#ঘুণপোকা
#পর্ব_৭
ডানহাতের লোমগুলো একমনে খুঁটিয়ে যাচ্ছে সৈকত। নিজের দোষগুলো একে একে স্মরণ হচ্ছে। প্রতিদিনই মনে পড়ে নিজের প্রতিটা দোষ। অনুশোচনা তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলতে থাকে৷ কেউ জানে না সেই অনুশোচনার তীব্রতা, কেউ দেখে না সেই অদৃশ্য রক্তক্ষরণ। কাউকে দেখাতেও চায় না সে। যার জন্য এত হাহাকার সেই মানুষটাই তো দেখে না, অন্য কারো আর দেখে আর কাজ কি! তবে আজ পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে খুব জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে সেই গল্পগুলো। গল্পটা তার জানা খুব দরকার, নয়তো অনুশোচনার আগুনে যে তাকেও কোনো একসময় নিঃশব্দে পুঁড়ে মরতে হবে প্রতিবেলা!
– ভাইয়া?
– হুম?
– হঠাৎ থেমে গেলেন যে!
– তোমার প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর আমার জানা নেই৷ যা কিছু করেছি পুরোটাই ছিলো অন্যায়। কোনো মানুষ হুবহু আমার মত হবে কিংবা আমি যা চাই ঠিক তেমনই হবে এটা আশা করা বোকামি। কখনোই সে হুবহু আমার মত কিংবা আমার মনমত হবে না। বিয়ের সাত আটদিন পর থেকেই ওর প্রতি আমার বিরক্তি শুরু হলো। খুব সাধারণ ব্যাপার যেটা বিরক্ত হওয়ার মত না, সেখানেও বিরক্ত হতাম। আমি হেলদি খাবার পছন্দ করতাম আর রুপুর পছন্দ ছিলো পৃথিবীর যত আনহেলদি খাবার আছে সেসব। যতধরণের ভাজাপোড়া, ঝাল এই জগতে আছে সেগুলো ও পাগলের মত খেতো৷ বিশেষ করে স্ট্রিট ফুড। কখনো বাহিরে ওকে নিয়ে বের হলে যতক্ষণ রাস্তায় থাকতাম ততক্ষণ এই ভর্তা, সেই আচার, আর নয়তো সিঙারা, ফুচকা এগুলো চলতেই থাকতো৷ আমি চাইতাম ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে বসে ওকে লাঞ্চ কিংবা ডিনার করাতে। আর ও কি করতো! রিকশা জোর করে টি এস সির ওদিকে নিয়ে যেতো। সেখানে যতধরণের স্ট্রীট ফুড পাওয়া যায় সব খেতো। একটা ফুড ভ্যান ছিলো ওদিকে। ঐ ছেলের ভ্যানের পাশে বসে ওর দোকানের পাস্তা আর বার্গার রুপু খাবেই। এরপর দৌঁড় দিতো ফুচকার দোকানে৷ ফেরার পথে টি এস সি তে অবশ্যই এক কাপ চা খেয়ে ফিরতো৷ আর বাসায় ফেরার সময় রিকশায় বসে যতধরণের ফেরিওয়ালা আছে সবার কাছ থেকে কিছু না কিছু হাবিজাবি খাবার কিনতোই৷ টুকটুক করে সারাপথ সেগুলো খেতো আর আমার সাথে একাই বকবক করতে থাকতো৷ বিয়ের পর ওকে নিয়ে বের হয়েছিলাম চারদিন। ওর এসব হাবিজাবি খাওয়ার বদঅভ্যাস আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই আর ওকে নিয়ে বের হইনি।
– অন্যসব মেয়েরা ফাইভ স্টার হোটেলে যেতে চায় আর উনি রাস্তার খাবারেই স্যাটিসফাইড ছিলো। আপনার তো খুশি হওয়া উচিত ভাবী অল্পতেই সন্তুষ্ট হওয়া মানুষ।
– হ্যাঁ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমার খুশি লাগতো না। আমি হলিউড আর আর্ট ফিল্ম দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু রুপু পছন্দ করতো সাউথ ইন্ডিয়ান উড়াধুরা মুভি। আমার সাথে যে আর্ট ফিল্ম দেখতো না তা না। দেখতো, তবে কোনো ইন্টারেস্ট আমি ওর মাঝে দেখতে পেতাম না৷ আমি বুঝতে পারতাম ও নিজের সাথে জোর খাটিয়ে আমার পাশে বসে মুভি হজম করছে। কখনো কখনো ও মুভি দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। এমন একটা অবস্থায় কি আর তুমি মুভি দেখতে পারবে? কখনোই না। এরপর থেকে আমি একাই বসে মুভি দেখতাম। ও আমার পাশে বসতে চাইলে বন্ধ করে দিতাম। আমি চাইতাম ওর সাথে লং ট্যুরে যেতে। কিন্তু যেতাম না। কারন রুপু একটা ইরিটেটিং ক্যারেক্টার। বেড়াতে গিয়ে আমাকে ছাড়া কথা বলার মত কাউকে পাবে না। কথা বলে বলে আমার মাথা খেয়ে ফেলবে৷ বিয়ের ঠিক ১৮-২০ দিন পর থেকেই নবনীকে আমি খুব মিস করতে লাগলাম। ওর সাথে আমার কাটানো সময়গুলো খুব মনে পড়তে লাগলো। কত সুন্দর বন্ডিং ছিলো আমাদের! একসাথে বসে মুভি দেখা, দূর দূরান্তে বেড়াতে যাওয়া আরো কত কি! রুপুকে আমার বিরক্তিকর বস্তু ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না। ঘুরে ফিরে বারবার নবনীকে মনে পড়তো।
– উনাকে বিরক্ত লাগার পিছনে আপনি যে কারণগুলো দেখাচ্ছেন সেগুলো কি আদৌ বিরক্ত হওয়ার মত কারণ ছিলো?
– অবশ্যই না। তখনই তো বললাম খুবই অযৌক্তিক কিছু কারণ ছিলো ওকে ভালো না লাগার পিছনে। আরো আছে এমন ঘটনা। শুনবে?
– শোনার জন্যই তো অফিসে রয়ে গেলাম।
– ওর মাইগ্রেন প্রবলেম ছিলো৷ মাসে দুই একবার মাইগ্রেন পেইন খুব বেড়ে যেতো৷ রুপু সহ্য করতে পারতো না৷ এত কথা বলা মেয়েটা মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে একদম চুপ করে শুয়ে থাকতো তখন। একটা কথাও বলতো না৷ রুপু চুপচাপ শুয়ে আছে তারমানে শরীরের অবস্থা বেশিই খারাপ। ওর যখনই পেইন হতো তখন ধূসর রঙের কি একটা তেল লাগাতো মাথায়। ভয়াবহ স্মেল ছিলো তেলটার৷ সেই তেল লাগানোর পর পুরো বাসা বিশ্রি গন্ধে ডুবে যেতো। বিয়ের পর প্রথম ওর মাইগ্রেন এ্যাটাক হয় ২২ দিন পর। অফিস থেকে বাসায় ফিরে পা রাখা মাত্রই সেই স্মেল এসে নাকে ধাক্কা খেলো৷ মা কে জিজ্ঞেস করতেই জানালো রুপুর কথা। ঘরে যেয়ে দেখি লাইট অফ করে মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে আছে৷ পুরো ঘরে যা স্মেল ছিলো তারচেয়ে দ্বিগুণ স্মেল আমার রুমে। মনে হচ্ছিল আমার মাথার ভিতর কেউ বুঝি খোঁচাচ্ছে। কোনোমতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাথরুমে গেলাম গোসল করতে৷ ফিরে এসে দেখি ঘরের লাইট জ্বালানো। রুপু বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখজোড়া ফুলে লাল হয়ে আছে। তেলে ডুবানো চুলগুলো দুহাতে টেনে ধরে রেখেছে। বিধ্বস্ত এক অবস্থা! আমাকে দেখা মাত্রই বললো,
– সিকু আমার চুলগুলো একটু টেনে দিবে প্লিজ৷ আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।
আমি কি করেছিলাম জানো?
– কি?
– নাক মুখ কুঁচকে ওকে বলেছিলাম কারো সেবা যত্ন করে আমি অভ্যস্ত না। কারো চুল টানা, হাত পা টিপে দেয়া এগুলো আমার কাছে বিশাল বিরক্তিকর কাজ মনে হয়। তারউপর কিসব লাগিয়েছো মাথায়! বিদঘুটে গন্ধ। তোমার মাথায় হাত দেয়া সম্ভব না। আশা করি আমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছো? তোমার খুব খারাপ লাগলে আমি সাবিহাকে ডেকে দিতে পারি। ডাকবো?
ও আর কোনো উত্তরই দিলো না। আবার বালিশটা মাথার উপর দিয়ে শুয়ে রইলো। তখন ওর কান্না পাচ্ছিলো কি না আমি জানি না৷ পাচ্ছিলো হয়তো! তাই বোধ হয় ওভাবে চুপচাপ মুখ লুকিয়ে আবারও শুয়ে পড়েছিলো চোখের পানি আড়াল করতে।
– মানুষটা কষ্ট পাচ্ছিলো, আর আপনি ওভাবে কথা শোনালেন! ব্যাপারটা খুব বেশি রুড হয়ে গেলো না?
– ব্যাপারটা আরো বেশি রুড হয়েছিলো সেদিন৷ আমি ওকে আমার ঘরে ঘুমাতে দেইনি। সাবিহার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম ওর তেলের গন্ধে আমার ঘুম হবে না। রাতটা সাবিহার সাথে কাটালে ভালো হয়৷ ও চুপচাপ বিছানা ছেড়ে চলে গিয়েছিল সাবিহার ঘরে৷
– উনাকে ঘর থেকেই বের করে দিলেন! কি এমন তেল লাগিয়েছিলো উনি?
– তেলটার স্মেল বাজে ছিলো। তবে এতটাও না যে ওকে আমার ঘর থেকে পাঠিয়ে দিবো।
– তাহলে বের কেন করলেন?
– রুপুকে আমার ভালো লাগছিলো না। আমি শুধু সুযোগ খুঁজতাম ওর কাছ থেকে দূরে থাকার।
– উনাকে বিয়ে কেন করলেন?
– বাবার কথা বিশ্বাস করে। বিশাল ধাক্কা খেয়েছিলাম আমি। ধাক্কার তাল সামলে উঠতে পারছিলাম না। বাবার প্রতি খুব রাগ হয়েছিলো আমার৷ রাগে উনার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিলাম। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না৷
– ভাবী সেদিনের পর আপনার সাথে রাগ করেনি?
– উহুম। আমার রুপু রাগ করার মত মানুষ না৷ সহজে সে রাগ করে না। অসহনীয় কষ্টও হাসিমুখে চেপে যাওয়ার ক্ষমতা রুপুর আছে।
সৈকতের দিকে খুব মনোযোগে তাকিয়ে আছে ইমরান। মানুষটাকে বুঝার চেষ্টা করছে সে। লোকটাকে অসম্ভব নির্দয় আর অসভ্য মনে হচ্ছে। অথচ অফিসে জয়েন করার পর থেকে এই মানুষটাকে কখনোই মনে হয়নি সে নির্দয় কিংবা সে অসভ্য। তাহলে এটা কি তার বদলে যাওয়া রূপ? আগে কি সত্যিই সে তার বলা গল্পের মত রুড ছিলো? আর রুপন্তি? সে কোথায়? এই মানুষটার সঙ্গে এখনো আছে নাকি চলে গেছে?
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন মনের মাঝে ছুটোছুটি করছে ইমরানের। খুব অস্থির করে তুলছে তাকে প্রশ্নগুলো। সমস্ত প্রশ্ন আর অস্থিরতাটুকু নীরবে মনের এককোনে রেখে সৈকতের দিকে তাকিয়ে আছে সে। প্রশ্নের উত্তরগুলো নাহয় গল্পের মাঝ থেকেই খুঁজে নিবে সে।
– ও যখনই সিক থাকতো আমি ওর ধারে কাছেও যেতাম না। নিজের মত থাকতাম। একবার হলো কি, রুপুর শুরু হলো মাথাব্যাথা৷ বরাবরের মত সেই অদ্ভুত বিশ্রি তেলটা ওর মাথায় লাগানো হলো। সাবিহাকে পাঠিয়ে দিলাম আমার ঘরে। আর আমি চলে গেলাম সাবিহার ঘরে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলাম ও সারারাত ঘুমাতে পারেনি মাথাব্যাথায়। সকালে আমি যখন অফিসে আসার জন্য রেডি হচ্ছিলাম তখন ও একহাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরলো। বললো,
– প্লিজ বাসায় থাকো। আমি বোধ হয় আজকেই মারা যাবো। মারা যাওয়ার সময় তুমি আমার সামনে থাকবা৷ তোমাকে থাকতেই হবে৷
ওর দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো৷ বিশ্বাস করো ওর চোখের পানি দেখে আমার মায়া তো লাগলোই না উল্টো মেজাজ গরম হচ্ছিলো। সামান্য মাথাব্যাথাকে ইস্যু করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার মানে কি! বিরক্তিতে আমার চেহারা কুঁচকে এলো। আমি কিছুই বলিনি রুপুকে। জাস্ট ওর দিকে চেহারা কুঁচকে তাকিয়ে ছিলাম। ও বুঝতে পেরেছিলো আমি বিরক্ত হচ্ছি। ও কাঁপা কন্ঠে আমাকে বলেছিলো,
– আমাকে একটু ভালোবাসলে কি হয় সিকু? ভালোবাসো না কেন আমাকে? আমি কি তোমাকে খুব বিরক্ত করি?
– ঠিকই তো বলেছে। আপনি উনাকে একদমই ভালোবাসতেন না৷ ঠিক না এসব। কি এমন করেছে উনি? এত বিরক্তি কেন আপনার?
– কারন ও নবনী না৷ আমার প্রয়োজন ছিলো নবনীর মত একজন মানুষ। সেইসাথে চুপচাপ শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে যে চুপচাপ সব মেনে নিবে। আমি নবনীকে যা দেখাতে চেয়েছিলাম সেটা আর কখনোই সম্ভব না সেটা আমি বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে টের পেয়েছিলাম। এবং তার সাথে আমার সংসার করা সম্ভব না সেটাও ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম।
– এক সপ্তাহেই ডিভোর্সের কথা মনে হলো আপনার!
– হুম। নবনীর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো খুব ডিস্টার্ব করছিলো৷ বারবার রুপুর মাঝে আমি নবনীকে খুঁজেছি। একবারও পাইনি। একটা কিংবা দুটো অমিল থাকলে হয়তো সংসার করা যেতো৷ যার সাথে আমার পুরোটাই অমিল তার সাথে সংসার কি করে সম্ভব?
– আপনি আপনার প্রেজেন্ট ওয়াইফের মাঝে যদি এক্স ওয়াইফকে খুঁজবেন তাহলে তাকে ডিভোর্স কেন দিলেন?
– নবনী যা চাচ্ছিলো তা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিলো না৷ দুর্ভাগ্যবশত রুপুও আমার কাছে একই জিনিস এক্সপেক্ট করতো৷ শুধু এক্সপেক্টই না, ও জোর করে ওর আবদারগুলো আদায় করে নিতো৷ পারতো না শুধু আমার ভালোবাসাটুকু আদায় করতে৷ প্রায়ই বলতাম চলে যাও। ডিভোর্স দিতে চাই তোমাকে। বিয়ের চারমাস পর থেকে খুব বেশিই বলতাম। ও বুঝতে পারতো আমি কথার কথা বলছি না। যা বলছি সত্যিই বলছি। তবুও ও রাগ করতো না৷ মুচকি হাসতো। কখনো আমার গলা দুহাতে জড়িয়ে হাসতো আর বলতো, ভালো তো বাসো না একটুও। সারাদিন তো শুধু বকাই দাও আমাকে।তোমার নবনী বেস্ট আর আমার লাজ-লজ্জা নেই, সেল্ফ রেসপেক্ট নেই বলতেই থাকো। আবার ডিভোর্সও দিতে বলো। আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করি। ইচ্ছে হয় চলে যাই৷ কিন্তু আমি যাই না। ব্যাগ গুছাতে যাবো ঠিক তখনই মনে হয় আমি চলে গেলে সিকু তো একদম একা হয়ে যাবে। কাকে বকা দিবে? আমি চলে গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট তোমারই হবে সেটা আমি জানি। এজন্য আমি যাই না। আর নয়তো কবে চলে যেতাম!
– উনার আত্মসম্মান নিয়ে খুব খোঁচাতেন তাই না?
– সুযোগ পেলেই এটা নিয়ে কথা শোনাতাম। কারণে অকারণে শোনাতাম। বিয়ের ২৭ দিন পর ও সাবিহাকে নিয়ে এসেছিলো আমার অফিসে। অফিসের ফ্লোরে পা রাখতেই আমাদের হাসিব ভাইয়ার সাথে ওর দেখা। ও বাহিরে দাঁড়িয়ে আমাকে কল করছিলো। আমি রিসিভ করিনি৷ আমি জানতাম না ও লিফটের ওখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভাইয়া নিজ থেকে এগিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো কাকে খুঁজছেন?
ও বললো, সিকুকে খুঁজি। সরি, সৈকতকে খুঁজি৷
ব্যস, হাসিব ভাইয়া অতটুকু শুনেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। সেদিন থেকে হাসিব ভাইয়া আমাকে সিকু বলেই ডাকতো৷ ভাইয়ার দেখাদেখি অফিসের সবাই ঐ নামেই ডাকা শুরু করলো। অফিসে রুপু সেদিন আড়াইঘন্টার মত ছিলো। আড়াইঘন্টার মধ্যে একঘন্টা হাসিব ভাইয়া নিজের কেবিনে রুপুকে বসিয়ে গল্প করেছে৷ রুপুর কথা শুনে খুব হেসেছিলো উনি সেই একঘন্টা। আর বাকি দেড়ঘন্টা অফিসের বাকি স্টাফদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে রুপু। অদ্ভুত সব কথা বলে আড়াইঘন্টায় আমার অফিসের বস, কলিগ সবাইকে হাসিয়ে রুপু হয়ে গেলো আমার অফিসের সেলিব্রিটি আর অফিসের সবাই হয়ে গেলো রুপুর ফ্যান। হাসিব ভাইয়া তো রুপুকে অফিসের নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছিলো। ও চলে যাওয়ার পর হাসিব ভাইয়া আমাকে বলেছিলো,
– চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিস৷ কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়।
অফিসের সবাই রুপুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো৷ কেন থাকতো আমি জানি না। আমি খুব বিরক্ত হতাম ওদের প্রশংসা শুনে। না পারতাম কিছু বলতে না পারতাম সহ্য করতে৷ তারউপর অফিসে যেয়ে সিকু ডাকটা শুনলে মনে হতো আমার কান পঁচে যাচ্ছে। তবুও শুনতে হতো। বাধ্য হয়ে শুনতে হতো৷ আমার অফিসের কলিগদের সাথে রুপুর দারুন সম্পর্ক তৈরী হলো৷ ওর সাথে কমবেশি সবাই ফেসবুকে যোগাযোগ করতো৷ ও মাঝেমধ্যে অফিসে চলে আসতো। দিনদিন ওদের এই সুন্দর হতে থাকা সম্পর্কটা আমার কাছে বিষ মনে হতে লাগলো৷ সীমা ছাড়িয়ে গেলো ঠিক দুইমাস পর। আমাদের অফিস কলিগদের একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ ছিলো। সেখানে আমরা সবাই টুকটাক কথা বলতাম, হাসি তামশা করতাম। সেই গ্রুপে রুপুকে এড করা হলো৷ সেদিন রুপুর সাথে খুব চেঁচামেচি করলাম। বললাম,
– তুমি এমন কেন? ওরা আমার কলিগ৷ ওদের সাথে তোমার এত কথা বলতে হবে কেন? এত সস্তা কেন তুমি? যখন তখন যেখানে সেখানে হাজির হয়ে ফালতু বকবক শুরু করো। ওরা তোমাকে অফিসে ডাকে আর তুমিও চলে যাও জোকার সেজে ওদের বিনোদন দিতে৷ নিজের সম্মানের দিকে একটু তো তাকাও!
ও বললো,
– এখানে সম্মানের প্রশ্ন আসছে কেন? কারো সাথে আমার সম্পর্ক যদি ভালো হয় সেখানে সম্মান নিয়ে টানাটানির কি আছে? সবকিছুতেই এত সম্মান-সম্মান করো কেন? তুমি যেটাকে আত্মসম্মান ভাবো সেটা কখনোই আত্মসম্মান না। সেটা তোমার ইগো।
– হ্যাঁ। ঠিকই তো বলেছে। অফিসের কেউ কি কখনো আপনাকে বলেছে ভাবীকে উনারা জোকার ভাবে?
– উহুম। অফিসের সবাই ওকে খুব পছন্দ করে।
– তাহলে এসব বললেন কেন?
– তখন যা মাথায় এসেছে তাই বলেছি।
– একটা কথা বলুন তো? আমি অফিসে এসেছি ছয়মাস হলো। কখনো তো দেখিনি কেউ আপনাকে সিকু বলে ডাকছে কিংবা ভাবীকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেছে।
– ওরা কেউ কখনো অফিসে বসে রুপন্তিকে নিয়ে কোনো গল্পই করবে না। আমাকে ঐ নামে ডাকবেও না।
– কেন?
– হয়তো রুপু নিষেধ করেছে।
– কেন?
– সেটা আমার শাস্তি।
– ভাবী কি এখনো আপনার সঙ্গে আছে? নাকি চলে গিয়েছে?
(চলবে)
#মিম