#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৪৬
নীলের কন্ঠ শুনে যেন আমার বুকের ভেতরটা ছেদ করে উঠল।
এর মধ্যেই রুমের বাইরে থেকে পুরুষালি কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো
– রুবাইয়া তোমার নানা, নানু এসেছে বাইরে এসো।
রুবাইয়া চমকে উঠল। মনোযোগ দিয়ে কোনো কিছু পড়লে সেটাতে ব্যাঘাত ঘটলে বা আচমকা কোনো শব্দ আসলে যেমনটা চমকায় সেও তেমনটায় চমকে উঠেছে। ডায়রিটা দ্রূত পড়ে শেষ করবে নাকি রুম থেকে বের হবে সে চিন্তায় মগ্ন সে। এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে সে, এরপর কী হলো জানার জন্য তার মনটা ছটফট করতে লাগল। মায়ের ডায়রি সবসময় যে কাছে পাবে সে সুযোগ ও নেই। ছোট থেকেই তার মা এ ডায়রিতে কী যেন লিপিবদ্ধ করত। ছোটবেলায় তার এসব জানার আগ্রহ না জাগলেও বড় হওয়ার পর মায়ের ডায়রিতে কী আছে সেটা জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। মূলত ওর বয়সটায় এমন, সকল নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি টান আকর্ষণ আর জানার আগ্রহ কাজ করে৷ ডায়রিটা সবসময় ড্রয়ারে লক করা থাকলেও আজকে তার মা লক করতে ভুলে গেছে।
এদিকে রুবাইয়া এখনই কী ডায়রি পড়ে শেষ করবে নাকি নানা নানুর সাথে গিয়ে আগে দেখা করবে? কী করবে সে বুঝতে পারছে না। এর মধ্যেই পুনরায় ডাক আসলো। রুবাইয়া রুমে থেকেই জবাব দিল
– দাদাভাই…… আসছি। একটু অপেক্ষা করো।
– তাড়াতাড়ি এসো। উনারা এসে অপেক্ষা করছে। কতদিন পর এসেছে। এখনই চলে যাবে। তোমাকে দেখতে শুধু এসেছে। রাতও হয়ে যাচ্ছে। একটু জলদি এসো।
রুবাইয়া ডায়রিটা বিছানার পাশেই রেখে দিল। রুবাইয়া হলো সিঁথির সেই মেয়ে যে এত সংগ্রাম করে পৃথিবীতে এসেছিল। আর এতক্ষণের কাহিনিটাও রুবাইয়ায় বসে তার মায়ের ডায়রিতে পড়ছিল।
এখন শুধু প্রশ্ন একটায় জাগছে, সেদিনের পর কী ঘটেছিল? সেদিন নীল আর সিঁথির জীবনে কী নতুন ঝড় এসেছিল নাকি সব শান্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রশ্নটা আপাতত অখন্ডায়িত রেখেই কাহিনির সামনে এগুনো যাক।
রুবাইয়া ঘর থেকে বের হয়ে দেখল তার নানা নানু বসে আছে সোফায়। রুবাইয়ার বয়স ষোলোতে পড়ল। মায়ের সমস্ত সৌন্দর্য যেন রুবাইয়ার সারা শরীরে ফুটে উঠেছে। চুলগুলোও হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে। তার চোখগুলোও বলে দেয় মায়ের কিছু ছাড়েনি সে। রুবাইয়া আসতেই সিঁথির বাবা, মা তাকে অপলকভাবে দেখতে লাগল। সিঁথির ষোলো বছরটায় যেন তারা এখন রুবাইয়ার মাঝে দেখতে পারছে। যদিও তারা যতবার আসে ততবারেই রুবাইয়ার মাঝে ছোটবেলার সে সিঁথিকে খুঁজে পায়। সিঁথির বাবা, মা রুবাইয়ার দিকে ক্ষণিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হালকা হেসে জিজ্ঞেস করল
– নানু মনি কেমন আছো? ঘরে কী করছিলে?
রুবাইয়া হালকা হাসলো। তার হাসিটার বিস্তৃতিও মায়ের মতোই। হাসিটার বিস্তার রেখেই জবাব দিল
– একটু বসে ছিলাম।
– তোমার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছি। তোমার প্রিয় চকলেট। তবে একদিনে বেশি খেয়ো না।
চকলেটের কথা শুনে যেন তার মুখে আরও বেশি হাসি প্রস্ফুটিত হলো। বেশ জোরেই আনন্দিত হয়ে জবাব দিল
– আচ্ছা বেশি খাব না প্রমিস।
সময়ের অভাবে গল্পের আসর তেমন জমে উঠেনি। সিঁথির বাবা, মা.., সিঁথি বাসায় আসার পূর্বেই চলে গেছে। নীলের বাবা অনেক বলার পরও তারা থাকেনি। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক গুলো কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়। চাইলেও সেটা আগের মতো ঝাঁকঝমক করা যায় না। নীলের বাবা আর সিঁথির বাবার বন্ধুত্বটাও আগের মতো নেই। হয়তো সময়েই সব মলিন করে দেয়। একটা দুটো বছর না পুরো ষোলোটা বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। সিঁথি এখন একজন আদর্শ ডাক্তার। শত সংগ্রামের পরও সে তার স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তার বয়স ৩৩ এ পা দিয়েছে মাস কয়েক হলো। নীলের মা মারা গেছে সেই ষোলো বছর আগেই। অত্যাধিক ধাক্কা সামলাতে পারেননি তিনি। মিহু সুনীলের সাথেই আছে। মিহু এখন তিন সন্তানের জননী। ৩,৪ বছর পর পর দেশের মাটিতে আসে তবে খুবই নগন্য সময়ের জন্য। তামান্নার বিয়ে হয়েছে ৮ বছর হলো। তারও এখন দুই সন্তান৷ সব মিলিয়ে সময়ের সাথে সব পাল্টে গেছে।
মফস্বলে থাকা সিঁথি এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েই শহরে চলে আসে। শ্বশুড়ের সাপোর্টে আর নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে সে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে সক্ষম হয়। সে সময়টা তার জন্য অনুকূলে ছিল না। একে একে প্রাণপ্রিয় স্বামীর করুণ পরিণতি আর তার শ্বাশুড়ি মায়ের অকাল মৃত্যু সিঁথিকে বেশ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। সে ভেঙে গুড়িয়া দেওয়া জীবনটাকেই সে পুনরায় মেরামত করে হয়ে উঠে আজকের একজন সাফল্য ডাক্তার।
সিঁথির বাবা, মা চলে যাওয়ার পর রুবাইয়া পুনরায় ঘরে আসলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন ১০ টা বাজে। ১১ টার মধ্যেই তার মা চেম্বার থেকে চলে আসবে। এর আগে পুরো ডায়রি তার পড়ে শেষ করতে হবে৷ সে পুনরায় ডায়রি খুললো। পৃষ্ঠাটা উল্টিয়ে হতাশ হলো। পরবর্তীতে কী হয়েছিল সে কাহিনি এখানে লিপিবদ্ধ নেই। লিপিবদ্ধ আছে কতগুলো উড়োচিঠি যেটা তার মা, বাবাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে। রুবাইয়ার মনে শুধু প্রশ্ন জাগছে তার বাবা কোথায়? জন্মের পর থেকে সে তার বাবাকে দেখেনি। তার বাবা যদি মরে যেত তাহলে নামের পাশে অন্তত মৃত শব্দটা একবার না একবার কেউ জুড়ে দিত। সে বড় হওয়ার পর যতবার তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করেছে ততবার তার মা আর দাদা কথাগুলো এড়িয়ে গেছে। কারণ সে সময়টায় কথা কাটিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে দিত। একটা সময় পর রুবাইয়াও হাল ছেড়ে দেয়। সময়ের সাথে সাথে সে ও তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দেয়। তলিয়ে পড়ে বাবাকে নিয়ে তার অযাচিত সকল প্রশ্ন।
কিন্তু আজ ডায়রি পড়ে তার মনে একটায় প্রশ্ন জাগছে সেদিন তার বাবার সাথে কী এমন হয়েছিল? তার বাবা কী আদৌ বেঁচে আছে? নাকি মারা গেছে? নাকি সে কাহিনির পরও রয়েছে নতুন কোনো কাহিনি নতুন কোনো ঘটনা। তার মনটা ছটফট করতে লাগল পরে কী হয়েছে জানার জন্য৷ ডায়রির পাতা গুলো বেশ উল্টাতে লাগল। বাবাকে উদ্দেশ্য করে লেখা মায়ের চিঠি গুলো পড়ে কাহিনির সার সংক্ষেপ বুঝার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ছোট মাথায় চিঠির মধ্যে ডুবে থাকা অন্তর্নিহিত বিস্তর ঘটনা ঢুকেনি।
সে কাহিনির পর প্রায় ছয় মাস সিঁথি কোনো কিছু ডায়রিতে লিখেনি। হয়তো রুবাইয়াকে নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল। প্রায় ছয়মাস পর সিঁথি নীলকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লেখে
#প্রিয় ডাক্তার সাহেব
তোমার ঠিক বিপরীত প্রান্তে আমি অবস্থান করছি। ভালো লাগছে না কিছুই। না পাওয়া আমাকে ভীষণভাবে গ্রাস করছে। রুবাইয়ার দিকে তাকালে আমার কলিজা ফেটে যায়। মাকে হারিয়ে আমি আরও নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। সামনে পরীক্ষা কী করব বুঝতে পারছি না। তুমি বলেছিলে আমাকে ডাক্তার হতে হবে। কিন্তু তুমি বিহীন আমি কীভাবে সামনে এগিয়ে যাব? তোমাকে ছাড়া যে আমি বিলীন হয়ে যাচ্ছি। মেয়েটার জন্য পারছি না নিজেকে কড়াল গ্রাসে তলিয়ে দিতে। তুমি এমনটা না করলেও পারতে। কেন তুমি এভাবে সব কিছু জেনেও এমন করলে? তোমাকে ছাড়া আমার থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। আমার রুবাইয়াও তোমার কাছে যেতে চায়। তুমি কেন একা করে দিলে এভাবে? আজ ভীষণ একা আমি। এ একাকীত্বের সঙ্গী হতে যেন আমার শরীরের ছায়াও চাচ্ছে না। সে ও যেন পালিয়ে বেঁচে মরতে চায়। একদিনে মরে গেলে হয়তো কষ্ট কম হতো। তবে প্রতিদিন মরতে মরতে আমি হতাশায় ডুবে যাচ্ছি। আমি তোমাকে আবারও ফিরে পেতে চাই। ফিরে পেতে চাই আমার সেই দিন গুলো। আমার কাছে ফিরে এসো। কবে এসে বলবে সব ঠিক হয়ে গেছে আমি চলে এসেছি। আমি তোমাকে পেতে চাই ভীষণ ভাবে পেতে চাই। আমার সারাজীবনের সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই।
ইতি তোমার বউ সিঁথি তোমারেই পাগলি বুড়ি।
রুবাইয়ার চোখটা ছলছল করছে কথাগুলো পড়ে। মায়ের আর্তনাথ যেন সে টের পাচ্ছে। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করছে তার। বাবার শূন্যতার চেয়ে একজন স্ত্রী এর স্বামীর শূন্যতার হাহাকার সে টের পাচ্ছে। না জানি তার বাবা কোথায় গিয়েছে। কী হয়েছিল সেদিন সেটার ব্যাখ্যা রুবাইয়ার কাছে নেই। নিজের নামের কথাটা ভাবতেও তার বাবার কথা মনে পড়ছে। তার নামটা যে তার বাবায় দিয়েছিল সেটা আজ জানতে পরেছে।
পাতাটা উল্টালো ডায়রির। পরের চিঠিটা পড়ল সে
#প্রিয় ডাক্তার সাহেব
সারাক্ষণ তোমাকে মনে পড়ে। পরীক্ষা গুলো দিয়েছি বেশ কষ্ট করে। তোমার কথা রাখতে হলেও আমাকে ডাক্তার হতে হবে। তবে তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারছি না। তুমি কী আমার হাহাকার টের পাও না? কেন এভাবে সবটা এলোমেলো করে দিলে? আমি তোমাকে চাই আমার সন্নিকটে একদম নিকটে। তোমার বাহুডোরে নিজেকে আগলে নিতে চাই। ভালোবাসি তোমায়। জানো রুবাইয়া আধো আধো গলায় বাবা, বাবা বলে ডাকে। রুবাইয়ার মুখে ডাকটা শুনলে যেন আমার কলিজা ভেদ করে যায় কিছু। সময় টা কেন এত নিষ্ঠুর হলো। সময় কী পারত না একটু সুন্দর হতে। এই একাকীত্ব থেকে মুক্তি চাই।
তোমার পাগলি বুড়ি।
রুবাইয়ার চোখ দুটো আরও ভিজে আসলো। মায়ের হাহাকার মাখা চিঠিগুলো তার বুকে কম্পন তুলছে। পরের পৃষ্ঠাটা উল্টাতে যাবে এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। রুবাইয়া ঝটপট ডায়রি রাখতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল। এর মধ্যেই তার মা রুমে প্রবেশ করল। রুবাইয়ার দিকে ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকাল।
চলবে?
কপি করা নিষেধ