#জলছবি
#পার্ট_৩৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নোলক। ঘন্টাখানিক সময় নিয়ে গোসল করে। ভেজা চুল ভেজা শরীর নিয়েই আদা-চা বানায়। মগ ভর্তি চা নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে অ-অনুমেয় সময় ধরে। চুলের ডগায় জমে জমে মুক্তর ন্যায় জলের ফোঁটা; তখনও টপটপ করে মেঝেতে পড়ে। স্নিগ্ধ মুখখানা ভারী বিষন্ন! অকল্পনীয় স্বপ্ন বুননে বাঁধা প্রাপ্ত হওয়া দু’খানা অস্বচ্ছ আঁখি। সূর্যের তীর্যক আলো এসে যখন সেই আঁখিতে লাগে; ঠিক তখনই মনটা হুঁ হুঁ করে উঠে!
জানালার পাশ থেকে সরে আসে। সমাপ্ত না করা চা সমেত মগটা ড্রেসিংটেবিলে রেখে
পুনরায় বিছানায় এসে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। নবনী রুমে নেই। কই কে জানে!
নোলকের যখন অত্যাধিক পরিমান মন বিষন্নতায় ছেয়ে থাকে, তখন তার খুব ঘুম পায়! মনের সাথে পাল্লা দিয়ে চোখদুটোও বুঝি অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চায়! কী আশ্চর্য!
সারাটাদিন নোলক ঘুমিয়েই কাটায়। মধ্যাহ্ন পেরিয়ে বিকেল নামে। বাড়িতে কি হচ্ছে-না হচ্ছে সেসব সে টেরও পায়নি একটুও!
বিকেলের শেষ দিকে নবনী রুমে আসে। দরজার ধারেই কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আগাগোড়া বিশেষণে মোড়ানো তার সেই ছোট্ট দূরন্তপনায় ভরপুর বোনটাকে দেখে। ইশশ, বড় হয়ে গেল মেয়েটা?
নবনী খুব সাবধানে কাছে এসে নোলকের মাথায় হাত রাখে। দু-একবার মাথায় হাত বুলাতেই নোলকের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম না কাটা দৃষ্টিতেই নোলক কপাল কুঁচকে তাকায়। নবনী মিষ্টি করে হেসে বলে,
“ঘুম ভেঙেছে?”
নোলক ইশারায় সায় জানায়। নবনী বার’কয়েক চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“তবে উঠে ফ্রেস হয়ে নে। সবাই চলে এসেছে।”
নোলক যেন একটু অবাক হলো। ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বলে,
“সবাই এসেছে মানে? কারা এসেছে?”
“তোর সব বন্ধুরা। ইশানরাও চলে আসবে কিছুক্ষণ পরই। এই কয়েকদিনেই কত বড় হয়ে গেলি তুই নোলক, আমি বুঝতেও পারলাম না!”
শেষের কথাটা নবনী গভীর আবেগ তাড়িত হয়েই বলল।
নোলক হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মনে করার চেষ্টা করে, আজ কী কোনো বিশেষ দিন? জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? আজ কী? সবাই কেন এসেছে?”
নবনী একটু রসিকতার সুরে বলে,
“সবাইকে রেখে একা একা বিয়ে করতে চাস নাকি? গাধী!”
নোলক হঠাৎ-ই যেন আসমান থেকে পড়ে! রাতের কথা মনে পড়তেই মনটা ভীষণ ভার হয়ে যায়! ইশান তবে সত্যি সত্যি….!
নোলকের কান্না পায় ভীষণ! দুনিয়ার ঐ সবচাইতে নিষ্ঠুর মানুষটার জন্য এক আকাশ, এক সমুদ্র অভিমান জমা হয় মূহুর্তের মাঝেই। গলায় এসে কান্না আটকায়। নোলক কিছু বলবে সেই সুযোগ পেলো না। তার আগেই বন্ধুমহল হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করল। নোলক অভিমান অনুরাগ কিছু করার ফুরসুরৎ-ই পেল না! বাকিদের দেখে অবাক না হলেও শ্রীতমাকে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। অভিমানেও কিছু ভাটা পড়লো বৈকি! ফয়সালের অসুস্থতায় শায়নের ছুটি না থাকায় যে আসতে পারেনি একা একা, ভিডিও কলে দেখেছে। সে কিনা..! কী মিষ্টি দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। সিঁদুর রাঙা উজ্জল প্রাণবন্ত মেয়েটি কাছে আসতেই অস্ফুট স্বরে বলল,
“শ্রী! তুই..!”
শ্রীতমা কাছে এসে নোলকের গলা জড়িয়ে বলল,
“কেমন আছিস দোস্ত! খুব মিস করেছি তোকে!”
ফয়সাল শ্রীতমাকে ব্যাঙ্গ করে, নিজের এলোমেলো চুল আরো এলোমেলো করতে করতে বলল,
“হুম, তুমি যে কী মিস করছো জাতি জানে। জামাই পাইয়া দিন-দুনিয়ার গুইলা খাইয়া ফালাইয়া; আসছে মিসের গল্প শুনাইতে।”
সৃজন ফয়সালের সুরে সুর মিলিয়ে তিক্ততা নিয়ে বলে,
“আর কইস না দোস্ত! মাইয়াগুলান এমনই স্বার্থপর।”
শ্রেয়া বলে,
“ফাজিল! তুই এমন সব কিছুতে মেয়েদের টানিস বলেই মেয়েরা তোরে পাত্তা দেয় না। তোরে আজীবন সন্যাসী সিল মেরে জঙ্গলে আজীবনের জন্য স্থায়ী করে দেয়া উচিত।”
শ্রীতমা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
“উফফ! সবসময় তোরা এমন ঝগড়া করিস কী করে বল তো? চুপ করবি? আজ অন্তত চুপ থাক বদমাইশের দল!”
নোলক বলে,
“শ্রী তোকে কে…!”
নোলক প্রশ্ন শেষ করার আগেই শ্রীতমা বুঝে ফেলে। নোলকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শ্রীতমা বলল,
“ইশান’দা কাল কল দিয়ে বলল, আর্জেন্ট যেন চলে আসি। তোর নাকি খুব দরকার! ওকে বললাম, আর ও নিয়ে এলো। ভাগ্যিস ওর ছুটি ছিল! এসে দেখি এই কান্ড! আ’ম সো হ্যাপি দোস্ত! ফাইনালি তুইও…!”
সৃজন ফোড়ন কেটে বলল,
“হ, তোগোই জিন্দেগী! শালার না পাইলাম একটা গার্লফ্রেন্ড আর না বিয়ে-ফিয়ে! কী করমু এই মরার জিন্দেগী লইয়া?”
“কচু গাছে ফাস দে। বাইচা থাইকা আর কিরবি?” বলল নিষাদ।
খিলখিল ধ্বনিতে মেতে উঠলো সকলে।
এরপর আরোকিছু হাসিঠাট্টা হলো। এক পর্যায়ে ফয়সাল টিটিকারি মেরে নোলককে বলে, “এর জন্য তবে তোমার এতো বিরহ? আগে কইতি, ধইরাবাইন্দা বিয়া দিয়া দিতাম, এর জন্য বিরহ করে জগৎ ভাসানোর কী প্রয়োজন ছিল? আমি আরো চিন্তায় পইরা গেছিলাম। ভাবলাম, মাইয়াডেরে এমন বিবাগী করলো কেডায়! মাইর-টাইর দেয়ার প্রিপারেশনও নিতেছিলাম। শেষে দেখি এই কাহিনী! কী মচেৎকার কান্ড, আহা!”
নিষাদ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,
“সবাই তলে তলে টেম্পু, বাস, ট্রাক চালিয়ে বিশ্বজয় করে ফেলছে; মাঝখান থেকে নাম হয় আমার আর শ্রেয়ার।”
বলেই শ্রেয়ার সাথে হাই-ফাইভ দেয়।
ফয়সাল কোনো প্রতিবাদ করে না, পাছে সে ফেঁসে না যায়! তবে সৃজন সায় জানায়।
লুবনা কাছে এসে নোলকের পাশে বসে বলে,
“দোস্ত আই ক্যান্ট বিলিভ! তোর কী সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে? শ্রী তো বিয়ে করে ডিরেক্ট কলেজ-ই চেঞ্জ করে ফেলল! তুইও হারিয়ে যাবি? সত্যি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, দোস্ত?”
ফয়সাল লুবনার মাথা আলতো আঘাত করে বলে,
“না বিয়ে বিয়ে খেলা হবে। মফিজের বউ! সর এনতে!”
শ্রেয়া ভাবুক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“দোস্ত মফিজ কে রে?”
সৃজন ফয়সালকে বলে,
“দোস্ত? তুই তো একটা মিসটেইক করে ফেললি! মফিজ তো এই বলদনীর জামাই হবে! তারপর বলদনী থেকে মফিজিনি তে রূপান্তরিত হবে।”
কথাগুলো সে বলে, শ্রেয়াকে উদ্দেশ করে।
বলেই হো হো করে হেসে ওঠে, সাথে বাকিরাও।
শ্রেয়া মুখ ফুলিয়ে বলে,
“তোরা সবসময় আমার সাথে এমন করিস। খারাপ সবগুলা! যাহ, কথাই বলবো না আর।”
সকলে আরো এক দফা হাসে। সকলের আরো কত কথা। কত উৎসাহ! তারা নোলকের মনের ব্যথা টেরও পেলো না।
প্রচন্ড মাথা ব্যথা উঠে যায় নোলকের। মনে হচ্ছিল মাথায় কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে! কী ভীষণ যন্ত্রণা।
নোলক বলে,
“তোরা এখন একটু যা তো।”
নিষাদ বলে,
“ছিঃ ছিঃ! এত বড়ো অপমান’স! কেমন দূরদূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে গাইজ! এর নাকি বিয়ে! মাগো মা! বিয়ের আগেই তো ভাব’স বেড়ে গেছে, বিয়ের পর তো চোক্ষেই দেখবো না!”
ফয়সাল নিষাদের সাথে যুক্ত হয়ে বলে,
“বিয়া করবি আবার ভংও ধরবি! এ কেমন দুই-নাম্বারি! যাহ থাকলাম না তোর রুমে, কী আর হইবো?”
সৃজন বলে,
“বুঝস না? মাইয়া মানুষ মানেই তো ঢং আর ভং এর দোকান! সারাজীবন ঢং আর ভং ধরেই কাটায় দেয়!”
শ্রেয়া লুবনা শ্রীতমা এবার সমস্বরে বলে ওঠে,
“কুত্তা তুই আবার মেয়েদের টানছিস…”
সৃজন এক ছুটে দরজার কাছে গিয়ে নিষাদ আর ফয়সালকে হুশিয়ার করার মতন করে বলে,
“বালক’স? এখন এখানে থাকা মানে দশ নাম্বার বিপদ সংকেত। প্লিজ ফলো মি। চইলে আসো মোর লগে।”
বলেই স্থান ত্যাগ করে দ্রুত। ফয়সাল আর নিষাদ নিজ থেকে বের হওয়ার আগেই তাদের ঠেলে বের করে দেয় শ্রেয়া আর লুবনা। অজ্ঞতা তাদের যেতেই হয়।
লুবনা, শ্রেয়া আর শ্রীতমা আরো খানিকক্ষণ থেকে বেড়িয়ে যায়, নোলকের আবদারে। তার একটু একা সময় চাই!
সকলে বেড়িয়ে যাওয়ার পরপরই নোলক খাটের সাথে হেলান দিয়ে, পা ভাঁজ করে বসে। চোখে টলমল করা পানি, মনে টসটসে অভিমান। রাগ ক্ষোভ আর অভিমানের সংমিশ্রণে বীভৎস অনুভূতির সৃষ্টি হয়। নাক লাল হয়, লাল হয় সমগ্র মুখমণ্ডল। মস্তিষ্কজুড়ে আদ্র’র পাঠানো সেই ভয়েস’টি! কী নিষ্ঠুর, অমানবিক তার ভাবনা! এতো সহজ, এত ঠুনকো, এত অবহেলিত কারো অনুভূতি তার কাছে!
বারবার করে ভাবে, আদ্র’র মনে সত্যিই কী তার জন্য একটুও টান নেই? নিজেই উত্তর দেয়, নেই তো! থাকলে কী অমন বলতে পারতো?
এই যে এত রাগ, এত অভিমান? তবুও কেন, কী ভেবে যেন ফোন দেয় সেই নিষ্ঠুর মানবটিকে!
একবার, দুইবার, ঠিক তিনবারের সময় আদ্র ফোন তোলে। শান্ত অথচ মুগ্ধ কন্ঠটি সারা দেয়, “হ্যালো!”
নোলক কি আর প্রতিত্তুর করতে পারে? তার স্বর, কন্ঠনালী কেউ যেন দু’হাতে চেপে ধরে রেখেছে! অমন কষ্টে কে বা সায় জানাতে পারে?
ওপাশ থেকে পুনরায় ভেসে আসে,
“কাঁদছ তুমি নোলক? আচ্ছা কাঁদো! কাঁদলে তোমায়, অবাক সুন্দর লাগে।”
নোলক তখনও চুপ। ঝরঝর করে কেঁদেই চলেছে, যেন আজ তার কান্নার দিন!
ফোন কানে দুটি মানুষ খানিকক্ষণ চুপটি হয়ে থাকে। নিরবতা ভেঙে আদ্র বলে,
“এই নোলক? আজ কী তুমি খুব সুন্দর করে সেজেছ? সাজলে তোমায় পরী লাগে, সত্যি বলছি! আচ্ছা শোনো? ঐ আহামরি টাইপ গর্জিয়াস শাড়ি পরো না তো! তুমি বরং আকাশের বুকে ফুটে থাকা মায়াবী রঙের অতি সাধারন শাড়িটা পরো! পায়ে নূপুর মাস্ট পরবে, ঠিক আছে? আর দু’হাত ভর্তি কাচের চুড়ি। ট্রাস্ট মি নোলক, তখন তোমায় ‘পৃথীবির সবচাইতে চমৎকারতম মানবী’ লাগবে। শুনতে পাচ্ছো নোলক তুমি? হ্যালো…”
নোলক ফোনটা দূরে ছুড়ে মারলো। ফোন ভাঙলো-কী-ভাঙলো-না তাতে কী এসে যায়? মনটা নিশ্চয়ই ভেঙেছে। অমন করে কথা, আর কেউ বলতে পারে না, কেউ না। অমন করে স্নিগ্ধ মায়ায় বাঁধার মন্ত্র আর কারো জানা নেই, থাকতেই পারে না!
এমন নিষ্ঠুর অশ্রু ঝড়িয়ে কেউ কখনও বলতে পারবে না, তোমার কান্না অতি চমৎকার নোলক!
নোলক হাঁটুতে মুখ গুঁজে চাপা আর্তনাদ করে উঠে। রিনরিনে কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করে! বুঝতে পারল ফোন করে মেয়েটা মস্ত বড়ো ভুল করে ফেলেছে। এক নিমিষে দুঃখ যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। এই দুঃখ নিয়ে এখন সে থাকবে কী করে?
মাগরিবের পরপর শ্রেয়া, লুবনা, শ্রীতমা, নবনী পদার্পণ করে তার রুমে। নোলক তখনও রুমে হাঁটুমুড়ে বসে ছিল।
তাদের আসার আলাপ পেয়েই খানিক আড়ষ্ট হয়ে বসল। নোলক আড়ালে চোখ মুছল।
নবনী আড়চোখে লক্ষ্য করলেও কিছু বুঝতে দিল না, পাছে অসস্তিতে না পড়ে যায় বোন তার!
তারা হাতের সাজগুজের সরঞ্জাম গুলো রেখে তৈরি হতে বললে নোলক বিরূপ আচরণ করে প্রথমে। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“যেমন আছি, তেমন অবস্থাতেই যা হওয়ার হবে।”
নবনীও আর জোর করে না। কেননা সে জানে, এই মেয়ের জেদের সাথে কেউ কখনও পেরে উঠবে না! নোলকের গালে, কপালে আলতো হাত বুলিয়ে নবনী বেরিয়ে যায়। বাকিরা থাকে।
নোলকের পরনের কালো রঙের লং স্কার্ট আর খয়েরী টপস। শরীরে নকশা করা ওড়নাটা পেঁচিয়েই বসে ছিল। শ্রীতমা নিচু কন্ঠে বলল,
“তুই কী বিয়ে করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত না দোস্ত?”
“প্রস্তুত। আমি বিয়ে করবোই। শুধু কোনো প্রকার ড্রামা করতে পারবো না।”
রাত আটটার দিকে নোলকের কাছে কিছু কাগজপত্র নিয়ে আসা হলো। যখন সাইন করতে দিলো ঠিক সেই মূহুর্তে নোলকের মনে হলো, ও যদি এখন মারা যেত তবে কেমন হতো!
নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। মনে হলো, এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে! হাত কাঁপছিল। কিন্তু কথায় আছে, রাগ আর অভিমানের কাছে সব কিছুই হেরে যায়! নোলকের বেলাতেও ঠিক তাই হলো। কাগজটা নিজের কাছে নিয়ে খচখচ করে সাইন করে দিল। এক ফোঁটা পানি সেই কাগজে পড়ল। পড়ুক, তাতে কী? কবুল বলল। বিয়েও হয়ে গেল। তারপর? তারপর পাশে থাকা শ্রীতমাকে বলল,
“আমায় একটু পানি দিবি দোস্ত? আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি!”
শ্রীতমা উঠার আগেই নবনী ঝটপট করে পানি এনে নোলকের মুখচোখ মুছে বলল,
“তুই ঠিক আছিস বোন? খারাপ লাগছে কী?”
“ঠিক আছি আপু।”
তপ্ত দীর্ঘশ্বাঃস ছেড়ে নবনী বলে,
“তোর রাগ, অভিমান, জেদ কিছুই আমি আজও বুঝে উঠতে পারলাম না বোন। তোর ইচ্ছেতেই তো বিয়ে হয়েছে। কষ্ট কেন পাচ্ছিস? যার জন্য কষ্ট পাচ্ছিস, তবে তাকে রেখে ইশানকে কেন বিয়ে করতে চাইলি?”
“আমি কারো জন্য কষ্ট পাচ্ছি না। আমি খুব খুশি! যা হয়েছে বেশ হয়েছে।”
“সত্যি?”
“সত্যি। ভয়ংকর সত্যি। এখন একটু একা থাকতে দিবা? খুব ক্লান্ত লাগছে।”
“আচ্ছা থাক।” বলে নবনী বেড়িয়ে গেল। শ্রেয়া, শ্রীতমা, লুবনা আরো কিছুক্ষণ পরে গেল।
সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই নোলক নিজের রুমের দরজা আটকে দিল। কাঁদল না। আর কোনো কান্না নেই যেন তার। দরজা আটকে দরজার সাথেই ঠেস দিয়ে বসে পড়ল।
বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। কারো মন, কারো প্রেম ভাসানো বৃষ্টি। আকাশও তার দুঃখ বুঝল, প্রেম বুঝল, বুঝলো না কেবল একটি মানুষ! অমন করে বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ল নোলক। রাজ্যের সব, দুঃখ, কষ্ট, অভিমানে ভেজা টইটুম্বুর আঁখিপল্লব অচিন কোনো দেশে পারি জমাল। যেখানে আদ্র’র প্রতি তার কোনো অভিমান নেই, রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, আছে কেবল প্রেম, জলের মতন স্বচ্ছ প্রেম!….(চলবে)
#জলছবি
#পার্ট_৩৫(অন্তিম)
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
প্রথম অংশ
———
সেই সকাল থেকে ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘকন্যার ভয়ংকরী গর্জন। জলে ভেজা পথঘাট। একটু থেমে জিরিয়ে নিয়ে পুনরায় আনন্দের সহিত টুপটুপ করে পড়তে থাকে।
ফয়সালের সাদা শার্টের বেশঅর্ধেক ভিজে গিয়েছে। যতক্ষণে টং দোকানের ভেতর ঢুকেছে ততক্ষণে বৃষ্টির পরশ তার শরীরের অনেকখানি স্পর্শ করে ফেলেছে। আধভেজা চুল কপালে লেপ্টে রইলো। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কণা সমস্ত মুখ, গলা, হাতে! টং দোকানের ইষৎ বেঁকে যাওয়া বেঞ্চটাতে বসে দু’হাতে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে দোকানদারকে বলল,
“মামা? এক কাপ গরম গরম চা দাও তো। মনটা যেন আরো বেশি ফুরফুরা হয়ে যায়, বৃষ্টি শেষে পরিষ্কার আকাশের মতন!”
দোকানদার মামা এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“লিকার বেশি দিমু, না কম?”
“বেশি মামা, বেশি দেও। আজ সব কিছুই বেশি বেশি চাই।”
“আপনে মনে হইতাছে আইজ অনেক খুশি?”
ফয়সাল তৃপ্তির হাসি হাসলো। সত্যি-ই ভীষণ খুশি সে। একটু একটু করে, অনেক নির্ঘুম রাত পারি দিয়ে, অক্লান্ত পরিশ্রম, মেহনত, চেষ্টা আর সদিচ্ছার আর প্রচেষ্টার ফলে ফ্রিল্যান্সিং-এ নিজের শক্ত একটা স্থান তৈরি করে ফেলেছে। মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই এখন মোটা একটা এমাউন্ট তার হাতে আসতে শুরু করেছে। এছাড়াও দুবছর আগে থেকে খানিক জেদ থেকে শুরু করা অনলাইন বিজনেসটাও এই অল্পদিনেই; অনলাইন-অফলাইন দুজাগাতেই বেশ সরব হয়েছে। এরই মাঝে সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছে। সৃষ্টিকর্তা যখন দিতে শুরু করেন, উজার করে দিতে থাকেন। সদিচ্ছা আর নিবির চেষ্টা থাকলে মানুষ কী না করতে পারে?
কাল মাকে নিয়ে ফয়সাল বেশ কয়েকটা ফ্লাট দেখে এসেছে। মায়ের যেটা পছন্দ সেটাতেই উঠবে। কোহিনূর বেগম অবশ্য আহ্লাদী হয়ে বলেছিলেন,”এত বড়ো বাড়ির কী দরকার বাপ? দুইডা মাত্র মানুষ!”
ফয়সাল আরো বেশি আহ্লাদী হয়ে বলেছিল,
“তুমি তো আমার রানীমা! আল্লাহ্ তৌফিক দিলে তোমারে আমি রাজপ্রাসে রাখমু আম্মা। আমার যা কিছু সব শুধু তোমার জন্য আম্মা, সব সুখ তোমার।”
চকচক করে উঠল কোহিনূর বেগমের দৃষ্টি। এত সুখকরও হয় মানবজীবন?
নতুন ফ্লাটের কথা অবশ্য লুবনা জানে না। জানবে কী করে? দু’দিন আগে কী সিরিয়াস ঝগড়া হলো। ‘জীবনেও আর মুখ দর্শন করবে না’ টাইপ প্রতিজ্ঞাও করেছে দুজন। যদিও এমন প্রতিজ্ঞা সপ্তাহ দুই-একবার করেই থাকে তারা! এটা তেমন বিশেষ কিছুই না। তবুও খুব রাগ লাগে ফয়সালের। এত ঘারত্যাড়া মেয়েটা! পরে আবার নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবে, সে নিজেও তো কম কিছু না। আনমনে হেসে ফেলে ফয়সাল।
তাদের প্রেম চিরাচরিত প্রেমের মতো নয়। বাহির থেকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না! ভাববে, দুজন দুজনকে সহ্যই করতে পারে না বোধহয়! সারাক্ষণ-ই ‘মেরে ফেলব, খেয়ে ফেলব’ টাইপ প্রতিক্রিয়া। বাহির দেখে তাদের ভেতরের টান বুঝা দুষ্কর!
সামনে বিশাল দালানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো ফয়সাল। দুবছর আগেও বাড়িটার দিকে তাকালে লুবনাকে নিয়ে ভাবার সাহস পেতো না! আর আজ?
চায়ের কাপটা বেঞ্চের উপর রেখে লুবনাকে ফোন দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন রিসিভ হলো। যেন ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল মেয়েটা। ফয়সাল কিছু হয়নি টাইপ ভাব নিয়ে বলল,
“এই ফাজিল, নিচে নাম। সময় দুই মিনিট দশ সেকেন্ড।”
লুবনা গম্ভীর হয়ে বলল,
“পারবো না।”
“দশ সেকেন্ড শেষ। আর দুই মিনিট বাকি। না এলে কী হতে পারে, ইউ নো বেটার দ্যান মি!”
“তুই একটা ফালতু, জঘন্য। তোর কথা শুনতে বাধ্য নই।”
বলে ফোন কেটে দিল। ফয়সাল জানে, লুবনা না এসে পারবেই না! মুখেই যত বড়ো বড়ো কথা! তার চোখে হাসি, মুখে হাসি। কৃষ্ণবর্ণ মুখটা তখনও ভেজা! দোকানদার মামাকে চায়ের কাপটা দিতে দিতে বলে,
“মামা? আজকের পরিবেশটা অদ্ভুত সুন্দর, না?”
দোকানদার মামা কাপ ধুতে ধুতে বলে,
“মন ভালা থাকলে, দুনিয়ার বেবাক কিছুই অদ্ভুত সুন্দর লাগে মামা!”
ফয়সালের পছন্দ হয় কথাটা। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়ার আগেই লুবনা এসে উপস্থিত হয়। হাতে ছাতা। পরনে সবুজ রঙের সেলোয়ার কামিজ। ভ্রু কুঁচকানো। টুপ টুপ ছন্দের মতো বৃষ্টি পড়ছে। ফয়সাল মাথায় এক হাত দিয়ে ‘ছাউনি দেয়ার মতন’ করে টং থেকে নেমে আসে। যতটুকু বাকি ছিল, ততটুকুও ভিজে যায় তার শরীর। লুবনার রাগ তখনও পড়েনি। মুখ ফুলিয়ে বলল,
“কেন ডেকেছিস, মানে ডেকেছেন?”
ফয়সাল খুব জোড়ে হেসে ফেলে। লুবনার রেগে থাকলে ‘আপনি আপনি’ করে কথা বলে। কী অদ্ভুত মেয়ে একটা। পাগলীও বটে!
ফয়সাল বলে,
“চটকোনা দিতে ডেকেছি। দিব? দেই?”
লুবনা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,
“ফাইজলামি কম করবি, মানে করবেন। কী চাই, তা বলুন। আমার অফুরান্ত সময় নেই!”
ফয়সাল একটু ঝুকে এসে বলে,
“তোরে চাই।”
লুবনা একবার তাকায়। তারপর মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগলে ফয়সাল হাত হেচকা টান মারে। তাল সামলাতে না পেরে লুবনার হাতের ছাতাটা পড়ে যায়। ভিজে যায় শরীর। লুবনা খানিক ভয় পায় যেন। রাগ ভুলে চাপা কন্ঠে বলে,
“বাসায় বাবা আর ভাইয়া আছে। দেখে ফেললে…..!”
ফয়সাল বলে,
“দেখুক। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি কী তাদের ভয় পাই?”
লুবনা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আশেপাশে তাকায়। মেয়েটা ভীত হলে কী দারুন দেখায়, যদি তা জানতো! ফয়সাল মোহনীয় কন্ঠে বলে,
“তোর বড়লোক বাপ আর ভাইয়ের একমাত্র আদুরীরে বিয়ে করে ফেললে কেমন হয় বলতো?”
লুবনার কী যে ভালো লাগে। আতংক, আশংকা ভুলে বৃষ্টি ভেজা ফুলের ন্যায় স্বচ্ছ-সুন্দর হয়ে ওঠে মুখখানা। অদ্ভুত ভাবে তারও মনে হয়, আজকের প্রকৃতি এত সুন্দর কেন? অদ্ভুত সুন্দর
.
সৃজন আর শ্রেয়া পাশাপাশি বসে আছে। সৃজন পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ব্যাবসা সামলাচ্ছে। ব্যাবসা সামলাচ্ছে বলেই যে সে ফয়সালের মতো ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বেশি সিরিয়ার হয়েছে তেমন নয়। খুব বেশি পরিবর্ত এই দুই-আড়াই বছরে তার জীবনে আসেনি। শুধু শ্রেয়ার জন্য হঠাৎ হঠাৎ খুব মায়া লাগে! ওর প্রতি মায়াটা একটু বেড়েছে এই যা! রাহাতের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর থেকেই মেয়েটা কেমন যেন দুঃখী হয়ে গেল, চুপচাপ মেয়েটা আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেল! জগতের সবচাইতে দুঃখী মেয়েটা হয়ে উঠলো যেন! সম্পর্ক ভেঙেছে, তা প্রায় বছর পেরোতে চলল; তবুও মেয়েটা নিজেকে সামলে নিতে পারছে না। এত দিনের স্মৃতি এত সহজে ভুলা যায় কী?
যখনই খুব বেশি মনে পড়ে, তখনই কেমন মুষরে যায়। অনেক মানুষের মাঝে থেকেও চোখ ভিজে যায়!
শ্রেয়ার দৃষ্টি নত। এক হাত দিয়ে অন্য হাতের নখ খুটছে। চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ধারা বইছে। আকাশে সকল জল যেন তার চোখে এসে ভর করেছে এই মূহুর্তে।
সৃজন মহাবিরক্ত হয়ে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। বেশ অনেকক্ষণ সহ্য করার পর তেঁতে উঠে বলল,
“কী সমস্যা তোর?”
“বাসায় যাব।”
“কেন?”
“এমনি।”
“না, যেতে পারবি না। এখানে বসে বসেই ড্রামা কর, ফালতু আবেগ দেখা। দেখি কতক্ষন দেখাতে পারিস!”
শ্রেয়া উঠে চলে যেতে লাগলে সৃজন টেনে বসায়। ধমকের সুরে বলে,
“শালার মগাডার জন্য এত কিসের দরদ তোর? সেল্ফরেসপেক্ট নাই? এত ফালতু আবেগ বেশি বলেই জাস্ট দুচ্ছাই করে ছেড়ে দিয়েছে। শালার ফালতুটার জন্য, ফালতু কান্না দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি!”
শ্রেয়া আকস্মিক রেগে গিয়ে একটা কান্ড করে বসলো। সৃজনকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসে। ভেজা আঁখিপল্লব, কম্পিত কন্ঠে বলে,
“মায়া বুঝিস? টান বুঝিস? সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝিস? বুঝিস না। বুঝিস না বলেই অন্যের মায়া, টানকে তোর কাছে ফালতু ইমোশন মনে হয়। তুই আমাকে আর কল দিবি না, মেসেজ দিবি না অসভ্য!”
বলেই হনহনিয়ে হাঁটতে লাগে। সৃজনের ভয়ানক খারাপ লাগে! চোখমুখ লাল হয়ে আসে। ধরে আসা কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, দুনিয়ার সব মায়া, টান আর আবেগ তো তোরেই দিয়ে রাখছে ইশ্বরে। আর কারো তো নাই। একজন চইলা গেছে, এহন এই ফালতু মায়ার দোহাই দিয়ে মইরা যাইতে হইবো তো, হইবো না? ওই মগাডারে ছাড়া তো আপনি দুনিয়ার কিছু চোখে দেখেন না। যা ইচ্ছা কর, আমার কী?”
বলে একটু দম নেয়। ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে পায়ের কাছের খালি বোতলটা পা দিয়ে দূরে ফিক্কা মেরে বলে,
“খবরদার ব্লক দিবি না। জাস্ট মাইরা ফেলমু।”
শ্রেয়া ততক্ষণে পার্ক থেকে বেরিয়ে যায়। সৃজন তখনও বসেই রইলো। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছে সৃজনের মুখে, হাতে, গালে…..
.
আটমাস আগে হঠাৎ একদিন নিশিতা নিষাদের সঙ্গে দেখা করতে এসে কান্নাকাটি করে জানায়, তার বাসা থেকে বিয়ের প্রেশার দিচ্ছে। মা বাবা সন্দেহ করছে।
নিশিতার আশংকা, ওকে যেকোনো সময় জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে। তাই হয়তো আজ ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, নয়তো ও সুইসাইড করবে।
নিষাদ খুব করে বুঝালো, এমন কিছুই হবে না। পালিয়ে যাবে কই? না পড়াশোনা শেষ হয়েছে, আর না আছে চাকরি! থাকবে কই? খাওয়াবে কী?
নিশিতা নাছর বান্দা। সে কিছুতেই বাড়ি ফিরে যাবে না। নিষাদ বাড়িতে আলোচনা করবে বলে, অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সেদিন বাড়ি পাঠিয়েছিল। এবং বাড়িতেও জানিয়েছিল। আর গন্ডগোলটা তখনই বাঁধে। বাবা-মায়ের সঙ্গে মতবিরোধ হয়, বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে নিষাদ জিদ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। নিশিতাকে ফোন করে জানায়, ‘বিয়ে করবে, বাসা থেকে বেড়িয়ে আসতে। আর জেদ বাস্তবায়ন করতে বিয়ে করেও ফেলে!’
বন্ধুরা যদিও ভাবতে বলেছে, রাগের মাথায় ভাবার অবকাশ পায়নি সে। বিয়ে হয়। এক দিকে জেদ, অন্যদিকে প্রণয়িনীকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে অন্যরকম সুখানুভূতিও হয়েছিল সেদিন। বন্ধুরা মিলে ছোটখাটো একটা বাসা ঠিক করে দিল। টুকটাক সরঞ্জাম কিনে দিল। কিন্তু জীবনের কী ভীষণ বাস্তবতায় যে পা দিয়েছিল তা তখনও ঠাহর করতে পারনি। প্রথম প্রথম সুখকর লাগলে; কিছুদিন যেতেই ত্যাক্ত লাগতে আরম্ভ হলো। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসার ফলেই বাস্তবতা মানতে কষ্ট হচ্ছে তার।
এই আটমাসেই পদে পদে টের পাচ্ছে রাগ করে বাসা ছেড়ে কী ভীষণ বাস্তবতার মুখে পড়েছে। পড়াশোনা শেষ হয়নি, চাকরি নেই। ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া, খাওয়া, দুজনের পড়াশোনার খরচ! সব মিলিয়ে কুলিয়ে উঠছে না। টিউশনির টাকা দিয়ে চলছিল। পাশাপাশি কিছু টাকা জমিয়ে একটা ব্যাবসা শুরু করেছিল, কিন্তু ভাগ্যে নির্মম পরিহাসে সেখানেও লোকসান! এরপর থেকেই মেজাজ আরো বেশি খিটখিটে হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
নিশিতার খুব বেশি চাওয়া পাওয়া নেই। মুখ ফুটে কিছু চায়ও না কখনও। সেও সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। এত অভাব কোনদিন চোখেও দেখেনি। তবুও প্রতিনিয়ত মানিয়ে নেয়ার তীব্র চেষ্ঠা করে যাচ্ছে। যেখানে আগে নিষাদ মতের বেমিল কিছু বললেই মুখ ফুলিয়ে থাকতো, উল্টা রাগ দেখাতো; সেখানে এখন নিষাদ অকারণ রাগ দেখালেও কোনো প্রতিবাদ করে না। নিষাদের দিকটাও বুঝতে চেষ্টা করে।
আজ সকালেও খুব চেঁচামেচি করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে নিষাদ। নিশিতা কয়েকবার কল করলেও ধরেনি।
নিশিতা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় তার বিষন্নতা ঝড়ে। খুব অভিমান লাগে মনে। সত্যি কী ‘অভাবে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়?’
কারো আসার আলাপে ভাবনা ভেঙে নড়েচড়ে ওঠে নিশিতা।
নিষাদ খুব মিষ্টি করে ডাকে,
“নিশি? একটু এদিকে আসো তো।”
নিশিতা খুব দ্রুত গতিতে নিষাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। নিষাদ হাতের ফুচকা আর চটপটি নিশিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“তোমার তো খুব প্রিয়, তাই নিয়ে এলাম!”
নিশিতার মনে হলো সে এত খুশি বহুদিন হয়নি! নিশিতার নিরবতা দেখে নিষাদ কাছে এসে নিশিতার গালে হাত রেখে বলে,
“সকালের জন্য স্যরি! তুমি খুব লক্ষ্মী নিশি। তবুও কষ্ট দিয়ে ফেলি। আ’ম স্যরি।”
নিশিতা মৃদু হেসে বলে,
“আমি কষ্ট পাইনি। আমি বুঝি তো তোমায়। কত চাপ যাচ্ছে! রাগ করে বাড়ি ছাড়াটা একদমই ঠিক হয়নি, বুঝলে? আম্মু আব্বুকে একটু কষ্ট করে মেনেজ করে নিলেই হতো। এখন তো তাঁরাও কষ্ট পাচ্ছে!”
নিষাদ শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে ভেতরের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
“ইশশ! কত বুঝের মেয়ে হয়ে গিয়েছ নিশি!”
নিশিতা মুখের হাসি আরো গাঢ় করে বলে,
“বিয়ে হয়ে গিয়েছে না আমার? আটমাস হয়ে গিয়েছে! বুঝের হতে হবে না?”
ভেতর থেকে হাসির ধ্বনি ভেসে আসে।
.
শেষাংশ
——-
“অগ্নিশর্মা, কেমন আছো? আশাকরি বৃষ্টির জলে ভেজা পদ্মফুলের মতো স্বতঃস্ফূর্ত আছো। তোমার শেষ ই-মেইলে বলেছো, আমি নাকি মেমসাহেব পেয়ে তোমাদের সকলকে ভুলে গিয়েছি! যদিও ভারী অদ্ভুত কথা বলেছো; তবে তোমার এই কথার পর থেকেই মনে হতে লাগলো, দুবছর পরও যদি একজন মেমসাহেব পটাতে না পারি, তাহলে এ আমার জন্য চরম মিস্টেইক। হা হা হা!
তার থেকেও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, বেশ কয়েকজন বিদেশীনীর ফটোগ্রাফি শুরু করলাম এরপর। মানে পোটানোর আধুনিক টেকনিক বলতে পারো, হা হা!
কিছু মেমসাহেবদের দেখলে হুট করে ম্যানিকুইন এর মতো লাগে বুঝলে? সব কেমন যেন কৃত্রিমতায় ভরপুর। হাসলে মনেহয়, জোড় করে পিটিয়ে পিটিয়ে কেউ হাসাচ্ছে! কী আশ্চর্য! তবে দুই তিনজন মেমসাহেবকে ভালোই লেগেছিল, কিন্তু এদের সাথে কথা বলার পর মনে হলো, কোনো ভিনগ্রহের এলিয়েনের সাথে কথা বলছি! মন খুলে কোনো কথাই বলতে পারি না। বলি এক বুঝে আরেক। কী এক যন্ত্রনা, বলো দেখি?
সেদিন কী হয়েছে জানো? এক মেমসাহেবকে পোটানোর দু-তিন ধাপ অতিক্রম করে ফেলেছি। সেও বেশ হেসে-টেসে কথা বলছে। আমার নামটাও মোটামুটি সুন্দর করে উচ্চারণ করলো। মনে মনে লাড্ডু ফুটে গিয়েছিল অলরেডি। ভাবলাম, মেমসাহেব এবার জুটেই যাবে। কিন্তু আমার সেই বিদেশীনী তোমার আর আদ্রর নামের পুরো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আদ্রকে বানিয়েছে “অ্যাড্র” আর তোমাকে বানিয়েছে “অঘ্নিশরম্যা” “নোওলোখ”! কী ভয়ংকর! এটুকু অব্দি তাও মেনে নিয়েছিলাম; কিন্তু যখন সে আমায় “ভাংঘালি ভ্যাবু” বানিয়ে দিয়েছে তখন থেকে আমার বিদেশীনী মেমসাহেব বিয়ে করার শখ অর্ধেক মিটে গিয়েছে। ভাংঘালি ভ্যাবু উপাধির সাথে সাথে আমাকেও ভেঙে দিয়েছে, অগ্নিশর্মা! আপাতত আমি ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে আছি। তোমার খোঁচা মারা কথার চক্কোরে পা দিয়ে, বিদেশিনী বিয়ে করে আপাতত ভেঙে যেতে চাচ্ছি না বুঝলে? তাই বিয়ে ফিয়ের চিন্তা বাদ দিয়েছি। হা হা হা!
আচ্ছা এসব কথা বাদ দেই। কাজের কথায় আসি। অ্যাড্র, না মানে আদ্র বলদটারে ভীষণ মিস করছি অগ্নিশর্মা। তোমাকেও বোধহয়!
আচ্ছা শোনো? বলদটারে বলবা আমাকে যেন কল না দেয়। ওর উপর আমি খুব রেগে আছি। দুবছরেই এই রাগ কমে যাওয়ার নয়। আরো বছর কয়েক লাগবে।
তোমায় চুপিচুপি একটা কথা বলি! এতদিন বলা হয়নি। আদ্র বলদটা তোমাকে খুব ভালোবাসে। শরৎ এর মতো সুন্দর আর জলের মতো স্বচ্ছ ভালোবাসা। ইশশ! এমন বলদের বলদ, ভালোবাসে সেটাও বলতে জানে না ঠিক ভাবে।
শোনো অগ্নিশর্মা? বলদটাকে বলে দিও তো, সে তোমায় যতটা ভালোবাসে, আমি বলদটারে ততটাই ভালোবাসি। রাগ কমলে দেশে ফিরে, আগে একটা ঘুষি দিব স্টুপিডটাকে তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনে জেদ মিটাবো।”
ই-মেইলটা পড়া শেষ করে নোলকের চোখেমুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে। শুরুতে যতটা হেসেছে, শেষে ঠিক ততটাই মুগ্ধ হয়েছে। আদ্রর পর এই মানুষটাকে নোলক খুবই পছন্দ করে। অদ্ভুত ভাল একটা মানুষ। বন্ধুর প্রতি কী অকৃতিম ভালোবাসা তার!
সেদিন যদি এই মানুষটা না থাকতো তবে কী করে এই ছেলেটাকে পেতো? কিন্তু হুট করে তাঁর ভিনদেশে পারি জমানো রহস্যটা আজও ভেদ করতে পারে না।
নোলক বিরবির করে বলে,”আল্লাহ্! এই ভাল মানুষটাকে একটা ‘মিষ্টি ম্যানিকুইন’ এর মতো ‘মেমসাহেব’ জুটিয়ে দাও প্লিজ! যে তাকে ‘ভাংঘালি ভ্যাবু’ না বলে ‘বাঙালি বাবু’ বলতে পারবে!”
রাতের শেষ ভাগ। বাহিরে প্রচুর বাতাস বইছে। ‘বৃষ্টি হবে?’ ভাবতে ভাবতে ঝপঝপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। খোলা জানালার ফাঁকে বৃষ্টির ছাট এসে নোলকের গায়ে লাগে, মুখে লাগে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে, পাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটার দিকে চায়। এত মায়া!
নোলক ডাকে,
“এই যে শুনছেন, এই? একটু উঠুন না!”
সুপুরুষটির ঘুম খুব পাতলা। আর এই মেয়ের ডাকের কাছে, সকল ঘুম কই যেন পালায়! চটজলদি উঠে বসল। অদ্ভুত সুন্দর চোখ দুটি পিটপিট করে। ভ্রু’জোড়া খানিক কুঁচকে আসে। অনুমানের উপর….ঠিক অনুমান বলা চলে না, অভ্যেস বলা যায়! সেই অভ্যেসেই বা’হাতটা নোলকের গালে রেখে বলে,
“কী হয়েছে নোলক? ঠিক আছো তুমি?”
নোলক এই পুরো কাজটাই ভারী মুগ্ধ হয়ে দেখে! যদিও আজ প্রথম নয়! বিগত দু’বছরে প্রায়শই এমনটি সে করে আসছে! কুটিকুটি হেসে বলে,
“বাহিরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। চলুন না ভিজি!”
মুগ্ধতায় ঘেরা মানবটি বিরক্তি নয় শুধু, মহা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
“আজীবন ছেলেমানুষ থেকে যাবে তুমি নোলক?”
নোলক ছেলেটির খুব সন্নিকটে গিয়ে গুটিশুটি হয়ে বুকে মাথা রেখে বলে,
“আপনি জুড়েই আমার সকল ছেলেমানুষি, আদ্র সাহেব! আপনি আমার, এই খুশিতেই আমার সকল ছেলেমানুষি! জনম জনম আপনাতেই আমার সকল অবুঝপণা বন্ধি হয়ে রইবে, আমার বুঝের মানুষ!”
আদ্র নোলককে নিজের বাহুতে জড়িয়ে বলে,
“আমার তুরতুরি, আমার চঞ্চলাবতী, আমার নোলকরানী! আমার পাগলী একটা!”
নোলক খুব আহ্লাদ করে বলে,
“শুনুন? শ্রী আর আপু দুজনেরই মেয়ে বাবু হবে, ইনশাআআল্লাহ্। খুব কিউট না ব্যাপারটা? দুটো মেয়ে বাবুর নাম ঠিক করতে হবে, বুঝেছেন?”
আদ্র ঠাট্টার স্বরে বলে,
“হায়রে! সবাই বড়ো হয়ে যাচ্ছে, মা হয়ে যাচ্ছে, শুধু আমার বউ’টাই বড়ো হচ্ছে না! আহ, দুঃখ!”
নোলক মুখ ফুলিয়ে উঠে যেতে লাগলে; আদ্র আরো শক্ত করে ধরে রেখে, খুব আদর দিয়ে বলে,
“এত মায়া, এত স্নিগ্ধতা, এত ভালোবাসা কেন পুরো তুমিটা জুড়ে? আমার জীবনের যত অপূর্ণ ভালোবাসা সব তুমি দিয়েছো নোলক! আমার নোলকরানী? আমার অভিমানী? এত সুখ আমি কই রাখি, বলো দেখি?”
মূহুর্তের মাঝেই নোলক পুনরায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। বলে,
“চলুন না, আজ আমাদের সকল সুখ জলে মেশাই?”
রাতদুপুরে আদ্র ভারী আওয়াজ করে হাসে। নোলকের কপালে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়িয়ে বলে,
“বৃষ্টি এলেই তোমায় পাগলে পায় নোলক!”
নোলক বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পর্দা আরো খানিক সরিয়ে দিয়ে বৃষ্টির মায়া অঙ্গে জড়ায়। চোখ দুটি বন্ধ করে খুব দরদ দিয়ে বলে,
“জলের সঙ্গে আমার খুব ভাব, আদ্র সাহেব। যতবার বৃষ্টি নামে, জলের ধারা বয়; ততবার, ঠিক ততবার আমি আপনার প্রেমে পড়ি! আকাশ জুড়ে, মন জুড়ে, আমার প্রাণজুড়ে জলে ভাসা প্রেম নামে। মন কেমন করা প্রেম।”
আদ্র ততক্ষণে নোলকের পাশে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টির জল দুজনের গায়ে মাখামাখি হয় খুব। নোলক চমৎকারতম দৃষ্টিতে আদ্রর দিকে চায়।
বৃষ্টি নামে, দুঃখ নামে, সুখ নামে! শহরজুরে প্রেম নামে, জলের প্রেম!
(সমাপ্ত)
[।)