জোয়ার ভাটা পর্ব -২৪

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#পর্ব-২৪
নিস্তব্ধ পরিবেশ। যেন কোনো ঝড় হবার পূর্বাভাস। মার্জান চোখ বুঝেই এক নিশ্বাসে বলে উঠলো,

” ছ’বছর আছে আমার খালা সুরভি আমাকে বেঁচে দেয়… সেদিন আমার শরীরে নেশার ইঞ্জেকশন পুশ করে আর……….”

এঁকে এঁকে সব ঘটনা বলে মার্জান। ঘন্টা খানেক খন পর…
গ্রীষ্ম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। মার্জান মুখ চেঁপে কাঁদছে।

” আমি… আমি জানি না সে কে ছিলো, তার চেহারাও আমার মনে নেই। কিন্তু আপনাকে দেখার পর আমার মনে থাকা আবছা অবয়ব আপনার সাথে মিলে যায়। অনেক ভেবে চিন্তে করেই এই পদক্ষেপ নিয়েছি আমি।”

গ্রীষ্ম নীজের চুল টেনে দরে বলে উঠলো,

” কিন্তু রিপোর্ট বলছে মৃণাল আমার ছেলে নয়। তবে ওঁ আমার বংশীধর। এটা কিভাবে সম্ভব? কারণ সেদিন আমি ওই হেটেলে ছিলাম। আমি আষাঢ় আর তুলতুল গেছিলাম কক্সবাজার বন্ধুদের নিয়ে । তুলতুলের বার্থ ডে ছিলো। কিন্তু ওখানে এমন কিছু হলো আমি দু’জনকেই হারিয়ে ফেলি। সেদিন বৃষ্টিতে ওঁদের খুঁজেও না পেয়ে হোটেলে ফিরে আসি।এবং প্রচন্ড জ্বরে তপ্ত হয়ে পরি। দু’দিন জ্ঞান ছিলো না আমার। আর আষাঢ়ে ওখানে ছিলোই না। তাহলে ওঁ কিভাবে মৃণালের বাবা হয়? ”

মার্জান মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। গ্রীষ্ম নিচেও মনে মনে পুড়ছে, সত্যি কি আষাঢ়ের সাথে কিছু হয়েছিলো মার্জানের??
নিজের মনের সাথে দরকষাকষি বন্ধ করে দিলো এবার গ্রীষ্ম। নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়ে মার্জানের হাত চেপে ধরে বলে উঠলো,

” চলো আমার সাথে।”

মার্জান আর গ্রীষ্ম এসে হাজির হলো রাফির কেবিনে। সব শুনে বিস্মিত রাফি আবারো চুল নিয়ে টেষ্ট করলো। একই রিপোর্ট আবার আসতেই জিজ্ঞেস করলো গ্রীষ্ম,

” এমনটি কিভাবে হচ্ছে, আষাঢ় তো তখন ছিলো না। ”

রাফি চোখের চশমা খুলে ফেললো। বলে উঠলো,

” তোমরা জমজ যার কারণে এমন হচ্ছে ব্যপার না আমি ব্লাড টেস্ট করাতে দিচ্ছি। দু’ তিন ঘন্টার মাঝেই চলে আসবে রেজাল্ট।”

আবারো শুরু হলো অপেক্ষার পালা। যেন প্রতিটি মুহূর্ত এক একটি বছর পর হবার জোগাড়। ওঁদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে হাসি মুখে উপস্থিত হলো রাফি। বলে উঠলো,

” কংগ্রাচুলেশন। মৃণাল তোমার সন্তান। ”

গ্রীষ্ম থম মেরে আবারো চেয়ারে বসে পড়লো। মৃণাল ওঁর দেহের একটি অংশ ভেবেই প্রফুল্ল হয়ে গেলো ওঁর মন। মার্জান নিজেও চোখের জল ছেঁড়ে দিলো। সত্যি? সত্যি গ্রীষ্মই ছিলো ওই ব্যক্তি?

————–

সোনালী রোদের কনা এসে পড়ছে মৃণালের চোখে মুখে। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকায় ফ্যাকাসে মুখটা আরো বিষন্ন দেখাচ্ছে। দূরে থাকা বাচ্চাদের দেখছে ওঁ। হসপিটালের পিছনের সাইডে বিশাল খেলার মাঠ। হসপিটালের বাচ্চাদের এখানেই আনা হয় খেলার জন্য। কিন্তু মৃণাল দুলনায় ম্লান হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই একটি ছেলের সাথে ওঁর খুব ঝগড়া লাগে। কারণ ছেলেটি মার্জানকে খারাপ কথা বলেছে বলে। আর মৃণাল ওঁর মমি সম্পর্কে একদম খারাপ কথা শুনতে চায় না। তাই এক ঘুশি মারে ছেলেটিকে। কিন্তু বেয়াদব ছেলেটি ওঁর মাকে এনে মৃণালকে বকা খাওয়ায়। মহিলাটি আমাদের বাচ্চা মৃণালকে বলে উঠে,

” তোমার তো বাবাই নেই। মা আর কত শিক্ষা দিবে? যে মা বিয়ের আগেই বাচ্চা পয়দা করে নেয়? তার ছেলে আর কতই ভালো হবে, বুঝলে ছেলে এই জন্য তোমার বাবা নেই। কারন তোমার মায়ের চরিত্রই তো ঠিক নেই।”

মৃণাল তখন থেকে রাগে ফুঁসছে। মার্জান মৃণালকে দূর থেকে গুমরো মুখে বসে থাকতে দেখে কাছে গেলো। মৃণালের মাথায় হাত রাখতেই মৃণাল ওঁর লাল লাল চোখ জোড়া নিয়ে তাকাতেি মার্জান আতঙ্কে উঠলো,

” বাচ্চা কি হয়েছে তোমার?”

মৃণাল এবার আর কান্না ধরে রাখতে পারলো না। যতই হোক বাচ্চা ছেলেই তো। মৃণাল হেঁচকি তুলে কেঁদে বলে উঠলো,

” মমি আমার পাপা নেই কেন? আমি কি এত দুষ্ট? তাই পাপা ছেড়ে গেছে?”

মার্জানের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো,

” এসব উল্টো পাল্টে কথা কে বললো তোমাকে?”

মৃণাল জবাব দিলো না। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। কিছুক্ষণ পর একটি শীতল হাত মৃণালের মাথায় স্পর্শ করতেই মৃণাল মাথা তুলে ব্যক্তিটির দিকে তাকালো। গ্রীষ্মকে দেখে এক চিলতে হাসি ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠেও হারিয়ে গেলো। গ্রীষ্ম এবার মৃণালকে কোলে তুলে নিয়ে বলে উঠলো,

” কে বলেছে তোমার পাপা নেই, আমি তোমার পাপা। ”

মৃণাল বড় বড় চোখ করে চাইলো গ্রীষ্মের দিকে। এরপর কথাটা সত্যি না মিথ্যা বুঝতে চাইলো মার্জানের দিকে। মার্জান তখন চোখের ইশরায় হ্যাঁ জানালো। সম্মতি পেতে ঝাপটে ধরে বলে উঠলো,

” পাপা আমার পাপা। তোমরা দেখে আমার পাপা আছে। দেখো সবাই।”

মৃণালের এমন পাগলামি দেখে হাসলো গ্রীষ্ম আর মার্জান। কিন্তু পরক্ষণেই মৃণাল গ্রীষ্মের কোল থেকে নেমে ছুটে গেলো ওই ছেলেটির দিকে। কাছে গিয়ে চেঁচালো,

” পঁচা ছেলে, ওই দেখো আমার পাপা। বুঝলে আমার পাপা আছে। আর মা ও যে কখনো পঁচা কথা বলে না। তুমি পঁচা আর তোমার মা পঁচা বুঝলে।”

ছেলেটি ভ্যা করে কেঁদে দিলো। মৃণাল ভ্যাবচেকা খেয়ে গেলো। দূর থেকে হায় হায় করতে করতে ছুটে এলেন ওই ছেলের মা। বলে উঠলেন,

” না জায়েজ ছেলে? কেন কাঁদাচ্ছো আমার ছেলেকে?”

বলেই মৃণালের গায়ে হাত তুলতে নিলো মহিলা। তখনি গ্রীষ্ম এক ধমক দিলো। মহিলা প্রায় কেঁপে কেঁপে উঠলো। বলে উঠলো,

” আপনি কে? এভাবে ধমকাচ্ছেন কেনো?”

গ্রীষ্ম মৃণালকে আবারো কোলে তুলে নিলো। গর্বের সহিত বলল,

” আমার ছেলে। খবরদার উল্টো পাল্টে কথা বলবেন তো!”

মহিলা শুকনো ঢুক গিললো। পিছন থেকে মহিলাম জামাই গ্রীষ্মকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। কাছে এসেই হাত জোর করে বলে উঠলো,

” সরি, সরি স্যার আমার ওয়াইফ যা করেছে তার জন্য।”

গ্রীষ্ম লোকটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। লোকটি আজ ১ মাস যাবৎ গ্রীষ্মের সাথে মিটিং করতে চাইছে। কিন্তু চান্স পাচ্ছে না। এবার আর পাবে তো? গ্রীষ্ম লোকটির উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

” তোমার কোম্পানীকে আমার ইন্ডাস্ট্রিজ ব্লেক লিষ্ট করলো। আগে নিজে ঘর সামলাও এর পর বিজনেস। ”

লোকটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মহিলাকে ইচ্ছে মতো কথা শোনাতে লাগলো। আসলে মার্জানকে হিংসে করে মহিলাটি। ওঁর হাজবেন্ড ওঁর সাথে মার্জানের তুলনা করে বলে। রূপে গুনে নাকি মার্জান ওঁর থেকে বেশি। মহিলাটি এবার রাগ দেখিয়ে ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো। মৃণাল খুশি হয়ে আবারো গ্রীষ্মের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,

” পাপা আমার পাপা।”

মৃণালের তৃপ্তির হাসি দেখে মার্জান আজ নিজেও খুব খুশি। গ্রীষ্ম এবার মার্জানের উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

” মৃণাল এখন থেকে আমার বাসায় থাকবে সঙ্গে তুমিও। এবং ওঁর সকল ট্রিট মেন্ট আমার বাড়িতেই হবে।”

মার্জান আর মানা করলো না। মৃণালের হাসি মাখা মুখ দেখে রাজি হয়ে গেলো।

—————————

মার্জান গ্রীষ্মের বাড়িতে ওকে দিয়া ঘরে নিজের সব গোছাতে লাগলো। বিগত দিনের হয়ে যাওয়া সব ঘটনা ভুলে গুন গুন করে গান গাইতে লাগলো। তখনি দরজায় কড়া নাড়লো গ্রীষ্মের মা অনিতা। মার্জান পিছনে পিরে অনাকে দেখেই লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

” আন্টি আসুন না ভিতরে!”

অনিতা হাসি মুখে ঘরে ঢুকলো। মার্জানে দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” মা তোমাকে শুরু থেকে আমার পছন্দ। কিন্তু তুমি যে আমাদের এত বড় খুশি দিবে! তা জানা ছিলো না।তবে আমি চাই তোমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করে নাও।”

মার্জান খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। অনিতা বুজতে পেরে ওঁর হাতের উপর হাত রেখে বিষন্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

” আমি চাই না ওঁর অতীত ভবিষ্যত নষ্ট করুক। আমি চাই তোমাদের খুব জলদি বিয়ে হোক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ ওঁর দাদি জানতে পাড়লে তা কখনো হতে দিবে। ”

বলেই মার্জানের গালে স্পর্শ করে বলে উঠলো,
” তুমি আমার মেয়ের মত। মা কখনো মেয়ের খারাপ চায় না। ”

মার্জান তখন মাথা নত করে। আসলে ওঁ এই বিষয়ে ভাবেইনি কখনো। কিন্তু ওঁর মনের মাঝে এক অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো বিয়ের কথা শুনে। আচ্ছা গ্রীষ্মকে কি ওঁ বলে দিবে ওঁর মনের কথা?? কিন্তু ওঁর অতীত?ওঁর অতীতে কি হয়েছিলো??

মার্জান এবার মাথা তুলে জিগ্যেস করলো,
” আন্টি আমি কি গ্রীষ্মের অতীত জানতে পারি?”

অনিতা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। পুড়োনো স্মৃতি ভেসে উঠলো চোখের পাতায় বলে উঠলো,

” গ্রীষ্ম, আষাঢ় ওঁরা আমার জমজ ছেলে। কিন্তু…..

চলবে,
পর্ববর্তী পর্ব আপনাদের রেসপন্সের উপর ডিপেন্ড করে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here