ঝরা ফুলের বাসর পর্ব ৬

#ঝরা_ফুলের_বাসর_০৩
#পার্ট_০৬
#Mst_Liza

সকালে হৃদকে খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত সবাই।আমি যে রাতে হোস্টেলে চলে এসেছি সেই খোঁজটুকু নেওয়ার সময়টাও কারও নেই।হৃদ খেতে পারছে না তবুও ঠেসে ঠেসে খাওয়াচ্ছে ওকে।মনে হচ্ছে যেন জনম ভুখী।কত্ত যুগ খাই না কিছু।

-আহারে মুখটা শুকিয়ে গেছে বিদেশে থেকে না খেয়ে ছেলেটার। আরও খা বাবা আরও খা।আজ সব তোর খেতে হবে।তোর পছন্দের আইটেমগুলো বেছে বেছে রান্না করেছি।

খালি প্লেট সামনে নিয়ে গালে হাত দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাবারের দিকে নূর আপু।মাম্মাম, কাকিমা হৃদকে নিয়ে ব্যস্ত।হৃদের সামনে আসলে নূর আপু কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে।নিরবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেরি হচ্ছে বুঝতে পেরে হসপিটালে চলে আসে আপু।

এদিকে সারা রাত জেগে থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি আমি।আড়মোড়া ছেড়ে উঠে বসে সময়টা দেখে ছুটলাম ওয়াশরুমে।মিনি, প্রিয়া, নিশি কেউ নেই হোস্টেলে।৩০২ নাম্বার শিশু ওয়ার্ডে মেঘ স্যারের এ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে ডিউটি ছিলো আমার।বাচ্চাগুলো যা দুষ্টু।সকাল থেকে কি কি খেলেছে কে জানে! প্রতিদিন ওদের জন্যই আমার বকা খেতে হয়।হায় আল্লাহ এখন সাড়ে এগারোটা।এগারোটা চল্লিশ পর্যন্ত তো মেঘ স্যারের ক্লাস।এরপরই আপু আসবে।আমাকে ক্লাসে না পেলেই তেরোটা বাজিয়ে দেবে।

কাল রাতে কি হয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই আমার।আমি প্রাণ পণ ছুটে চলেছি।হোস্টেল থেকে বের হয়ে ইজিবাইকে উঠে পাঁচ মিনিটে হসপিটালে পৌঁছে গেলাম।ক্লাস রুমে এসেই তারাহুরো করে ঢুকে পরলাম ভেতরে।থরবর করে পিছনের বেঞ্চটায় গিয়ে ব্যাগ ঠেলে এক ধাক্কায় নিশি, প্রিয়া, মিনি কে সরিয়ে বসে পরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। হুট করে সামনে শব্দ পেয়ে লাফিয়ে দাড়িয়ে উঠে দেখলাম মেঘ স্যার ডাস্টার দিয়ে আমার মুখের সামনের হাই বেঞ্চে জোরে আঘাত করছে আর শব্দ হচ্ছে। আমি ছরি স্যার ভুল হইছে বলে এক দৌড়ে ক্লাস রুমের বাইরে গিয়ে দাড়িয়ে বললাম,

-মে আই কাম ইন স্যার।

ক্লাসে উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো।অমনি ঘন্টা বেজে উঠলো।স্যারও কিছু বললো না।বিরক্তিকর মুখ নিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।মেঘ স্যার ক্লাস রুম থেকে বের হতেই একটা আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট এনে ছুড়ে মারলো আপু উনার মুখের উপর। উনি রেগে আপুর গালে চড় মারতে যাবে উনার বাবা মানে এই হসপিটালের এমডি এসেই উনার হাতটা ধরে বসলেন।রিপোর্টটা উঠিয়ে আপু উনার বুকের সাথে ঠেসে ধরে রাগি দৃস্টি তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,

-কোন অধিকারে তুই আমার প্রেশেন্টের সার্জারি করেছিস কাল রাতে? আমি ছুটিতে ছিলাম।অপারেশন আজ এসে করতাম।এই হসপিটালে এতোগুলো সার্জারি ডাক্তার থাকতে কারও সাহশ হয়নি যেখানে সেখানে তুই কোন সাহশে আমার প্রেশেন্টের অপারেশন করেছিস মেঘ?

-ওহহ এইজন্য? এটাতো তোর বোঝা উচিৎ ছিলো।কতোটা কেয়ারলেস হলে মানুষ এমন একটা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকা প্রেশেন্টকে রেখে পার্টিতে যাওয়ার জন্য ছুটি কাটায়।তুই কেমন ডাক্তার?

-ভদ্রভাবে কথা বল মেঘ।ভুলে যাস না এখানে আমি তোর সিনিয়র।

-তো সিনিয়র হয়েছিস কি হয়েছে।একটা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিস? কাল আমি অপারেশনটা না করলে তোর প্রেশেন্টটা মারা যেতো।

-ওহহ তাই? অপারেশন করার সময় তোর হাতের আংটি প্রেশেন্টের পেটের ভেতরে ফেলে এসেছিস।আমাকে ফাঁসাবি বলে? এতোটা কেয়ারলেস অপারেশন আর আমাকে কথা শুনাস।প্রেশেন্টের বাড়ির লোক কেস করলে আমার ডাক্তারির ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে।আমার এতোদিনের সব পরিশ্রম, সাধনা, ডাক্তারি লাইসেন্স সব আজ তোর জন্য হারাতে চলেছে।সাথে জেলও।কেন করলি এমনটা মেঘ?

-হোয়াট? কিসব বলছিস?

-বুঝতে পারছিস না? এই রিপোর্টটা দেখ।

আপু স্যারের হাতে রিপোর্টটা ধরিয়ে দিলো।রিপোর্টটা দেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন উনি,

-অসম্ভব! আমি নিজে অপারেশনের আগে হাতের ঘড়ি, আংটি সব খুলে রেখে ও.টি তে গেছিলাম।

স্যার উনার বাবাকে বললেন।উনার বাবা একটা চড় বসিয়ে দিলেন উনার গালে।উনি গালে হাত দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উনার বাবার দিকে।উনার বাবা চিৎকার করে বললেন,

-ছেলে বলে তোমার এতো বড় অন্যায় আমি ক্ষমা করতে পারবো না।অপরাধ যখন করেছো শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।আমার হসপিটালের গায়ে দাগ আমি লাগতে দেবো না।প্রেশেন্ট কেস করার আগেই তোমার নামে আমি কেস করবো।লোকে জানুক এই আবির চৌধুরীর হসপিটাল কতো পবিত্র।এখানে অপরাধ করা একটা ডাক্তারও রেহায় পাই না।সে ছেলেই কেন না হোক।

আপুকে বললেন পুলিশে ফোন দিতে।একজন ডাক্তার বললো আরেকটাবার ভেবে দেখতে কিন্তু আবির চৌধুরী শুনলেনই না।আপুও রেগে পুলিশকে ফোন করে বসলো।পাশ থেকে কিছু ডাক্তার বলল ডা.মেঘকে পুলিশে দিলে উনি ডাক্তারির লাইসেন্স হারাবে।উনার মতো এতো ভালো ডাক্তার কোথায় পাবো আমরা? তাছাড়াও উনার প্রেশেন্টগুলোকে কে দেখবে? এতো তাড়াতাড়ি অন্য ডাক্তারও তো পাওয়া যাবে না নিয়োগ ছাড়া।

আপু সবাইকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বললেন মেঘের থেকে ভালো ডাক্তার আমার বাড়িতেই আছে।তেমন যদি হয় মেঘের প্রেশেন্টদের কথা বিবেচনায় এনে তাকে রাখা হবে হসপিটালে।আবির চৌধুরীর কাছে আপু জিজ্ঞাসা করলেন,

-স্যার আপনি চাইলে আমি তাকে আসতে বলতে পারি।

আবির চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে শুকনো মুখে চলে যায় সেখান থেকে।মেঘ স্যার লজ্জায়, অপমানে নিজের মাথাটা নিচু করে নেয়। কিছুক্ষণ পর ভীর ঠেলে পুলিশ এসেও তাকে এ্যারেস্ট করে কলারটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর হৃদ আসে হসপিটালে।আপু পুরো হসপিটালে হৃদকে পরিচয় করিয়ে দেয়।সে এখানের নতুন ডাক্তার আর মেঘ স্যারের পোস্টটা তাকে দেওয়া হবে।আবির চৌধুরী সবার সামনে থেকে সেই যে গেলো আর নিজের কেবিন থেকে বের হলো না।বুঝতে পারছি মুখে না বললেও ছেলের জন্য তার কস্ট হচ্ছে তাই হয়তো নিজেকে একা রাখতে চাইছে।

কিছুক্ষণ পর হসপিটালের মধ্যে এক চিপায় দাড়িয়ে এক বান্ডিল টাকা হৃদ একজন নার্সের হাতে তুলে দেয়।এই দৃশ্য দূর থেকে দেখে আমি এগিয়ে এসে তাদের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।এই নার্সটা হৃদের থেকে টাকা খেয়ে মেঘ স্যারের আংটিটা সার্জারির সময় প্রেশেন্টের পেটে ফেলেছিলো। কিন্তু কেন? আরও শোনার চেস্টা করলাম তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে।হৃদ এবার বলল,

-একটা মেয়েকে অপমান করতে চাই আমি।এতোটা অপমান করতে চাই যেন লজ্জা, ঘৃণা আর অপমান বোধে হয় নিজেকে শেষ করে দেবে।না হয় তার প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে যাবে।এতোটা দূরে যাবে যেন তার মুখটা আমার আর কখনো দেখতে না হয়। আর তারজন্য এই হসপিটালে জয়েন হবার আমার খুব প্রয়োজন ছিলো।

নার্সটা বলল,

-এজন্য ডাক্তার মেঘকে ফাঁসিয়ে তার পদটা নিয়ে নিলেন।বাহ দারুন আইডিয়া ছিলো স্যার।দোয়া করি যেন আপনার উদ্দেশ্য সফল হয়।আর আমার বাকি টাকাটা?

-হবে হবে এখন ক্যাশ নেয় কাছে।সন্ধ্যার পর দিবো।

-আচ্ছা। আবার কোনো প্রয়োজনে লাগলে বলবেন কিন্তু স্যার।টাকার জন্য আমি সব করতে পারি।

কথাগুলো শুনে হৃদের প্রতি আরও ঘৃণা বাড়ছে আমার।ছিঃ এতোটা নিচ হৃদ? ওর জন্য একজন নিঃদোষ মানুষ শাস্তি পাবে? নাহ এ হতে দেওয়া যাবে না।আমাকে যেভাবেই হোক প্রমাণ যোগার করে স্যারকে ছাড়াতে হবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here