ক্লিওপেট্রা পর্ব- ০৮

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৮

রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল ক্লিওপেট্রা এখনো এলো না। মা ওর সঙ্গে কী এমন কথা বলছে কে জানে! ও আবার মাকে ওর জীবন কাহিনী এ টু জেড সব বলে দিল না তো! তাহলেই সব শেষ। এ দুঃশ্চিন্তায় বাকি রাতটুকু আমার আর ঘুম হয়নি।

সকাল আটটার দিকে ক্লিওপেট্রা আমার ঘরে এল। ঘরে ঢুকতেই দেখলাম গতকালকের পড়নের এলোমেলো লাল শাড়িটা সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে পড়নে। আমার তাকানো দেখে ও বোধহয় কিছু বুঝল। আমাকে বলল, ‘মা পড়িয়ে দিয়েছে।’

আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাতে মা তোমাকে ডেকে নিয়ে কী বলল?’

ক্লিওপেট্রা মুচকি হাসল। বলল, ‘তেমন কিছু না। জিজ্ঞেস করল, আমাদের সম্পর্ক কতদিনের।’

‘তুমি কী বলেছ?’

ও বলল, ‘মিথ্যে বলেছি। বলেছি দু’বছরের প্রেম।’

আমি বললাম, ‘মা আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি?’

ও হাসল, ‘হ্যাঁ। বলল তুমি কি বিদেশী?’

‘তারপর? ‘

‘তারপর আমি বলেছি হ্যাঁ। উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন কোন দেশী? আমি বলেছি, মিশরীয়। ‘

‘সবটুকু বলো।’

ক্লিওপেট্রা বলতে লাগল,
‘এরপর মা বললেন, তাহলে তুমি এত ভালো বাংলা কীভাবে বলো। আমি উত্তর দিয়েছি, তোমার সঙ্গে পরিচিত হবার পর শিখেছি। যাতে আমাদের কমিউনিকেশনে কোনো প্রবলেম না হয়।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ক্লিওপেট্রা আমাকে সত্যি করে বলো তো তুমি এত ভালো বাংলা কীভাবে পারো?

ক্লিওপেট্রা লজ্জা পাবার ভঙ্গিতে বলল, ‘এই প্রশ্নের উত্তরটা মা’কে সত্যিটাই দিয়েছি। তোমার সাথে যোগাযোগে যাতে সমস্যা তৈরি না হয় সেজন্যই শিখে নিয়েছিলাম।’

আমি বললাম, ‘এত দ্রুত?’

ও বলল, ‘দ্রুত কই! ছ’মাস লেগেছে পুরোপুরি ভালো করে শিখতে। এখন আমি তোমার চাইতেও ভালো বাংলা পারি।’
বলে ও শব্দ করে হাসলো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘লিখতে পারো?’

ও জবাব দিল, ‘হুম। সব পারি। একটু পরেই দেখবে।’

‘কী দেখব?’

ও উত্তর দিল না।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা তোমাকে তোমার বাবা-মা’র ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?’

‘করেছে। বলেছে, তোমার বাবা-মা কী মিশরেই থাকে? আমি বলেছি, তারা আর বেঁচে নেই।
এরপর মা আর কিছু জিজ্ঞাসা করেন নি। আমাকে বলল, এসো ভালো করে শাড়িটা পরিয়ে দেই।’

এরপর ক্লিওপেট্রা আমাকে শাড়িটা দেখিয়ে বলল, ‘দেখো! মা কি সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দিয়েছেন! ‘

আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল।


সকাল দশটার দিকে মা হঠাৎ আমার ঘরে এসে বলল, ‘আহান জলদি তৈরি হয়ে নে। আর হ্যাঁ আলমারিতে তুলে রাখা একটা সোনালী রঙের নতুন পাঞ্জাবি আছে না? সেটা পরিস।’

আমি বললাম, ‘কেন মা? হঠাৎ পাঞ্জাবি পরতে হবে কেন?’

মা বলল, ‘পরতে বলেছি পরবি। এত প্রশ্ন কীসের?’

বলে মা একমুহূর্ত দেরি করল না। চলে গেল।

আমি মা’র কথামতো তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। সোফার ওপর চোখ পরতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। ক্লিওপেট্রা বউ সাজে বসে! ওর পাশে অহনা বসে আছে। অপর প্রান্তে কাজী বসে আছে!

একটা ঘোরের মধ্যে ঘটে গেল সবকিছু। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে গেল।

বিয়ে হবার পর থেকেই মা ক্লিওপেট্রার সঙ্গে এমন আচরণ করছে যেন ও মায়ের কত পরিচিত। ক্লিওপেট্রাও মা’র পিছুপিছু ঘুরছে সারাক্ষণ।
আর অহনা তো এক ডিগ্রি এগিয়ে। সারাদিনই ভাবি, ভাবি করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আমাকে কেউই কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। না মা, না অহনা আর না ক্লিওপেট্রা!

রাত এগারোটা। আমি সোফায় বসে টিভি দেখছি। অহনা কোত্থেকে তেড়ে এসে বলল, ‘তুই এখানে কী করছিস?’

‘চোখ নেই? দেখতে পাচ্ছিস না টিভি দেখছি?’

অহনা চেঁচিয়ে বলল, ‘আজকে তোর বাসর রাত। আর তুই বসে বসে টিভি দেখছিস! ভাবি সেই কখন থেকে তোর জন্যে বসে অপেক্ষা করছে।’
এরপর মা’কে ডেকে বলল, ‘মা! তোমার ছেলেকে কিছু বলো!’

মা তার ঘর থেকে চিৎকার করে বলল, ‘কি রে আহান কী হয়েছে?’

আমি অহনার কান টেনে বললাম, ‘চুপ! একদম চেঁচাবি না! যাচ্ছি!’

আমার ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়েছে। ঘরটা ফুলের গন্ধে মোঁ মোঁ করছে।
সাজানো বিছানায় ক্লিওপেট্রা ঘোমটা টেনে বসে আছে। আহারে! বেচারি আমার জন্যে এভাবে কতক্ষণ ধরে বসে আছে কে জানে! আমি ভেতর থেকে দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে ক্লিওপেট্রা মাথা তুলে তাকাল। ওকে দেখে আমার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে গেল। কোনো মানুষ কি এত সুন্দর হতে পারে! ও কি রূপকথার রাজ্য থেকে উঠে এসেছে আমার ঘরে?

আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্লিওপেট্রা লজ্জা পেল। বলল, ‘এভাবে কী দেখছ?’

‘আমার বউকে।’

‘ইশ!’

ক্লিওপেট্রা বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে কোথাও চলে যেতে নিল। আমাকে ঘোরানো হচ্ছে? কোথায় পালাবে ও! আমি ওর হাত ধরে হেচঁকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। ও তাল সামলাতে না পেরে আমার হাত ধরল। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও আমার বুকে মুখ লুকালো। আজ আর কোনো দূরত্ব অবশিষ্ট থাকবে না আমাদের মাঝে!


সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দিনের আলোয় জীবনে প্রথমবারের মতো ক্লিওপেট্রাকে আমার পাশে ঘুমোতে দেখলাম। আমার বুকে মাথা রেখে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। আমি ওর কপালে চুমু খেলাম। ও নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে তাকাল। আমি আলতো করে কয়েকবার ওর পিঠ চাপড়ে দিলাম। ও আবার ঘুমিয়ে গেল। আমার হাসি পেল। ঘুমোলে ও একেবারে বাচ্চা হয়ে যায়।

সকালে জাগার পরে আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি। ঘুম ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম নয়টা বাজে! সর্বনাশ! আজ আর অফিস হয়েছে!

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই ক্লিওপেট্রা ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। চুল ভেজা। গোসল করেছে নিশ্চয়ই। ভেজা চুলে বড্ড মোহনীয় দেখাচ্ছে ওকে। আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল।
একটা সোনালী পাড়ের কালো শাড়ি পড়েছে ক্লিওপেট্রা। একেবারে বাঙালি নতুন বউদের মতোই দেখাচ্ছে ওকে।
ও একটা শুকনো তোয়ালে নিয়ে চুল মুছতে লাগল। আমি ওর হাত থেকে তোয়ালেটা কেড়ে নিলাম। নিজের হাতে মুছে দিতে লাগলাম ওর ভেজা চুল। ও লক্ষী মেয়ের মতো চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল।


দু’মাস হতে চলল আমাদের বিয়ের। ক্লিওপেট্রার ওপর থেকে ওই ত্রিবিদ্যার প্রভাব অনেকটাই কেটে গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য ও চাইছে একবার আমেরিকা গিয়ে গুরু তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা করতে। আমিও ওর সাথে একমত। আমি চাইনা এই ফুলের মতো মেয়েটি আর কোনো কষ্ট পাক।
মা’কে সত্যিটা বলা যাবে না। তাই বললাম, আমি আর অহনা হানিমুনে আমেরিকা যেতে চাইছি। মা দ্বিমত করলো না। আমরা স্বীদ্ধান্ত নিলাম আগামীকালই আমেরিকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেবো।


গতকাল আমেরিকায় এসে পৌঁছেছি। একটা লোকাল হোটেলে এসে উঠেছি আমরা। ক্লিওপেট্রা প্রথমে ওদের পুরোনো বাড়িতে উঠতে চেয়েছিল। আমিই নিষেধ করেছি। কতশত ভয়ানক স্মৃতি জমা ওখানে! ওকে আর কখনোই ও বাড়িতে যেতে দেবো না। ওকে রাজি করিয়ে বাড়িটা বিক্রি করে দেবো।

আমরা এখন গুরুতান্ত্রিকের সাথে দেখা করার জন্য বেরোবো। ক্লিওপেট্রা ও ঘরে তৈরি হচ্ছে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বেরিয়ে এল। দেখলাম এখানেও ওর পড়নে শাড়ি। নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। এত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! চোখ ফেরানো দায়!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমেরিকা এসেও শাড়ি পড়লে যে?’

ও উত্তর দিল, ‘বরাবরের মতো তোমার ওই মুগ্ধ দৃষ্টি উপভোগ করার জন্য।’

আমি স্মিত হেসে ওর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলাম। ‘চলো।’

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

(অনেকে বলছে কবে শেষ হবে যেন জলদি শেষ করে দেই। আবার অনেকে বলছে যেন তাড়াতাড়ি শেষ না করি।
আসলে গল্পটাকে ছোটও করা যাবে না। বড়ও করা সম্ভব নয়। কারণ এটা তো উপন্যাসিকা। উপন্যাস নয়। এটাকে টানতে গেলে গল্পের আসল সৌন্দর্য্যই নষ্ট হয়ে যাবে। আর বোধহয় দু-তিন পর্ব বাকি আছে গল্পের। প্রিয় পাঠকেরা, কেউ প্লিজ মন খারাপ করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here