ঝরে যাওয়া বেলীফুল পর্ব -১৬

###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
পর্ব_১৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল ৮ টা নাগাদ ইরফানের ঘুম ভাঙে । ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে হতেই সাড়ে ৮ টা । টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে পূর্বের ন্যায় বেলী সব নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে । ইরফান আর তেমন কোন কথা বলে নি , নাস্তা খেতে বসে যায় সে । কিছুক্ষণ পর বেলী চা নিয়ে ইরফানের কাছে যায় । চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীকে একা রেখেও যেতে ইচ্ছা করতেছে না তার । অন্যান্য দিন তো মিনু বাসায় থাকে ৷ আজকে সেও নাই । মেয়েটা এখনও আসে নি বাসায় ।

– একা থাকতে পারবা ?
– হু ,
– ভয় লাগবে না ?
– উহু ,
– আমার আজ অফিসে যেতেই হবে না হয় আমি থাকতাম ।
– আমি যখন থাকবো না তখন ?
– মানে ?
– কিছু না , আপনি খান ।

ইদানীং বেলীকে অনেক অচেনা লাগে ইরফানের কাছে । বেলী কি বলে , কি করে , কি বলতে চায় , কি করতে চায় কিছুই বুঝে না সে । তবে বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা শান্তি আসে মনে তার । দেখতে দেখতে ইরফানের অফিসের সময় হয়ে যায় , তখন আর কিছু না বলেই ইরফান চলে যায় অফিসে । পুরো বাসায় আজ বেলী একা । একা মস্তিষ্কে অনেক কিছুই ভর করে । জানালার কাছে গিয়ে গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখছে বেলী । নীল আকাশে কয়েকটা পাখি উড়ে যায় । বেলীর নিজেকে পাখি মনে করতে চায় । পাখিরা যেমন স্বাধীন তেমনি সেও স্বাধীন হয়ে উড়তে চায় । যেখানে থাকবে না কোন কষ্ট , থাকবে না কোন গ্লানি । শুধু দুচোখ ভরা ভালোবাসা আর স্বপ্ন মাখা কিছু মিষ্টি অনুভূতি ।

তুমি উড়বে আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে
তুমি উড়বে আকাশে শত ভালোবাসার
তারা হয়ে
আমি চাই গো তোমায় আপন করে
যদি দেও একটু সাড়া ভালোবেসে

মুহুর্তের মাঝেই চারটা লাইন মনে পড়ে যায় বেলীর । বহুদিন আগে কেউ একজন মোড়ের মাথার দাঁড়িয়ে তার জন্যে এই চারটা লাইন বলেছিল । লাইনের সাথে সাথে মানুষটার চেহারা টাও মনে পড়ে যায় তার । সেদিনের মানুষটা আপন হতে হতেও হলো না ।
বেলীর রাজুর কথা মনে গেছে । ছেলেটা বড্ড মায়াবী ছিল । এক কথায় বেলীকে খুব পছন্দ করতো সে । তার কাছে বেলী শুধু বেলী ছিল না , তার কাছে বেলী ফুল হয়ে ছিল । বেলীকে সে ফুল বলে ডাকতো , শুধু ফুল । গায়ের রঙ হালকা শ্যামলা রঙের বলে সে বেলীকে কালচে ফুল নাম দিয়েছিল যদিও এটা মজা করে বলতো । এটা বেলীর জানা ছিল । একদিন কলেজ থেকে আসার পথে , পথ আগলে ধরেছিল রাজু । হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে । আজও ডাকটা কানে ভাসে বেলীর । রাজুর ডাকে অনেক মায়া ছিল সেইদিন । যখন সে ‘ কালচে ফুল ‘ বলে ডাকতো বুকের ভেতরটা মায়ায় ছেয়ে যেতো । নিজের থেকে ছোট বলে তুই তুই করে ডাকতো বেলীকে সে । সেদিন দুপুরের পথ আগলে ধরাটা ছিল অন্যরকম ।

– কালচে ফুল,,,,,,,,,, দাঁড়া
-……………
– এই দাঁড়া ,
– আপনে আমারে কালচে ফুল ডাকেন কেন ?
– হুর কালি , কালিরে কালি বলবো না তো কি বলবো ?
– হুহ , তাইলে আর ডাকবেন না কখনো ।
– ওরে ওরে কালচে ফুল রাগও করে , ওই দেখো ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যায় । দাঁড়া না প্লিজ ,
– কি হইছে ?
– এইটা নে ,
– কি এইটা ?
– খুলে দেখ ?

বেলী খুলে দেখে ঠোঙা ভর্তি বেলীফুল রাখা আছে । বেলীফুল গুলো একদম তর তাজা , একদম সতেজ । বেলীফুল গুলো নিজের হাতে পেয়ে বেলী নিজেকে সব থেকে খুশি মানুষ ভাবে সে সময় । ঘ্রাণ নিতে থাকে সে বার বার ।

– রাজু ভাই , আমার জন্যে আনলা ?
– হু ,
– কই থেকে আনলা গো ?
– আমার গাছের ,
– অনেক সুন্দর ফুল গুলা ।
– তোর কাছে এর সৌন্দর্যও ব্যর্থ রে ।

রাজুর কথায় হাসিমুখে মুহুর্তের মাঝেই লজ্জার আবরণ পড়ে যায় । ‘ আমি যাই ‘ বলে বেলী সামনে পা বাড়াতেই রাজুর ডাকে পা জোড়া আটকে যায় তার ।

– কি হইলো ?
– চলে কেন যাস ?
– বেলা বাইরা যাইতাছে , মায় বকবো পরে ।
– কালকে দেখা করবি ?
– কই ?
– মিয়াগো পুকুর পাড়ে ।
– ও মা গো , ওইদিকে যামু না , দেইখা ফেললে মায়ের কাছে খবর যাইবো গা লগে বাবার কাছেও ।
– তাহলে আসবি না ?
– পারলে আসমু ,
– ওই কালি দাঁড়া ,

..

কলিংবেলের আওয়াজে ধ্যান ভেঙে যায় বেলীর । এতক্ষন ভাবনার জগতে ছিল বেলী । অতীতের কিছু কিছু দিক হঠাৎ করে মনে পড়ে মনটাকে কখনো ভালো আবার কখনো খারাপ করে দিয়ে যায় । ওড়নাটা দুই পেচ করে পেচিয়ে মাথায় দিয়ে দরজার কাছে যায় বেলী । দরজা খুলতেই একটা চিৎকার শুনতে পায় বেলী ।

– আয়ায়ামিইইইইই আইয়া ফচ্চি ভাবীইইই
– আরে মিনু !
– হ হ আমি মিনু , আইয়া ফচ্চি ।
– এসো এসো , এত তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলা ?
– ও মোর খোদা , আপনে কি কন ভাবী , কয়টা বাজে দেখছেন নি , ১১ টা বাইজ্জা গেছে ।

মিনুর কথায় বেলী ঘড়িতে নজর দেয় । আসলেই ১১ টা বেজে গেছে । কখন যে এত সময় পাড় হয়ে গেল বলতেও পারবে না সে । মিনু আবার তার কথার মেশিন স্টার্ট করে ফেলে ।

– ও ভাবী , কি ভাবেন এত ?
– কই না তো , কিছু না
– ভাইয়ে কই , গেছে গা কামে ?
– হুম ,
– আইচ্ছা কন কি কি কাম করতে হইবে ?
– কিছু করতে হবে না তুমি আগে রেস্ট করো ।
– আরে আমি ঠিকাছি , আইয়েন আইয়েন কইয়া দেন কি কি করা লাগবো ।

এমন সময় ইরফানের রুমের দিকে নজর যায় মিনুর । উকি দিয়ে দেখে রুবি নেই রুমে । এই আবার শুরু করে মেশিন ,

– খবিশডায় কই ,
– কে ?
– রুবি খবিশডায় কই আইয়ে না হেতি ?
– ছিহ মিনু এইসব বলো না , সে খবিশ না সে তো মানুষ তাই না ?
– থামেন থামেন , সতীনের গীত কইয়েন না , আইয়ুক নাইলে মরুক আমার কি , আমি কিডা , আমি তো কামের মাইয়া ।

মিনু মনে মনে ১০০ গালি দিতে দিতে রুবির গুষ্ঠির ষষ্ঠী পূজা করতে করতে কাজে লেগে যায় । বেলীও এইদিকে সব গুছিয়ে দুপুরের রান্নার কাজে লেগে যায় । আজান পড়ে গেলে গোসল করে নামাজে দাঁড়ায় সে । নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে যেইনা দাঁড়িয়েছে , ওমনি আবার কলিংবেল বেজে ওঠে । বেলী জায়নামাজ টা রেখে দরজা খুলতে যায় । বেলী দরজা খুলে চমকে যায় । যদিও এটা চমকানোর মত কিছু না । এটা তো হওয়ারই ছিল । দরজায় রুবি দাঁড়িয়ে আছে । বেলীকে সাইডে ধাক্কা দিয়ে রুবি ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় । রান্নাঘর থেকে আবার মিনু রুবিকে দেখে ফেলে ।

– শয়তানের নামডা যে কিত্তে নিছিলাম , শয়তানের নাম নিছি সকালে , শয়তান দুফুরে হাজির । এত মানুষ মরে এই শয়তান মরে না । অসিভ্য মাতারি একডা।

ইচ্ছামত রুবিকে বকতে থাকে মিনু । মোট কথা মিনু রুবিকে দেখতেই পারে না । তাই এত কটাক্ষ করে রুবিকে তবে তা অবশ্য রুবির অগোচরেই ।

রুবি এসেই পুরো বাসা মাথায় তুলে নিয়েছে । বেলীর সাথে অনর্থক বাড়াবাড়ি করছে সে । বেলীকে ইচ্ছে করেই বকছে , উউল্টাপাল্টা মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে সে । তবুও বেলী একদম চুপ করে আছে । বেলীর নিজেকে এখানে এখন বড় বেশি অসহায় লাগে । এইভাবে নিংড়ে নিংড়ে মরতে হবে তাকে । অহেতুক চিল্লাচ্ছে রুবি বেলীর উপর ।

বিকেলের শেষের দিকে বেলী রুমে শুয়ে আছে । সারাদিন কাজ করে অনেক ক্লান্তু সে । কাজ করা আগেই শেষ হয়েছিল কিন্তু রুবি এসে আবার তার জামাকাপড় গুলো বেলীকে দিয়ে ওয়াস করায় । এই সব কাজ করতে কর‍তে বেলী খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে । শোয়ার পরেও বেলীর চোখে ঘুম আসে নি । ঘুরে ফিরে মাথায় একই ভাবনা কাজ করে যায় । কি হবে তার ভবিষ্যত । কিভাবে থাকবে সে এখানে । এরই মাঝে রাজুর কথা মনে পড়ে তার । রাজুর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১ বছর আগে যেদিন রাজু একেবারেই ঢাকা চলে আসবে তার আগের দিন সন্ধ্যায় । বেলীকে বাধ্য করেছিল সে তার সাথে দেখা করতে । সেদিন বেলী গিয়েও ছিলো তার সাথে দেখা করতে । চারপাশে অন্ধকার নেমে যায় আর সেই আঁধারের মাঝে চুপিসারে রাজুর সাথে কথোপকথনের ঢল পড়েছিল বেলীর ।

– এই কালি , এত দেরি করলি কেন রে
– তো কি করতাম ?
– মশার কামড় গুলা আমি খাইছি
– ভালো হইছে
-…………..
– রাজু ভাই,,,,,,,?
– হুম ,
– সত্যিই কি কালকে চইলা যাবেন ঢাকা ?
– হু
– আসবেন না আর ?
– আসবো তো ,
– রাজু ভাই ,,,,,,,,,?
– বল ,
– ভয় লাগে অনেক ,
– চাকরি টা আরেকটু পাকা পক্ত করে আবার আসবো তখন তোর বাবার সাথে কথা বলবো আমি ।
– সত্যি তো ?
– হ্যাঁ রে সত্যি , বল কি আনবো তোর জন্যে
– কিছু লাগবো না আমার ,
– কেন ?
– আপনে আসলেই হবে ।

কথা গুলো মনে পড়ে গিয়ে এক গাল হেসে দেয় বেলী । ওইটাই ওদের শেষ দেখা ছিল । কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় সে এখন বিবাহিতা । তার স্বামী আছে আর রাজু এখন পর পুরুষ । তাই তার কথা মনে আনাও পাপ । কিন্তু বেহায়া মন টা কেন যেন বেশি করে মনে করিয়ে দেয় তাকে । পরিস্থিতি সব গোলমেলে লাগে বেলীর কাছে । সেই সময় সবে মাত্র মনটা রাজুতে বসেছিল আর তখনই নিয়তি ইরফানকে বসিয়ে দেয় । সেই থেকে সব টাই শেষ । ভাবনার সাথে বাস্তবতার মিল কখনোই ছিল না ।

– আমার নিয়তিই আমায় বার বার ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে । আমি কি কখনো ভালো থাকতে পারবো না । কপাল টা খারাপ মানি কিন্তু এত খারাপ হবে ভাবি নি । আমার জীবন টা একটা কালো অন্ধকার যেখানে আলোর রেখা নিয়ে দাঁড়ানোর কেউই নেই ।

নিজে নিজেই কথা গুলো সাজাতে থাকে বেলী । ইদানীং মনটাই তার সব থেকে কাছের । মনের সাথেই সব বলা যায় । আত যাই হোক মন কখনো ধোঁকা দেয় না । এরই মাঝে রুবি অনেক জোরে জোরে বেলীকে ডাকতে থাকে ।

– বেলী , ওই বেলী , বেলী , মরছিস নাকি , সাড়া দেস না কেন ?

মরার কথা শুনে বেলীর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠে ।

– হ্যাঁ , হয়তো একদিন আমাকেও এই রঙ্গমঞ্চের মায়া ত্যাগ করতে হবে । যত পারো নিংড়ে নাও আমায় । আমি কিছুই বলবো না !!

বেলী এইটা বলতে বলতে তাড়াতাড়ি রুবির কাছে চলে যায় ।

.
.

চলবে…………………….

[ বিঃদ্রঃ অতীত , বড় পিছুটান । অতীত দুই রকমের হয় । কখনো সুখের কখনো বা দুঃখের । যে অতীত মনে পড়ে মুখে হাসি আসে সেই অতীত মনে রাখা বাঞ্চনীয় । আর যে অতীত মনে পড়ে চোখের পানি আসে তা ভুলে যাওয়া কর্তব্য । কারণ অতীতের ছায়া বর্তমানের ভালো লাগা গুলোকে নিমিষেই শেষ করে দেয় । এখানে রাজুও তেমন , তবে রাজুর সাথে আদৌ বেলীর দেখা হবে কিনা তা জানা নেই । বেলীর মত আমরা হাজারো মেয়েরা এটা ভেবেই ব্যাকুল , অতীত ছেড়ে কিভাবে ভালো থাকবো । তবে বেলীরা বাবার দিয়ে যাওয়া কথা রাখতে মায়ের মান সম্মান দেখে নিমিষেই অতীত চেপে বর্তমানকে আপন করে নেই । এই বর্তমানে কেউ সুখী আবার কেউ বা বেলীর মত পিষে মরে প্রতিনিয়ত ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here