#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ২৫
#অত্রি_আকাঙ্ক্ষা
কুয়াশা আচ্ছন্ন রাত।বাহিরে হিমশীতল ঠান্ডা।ঘরের ভেতরে থেকে বাহিরের অবস্থা বোঝা মুশকিল।ধোঁয়া ওঠা চা ইতিমধ্যে ঠান্ডা হয়ে গেছে।এক ঘন্টা আগের তৈরি।ঠান্ডা হবে এটাই স্বাভাবিক!কাপের চারপাশে দুটো মাছি ভনভন করছে।বেলকনির আধখোলা দরজা দিয়ে হিম বাতাস একটু একটু করে কক্ষের ভেতরে ঢুকছে।টেবিলের ওপরে বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।চন্দ্ররেখা ঘুমে বিভোর।পড়তে পড়তে বইয়ের ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।শৈত্য সমীরণের স্পর্শে পেতেই তার দেহের প্রতিটি পশম দাঁড়িয়ে গেছে।ঘুমের মধ্যে বারবার কুঁকড়ে যাচ্ছে সে।ক্ষীণ একটা শব্দ হলো।ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো শারাফ।মাত্র ফিরিছে সে।দরজা বরাবর রিডিং টেবিল।সেদিকে চোখ পড়তেই থমকে গেল।ঘুমন্ত এক অপ্সরার মাঝে ক্ষণিকের মধ্যেই হারিয়ে গেল।মোহগ্রস্তের ন্যায় এগিয়ে গেল।চন্দ্ররেখার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।ঘুমন্ত দশায় গৌরবর্ণের মসৃণ দীপ্তমান ত্বকের লাবণ্যতা যেন দেড়গুণ বেড়ে গেছে।মায়াময় মুখশ্রীর দিকে নেশালু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।শারাফের স্থির চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো।কিছু বৈধ আকাঙ্ক্ষা মাথায় আঘাত হানলো।রুক্ষ ঠোঁটজোড়া এগিয়ে নিয়ে গেল।উদ্দেশ্য চন্দ্ররেখার ডান কপোলে উষ্ণ উত্তাপের তীর ছোড়া।ঘুমের মাঝে কেঁপে উঠলো রেখা।সেদিকে খেয়াল দিলো না শারাফ!হুশ খুইয়ে চন্দ্ররেখার তুলতুলে গালে একের পর এক উষ্ণতা ছাড়িয়ে দিতে লাগলো।রেখার ঘুমের রেশ কিছুটা কাটতে শুরু করেছে।অযাচিত পরশে হৃদয়ে স্পন্দন বেড়ে গেল।ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে!চেয়ার সমতে পড়েই যাচ্ছিলো,তার পূর্বে পেশীবহুল অভ্যস্ত এক হাত তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
-“রিল্যাক্স!ইট’স মি।”
শ্রবণন্দ্রিয়ে ভরাট আশ্বস্ততার নমনীয় কন্ঠস্বর সর্নভেদ করতে চন্দ্ররেখার ঘুৃম পুরোপুরি উবে গেল।চোখের সামনে স্বামী নামক প্রেমিক পুরুষকে দেখে শান্তির শ্বাস ছাড়লো।পর মূহুর্তে জড়িয়ে ধরলো।বলিষ্ঠ পুরুষালী বক্ষে নিজেকে মিশিয়ে ফেলল।শারাফ কিছুটা অবাক হলো।ডান হাত চন্দ্ররেখার কোমড়ে থাকায়,বা’হাতে দ্বারা পিঠ বুলিয়ে দিতে লাগলো।ঘন গলায় ধীরে ধীরে বলল,
-“ইজ অল ওকে?হোয়াই ডু ইউ ফিল সো রেস্টলেস?”
চন্দ্ররেখা শারাফের চওড়া বুক থেকে মাথা তুললো।ডান হাত শারাফের গালে রেখে,ঠোঁট ফুলিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।কান্নারত গলায় শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
-“নাথিং,ইজ ওকে।আজকে সারাদিনে আপনি আমাকে একবারও কল করেন নি।তাই আমি অস্থির হয়ে আছি।আপনি কি আমার ওপর রেগে আছেন?কিছু কি করেছি আমি?”
রেখার ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে শারাফের বুক ধক করে উঠলো।সকালের অভিমান সব ঝরঝর করে পড়ে গেল।নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হলো।সারাদিনের ব্যস্ততায় চন্দ্ররেখাকে ফোন দেওয়ার সময়ই পায় নি সে।তিন-চারবার মনে হলেও সিচুয়েশনে ভিন্ন থাকায়,ফোন হাতে নিয়েও পুনরায় পকেটে ভরে নিয়েছে।ইশশ…..মেয়েটাকে নিশ্চয়ই অপেক্ষায় ছিলো।শারাফ চন্দ্ররেখার কপালে ঠোঁট রেখে রাশভারি নরম গলায় কাতর কন্ঠে বলল,
-“সরি,চন্দ্রপ্সরা।অনেক অনেক সরি।প্লিজ কাঁদবেন না।সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম।বাট আই মিসড ইড এ লট।আর আপনার ওপরে রাগ করবো!তাও আমি! আমার বিনাশ হোক।”
চন্দ্ররেখা কান্নার গতি কিছুটা কমে এলো।আরো একটু নিকটস্থ হলো।শারাফের শার্টের প্রথম দুটি বোতাম খোলা থাকায়,শক্ত বলিষ্ঠ বক্ষের কিছু অংশে তার নজর গেঁথে গেল।গলার কিছুটা নিচে লালচে একটা তিল।হুট করে চন্দ্ররেখা তার পাতলা ঠোঁটজোড়া সেখানটায় বুলিয়ে দিলো।তারপর জড়ানো গলায় বলল,
-‘আর কখনো এমন করবেন না।আমার কষ্ট হয়।’
চন্দ্ররেখার স্পর্শে ও রিনরিনে সুমধুর কন্ঠে শারাফের সারাদেহ অবশ হয়ে এলো।ভালোবাসাময় উদ্দামতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।অনেক কিছু বলতে চাইলো,কিন্তু সবকথা দলা পাকিয়ে গলার কাছে আঁটকে এলো।অপলক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো।চেয়ারে যত্ন সহকারে বসিয়ে দিলো তার চন্দ্রপ্সরাকে।মেদহীন কোমড় থেকে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিলো।বহু কষ্টে নিজের সংযত করে উঠে দাঁড়ালো।কিছুটা ঝুঁকে চন্দ্ররেখার অবিন্যস্ত চুল গুলো ঠিক করলো।অতপর ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি নিয়ে বলল,
-“আমি অঙ্গীকার করলাম কখনো এমন হবে না।এবার আপনি একটু অপেক্ষা করুন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি…কেমন?”
চন্দ্ররেখা মাথা নাড়ালো।শারাফ তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।মিনিট বিশেক পরেই বের হয়ে এলো।ঘাসের লেগে থাকা শিশির বিন্দুর ন্যায় চওড়া বুকের ওপর পানির ফোঁটা বসে আছে।সদ্য স্নান শারফকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে।পরনে কেবল একটা গ্রে কালারের বারমুডা।তার উন্মুক্ত লিন বডির দিকে তাকিয়ে রেখার শরীর শিরশির করে উঠলো।বেহায়া দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।শারাফ চন্দ্ররেখার লজ্জা রাঙা লালচে মুখের দিকে আড়চোখে তাকালো। শব্দবিহীন চওড়া হাসলো।রেখা হাল্কা কেশে,উৎসুক কন্ঠে বলল,
-“আজকে কি হয়েছে জানেন?”
শারাফ তোয়ালে দিকে চুল মুছ ছিলো।সে চুল মোছা থামিয়ে চন্দ্ররেখার দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল।
-“জাহিদ ভাইকে নিয়ে হুলুস্থুল বেঁধে গিয়েছিলো।তার চোখে কি করে যেন মরিচের গুঁড়ো ডুকেছে?এরপর চোখ বন্ধ করে পানি খুঁজতে যেয়ে, গ্রাইন্ডার মেশিনে নাকি ভুলে ডান হাত ঢুকিয়ে দেন।তখই কেউ নাকি ইচ্ছে করে মেশিন চালু করে দেয়।ব্যস! এতে যা হওয়ার হলো!আঙুল ভেঙে খান খান।সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো,ছোট মামা সবাইকে জিজ্ঞাসা করলো।অথচ সে সময় নাকি কিচেনে কেউই ছিলো না।তাহলে সুইচ কে অন করলো,বলুন তো?”
শেষে চন্দ্ররেখা প্রায় চিন্তিতস্বরে প্রশ্ন করলো। জাহিদের কথা শুনে শারাফের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।চুল মোছা থামিয়ে দিয়ে চন্দ্ররেখার একদম কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়াল।চন্দ্ররেখা শারাফের জন্য খাবার নিয়ে সোফায় বসে ছিলো।শারাফ কিছুটা ঝুঁকে সোফার দুপাশে হাত রেখে চন্দ্ররেখাকে বন্দি করে নিলো।তারপর ফিসফিস করে বলল,
-“আমার পেয়াদারা।”
সামনে থাকা সুপুরুষটির দেহ থেকে ভেসে আসা আ্যারোমেটিক সোপ আর শ্যাম্পুর মিশ্রিত গন্ধে, চন্দ্ররেখার এতো সময় বিভোর ছিলো।পর মূহুর্তে শারাফের সম্পূর্ণ কথা বোধগম্য হতে বিস্ফোরিত দৃষ্টি তাকিয়ে রইল।কয়েক সেকেন্ড নিজেকে সামলে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
– “কিন্তু কেন?”
-“আমরা স্ত্রী,আমার বোনদের দিকে দুর্গন্ধযুক্ত চোখে তাকাবে,আর আমি সবকিছু মুছ বুঝে সহ্য করবো তা হয় না! লাইলি আর লুবনা আপাকে বলে রেখেছিলাম।তারা এতো সুন্দর করে কাজটি করবে বুঝতে পারি নি।”
শারাফ বাঁকা হেঁসে উত্তর দিলো।চন্দ্ররেখা চোখ আপনাআপনি ছলছল করে উঠলো।কম্পমান গলায় বলল,
-‘কিন্তু সিম্পল একটা বিষয়ে নিয়ে আপনি কি করে একজনকে এভাবে শাস্তি দিতে পারেন?”
চন্দ্ররেখার কথা শুনে শারাফের মুখ শক্ত হয়ে গেল।চোখের সাদা অংশে হাল্কা লাল আভা দেখা যাচ্ছে।চন্দ্ররেখাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।ক্ষুদ্ধ গলায় চাপাস্বরে বলল,
-“সিম্পল মনে হচ্ছে আপনার কাছে?সে যদি আপনার বিরাট কোনো ক্ষতি করে দিতো? আপনি জানেন,তাকে আমি সকালে একবার ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম।লাস্ট চান্স!অথচ সে মিসইউস করেছে!আপনার অনুমতি বিহীন ছবি তুলেছে।সে ছবিতে বাজেভাবে স্পর্শ করেছে।আমার স্ত্রীর সাথে কেউ এমন হরিবল কাজ করবে আর আমি স্বামী হয়ে তা টোলারেট করবো?ইম্পোসিবল!আপনি আমাকে মন্দ……
শারাফ পুরো কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই চন্দ্ররেখা পেছন থেকে এসে তাকে ঝাপটে ধরলো।শারাফের অবরুদ্ধ পৃষ্ঠে মুখ চেপে কাতর কন্ঠে বলল,
-“আমি আপনাকে একবারও খারাপ ভাবি নি।বিশ্বাস করুন!সে যদি পরর্বতীতে আমার জন্য আপনার কোনো ক্ষতি করে?আমার জন্য বাবার কতো বড় ক্ষতি হয়েছে,সেটা তো আপনি নিজ চোখেই দেখেছেন।আপনার চিন্তা করেই আমি বলেছি।জাহিদ ভাইয়ের দৃষ্টিতে আমি অস্বস্তি বোধ করতাম ঠিকি।কিন্তু আমি জানতাম না যে,সে এতোকিছু করেছে।একেবারেই জানতাম না!আপনি একদম ঠিক করেছেন।আমি আসলে তখন….
শারাফ দু’হাতে নিজের মুখ ঘষে পিছনে ঘুরলো।চন্দ্ররেখার মুখ নিজের হাতে তুলে ধরলো।কপালে গভীর চুমু খেলো।
-“হুশশশ…..কাঁদবেন না।আমার বুকে ব্যাথা হয়।আপনার জন্য কারো কিছুই হয় নি।আমারও কিছু হবে না।আপনার জন্য আমি সব করতে পারি!সব!আপনি আমার কাছে ওয়াদা করুন কখনো ভুল বুঝবেন না আমায়।আমাকে ছেড়েও যাবেন না।কখনো কিছু হলে আমরা একসাথে সবকিছু শর্টআউট করবো…..ওকে?”
চন্দ্ররেখার তাৎক্ষণাৎ কান্না থামিয়ে দিলো।মাথা নেড়ে শারাফের বাড়িয়ে দেওয়া হাত চেপে ধরলো।
-“ওয়াদা করলাম,আপনাকে কখনো ভুল বুঝবো না।সবসময় পাশে থাকবো।”
শারাফ চন্দ্ররেখাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।তারপর বিড়বিড় করে বললো,
-“থাকতে বাধ্য আপনি।না চাইলেও রাখবো।আপনার কাছে সেকেন্ড কোনো অপশনও নেই।”
চন্দ্ররেখা আদোও কি সেকথা শুনতে পেয়েছে?একদমই না!সে নিজের মতো চোখ বন্ধ করে শারাফের শরীরের উষ্ণতা উপভোগ করছে।
———
শীতকাল শুরু হলেও মিষ্টি রোদের দেখা মেলা দুষ্কর।রাতের শেষভাগে কিছুটা ঠান্ডা অনভূত হলেও মধ্যাহ্নের দিকে সূর্য থেকে ধেয়ে আসা কড়কড়ে রৌশনি,সারা শরীর জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম।ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে মাত্রই গেটের বাহিরে পা রেখেছে চন্দ্ররেখা।মুখে মাক্স থাকা সত্যেও তার লালচে কপালের দিকে তাকালে আবহাওয়া উত্তাপ সহজেই বুঝে ফেলা যায়।আচমকা টয়োটা ভিটজ ১.৫ ভার্সনের একটি ছোট হ্যাচব্যাক কার চন্দ্ররেখার সামনে এসে ব্রেক করলো।গাড়ি থেকে নেমে এলেন সুধা মির্জা।চন্দ্ররেখাকে আগলে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললে,
-“চলো,আজকে মা মেয়ে মিলে পুরো ঝিল্লিপুর চষে বেড়াবো।সারাদিন ঘুরবো।যতো স্ট্রিট ফুড আছে ট্রাই করবো।প্রথমে না হয় ফুসকা দিয়ে শুরু করি কি বলো?”
ক্লাস শেষ হওয়ায় আধঘন্টা আগে শারাফ ম্যাসেজ করেছিলো সে রেখা পিক করতে আসছে।শারফের পরিবর্তে নিজের মাকে দেখে,চন্দ্ররেখা প্রথমে কিছুটা চমকালো।পর মূহুর্তে মায়ের অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টি দেখে মাক্স সমেত খিলখিলে হেঁসে উঠলো।অতঃপর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।সুধা মির্জা মেয়ের হাত আগলে ধরে ফুসকা স্টলের দিকে এগিয়ে গেলেন।অনন্য নজরের সীমাবদ্ধতার জন্য,
পৃথিবীর সবচেয়ে মনোরম দৃশ্যটি কেউ উপভোগ করতে পারলো না।তৈরি হতে লাগলো অসমবয়সী দুই নারীর বন্ধুত্ব গাঁথা।
চলবে
আপনারা একটু বেশি বেশি কমেন্ট করবেন।না হয়,আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি।😐