#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৩
#আফনান_লারা
________
পূর্ণতা জিলাপি বানাতে বানাতে ভাবছিল আজিজ খান এতসব কি করে জানে!এটা তো অসম্ভব। পরে মাথায় আসলো হয়ত দাদাজান সব বলেছেন।
জিলাপি হাতে সোজা দাদাজানের রুমের দিকে যাচ্ছিল সে সেসময় ফারাজ সামনে পড়লো,তাকে নাকি দাদা ডেকেছেন।পূর্ণতার হাতে এক প্লেট তাজা গরম গরম জিলাপি দেখে লোভ সামলাতে পারেনি ফারাজ।এক টান দিয়ে দুটো নিয়ে ফেললো।পূর্ণতা ভ্রু কুুঁচকিয়ে বললো,’খান খান।আপনার বিয়ের মিষ্টি’
‘আমার বিয়ের মিষ্টি মানে?’
‘দাদাজান আমার এই সুন্দর হাতখানা দেখিয়া বলিয়াছেন আমার বিয়ে হবে মিরাজুলের সাথে।’
‘কিহ?মিরাজুল তো আমি।’
‘জ্বী,ঠিক ধরেছেন।’
পূর্ণতা এবার চলে গেছে।ফারাজ অবাক হয়ে হাতে জিলাপি নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এরপর যে প্রস্তাব আসবে টাতে চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে যেতে হবে।নাহলে দেখা গেলো দাদাজান জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিবেন পূর্ণার সাথে।
হাতের জিলাপি যে ইচ্ছে নিয়ে সে হাতে নিয়েছিল এখন সেই ইচ্ছা বিস্বাদ মনে হচ্ছে।খাওয়ার ইচ্ছা নেই বলে সিয়ামকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দাদাজানের রুমের দিকে চললো সে।
পূর্ণতা ততক্ষণে পৌঁছেও গেছে।
দুজনে একত্রে দাঁড়িয়ে দুই দাদার কথা শুনার অপেক্ষায় আছে এখন।
‘শুনো নাতি নাতিন!তোমরা একে অপরের জন্য শতে শতে দুইশ!!আমি কি বলছি বুঝতে পারছো?তোমাদের দুজনের সাথে দুজনকে মানায় বলেই আমরা বড়রা মিলে তোমাদের বিয়ে দিতে চাইতেছি।তাহলে কেন তোমরা মানা করছো?ক্ষনিকের ঘৃনা কি সারাজীবন থাকে?বিয়ে করলে মনে প্রেম জাগবে,জীবন সুন্দর কাটবে।আমাদের কথা মানো, বিয়েতে বসে যাও।বলো এবার তোমাদের যা বলার’
ফারাজ পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্ণতাও ওর মুখের দিকে চেয়েছিল।এরপর ফারাজ বললো,’আমার সাথে যে কেবল পূর্ণাকেই মানায় তা কিন্তু নাহ।
আরও অনেক মেয়ে আছে।আপনারা দয়া করে সেই কাতার থেকে একটি মেয়ে খুঁজে আনেন।পূর্নাকে না প্লিজ!’
বেলায়েত হোসেন গাল ফুলিয়ে পূর্নতার মুখের দিকে তাকিয়েছেন।পূর্ণা বললো,’আমারও একই কথা।আমার জন্য কি ছেলের অভাব পড়েছে?!আমার বাবাও পাশে নেই।আমি এখন বিয়ে করতেও চাইনা। ‘
ওদের দুজনের কথা শুনে দুই দাদা ভীষণ ক্রোধীত হলেন।
রাগে তাদের চোখে যেন আগুন জ্বলছিল।দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের কাছে তারা এমন সোজা উত্তর হয়ত আশা করেননি।এখনকার ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের সম্মান দিতে জানেনা।নাহলে তাদের কথা ধরে হলেও বিয়েতে হ্যাঁ বলা ওদের কর্তব্য ছিল।তা না করে শুরু থেকে মুখের উপর না করে যাচ্ছে ওরা।
ফারাজ হাতের ঘড়িটা দেখে বললো,’আমার কাজ আছে।যেতে পারি?’
দাদাজান তখন রেগে বললেন,’আমি কি বলেছি আমার কথা শেষ হয়েছে?’
‘আচ্ছা বলুন।শুনছি’
‘তোমাদের না বলেছিলাম একসাথে থাকবেনা?তাহলে একসাথে সারথিকে আনতে কেন গিয়েছিলে?আমি কিন্তু আমার কথায় অটল।আর একদিন দুজনকে একসাথে দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিব।আজিজ এখানেই থাকবে।দেখি তোমরা কত লুকোচুরি পারো’
পূর্ণতা আর ফারাজ মুখ ফুলিয়ে চলে এসেছে।বাইরে বের হয়ে দুজনে আবার দুদিকে চলেও গেছে।
————
সারথি মাত্র বিশ ঘন্টায় যেন আনাফের পুরা বাসাটাকে ভরিয়ে দিয়ে ফেলেছিল।সেই পরিবেশটা এখনও যায়নি।চারিদিকে ভাসছে।আর সেই মেয়েটা যদি একেবারে থেকে যেতো তাহলে কি না হতো!তাই ভেবে আনাফের বুকটা খালি হয়ে যাচ্ছে।কবে সেই মেয়েটিকে একেবারে নিজের করে সে পাবে সেই দিনটার অপেক্ষায় আছে সে।
একাকি রাতটায় সারথির বড্ড প্রয়োজন ছিল। মানসিক চাহিদার জন্য হলেও এই মেয়েটিকে তার চাই।এখনই!!
সে বড় একা।তার একাকিত্ব সারথি নামের মেয়েটা ছাড়া আর কেউ মিটাতে পারবেনা।আনাফ পারতে দেবেওনা।
কেন যে এই রাতেই চলে যেতে হলো তার!বেশ তো তার মুখ চেয়ে আরামসে সময় কেটে যাচ্ছিল।যে আনাফের ব্যস্ততার মাঝে সময় বলে জ্ঞান ছিলনা,ধারণা থাকতো না,সে আনাফ এই কয়েক মূহুর্তে বুঝে গেছে সময় কত মূল্যবান।কেবল চাকরিটাই সব হয়না।আমাদের নিজেদের একটা ব্যাক্তিগত লাইফ থাকে।
মেয়েটা সব বুঝেও চলে গেলো,থেকে গেলে কি এমন হয়??আমার অনুভূতির কি কোনো দাম নেই তার কাছে?’
——-
সজীব বাংলাদেশে ফিরে হোটেলে উঠেছে।বাসায় যায়নি।সবার আগে কোর্টে যাবে।তার পরিচিত উকিলের সাথে কথা বলে ডিভোর্স লেটার রেডি করে তারপর সারথির সাথে দেখা করবে।তার আগে না।
একটু রেস্ট করে সে বেরিয়ে পড়েছে কাজে।
ওদিকে সারথি সকাল থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।তার ফুড পয়েজনিং হয়েছে।ফারাজ ডাক্তার এনে দেখিয়ে ঔষুধও এনে দিয়েছে তাও ভাল হচ্ছেনা।বমি করতে করতে সারথির অবস্থা কাহিল।
সবাই সজীবকে কল করে যাচ্ছে কিন্তু ওর ফোন বন্ধ বলছিল বারবার।শেষে বাধ্য হয়ে ওর মাকে কল করেছেন জনাব মানিক।
সজীবের মা জানালেন তিনিও সজীবকে কলে পাচ্ছেন না।হয়ত জরুরি কাজে ব্যস্ত বলে ফোন বন্ধ রেখেছে।
তিনি রওনা হয়েছেন সারথিকে দেখতে আসার জন্য।পূর্ণতা একটা টোটকা হিসেবে শরবত বানাচ্ছিল সারথির জন্য, ঠিক সেসময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মতিনকে বললো গিয়ে দেখতে।বাকি সবাই উপরের তলায় সারথির রুমে ছিল।মতিনের হাতে আটা মাখা বলে সে পূর্ণাকেই পাল্টা আদেশ করে গিয়ে দরজা খোলার জন্য।তাই পূর্ণা হাতের কাজ রেখে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলতেই তার সাথে দেখা মিললো এক সুদর্শন পুরুষের।
পরনে কালো ফুল শার্ট,প্যান্ট।এক হাত পকেটে ঢোকানো আর এক হাতে একটা ফাইল।পকেট থেকে হাত বের করে চোখের চশমাটা খুলে সজীব বললো,’হাই??আমি সজীব।সারথি কি বাসায় আছে?’
সজীব শুনে পূর্ণতা ইয়া বড় হা করে এক দৌড় দিলো।
সজীব ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকেছে।মতিন আটামাখা হাত নিয়ে বাইরে বের হয়ে সজীবকে দেখে সেও এক দৌড় দিলো।
সিয়াম আর অর্ক একটা সাবজেক্ট নিয়ে তর্কাতর্কি করছিল।করতে করতে সজীবের সামনে এসে ওকে দেখে তারা ইয়া বড় হা করে এবার দুজন মিলে দৌড় দিলো।সবাই উপরের তলায় এসে বাকি সবাইকে গিয়ে জানালো সজীব এসেছে।কেউ শুরুতে বিশ্বাস করেনি।পরে যখন একসাথে সবাই বলা শুরু করলো তখন তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো।
সবাই এবার সারথিকে রেখে নিচ তলার দিকে ছুটেছে।সারথি এখন একা।
সারথিও শুনেছে সজীব এসেছে।কিন্তু সে তার কানকে বিশ্বাস করেনি।কেবল কানের ভ্রম বলে ধরে নিয়ে সে চোখ বুজে দম ফেললো।শরীর এমনিতেও টানছেনা তার উপর উদ্ভত সব কল্পনা।
মিনিট দশেক পর দরজা খোলার আওয়াজ শুনে সারথি।তখন সে এপাশ করে ফিরে বললো,’মা আমি একটু ঘুমাবো।সবাইকে বলবে যেন বিরক্ত না করে।’
দরজাটা খুলার পর এবার বন্ধের আওয়াজ ভেসে আসলো।সারথি বুঝলো চলে গেছে হয়ত।তার এক মিনিট পর নিজের কাছে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চট করে উঠে বসে সারথি।খোলা চুলগুলোকে সামলে মৃদু স্বরে বলে,’কে?’
‘আমি’
কণ্ঠস্বরটা খুব চেনা সারথির।মূহুর্তেই সে বুঝে গেছে এটা কল্পনা নয়,সত্যি সজীব এসেছে।হাসবে নাকি কাঁদবে সেটা ভেবে পাচ্ছেনা সারথি।
হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো।ওমনি তার হাতটা যাকে খুঁজতে এগিয়েছিল সেই মানুষটা নিজেই ছুঁলো তাকে।সারথি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,’কেন দিলেন এত বড় শাস্তি!আমার কি দোষ ছিল!’
‘সারথি প্লিজ কেঁদোনা’
কথাটা বলে সজীব ওর পাশে বসে পড়ে।দুহাত বাড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’আমি তোমায় ধোকা দিতে চাইনি।তোমার বাকি জীবনে কোনো কষ্ট হবেনা সারথি।এই দেখো আমি একটা দলিল এনেছি।এটাতে লেখা আছে আমার উত্তরার যে ফ্ল্যাট আছে ওটা তোমার নামে।আমি তোমার নামে করে দিয়েছি পুরাটা।তাছাড়া তোমার সারাজীবনের ভরণপোষণের দায়িত্বটাও কিন্তু আমার।তুমি ভেবোনা সারথি’
সারথি তাচ্ছিল্য করে হাসে এবার।চোখ মুছে ফেলে বলে,’এটাই কি একটা মেয়ের চাহিদা?আর কিছু নেই আগে পরে?’
‘তুমি চাইলে বিয়েও করতে পারো।ধরা বাঁধা নেই’
‘আপনি আজ কি কারণে এসেছেন?’
‘আরেকটি দলিল এনেছি।ডিভোর্সের।’
‘দিন,সই করে দিচ্ছি।’
কথাটা বলে সজীবের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় সারথি।তারপর কলম নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে রাখে।সজীব পকেট থেকে কলম নিয়ে ওর হাতে দিয়ে কাগজ দেখিয়ে দিলো।সারথি দম আটকে সই করে দিয়েছে।দিয়েই একটু দূরে সরে বললো,’চলে যান।আজ থেকে আপনি মুক্ত।আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবোনা।’
সজীব কাগজগুলো একপাশ করে রেখে ফ্ল্যাটের ফাইলটা সারথির সামনে রেখে বললো,’এটা রেখে দাও’
‘বিয়ের আগে কি আমার মাথার উপর ছাদ ছিল না?তিন বেলা ভাত খেতে পারতাম না?পরনে পোশাক ছিল না?
সব ছিল। সুতরাং আপনার দয়া না ঢাকলেও আমি বেঁচে থাকতে পারবো।আপনি যান এখন’
সারথি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।সজীব সব একপাশ করে রেখে সাররথির পাশে বসে থাকলো,যাচ্ছেনা।সারথি চোখ মুছে ধরে নিলো সজীব চলে গেছে।এবার সে নিজে নিজে বিছানা ছেড়ে নামলো।হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে সেটাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মনে হয় যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেছে ওর।বাইরে থেকে হইচই শোনা যাচ্ছে।জামাই আদরের ব্যবস্থা করছে সবাই।সারথি যতবার চোখ মুছো ততবারই চোখ ভিজে যায় অশ্রুতে।
মেঝোতে বসে সে হাউমাউ করে কাঁদছে।সজীব খাটে বসে এক দৃষ্টিতে ওকে কাঁদতে দেখছে।
সারথির এমন হোক সেটা ও চায়নি।এখন তার নিজের ভেতরটা পুড়ে যচ্ছে সারথির জন্য।বারবার মন বলতে চাইছে সারথি তুমি কোঁদোনা।আমি সই করিনি এখনও,কখনও করবোনা।
সারথি হঠাৎ উঠে দ্রুত দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমে চলে গেলো বমি করতে।শরীর আর কোনো কিছু সহ্য করার অবস্থাতে নেই।মুখ ধুয়ে বের হয়ে দূর্বল শরীরে সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
সজীব নিজের কোটটা খুলে বালিশের উপর রেখে মাথার চুল ধরে টানাটানি করছিল,সারথিকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজে উঠে এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।সারথি তখন অন্য দুনিয়ায়।তার বিশ্বাস হচ্ছেনা সে ডিভোর্স লেটারে সই করে দিয়েছে।মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে সেসবই ভাবছিল সে ঠিক তখন হাতের সাথে সজীবের হাতের স্পর্শ পেলো ।চমকে বললো,’আপনি যান নি?’
‘নাহ,পরে যাব।আসার পর থেকে ভাল ভাবে রেস্ট নিতে পারিনি।আধ ঘন্টা হোটেল রুমে থেকে কাজে লাগতে হয়েছে।’
‘আপনি এই রুম থেকে বের হয়ে যান,এটা আমার অনুরোধ’
‘কই যাব?তুমি চাও হোটেলে ফিরে যাই?’
‘যেখানে খুশি যান’
‘এত বছর পর স্বামীকে পেয়ে হোটেলে পাঠাচ্ছো?’
‘ স্বামী?ডিভোর্স পেপারে সই করলাম পাঁচ মিনিট হলো’
‘আমি কিন্তু করিনি।এখনও তোমার আমার সম্পর্ক ভাঙ্গেনি।সো আমি এখন যাব না।কয়েকদিন থাকি,ঘুরিফিরি তারপর যাব’
সারথি বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে পা বাড়াতেই হোচট খেলো।সজীব ওকে এক হাতে ধরে ফেলে বলে,’তোমার বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। তবে কি জানো?আমি জানি তুমি আমায় ভালবাসো।ফায়দা লুটতে সমস্যা কোথায় বলোতো?’
‘আপনি জানেন আপনি একজন কাপুরুষের মতন কথা বলছেন?আপনার নিজের ভালবাসার মানুষ আছে,আপনি তাকে বিয়েও করবেন।আপনি নিজের স্ত্রীকে সে জন্য ডিভোর্স ও দিবেন, আবার বলছেন সেই স্ত্রীর ফায়দা লুটবেন?’
সজীব হেসে সারথিকে ছেড়ে বললো,’ফায়দা লুটা মানে কি বুঝলে?শারীরিক চাহিদা?উহু!!আমি সেরকম পুরুষ না।তুমি জেনে অবাক হবে আমার আর লেভেনের সম্পর্কটা এখনও শারীরিক অবধি গড়ায়নি’
‘আমার কাছে খারাপ মানে কেবল শারীরিক দিক দিয়ে না!
যে স্ত্রী থাকার পরেও মানসিক ভাবে আরেকজনের জন্য উন্মাদ আমার কাছে সেই মানুষটা খারাপ’
চলবে♥
(সর্দি-জ্বর পিছুই ছাড়ছেনা।দোয়া করবেন যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে পারি,আগেরমতন প্রতিদিন গল্প দিতে পারি)#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৪
#আফনান_লারা
________
সজীব জানে সে এখন যাই বলবে সারথির কাছে সেটাই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।তাই চুপচাপ দরজা খুলে সে বের হয়ে গেছে জামাই আদর খেতে। সেটা খেয়ে যদি মনটা ভাল হয়,বউকে দিয়ে তো মন ভাল হয়নি।
বের হতেই দাদাজান এসে সামনে দাঁড়ায় সজীবের।দুহাত দিয়ে ওকে ধরে বলেন,’খাওয়া দাওয়া ঠিক ঠাক করোনা নাকি?আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছো’
‘খাই।তবে ওখানকার খাবার আর এখানকার খাবারের তো তফাৎ আছে’
‘সেটাও ঠিক।তা কতদিনের জন্য এসেছো? ‘
‘আসলে আমি ছুটিতে আসিনি।জরুরি একটা কাজে এসেছি।এক সপ্তাহ পর চলে যাব’
‘ততদিন আমাদের এখানেই থেকো।তোমার মা তো আসছেন এখানেই’
‘মা আসছে?ওহ!কেন?আমার কথা জানিয়েছেন?’
‘নাহ,সারথির তো সকাল থেকে শরীর খারাপ।বদহজম হয়েছে।তাই দেখতে আসতেছে’
‘সারথি এ নিয়ে আমায় কিছু বলেনি,দূর্বল দেখলাম অবশ্য’
‘জানোই তো, সারথি তার অসুখ নিয়ে কাউকে বলতে পছন্দ করেনা।বুঝে নিতে হয়।চলো বাগানের দিকে, তোমার সাথে গল্প করবো’
দাদাজান সজীবকে ধরে বাগানের দিকে নিয়ে গেছেন।নাতিন জামাই আলাদা ব্যাপার স্যাপার।এদের সাথে আড্ডাটাও দারুণ জমে।তার উপর একমাত্র নাতিন জামাই।যাই বলবেন তাতেই ভেতর থেকে ভাল লাগা কাজ করবে।কত বছর পর একসাথে হলো তারা।কথার তো শেষ খুঁজেই পাওয়া যাবেনা।
ফারাজ দূরে দূরে থাকছে।যেদিন থেকে শুনেছে সজীব সারথিকে মেনে নিতে পারেনি সেদিন থেকে সজীবকে ওর ভাল লাগেনা।তাছাড়া ও সারথিকে কতটা অবহেলা করতো তার সবই ফারাজ দেখতো। সে কারণে এখন সে সজীবের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেনা।এই বিষয়টা ভাল লাগেনি মানিক সাহেবের। তিনি রেগে আছেন ফারাজের উপর।তার কথা হলো ফারাজ একমাত্র শালা হিসেবে উচিত গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করা।সেটা না করে ফারাজ বিশ হাত দূরে দূরে থাকছে।তিনি পারছেন না ফারাজকে ঠেলে পাঠাচ্ছেন।কিন্তু ফারাজ হলো মহা ঘাড়ত্যাড়া। তাকে জোর করে কিছু করানো যায়না এই নিয়ে তিনি পরিচিত বলেই চুপ করে শুধু রাগে ফুঁসে যাচ্ছেন।এর বাইরে তার কিছুই করার নেই বলে সোনালীকে ডেকে বললেন তিনি যেন ফারাজকে বলে গিয়ে সজীবের সাথে কথা বলতে।
মিসেস সোনালীর নাক অবধি কাজে ডুবে আছে,একমাত্র মেয়ে জামাই বাড়িতে আসলে বুঝি সব শাশুড়ির এমন হয়।কি রেখে কি রাঁধবেন সেটা গুছাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।পূর্ণতা,সায়না আর মতিন ও কাজে লেগে আছে।
তাও যেন কাজের লোকের অভাব।বড় বাড়ির ছেলে,কত বছর পর এসেছে।তাও আবার একমাত্র মেয়ের জামাই।২০পদ করলেও কম মনে হবে।মানিক সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে মতিনকে কাজ থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন।ফারাজ গাল ফুলিয়ে বসে আছে তখনও।সজীবকে ঘিরে যত আয়োজন হচ্ছে সে একটাতেও সামিল হতে চায়না বলেই কাজের মধ্যিখানে মূর্তি হয়ে বসে আছে।
সিয়াম,অনন্ত অর্ক চকলেট নিয়ে হইচই করছে।সজীব মার্কেটে লোক পাঠিয়ে বিশাল বিশাল দুইটা বাক্স চকলেট এনেছে শুধুমাত্র বাড়ির বাচ্চাদের জন্য,আসার পথে বিদেশী চকলেট আনার কথা ভুলে গেছিল।
এখন যেগুলো এনেছে তার থেকে মাঝারি সাইজের একটা বাক্স সারথির রুমের দিকে গেছে।
সারথি দরজা বন্ধ করে বসেছিল।মিসেস সায়না চকলেট দেয়ার জন্য কয়েকবার করে দরজা ধাক্কিয়েও সারথির সাড়া না পেয়ে চলে এসেছেন।
সজীবের সামনে এক থালা পিঠা রেখে গেছে পূর্ণতা।সজীব তখন দাদার কাছে জানতে চাইলো ও কে।দাদাজান সোজা ভাষায় বলে দিলেন ফারাজের হবু বউ।
সজীব হেসে বললো,’শালাবাবুর জন্য তো ম্যাচিউর মেয়ে দরকার।ভাইয়ের পছন্দ তো সেরকমই জানি,তা এ কেমন?’
‘হুম।এই মেয়েটা বাচ্চার মধ্যে ম্যাচিউর’
সজীব খিলখিল করে হেসে ফেললো দাদাজানের কথা শুনে।
————
সারথি সব হইচই শুনছে রুমে বসে থেকে।তার ইচ্ছে করে!! হয় নিজের জীবনটা এই মূহুর্তে নিয়ে নিতে নাহয় গিয়ে সজীবকে মেরে ফেলতে।রাগে হাত বাড়িয়ে বালিশ ফেলতে গিয়ে দেখলো হাতের কাছে সজীবের ফোন।এটা সজীবের সে জানে কারণ তার ফোন তো ফারাজের রুমে।
ফোনটা আগের জায়গায় রেখে চুপ করে আছে সারথি।সে জানে সজীবের ফোন লক করা থাকে তাই আর এটা নিয়ে গবেষণা করে নাই।
দরজার কড়া নাড়ালেন মানিক সাহেব।গলার স্বরে বোঝা গেলো ফারাজের সাথে সাথে এবার তিনি সারথির উপরও রেগে আছেন।
রেগে রেগে বললেন,’জামাই এত বছর পর এসেছে তার কাছাকাছি না থেকে দরজা বন্ধ করে রেখে কি বুঝাতে চাস সারথি??দুই ভাই- বোন মিলে কি আমার মানসম্মান ডুবাবি??এটা কেমন বেয়াদবি?ছেলেটা কি এসেছে কেবল বাবার সাথে কথা বলার জন্য?তোরা কেউ ওকে সময় দিচ্ছিস না।ওর মা কিছুক্ষণ পর এসে পড়বেন,কি ভাববেন বুঝতে পেরেছিস??তুই তৈরি হয়ে এখন ওর কাছে যাবি।আমি কিছু শুনতে চাইনা’
এই কথা বলে মানিক সাহেব চলে গেছেন।
সারথি বিছানা ছেড়ে চোখ মুছে ধীর পায়ে এসে দরজা খোলে।খুলতেই কিসের যেন আওয়াজ হলো।নিচু হয়ে হাতিয়ে বুঝলো একটা চকলেটের বাক্স।
এই বাড়িতে চকলেট কেনা হয়না।মাঝে মাঝে ফারাজ হাতে করে দুই একটা আনে বাচ্চাদের জন্য।কেনা হয়না কারণ বত্রিশ বার দাঁতের ডাক্তার এসেছে এই বাসায়।তাই দাদাজানের কড়া নিষেধে এই বাড়ি থেকে চকলেট নিষিদ্ধ হয়ে ছিল এতদিন।এখন সজীব এনেছে বলে কেউ কিছু বলবেনা হয়ত।
বাক্সটা যেখানে ছিল ওখানে রেখেই সারথি দেয়ালে হাত রেখে সিঁড়ির দিকে গেলো।সিঁড়ি অবধি এসে নামতে যেতেই নিচ থেকে সজীব বললো,’আসতে হবেনা।আমি আসছি ওখানে’
‘আমি আপনার জন্য আসছিনা।’
‘তাও আসতে হবেনা।সিঁড়িতে পড়ে যেতে পারো’
‘ছোটবেলা থেকে অভ্যাস আছে।’
‘অসুখের সময় অভ্যাস কাজে দেয়না।’
ফারাজ সোফায় বসে সব শুনছে।সারথি যে রাগ দেখাচ্ছে তাতে সে খুশি হলো।সজীবের মতন ছেলের সাথে এমন ব্যবহারই করা উচিত বলে তার মনে হয়।
সজীব মন খারাপ করে পেছনে ফিরতেই ফারাজকে দেখে এক গাল হাসি দিয়ে ওর পাশে বসলো।তারপর বললো,’কি খবর শালাবাবু।শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক?’
‘নাহ’
‘দাদাজান বললো।তা বলো কি খবর?ফোন -টোন তো দাওনা’
‘আপনি দিতেন?’
‘আমি তো ব্যস্ত থাকতাম’
‘আমিও ব্যস্ত ‘
মানিক সাহেব সব শুনে গেলেন রেগে।এক ধমক দিয়ে বললেন,’দুলাভাইয়ের সাথে কেউ এমন করে কথা বলে ফারাজ?এটা কিরকম বেয়াদবি!!সুন্দর করে কথা বলবে!’
‘আঙ্কেল সমস্যা নাই।ফারাজ তো মজা করছে আমার সাথে।আপনি বসুন না এখানে’
সারথি এক সিঁড়ি এক সিঁড়ি করে নিচে নেমে মায়ের কাছে গেছে।সজীব তখন ডাইনিয়ের কাছে এসে এক গ্লাস পানি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকালো।সারথি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। নিচে বসে ওর মা আর কাকি মাছ,মাংস কাটছেন।সারথি এখন আর ঠিক আগেরমতন নেই,চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে,ঠোঁটে সেই রঙটা নেই।কেমন যেন মনে হয় গোলাপির উপর কালচে রঙ পড়ে গেছে।যে রুপ সজীব বিয়ের আগে দেখেছিল সেই রুপ এখন নেই।মনে হয় সব কিছুর উপর একটা ছাপ বসে গেছে। এত কিছুর পরেও সারথিকে দেখতে সজীবের ভালই লাগছিল।সাধারণের মাঝেও তাকে অসাধারণ লাগছিল আজ।নিজের স্ত্রী বলেই কি!!!
মিসেস সায়না সজীবকে দেখে লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে বললো,’ভাবী আপনার মেয়েরে বলেন জামাইর কাছে যাইতে।জামাই বেচারা তো দূর থেকে দেখছে উপায় না পেয়ে’
মিসেস সেনালী মুচকি হেসে সজীবের দিকে চেয়ে এবার সারথির আঁচল ধরে টান দিয়ে বললেন সজীবের কাছে যেতে।ওর কি লাগবে না লাগবে সেটা দেখতে।
সারথি যেন শুনলোইনা।যেভাবে ছিল ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
সোনালী এবার পূর্ণতাকো ইশারা করলেন।পূর্ণতা উঠে সারথির হাত ধরে সজীবের সামনে দিয়ে আসলো।
সজীব মুখে হাসি ফুটিয়ে সারথিকে দেখছিল,সারথি তখন রাগে ক্ষোভে বললো,’আপনার ভাল মানুষীর পেছনে যে রুপ আছে সেটা কবে সবাইকে জানাবেন?’
‘যখন আমি সই করবো তখন সবাই জানবে!’
‘আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এত প্রেম কেন দেখাচ্ছেন?সবাইকে বুঝাতে চাইছেন দোষটা আপনার না, দোষটা আমার?আমি নিজের ইচ্ছেতে সব করেছি?’
‘তা নয়।অনেকদিন পর আসলাম তো।বউয়ের প্রতি তাই দরদ উতলিয়ে পড়ছে’
‘আপনার সাথে কথা বলাই আমার ভুল’
এটা বলে সারথি হনহনিয়ে চলে গেলো।দ্রুত হাঁটতে গিয়ে টেবিলরে কোণার সাথে লেগে ব্যাথা পেয়ে থেমে গেছে।সজীব ওর হাঁটুতে হাত রেখে বললো,’আমি না থাকলেও কি এমন কোণায় কোণায় ব্যাথা পাও?নাকি আমি আসাতে নিজের খেয়াল রাখা কমিয়ে দিয়েছো??’
‘আমি কারোর উপর নির্ভরশীল না।হাত সরান।আপনি প্লিজ এই মিথ্যে আদর দেখাবেননা।আমার সহ্য হচ্ছেনা এইসব’
সজীব হাত সরিয়ে নিলো।সারথি চলে গেছে আবার।ফারাজ সব দেখছে তাও চুপ করে আছে।পূর্ণতা সজীবকে দেখলো সারথির পিছু পিছু লুকিয়ে যাচ্ছে যেন সে টের না পায়।এসব দেখে মিটমিট করে হাসছে পূর্ণা।তারপর পেছনে ফিরতেই ফারাজকে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বললো,’দুলাভাইকে ওমন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছেন কেন?’
‘আপনার কি তাতে?’
‘আচ্ছা আমি বুঝলাম না,আপনি আর সারথি আপু সজীব ভাইয়াকে পছন্দ করেন না কেন?’
‘মানুষকে অপছন্দ করার পেছনে যথাযথ কারণ থাকে।আমাদের সেই কারণ আছে এবং সেটা আপনাকে বলতে চাইতেছিনা’
সেসময় দাদাজান এসে ওদের দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন,’তোমাদের দুজনকে আলাদাই করতে পারিনা আবার বিয়েও দিতে পারিনা।তোমাদের আসলে কি সমস্যা বলতে পারো?’
‘আমি ওরে বলিনি আসতে।ও এসেছে সেধে সেধে কথা বলতে’
ফারাজের কথা শুনে পূর্ণতা একমাত্র দোষী হয়ে গেলো দাদার কাছে।ঢোক গিলে সে দাদার মুখের দিকে চেয়ে আছে।তিনি আঙুল তুলে বললেন,’এতবার মানা করতে পারবোনা।আমার নেহাত মনমানসিকতা ভাল।এরপর যদি মন খারাপের সময় তোমাদের একসাথে দেখি তো দেখিও কি করি।যাও সামনে থেকে।
সারাদিন কাছাকাছি থাকবে,বিয়ের কথা বললেই দুজনে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
কি আজব দুটি মানুষ!’
ফারাজ আছে সারথির চিন্তায় এর ভেতরে বয়স্ক দুজন এসে সারাদিন এক কথা বলে।বিয়ে বিয়ে!!পূর্ণতাকে বিয়ে বিয়ে বিয়ে!!
————
সারথি সিঁড়ি শেষ করে উপরে চলে এসেছে।উঠার সময় বারবার মনে হয়েছিল কেউ তার পাশে আছে।
সজীব বিয়ের পরে শুরুতে যেমন ব্যবহার করত এখনও একই ব্যবহার করছে।তফাৎ হলো বিয়ের পরে প্রথমে সারথি জানতোনা সজীব নাটক করছে।আর এখন জানে!!
রুমের কাছে এসে থামলো সারথি।পেছনে ফিরে বললো,’আপনি আর কি চান আমার থেকে?সই তো করে দিলাম।আর কি চাওয়ার থাকে?’
‘তুমি জানলে কি করে আমি এসেছি?’
‘সেটা যদি জানতেন তবে ডিভোর্স পেপার আনতেন না আসার সময়’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৫
#আফনান_লারা
________
সজীবের হঠাৎ করে লেভেনের কথা মনে পড়লো।সারথিকে রেখে দিলো এক দৌড়।সোজা রুমে এসে ফোন অন করে মনে আসলো তার তো দেশের সিম নাই।
লেভেনকে কেমনে কল করবে।ভাবতে ভাবতে সারথির ফোনের কথা মনে আসায় সে সারথির কাছে ওর ফোন চাইলো।সারথি বলে তার ফোন হয়ত ফারাজের রুমে।সজীব যেন গিয়ে নিয়ে আসে।
ঝামেলা দেখে পরে কথা বলবে ঠিক করে ওখানেই বসে থাকে সজীব।
সারথি আর কথা বাড়ায়নি,
যেমন করে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন করেই দাঁড়িয়ে আছে।
আনাফের সকাল থেকে সারথির জন্য চিন্তা হচ্ছিল।এদিকে তার কাছে না আছে সারথির নাম্বার আর না আছে ওর বাড়ির নাম্বার।
ফারাজের নাম্বারটাও খুঁজে পাচ্ছেনা ফোনে।
তাই সে ঠিক করেছে সোজা হাবিজাবিতে যাবে বিকালের দিকে ঠিক করে হাসপাতালে বসে রুগী দেখছে সে।
সজীবের মা এসে যখন জানলেন সজীব দেশে ফিরেছে,তিনি তো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।বারবার সজীবের নাম নিয়ে ডাকছিলেন।সজীব রুমে থেকে তার ডাক শুনে বের হয়ে আসলো।মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় জানতে চাইলেন সে কেন আগে ওনার সাথে দেখা করেনি।সজীব বলছে সে কাজে এসেছে।তিনি সেটা কিছুতেই মানতে রাজি নন।সারথিকে আগে দেখতে এসেছে এটা মনে করেই তিনি রেগে আছেন।
কোনো কিছু করেও মাকে সজীব মানাতে পারছেনা।তিনি রেগে আছেন সজীবের এমন উদ্ভট কাজে।
তাই সারথির কাছে এসে শুরুতে জানতে চাইলেন সে জানতো কিনা সজীব আসার কথা।তারপর যখন জানলেন সেও জানতোনা তারপর তার রাগ কমলো।
হাসি মুখে বললেন সারথি যেন ভাল শাড়ী পরে একটু সেজে নেয়।সারথি মাথা নাড়ালো কিন্তু কিছুই করলোনা।এরপর তিনি কথাটা পূর্ণতাকে বললেন।এটাও বললেন সে যেন জোর করে সারথিকে সাজিয়ে দেয়।
মিসেস সোনালীর থেকে একটা শাড়ী নিয়ে পূর্ণতা গেলো ওকে সাজাতে।জোরজবরদস্তি করতে হয়নি।সারথি কেমন যেন মনমরা হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।সজীবের চেহারা বর্ণনা দিতে দিতে পূর্ণতা ওকে শাড়ী পরিয়ে দিয়েছে,চুল বেঁধে দিয়েছে,বাগান থেকে ফুল এনে চুলে গুজেও দিয়েছে।হাতে বালা পরিয়ে দিয়েছে,ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়েছে।তার মতে সজীব যেমন সারথিকে পেয়ে জিতেছে তেমনি সারথিও জিতেছে।কারণ সজীব সব দিক মিলিয়ে একেবারে সুদর্শন পুরুষ।হাইট,ওয়েট,ব্যবহারের বর্ণনা দিতে দিতে শেষ পূর্ণা।সারথির কাছে সব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।কারণ মানুষের বাহ্যিক কোনো কিছু দেখে আসলেই জাজ করা উচিত না।সে ভেতরে খুব ভাল হতে পারে আবার খুব খারাপ ও হতে পারে।
সারথির চোখে সে প্রচণ্ড খারাপ।
পূর্ণতা সারথিকে সাজিয়ে চলে গেছে সজীবকে ডাকতে।
সারথি জানে সজীব এখন রুমে আসবে তাই সে বের হয়ে গেলো।বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বাগানে নেমে গেছে সে।পায়ে জুতা নেই।তাড়াহুড়া তে নিতে ভুলে গেছে।
আগে সজীব আসার কথা শুনলে সারথির কত আয়োজন থাকতো আর আজ সে নিজে পালাচ্ছে সজীবের কাছ থেকে।খালি পায়ে কঙ্করে পাড়ি জমিয়ে হাঁটছে সে।
শুরুতে সব ঠিক ছিল কিন্তু হঠাৎ পায়ের ব্যাথাটা তীব্র হয়ে গেলো।মনে হয় কিছু একটা ফুটেছে।তা না খেয়াল করেই সারথি পথ চলছে।যেদিকে পা চলবে সেদিকে যেতেই থাকবে।বাড়ি থেকে অনেকটা পথ সে এসে গেছে।কোলাহল কমে যাওয়ায় হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো সে।
দম ফেলে মুচকি হাসলো।যাকে সে চায়না তার থেকে দূরে আসতে পেরে ওর ভাল লাগা কাজ করছে মনের ভেতর।হাসি মুখে এক কদম ফেলতেই টের পেলো তার পায়ে অসহনীয় ব্যাথা।
হাত নিয়ে পা ধরে ভেজা ভেজা কিছু বুঝতে পেরে নিচে রাস্তায় বসলো সে।তারপর হাত দিয়ে ধরে দেখার চেষ্টা করলো কি হয়েছে।ব্যাথা করছে তার মানে এগুলো রক্ত।
রাস্তায় পা ডলে সারথি আবার উঠে দাঁড়ায়।আরও দূর যেতে হবে ভেবে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করলো সে।ওমনি একটি মিষ্টি গন্ধ এসে লাগলো নাকে।নাকটা ডুবে গেছে এক নরম শীতল জায়গায়।এই জায়গার সুবাস তার অনেক চেনা।চোখ বন্ধ করে এক আলাদা দুনিয়ায় চলে গিয়েছিল সে।পরে হুশ ফিরায় হাত বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করেই পিছিয়ে গেলো সারথি।ওটা আনাফ!
আনাফ কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আর এক মিনিট আমার বুকে মাথা রাখলে কি এমন হতো?জানেন আমি নিজেও আলাদা জগতে চলে গেছিলাম?’
‘সেই জগতে কি সবুজ গাছ ছিল?’
‘নাহ,শুকনো পাতার শহর ছিল।কেন বলুন তো?’
‘আমারও। ভাল!আপনি এখানে কি করেন?আমি যেখানে যাই আপনাকে খবর কে দেয়?’
‘তার নাম মিঃ মন’
‘সে কে?’
‘বুঝবেননা।পায়ে কি হয়েছে দেখি’
কথাটা বলে আনাফ নিচে বসে সারথির পা ধরতেই সে সরে যাবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা,আনাফ শক্ত করে ধরে রেখেছে।মাথা তুলে সে আবার বললো,’বলতে বাধ্য হচ্ছি,যারা চোখে দেখেনা তদের ভুলেও যে কাজটা করা উচিত না সেটা হলো জুতা ছাড়া বের হওয়া।পায়ের হাল কি করেছেন জানেন?দেখে মনে হয় অগ্নি পথ পাড়ি দিয়ে আসছেন’
সারথি চুপ করে আছে।আনাফ পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,’আমি ডাক্তার বলেই কি আপনার এত অসুখ?’
‘রোগীর রোগ হলেই তো ডাক্তাররা খুশি হয়’
‘সেক্ষেত্রে আমি ব্যাতিক্রম।কারণ আমি নিজের খরচ দিয়ে রোগী দেখি।যেমন ধরুন এখন আমার রোগী দেখার সময়।৪০টা রোগী রেখে আমি আপনার সাথে দেখা করতে হাবিজাবি এলাকাতে ঢুকেছি।ভাবতে পারছেন কত খরচা গেলো?একটা রোগীর থেকে ভিজিট ৭০০টাকা নিই।৪০জন থেকে কত আসে হিসেব করেন দেখি।ফারাজ বলেছে আপনার হিসেবের মাথা কড়া’
‘মুড নেই।আপনার রুমাল সরান।আমার হাঁটতে অসুবিধা আরও বেশি হবে’
‘আপনাকে হাঁটতে দেবে কে?আমি এখন সিনেমার নায়কদের মতন আপনাকে কোলে তুলে গাড়ীতে নিয়ে বসাবো।সবাইকে দেখিয়ে দিব ডাক্তাররাও নায়কের রোল করতে পারে’
‘খবরদার বলছি!’
‘আপনাকে এর আগেও কোলে নিয়েছিলাম।হয়ত ভুলে গেছেন।মনে করিয়ে দিচ্ছি।শেষবার নদীতে ডুবে মরতে গেছিলেন না?তখন আমি আপনাকে পানি থেকে তুলে সোজা হাসপাতালে নিছিলাম।দেখতে যতটা মোটা লাগে আসলে আপনি তা নন।মনে হচ্ছিল পেঁপে গাছ তুলেছি।’
‘আমি হেঁটে যেখানে যাবার যাব,আপনাকে সঙ্গ দিতে হবেনা।সরুন সামনে থেকে’
‘আনাফ যতদিন আছে ততদিন সারথির কপালের ঘাম,আর চোখের পানি নিচে পড়ার আগেই মুছে যাবে’
‘আপনার আসলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়াই উচিত ছিল।আপনাকে ডাক্তার বলতে গেলে আমার মনে হয় ঠাট্টা করছি’
‘আসলেই!!অধরা আপনাকে এই ইতিহাস বলে দিয়েছে?আজকালকার ননদ গুলা এমন কেন!’
সারথি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে ছিল।আনাফ হাসতে হাসতে হঠাৎ ওর চোখ গেলো সারথির দিকে।সারথি আজ সেজেছে এটা সে খেয়ালই করেনি এতক্ষণ।সেজেছে বলতে একেবারে ভীষণ সুন্দর করে সেজেছে।লাল পাড়ের সাদা শাড়ী,খোঁপায় ফুল
গলায় হার,হাতে বালা।আনাফ হা করে শুধু দেখে যাচ্ছে,সেসময় সারথি নড়ে দাঁড়াতেই ওর মাথায় আটকানো মাধবীলতা ফুলগুলো নিচে ঝরে পড়ে গেলো।আনাফ সেগুলো তুলে ওর মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে ছিল।
———
সজীব এসে দেখে রুমটা খালি পড়ে আছে।সারথি কোথাও নেই।তাই সে রুমে না ঢুকে বাহিরে এসে পূর্ণতার কাছে জানতে চাইলো সে কোথায়।পূর্ণতা বললো সে জানেনা।
তাই সজীব নিজেই বের হয় সারথিকে খোঁজার জন্য।
——–
ওদিকে আনাফ সারথিকে নিয়ে যাবার জন্য ওর সাথে কথা কাটাকাটি করছিল ঠিক সেসময় দূর থেকে শোনা গেলো ডাক।
আনাফ দেখে সেই দূর থেকে সারথির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একটা মানুষ ছুটে আসছে।
আনাফ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো।সজীব কাছে এসে সারথির সামনে গিয়ে বললো,’এটা কি সারথি??না বলে চলে আসলে?আমার জন্য সাজলে আর আমায় দেখালে না?’
এই কথা বলে সজীব আনাফকে দেখে মুচকি হেসে বললো,’আমার স্ত্রী। নিশ্চয় রোডে এক্সিডেন্ট করতে নিছিলো?ও এমনই করে।আপনি বাঁচিয়েছেন?অনেক ধন্যবাদ।ওহ পরিচয় তো দিলাম না।আমি সজীব!!এন্ড ইউ??’
আনাফ সজীব নাম শুনে তব্দা খেয়ে গেছে।কোনোমতে হাত উঠিয়ে হাত মিলিয়ে বললো সে আনাফ।
সারথি যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে আছে।সজীব ওর হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য টান দিতেই সারথি পায়ের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।আনাফ কিছু চেয়েও করতে পারেনি।চুপ করে সব দেখছে শুধু।
‘কি হয়েছে সারথি?কোথাও ব্যাথা পেয়েছো?’
‘নাহ।আপনি চলে যান।আমি যাব না’
‘কেন যাবেনা?’
‘কি দরকার যাওয়ার?জোর করবেন না।আমাকে একা থাকতে দিন’
সজীব এগোলো কোলে নেয়ার জন্য।আনাফ হাত মুঠো করে এসব তাকিয়ে দেখছে শুধু।ভেতরে যেন কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে কেউ।সহ্যই হচ্ছেনা ওর।
————-
ফারাজ একটা পথ খুঁজছিল পূর্ণাকে ধরার জন্য।সে সারথিকে সাজিয়ে তৈরি করেছে এটা নিয়ে ফারাজ ওর উপর ভীষণ ভাবে রেগে আছে।এতই রাগ যে পারছেনা দাদাজানের সামনে দিয়ে গিয়ে ওকে ধরতে।
অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে সে ছিল পূর্ণতাকে একান্তে পাবার।কিন্তু কাজের এতই চাপ যে সে ওকে একাই পাচ্ছেনা।একবার একজন থাকছে পাশে।
পরে যখন সবাই কাজ শেষ করে বাগানের দিকে গেলো তখন ফারাজ ঠিক করলো এবার ধরবে ওকে।
পূর্ণা হাত ধুয়ে সেও যাচ্ছিল বাগানের দিকে,তখনই পথ আটকে দাঁড়ায় ফারাজ।
চোখ মুখ ফুলা দেখেই পূর্ণা আন্দাজ করে ফেলেছে কিছু একটা বলবে,করতেও পারে।
পরিস্থিতি সামলে পূর্ণতা জানতে চায় কি হয়েছে।এভাবে পথ আটকানোর মানে কি।
‘আপনি আমার বোনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ আর করবেন না’
‘কি করেছি?’
‘ও চায়না সাজতে,আপনি তাও সাজালেন কেন?’
‘আমাকে ওনার শাশুড়ি বলেছিল’
‘তো?? বলছে তো কি হয়েছে?আমার বোন যেটাতে সহজবোধ করবে সেটাই করবে।জোর কেন করবেন?’
‘করিনি।আপু চুপ ছিল।মানা করলে আমি করতাম না’
‘আর কখনও এমন আরেকজনের কথা ধরে কিছু করবেননা।ভেতরের খবর সবাই জানেনা। ‘
পূর্ণতা ঠিক আছে বলে আসা ধরতেই ফারাজ আবারও ওর পথ আটকালো।
কি ভেবে বললো,’সরি’
‘সরি কেন?’
‘জানিনা।এমনি মনে হলো বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছি’
‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,এবার ঘুঘু তোমার বধিবো পরাণ’
এই কথা শুনে ফারাজ আর পূর্ণতা একসাথে তাকায়।আজিজ খান কোমড়ে হাত রেখে চেয়ে আছেন।মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।
‘তোমাদের তো একসাথে একা বাসায় ধরেই ফেললাম।এবার বলো বিয়ে আজ করবা নাকি কাল সকালে?’
ফারাজ আর পূর্ণতা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে বারবার।শেষে বাধ্য হয়ে ফারাজ বললো,’আপনি ভুল দেখেছেন দাদা’
‘আমি ভুল হতেই পারিনা।আমার চোখের স্পষ্টতা জানো??আমি এক দেখায় বলে দিতে পারি মানুষটা কিরকম!আর সেখানে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কাহিনী বুঝবোনা??এখনই আমি বেলায়েতকে ডাকবো।ডেকে বলবো তোমাদের একসাথে একা বাড়িতে আমি পেয়েছি।এটাই ছিল শেষবার।এবার তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেবার পালা’
———–
সজীব কোলে নিতে চাইছে কিন্তু সারথির কারণে পারছেনা।সে ধমক দিয়ে বলে দিলো তাকে যেন সজীব ছোঁয়ার চেষ্টা না করে।আনাফ সব দেখছিল,একটা সময়ে সারথির মাথা ঘুরে উঠলো,সে শেষবারের মতন মৃদু স্বরে বললো তাকে যেন সজীব না ধরে।
সজীব ওকে দূর্বল হতে দেখে আরও আগলে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু এবার সারথি নিজ থেকেই সরে গেছে।
আনাফের ইচ্ছে করছে সজীবকে সরিয়ে সারথিকে নিজের কাছে নিয়ে আনতে কিন্তু সে পারছেনা।
“একবার যদি সারথি বলতো সে আমায় চেনে তাহলে এই অধিকারবোধটা দেখাতে আমার সময় নিতে হতোনা।”
চলবে♥