কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৮.
আত্মীয়-স্বজনরা সবাই চলে গেছে। বাড়িতে এখন পরিবারের সদস্যরা ছাড়া অন্য কেউ নেই। এরমধ্যে রৌদ্রুপ-নৈঋতার বাসায় ফেরার কথা উঠলে তিহান কড়াভাবে জানিয়ে দিলো তাদের আর এই বাড়ি থেকে ফেরা হবে না। এখন থেকে এখানেই থাকবে। সরফরাজ চৌধুরীও যে মৃ’ত্যুর আগে এটাই চাইছিলেন। রৌদ্রুপ দ্বিমত করল না। তবে শাহানা খানমের উত্তরের আশায় রইল। তিহান নিজে শাহানা খানমের সাথে কথা বলল। যেভাবে পারল বুঝাল। বাড়ির কর্তা চলে গেছে। বাড়ির বড়ো ছেলে পা হারিয়েছে। মেয়েটা বাবার বাড়ি পড়ে আছে। শশুরবাড়ি থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো লক্ষণই নেই। এমতাবস্থায় এই পরিবারে রৌদ্রুপকে অনেক বেশি দরকার। নৈঋতা মেয়েটা খারাপ নয়। রূপে, গুণে তার কমতি নেই। এটুকু বয়সেই আচার-আচরণ যথেষ্ট পরিপক্ক। মনটাও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এখন তো আবার পড়াশোনাও করছে। খাদটা কেবল পারিবারিক দিকেই। ওসব তথাকথিত খাদ সুন্দর দৃষ্টি আর মানসিকতায় বাঁধে না। ওসব আমলে না নিলে নৈঋতা অবশ্যই রৌদ্রুপের যোগ্য। তিহানের এরূপ কথা আর অনুরোধ শাহানা খানমকে ভাবতে বাধ্য করল। ছেলে তার সম্পূর্ণ ভুল বলেনি। তবু এতদিনের রাগটা একদিনে উড়িয়ে দিতেও পারলেন না। নৈঋতার প্রতি কিছুমাত্র আপত্তি থেকেই গেল। কিন্তু উপায় যে নেই আর। ভেবেচিন্তে তবেই তিনি তিহানকে সমর্থন করলেন। এরপর আর রৌদ্রুপের কথা রইল না। নৈঋতার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিল মেয়েটা মনে-মনে কতটা খুশি হয়েছে। এবার নিজের শ্বশুরবাড়িতে সংসার হবে তার। পরের দুদিনের মধ্যে রৌদ্রুপ তার ভাড়া ফ্ল্যাটের থেকে সমস্ত জিনিসপত্র বাড়িতে নিয়ে এল। নসিবকে নিয়ে সে অন্য ভাবনায় থাকায় তাকেও নিজের বাড়িতে নিয়ে এল। নসিবের উপস্থিতিতে যে সবাই খুশি হবে না, তা তার আগেই জানা ছিল। তাই নিজের চিন্তা-ভাবনা সবাইকে জানাল। সরফরাজ চৌধুরীর মৃ’ত্যু আর তিহানের পা হারানো, দুটো দু’র্ঘট’নার প্রভাব তাদের ব্যবসায় নিশ্চতভাবে পড়বেই। সরফরাজ চৌধুরীর অনেক কষ্টে দাঁড় করানো ব্যবসাটা এত সহজে অবনতির দিকে যাবে, তা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই তিহানের সাথে আলোচনা করে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবার অনুপস্থিতিতে সে তিহানকে ব্যবসায়ের কাজে যথাসম্ভব সাহায্য করবে। সাথে থাকবে নসিব। কারণ রৌদ্রুপের নিজের চাকরি আছে। তার ফাঁকে সময়-সুযোগ বুঝে তবেই সে ব্যবসায়ের কাজে হাত দিতে পারবে। তিহানের মতো সবসময় তো আর সে এসবের পেছনে লেগে থাকতে পারবে না। নসিবকে দিয়ে নিঃসন্দেহে অনেক উপকার হবে তাদের। তাছাড়া ব্যবসায়ের কাজে বিশ্বাসী কর্মী খুঁজে পাওয়া বড়ো দুষ্কর। নসিব নিজেদের লোক। রৌদ্রুপের বিশ্বাস নসিব চূড়ান্ত সততার সাথে নিজের কাজ করবে। তিহান আর রৌদ্রুপের সিদ্ধান্তের পর আর কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। নৈঋতা নিজের ভাইয়ের জন্য খুব চিন্তিত ছিল। এই সিদ্ধান্ত জানার পর রৌদ্রুপের প্রতি তার সম্মানটা যেন আরও একধাপ বেড়ে গেল। মানুষটা যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাকে চিন্তামুক্ত রাখার কথাও ভেবেছে, তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। বেশ কয়েক দিনের মধ্যেই শাহানা খানমের আচরণে কিছু পরিবর্তন সকলেরই চোখে পড়ল। মনে হলো তিনি নিজের রাগের খোলস থেকে একটু-একটু করে বেরিয়ে নৈঋতার সাথে শাশুড়ির মতোই আচরণ করতে শুরু করেছেন। এতে বোধ হয় নৈঋতার অবদানই সবচেয়ে বেশি। এ বাড়িতে থাকতে শুরু করার পর থেকেই মেয়েটা বাড়ির বউ হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করেছে। বাড়ির বি’পদের পরিবেশে সংসারটা দেখেশুনে রাখার ভারটা নির্দ্বিধায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে সংসার। তবু যেন তার কোনো কিছুতেই রা নেই। বরং যথাসম্ভব খুশিমনে সে সবার দিকেই নজর রাখার চেষ্টা করে। মেয়েটার এসব কর্মকাণ্ডই শাহানা খানমের স্বার্থপর বিবেককে নাড়া দিলো। অ’পরাধবোধ হুট করেই জেগে উঠল, কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারলেন না। তবে তার আচরণেই তার মনের ভাব প্রকাশ পেয়ে গেল সবার কাছে। আজকাল তিনি নৈঋতাকে নিদ্রার মতোই গুরুত্ব দেন বাড়ির ছোটো বউ হিসেবে। তিহানের সেবাযত্নে নৈঋতা নিদ্রাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। দুজনের সেবাতেই তিহান অতি দ্রুত বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। এক পা হারানোয় তিহানের চলাফেরায় ক্র্যাচের সাহায্য নিতে হয়। পড়াশোনার ফাঁকে সময় বুঝে নৈঋতা নিজের সাংসারিক দায়িত্ব পালন করারও চেষ্টা করে। মেয়েটা যেন দিন-দিন রৌদ্রুপের মতোই হচ্ছে। তার এ নিঃস্বার্থ স্বভাব নিদ্রার মন গলাতে দারুণ কাজে লাগে। আজকাল এই দায়িত্বশীল ছোটো মেয়েটাকে নিজের ছোটো জা ভাবতে নিদ্রার মন্দ লাগে না। তুলির সাথে মেয়েটার সম্পর্ক যেন মা-মেয়ে। নিদ্রা খুব অবাক হয়, যখন ভাবে এই ছোটো মেয়েটার মাঝে এত সুপ্ত শক্তি ছিল, অথচ তারা বুঝতেই পারেনি। প্রথম দিকে শশী একটু সাত-পাঁচ করলেও; পরবর্তীতে নৈঋতার নম্র ব্যবহারের কাছে তাকেও হার মানতে হয়। সময়ের সাথে নৈঋতা এই পরিবারের সাথে দারুণভাবে মানিয়ে নেয়। নসিবও তিহানের সাথে ব্যবসায়ের কাজে মনোনিবেশ করার পাশাপাশি বোনের শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের একজন হয়ে ওঠে। এর পরের সময়গুলো যায় অনেকটা স্রোতের গতিতেই। মোটামুটি একটা সুখী পরিবার যেন নিজেরাই টের পায় না কীভাবে তাদের জীবন থেকে সময়গুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। নৈঋতার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে হুট করেই শশীর বিয়ে হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিয়ে। তার প্রথম বিয়েটা শেষমেষ টেকেনি। ডিভোর্সটা তাই মেনে নিতেই হয়েছে। তার দ্বিতীয় স্বামীও ডিভোর্সড, তবে বেশ ভালো শ্বশুরবাড়ি জোটে তার ভাগ্যে। বিয়ের পর শশীর সুখের সংসার দেখে তার মা-ভাইয়েরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সরফরাজ চৌধুরীর মৃ’ত্যুর পর মেয়েটার জন্য খুব চিন্তায় থাকতে হত তাদের। নিজ প্রচেষ্টা আর রৌদ্রুপের সহায়তায় নৈঋতার পড়াশোনা চলছে ভীষণ ভালোভাবে। উচ্চ মাধ্যমিকে তার রেজাল্ট আসে সন্তোষজনক। ভাগ্যক্রমে পরবর্তীতে সরকারি ভার্সিটিতেও চান্স মিলে যায়। ভার্সিটিতে পড়াকালীন বছর না গড়াতেই নৈঋতার সুখের জীবনে আরও এক নতুন সুখের দেখা মেলে। তবে এই সুখ বাকিগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অভিন্ন অনুভূতি, যা তার সাথে রৌদ্রুপও অনুভব করে। নৈঋতা মা হতে চলেছে, খবরটা শুধু রৌদ্রুপ-নৈঋতা নয়, তাদের দুজনের পরিবারেই আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে। পরিবারে নতুন সদস্য আসতে চলেছে জানার পর থেকে আদুরে নৈঋতার আহ্লাদ তরতর করে বেড়ে যায় আরও কয়েক ধাপ। শাহানা খানম আর নিদ্রা কড়া আদেশ জারি করেন, নতুন সদস্য আসার আগ পর্যন্ত যেন কোনোক্রমেই সে কোনো কাজে হাত লাগাতে না আসে। রান্নাঘর তার জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাড়ির কাজের মেয়েকে তার পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয় দেখাশোনার জন্য। এছাড়া তুলি তো আছেই। তার প্রতি রৌদ্রুপেরও যত্ন-আত্তি বেড়ে যায় প্রয়োজনের অধিক। নৈঋতার শরীরের ওপর কোনোরকম চাপ যেন না পড়ে, সেদিকে তার কড়া নজরদারি থাকে। মোটামুটি নতুন করে এক দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করে ফেলে সে। সকালে নৈঋতাকে ঘুম থেকে তুলে, খাবার খাইয়ে ভার্সিটি নিয়ে যায়। প্রতিদিন নসিবকে ফোন করে নৈঋতাকে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে আসার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বলা তো যায় না, যদি কাজের ব্যস্ততায় ভুলে বসে থাকে? অফিসের কাজের ফাঁকে বা অবসর সময়ে বারবার ফোন করে নৈঋতার খবর নেয়। রাতে অফিস ছুটির পর প্রায় ছুটে বাড়ি ফিরে আসে। প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর কপালে দীর্ঘ চুম্বন রেখা এঁকে তবেই সারাদিনের ক্লান্ত মনটা শান্ত করে। আলগোছে হাতের মুঠোয় চকোলেট গুঁজে দেয়। প্রয়োজন অনুযায়ী নৈঋতার পড়াশোনার সমস্যাগুলো সমাধান করে দেয় নিরলসভাবে। নিজ হাতে রাতের খাবার খাইয়ে দেয়। নৈঋতার শরীর খারাপ লাগলে তার মাথায় যেন দুশ্চিন্তার পাহাড় জমে ওঠে। ক্রমশ ভারী হওয়া নৈঋতার পেলব শরীরটাকে অতি আদরে বুকে জড়িয়ে শত অভিমান, অভিযোগ, আবদার শোনে। আঙুলে আঙুল রেখে অনাগত সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন সাজায়। চুলের ফাঁকে যত্ন সহকারে বিলি কে’টে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মাঝরাতে নৈঋতার ঘুম ভেঙে গেলে নিজের ঘুম জড়ানো চোখেই প্রেয়সীকে নিয়ে বারান্দায় সময় কা’টায়। নৈঋতার নিষেধ আগ্রাহ্য করে তার নির্ঘুম রাতের সঙ্গী হয়। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত মানুষটাকে অযথা কষ্ট দিতে নৈঋতার খারাপ লাগে। কিন্তু মানুষটার সাথে কা’টানো সময়গুলো সেই খারাপ লাগা নিমিষেই দূর করে দেয়। রৌদ্রুপ যে তার নিষেধ শোনার মানুষ নয়। একটু-একটু করে রোজ কতশত মিষ্টি স্মৃতি জমা পড়ে যায় তাদের ঝুলিতে! প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে নৈঋতার চেকআপের দায়িত্বটা রৌদ্রুপের ওপর ফেলে না রেখে তিহান নিজেই নৈঋতাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। অবশ্য সে নসিবকেও সাথে নিয়ে যায়। বিপদ তো আর বলে-কয়ে আসে না। ক্র্যাচকে সম্বল করে হাঁটা মানুষটা কী করে নৈঋতাকে সামলাবে? তবু তার এটুকু চেষ্টাই যথেষ্ট। ছুটির দিনে একটু-আধটু ঘোরাঘুরি ছাড়া গর্ভাবস্থায় নৈঋতাকে নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় রৌদ্রুপ। ফলস্বরূপ তার গ্রামে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। সামসুদ্দীন বেপারী আর আফিয়া বেগম নিজেরাই নসিবের সাথে শহরে এসে মাঝে-মাঝে মেয়েকে দেখে যান। ছেলে-মেয়ের সুখী জীবন দেখেই যেন তারা তৃপ্ত। নসিব প্রতি মাসে বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠায় জানার পরও রৌদ্রুপ আলাদা করে সবার অগোচরে শ্বশুরের কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এই ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তাদের। এদিকে নিজের ছেলেদের সুখের সংসার শাহানা খানমের চোখে আনন্দের অশ্রু ঝরায়। আনন্দের সঙ্গে কিঞ্চিত দুঃখও মিশে থাকে বটে! তার স্বামী যে দেখে যেতে পারলেন না নিজের ছেলেদের এই সুখে ভরপুর সংসার। চাপা স্বভাবের মানুষটা দেখলে হয়তো মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু আদতে তার চেয়ে বেশি খুশি বোধ হয় কেউ হত না। কথায় আছে, অতিরিক্ত হাসি কান্নার আগাম বার্তা। কথাটাকে সত্যি করে তুলে অতিশয় সুখের মাঝেই হঠাৎ এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয় এই সুখী পরিবার। তখন নৈঋতার গর্ভাবস্থার সাত মাসের কিছু বেশি। দিনটি শুক্রবার। রৌদ্রুপের ছুটির দিন, বিধায় সিদ্ধান্ত নিল নৈঋতাকে নিয়ে একটু বাইরে বেরোবে। ঘোরাঘুরি করে মেয়েটার জন্য একটু কেনাকা’টাও করবে। বিকালের দিকে তারা বেরুল। রৌদ্রুপ গত মাসে নিজের উপার্জনের টাকায় একটা প্রাইভেট কার কিনেছিল। সেটা নিয়েই বেরুল। প্রথমে গেল একটা খোলামেলা পার্কে। নৈঋতার হাত ধরে ধীরে-ধীরে সম্পূর্ণ পার্ক ঘুরে বেড়াল। নৈঋতার হাতে পপকর্নের প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। নৈঋতা মুখ কুঁচকাল। তার যে ফুসকা, চটপটি চাই। সামনের দোকানে এত মজার খাবার রেখে তার বর মশাই কি না পপকর্নের প্যাকেট ধরিয়ে দিলো! রৌদ্রুপ বলল,
“বাইরের এসব খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর নৈঋ। তোমার শরীরের ক্ষতি মানে বাবুরও ক্ষতি। জেনেশুনে আমি তোমাদের ক্ষতি কী করে হতে দিই? আমি বাড়ি ফিরে ভাবিকে বলব। ফুসকা, চটপটি যা খাবে ভাবি বানিয়ে দিবে। বাড়ির মতো তো বাইরে অত সতর্কতা অবলম্বন করে খাবার বানায় না।”
নৈঋতার একটু মন খারাপ হলেও তা প্রকাশ করে না। তার প্রতি মানুষটার যত্ন আর চিন্তা দেখলেই মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে যায়। স্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পেরে রৌদ্রুপ মুচকি হাসল। একহাতে আগলে ধরে আদুরে গলায় বলল,
“একবার বাবু আসুক, তারপর আর কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করব না। প্রমিস।”
নৈঋতা মিনমিনে গলায় বলল,
“তহন তো আপনের বাবুর লাইগাই চকোলেট নিয়া কূল পাইবেন না। আমার কতা মনে থাকব?”
রৌদ্রুপ শব্দ করে হেসে উঠল। কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলল,
“বাবুর আগে কিন্তু বাবুর আম্মুকেই আমি ভালোবেসেছি। ভুলে যাওয়া কি সম্ভব?”
অনেকটা সময় ঘুরে-ফিরে তারা একটা মার্কেটে ঢুকল। কেনাকা’টার মাঝে রৌদ্রুপ জানাল তার এক বন্ধু মার্কেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে যেতে বলেছে। তার সাথে না কি একটা বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। নৈঋতার কথা ভেবে রৌদ্রুপ তার বন্ধুকে বলেছিল মার্কেটের ভেতরে আসতে, কিন্তু সে রাজি হয়নি। রৌদ্রুপ নৈঋতাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলে নৈঋতাই বাধা দিলো। রৌদ্রুপকে একাই যেতে বলল, তার এত হাঁটাহাঁটি ভালো লাগছে না। রৌদ্রুপ আসতে-আসতে সে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পছন্দ করবে। তাতে নিশ্চয়ই যথেষ্ট সময় লাগবে। রৌদ্রুপ আপত্তি জানাল না। নৈঋতাকে আশ্বাস দিলো সে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবে। নৈঋতাকে মার্কেটের দোতলায় রেখে সে বাইরে এসে বন্ধুকে কল করল। বন্ধু জানাল মার্কেট থেকে আরেকটু দূরে সে অপেক্ষা করছে। রৌদ্রুপ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মার্কেটের দিকে তাকাল। নৈঋতাকে রেখে যেতে কিছুতেই ভরসা পাচ্ছে না। তবু বন্ধুর কাছে এগিয়ে গেল। গিয়ে জানল তার বন্ধু একটা বাজে ঝামেলায় পড়েছে। নিজেরই এক আত্মীয়ের সাথে তার ঝামেলা বেঁধেছে। সেই আত্মীয় এই মার্কেটেই চাকরি করে। সে রৌদ্রুপের কাছে এসেছে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ নিতে। তার মাথায় কিছুই আসছে না। রৌদ্রুপ সবসময়ই এসব বিষয়ে পাকা। যেকোনো বিষয়ে বন্ধুদের সঠিক পরামর্শ দিতে সে সদা তৎপর। মনোযোগ দিয়ে বন্ধুর সমস্যার কথা শুনে সে চট করে পুরো সমাধান ভেবে নিল। শব্দগুলো গুছিয়ে যখন বলতে শুরু করল, ঠিক তখনই অদূর থেকে অনেক মানুষের আ’র্তনা’দ কানে ভেসে এল। রৌদ্রুপ আর তার বন্ধু চকিতে থমকে গেল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল কোথা থেকে এমন দলবদ্ধ চিৎকার, চেঁচামেচি ভেসে আসছে। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে অনেকটা সময় লাগল। শব্দের উৎসস্থল আন্দাজ করতে পেরেই সে পা ঘুরিয়ে উলটো পথে প্রাণপণ ছুটল। পেছন থেকে তার বন্ধু ডাকারও সুযোগ পেল না। প্রবল ঝড়ের বেগে ধেয়ে এসে মার্কেটের সামনে দাঁড়াল রৌদ্রুপ। ততক্ষণে মার্কেটের দোতলায় আ’গুনের শিখা দাউদাউ করে বেড়ে চলেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক মুহূর্ত সেই অ’গ্নিশিখার পানে চেয়ে থাকল রৌদ্রুপ। চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল প্রিয়তমা স্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা। মেয়েটা তার জন্য অপেক্ষা করছে ভেবেই আবার ছুট লাগাল। পা দুটো টলছে, সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হবার জোগাড়। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে সমস্ত শক্তি হারাবে। তবু দিক-বিদিক ভুলে ছুট লাগিয়েছে মার্কেটের ভেতরের দিকে। কিন্তু সে সফল হলো না। কোথা থেকে দুজন লোক এসে তাকে জাপটে ধরল। জোরপূর্বক টানতে-টানতে নিয়ে গেল আবার মার্কেটের বাইরে। রৌদ্রুপের মাথায় তখন রাগ চড়ে বসেছে। লোকগুলোর ওপর সে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। কোনোভাবেই যখন তাদের হাত থেকে ছাড় পেল না, তখন অনুনয়-বিনয় করে বলল তার স্ত্রীকে দোতলায় রেখে গিয়েছিল সে। লোকগুলো তবু তাকে ছাড়ল না। বলল ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসেছে। তারা নিজেদের কাজে লেগে পড়ছে। জীবিত বা মৃ’ত থাকলে তাদের সবাইকেই উদ্ধার করবে। রৌদ্রুপের ভয় তরতর করে আরও বেড়ে গেল। বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসছে। কাঁপুনি হচ্ছে ক্রমাগত। নিঃশ্বাসটা ফেলতেও যেন তার কষ্ট হচ্ছে। এত ভীড়ের মধ্যে নিশ্চয়ই নৈঋতা ভারী শরীর নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে বেরোতে পারেনি। অতিরিক্ত উত্তেজনায় অবচেতন মানসপটে ভেসে উঠল জীবনের সবচেয়ে নি’র্ম’ম দৃশ্যটি। জ্ব’ল’ন্ত আ’গু’নের ক’বলে পড়ে ছটফট করছে নৈঋতা। গলা ফাটিয়ে আ’র্তনা’দ করে সাহায্য চাইছে, কিন্তু কেউ নেই তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। সবচেয়ে ভরসার হাতটাও কোথাও নেই। মিছে আশায় সে নিজের ভরসাযোগ্য, ভালোবাসার মানুষটির নাম জপতে-জপতেই ছটফট করছে। নির্দয় আ’গু’নের শিখা তার এই করুণ কান্না শুনল না। দাউদাউ করে ছড়িয়ে পড়ল রৌদ্রুপের মেঘবতীর ছোট্ট শরীরে। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছেও সে নিজের মানুষটাকে কাছে ডাকছে, শেষবারের মতো। জ্ব’লেপু’ড়ে যাওয়া হাতটা পেটে চেপে ওই মানুষটার ভালোবাসার অস্তিত্ব বাঁচাতে চাইছে। কিন্তু সে ব্যর্থ। না নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে, না রৌদ্রুপের অনাগত অস্তিত্বটাকে। তারপর? গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল রৌদ্রুপ। চারপাশের আ’র্তচিৎকারের মাঝেই তার কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হলো তারই করুণ কন্ঠের ডাক, নৈঋ! নৈঋ! ছাড় পাওয়ার জন্য ছটফট করতে-করতে সে পা ছড়িয়ে নিচে বসে পড়ল। এক বউ পাগল ছেলের বুকফাটা আ’র্তনা’দ, করুণ হাহাকার দেখে চারপাশের মানুষ উৎসুক হয়ে এগিয়ে আসছে। ব্যথিত দৃষ্টিতে দেখছে, কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কেবল নিজেদের মধ্যে আফসোস করছে, দুঃখ প্রকাশ করছে। এরমধ্যে নসিবও চলে এসেছে। রৌদ্রুপকে সামলাবে কী, সে এসে নিজেই হতভম্ব হয়ে রৌদ্রুপের পাশে বসে পড়ল। পুরোদস্তুর বোবা বনে গেল। এই তো আজ সকালেই অফিসে যাওয়ার আগে তার বোনটা কত হাসিখুশি মনে তাকে বিদায় জানাল। তখনও যদি সে জানত তার বুবু তাকে চিরতরে বিদায় জানাচ্ছে, তবে কোনো মূল্যেই সে আজ তার বুবুর থেকে দূরে যেত না। টলমলে চোখে শূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল চোখের সামনের জ্ব’ল’ন্ত অ’গ্নিকাণ্ডে। অ’গ্নিনির্বাপক বাহিনী এসে আ’গুন নেভানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। চারদিকে স্বজনদের আহাজারি। ভারী বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে পো’ড়া গন্ধ। চিৎকার করে-করে রৌদ্রুপ পাথর বনে গেছে। এখন সে মেঝেতে মৃ’ত দৃষ্টি মেলে অনুভূতিশূন্য ভঙ্গিমায় নত মস্তকে থম মে’রে বসে আছে। তার আদুরে রানিটাকে না দেখতে যে তার শক্তি ফিরবে না।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৯.
চারপাশের করুণ আ’র্তনা’দের মাঝে হঠাৎ নসিবের কন্ঠের ‘আপা’ ডাকটা অতিশয় অবিশ্বাস্য ঠেকল রৌদ্রুপের কানে। তড়াক করে মাথা তুলতেই সে নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারল না। তার সামনে এ কে দাঁড়িয়ে আছে? সত্যিই কি নৈঋতা এসেছে? কল্পনা নয় তো? রৌদ্রুপের স্তব্ধ অবস্থার মাঝেই তাকে দুটো কোমল হাত টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। চির পরিচিত স্পর্শ অনুভব করতেই রৌদ্রুপের চেতনা ফিরল। বুকের ওপর থেকে মস্ত বড়ো এক পাথর নেমে গেল। বন্ধ হওয়া দমটা পুনরায় সচল হলো। সেই হাত দুটোর বদৌলতে রৌদ্রুপ উঠে দাঁড়াল। খপ করে ওই চিন্তাগ্রস্ত কোমল মুখটা নিজের দুহাতের মধ্যখানে চেপে ধরল। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে ভ’য়া’র্ত চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় ডাকল,
“নৈঋ!”
পরক্ষণেই ব্যস্ত হয়ে নৈঋতার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে তবেই আশ্বস্ত হলো। নৈঋতার মাথায়, গালে পাগলের মতো হাত বুলিয়ে উদগ্রীব হয়ে শুধাল,
“ঠিক আছো তুমি? কীভাবে বেরুলে? লাগেনি তো কোথাও? তাপ লেগেছে? কষ্ট পেয়েছ? শরীর খারাপ করছে না তো?”
নৈঋতার চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মানুষটার মনের অবস্থা টের পেয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠছে। কত ভয় পেয়েছে মানুষটা! নৈঋতার চোখে পানি দেখে রৌদ্রুপের উদ্বিগ্নতা বাড়ল। পাশ থেকে নসিব রৌদ্রুপকে থামানোর চেষ্টা করছে। নৈঋতা রৌদ্রুপের এক হাতের বাহু শক্ত করে ধরে আশ্বস্ত করল,
“আমার কিচ্ছু হয়নায়। দ্যাহেন, একদম ঠিক আছি আমি। আপনে শান্ত হন তো। আহেন।”
নৈঋতা আর নসিব মিলে রৌদ্রুপকে ধরাধরি করে মার্কেটের একপাশে দাঁড় করানো গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। নৈঋতা নসিবকে বলল দোকান থেকে ঠান্ডা পানির বোতল কিনে আনতে। এই উদ্বিগ্নতা নিয়ে রৌদ্রুপ গাড়ি চালাতে পারবে না। একটু অপেক্ষা করে রৌদ্রুপ শান্ত হওয়ার পর রওয়ানা দিবে ভেবে নৈঋতা রৌদ্রুপকে নিয়ে পেছনের সিটে উঠে বসল। রৌদ্রুপ ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিটে শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। দুহাতে মুখ ঢেকে বড়ো-বড়ো দম নিতে লাগল। নৈঋতা রৌদ্রুপের হাত দুটো টেনে সরিয়ে আনল। চোখের পানিতে ভিজে আছে সমস্ত মুখ। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে। আ’ত’ঙ্কে এখনও রৌদ্রুপের শরীর কাঁপছে, চোখের পানি ঝরছে। নৈঋতা রৌদ্রুপের চোখের পানি মুছে দিলো। ধরা গলায় বলল,
“এইটুকেই এত ভয়! সত্যি সত্যিই মইরা গেলে কী করতেন? আ’গুন থিকা না হয় বাঁচলাম, বাবু আসার সময় যদি ম’ইরা যাই? তহন কী করবেন? সইহ্য করা লাগব না?”
রৌদ্রুপ ফট করে রেগে গেল। ঝটকা মে’রে নৈঋতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে রাগত স্বরে ডাকল,
“নৈঋ।”
নৈঋতার ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কেঁপে উঠল। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল। রৌদ্রুপ ঝুঁকে পড়ে নৈঋতার পেটে হাত বুলিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর সোজা হয়ে বসে নৈঋতার ছোট্ট মুখটা নিজের দুহাতের আঁজলায় নিল। আলগোছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো পাতলা ঠোঁট জোড়ায়। অতঃপর কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
“আমার সব ভেসে যাক। শুধু তুমি থেকে যেয়ো। তুমি হারিয়ে গেলে যে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলব। তখন আর কোনোকিছুই আমার কাজে লাগবে না। আমাকে বাঁচাতে হলে থেকে যেয়ো নৈঋ।”
নৈঋতা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। বাচ্চা জন্মের সময় যদি সত্যি সত্যিই কিছু একটা হয়ে যায়, তবে? মানুষটার এই মাত্রারিক্ত ভালোবাসা হারিয়ে সে কীভাবে হারিয়ে যাবে? এই মানুষটা তো একদম ভালো থাকবে না। রৌদ্রুপের প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে দুহাতে শার্ট আঁকড়ে ধরে নৈঋতা কান্না থামানোর প্রয়াস চালাল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“কী কন এইগুলা? একদিন ম’র’তে হইব না? এমন কতা কইবেন না, আমার ডর লাগে।”
রৌদ্রুপ খুব সাবধানে নৈঋতাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তাহলে আমার কেমন লাগছে বুঝতে পারছ?”
নসিবকে আসতে দেখে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। নসিব এসে রৌদ্রুপের হাতে পানির বোতলটা দিলো। রৌদ্রুপ সেটা আগে নৈঋতাকে দিতে গিয়েও বেশি ঠান্ডা দেখে দিলো না। এত বেশি ঠান্ডা খাওয়া ঠিক হবে না। অগত্যা নিজেই বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে অর্ধেকটা পানি খেয়ে নিল। নসিব খাবে না বলায় বাকিটা নৈঋতার জন্য রেখে দিলো। ঠান্ডা ভাবটা একটু ছাড়লে খেতে দিবে।
বাড়িতে যখন নৈঋতার ঘটনাটা জানানো হলো, তখন সবাই আ’ত’ঙ্ক প্রকাশ করল। সবাই সমস্ত রাগ ঝাড়ল রৌদ্রুপের ওপর। সে কেন নৈঋতাকে একা ছাড়ল, এটাই তার দোষ। নৈঋতার বাবা-মা তো ফোনে ম’রাকান্না জুড়ে দিলো। শাহানা খানম কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন, সুস্থ হওয়ার আগে কলেজ ছাড়া অন্য কারণে যেন নৈঋতা বাইরে কোথাও না যায়। ভাগ্য অনুকূলে ছিল বলে, নয়তো আজকের পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ হতে পারত। রৌদ্রুপ নিজেও এখনও আ’ত’ঙ্ক থেকে বেরোতে পারেনি। রাতেও নৈঋতাকে বুকে চেপে ধরে আ’ত’ঙ্ক প্রকাশ করতে লাগল। ভ’য়া’র্ত চোখ জোড়ায় যেন আজ ঘুম নেই। নৈঋতা ভালোবাসার স্পর্শে রৌদ্রুপের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“রাগ কইরেন না, একখান কতা কই। একটা মাইয়ার জীবনের সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হইলো সন্তান জন্ম দেওয়া। হায়াত থাকলে কেউ বাঁইচা আহে, না থাকলে ওই অছিলায়ই ম’র’ণ হয়। এইডা বাস্তব কতা। আল্লাহ্ না করুক আমার যদি কিছু একটা হইয়া যায়, তাইলে তো আপনের শক্ত থাকতে হইব। আমগো সন্তানরে বুকে রাইখা মানুষ করতে হইব। আপনে কোনোদিনও ওরে মায়ের অভাব বুঝতে দিবেন না। আমি জানি আপনে পৃথিবীর সবচাইতে ভালো বাবা হইবেন।”
রৌদ্রুপ হাতের বাঁধন একটুখানি শক্ত করে মিইয়ে পড়া ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
“আমি পারব না নৈঋ। তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু পারব না আমি। আমার বাবুকে বড়ো করতে তার আম্মুকেই লাগবে। বাবুর আম্মুকে ছাড়া আমার জীবন প্রাণহীন হয়ে পড়বে। তোমার দুটো হাতে ধরি নৈঋ, এসব বোলো না। আমার দমবন্ধ লাগে।”
নৈঋতা মাথা তুলে রৌদ্রুপের চোখের দিকে তাকাল। অস্থির হয়ে বলল,
“আপনের পারতে হইব, আমার লাইগা পারতে হইব। ও আপনের-আমার ভালোবাসার চিহ্ন।”
রৌদ্রুপ একহাত এগিয়ে নৈঋতার ডান গালে আলতো করে রাখল। শান্ত স্বরে বলল,
“পৃথিবীতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মেয়েরা মা হয়। তারা নিজেদের সন্তান নিয়ে কয়েক যুগ বেঁচেও থাকে। মা হলেই সবাই চলে যায় না, নৈঋ। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। তোমার কিচ্ছু হবে না, দেখো। তুমি, আমি আর আমাদের ছোট্ট একটা বাবু, আমরা তিনজন এই ঘরে থাকব। দিনের বেলায় তুমি বাবুকে সামলাবে, রাতে আমি। তাছাড়া প্রতিদিন আমার বুকের বাঁ পাশটায় ঘুমানোর জন্য বাবুর আম্মুকে লাগবেই। বি পজিটিভ মেঘবতী।”
নৈঋতার দুচোখ টলমল করে উঠল। এই মানুষটা তাকে এত বেশি কেন ভালোবাসে? মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসায় য’ন্ত্র’ণাও বেশি, তা কি সে জানে না? তার চোখের কোল ঘেঁষে গড়াতে চাওয়া অশ্রুকণাটা রৌদ্রুপ চট করে মুছে ফেলল। কন্ঠে মেকি রাগ টেনে গম্ভীর মুখে বলল,
“আমি রেগে যাচ্ছি নৈঋ। ঘুমাও, রাত জেগে বকবক করতে হবে না। ইদানিং তুমি বড্ড নেগেটিভ হয়ে পড়ছ। চুপচাপ ঘুম দাও, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার মাথাটা পুনরায় নিজের বুকে রাখল। নৈঋতা ঠোঁট ফুলিয়ে তীব্র অনীহা প্রকাশ করল।
“ঘুম নাই চোখে, চলেন বৃষ্টিতে ভিজি।”
রৌদ্রুপ গোল-গোল চোখে চাইল। অবাক কন্ঠে শুধাল,
“তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছ?”
“হ, ওঠেন।”
নৈঋতা উঠে বসে রৌদ্রুপকেও উঠতে তাড়া দিলো। রৌদ্রুপ উঠে বসে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এই, তুমি সিরিয়াস? তুমি তো বৃষ্টি পছন্দ করো না।”
“উফ্! এত কতা কন ক্যান? আপনে যাইবেন কি না কন। নইলে আমি একলাই গেলাম।”
নৈঋতা বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে হাঁটা ধরতেই রৌদ্রুপ হুড়মুড় করে গিয়ে তার হাত টেনে ধরল।
“হয়েছে, রাগ দেখাতে হবে না। আমিই নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বেশি ভেজা যাবে না। ঠান্ডা লেগে গেলে পরে আবার আরেক সমস্যা।”
“অহনও নিলই না, আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করতাছে।”
নৈঋতার কথা শুনে রৌদ্রুপ হেসে তার গালটা আলতো করে টিপে দিলো। তারপর হাত ধরে নিয়ে গেল সদর দরজার কাছে। শব্দ না করে সন্তর্পণে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাড়ির বাইরে। নৈঋতার হাত শক্ত করে ধরে খুব সাবধানে নেমে পড়ল ঝুম বৃষ্টির নিচে। বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠানের মাঝখানটায় দাঁড়াল তারা। দুই পাশে সব ফুলে ভরা গাছের সারি। বৃষ্টিবিমুখ নৈঋতা শেষ কবে এমন ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভিজেছিল, তা এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। বহু বছর হয়ে গেছে বোধ হয়। এতগুলো বছর পর ঝুম বৃষ্টির একেকটা ফোঁটার শব্দ যেন নৈঋতার কানের কাছে উল্লাসের গান গেয়ে উঠল। সারা শরীর কাঁ’টা দিয়ে উঠল তার। দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে সে শরীরের সাথে মনটাকেও ভিজিয়ে নিল এই অপূর্ব বর্ষণে। সামনে দাঁড়িয়ে রৌদ্রুপ অপলক চেয়ে তার বৃষ্টি বিলাসী মিষ্টি মেঘবতীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর অকৃত্রিম উচ্ছাস দেখছে। এ যেন সম্পূর্ণ নতুন এক সফেদ মেঘের টুকরো। কী প্রফুল্ল তার চিত্ত! এই অপরূপ বর্ষণের অসাধারণ সৌন্দর্যও যেন হার মেনেছে ওই ছোট্ট পেলব তনুর কাছে। এগিয়ে গিয়ে নৈঋতার ভেজা কপালে নিজের আর্দ্র ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো রৌদ্রুপ। প্রসারিত হাত নামিয়ে নিয়ে বলল,
“হয়েছে আমার লক্ষ্মী বউ, এবার চলো।”
নৈঋতা জেদ ধরে বসল। শক্ত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল ওই জায়গাতেই। বায়না করল আরও কিছুক্ষণ ভিজবে। কিন্তু রৌদ্রুপ নারাজ। এই অবস্থায় ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেলে বিপদ। অসুখ বাঁধলে বউকে নিয়ে তার হাঁসফাঁস করা লাগবে, মায়ের বকুনিও তাকেই খেতে হবে। নৈঋতা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বাবুর আম্মুর লাইগা ওইটুকু বকা মধু মনে কইরা গিলে ফেলবেন।”
“তোমার হঠাৎ অপছন্দের বৃষ্টিকে এত মধুর মতো লাগছে কেন শুনি?”
“জানি না। ইদানিং বৃষ্টি ভালা লাগে।”
“তাহলে তো আমার ভবিষ্যতবাণী মিলে গেল।”
“কী?”
“একদিন বলেছিলাম, আমার সাথে থাকতে-থাকতে একদিন তোমারও বৃষ্টি ভালো লাগবে। দেখলে? ঠিকই তোমার মন পালটে গেল।”
নৈঋতা দাঁত বের করে হাসল। রৌদ্রুপের গলায় দুহাত বেঁধে ঝুলে পড়ে বলল,
“এমন একটা মানুষ যার আছে, তার মন না পালটায়া উপায় আছে?”
রৌদ্রুপ অতি সাবধানে নৈঋতার কোমর জড়িয়ে হাসিমুখে বলল,
“হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু আমি এখন মোটেও গলছি না বাবুর আম্মু। দুঃখিত।”
চট করে নৈঋতাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে রৌদ্রুপ বাড়ির ভেতরে হাঁটা দিলো। নৈঋতা বাচ্চাদের মতো পা দুলিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“অহন না, আরেকটু থাকেন। আরেকটু, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। কী হইব আরেকটু দেরি করলে? একটুও ভালোবাসে না আমারে। বাবু-ই সব, আমি কেউ না। বুঝি তো।”
নৈঋতার অভিযোগ শুনে রৌদ্রুপ হেসে ফেলল। তাল মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি আমার বাবুর যত্নই নিচ্ছি। বাবুর আম্মু তো এখন বুড়ি হয়ে যাচ্ছে, তাই ভালোবাসা কমে গেছে।”
নৈঋতা রাগত দৃষ্টিতে তাকাল। রৌদ্রুপ ফিক করে শব্দ তুলে হেসে বলল,
“মাফ করুন বুড়ি বউ।”
নৈঋতাকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে ওই দুর্ঘটনার কারণে শপিং না করেই ফিরে এসেছিল বলে রৌদ্রুপ আজ নিজেই নৈঋতার জন্য শপিং করে নিয়ে এসেছে। দুইটা শাড়ি, দুইটা সুতি ড্রেসের সাথে টুকটাক কিছু কসমেটিকস। সেসব দেখে নিদ্রার কিঞ্চিত মন খারাপ হয়। আজকাল তিহান নিজে তার জন্য তেমন কিছু কিনে আনে না। চলাফেরায় কষ্ট হয় বলে অফিস ছাড়া কোথাও পা রাখে না সে। নিদ্রার কিছু দরকার পড়লে টাকা ধরিয়ে দেয়। রৌদ্রুপ যেমন রোজই নৈঋতার জন্য এটা-ওটা নিয়ে আসে। তিহানও আগে মাঝেমাঝে এমনটা করত। ইদানিং নৈঋতার ভাগ্যকে বড়ো হিংসা হয় নিদ্রার। তার কপালটা এমন কেন হলো? তিহান মানুষটা তো তার চেয়ে হাজার গুণ ভালো। সেই মানুষটার সাথেই এই বয়সে এমন খারাপ কিছু হতে হলো? নিদ্রার আরো খারাপ লাগে যখন তুলি আগের মতো যখন ইচ্ছে তখন বাবার হাত ধরে এখানে-ওখানে ছুটাছুটি করতে পারে না। যদিও রৌদ্রুপ নিজের সময় বুঝে তুলিকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। তবু, বাবা তো বাবাই। তিহান নিদ্রার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। এই বয়সী একটা মেয়ের চোখের সামনে নিজের স্বামী পা হারিয়ে বসে আছে, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তার জন্য সুখকর নয়। যথেষ্ট ব্যথাদায়ক। তিহানের নিজেরও যে খারাপ লাগে স্ত্রী, মেয়ের কথা ভেবে। তবু ভাগ্যকে সবারই মেনে নিতে হয়। নিদ্রা যে হুট করে বদলে যাওয়া ভাগ্যকে এভাবে মেনে নিবে, এতটাও আশা তিহানের ছিল না। বরাবরই সে ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে। এই তো তিহান যখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল, তখনও ঘন্টার আগায়-মাথায় তিহানের সাথে কথা কাটাকাটি করতে তার বাঁধত না। অথচ তিহানের অসুস্থতার পর থেকে আজ পর্যন্ত মেয়েটা তিহানের সামনে এ-ও মুখে তোলেনি যে, তিহানকে এভাবে দেখতে তার ভালো লাগে না। মনের ব্যথাটুকুও সে যেচে প্রকাশ করে না। বরং তিহান যখন এ বিষয়ে কথা তোলে তখন তার বুকে মুখ গুঁজে একচোট কেঁদে মনের সমস্ত ব্যথা বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করে। নিজের মনের সকল খারাপের মধ্যেও মেয়েটার সবচেয়ে সুন্দর দিকটাই ছিল বোধ হয় তিহানকে মনেপ্রাণে ভালোবাসা। তিহানের বাঁধন ছাড়তে না পারা। এ-ই বা কম কিসে? নিখাদ ভালোবাসারা বোধ হয় মানুষের ভালোসহ খারাপ দিকগুলোও এভাবেই জয় করে নেয়।
ওদিকে রৌদ্রুপ নতুন শাড়ির মধ্য থেকে একটা নিয়ে তখন থেকে নৈঋতার পেছন-পেছন ঘুরছে। শাড়িটা টুকটুকে লাল রংয়ের। রৌদ্রুপ এটা খুব শখ করে কিনেছে। শাড়িটা দেখেই তার ইচ্ছে জেগেছে নৈঋতাকে এই শাড়িতে একবার দেখার। অনেকদিন হলো মেয়েটাকে সে শাড়ি পরিহিতা দেখে না। শরীর ভার হওয়ার পর থেকেই শাহানা খানমের আদেশে সে ঢিলাঢালা সুতি ড্রেস পড়া শুরু করেছে। এতদিন পর হুট করে যখন অসময়ে রৌদ্রুপ শাড়ি পরার কথা বলল, তখন নৈঋতার ভারী শরীরটা যেন অলসতায় আরও এক গুণ ভার হয়ে গেল। চরম অনীহা নিয়ে সে উলটো অনুরোধ করল অন্য একসময় পড়বে বলে। কিন্তু রৌদ্রুপ আজ নাছোড়বান্দা। তার আজ ইচ্ছে জেগেছে মানে আজই তা পূরণ করতে হবে। নৈঋতা হাত-পা গুঁজে বিছানায় ঠাঁয় গুটিয়ে পড়ে আছে। রৌদ্রুপ তার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ও মেঘবতী, ওঠো না।”
নৈঋতা অসহায় চোখ তুলে ঠোঁট উলটে বলল,
“আমার শরীর চলব না অহন। ভালা লাগে না।”
“তুমি তো বললে শরীর ভালো আছে।”
“আইলসামি লাগতাছে।”
“আচ্ছা, আমি নিজেই পরিয়ে দিবো। তুমি শুধু দাঁড়িয়ে থেকো।”
“তবু পরাইতে হইব?”
“হুঁ। বেশিক্ষণ পরিয়ে রাখব না।”
“প্রমিস?”
“প্রমিস।”
“তবু ওঠতে ইচ্ছা করতাছে না আমার,” নাকি সুরে বলল নৈঋতা।
“আমার লক্ষ্মী বউটা, এসো।”
নৈঋতাকে দুহাতে আগলে বিছানা থেকে তুলল রৌদ্রুপ। কাঁচা হাতে শাড়ি পরাতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠল। কুঁচিকে তো কুঁচি বলাই যায় না। কোনোরকম পেঁচিয়ে যেভাবে পারল, সেভাবেই শাড়ি পরিয়ে দিলো। নৈঋতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। সে নিজেও যে আজও গুছিয়ে শাড়ি পরতে পারে না। এদিক থেকে দুজনেই আনাড়ি। শাড়ি পরানো শেষ হলে নৈঋতাকে ধীরে-ধীরে নিয়ে আয়নার সামনে বসাল রৌদ্রুপ। তারপর তার চুলে চিরুনি চালিয়ে যত্ন করে পিঠময় ছড়িয়ে দিলো। কাজল হাতে নিয়ে ভয়ে-ভয়ে চোখে লাগাতে গিয়েও হাত থামিয়ে চিন্তিত মুখে বলল,
“এটা বরং তুমি লাগাও। আমি দিলে যদি চোখের ভেতরে খোঁ’চা লাগে?”
নৈঋতা হেসে বলল,
“কিছু হবে না। ধীরে-ধীরে লাগান।”
নৈঋতা দেখিয়ে দিলে রৌদ্রুপ সাহস করে ধীর হাতে চোখে কাজল লাগাল। এই কাজে লেগে বেচারার নাকের ডগাসহ নাকের নিচে ঘাম জমে গেছে। নৈঋতা আবার সেই ফাঁকে ঘামটুকু মুছিয়ে দিয়েছে। দুই চোখে কাজল পরানোয় সফল হয়ে রৌদ্রুপের মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি ফুটল। হাঁফ ছেড়ে বলল,
“তোমাদের মেয়েদের সাজগোজ এত কঠিন কেন? শাড়ি আর কাজল পরাতে গিয়েই ঘেমে গেলাম, না জানি মেয়েরা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে মেকআপ করে কীভাবে! ভালো হয়েছে তুমি অত মেকআপ করো না। বাপ রে! জটিল কাজ।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।