#জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-২১
পূর্ব দিগন্ত থেকে ভেসে আসচ্ছে পূবালী বাতাস। মনমাতানো অচেনা-অজানা ফুলের সুবাস।মার্জান ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভেজা কাপড়ে ঠান্ডার প্রকোপ টা বেশিই। বুঝতে পেরে গ্রীষ্ম নিজের দেহের উষ্ণতা স্পর্শ করালো মার্জানকে। তুলতুলে নরম দেহের উপর ওঁর শক্তপোক্ত শরীরের ভরটা ছেড়ে দিলো। উষ্ণতা অনুভব হতে মার্জান সাড়া দিলো। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে মার্জান। গ্রীষ্মের এক অদ্ভুত শিহরণ খেলা করছে ওঁর শরীরে। দেহের সাথে দেহের কথপোকথন হতেই মার্জানের টেম্প্যারেচার নরমাল হতে লাগলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে আবিস্কার করলো প্রশস্ত লোমহীন বুক। মার্জান চকিতে তাকালো মুখখানা দেখবার জন্য ব্যক্তিটির। হঠাৎ হুঁশ ফিরতেই এমন পরিস্থিতিতে পেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে ও। কিন্তু পরক্ষণেই গ্রীষ্মের ক্লান্ত মুখটা দেখে হাফ ছেঁড়ে দিলো। গ্রীষ্মের নিজেরও চোখ লেগেছিল। মার্জান নড়াচড়া করতেই সচকিত হলো। চোখ খুলেই প্রশ্ন করলো,
” ঠিক আছো তুমি?”
মার্জান ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” ঠিক আছি।”
গ্রীষ্ম উঠে পড়লো। ছেঁড়ে দিলো ওঁকে। দু’জনের এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। নজর এদিক সেদিক ফিরাতে লাগলো। বুঝতে পেরে গ্রীষ্ম থমথমে গলায় বলে উঠলো,
” আমি তোমার সাথে তেমন ওসব কিছু করিনি। ডোন্ট প্যানিক।”
মার্জান খানিক অবাক হলো। এরপরেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
” হলেই বা কি? এক বাচ্চার মা তো আগেই করে দিয়েছেন!”
গ্রীষ্ম ওঁর কথাটা তেমন বুঝতে পাড়লো না। তবে ‘বাচ্চার মা’ কথাটি তার কানে পৌঁছেছে ঠিকিই পৌঁছায়। ভ্রু জোরা কুচকে ফেলে জিগ্যেস করলো,
“বাচ্চার মা মানে?”
মার্জান থতমত খেয়ে গেল। নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
” আপনার কান বাজতেছে মি:”
গ্রীষ্ম ভ্রু কুঁচকিয়েই অন্য দিকে চাইলো। সাঁঝের বেলা।চতুর্দিকে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে। সাগরের ঢেউয়ের মন মাতানো উথাল-পাতাল ঢেউ আর ঝিঁঝি পোকার মতো ডাক ভয়ংকর গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে পেটের ভিতর পুরো দিন পরে নি। দু’জনেই ক্ষুধা কাতর। গ্রীষ্ম এবার আঁধারের মাঝেই উঠে পড়লো। ওঁর হাতের মাঝা একটা রিং এ চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে এক্টিভেট হতেই স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। এর পরেই হেঁটে হেঁটে এদিকে সেদিক করতে লাগলো খাবারের খোঁজ। কিছু খাবারের জোগার করে ফিরে আসতেই বিষ্ময়কর এক পরিস্থিতি পরে গেলো।আতঙ্কিত মুখে গুটি গুটি মেরে বসে আসে মার্জান। চোখে মুখে ভয় ফুঁটে। গ্রীষ্ম এগিয়ে যেতেই মার্জান চেঁচালো,
” এদিকে আসবেন না?”
গ্রীষ্ম আবারো ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলল। মার্জান বেহুঁশ থাকাকালীন গ্রীষ্ম শুকনো পাতা আর কাঠ জোগাড় করে জ্বালিয়ে ছিলো আগুন। আগুনের লকলকে আলোয় বোঝতে চেষ্টা করলো মার্জানে মুখভঙ্গি। মার্জানের নজর পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো ওঁ। কিন্তু মার্জানের পা পেঁচিয়ে বসা সাপটি থেকে এক প্রকার ছুটে কাছে চলে গেলো। এবং কোনো কিছু না ভেবেই সাপের লেজ ধরে টান দিতে ধূর্ত সাপ ফট করে কামড়ে দিলো গ্রীষ্মের হাতে। এবার আর্তনাদ করে উঠলো গ্রীষ্ম হাত মুঠ ঢিলে হতেই লেচ গুটিয়ে পালালো সাপটি। মার্জান চিৎকার করে উঠলো । পুরো বেপারটা কেমন জানি সিনেমাটিক মনে হলো। এক বার মনে হলো গ্রীষ্মে সিনেমার নায়কার মতো মার্জান দৌড়ে কাছে আসবে। গ্রীষ্মের হাত দু’টি ধরবে, চিন্তিত হয়ে চোখের জল ছাড়বে। নিজের জামার অংশ ছিঁড়ে বেঁধে দিবে হাত? কিন্তু তার ছিঁটেফোঁটা হলো না। মার্জান কাছে এসে শুধু বলল,
” এই কি করলেন? কে বলেছিলো হিরো সাজতে।আসুন? দিলো তো কামড়ে?”
গ্রীষ্ম মার্জানের কথায় হতাশার শ্বাস ছাড়লো। তাৎক্ষণিক উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগালো। ওঁ রুমালটা শক্ত করে বেঁধে দিলো কামগের অংশটুকু বাহিরে রেখে। এরপর ছোট একটি ছুঁড়ি আগুনে তাপ দিয়ে কেঁটে দিলো, ওই অংশটুকু। যদি বিষাক্ত হয় তাহলে এবার আর চিন্তা নেই। মার্জান গ্রীষ্মে এহেন কান্ড হতবাক। গ্রীষ্ম মার্জানের কাজে কিছুটা ক্ষুন্ন হলো বটে। কিছু ফল বের করে মার্জানকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্য পাশে বসে পড়লো। মার্জান নিজেও বুঝলো গ্রীষ্মের অভিমান। আড় চোখে বার কয়েক দেখেও না দেখার বান করলো ওঁ। মার্জান চায় না গ্রীষ্মকে বোঝাতে কতটা বিচলিত ওকে নিয়ে এ মুহূর্তে। কিন্তু গ্রীষ্মের অনেকক্ষন যাবত হালচাল না দেখে এবার আমতাআমতা করেই উঠে গেলো ওঁ। গ্রীষ্মকে হালকা ডাকলে সাড়া পেলো না। কিছুটা ভয় মিশ্রীত কন্ঠে এবার গায়ে স্পর্শ করে ডাকতে গ্রীষ্ম হেলে নিচে পড়ে যায়। মার্জানের গগনবিদারী এবার কে শোনে?? মার্জান গ্রীষ্মের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলো। গ্রীষ্মের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে গায়ে। এই জন্যই বুঝি হারিয়েছে জ্ঞান? মার্জান এবার গ্রীষ্মকে মাটিতে রেখে সাগর থেকে পানি নিয়ে এলো। গ্রীষ্মের মুখে ছিঁটে দিতেই নড়েচড়ে উঠলো এবার। পিটপিট করে চোখ খুলতেই গ্রীষ্ম অদ্ভুত নয়নে যেন তাকালো। মার্জানের গাল স্পর্শ করেই বলে উঠলো,
” তুলতুল, তুলতুল আমার তুলতুল, কোথায় ছিলে তুমি? কত খুঁজেছি তোমায়? তুমি আমাকে ফেলে কোথায় চলে গেলে? দেখো আজও তোমার অপেক্ষায়।”
মার্জানের এবার বুক কেঁপে উঠলো। তুলতুল? তুলতুল টা আবার কে? গ্রীষ্মের ভালোবাসা? রায়হান কি ওঁর কথাই বলে ছিলো? মার্জানের বুকে ভিতরটা তেতো হয়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো গ্রীষ্ম। এক ঝাটকায় উঠে বসে মুখ চেঁপে ধরলো মার্জানের। এদিক সেদিক মুখ করে দেখে চট করেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। মার্জান কিছু বলা বা করার আগেই গ্রীষ্ম ওই জায়গায় থেকে বের হয়ে সাগরের পাড়ে চলে যেতে লাগলো। মার্জান থম মেরে বসে রইলো। কি হলো মাত্র? এটা কি হয়ে গেলো? গ্রীষ্ম কি তাহলে ওঁর সাথে এতদিন নাটক করলো?? মার্জানের ভাবার মাঝেই স্পিড বোর্ডের শব্দ পেলো। ও নিজেও জলদি বেড়িয়ে সাগর পাড় এসে এবার সব থেতে বড় ধাক্কাটা খেলো। গ্রীষ্মের দল বল ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মার্জার জোরে জোরে ডেকেও লাভ হলো না। ওঁরা অনেক দূর চলে গেছে। মার্জান এবার ওখানেই হাটু মুড়ে বসে কাঁদতে লাগলো হাউ মাউ করে। এদিকে প্রভাত ফুটে উঠছে।চারপাশ নিরবতা ছেয়ে। মার্জানের ভয় করছে ভিষণ রকমের ভয়। এই নির্জন দ্বিপে ও মুধু এঁকা আর এঁকা… মার্জানের নিজেকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, কিন্তু ওঁর ছেলের জন্য বের হতেই হবে এখান থেকে।তা ভেবেই মার্জান এদিক ওদিক ছুটলো কিন্তু কোনো কোল কিনারা না পেয়ে ফোঁপাতে লাগলো। আকাশ পানে তাকিয়ে প্রার্থনা করলো মনে মনে। উধার করতে এই পরিবেশ থেকে।এই পরিস্থিতি থেকে বের হলে একবার, ওঁ আর কখনো গ্রীষ্মের মুখ দেখবে না। ঠিক তখনি আল্লাহ যেন কথা শুনলো ওঁর। একটি স্পীড বোর্ডের শব্দ কানে ভেসে আসতেই ধক করে উঠলো বুক। গ্রীষ্মটি ওঁকে নিতে এসেছে? ভেবেই রাজ্যের খুশি ঠোঁট স্পর্শ করে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো ওঁর মুখ। সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে বিষিয়ে উঠলো ওঁর মন। এমন এক পরিস্থিতিতে তাহলে কি গ্রীষ্ম সত্যি ছেঁড়ে চলে গেলো? ওঁকে! মনে পড়লো না একবারো? একবারো না??????
স্প্রীড বোটটি এসে থামলো এবার মার্জানের সামনে। তায়ানশাহ্ মুচকি হাসলো, কটাক্ষ করে বলল,
” কিহ্ ছেঁড়ে গেলো বুঝি? আমি আগেই জানতাম, ওঁর মতো ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসে না নিজেকে ছাড়া। ”
মার্জান রাগে, দুঃখ, ক্ষোভে জর্জড়িত। এ মুহূর্তে এখান থেকে বের হতে চায় সে। কিন্তু তায়ানশাহ্ কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা দিয়ে যেন বেশ মজা পাচ্ছে। তাই তিক্ত কন্ঠ বলল,
” আমি নিজে কি? মি: গ্রীষ্ম থেকেও আপনি অনেক নিকৃষ্ট। ”
হো হো হো করে হেসে উঠলো তায়ানশাহ্,
” ভাঙ্গবে তবে মচকাবে না? আই লাইক ইট। জানো তোমাকে আমার ভিষন পছন্দ হয়েছে। যেমন আমার গার্ল ফ্রেন্ড ঠিক তেমন তুমি। তোমার বাচ্চা না থাকলে তোমাকেও আমার করে নিতাম। দু’ বান্ধবী এক সাথে। ”
মার্জান ঘৃণিত দৃষ্টিতে চাইলো,
” আপনার মতো মানুষের উডর আমি থুতু ফেলি।”
তায়ানশাহ্ আবার হাসলো,
” হ্যাঁ তাতো মন চাইবেই, তোমার তো আবার ওই আধা পাগল গ্রীষ্মকে পছন্দ। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি জানো গ্রীষ্ম পাগল?”
মার্জানের এবার বিরক্তি লাগলো,
” ফালতু কথা না বলে এখানে কেন এসেছেন তা বলুন?”
তায়ান শাহ্ সিগারেট জ্বালালো। দু’ঠোঁটের মাঝকানে নিয়ে টান দিয়ে ভুরভুর করে ধোয়া ছাড়লো। বলে উঠলো,
” আমি দেখেছি গ্রীষ্মকে যেতে বুঝে গেছে পাগলের আবার এ্যাটাক এসেছে। ফেলে গেছে তোমাকে। আর তুমি তো আমার প্রিয় শীপ্রার জান। তাই ভাবলাম হাল চাল জিজ্ঞেস করে যাই?”
মার্জান ক্ষেপে গেলো,
” দেখেছেন? খুশি এবার?”
তায়ানশাহ্ সপ্তপর্ণে শ্বাস ছাড়লো,
” তুমি চাও, তো তোমার গন্তব্য পৌঁছে দিতে পারি আমি!”
মার্জানের চোখে মুখে আশার ঝলক দেখা গেলো,
” সত্যি? ”
তায়ানশাহ্ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। এবং মার্জানকে তুলে নিলো বোডে। পুরো সময় চুপ থাকলেও ওঁর গন্তব্য পৌঁছায় দিয়ে বলে উঠলো তায়ানশাহ্,
” মনে রেখো, তুমি কিন্তু ঋণি আমার কাছে!”
মার্জান তেমন পাত্তা দিলো না। পারে এসেই ছুটে চললো হসপিটালের দিকে।
——-
দিনক্ষণ কেঁটে গেলো আবারো গ্রীষ্ম হারিয়ে গেলো। সেদিনের পর অনেক দিন কেঁটে গেছে, রাফান এখন সুস্থ। কিন্তু ওঁর শরীরে বিষের প্রবেশের কারণে মৃণালের কোনো হেল্প করতে পারবে না ওঁ। আবারো ডোনার খুঁজে চলছে মার্জান। এসব ভাবতে ভাবতেই
এসে বসলো পার্কে। শীতল বাতাস গা ঘেসে যেতেই। মার্জানের সামনে এসে দাঁড়ালো এলোমেলো চুল আর নোংরা কাপড়ের একটি চিকন মেয়ে। মার্জানের কাছে এসেই হাত পেতে বলে উঠলো,
” আমাকে ভাত কিনে দিবে, খাবো? অনেক দিন খাইনি!”
মার্জানের খুব কষ্ট হলো। মুখ তুলে তাকাতেই কিছুটা চমকে গেলো। মেয়েটির মুখমন্ডল একে বারে ওঁর মতো। মেয়েটি নিজেও চমকে গেলো। মার্জানকে দেখে এক প্রকার ছুটে চলে গেলো। মেয়েটি দৌঁড়াবার সময় ওঁর হাত থেকে কিছু একটা খুলে পড়লো। মার্জান তা তুলতেই বিষ্ময়ে বুঁদ হয়ে দৌঁড়াতে লাগলো মেয়েটির পিছনে। কিন্তু বড় রাস্তার ধারে এসেই হারিয়ে গেলো মেয়েটি। মার্জান তন্নতন্ন করে খুঁজলো। পেলো না। কিন্তু মেয়েটির ফেলে যাওয়া বেসলেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো ওঁ। ওখানে দু’টি অক্ষর আড়াআড়ি ভাবে লাগলো,
” টি, স”
মার্জান ভাবনায় পরে গেলো, কে এই মেয়ে? কেন ওঁকে দেখে পালিয়ে গেলো ওঁ? মেয়েটি অনেকটা ওঁর মতো দেখতে! কোনো কানেকশন আছে কি ওঁদের মাঝে??
চলবে,
নতুন পর্ব পরশু রাত ১০ টার পর দিবো। এখন থেকে আগেই উল্লেখ্য করে দিবো কবে গল্প দিবো। প্রতিটি পর্বের নিচেই।