জলছবি পর্ব ৪

৪.

#জলছবি
#৪র্থ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
ইশানের হাসির উৎস ধরেই উপরে তাকায় নোলকও। ইশান এবং ইশানের পাশে দাঁড়ানো কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত মানবটাকে দেখে কপালে দুই-তিন ভাজ পড়ে যায়। চোখ হয়ে যায় ছানাবড়া। নোলকের মনেও একই প্রশ্ন,”এই ছেলে এখানে কেন?”

আদ্র এবং নোলক দুজন দুজনের দিকেই কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিষাদ নোলকের কাছে এসে ফিসফিয়ে বলে,
“কিরে ভাই? এমনে তাকায়া আছিস ক্যান ছেলেটার দিকে? লাভ এট ফার্স্ট সাইড নাকি?”
নোলক কটমটিয়ে তাকায় নিষাদের দিকে। নিষাদ নিজেকে সামলে নেয়। তবে নোলকের থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরে না। উপরন্তু বাকিদেরও ফিসফিয়ে বলে,
“কাহিনী কিছু বুঝতে পারছিস?”
শ্রেয়া নিষাদের একটু কাছে ঝুকে ওর মতোই নিচু স্বরে বলে,
“এইখানে আবার কাহিনী পাইলি কই থেইকা তুই? এমন ‘ভদ্র-সদ্র দেখতে’ কাউকে দেখলে সবাই-ই তাকাবে। আমিও তো তাকাইলাম। তোর মতো বলদের মতো দেখতে পোলাগো দিকে তাকাইলে নাহয় কাহিনী খুঁজতাম।”
শেষের কথাটুকু বেশ তাচ্ছিল্যের সহিত-ই বলে শ্রেয়া। নিষাদ পারে না গিলে খায় শ্রেয়াকে। সামনে অনুপমা দেবী থাকায় কিছু বলতে পারে না।
এরই মাঝে অনুপমা দেবী নোলকের কাছে এসে বলে,
“তুমি নোলক?”
নোলক মিষ্টি হেসে সম্মতি জানায়। তিনি নোলকের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“শ্রী তোমার কথা খুব বলে।”
লুবনা আর শ্রেয়া ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন ছুড়ে,
“আমাদের কথা বলে না, আন্টি?”
অনুপমা দেবী বিষয়টা ধরতে পেরে মৃদু আওয়াজ করে হাসে। তারপর সবাইকে এক এক করে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
“তোমাদের সবার কথাই বলে।”

তবে সত্যি এই যে, এই বন্ধুমহল তৈরি হওয়ার পেছনে নোলকের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তার চঞ্চল আর মিশুক স্বভাবের কারনেই সবার সাথে তারই আগে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সবার সাথে যোগসূত্রও তারই মাধ্যমে। তাই সবার কাছেই তার প্রিয়তা একটু বেশি-ই। সেটা উপরে উপরে প্রকাশ করতে না চাইলেও ভেতর ভেতর সবাই-ই জানে।

‘নোলক এখানে কেন’ বুঝতে পারার পর আদ্র আর দাঁড়িয়ে থাকে না। নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ইশান ওর পেছন পেছন আসতে আসতে বলে,
“ব্রো, অগ্নিশর্মার লুক দেখছিস? তোমার কপালে শনি আছে।”
আদ্র বিরক্তি নিয়ে তাকায়। ইশান ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার’ মতন করে প্রসজ্ঞ পাল্টে বলে,
“না মানে, নোলক নামটা সুন্দর না?”
“জঘন্য! খুবই জঘন্য একটা নাম। এর আগে এমন পঁচা নাম আমি আর শুনিনি।”
কথাটা বলে সে দরজা আটকানোর আগ দিয়ে। তারপর ঠক করে দরজা আটকে দেয়। ইশান অথৈ সমুদ্রে পরে যাওয়ার মত করে বলে,
“এই আমি যাবো না রুমে?”
ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,
“তোর রুম পাশেরটা, গাধা।”
.
গোলাকৃতির বাড়িটা দোতলার। খুব চমৎকার নিখুঁত কারুকার্যময় নকশা আকা পুরো বাড়িটা জুড়ে। বাড়িটার মাঝখানে একটা তুলসী গাছ। শ্রীতমার থেকে জানা গেলো, এ বাড়িতে মোট আঠারোটা রুম আর একটা চিলেকোঠা আছে। এই বাড়ির সৌন্দর্য নিয়ে সবার তুখড় উত্তেজনা থাকলেও নোলকের তেমন কোনো উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়নি। সবাই শ্রীতমার রুমে এসে বসে। সবাই মিলে শ্রীতমার জন্য করে আনা শপিং গুলো খুলে খুলে দেখে। এই কাজে অবশ্য লুবনা আর শ্রেয়ার উৎসাহ-ই বেশি। সৃজন ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। সবার ধারনা, ফোনে কথা বলার প্রতিযোগিতা হলে সৃজন সেখানে চ্যাম্পিয়ন হবে! বিশেষ করে মেয়েদের সাথে তার খুব ভাব। অন্যদিকে ফয়সাল নিজেকে সিঙ্গেল সমিতির নেতা হিসেবে জাহির করে বেড়ায় সারাক্ষণ। তার ভাষ্যমতে সে, নিরীহ মাসুম বাচ্চা বলেই এখনও সিঙ্গেল। নিষাদ বন্ধু মহলের মিস্টার জৌতিষ হিসেবে বেপক আলোচিত। তার আন্দাজে ঢিল মেরে বলা অনেক কথাই কাকতালীয় ভাবে মিলে যায়। যদিও বেশিরভাগ-ই ফেইল মারে। শ্রীতমা প্রকৃতপক্ষেই নিরীহ টাইপ একটা মেয়ে। কোনো ধরনের জটিলতার ধারের কাছেও থাকে না। সৃজন, শ্রেয়া আর শ্রীতমা সনাতন ধর্মাবলম্বী। বাকিরা মুসলিম হলেও মিশতে খুব একটা অসুবিধে কারোই হয় না।

এই মূহুর্তে সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু নোলকের চোখমুখ শক্ত হয়ে আছে। তার মাথায় সারাদিনের ঘটনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। যার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই আদ্রর দখলদারিত্ব। তার বলা কাটকাট কথাগুলো মনে পড়লেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
শ্রীতমা সেটা খেয়াল করে বলল,
“তোর কি মন খারাপ, নোলক?”
“মন নয়, মেজাজ খারাপ।”
নিষাদ বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“এ আর নতুন কী? সে তো তোর বছরে বারো মাস-ই থাকে। ইট’স ইওর স্প্যাশাল ট্যালেন্ট। নো চাপ বেইব, জাস্ট চিল।”
সবাই মুখ চেপে হাসে।
নোলক দাঁত কিড়মিড় করতে করতে পাশ থেকে বালিশটা নিয়ে নিষাদের দিয়ে ছুড়ে মেরে বলে,
“চুপ থাক, ফাজিল!”
নিষাদ ছুড়ে দেয়া বালিশটা ধরে নিয়ে খটখট করে হাসে।
ফয়সাল টেনে টেনে বলে,
“তো ম্যাডাম, কিসের জন্য আপনার মেজাজ খানা খারাপ জানতে পারি কি?”
ফয়সালের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে নোলক শ্রীতমাকে জিজ্ঞেস করে,
“ঐ বেয়াদপ, অভদ্র লোকটা এখানে কেন?”
সবাই কৌতুহলী হয়ে তাকায়। শ্রেয়া বলে,
“ওমাহ! এখানে আবার বেয়াদপ, অভদ্র আইলো কইতে?”
শ্রীতমা কিছুটা অনুমান করতে পেরে বলে,
“কার কথা বলছিস? বাই এনি চান্স, তুই কী আদ্র আর নিশাদ ভাইয়ার কথা বলছিস?”
নোলক মুখ বিকৃতি করে বলে,
“হ্যাঁ, ওই আদ্র না টাদ্র! বেয়াদপ, খারাপ!”
নিষাদ বাধা দিয়ে বলে,
“এই ওয়েট, ওয়েট, ওয়েট! এইটাই কি তোর সেই বই-মানব?”
নোলক শক্ত মুখে সম্মতি জানায়। সৃজন ফোন রেখে হাসতে হাসতে বলে,
“ওয়াও! হোয়াট আ কো-এনসিডেন্স! কাহিনী তো পুরাই জইমা গেছে মামা!”
নোলক চট করে ভয়ংকর রেগে যায়। অনেকটা উচ্চস্বরে বলে,
“ফালতু কথা বলবি তো, থাপ্পড় খাবি। কিসের কাহিনী, হ্যাঁ? ঐ ছেলে আমাকে ইনডিরেক্টলি পাগল বলেছে, জানিস?”
ফয়সাল মিনমিন করে বলে,
“খুব একটা ভুল বলেনি।”
লুবনা চিমটি দিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলে। আস্তে বলার ফলে নোলক শুনতেও পায়নি। জিজ্ঞেস করে,
“কি বললি? আবার বল?”
ফয়সাল ভদ্র বালকের মতো করে বলে,
“কই কি বলছি? বললাম যে, ঐ ছেলের এতো বড় সাহস, পাগলনীরে পাগল বলে! সে তো জেন্ডারে গোন্ডগোল কইরা ফেলাইছে। কি সাংঘাতিক!”
“ফয়সালের বাচ্চা….!”
“না, আমি ফয়সাল। জন্মের আগে থেইকা সিঙ্গেল ছিলাম, বর্তমানেও আছি। আমি হচ্ছি আজন্ম সিঙ্গেল মানব। আমার কোনো বাচ্চাকাচ্চা নাই, বিশ্বাস কর।”
সবাই মুখ চেপে হাসলেও স্বস্থি পায় না শ্রীতমা। সে আগাম বিপদের সংকেত পেয়ে সামাল দেয়ার মত করে বলে,
“দোস্ত, তারা তো দা’ভাইর বন্ধু। তুই রাগ করিস না প্লিজ।”
নোলক বলে,
“কোনো রাগ-টাগগ বুঝি না। এই ছেলে যেখানে থাকবে আমার সেখানে থাকা সম্ভব নয়। আমি কালই বাড়ি ফিরে যাবো। কত্ত বড়” সাহস! আমায় বলে, আমার নাকি মানসিক সমস্যা আছে! বেয়াদপ, ফালতু।”
কথাটা বলতে বলতে সে বিছানা থেকে নামে।
শ্রীতমার তখন বেহাল দশা। সে এসে নোলকের হাত ধরে বোঝায়। অনেক বুঝানোর পর একটু শান্ত হয়। ঠোঁট উল্টে বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে যাবো না। কিন্তু ওই ফাজিল যেন আমার সামনে না পরে।”
সাময়িক ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেতে শ্রীতমা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।
আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আচ্ছা, পড়বে না।”
.

ঘড়ির কাটা এগারোটা ছুঁইছুঁই নোলক বৈঠকে এসে দাঁড়ায়। পুরো বাড়ি লাল-নীল বাতিতে সাজানো হচ্ছে। কি যে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে বাড়িটা! নোলক পুরো বৈঠক জুড়ে হাঁটে। পায়ে রুপার নুপুর গুলো রুমঝুম আওয়াজ তোলে। যারা লাইটিং এর কাজ করছে, নোলক তাদের একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
“এই যে দাদা? ফুল লাগাবেন না?”
লোকটা বলে,
“ফুলের কাম ভোর সকাল হইতে শুরু করুম। রাইতে খালি লাইটিং ডেকোরেশন কইরা যাইম গা।”
নোলক উত্তর পেয়ে স্থান ত্যাগ করে। উঠোনে নেমে দাঁড়ায়। উঠোনে তুলশি গাছটাকে কেন্দ্র করে প্রদিপ সাজাচ্ছে একজন শ্যামকন্যা। নোলক এসে থেকে লক্ষ্য করছে, এই মানুষটা এক সেকেন্ডও স্থির থাকে না। কে কখন আদেশ করবে আর সে পালন করবে সেই চিন্তায় থাকে। নোলক কাছে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে সে প্রশ্ন করে,
“কিছু লাইগবে দিদিমুনি?”
নোলক সুন্দর হেসে বলে,
“এতো অস্থির হয়ে থাকো কেন সবমসময়? আমার কিছু লাগবে না। তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। অসুবিধে নেই তো তোমার? অবশ্য অসুবিধে থাকলেও কিছু করার নেই। খানিক-ক্ষন হলেও গল্প করতে হবে। কি নাম তোমার?”
মেয়েটা সহাস্যমুখে বলে,
“শ্যামা, শ্যামা আমার নাম। আপনের নাম কি দিদিমুনি?”
নোলক মুগ্ধ হওয়ার মতো করে বলে,
“বাহ! কি সুন্দর নাম। ঠিক তোমার মতোই।”
শ্যামা ভারী অবাক হওয়ার মতো করে তাকায়। যেন এমন মিষ্টি করে কেউ কখনো বলেইনি ওকে! বিস্মিত, মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। যেন এত সুন্দর কথা কখনো শুনেনি!
হুট কিছু একিটা মনে পড়ে যাওয়ার মতো করে নোলক বলে,
“আর, ও হ্যাঁ, আমার নাম নোলক।”
শ্যামা সারল্য হেসে বলে,
“আমি আগে কহনো এমন নাম শুনি নাই।”
নোলক মৃদু আওয়াজ করে হাসে। শ্যামার হাত থেকে প্রদিপ নিতে নিতে বলে,
“আমি তোমাকে শ্যামা’দি বলে ডাকবো কেমন?”
শ্যামার চোখ দুটো যেন ঝলমল করে উঠে। জোর দিয়ে বলে, “একশবার ডাকবেন, হাজার বার ডাকবেন। ক্যান ডাকবেন না?”
নোলক হাসে। কোমল সুন্দর সেই হাসি।
এই মেয়েটা এমনই। ঠুসঠাস যেমন রেগে যেতে পারে, ঠিক তেমনি মূহুর্তেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে। উজার করে ভালোবেসে আগলে নেয়ার অসীম ক্ষমতা তার। তুলসী গাছের চারপাশে প্রদিপ সাজাতে সাজাতে নোলক বলে,
“শ্যামা’দি? আমি কাল উঠোন জুড়ে আলপনা দিবো। তুমি কি আগের আলপনাগুলো উঠিয়ে দিতে পারবে।”
শ্যামা দৃঢ়তার সহিত বলে,
“ক্যান পারুম না? একশো বার পারুম।”
“একশো বার পারতে হবে না, আপাতত একবার পারলেই চলবে।”
কথাটুকু বলেই পুনরায় হাসে মেয়েটা। প্রদিপের আলোয় চাঁদের টুকরো মতো লাগে হাস্যজ্জ্বল মুখখানা।
আদ্র’র কপাল কুঁচকে আসে। সে দোতলায় দাঁড়িয়েই সবটা দেখছে। একটা মানুষকে কত সহজে আপন করে নেয়া যায় সেটাই দেখলো কেবল। একটু নিচে নেমে আসা চশমাখানা ঠেলে উপরে তুলে। সারাক্ষণ ছটফট করতা থাকা নোলকের এহেন ভিন্ন রূপ দেখে একটু ভালো লাগে। বিড়বিড় করে বলে, এমন থাকলেই তো হয়, অতো ছটফটানির কি প্রয়োজন?
আদ্র’র ভাবনায় ছেদ পড়ে রুমের ভেতর থেকে ভেসে আসা ইশানের কন্ঠে,
“দোস্ত? আমার ব্ল্যাক টি-শার্ট টা কই? দেখছিস তুই?”
আদ্র মগ্নতা কাটিয়ে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আনমনে বলে,
“টি-শার্ট তার, জিজ্ঞেস করছে আমাকে। কি চমৎকার ব্যাপার!”
.

কাজ শেষে ডেকোরেশন এর লোকেরা চলে গেলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাইকে সবার জন্য বরাদ্দকৃত রুম দেখিয়ে দেয়া হলো। দোতলায় সিরিয়ালে সবার রুম। সবাই খুশি মনে মেনে নিলেও মানল না কেবল নোলক। সে মিনমিন করে বলল,
“আমি একা ঘুমাতে পারি না। আমার সাথে আমার আপু ঘুমায়।”
কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো আদ্র আর ইশান।
ইশান দূর থেকেই মৃদু হেসে বলে,
“আপনি ভূতে ভয় পান? অগ্নিশর্মা আবার ভূতে ভয় পায় নাকি?”
নোলক কোনো প্রতিক্রিয়া করে না। কারন সে আসলেই খুব বেশি ভয় পায়।
দ্বীপ অভয় দিয়ে বলে
“আরে বোকা মেয়ে? এখানে ওসব ভূত-টূত নেই। পুরোনো আমলের বাড়ি হলেও এখানে তেমন কোন ব্যাপার নেই। রিল্যাক্স, ওকে?”

নোলক জানে ভূত-টূত ভয় পাওয়া নেহাৎ বোকামি বৈ কিছু নয়, তবুও সে তার এই ভয় কাটাতে পারে না। এমনকি সে রাতে বাতি বন্ধ করেও ঘুমায় না। সেই ছোট থেকেই। যেদিনই বাতি বন্ধ করে ঘুমাবে, সেদিনই উদ্ভট উদ্ভট স্বপ্ন দেখে। সে রাতে তার আর ঘুম হয় না। বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে, ঘুমের মাঝে সে অনুভব করেছে কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। কিছু বলতে পারে না, সইতে পারে না। এটা যে কি যন্ত্রণাময়! অবশ্য পরে জানতে পেরেছে, এই ব্যধি’টার একটা বৈজ্ঞানিক নাম আছে। স্লিপিং প্যারালাইজড। কিন্তু তার মনে রয়ে গিয়েছে শান্তার দাদির বলা, ‘তোমারে বোবা জ্বিনে ধরে বুবুজান। সাবধানে থাইকো।’ কথাটি!
পৃথীবিতে এই ভূত-জ্বিন ভীতি ব্যতীত প্রাকৃতিক আর কোনো কিছুতেই তেমন ভয় নেই মেয়েটার। এমন কি সাপ-বিচ্ছুতেও না। অন্য সব বেলায় দূরন্ত কেবল এই বেলাতেই তার রাজ্যের সংশয়, ভয়, অস্থিরতা, দূর্বলতা। বন্ধুরা নোলকের এই ভূত-ভীতি সম্পর্কে অবগত। লুবনা অভয় দিয়ে বলল,
“সমস্যা নেই, আমি তোর সঙ্গে ঘুমাবো।”
সমস্যার সমাধান এখানেই। যে যার রুমে ঘুমাতে গেলো। নোলকের সঙ্গী হলো লুবনা।
.
রাত তখন একটা কি দুইটা বাজে হয়তো। নোলকের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ পিটপিট করে তাকায়। রুমের লাইট অন করে ঘুমিয়েছিল কিন্তু লাইট এখন অফ। হয়তো লুবনা অফ করে দিয়েছে। তবে ড্রিম লাইট জ্বালানো। সেই আবছা আলোয় সে সাদা চাচের দরজায় দেখতে পায় কেউ হাঁটছে। একবার যাচ্ছে, একবার আসছে। মূহুর্তে নোলকের কপালে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হয়। নোলক পাশে ঘুমিয়ে থাকা লুবনাকে নিচু স্বরে ডাকে,
“লু..লুবনা? এ..এই লুবনা?”
গভির ঘুমে থাকা লুবনা ভয়ে ভীত নোলকের ডাক শুনতে পায় না। বেশ কিছুক্ষণ খিট করে শুয়ে থাকার পর বোনের বলা ‘ভয় কে জয় করতে শিখ’ কথাটি স্বরন করে। মনে সাহস সঞ্চয় করে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে আগপিছ না ভেবে চট করে দরজা খুলে দেয়। দরজার সামনে পায়চারী করা মানটাকে দেখে কেঁপে উঠে। ঘটনার আকস্মিকতায় আদ্রও খানিক চমকে যায়। তবে সে নিজেকে সামলে নেয়। হাতের মোটা বইটি এক হাত থেকে অন্য হাতে নিয়ে চমশা ঠিক করে। নোলকের ভীতি সম্পর্কে আগে থেকে অবগত থাকার ফলে বুদ্ধিমান ছেলের মতো পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করে। ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকা নোলকে সাহস এবং সামাল দেয়ার মতো করে বলে,
“হাই, নোলক, রাইট? কেমন আছেন? আসলে আমার রাত-বিরেতে পায়চারী করার স্বভাব আছে। রাত জেগে বই পড়ার পুরোনো বাজে অভ্যাস। তাই একটু হাঁটছিলাম। আপনি ঘুমাননি এখনও? আমার মতো আপনারও কি রাত জাগার অভ্যাস আছে নাকি? নোলক? ঠিক আছেন? প্লিজ ভয় পাবেন না। আমি, আমি আদ্র।”………(চলবে)

(বিঃদ্রঃ১. ব্যস্ততার কারনে না চাইলেও গ্যাপ পড়ে যাচ্ছে। এই যে, লিখে রেখেছি আরো আগে, কিন্তু পোস্ট করার সময় পেলাম কেবল!

২.আমাদের সবারই কিছু না কিছুর প্রতি মারাত্মক ভয় কাজ করে। যেমন সাপ-বিচ্ছু, পোকামাকড়, তেলাপোকা ইত্যাদি। তেমন-ই নোলকের ভুতে ভয়। প্রচন্ড ভয়ে আমাদের সকলের-ই ভাবনা-চিন্তায় তালগোল পাকিয়ে যায়, আচার-আচরণ অনেকটা বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। এটাকে কিন্তু ইম্যাচিউরিটি বলা যায় না। অনেকে আবার নোলকের এক্সট্রোভার্ট স্বভাবের সাথে ইমম্যাচিউরিটি গুলিয়ে ফেলছেন। সে এক্সট্রোভার্ট তবে অতোটা ইমম্যাচিউর নয়।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here