুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে বিলি কা’টতে লাগল। রৌদ্রুপ নৈঋতার মুখটা একহাতে আগলে ধরে কপালে কপাল ঠেকাল। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইল। নৈঋতা নড়েচড়ে উঠতেই রৌদ্রুপ মিইয়ে পড়া অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমার বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, নৈঋ। একটু শান্তি দাও।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।