#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি (Unexpected story)
#পর্ব- ৪৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
–“জানেমান তোকে দেখলেই আমার মুড রোমান্টিক হয়ে যায়। যাকে বলে রোমান্স।” রুদ্রিকের তপ্ত নিঃশ্বাস যেনো আমার কাঁধে উপছে পড়ছে। আমার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। রুদ্রিক কী আমার প্ল্যান সম্পর্কে সব জেনে গেলো? রুদ্রিক আমাকে কোমর টেনে, আমাকে নিজের সাথে আবদ্ধ করে বলে,
–“তা আমার জানেমান তুই কী ভেবেছিস? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারবো নাহ তোর প্ল্যান সম্পর্কে হুহ। ”
কথাটি বলে রুদ্রিক আমার ভার্সিটির ব্যাগটা বের করে ফেলে। আমি এইবার জান যায় যায় অবস্হা।
রুদ্রিক ব্যাগটা বিছানায় রেখে পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমার দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
—“এতোবার বলার পর ও তুই আমার কথার অবাধ্য হয়েছিস। শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে। ”
রুদ্রিক এগিয়ে আসছে আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। রুদ্রিক আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে আমার গলার কামড় বসিয়ে দেয়। আমি চিৎকার করতে গেলে সে আমার মুখ চেপে ধরে। অনেক্ষন পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে, রুদ্রিক একটা ভাব নিয়ে বলল,
—-“আর কখনো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার চেস্টা করবি? ”
—–“আমি আবার কখন ষড়যন্ত্র করার চেস্টা করলাম? ”
—-“আমাকে ফাঁকি দিয়ে ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছিলো। একে যড়যন্ত্রই বলে। ”
আমি গলার হাত বুলিয়ে ‘মাগো রাক্ষস একটা ‘ বলে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।
রুদ্রিক হাত ভাজ করে বলল,
—“তুই আমাকে রাক্ষস বললি? ”
—–“রাক্ষস কে রাক্ষস বলবো না তো কী বলবো?
আমার বেবী একবার শুধু আসুক। বিচার দিবো হুহ।”
রুদ্রিক আমাকে পাত্তা না দিয়েই কফি নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।
আমিও মুখ বেঁকিয়ে কফি হাতে নিলাম। কফিতে চুমুক দিতে যাবো, তখনি সিথি ঘুমড়ো মুখ নিয়ে এসে বলল,
—“ভাইয়ূ-কাজল তোরা কী খবর পেয়েছিস,? ”
সিথির প্রশ্নে আমি পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম,
—“কিসের খবর? ”
আমার প্রশ্নের মাঝেই মা এসে বলল,
—“দিয়া ও লাজুকের বিয়েটা পিছিয়ে গেলো। ৭-৮ মাস পর বিয়ে হবে। ”
রুদ্রিক কফির কাপটা রেখে রুমে এসে বলে,
—“হঠাৎ পিছিয়ে গেলো কেনো? ”
দিয়া পিপিও রুমে প্রবেশ করে বলে উঠলো,
—“তুই তো জানিস রুদ্রিক। ইশানি আপাইয়ের জন্যে বিসনেজ এর অনেক লস হয়ে গেছে। একটা ইম্পোর্টেন্ট প্রযেক্ট পেয়েছে আমাদেরকম্পানি,তাও সেইটা সুইজারল্যান্ড এ। আমাকে এবং নাকবোঁচা এ্যাসিস্টেন্টকেই যেতে হবে এই প্রযেক্ট হ্যান্ডেল করতে। চিন্তা করিস নাহ আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।”
—-“কতদিনের জন্যে যাচ্ছো? ” ( সিথি বলল)
—“৭ বা ৮ মাস লাগবে। ”
—–“তোমার ফ্লাইট কবে পিপি? ” (রুদ্রিক বলল)
—-“আজকেই। ”
আমি দিয়া পিপির কাছে গিয়ে বললাম,
—“নিজের খেয়াল রেখো পিপি। ”
পিপি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—“আমাদের পুচুর খেয়াল রাখিস। টেক কেয়ার অফ ইউর সেল্ফ।”
দিয়া পিপি চলে যাচ্ছে শুনে আমার এবং সিথির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
দিয়া পিপি আমাদের দিকে তাঁকিয়ে বলে,
—–“এই তোরা কী মন খারাপ করিস নাহ ওকে? আমি খুব তাডাতাড়ি চলে আসবো। বাট চল আগে একটা সেল্ফি তুলে নেই।”
কথাটি বলে দিয়া পিপি নিজের ফোন বের করে। রুদ্রিক ও হাঁসিমুখে এগিয়ে এসে বলে,
—-“আমিও কিন্তু আছি সেল্ফিতে। ”
দিয়া পিপি হেঁসে অনেকগুলো সেল্ফি তুললো।
_____________
গাড়িতে বসে আছে লাজুক এবং দিয়া। উদ্দেশ্য এয়ারপোর্ট। লাজুক ড্রাইভ করতে করতে খেয়াল করে দিয়া জানালার দিকে তাঁকিয়ে আছে। লাজুক দিয়ার হাতে নিজের হাত রাখে। দিয়া লাজুকের দিকে তাঁকাতেই লাজুক বলে উঠলো,
—-” আমরা খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবো। ”
—-“হু। ”
শুকনো মুখে জবাব দিলো দিয়া।
লাজুক বুঝে গেলো দিয়ার মুড আপাতত ভালো নেই। লাজুক কিছুটা রসিকতার ছলে বলল,
—-“একদিক থেকে কিন্তু ভালো হবে। এইযে দেখো মানুষ বিয়ের পর ঘুড়তে যায় কিন্তু আমরা বিয়ের আগেই ঘুড়তে চলে যাচ্ছি। আমরা একটু আলাদা তাই আর কি। ”
দিয়া মুচকি হেঁসে লাজুকের কাঁধে মাথা রেখে দেয়। লাজুক ও মুঁচকি হেঁসে ড্রাইভ করতে থাকে।
________
আমি নীচে এসে দেখি ছুটকি বসে আছে। হাতে তার আচারের বোতল। হ্যা মা পাঠিয়েছে। আমি ছুটকির কাছে গিয়েই আচারের বোতল টা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দেই। মায়ের হাতে আমের আঁচার মানেই ভিন্ন স্বাদ।
ছুটকি আনমনে কিছু ভেবে চলেছে। আমি আচার ছুটকির দিকে এগিয়ে দিতেই, ছুটকি ‘না’ বলে আবারো ফোনে মন দেয়।
আমি ছুটকিকে মৃদ্যু ধাক্কা দিয়ে বলে,
—“কিরে?তুই এতো চুপচাপ কেন? সেদিন বাবা-মা এসে দেখা করে গিয়েছিল তুই এলি নাহ। ”
ছুটকি ফোন টিপতে টিপতেই বলল,
—-“আমার এক্সাম ছিলো রে আপাই। ”
—–“তোর চোখ-মুখ দেখে কেমন শুকনো লাগছে। কী হয়েছে বোন? দেখ কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারিস। ”
—–“আচ্ছা আপাই এক তরফা ভালোবাসা শুধু কষ্ট দেয়? ”
ছুটকির প্রশ্নে আমি বললাম,
—-“হঠাৎ এই প্রশ্ন? ”
—-“তুই বল আপাই প্লিয। ”
আমি আচার মুখে নিয়ে বলতে লাগলাম
—-” এক তরফা ভালোবাসায় সুখ যেমন রয়েছে তেমনি কষ্টও রয়েছে। এক তরফা ভালোবাসায় শুধু কষ্ট থাকলেও,তাতে এক অন্যরকমের তৃপ্তি রয়েছে। যাকে বলে নিঃশ্বার্থ ভালোবাসার তৃপ্তি।নিঃশ্বার্থের ভালোবাসায় কোনোপ্রকার স্বার্থ থাকে নাহ। ”
কথাটি বলেই আমি আবারো আচার খাওয়াতে মন দিলাম।
ছুটকি মনযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনে মুঁচকি হাঁসলো। ছুটকি উঠে দাঁড়িয়ে আড়ালে গিয়ে, একটা ফোন নিয়ে তনয়ের নাম্বারে ফোন করলো।
তনয় অফিসে কাজ করছিলো। নিজের ফোন বাজতেই তনয় তাঁকিয়ে দেখে ছুটকির ফোন। তনয় বিরক্ত হয়ে ফোন ধরেনা। অনেক্ষন ধরে বাজার কারণে ফোনটা অবশেষে বাধ্য হয়েই ফোনটা ধরলো। ফোনের ওইপাশে কেউ কিচ্ছু বলছে নাহ। তনয় বুঝতে পেরেছে ফোনটা ছুটকি সহজে কথা বলবে নাহ।
তনয় ফোনটা কাত করে ধরে বলল,
—“কথা বলতে চাইলে বলো,নাহলে কেটে দাও। ”
ছুটকি ফোনের ওইপাশ থেকে মুচকি হেঁসে বলল,
—-“তনয় ভাই আমি জানি আপনি আমার প্রতি বিরক্তি হচ্ছেন, কিন্তু একটা কথা কী জানেন? আপনিও বিশ্বাস করেন, কতটা নিঃশ্বার্থভাবে ভালোবাসি আমি আপনাকে। ”
তনয় কথাটি শুনে কিছু বলল নাহ।
ছুটকি আবারো বলল,
—-“এই নিঃশ্বার্থ ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে আপনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলবেন তনয় ভাই কথা দিলাম।”
কথাটি বলে ছুটকি ফোন কেটে দিলো।
তনয় প্রতিউত্তর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে জানে না ভবিষ্যৎ কি হবে।
সিথি খেয়াল করলো রুমি সাদির সাথে নোটস নেওয়ার কথা বলে একপ্রকার চিপকে রয়েছে। সিথি এইবার আর সহ্য করলো নাহ। মেয়েটার ন্যকামি অনেক সহ্য করেছে সে আর সহ্য করবে নাহ।৷ সিথি রুমিকে একপ্রকার সরিয়ে দিয়ে, সাদির পাশে ঘেসে বলে,
—“রুমি তুমি এখন যেতে পারো আমাদের একটু পারসোনাল কথা আছে। ”
রুমি বোধহয় সিথির কথা ভালো লাগলো নাহ। তাই সে সাদির দিকে তাঁকালো। সিথি রুমির চাহিনী দেখে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
—“এইযে এদিকে তাঁকিয়ে লাভ নেই। তুমি যাও। সাদি ভাইয়ার সাথে আমার কথা আছে তুমি আমাদের মাঝখানে থেকে বিরক্ত করছো। সাদি ভাই তুমি কিছু বলো। ”
দাঁতে দাঁত চেপে সাদির দিকে তাঁকিয়ে কথাগুলো বলল সিথি। সাদিও সিথির কথায় সায় দিয়ে বলল,
—“রুমি তুমি এখন যেতে পারো। ”
রুমি ঘুমড়ো মুখ নিয়ে চলে গেলো। রুমকি চলে যেতেই, সিথি সাদির কলার চেপে ধরে বলে,
—“আরেকবার যদি ওই মেয়েকে তোমার আশপাশে দেখি, তাহলে বুঝবে মজা। ”
সাদি ঠোটে হাঁসি ঝুলিয়ে বলে,
—“আর ইউ জেলাস? ”
—“ওইযে আমার যে রোগে ধরেছে। যাকে বলে ‘প্রেমরোগ। তোমার ও এই রোগে খুব করে ধরবে। ”
সাদি প্রতিউত্তরে বলল,
—“এই রোগে তো আমি সেই কবেই আক্রান্ত হয়ে গেছি। ”
সাদির কথা শুনে সিথির কি হলো কে জানে? সে লজ্জায় উঠে দাঁড়ালো।
_____৭মাস পর,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছি আমি। পেটটা বেশ ফুলে গেছে। আমার গালদুটোও বেশ ফুলে গেছে। রুদ্রিক আসতেই আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
–“রুদ্রিক শুনো নাহ।”
—“কি হয়েছে?
–“আমাকে গালদুটো কি খুব ফুলে গেছে?আমি জানি গালদুটো ফুলে যাওয়ার কারণে আমাকে খুব বাজে লাগছে? ”
রুদ্রিকের এক্সাম তাই পড়ছিলো। আমার কথা শুনে
রুদ্রিক মুচকি হাঁসে। রুদ্রিক খেয়াল করে দেখে লাল টকটকে গালদুটো ফুলে যাওয়াতে পুরো ফুটন্ত গোলাপের মতো লাগছে।
রুদ্রিক আমার কাছে এসে আমার গালদুটো টেনে ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,
—“তুই জানিস কাজল? তোর ফুটন্ত গালদুটো আমাকে তোর দিকে কতটা আকর্ষিত করে। ”
আমি শুকনো ঢুগ গিলে বলে উঠলাম,
—“দেখো আমি কিন্তু তোমার মতলব বুঝতে পেরেছি। বাট এইসব কিচ্ছু হবে নাহ। আমি তোমার সাথে এখনো রেগে আছি। তুমি আমাকে বাইরে যেতে দাও হুহ। ”
কথাটি বলে আমি বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে পরি।
—–“তুই আবারোও রাগ করেছিস? ”
—-“রাগ করবো নাহ? তুমি আমাকে বাইরে যেতেই দিচ্ছো নাহ। দিনের পর দিন আমি মোটু হয়ে যাবো তারপর তুমি আবারোও নিউ গার্লফ্রেন্ড বানানো শুরু করবে। ”
মন খারাপ নিয়ে কথাগুলো বলে ডাইরিতে লিখা শুরু করে দিলাম।
প্রতিউত্তরে রুদ্রিক বাঁকা দাঁত দিয়ে শব্দ করে হাঁসলো। রুদ্রিকের ফোন বেজে উঠতেই আমি খেয়াল করে দেখি ‘জেনি ‘ নামটি। রুদ্রিক নামটি দেখে কেটে দিলো। এতোদিন পরে জেনি কেনো ফোন করেছে? প্রশ্নটা মনে নাড়া দিয়ে উঠলো।
রুদ্রিক আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ‘ঘুমিয়ে পড় রাত হয়েছে।’কথাটি বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। আমি ডাইরিটা পাশে রেখে শুয়ে পড়লাম।
_________________
সকাল সকাল রুদ্রিক কিছুটা তাড়া নিয়েই অফিসের কাগজ সব রেডি করে গুছিয়ে নিলো। আমি রুমে প্রবেসব করতেই,রুদ্রিক দ্রুত পা চালিয়ে আমাকে কিছু না বলে বেড়িয়ে গেলো। প্রতিদিনের মতো রুদ্রিক আমার কপালে চুমু খেলো নাহ কিংবা ঠিক ‘সময় মতো নিজের খেয়াল রাখবে’ জাতীয় কিছুই বলল নাহ ।
এইসব কিছুই রুদ্রিক প্রতিদিন করে,কিন্তু আজ
রুদ্রিক কিছুই বললো নাহ। গাড়ি নিয়ে রুদ্রিক বেড়িয়ে গেলো। আমি জানালা দিয়ে তাঁকিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথায় গেলো রুদ্রিক? কালকে জেনির ফোন আসার পর থেকেই রুদ্রিকের মাঝে পরিবর্তন খেয়াল করছি।
রুদ্রিকের যাওয়ার পানে তাঁকিয়ে আনমনে বলে উঠলাম,
—-” পৃথিবীতে সবকিছু সহ্য করতে পারলেও,নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে একদিনের জন্যে অবহেলা সহ্য করা যায়না। রুদ্রিকের ভালোবাসা আমার কাছে যতটা সুখকর, রুদ্রিকের অবহেলা আমার কাছে ততটাই বেদানায়ক। ”
#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি (Unexpected story)
#পর্ব- ৪৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
রুদ্রিককে দেখেই জেনি রুদ্রিকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। নিজের স্বামীর বুকে অন্য কাউকে দেখে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। রুদ্রিকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেনি কেঁদে উঠলো। আমি নিজের সামনে সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখতে পারছি । ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ছুটে গেলাম বাইরের দিকে।
রুদ্রিক কাজলকে দেখতে পেলো। তাই সে নিজের থেকে তাড়াতাড়ি জেনিকে ছাড়িয়ে কঠোর গলায় বলল,
—“কি করছো কি জেনি? বিহেভ ইউর সেল্ফ!
কাজল বোধহয় আমাকে ভূল বুঝলো। ”
জেনি অনুনয়ের চোখে তাঁকিয়ে বলল,
—“আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি রুদ্রিক। আমি আসলে ইমোশোনাল হয়ে পড়েছিলাম। ”
রুদ্রিক আর অপেক্ষা না করে কাজলের পিছনে ছুটে চলল।
এইদিকে,
আমি এলোমেলো হয়ে হেঁটে চলেছি। হাটতেও কষ্ট হচ্ছে। রুদ্রিককে অফিসে যাওয়ার পরে, অফিসের একজন স্টাফ আমাকে যখন খবর দেয় জেনি অফিসে এসেছে,তখনি আমিও অফিসে যায়।বিষয়টা দেখার জন্যে,কিন্তু বিষয়টা দেখতে এসে এতো বড় সারপ্রাইজড হয়ে যাবো ভাবিনি। জেনি আবারোও রুদ্রিককের জীবনে ফিরে এসেছে। তাইতো রুদ্রিকের আচরণ এতোটা পরিবর্তন।
সবটাই আমি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি। আমার ভাবনার মাঝেই রুদ্রিকের গাড়িটা আমার সামনে আসে। আমি থেমে যাই। রুদ্রিক গাড়ি থেকে নেমে আমার কাছে এসে, আমার গালে হাত দিয়ে বলে,
—“জানেমান, তুই এইভাবে চলে আসলি কেনো?তুই জানিস? আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এতোটা দায়িত্বহীন কীভাবে তুই আমাকে বল? তুই কি ভূলে গেলি এখন তুই একা না আমাদের বেবী ও আছে তোর সাথে। ”
রুদ্রিকের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাঁসি মুখে ফুটে উঠলো। আমি রুদ্রিকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,
—“তাই বুঝি? তোমার মনে আছে? আমাদের সাথে এখন আমাদের বেবীও আছে। যদি তাই থাকতো তাহলে জেনীকে তুমি নিজের লাইফের আবারো এলাও করতে নাহ রুদ্রিক। ”
রুদ্রিক আমাকে কিছু বুঝাতে চাইবে,আমি আবারোও বলে উঠলাম,
—-“রুদ্রিক আমাকে কিছু বুঝাতে এসো নাহ। আমি সবকিছু নিজের চোখে সবকিছু দেখে ফেলেছি। সো তুমি আমাকে বুঝাতে এসো নাহ। আসলে ভূলটা আমারই ছিলো যে, আমি ভেবেছি তুমি হয়তো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছো,কিন্তু আমি ভূল। ”
কথাটি বলে আমি কেঁদে উঠলাম।
রুদ্রিক আমার কথা শুনে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া করলো নাহ।
কেননা সে জানে কাজলের প্রতিটা কথায় রয়েছে অভিমান। এই অভিমান দূর করতে অনেক কাঠখড় পুরাতে হবে।
রুদ্রিক নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
—-“চোখের দেখা যে সত্যি নয়, তা তো তুই খুব ভালো করে জানিস কাজল। আমি জানি তুই চোখের দেখাটা বিশ্বাস করিস নাহ।
তাহলে তবুও জোড় করে বিশ্বাস করছিস কেন?”
আমি কাঠকাঠ গলায় বললাম,
—“আমার থেকে তুমি আমাকে চিনো বেশি? ”
—-“হুম তুইতো শুধু আমার ভালোবাসার মানুষ তো নয় তুই আমার স্ত্রীও। সংসার করছি,অথচ নিজের স্ত্রীকে চিনবো নাহ। ভালোবাসলেই তো আর একজন মানুষকে চিনা যায়না তাইনা? আগে তাকে পুরোপুরিভাবে চিনতে হলে, তার সাথে সংসার করতে হয়।”
—–“তাইতো আমি তোমাকে চিনতে পারলাম নাহ রুদ্রিক। ”
—-“সত্যি চিনতে পারিস নি? ”
রুদ্রিকের কথায় কোনো জবাবা দিলাম। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। রুদ্রিক ও আমার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো।
আমি রাগ নিয়েই বাড়িতে হেঁটে চলে এলাম। বাড়িতে এসেই কাউকে কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলাম। আমার পিছন পিছন রুদ্রিক ও বাড়িতে চলে এলো।
রুদ্রিকের মা রুদ্রিককে ইশারা করে বলে ‘কাজলর হঠাৎ কি হলো? ‘
রুদ্রিক মাথা নাড়িয়ে বলল,
—“সব ঠিক আছে মা। ”
রুদ্রিক সিথির কাছে গিয়ে বলল,
—“তোকে রাস্তায় আসার পথে যা যা করতে বলেছিলাম, করেছিলি? ”
সিথি রুদ্রিককে ভরসা দিয়ে বলে,
—“তুই নিশ্চিন্ত থাক ভাইয়ূ। তুই এখন আমার অবুঝ
ভাবিকে গিয়ে বুঝাও। ”
রুদ্রিক উপরে গিয়ে দেখে,কাজল নিজের মতো বিড়বিড় করছে আর কাপড় সব ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছে।
রুদ্রিক দেখে আমি মুখ ফুলিয়ে আবারো কাপড় গুছাতে শুরু করলাম। রুদ্রিক বলল,
—-“কোথায় যাচ্ছিস? ”
—-“আমি নিজের বাড়ি চলে যাচ্ছি। কেউ যেনো আমাকে না আটকায়। ”
রুদ্রিক কিছু না বললো নাহ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে জেল দিতে লাগলো। আমি রুদ্রিককে দেখে খানিক্টা অবাক হলাম বটে। এই মানুষটা আমার যাওয়ার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো নাহ কিংবা আমাকে আটকাতেও চাইলো নাহ। এতোটা পরিবর্তন কীভাবে?
আমার এখন গলা ফাঁটিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। আমি রুদ্রিকের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে, বেড়িয়ে গেলাম। সিড়ির কাছে আসতেই রুদ্রিক আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি কিছুটা হচকিয়ে গিয়ে বললাম,
—“কি হচ্ছে কি? ”
রুদ্রিক আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নীচে নামিয়ে দিয়ে বলল,
—“সিড়িতে তেল ছিলো পড়ে গেলে আমার বেবীর ক্ষতি হতো। তাই আর কি নীচে নামিয়ে দিয়ে গেলাম। এখন তুই যেতে পারিস।
কথাটি বলে রুদ্রিক চলে গেলো।
আমি রুদ্রিকের যাওয়ার পানে তাঁকিয়ে রইলাম। এই মানুষটাকে আমি চিনতে পারছি নাহ।
মা বাইরে চলে গেছে। তাই এই সুযোগেই আমি বেড়িয়ে গেলাম।
কাজল বেড়িয়ে যেতেই সিথি রুদ্রিকের কাছে এসে বলল,
—“ভাইয়ূ কাজল তো একা চলে যাচ্ছে। ”
—-“আপাতত আটকাস নাহ। ”
—-“কিন্তু ভাইয়ূ……
সিথির বলার মাঝেই রুদ্রিক বলল,
—-“আমি ড্রাইভারকে কাজলের পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছি। সমস্যা হবেনা।”
সিথি একটা কথা ভেবে বলল,
—-“আমি শুধু একটাই কথা ভাবছি যে, আমাদের বুদ্ধিমতী কাজল এমন ছেলে-মানুষ কীভাবে হয়ে গেলো? ”
সিথির কথার মাঝেই রুদ্রিকের মা এসে বললেন,
—-“মেয়েদের এই সময় মুড সুইং হয় বুঝেছিস? তারা সন্তানকে গর্ভ ধারণ করার সময় নিজেরাই বাচ্ছা মানুষ হয়ে উঠে। ”
রুদ্রিকের মাকে দেখে রুদ্রিক বলল,
—-“মা! তুমি? ”
রুদ্রিকের মা রুদ্রিকের গালে হাত দিয়ে বলল,
—“রুদ্রিক বউমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। জানিনা তোমাদের মাথায় কি চলছে কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখবে হিতে যেনো বিপরীত না হয়ে যায়। ”
লকাপে বসে আছে ইশানি। একজন মহিলা এসে বলে,
—“আপনার হাজবেন্ডের মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়েছে।”
ইশানি কিছু না বলে পুলিশ মহিলার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো। ইশানির চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে। গোছানো ইশানি কেমন যেনো অগাছালো হয়ে গেছে। ইশানিকে মর্গে নিয়ে আসা হলো। ইশানি দেখেই মাহিরের লাশের থেকে সাদা চাদর দিয়ে আবৃত মাহিরের মুখখানা বের হয়ে গেলো। দীর্ঘ ৭মাস লড়াই করে অবশেষে মাহির মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়ে আজ মারা গেলো। ইশানি এগিয়ে এসে,মাহিরের কপালে হাত বুলিয়ে আবারো মাহিরের মুখে চাঁদর দিয়ে আবৃত করে দিলো। ইশানির চোখ দিয়ে এক ফোটা জল ও গড়িয়ে পড়লো নাহ। সবাই অবাক দৃষ্টিতে ইশানির দিকে তাঁকিয়ে আছে। যে মানুষ নিজের স্বামীকে এতোটা ভালোবাসে, সেই ইশানির নিজের স্বামীর মৃত্যুতে এতোটুকুও চোখে জল নেই। ইশানি আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
—“ভালো থেকো মাহির। অনেক ভালো থেকো।”
একজন পুলিশ এগিয়ে এসে বলল,
—“আমার মনে হয় উনার পরিবারকে খবর দেওয়া উচিৎ। ”
পরিবারের কথা শুনে ইশানি রক্তচক্ষু দিয়ে পুলিশের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
—“একদম নাহ। কাউকে খবর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ”
পুলিশ মহিলা বলে উঠেন,
—“কি বলছেন কি….
মহিলাকে থামিয়ে ইশানি কঠোর গলায় বলল,
—-“আমি মানা করেছি। জানানো হবেনা মানে হবেনা। মাহিরের দাফনের ব্যবস্হা করুন। ”
কথাটি বলে ইশানি মাহিরের দিকে তাঁকিয়েই রইলো।
ইশানি হাবভাব দেখে সবার কেমন যেনো খটকা লাগছিলো।
_________
আমাকে হঠাৎ বাড়িতে দেখে মা এসে বলল,
—-“কাজল, তুই হঠাৎ? ”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
—-“কেনো আমি আসতে পারিনা? ”
—-“নাহ। আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম যে, তুই একা জামাই কোথায়? ”
মায়ের কথা শুনে রাগ হচ্ছে নিজের বাড়িতে আসতে কী এখন একে ওকে নিয়ে আসতে হবে?
আমি রাগ দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। মা হয়তো কিছুই বুঝলো নাহ আমার মতিগতি।
_________
আমার কথা সব কথা শুনে ছুটকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—-“তোর কী মনে হয় আপাই? রুদ্রিক ভাইয়ের জেনির সাথে কিছু আছে। ”
আমি ছুটকির দিকে তাঁকিয়ে বললাম,
—-“আমি জানি রুদ্রিক এমন কিছু করবে নাহ। এর পিছনে অন্য গল্প রয়েছে।
রুদ্রিকের উপর আমার ভরসা আছে। ”
—-“বাবাহ এতেটা বিশ্বাস? ”
—-“হু। কেননা ভালোবাসার মূল মন্ত্র হলো বিশ্বাস,ভরসা। রুদ্রিককে ভালোবাসি অথচ বিশ্বাস করবো নাহ? তার উপর ভরসা করবো নাহ? ”
ছুটকি বলল,
—-“তাহলে হঠাৎ রাগ করে এলে যে? ”
আমি থমথমে গলায় বললাম,
—-“রাগ হয়েছিলো প্রচন্ড। নিজের স্বামীর বুকে অন্য কাউকে কখনোই সহ্য করা যায়না। আমি সেখানে কীভাবে সহ্য করবো বল? যার বুকে আমি মাথা রেখে ঘুমাই, সেই বুকে অন্য কেউ মেয়েকে সত্যি সহ্য করা যায়না। যাক অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। ”
কথাটি বলে আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। যদিও আমি জানি আজ রাতে আমার ঘুম আর আসছে।
রুদ্রিক কাজলের ছবির দিকে হাঁসলো। কাজলকে ছাড়া আজকে তার সত্যি ঘুম হবে নাহ। তাই রুদ্রিক আকাশপানে তাঁকিয়ে আনমনে গাঁইতে লাগলো,
—-“খোঁলা জানালা দখিনের বাতাসে ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে
কখন তুমি এসে হেঁসে বলে দাও আমি আছি তোমার পাশে। ”
চলবে….