#জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া-সাত্তার-ঊর্মি
৭।
” ব্রাদার্স এবার শুরু হবে আমাদের আসল পার্টি। নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য হুর-পরী।”
বলেই হাসলো লোকজন। মার্জান এক পলক এদের দেখলো সবাইকে। কতগুলো ছেলে-মেয়ে বসে আছে এখানে। এদের দেখেই মনে হচ্ছে উগ্রবাদী মানুষ সব। কিন্তু শেষে যাকে দেখলো.. মার্জান বিষম খেলো…।
” গ্রীস্ম এবার কিন্তু তোমার উপস ভাঙ্গতেই হবে, আর কত মেয়েদের থেকে দূরে দূরে পালাবে? দেখো কত সুন্দর মেয়ে এসে পড়েছে তোমার পায়ের কাছে?”
রায়হানের কথায় গ্রীস্ম পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। শুধু চোখের দৃষ্টি মেলে রইলো সামনে পরে থাকা সকালের মেয়েটির দিকে। গ্রীস্মের নজর এবার ভালো করেই পড়েছে মার্জানের উপর। ওঁর সৌন্দর্য্য পূর্ণিমার আলোর মতো ঝলমল করছে। মেয়েটির আতঙ্কিত মুখটি বড্ড টানছে ওঁকে। মার্জান এদিকে ভয় পেয়ে আছে ভারী.. নতুন কোনো ঝামেলার মুখে আর পড়তে চায় না ওঁ। কিছু বলবে তার আগেই কেউ একজন টেনে তুলে তাকে,
” আম সরি মিস আপনাকে অন্য কেউ ভেবে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে , আপনি ঠিক আছেন তো!”
বিনম্র কন্ঠে শুধালো গ্রীস্ম। মার্জানের অন্তরের ভিতর এক ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। নাহ্ লোকটি আর যেমনই হোক না কেন? তাকে হেল্প তো করতে পিছুপা হয় নি? মার্জান ছলছল চোখে গ্রীস্মের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। মার্জান ভাবেইনি এই লোকটির সাথে এত জলদি দেখা হবে। মার্জান বলল,
” থ্যাঙ্ক ইউ। ”
বলেই বেড়িয়ে যেতে নেয় মার্জান তখনি কেউ একজন বলে উঠলো,
” এখনি তো এসেছো জানেমান, এখনি চলে যাবে?”
মার্জান এবার রাগ উঠে গেলো। কিন্তু পরিবেশ আর জায়গায় দেখে, নিজেকে সামলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো,
” দেখুন আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে, আমি তো বের হচ্ছিলাম হুট করেই উনি টেনে নিয়ে এলেন। প্লিজ আমাকে যেতে দিন! ”
ওখানে বসে থাকা একটি মেয়ে, যে কি না একটি ছোট টপস্ পড়ে চিপকে বসে আছে রায়হানের পাশে সে বলে উঠলো,
” আজ কাল দেখছি দু’ টাকার নাচনী ওয়ালাদের কি-ভাব। ভাব তো এমন করে যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।
মার্জান মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো,
” কে কি পারে, আর কে কি পারে না.. তাতো বোঝায় যাচ্ছে। ”
তাচ্ছিল্য হাসলো মার্জান। মেয়েটি রেগে গিয়ে তেড়ে এলো মার্জানের গায়ে হাত তোলতে। মার্জান তখন উল্টো টেবিল থেকে ওয়াইনের গ্লাস তুলে মেয়ের মুখে মেরে দিলো। মেয়েটি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
” ইউ.. ব্লাডি..”
এর আগেই একটি কন্ঠ থামিয়ে দিলো মেয়েটিকে,
” মাইশা এখান থেকে যাও।”
” কিন্তু আমি..”
গ্রীস্মের কন্ঠ আরো ঠান্ডা হলো,
” আই সেইড.. গো!”
মাইশা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো। রায়হান বলল,
” আমার ভাইয়ের বুঝি মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে?”
এর পরেই মার্জানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
” কংগ্রাচুলেশন, ইরফানুর মাসাবীহ গ্রীস্মের নজর তোমার উপর পড়ে গেছে। কে বাঁচাবে তোমায় এবার।”
মার্জান রাগে ফেঁটে পড়লো এবার পাশেই থাকা গ্রীস্মকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো ওঁ। ঠিক তখনি টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিজেও পড়ে গেলো গ্রীস্মের উপর। সঙ্গে সঙ্গে মার্জানের ঠোঁটের লিপস্টিকের দাগ গ্রীস্মের সাদা শার্টের উপর সুন্দর ভাবে লেগে গেছে। মার্জান গ্রীস্মের শক্ত-পোক্ত শরীরটা অনুভব করছে। ওঁর শ্বাস-প্রশ্বাস আর শরীরের মিষ্টি সুবাস আছড়ে পড়ছে মার্জানের নাকে মুখে । মার্জান হারিয়ে যেতে লাগলো যেন। এক পলক মনে হলো ওদের দু’জনের চারপাশে হাজারো প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। পরক্ষনেই মার্জানের ধ্যান ভাঙ্গে, হন্তদন্ত হয়ে উঠতেই গ্রীস্ম ওঁর কোমর শক্ত করে চেপে ধরলো।তখনি রায়হান রাঙ্গানীত কন্ঠে বলল,
” ষ্টুপিড গার্ল, তোমার সাহস তো কম না.. তুমি গ্রীস্মকে ধাক্কা দাও, জানো এর আগে যে মেয়ে গ্রীস্মকে টাচ্ করেছিলো শুধু ওই মেয়েটির দু’টো হাত কেঁটে নিয়া হয়েছিলো।”
মার্জানের মনে হলো এবার পায়ের নিচ থেকে মাটি স্বরে গেছে। ওঁর কিছু হয়ে গেলে মৃণালের কি হবে?গ্রীস্ম অনেক ডেঞ্জারাস ইতি মধ্যই বুঝে গেছে মার্জান, সব কিছু ভেবেই সে গ্রীস্মের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে বিনীত সুরে অনুরোধ করলো,
” প্লীজ আমাকে যেতে দিন, আমি ইচ্ছে করে করিনি। প্লীজ।”
গ্রীস্ম এবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মার্জানকে মাটিতে।মার্জান ধড়াম করে পড়লো। গ্রীস্ম চেচিয়ে উঠলো,
” এখান থেকে গায়েব হয়ে যাও। মেয়েদের ঢং একদম পছন্দ নয় আমার। ”
মার্জান ডান বামে কিছু দেখলো না। গ্রীস্ম কি বলল, তাতেও ভ্রুক্ষেপ করলো না। এক ছোটে পালিয়ে গেলো সেখান থেকে। তখনি রায়হান আহ্ করে শ্বাস ফেললো,
” গ্রীস্ম তুমিকি মেয়েটিকে চিনো? কেন ওঁকে এভাবে বাঁচাতে চাইছো?”
গ্রীস্ম উত্তর দিলো না। বাঁকা হাসলো শুধু। এদিকে মার্জান চট জলদি ওয়াশরুম চলে এলো। হুট করেই অনুভব করলো ওঁর পেট খুব ব্যথা করছে। এবং জামার পিছনে দাগ লেগে গেছে রক্তের। বুঝতে বাকি নেই মার্জানের ওঁর পিরিয়ড শুরু হয়ে গেছে। মার্জান এবার ঘাবড়ে গেলো। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেলো। যখন গ্রীস্মের উপর পড়েছিলো মার্জান তখন নিশ্চয়ই ওই লোকের কাপড়ে দাগ বসে গেছে? মার্জান ভয়ে আঙ্গুল চাবাতে লাগলো। এই লোকের মুখ দর্শণ আর করতে চায় না.. কমছে কম কিছুদিন। মার্জান আবারো তাকালো নিজের ড্রেসটির দিকে। কালো জামা বলেই স্থীর শ্বাস ছাড়লো।
হোটেলের ফাস্ট ফ্লোরে ইন্টার ভিউ চলছিলো নির্ঝরের। এইবার ধারাবাহিক নাটকের বদলে রবীন্দ্রনাথের লিখত বিখ্যাত গল্পের কদম্বারি দেবির চরিত্রের অভিনয় করতে চলেছে সে। সেই সুবাদে ডিরেক্টর, প্রডিউসারের সাথে সাথে সে নিজেও নিজের ব্যক্তব্য রেখে যাচ্ছে। এন্টারটেইনমেন্ট জগতে নির্ঝোর পরিচিত মুখ আর সব থেকে ইনোসেন্ট এবং ভালো চরিত্রের মানবী। যেখানে নায়ক-নায়কার স্ক্যান্ডালের অভাব থাকে না.. সেখানে নির্ঝোরের কোনো স্ক্যান্ডাল নেই বললেই চলে। ওঁর অভিনয় প্রতিটি মানুষ মুগ্ধ। নির্ঝোর এবার হাপিয়ে উঠেছে বসে থাকতে থাকতে ভিতরে। তাই রুমের বাহিরে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। এবং ফোনে কথা বলতে লাগলো শীপ্রার সাথে,
” দোস্ত.. আর বলিস না। মাথা পুরো হ্যাং হয়ে গেছে। বাই দ্যা ওয়ে.. তোর কথা বল?”
শীপ্রা ফোনের ওপাশ থেকে জোড়ালো শ্বাস ছাড়লো। বলল,
” তেমন কিছু না। মৃণালকে নিয়েই আছি আপাতত। ”
মৃণালের কথা শোনে খুশিতে গমগম করে উঠলো নির্ঝর। বলল,
” ওহ্ ডিয়ার আমি যে কবে আমার বাবুজানকে দেখবো? আর তর সইছে না। এদিকে ব্যস্ত আর ব্যস্ত। তবে খুব জলদি আমাদের পছন্দের জায়গায় দেখা হবে, মার্জানকে বলিস খুব মিস করছি আমি!”
শীপ্রা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। টুক টাক কথা বলে ফোন কেঁটে পিছনে ফিরতেই ধাক্কা লেগে ফোন পড়ে গেলো নির্ঝোরের। সামনের ব্যক্তিটিকে কিছু শক্ত কথা বলবে বলেই মুখ খুললো ওঁ। কিন্তু মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। একজন সুদর্শন যুবক যার চার্ম পুরো করিডোর যেন গ্লো করছে। নির্ঝর হারিয়ে যেতে লাগলো এই লোকটির উপর। লাভ এট ফাস্ট সাইড যাকে বলে আর-কি। এই ব্যক্তিটির সাথে নির্ঝোর কথা বলার জন্য এগিয়ে যেতেই থামিয়ে দিলো ওঁর গার্ডরা। নির্ঝোর শুধু হা করে চেয়েই রইলো। নির্ঝোর যেতেই একটি গার্ড বলে উঠলো,
” গ্রীস্ম স্যার ম্যাম মনে হয় হোটেল থেকে বেড়িয়ে গেছে!”
রাত গাড় হচ্ছে। রাস্তার ধারের মানুষ কমছে। মার্জান তাই ট্যাক্সি বা সি এন জি নিয়ে নিবে ভেবেই ওয়াশরুম থেকে বের হলো। কিন্তু হায়.. সামনেই গ্রীস্মকে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখে আত্না শুকিয়ে গেলো। লোকটি এবার ভিলেন মনে হচ্ছে। মার্জান সেখান থেকে লুকিয়ে বেড়িয়ে গেলেও কিছু কালো পোশাকদারি লোকের মুখে পড়ে গেলো। সেখানের লোকটি ব্লু টুথে কথা বলছে,
” মেয়েটি-কে পেয়ে গেছি স্যার!”
মার্জারের বুকের ভিতর এবার ধড়াস ধড়াস শব্দ করছে। সে পিছনে ফিরে আবার দৌঁড়। আজকে এই দিনটি যে কি জন্য এসেছিলো মার্জানের জীবন? মার্জান নিজের ভাগ্যকে হাজার টা গালি দিতে দিতে লুকিয়ে পড়লো সামনে একটি বট গাছের আঁড়ালে। আলো নেই সুনশান-নিস্তব্ধ। একটি মানুষ পর্যন্ত নেই। মার্জান কিছুতেই বুঝতে পারছে না। লোকটি তো তাকে ছেঁড়ে দিয়েছিলো। তাহলে কেন আবার আটকাতে চাইছে ওঁকে। কি চাইছে? মার্জানের ভাবনার মাঝে পর পর কয়েকটি গাড়ি এসে ঘিরে ফেললো বট গাছটি। মার্জানের আত্মা এবার বেড়িয়ে আসার উপক্রম। মার্জান নিজেকে আড়াল করতে ব্যর্থ। ঠিক তখনি সামনের গাড়ি থেকে গ্রীস্ম বেড়িয়ে এলো। মার্জান স্পষ্ট দেখতে পেলো লোকটির সাদা শার্টের বুকের মাঝে ওঁর ঠোঁটের লিপস্টিকের ছাপ। আর সাদা প্যান্টের মাঝে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। মার্জানের শরীর হীম হয়ে গেলো। গ্রীস্মের কন্ঠ ভেসে এলো তখন,
” তোমার লুকোচুরি খেলা শেষ হয়েছে মিস? বের হও!”
মার্জানের মনে হলো পা জমে গেছে। শরীরটাো মৃদুমন্দ কাঁপছে। মার্জানকে বেড়িয়ে আসতে না দেখে দু’টো বডি গার্ড গেলো ওঁর কাছে। টেনে ছিঁড়ছে দাঁড় করালো গ্রীস্মের সামনে।
” আপনি কি চাইছেন আমার কাছে? আপনিতো যেতে দিয়ে ছিলেন আমাকে, তাহলে এমন করছেন? প্লিজ যেতে দিন!”
গ্রীস্ম হাসলো, ওঁর বডিগার্ডদের উদ্দেশ্য করে বলল,
” ওঁকে গাড়িতে উঠাও।!”
মার্জান চোখ বড় বড় করে চাইলো। চিৎকার চেঁচামেচি করে বলল,
” মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি? আমি যাবো না আপনাদের সাথে। ছাড়ুন আমাকে। হেল্প, হেল্প হেল্প। কেউ আমাকে বাঁচান এঁরা আমাকে কি’ড’নে’প করছে।”
মার্জানের কথায় বিরক্তি নিয়ে চাইলো গ্রীস্ম। ধমকের সুরে বলে উঠলো,
” অনেক বকবক করো তুমি। একদম চুপ থাকো। নয়তো এখানেই পুতে রেখে দিবো।”
মার্জান অসহায় চোখে তাকালো। বলে উঠলো,
” দেখুন আপনি আমাকে যেমন মেয়ে ভাবছেন আমি তেমন মেয়ে নই.. প্লিজ আমাকে যেতে দিন!”
মার্জানের কথা কর্ণপাত হলো না যেন। লোক গুলো এবার মার্জানের মুখে রুমাল চেপে ধরলো। তীব্র মেডিসিনের গন্ধে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে লাগলো মার্জান। তাহলে আবার কি মার্জানের ওই সব কিছু ফেইস করতে হবে? কি হতে চলেছে ওঁর সাথে? লোকটি কি ওই মেয়েটির মতো ওকেও গুম করে দিবে? ওঁর কিছু হলে,মৃণালের কি হবে? ওঁর মার কি হবে? কে দেখবে ওদের? কে?
চলবে,