###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
#পর্ব_৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সকাল বেলা উঠে বেলী সব নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে । আজ ইরফানের জন্যে একটি বিশেষ দিন । প্রেজেন্টেশন টা সবার পছন্দ হলেই এই প্রজেক্ট অনুযায়ী তাদের কাজ হবে । এর সাথে ইরফানেরও প্রমোশনটা হয়ে যাবে । সব কিছু মাথায় রেখেই আজ বেলীর আয়োজন । ইরফান লাচ্ছা সেমাইটা খুব পছন্দ করে তাও ডুবো দুধে । আর বেলী সেমাইটা দারুণ বানায় । তাই আজ সেমাইও বানিয়েছে । আজ মনে হচ্ছে ইরফানের থেকে বেলীর উদ্বিগ্নতা বেশি ।
রুমে ইরফান রেডি হচ্ছে । ফরমাল পরে পাক্কা সাহেব সাহেব লাগছে তাকে । সাদা শার্ট সাথে নেভিব্লু ব্লেজার । সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগছিল ইরফানকে ।
সব গুছিয়ে নিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বের হয় ইরফান । নাস্তা করতে টেবিলে এসে দেখে এলাহী কারবার । ইরফান যা যা ভালোবাসে সব বানিয়েছে বেলী । ইরফান এইসব দেখছে আর ভাবছে ,
– এক রুবি , যে কিনা একটা থাপ্পড় দেয়াতে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে । খোঁজ খবর তো নেয়-ই না , আসারও নাম নেই । আর এক এই মেয়েটা , শত অবহেলা , শত মা’র খেয়েও আমার কথা ভেবে যায় নির্দ্বিধায় । আমার কি প্রয়োজন , কিসে আমি ভালো থাকি সবটাই তার জানা । আর এই মেয়েটাকে গ্রাম্য , অশিক্ষিত , গরীব মানুষ ভেবে কত অপমান , কত মারধর করেছি আমি । কতটা নির্বোধ হলে এইসব করতে পারলাম । এমনকি জিদ করে আরেকটা বিয়েও করে ফেললাম । ওর বয়সটাই বা কতটুকু ছিল , যার এখন প্রতিটা মুহুর্ত হাসার কথা তার মুখ থেকে হাসি নামক জিনিসটা কেড়ে নিয়ে নিলাম আমি । আর সে নিরবে চুপ করে থাকে । সত্যিই হাজারো মেয়ে রুবি হতে পারে , কিন্তু একজন মেয়ে বেলী হতে হাজারবার জন্ম নিতে হয় হয়তো হবে ।
ইরফান এর ভাবনায় ছেদ পরে মিনু ডাকে ,
– ও ভাই , ভাই ???
-……..
– ভাই , ও ভাই,,,,,,,,???
– হু,,,,,,, হু
– দাড়াইয়া আছেন যে ভাই , বসেন । নাস্তা কইরা লন ।
– এত নাস্তা বেলী বানিয়েছে ?
– হ ভাই ,
– এত কিছু কিভাবে খাবো ?
– সব কিছুর থিকা একটু একটু কইরা খাইয়া নেন , আর সেমাইডাও খাইয়েন ডুবা দুধে বানাইছে ভাবী । সেই সকাল থিকা সব বানাইছে ভাবী ।
– বেলী কোথায় ?
– ভাবী আইতাছে , আপনে খাইয়া নেন ।
ইরফান ভেবেছিল বেলী অন্তত এখন তার সামনে থাকবে । কিন্তু বেলী রুমে বসে আছে । বিষয়টা ইরফানের কাছে খটকা লাগছিল , কিন্তু হাতে সময়ও নেই তার । তাই নাস্তা খেতে বসে যায় সে । প্রত্যেকটা আইটেম থেকে কিছু কিছু খেয়ে নেয় সে । তবুও তৃপ্তি পাচ্ছে না সে , হয়তো তৃপ্তিটা বেলীর আগমনেই ঘুচে যেতো । আজ বেলীকে একটু ট্রাই করবে সে । সেমাইটা খেয়ে পানি খেয়ে ঘড়িতে টাইম দেখে নেয় ইরফান । গাড়ি আসতে এখনও ১০ মিনিট বাকি । ইরফান উঠে বেলীর রুমে যায় ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে বেলী বিছানায় ওপাশ ফিরে বসে কি যেনো করতেছে ।
– বেলী,,,,,,,,,,,?
ইরফানের মুখ থেকে নিজের নামটা শুনে চমকে যায় সে । কেঁপে ওঠে সে , বেলী এমনিতেও একটু ভীতু , আচমকা কেউ এসে ভাউ করলেও সে লাফিয়ে উঠে । গরীব ঘরের আদরের রাজকুমারী ছিল সে আর আজ সে স্বামীর ঘরের কাজের মেয়ে হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে পিছনে ফিরে দাঁড়ায় বেলী ।
ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । ওড়না দিয়ে সুন্দর করে দুই পেচ দিয়ে ঘোমটা দেয়া তার মাথায় । এইভাবে বেলীকে খুব সুন্দর লাগে । আবার ওড়না ছাড়াও ভালো লাগে দেখতে । হাত দুটো দিয়ে জামাটা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে সে । ইরফান ধীর পায়ে বেলীর সামনে এসে দাঁড়ায় ।
– কিছু বলবেন ?
– হু , নাস্তার টেবিলে গেলি না যে ?
– মিনু তো ছিল , আসলে আমি একটু কাজ করতেছিলাম ।
– টাই টা ঠিক করে বেঁধে দে ।
ইরফানের এমন কথায় হতভম্ভ হয়ে যায় বেলী । হঠাৎ টাই বাঁধার কথা বললো তাও আবার আজকেই । কিন্তু আজকেই তো,,,,,,,
– কিরে বেঁধে দে ,
– বাঁধা আছে তো ,
– ঠিক করে দে টাই টা ।
বেলীর প্রচন্ড ভয় লাগছিল । এখন হাত উপরে উঠাবে কিভাবে সে । উঠালেই তো ইরফান দেখে ফেলবে । আর দেখার পর যদি প্রশ্ন করে তখন কি হবে ? এরই মাঝে আবারও ইরফানের তাড়া ,
– কিরে , একটু পরে গাড়ি চলে আসবে , বেঁধে দে ঠিক করে ।
– ঠিকই তো আছে ,
– টাইতে হাত দিয়ে ঠিক করে দে বেলী ।
অগত্যা হাত টা কাঁপতে কাঁপতে ইরফানের বুকের কাছে আনে বেলী । আর তখনই ইরফানের চোখে অন্য কিছু পড়ে । বেলীর ডান হাতের অনামিকা আঙুলে পুরো ব্যান্ডেজ করা । হাতের দিকে তাকিয়ে আবার সে বেলীর মুখের দিকে তাকায় । ইরফান । সে জানতো বেলীর কিছু একটা হয়েছে যার কারণে বেলী নাস্তার টেবিলের কাছে ছিল না । বেলীর মুখটা একদম শুকনো হয়ে আছে । ইরফান অনেকটা শান্ত গলাতেই বেলীকে প্রশ্ন করে ,
– কিভাবে কাটলি ?
-…………
– কিরে , বল কিভাবে কাটলি ?
– গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না ।
– এইটা উত্তর ?
– টাই ঠিক আছে এখন ?
– গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না কথাটার জবাব রাতে পাবি , আসতেছি ।
ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলীর মনে ভয় ঢুকে যায় । হয়তো রাতে এসে আবারও মারবে বেলীকে ইরফান । এমনটাই ধারনা তার । তবে আপাতত সব কিছু ভুলে গিয়ে আজকে ইরফানের জন্যে মন থেকে দোয়া পড়ছে বেলী । অসুস্থতার কারণে নামাজ পড়তে পারছে না সে । তাই মনে মনে দোয়া পড়ে বেলী । বেলীর একটাই চাওয়া ।
– ‘ হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকিল ‘
হে আল্লাহ পাক আপনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং আপনিই উত্তম সাহায্যকারী । আল্লাহ পাক আজ যেনো মানুষটা সফল হতে পারে । তাকে আপনি সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষান করুন এবং তাকে সফলতা দান করুন ।
ঠিক সেই মুহুর্তে মিনু দরজার সামনে থেকে বলে উঠে ,
– মরইন্না দোয়া আছে নি ?
কথাটা শুনে চমকে যায় বেলী । অবাক নজরে মিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে সে । হঠাৎ মরার কথা কেন বললো সে ।
– এইসব কি বলো মিনু ?
– না মানে কইছিলাম , মরার আগের দোয়া থাকলে পইড়া লন , কওন যায় না কোন সময় না সময় মাইরা লায় আপনেরে ।
– এইভাবে কেন বলতেছো মিনু ? উনি আমার গায়ে হাত তুলে তা ঠিক তবে আমাকে একেবারে মেরে ফেলবেন না তিনি ।
– হ , হাচাই তো । আরে ভাবী এইসব আপনের মত আলাভোলারাই কয় গো ভাবী । ভাইয়ে জানি কেমন হইয়া গেছে , চুপচাপ । নিশ্চয়ই মাতায় পেলেন করতাছে আপনেরে কিভাবে মারন যায় ।
সি আই ডি ‘ র মইদ্যে এই সব দেহায় ।
– তুমি আর এইসব দেখবা না । এইসব দেখে আর উলটাপালটা চিন্তাভাবনা মাথায় আনে ।
– হ হ , হের সোয়ামীরে লইয়া কিছু কওন যায় না এক্কেরে । এত ভালাবাসা ঠিক না , এই কইলাম আমি । এত ফিডায় তহন কই থাহে ভালাবাসা ।
– রান্নাঘরে যাও আমি আসতেছি ।
– হুহ উচিত কথা কইলেই আমি ভালা না , কি আর করনের আছে আমার । আমি তো ভালা না ভালা লইয়াই থাহেন ।
মিনুর এমন পাকা পাকা কথায় এক গাল হেসে দেয় বেলী । তারপর নিজের রুম গুছিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে যায় বেলী । কিন্তু মনটা উদ্বিগ্নতায় ভরপুর । স্বয়ং আল্লাহ পাকই জানেন অফিসে কি হচ্ছে এখন ।
অন্যদিকে ,
রুবিকে তার বাবা এবং মা উভয়েই বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত । তারা যতই বোঝাচ্ছে সে কিছুতেই মানছে না । জাফর সাহেব সর্বপ্রকার মেয়েকে বুঝিয়েও কোন দিক করতে পারছেন না ।
– তুমি কি চাইছো রুবি , তোমার সংসার টা ভেঙে যাক ?
– বাবা সে আমাকে চড় মেরেছে ।
– মেরেছে তো কি হয়েছে , তোমার প্রোভোকেশনেই তো বেলীকে মারে ইরফান , তা তুমি না হয় একটা চড় খেলেই । তাতে সমস্যা কি ?
– বাবা,,,,,,,,,,?
– স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার বাসায় বসে আছো । তো বেলী কি সুযোগ পাবে না এই সুযোগে ইরফানকে হাত করার ।
– কখনোই না , ইরফান তো বেলীকে ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই করে না ।
তখনই রুবির মা বলে ওঠে ,
– বার বার মানা করছিলাম বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করিস না করিস না , শুনছোস আমার কথা ? এখন সতীন নিয়ে সংসার করস ।
– ওহহহ মা , থামবা ।
– আমি বললেই থামবা , আরেক মেয়ের ঘর নষ্ট করছিস , আল্লাহ তোর সাথে কি করে দেখ এখন ।
– বাবা দেখলা মা কিভাবে বললো ?
– ভুল কিছু বলে নাই তোমার মা । কাল সকালে চলে যাবা ইরফানের কাছে ।
– আমি যাবো না , যতক্ষন না ও আমার পা ধরে ক্ষমা না চায় ততক্ষণ অবদি আমি কোথাও যাবো না ।
– তাহলে বাপের বাড়িতে বসে থাক সারাজীবন ।
মায়ের এমন কথায় রুবি জেদ দেখিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয় ।
– এই মেয়ের যে কি হবে , আল্লাহ পাকই ভালো জানেন ।
– মেয়ের শিক্ষায় ঘাটতি আছে তাই মেয়ে এমন হয়েছে ।
– আমাকে কথা শুনাচ্ছো নাকি তুমি ?
– তুমি মেয়ের মা , তুমি বর্তমান থাকাকালীন সময়ে সে কিভাবে বিবাহিত ছেলের পাল্লায় পড়ে ?
– বিবাহিত ছেলে কি ধোয়া তুলসীপাতা ? যে মেয়ে ইশারা করলো আর ছেলেও গলে গেলো ?
– অবশ্যই গলে যাবে । একটা মেয়ে ইশারা করবে আর ছেলে কি বসে থাকবে । তোমার মেয়ে জানতো না ওই ছেলের বউ আছে ।
– তোমাকে যখন বলেছিল , তখন নিজে চুপ ছিলা কেন ? এখন আমার দোষ দাও কেন ?
– দোষ ছেলেরও দোষ মেয়েরও মাঝে থেকে ওই গরীম এতিম মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে । দেখবা অভিশাপ লাগবে আমাদের৷, ওই মেয়ের অভিশাপ ।
– ওই মেয়েও কম যায় না । চলে গেলেই তো পারে ?
– তুমি মা হয়ে কিভাবে বলো এইসব কথা , তা তোমার মেয়েও তো চলে আসতে পারে ? নিজের কাছে রেখে মেয়েকে বানিয়েছো আল্ট্রামর্ডান । দুই হাতে টাকা উড়ানো , বন্ধু বান্ধবী নিয়ে আমোদ ফূর্তক করা এইসব শিখিয়েছো , এখন মেয়ে এইসব ছাড়তে পারে না ।
– দেখো রুবির বাবা , আমি কোন বলে দেই নাই যে বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করতে আর তাকেই বিয়ে করতে । অতএব আমাকে বলবা না এইসব । আমি কিটি পার্টিতে যাবো আজকে ।
– ওই তো , এইসব পার্টি পুর্টি করেই জীবন পার করলা আর মেয়েকেও বানিয়েছো তেমন ।
রুবির বাবা মায়ের মাঝে রুবিকে নিয়ে তর্ক লেগে যায় । আর তার একপর্যায়ে রুবির মা চলে যায় রুমে আর রুবির বাবা বাসা থেকেই বেরিয়ে যায় ।
[ বিঃদ্রঃ একজন মা-ই কিন্তু পারেন তার সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে । কারণ বাবারা সব সময় কাছে থাকেন । এখনকার যুগে কিছু কিছু মায়েরা আছেন যারা সন্তানকে এত বেশিই আহ্লাদি করে লালন পালন করেন যারা পরবর্তীতে এমন এক একটা রুবি তৈরি হয় । আবার কিছু কিছু সন্তান আছে হাজারো শাসনের মধ্যে থেকেও জানোয়ার তৈরি হয় , যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আবরার হত্যার খুনিরা । কারো বাবা ভ্যানচালক কারো বাবা অনেক কষ্টে ছেলে মেয়েকে মানুষ করছেন , তারা কিনা অন্য মায়ের কোল খালিই করে দিল সারাজীবনের জন্যে । আবার কারো বাসাতে নাকি টিভিই নাই যাতে করে নাকি সে ভিক্টিমের খবরই দেখেন নাই , তার সন্তান বুলেটে পড়ে । কিছু কিছু বাবা মায়ের প্রশ্রয়ে সন্তান উচ্ছন্নে যায় আবার কিছু কিছু পারিশ্রমিক বাবা মায়ের সন্তানও উচ্ছন্নে চলে যায় । আর কিছু কিছু মেয়ে হয় যারা জন্ম থেকেই একরোখা ছাড়পোকা যারা এক একটা রুবি তৈরি হয় ]
রাত প্রায় ৯ টা বাজছে ঘড়িতে । কিন্তু আজ ইরফান এখনও আসে নাই । অন্যান্য দিন তো ৮ টার পর পরই চলে আসে । তাহলে আজ এত দেরি কেন ? বেলীর চিন্তা বেড়েই যাচ্ছে । এই যাবত প্রায় ১৫ বার বারান্দায় গেছে বেলী । দেখার জন্যে ইরফান আসে কিনা । মিনু তখন টিভিতে সিরিয়াল দেখছে । বার বার বেলীর বারান্দায় যাওয়া দেখে মিনুও বিরক্ত হয়ে যায় ।
– ভাবী কি অইছে আপনের ? এমন করতেছেন কিল্লাই ?
– এই মিনু দেখো ৯ টা ৫ বেজে গেছে , আজকে এখনও আসে নাই যে মানুষটা ?
– হায়রে আল্লাহ , এই বেডির শরম লইজ্জা কিছুই নাই । বেলাজা মাতারি এইদিকে আইয়েন , আর বইয়া বইয়া নাটক দেহেন আইয়েন ।
– কি বলো এইসব তুমি মিনু ?
– ভাবী ভাইয়ে দেহেন গিয়া হেই শয়তানির বাসায় গেছে গা । এখন শয়তানি হেইডার মা শয়তানি মিল্লা ভাইয়েরে ফাম দিবো আর ভাইয়েও ফাম নিবো । দেইক্ষেন আমার কতাই মিলবে ।
– কিযে বলো না তুমি আজকাল মিনু আর শুনো মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত তাদের শয়তান বলতে হয় না ।
– ভাবী হুনেন , সেই আশরাফুল মাখলুকাত যদি শয়তানের মত কাম করে তারে শয়তান কা আরও কত্ত কিছু কওন যায় । ওহন নাটক চাইতাছি কতা কইয়ে না ।
মিনু নাটক দেখায় মন দিচ্ছে । আর অন্যদিকে বেলীর মনে ভয় আরও গাঢ় হচ্ছে । এরই মাঝে হঠাৎ করেই ডোরবেল বেজে ওঠে । বেলীই যায় দৌড়ে । তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয় সে । ইরফান দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে । ইরফানকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেলী । তবে মানুষটাকে বড্ড বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো ।
– আসছেন আপনি , এত দেরি হলো যে ?
– আগে এক মগ কফি বানা , আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি । মাথা প্রচুর পরিমানে ধরে আছে ।
– আচ্ছা ,
বেলী এক দৌড়ে গিয়ে কফি বানাইতে থাকে । মিনুও দেখতেছে সব , হাল্কা মলিন হাসি দিয়ে সেও মনে মনে বলে ,
– আল্লাহ পাক তারে যে এত সরল সোজা কিত্তে বানাইলো । জামাই যা কয় তাই হুনে , জামাই তো ভালা না কোনদিন জানি মাইরাই ফালায় । বেচারি এইডাই বুঝপার পারে নাহ । জামাই যা কয় তাতেই হ হ করে । সহজ সরল মাইয়া মানুষ ।
মিনুর মনের ভয় তার বেলী ভাবীকে কোনদিন জানি ইরফান মেরেই ফেলে । কিন্তু বেলী তো তা বোঝে না । এটাই মিনুর খারাপ লাগে ।
বেলী কফি বানিয়ে ইরফানের রুমে যায় । ইরফান তখন গোসল করে বের হয় , ইরফান তখন মাথার পানি গুলো মুছতেছে । তখনই বেলী রুমে যায় ।
– আপনার কফি,,,,,,,?
– থ্যাংকস রে , এত ধকলের পরে এই কফিটার সত্যিই প্রয়োজন ছিল ।
– খেয়ে নেন ।
– বেলী,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘ প্রজেক্টটা সাইন হয়ে গেছে ।
– বুঝলাম না ঠিক ।
– বুঝলি না ?
– উহু ,
কফির মগে চুমুক দিয়ে বেলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ইরফান । তারপর হাল্কা হেসে বেলীর চোখের দিকে তাকায় ইরফান ।
– তোর দেয়া নামটাই রেখেছি প্রজেক্টের । বস নামটা শুনে খুব খুশি হলেন । আমাদের কোম্পানির পরবর্তী প্রজেক্টের নাম হচ্ছে ‘ স্বপ্ননীড় ‘। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা , আমার প্রমোশনটাও হয়ে গেছে আজকেই বস ডিক্লেয়ার করে দিলো ।
– আলহামদুলিল্লাহ , আমি বলেছিলাম না আপনাকে , ঠিক হবে সব ।
– হ্যাঁ , সবটাই ঠিক হয়েছে ।
– আচ্ছা আপনি কফি খেয়ে আসেন , আমি টেবিলে ভাত দিতেছি ।
– বেলী দাঁড়া ,
– জ্বি , কিছু বলবেন ?
– কি চাই তোর , আজ যা চাস মুখ ফুটে বল ।
– চাইছি তো কাল রাতে ।
– বেলী ,,,,,, শাড়ি গহনা কিংবা অন্য যা কিছু চাই বলতে পারিস ।
– এইসব কিছুই চাই না আমার , আমার যা চাই তা বলছিলাম তো কালকে । আপনি খাইতে আসে , আমি ভাত বাড়তেছি ।
ইরফানের কথা এড়িয়ে গিয়ে বেলী রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলী যেই কথা গুলো বলে গেলো কথা গুলো কি অভিমানের কথা নাকি বেলীর মনের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না ইরফান । তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছে বেলীর সাথে করা অন্যায় গুলোর জন্যে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে বেলীর কাছে । আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ।
ইরফান ডাইনিং টেবিলে বসে আছে । বেলী ভাত সহ সব কিছু এগিয়ে দিচ্ছে ইরফানকে । ইরফান কিছুক্ষণ বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । তারপর কি যেনো একটা ভেবে বেলীর সামনেই মিনুকে ডেকে আনে ইরফান ।
– জ্বে ভাই , আমারে ডাকছেন ?
– হু ,
– কি ভাই , কন ।
– আজকে তুই গেষ্ট রুমে থাকিস ।
কথাটা শুনে বেলীর কলিজায় এক কামড় দেয় । আর তার থেকেও বড় কথা মিনুর তো কলিজার সব পানি নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে । ইরফান হঠাৎ করেই কেন আজকে মিনুকে গেষ্ট রুমে শুতে বললো । মিনু বেলীর দিকে তাকায় আর বেলীও মিনুর দিকে তাকায় । মিনু চোখের ইশারায় বেলীকে বোঝাতে চাচ্ছে হয়তো আজ রাতই বেলীর শেষ রাত । ইরফান হয়তো আজ রাতেই বেলীকে মেরে ফেলবে । তাই মিনুকে আলাদা শুতে বলেছে । এইদিকে বেলীও বিচলিত , হঠাৎ করে ইরফানের আজ কি হলো ? মিনু কথা ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেই বলা শুরু করে ,
– ভাই আমার একলা হুইতে ডর লাগে তো ,
– কিসের ডর আবার , বাসায় আমি আছি তোর ভাবী আছে , কিসের ডর আবার ।
– ভাবী আছে সমিস্যা নাই কিন্তু আপনে আছেন এইডাই আসল সমিস্যা (গুনগুনিয়ে)
– এই মিনু কি বলিস গুনগুন করে ।
– কই কি কইচি আবার , আমি ভিত্রের রুমে হুইতাম না , আমার ডর করে ।
– আচ্ছা তাহলে তুই বেলীর রুমে ঘুমাস , বেলী গেষ্ট রুমে ঘুমাবে ।
– কিল্লাই , ইরাম কিল্লাই ?
– কি কিল্লাই কিল্লাই করছিস , আর তোকে না কতবার বলছি নরমাল ভাষায় কথা বলতে ।
মিনুর মনে এইবার পুরোপুরি দাগ কেটে যায় , যে আজ রাতেই ইরফান বেলীকে মেরে ফেলবে । তাই বেলীকে , চোখে ইশারা করে । তখন আবার বেলী বলা শুরু করে ।
– মিনু তো রোজ আমার কাছেই ঘুমায় তাহলে আজ কেন অন্য ঘরে ঘুমাবে ?
– আমি বলেছি তাই ,
– কিন্তু ও তো ভয় পায় ।
– পাবে না ভয় । এখন মিনু তুই কোন রুমে থাকবি ভেবে দেখ ।
এই বলে ইরফান খাবার টেবিল থেকে উঠে নিজ রুমে চলে যায় । ইরফান যেতে না যেতেই মিনু শুরু করে দেয় ,
– দেখছেন ভাবী দেখছেন৷, কইছিলাম না মাইরা ফালাবে , আমারে অন্য রুমে দিয়া আপনেরে মাইরা ফালাইবো গো ভাবী ।
– কি সব বলো না তুমি । আমাকে মেরে ফেললেও তুমি দেখবে না মারলেও তুমি দেখবে , বাদ দাও । উনি যা বলছে তাই করো , আজকে বরং গেষ্ট রুমেই ঘুমাও ।
– কিন্তু আপনে ,
– যা আছে কপালে ।
রাত প্রায় ১২ টা নাগাদ বাজবে । মিনু চিন্তা করতে করতে গেষ্ট রুমেই ঘুমিয়ে গেছে । আর অন্যদিকে রুমে শুয়ে শুয়ে বেলী ভাবছে আজকে হঠাৎ মিনুকে কেন অন্য রুমে ঘুমাইতে বললো ইরফাজ । এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না বেলীর । এরই মাঝে দরজায় টোকা পড়ে , বেলী দরজা খুলে দিয়ে দেখে ইরফাজ , টাউজারের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে । অনেকটাই চমকে যায় বেলী ইরফাজকে দেখে ।
– ভেতরে আসতে পারি ?
– এটা আপনার বাসা , সেই হিসাবে রুমগুলাও আপনার , আসেন ।
– ঘুমাস নাই এখনও ?
– শুইছিলাম , এখনি ঘুম আসতো ।
– ওহ , তখন বললাম কি চাই তোর কিছুই বললি না ?
– আমার কিছু চাই না । আর যা চাওয়ার ছিল চেয়েছি তো ।
– আজ যদি আমি তোর কাছে কিছু চাই , দিবি আমাকে ?
– এমন কিছু চাইয়েন না যা আমি দিতে পারবো না । আর যদি আমার জীবনটা চান সহজেই দিয়ে দিবো , তবুও এমন কিছু চাইয়েন না যা আমার আয়ত্তের বাহিরে ।
– জীবন চাইবো না কারণ এই জীবনটাই তো আমার ।
– মানে ??
– যদি বলি আমি তোকে চাই , তখন কি করবি তুই ??
ইরফানের কাছ থেকে এমন কথা আশা করেনি বেলী । এই কথাটা পুরোটাই তার আশপাশের জগত থেকে অনেক দূরে ছিল যা বেলীর ধারণাতেই ছিল না । যেই মুহুর্তটা প্রত্যেক নারী আশা করে তার স্বামীর কাছে । সেই মুহুর্তটা যে এইটা হবে জানা ছিল না বেলীর । আর মুহুর্তটা যে আজকের রাতটা হবে তাও জানা ছিল না বেলীর ।।
.
.
চলবে………………
[