#চুপকথা
#৮ম_পর্ব
“আমি তো একবার বললাম আমার ভালো লাগছে না, কেনো এক কথা বারবার বলছেন?”
আরশিয়ার কথায় রুক্ষতা স্পষ্ট বোঝা গেল। পৃথুল থতমত খেয়ে গেল। খানিকটা অপ্রস্তুত হল। নিজের অনধিকার চর্চায় বেশ লজ্জিত হল সে। সে ভেবেছিল বাহিরে গেলে আরশিয়ার ভাল লাগবে। কেননা বাবা না আসার কথা জানার পর থেকেই মেয়েটি কেমন চুপসে গিয়েছিল। তবুও তার সম্মান রক্ষার্থে সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলেছে, গল্প করেছে। স্বামী হিসেবে এটা তার দায়িত্ব ছিল, কিন্তু সে হয়ত একটু বেশি করে ফেলেছে। তাই ধীর স্বরে বলল,
“সরি, আপনাকে বিরক্ত করার মোটিভ আমার ছিল না”
আরশিয়া বুঝতে পারল, সে ভুল করেছে। একজনের ক্ষোভ অন্যজনের উপর বর্ষাণো যৌক্তিক নয়। কিন্তু সে কিছু বলার পূর্বেই পৃথুল ঘর ত্যাগ করল। ফলে পুরো ঘরে একাই থেকে গেল আরশিয়া। নিজস্ব কৃতকার্জে তীক্ত গ্লানির সম্মুখীন হল সে। পৃথুল তো তার কথা রেখেছে। নিজ থেকে দূরত্ব মেটাবার অভিযানে নেমেছিলো সে। কিন্তু সেই অভিযানকে নিষ্ঠুরভাবেই দুমড়ে মুচড়ে ফেলল আরশিয়া। নিজের উপর তীব্র ধিক্কার জানাল সে। হ্যা, রাগ সংবরণ ক্ষমতা বরাবর ই তার কম। কমের পরিমাণকে মিটার স্কেলে মাপতে গেলে ভার্নিয়ার স্কেলের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র সংবরণ ক্ষমতাকে কখনোই দোষের মনে হয় নি, কারণ কখনো কেউ মনক্ষুন্ন হবার অপবাদ দেয় নি। অথচ আজ অকারণেই প্রিয় অপ্রিয় তালিকার সবচেয়ে উপরের মানুষটিকে আঘাত করল সে। বিরক্তিতে ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে উঠল আরশিয়ার। না ভুলটা শুধরে নেওয়া উচিত, তাই সময় নষ্ট না করেই বাহিরের ঘরে আসল। কিন্তু বাসার কোথাও পৃথুলের চিহ্ন খুঁজে পেল না। শ্বাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি উত্তরে বললেন,
“বাবু তো বেড়িয়েছে”
“কোথায় গেছেন?”
“সেটা তো বলে নি, শুধু বলেছে ঘুরে আসছে। কেন আরশিয়া তোমাকে কিছু বলে নি!”
আরশিয়া উত্তর দিতে পারল না। কারণটা জানলে শ্বাশুড়ি মা কষ্ট পাবেন। তার থেকে মৌন থাকাই শ্রেয়।
*******
বাসায় ফিরেই ল্যাপটপ খুলে বসল আত্মিকা। হাতে গুজে থাকা পেনড্রাইভটি এখনও অক্ষত। কৌতুহল মারাত্মক বাজে জিনিস। মাঝে মাঝে সব অনুভূতিকে বাজিমাত করে দেয় এই কৌতুহল। নয়তো রাইয়ানের দেওয়া পেনড্রাইভটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাসা অবধি টেনে আনতো না আত্মিকা৷ মনে হাজারো প্রশ্নেরা ডানা মেলেছে। অধিকাংশ বিশ্রী প্রশ্ন। ছেলেটির কি কোনোভাবে তাকে ব্লাক/মে/ইল করার চেষ্টা করছে! ছেলেটির কি কোনো কুমতলব আছে! ছেলেটি বিগত কিছুদিন যাবৎ তাকে ফলো করছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অকারণে! ব্যাপারগুলো সন্দিহান। কিন্তু আত্মিকা ব্যাপারটা আমলে আনে নি, কারণ অহেতুক জিনিসে তার মস্তিষ্ক সঞ্চারিত করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এখন নিজের খামখেয়ালিতে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ছেলেটিকে আশকারা দেওয়াটি বুদ্ধিমানের কাজ হয় নি। বুকের মাঝে স্বল্প ভয় নিয়েই পেনড্রাইভটি অন করল। ষোল জিবি পেনড্রাইভে একটি ফাইল। যার নাম “একমাত্র বেয়াইন সাহেব”
ফাইলটিতে প্রবেশ করতে একটি ভিডিও ফাইল নজরে পড়ল। ভিডিওটি অন করতেই দেখলো বিয়ে, হলুদ ব্যাপি আত্মিকার ছবিগুলো একটি গানের ব্যাকগ্রাউন্ডে কলাজ করে ভিডিও বানানো। এমন এমন কিছু ছবি যা আত্মিকারও অজানা। কিছু ছবিতে তার মুখে উজ্জ্বল হাসির কিরণ, কিছু ছবিতে সে গোমড়ামুখী, কিছু ছবিতে সে চিন্তিত, আর কিছু ছবিতে তার চোখে ছলছল করছে বিচ্ছেদের মুক্তদানা। ছবিগুলো প্রতিটি তার অজান্তেই তোলা। রাইয়ান ঠিক কখন এই ছবিগুলো তুলেছে জানা নেই আত্মিকার তবে তার ছবি তোলার হাত যে শিল্পকলা থেকে কম নয় তা বলতেই হবে। প্রতিটি ছবিতে আত্মিকাকে কোনো শিল্পী যতনে আঁকা তৈল্পচিত্রের ন্যায় লাগছে। আর পেছনে চলমান গানটিও চমৎকার। সদ্য প্রেমে পড়া পুরুষের যেন লুকায়িত হাহাকার।
“অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিষ্পাপ মুখখানি
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়
ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মণিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে
ভালবাসবো তোমায়
ভালবাসবো তোমায়
তোমার চিরচেনা পথের ঐ সীমা ছাড়িয়ে”
অনিমেষনেত্রে ভিডিওটি দেখলো আত্মিকা। হঠাৎ লক্ষ্য করল ভিডিও শেষ হয়ে গেছে এখন সাদা ক্যানভাসে কিছু কথা একেক একেক করে ভেসে উঠছে। সাথে সাথে পজ নামক অপশনটি চাপলো আত্মিকা৷ সেখানে লেখা,
“আসসালামু আলাইকুম বেয়াইন সাব,
আমি এই গানটি ব্যাকগ্রাউন্ড কোরে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করি নি, মনের ভাবটা রঙতামাশায় প্রকাশ করাটা বুদ্ধিমানের হত না। মেয়েরা অতিবুদ্ধিমান আশাকরি আপনার বুঝতে কষ্ট হবে না। তবুও যদি অবুঝ থাকেন তবে একটি কথা,
«ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়
ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মণিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে
ভালবাসবো তোমায়»”
আত্মিকা বিমূঢ় চিত্তে বসে রয়েছে। কপালে জমেছে বিন্দুবিন্দু ঘাম। বুক কাঁপছে। হাত পায়ে ঝি ঝি ধরেছে। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে গেল যেন। ছেলেটি তাকে প্রেমনিবেদন করলো?
*******
মর্তে কালবৈশাখীর আনাগোনা। চৈত্রের শেষ প্রহর সবাইকে জানান দিতে ব্যস্ত “শোনো পৃথিবী, নতুন বছর আসছে”। সেই সাথে ধরণীময় জুড়ে আছে তীব্র বিড়ম্বনা। এই রোদের তীব্র নিষ্ঠুরতা তো এই বর্ষার মোহনীয় শীতলতা। মুহূর্তেই তেজে ঝলসে যাওয়া কালো পিচের রাস্তা হয়ে যাচ্ছে থৈ থৈ জলরাশির কুপ। এই আবহাওয়া কবি সাহিত্যিকের প্রিয় এর তালিকায় হলেও আরশিয়ার বড্ড অপ্রিয়। ইটপাথরের বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে আরশিয়া। ফুলের স্নিগ্ধ গন্ধে ম ম করছে বারান্দা। অথচ তার মন ভালো নেই। প্রকৃতির অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের মতো তার মনের আবহাওয়ার ও বেশি পরিবর্তন হয়েছে। মন আকাশে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিপদ সংকেত নয় নম্বর ধারা চলছে। এই দূর্যোগের নাম “পৃথুল”। পৃথুল নামক দূর্যোগের জন্য আজ আরশিয়া দিশেহারা। লোকটি অভিমান করেছে। ভীষণ শক্ত অভিমান। বিগত তিনদিন যাবৎ সে কোনো কথাই বলে নি আরশিয়ার সাথে। খানিকটা এড়িয়ে চলছে। আর জিজ্ঞেস করলেই কাজ নামক তলোয়ারটি নির্দ্বিধায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে। সেদিনের ব্যবহারের জন্য আরশিয়ার কাছ থেকে সরি বা ব্যাখ্যা কোনোটিকে বেশ গুরুত্ব দেয় নি সে। এটা যেমন সত্য আরশিয়া প্রচন্ড বদরাগী তেমন এটাও সত্য পৃথুল বেশ অভিমানী, আত্মসম্মানসম্পন্ন। নিজের আত্মসম্মানে আঘাত সে সয় না। তাই তাদের একশ দিনের বিবাহ যাত্রা আপাতত আটদিনে বেশ একটা আগায় নি। আরশিয়া বক্ষস্থলে চাঁপা দীর্ঘশ্বাসটি গোপন করল। এর মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠল। কোহিনূর ছুটে গিয়ে খুলতেই দেখল পৃথুল কাকভেঁজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোহিনূরকে সরতে বলেই নিজ ঘরে চলে গেল সে। আরশিয়াও পিছু পিছু গেল। পৃথুল নিজের ভাগের আলমারি থেকে একটি নীল শার্ট বের করল। আরশিয়া ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,
“আবার কোথাও যাবেন?”
পৃথুল উত্তর দিল না। হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেল। ভেজা কাপড় গুলো একটি ঝুড়িতে রেখে বলল,
“কোহিনুর, এখানে কাপড় আছে। ধুয়ে দিস। আর আমার লাগেজটা বের করে রাখিস। আমার রাতের মধ্যে লাগবে”
“কোহিনুরকে বলছেন কেন, আমি তো সামনেই আছি। আর রাতে কেন লাগবে”
“সরি। আসলে আপনাকে বললে বিরক্ত হবেন কি না জানা নেই তো, তাই কোহিনুরকে বললাম। অভ্যাস আর কি”
বড্ড ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো পৃথুল। যা আরশিয়ার অহমিকায় লাগল। সে সেদিনের কথার প্রেক্ষিতেই এমন বাকা উত্তর দিচ্ছে তাতে দ্বিমত নেই। আরশিয়া নিজের রাগ গিলে আবার ও শুধালো,
“রাতে কি কাজ? কোথাও কি যাচ্ছেন?”
কিন্তু পৃথুল উত্তর দিল না। সে তার ফাইল গোছাতে ব্যস্ত। ফলে সুপ্ত রাগ আগ্নেয়গিরির রুপ নিল। আরশিয়া এমন একটা কাজ করে বসল যার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না পৃথুল…….
চলবে
[আজ দুটো গল্প দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু অসুস্থতা এবং কিছু ব্যস্ততার জন্য একটি লিখতে পেরেছি। কথা রাখতে পারছি না। একারণে সত্যি ক্ষমাপ্রার্থী। দ্বিতীয় মুদ্রণ অর্ডার শুরু হয়ে গিয়েছে। কুরিয়ারচার্জ সহ ৩০০ টাকায় পেয়ে যাবেন আমার প্রথম বই “তন্দ্রাবিলাসী”। সাথে থাকবে আমার লেখা অটোগ্রাফসহ চিরকুট। অর্ডার করতে যোগাযোগ করুন @বুকশেলফ.কম এ]
মুশফিকা রহমান মৈথি