#ঘুণপোকা
#পর্ব_৮
সৈকত মুচকি হাসলো। ইমরানের প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গ টেনে আনলো৷
মাসখানেক যাওয়ার পর আমি অদ্ভুত তীব্র শূণ্যতায় ভুগতে শুরু করলাম। নবনী নামক শূণ্যতা দিন দিন গাঢ় হতে থাকলো। আমার বারবার মনে হতে লাগলো কেন আমি নবনীকে যেতে দিলাম? কেন আমি রুপন্তিকে বিয়ে করলাম? নবনী আমার জন্য পারফেক্ট ছিলো। নবনীর সবকিছু আমার সাথে মিলে যেতো। কত ভালো ছিলাম আমি! আর রুপন্তির সাথে আমার সম্পর্কটা একটা মিসম্যাচ। দুজনের মাঝে বিশাল পার্থক্য। এই পার্থক্য কখনোই মিটবে না। ওর প্রতিটা ব্যাপার আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হতো৷ রুপুকে আমার কাছে বিশাল বড় আপদ ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না। বিশেষ করে আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় কেউ নাক গলাচ্ছে এটা আমার সহ্য হচ্ছিলো না৷ ও ভালো কথা বললেও আমার বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। আমি খুব বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গিয়েছিলাম। কোনকিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না৷ কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। তখন মনে হলো রুপন্তিকে আর চুপচাপ মেনে নেয়া ঠিক হচ্ছে না। ওকে কড়া কথা না শোনালে আমি শান্ত হতে পারবো না। মনে রাগ পুষে আর কতক্ষণ শান্ত থাকা যায় বলো? সেদিন অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম। বরাবরের মতই রুপন্তি বারবার কল করছিলো। আমি একটা কলও রিসিভ করিনি। যখন আমি বাসায় পা রাখি তখন বাজে রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ। কলিংবেলে চাপ দেয়া মাত্রই রুপু দরজাটা খুলে দিলো। মনে হচ্ছিল যেন ও দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে দেখতেই ভ্রু কুঁচকে অভিযোগ করা শুরু করলো,
– এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? কতবার কল করলাম একটাও রিসিভ করলে না!
ওর কোনো কথার উত্তর না দিয়েই জুতা খুলে ঘরে ঢুকলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায়। বাবা ডাইনিংরুমেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি উত্তর দিচ্ছি না দেখে বাবা বললো,
– মেয়েটা কখন থেকে অস্থির হয়ে আছে। ওর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
ব্যস, শুরু করে দিলাম চিৎকার। বললাম,
– কেন এই মেয়ের সব কথার উত্তর আমাকে দিতে হবে? ও কে? কেন ওকে আমার সবকিছুর কৈফিয়ত দিতে হবে?
বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ আমার চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মা আর সাবিহা। ওরা দুজনও চুপ করে ছিলো আমার চিৎকারে৷ আমার এসব আচরনের সাথে বাসার সবাই পরিচিত ছিলো৷ অপরিচিত ছিলো রুপন্তি৷ খুব অবাক হয়েছিলো সেদিন। কেমন বোকা বোকা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। খুব শান্ত কন্ঠে আমাকে বললো,
– তুমি বাবার সাথে এভাবে কথা বলছো কেন?
সেদিনই প্রথমবার রুপন্তির দিকে আমি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছিলাম। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিয়েছিলাম,
– তো আর কার সাথে করবো শুনি? উনার কথায় তোমাকে বিয়ে করেছি। ভেবেছিলাম বাবা তো আর ছেলের জন্য খারাপ কোন সম্বন্ধ নিয়ে আসবে না৷ তোমার মত একটা সার্কাসের জোকারকে আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে কখনোই কল্পনা করতে পারি নি। বিয়ের পর থেকে আমার ঘাড়ে চড়ে বসে আছো। নরকে পরিণত হয়েছে আমার জীবন। যা যা আমি সহ্য করতে পারি না সেসব আরো বেশি করে করতে থাকো। কেন করো? কি চাও? আমাকে অশান্তিতে রেখে মারতে চাও তুমি?
– আমি কি……
– থামো। একটা কথাও বলবে না। সারাদিন কথা বলতেই থাকো, বলতেই থাকো। কত কথা বলো! মুখ ব্যাথা করে না তোমার? পাশের মানুষটা বিরক্ত হচ্ছে কি না সে খেয়াল আছে তোমার? মাথাব্যাথা শুরু হয় আমার তোমার কথা শুনতে শুনতে। আর এতবার কল করার কি আছে শুনি! ভালো লাগে না ঘন্টায় ঘন্টায় এত কল। আমি তোমার কল রিসিভ করি না এটা তুমি বুঝো না কেন? ইচ্ছে করে রিসিভ করি না আমি। এতটুকু বুঝার ক্ষমতা কি নেই? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান ধরো?
আমি রুপুকে এতগুলো কথা বললাম অথচ ও আমার একটা কথারও প্রতিউত্তর দিলো না৷ একফোঁটা চোখের পানিও ও ফেলেনি৷ শুধু চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো৷
– খুব সাধারণ কথা ছিলো। এখানে তো রেগে যাওয়ার মত কোন কথা ছিলো না৷
– হ্যাঁ, খুব সাধারণ কথাই ছিলো। কিন্তু ওর প্রতি আমার রাগ তো পুরানো ছিলো৷ ঐ একমাসের রাগ একদিনে ঝেড়েছি৷
– আপনার বাবা মা কিছুই বললো না?
– না৷ উনারা জানতো আমাকে তখন কিছু বললে আমি আরো বেশি রেগে যেতাম আর যা খুশি বলে দিতাম।
– সেদিনের পর ভাবী আপনার সাথে রাগ করে ছিলো কতদিন?
– কতদিন! কি যে বলো না! আমি ভেবেছিলাম সেদিনের পর রুপু আর উল্টাপাল্টা কিছু করবে না৷ আমাকে বিরক্ত করবে না৷ রাগ করে আমার সাথে এটলিস্ট সপ্তাহখানেক কথা বলবে না৷ আমি এই কয়টাদিন একটু শান্তিতে কাটাতে পারবো। আমার ধারণা আবারও ভুল হলো৷ কড়া কথা মুহূর্তেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার ক্ষমতা রুপুর আছে সেটা আমি সেদিনই জেনেছি। সেদিন শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখি রুপু ওয়াশরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে৷ আমার হাত থেকে তয়লাটা নিয়ে আরেক হাতে টেনে আমাকে বসালো খাটের উপর। তয়লা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো,
– এত রাগ করেছো আমার সাথে! এত বকা দিতে জানো তুমি! আমি কিন্তু কষ্ট পেয়েছি। এবারের মত মাফ করে দিলাম৷ আর কখনো এভাবে বকবে না আমাকে। আবার যদি বকা দাও তাহলে আমি কিন্তু রাগ করে চলে যাবো।
আমি আবারও বোকা বনে গেলাম। সামনে দাঁড়িয়ে সযত্নে আমার চুল মুছতে থাকা মেয়েটাকে আমি বেহায়া হিসেবে আবিষ্কার করলাম। কিভাবে সম্ভব! এত কথা শোনার পরও কিভাবে এই মেয়ে আমার সাথে আহ্লাদ করে কথা বলছে! ও আরও কি বলছিলো জানো?
– কি?
– সিকু তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একগ্লাস শরবত এনে দেই৷ খুব যত্ন করে বানাবো। আমার এত্তগুলো ভালোবাসাও মিশিয়ে দিবো। খাওয়ার সাথে সাথেই দেখবে এসব ক্লান্তি টান্তি সব উধাও৷
– কি অদ্ভুত! আপনার কথা শুনে উনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলো আপনি কতটা বিরক্ত উনার প্রতি। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী উনি৷ বিয়ের পরপরই কোনো মেয়ের সাথে তার হাজবেন্ড এত রুড বিহেভ করলে তো সেই মেয়ে হয় বাবার বাড়ি ফিরে যাবে আর নয়তো দশ বারোদিন কথাই বলবে না। অথচ উনি আপনার রুড বিহেভ কি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলো! আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করছে!
– ও এমনই। ওকে কেউ শ’খানেক কড়া কথা শোনালেও ওর কিছুই আসে যায় না৷ এক কানে ঢুকায় অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। রুপুকে কেউ বকা দিলে তার সাথে রুপু কয়েক মিনিট পরই হেসে হেসে কথা বলা শুরু করে৷ ওকে দেখে বুঝার উপায় নেই একটু আগেই সামনের মানুষটার কাছে সে বকা খেয়েছে। আর আমি বকা দিলে কিছুক্ষণ চুপ থাকতো। তিন চারমিনিট পর আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলতো,
– থাক, আমরা আমরাই তো। তুমি বকা দিয়েছো আবার তুমিই আদর করবে৷ বকা তো দিয়েছোই এখন রাগ ঝেড়ে ফেলো তো! কাছে আসো তোমাকে একটু আদর করে দেই।
এই বলেই গালে আর নয়তো ঠোঁটে চুমু দিতো।
– উনি আপনাকে খুব ভালোবাসতো তাই না?
– অনেক বেশি৷ আমি ওর ভালোবাসার যোগ্য ছিলাম না৷ এতখানি ভালোবাসার মত কিছুই আমি করিনি। কিন্তু আমাকে ঘৃনা করার মত অনেক কারণ ছিলো ওর কাছে। ওর সাথে প্রথম যেদিন আমি খারাপ ব্যবহার করলাম, সেদিনের পর থেকে ওর সাথে ভালো আচরন আমি খুব কমই করেছি। সেদিন রুপু এতগুলো কথা শোনা সত্ত্বেও আমার সাথে নরমাল বিহেভ করে আমাকে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছিলো ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করার। পান থেকে চূন খসলেই ওকে আমি কথা শোনাতাম। দিন যাচ্ছিলো ওকে কড়া কথা শোনানোর মাত্রা আরো বাড়ছিলো৷
– কেন?
– মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। রুপু কেন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নেয়, ও কেন কষ্ট পায় না এটা আমাকে খুব খোঁচাচ্ছিল। কি বললে ও কষ্ট পাবে, ও মেনে নিতে পারবে না এটা জানা আমার জন্য খুব জরুরি হয়ে গেলো। এজন্যই ওকে নিত্যদিন কিছু না কিছু শোনাতামই। ওকে কথা শুনিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না দেখে শুরু করলাম নবনীর সাথে তুলনা করে ওকে খোঁটা দেয়া। কথায় কথায় নবনীর সাথে ওকে তুলনা করতাম। আজেবাজে বকতাম। ও শুধু হাসতো আর বলতো,
– তোমার নবনী কখনোই আমার মত হতে পারবে না। দুনিয়াতে রুপু এক পিসই আছে।
– এত অপমান করতেন, তবুও উনি আপনাকে ভালোবাসতো!
– হুম বাসতো। অকারণেই রুপু আমাকে ভালোবাসতো।
পৃথিবীতে কোনো মেয়ে তার হাজবেন্ডের মুখে এক্স ওয়াইফের প্রশংসা হাসিমুখে মেনে নিয়েছে এমন ঘটনা আমি কখনোই শুনিনি৷
– শুধু আপনি কেন? কেউই শুনেনি৷
– সত্যিই পৃথিবীতে রুপু একজনই আছে। ওর মত কেউ নেই।
– এই মানুষকে এত অবহেলা কি করে করলেন ভাইয়া? আপনি উনাকে কখনো স্বাভাবিক ভাবে মেনেই নেন নি। কেন?
– প্রথম থেকেই আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল রুপু আমার মত না। ও অদ্ভুত এবং বিরক্তিকর একটা ক্যারেক্টার। ওকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
– একটাবার কি উনাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়ার চেষ্টা করতে পারতেন না?
– অবশ্যই পারতাম। কিন্তু করিনি। যাকে জীবন থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছি তাকে কেন স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার চেষ্টা করবো?
জানো ইমরান, রুপু জাদু জানতো। মানুষ বশ করার জাদু৷ আমার ছোট ফুফু খুবই জাদরেল স্বভাবের মহিলা। বিয়ের সাতমাসের দিকের ঘটনা। একরাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে জানতে পারলাম পরদিন ফুফু আসছে৷ মনে মনে কি যে খুশি হয়েছিলাম!
– আপনার ফুফুর সাথে সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো ?
– মোটেই না। আমরা দুজন দুজনকে একদম সহ্য করতে পারতাম না৷ ফুফু কারো কোনো ভুল দেখলেই খোঁচা দিয়ে কথা বলতো, বকা দিতো। আমার ফ্যামিলির সাথে আমার অতটা আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো না, বাবা মা কে তেমন প্রায়োরিটি দিতাম না এসব কারণে ফুফু আমাকে কথা শোনাতো৷ আমার অসহ্য লাগতো উনাকে। উনি আমাদের এখানে আসলে সহজে আমি বাসায় পা রাখতাম না। আর আমার বিয়ের পর তো নবনীকে যথাসম্ভব উনার কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতাম। উনি নবনীকে সহ্যই করতে পারতো না। সবসময় বাবা মাকে বলতেই থাকতো,
– কি এক বউ যে সৈকত নিয়ে আসলো! এটা বউ নাকি ব্যাটা ছেলে বুঝি না তো কিছু।
– ব্যাটা ছেলে বলতো কেন?
– নবনী জিন্স পরতো। বাসার কাজ টাজ ছুঁয়েও দেখতো না৷ বাসার বাহিরে থাকতো বেশিরভাগ সময়। এসব কারণে ফুফু ওকে ছেলে ডাকতো। রুপু রান্না করতে পারতো না। রান্না করতে গেলে জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলতো। তারউপর বকবকানি স্বভাব, সারাঘর অকারণে ছুটোছুটি তো চলতোই। ফুফু এসব একদম সহ্য করতে পারবেনা এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম৷ উনার মতে মেয়ে মানুষ হবে ঘরোয়া কাজে পটু, শান্ত আর স্নিগ্ধ। আমি রেডি হয়ে বসে ছিলাম ফুফু রুপুকে জম্পেশ ধোলাই দিচ্ছে সেটা দেখার জন্য। পরদিন আমার অফিস আসতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না৷ কাজের প্রেশার ছিলো অনেক তাই আসলাম। মন পড়ে রইলো বাসায়৷ কতক্ষণে বাসায় যাবো সেই অপেক্ষায় অস্থির হয়ে গেলাম। অস্থিরতায় এক কাজ তিনবার ভুল করলাম৷ আমার আর জলদি বাসায় ফেরা হলো না৷ বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত একটা। বাসার সবাই ঘুম একমাত্র রুপু বাদে। ও জেগে বসে ছিলো আমার জন্য। সবসময়ের মত আমার মুখ দেখেই বললো আমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। লেবুর শরবত বানিয়ে দিবে কিনা৷ অন্যদিন হলে রাত একটায় আমি কখনোই শরবত খেতে রাজি হতাম না৷ কিন্তু সেদিন শরবত বানাতে বললাম। ছুটে চলে গেল রান্নাঘরে শরবত বানাতে। আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি ও শরবতের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে খুব ধীরে ধীরে শরবত খাচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম ও আমাকে কখন ফুফুর ধোলাই খাওয়ার গল্প শোনাবে। একগ্লাস শরবত আমি পুরো বিশমিনিট সময় নিয়ে শেষ করলাম। এই বিশ মিনিটে রুপু রাজ্যের সব গল্প বলে ফেললো অথচ ফুফুকে নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না৷ ও কিছু বলছে না দেখে আমিই জিজ্ঞেস করলাম
– ফুফু এসেছে?
– হ্যাঁ এসেছে তো। সাবিহার সাথে ঘুমাচ্ছে।
– কথা হয়েছে উনার সাথে?
– ও মা! হবে না! সারাদিনই তো কথা হয়েছে। খুব ভালো মানুষ।
– বকা টকা দিয়েছে?
– নাহ্। বকা দিবে কেন?
– রান্না বান্না তো জানো না। করো তো সারাক্ষণ তিড়িংবিড়িং৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!
– নাহ্ আমাকে তো বকে নি।
– সত্যিই বকা দেয়নি?
– নাহ্। ভালোই তো কাটালাম সারাদিন। আমি আইসক্রিম পছন্দ করি তাই বিকেলে আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো। বললো, যেই ফ্লেভারের বক্স ভালো লাগে সেটা তুলে নিতে। রাতে আমি সাবিহা আর ফুফু বসে রজনী কান্তের মুভিও দেখেছি। কাল থেকে উনার কাছে আমার কুকিং ক্লাস শুরু হবে। উনি নিজেই বললো আমাকে রান্না শেখাবে এই দশদিন। দশদিনে দশটা রেসিপি শিখবো আমি৷
ওর কাছে এই ধরনের উত্তর আমি মোটেও আশা করিনি। সারাদিনের আশা আর স্বপ্ন মুহূর্তেই মাটি হয়ে গেলো। প্রচন্ড হতাশ হলাম আর ভাবতে লাগলাম, এটা কেমন অবিচার! রুপুর এক হাজার সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ফুফু ওকে কেন ছাড় দিলো? আমি হলে তো এতক্ষণে ধুয়ে মুছে শেষ করে ফেলতো। লেবুর শরবতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আরো বেশি হতাশ লাগছিলো। অহেতুক এত রাতে এই শরবতটা আমাকে খেলাম। তাও বিশি মিনিট সময় নিয়ে! পুরো সময়টাই আমার বৃথা। একে তো মেজাজ খারাপ হচ্ছিল খুব। তারউপর আগুনে ঘি ঢালার মত একটা কথা বলে বসলো রুপন্তি।
– কি বলেছিলো?
– ও কেমন একটা শয়তানী ধাঁচের হাসি দিয়ে বললো ফুফু আমাকে বকেনি কিন্তু অন্য একজনকে বকেছে। জানো কাকে? আমার সতীন নবনীকে। কি বলেছে জানো? তুমি একটা অহংকারী আর অকর্মার ঢেঁকিকে বিয়ে করেছিলে। আর এখন তোমার বিয়ে হয়েছে মিষ্টি চড়ুই পাখির সাথে৷ এইযে তুমি আমাকে রান্না জানি না, আমি কোন কাজের না এসব বলে খোঁটা দাও আর নবনীর এত গুন কীর্তন করতে থাকে এগুলো কিন্তু ঠিক না। রান্না তোমার নবনীও জানতো না৷ সে আর আমি একইরকম। আমরা দুজনই অকর্মা। ফুফু আমাকে সব বলে দিয়েছে।
এগুলো বলেই ও হাসতে শুরু করলো। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলছিলাম আমি। তখন কয়টা বাজে ঘড়িতে! খুব সম্ভবত দুইটা। অতরাতেই আমি খুব চেঁচামেচি করেছিলাম রুপুর সাথে।
– কি বলেছিলেন?
– অনেক কিছু। নবনীর সাথে ও নিজেকে তুলনা করছে এটা আমার সহ্যই হলো না। বললাম, নবনীর সাথে নিজেকে তুলনা করো! নবনীর পায়ের যোগ্যতা তোমার আছে! ও ঘরের কাজ পারে না কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার তো সামলে যাচ্ছে। ও কত ট্যালেন্ট তুমি জানো? মাসে কত সেলারী পায় সে খবর জানো? মানুষকে বিরক্ত করা ছাড়া আর তো কিছুই করতে জানো না।
– হ্যাঁ করবোই। করতেই থাকবো৷ কি চাও? তোমাকে রেখে চলে যাই? তুমি যত বেশি রাগ করবে আমি ততবেশি তোমাকে জ্বালাবো৷ জীবন থাকবে যতক্ষণ জ্বালাতে থাকবো ততক্ষণ। এই যে তোমার গলায় ঝুলেছি, আমি আর তোমাকে ফেলে কোথাও যাচ্ছি না৷ তুমি চাইলেও আমাকে দূরে সরাতে পারবে না।
– একটা কথা বলি ভাইয়া?
– হুম?
– নবনী আপনার এক্স৷ হতে পারে ভাবীর সহ্যক্ষমতা বেশি। কিন্তু আপনার এক্স কে নিয়ে ভাবীকে এত কথা না শোনালেও পারতেন৷ হয়তো উনি হাসিমুখে কথাগুলো ইগনোর করতো কিন্তু কষ্ট কি উনি পেতো না? একটু হলেও পেতো।
– অবশ্যই রুপুর কষ্ট হতো৷ কিন্তু ও প্রকাশ করতো না৷ অদ্ভুত সহ্যক্ষমতা আছে ওর। রুপুর এই সহ্যক্ষমতার শেষ সীমা কোথায় সেটা খুঁজতে গিয়েই তো আমি আমার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলাম।
~চলবে~
#মিম