#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১৬
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রেনু বেগম আর উনার স্বামী শফিক ইসলাম ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন।একাধারে কলিংবেল বাজাতে দুজনেই বিরক্ত হয়।রেনু বেগম উঠে এলেন,একটু আগেই তো বন্যা ফিরে এলো এখন আবার কে এলো? দরজা খুলে দেখেন আফিয়া বেগম ক্ষিপ্ত দৃষ্টি মেলে উনার দিকে তাকিয়ে আছে পেছনে মোবারক সাহেব।রেনু বেগম মনে মনে আন্দাজ করলেন যে কিছু সমস্যা হয়েছে উনি হাসার চেষ্টা করে বললো,
“কি ব্যাপার ভাবী?”
উনার কথায় যেনো আফিয়া বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।
“কি ব্যাপার!আপনার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন কি ব্যাপার?”
উচ্চকন্ঠে কথা শুনে শফিক ইসলাম এগিয়ে আসে।রেনু বেগম থমথম খেয়ে বললো,
“বন্যা!কি করেছে বন্যা?”
“কি করেনি তা বলেন।আমার লক্ষী ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেতেও দ্বিধা করেনি।”
শফিক ইসলাম গম্ভীর গলায় বললো,
“কি যা তা বলছেন বন্যা এমন মেয়ে না।”
উনার কথা শুনে যেনো আফিয়া বেগম আরো বেশী রেগে যায়।
“যা তা বলছি?শুধু মেয়ে জন্ম দিলেই হয় না কই যাচ্ছে কি করছে এসব ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয়।এমনিতেই মেয়ে নষ্ট তার উপর আমার ছেলেটার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছেন।”
উনার কথা শুনে রেনু বেগম আর শফিক ইসলাম দুজনেই হতভম্ব।এই মহিলা কি বলে?মাথা নষ্ট নাকি?উনারা কেনো ছেলের পেছনে মেয়েকে লাগাতে যাবে?
রেনু বেগম এবার গম্ভীর গলায় বললো,
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না।আমরা আমাদের মেয়ে আপনার ছেলের সাথে লাগিয়ে দেইনি।”
“তা দেননি কিন্তু বাড়িওয়ালার ছেলে দেখে লোভ ও তো সামলাতে পারেননি।”
শফিক ইসলাম অবাক হয়ে বললো,
“আপনি আমাদের বাড়ির লোভ দেখাচ্ছেন?”
“তা দেখেই তো মেয়েকে দিয়ে আমার ছেলেটাকে আধাপাগল বানিয়েছেন।”
কান্নায় রেনু বেগমের গলা রোধ হয়ে এলো কিন্তু কান্না না করে বললো,
“ফালতু কথা বলবেন না।আমার মেয়ে এমন না।”
আফিয়া বেগম সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“একশো বার বলবো।অসভ্য মেয়ে একটা।”
রেনু বেগম নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে।মোবারক সাহেব আফিয়া বেগমের হাত ধরে বললো,
“চুপ করো।এভাবে সমাধান হবে না।এসব নিয়ে পরে কথা হবে।বাসায় চলো।”
স্বামীর কথায় আফিয়া গা করেনা।
“কিসের পরে কথা হবে?এখনই যা বলার বলবো,এই অসভ্য মেয়ে নিয়ে আজকেই বাসা ছেড়ে চলে যাবেন।যদি না যান তো খারাপ হবে।”
এই কথা বলে আফিয়া হনহন করে চলে যায়।মোবারক সাহেব স্ত্রীর কথায় বেশ বিব্রত বোধ করে।শফিক ইসলাম আর রেনু বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওর কথায় কিছু মনে করবেন না ভাই।আসলে হুট করে এসব শুনে মাথা ঠিক নেই।”
উনি চলে যাবার পর রেনু চুপচাপ ভেতরে আসে।বন্যা তার রুমের দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে,চোখে হতবিহ্বল ভাষা।রেনু বেগম কোনোদিকে না তাকিয়ে বন্যার দিকে এগিয়ে যায়।বন্যার সাথে যে তাহসানের কিছু আছে তা উনি আন্দাজ করেছিলো এমনকি বন্যাকে জিজ্ঞেসও করেছিলো কিন্তু বন্যা বলেছে তারা নাকি বন্ধু এর বেশী কিছু না।মেয়ের এমন উড়নচণ্ডী ভাব রেনু বেগমও কখনো ভাবেনি বন্যা যে এমন কিছু করবে।বন্যা মাকে সামনে এগিয়ে আসতে দেখে কিছু বলতে চায় তার আগেই রেনু বেগম শরীর কাঁপিয়ে ভয়ানক এক থাপ্পড় দিয়ে দেয়।থাপ্পড় দিয়ে থামে না বন্যার দু গালে সজোড়ে হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,
“এসব শোনানোর জন্য বেঁচে ছিলি?”
বন্যার চোখ উপচে পানি পড়ে।কথা বলার চেষ্টা করে,
“আম্মা…”
রেনু বেগম শব্দ করে কাঁদছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“সেদিনই ম,রে গেলি না কেনো?ম,রে গেলে তো আজকে এই দিন দেখতে হতো না।সারাজীবন আমাকে মানুষের কথা শোনানোর আয়োজন করতেই তুই ব্যস্ত।তোরে জন্ম দেয়া আমার জন্য পাপ ছিলো।আজকে এইসব শোনার পরে আমার মন চাচ্ছে আমি ম,রে যাই।”
বন্যা দু’দিকে মাথা নেড়ে বললো,
“আম্মা এসব….. ”
রেনু বেগম কড়া গলায় শাসিয়ে বললো,
“সব সত্যি?বল মিথ্যা বলবিনা।”
বন্যার বুকে কেমন ধিমধিম করে ভ,য় নেচে উঠে।ভ,য়ে দম বন্ধ হয়ে আসে।কিন্তু এখন মিথ্যা বলা মানে ভালোবাসা অস্বীকার করা,কিন্তু যে একবার ভালোবাসার সুধা পান করে সে কি করে অস্বীকার করবে?সাহসী বন্যার মূহুর্তেই কেমন গা নড়েচড়ে যায় সে মাথা নিচু করে বললো,
“হ্যাঁ।”
তিনি আবারো বন্যাকে আঘাত করে।প্রচন্ড শব্দ হয়ে বন্যা দরজায় ছিটকে পড়ে।রেনু বেগমের হাত ধরে শফিক ইসলাম আটকে দেয়।বন্যা গালে হাত দিয়ে হতবিহ্বল হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।শফিক ইসলাম বললো,
“পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
রেনু বেগম চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বললো,
“তুমিই বলো,এই মেয়ের জন্য কোন মানুষের কথা শুনিনি,যে পারে সেও বলে যে পারেনা সেও বলে কিন্তু কারোর কোনো কথা গায়ে মাখিনি কেননা আমার মেয়ের তো কোনো দোষ ছিলনা।এখন?এখন যে উনি এতোগুলা কথা শুনিয়ে গেলো এই কথাগুলোর কি জবাব দেবো।আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতেও দ্বীধা করেনি।”
বন্যা বাবা মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারছে।তাহসানের মা যে এমন করে বাসায় এসে অপমান করে যাবে এটা সে ভাবেনি।আর অপমান করেছে তো করেছে তার মা বাবাকেও করেছে অথচ উনারা এই ব্যাপারে জানতেন না।বন্যা মায়ের কথায় ফুপিয়ে উঠে।এলোমেলো চোখে এদিক ওদিক তাকায়।
রেনু বেগম কিছু না বলে রুমে চলে যায়।শফিক সাহেব মেয়ের কাছে আসে।বন্যা উনার আপন মেয়ে না হলেও আপনের চেয়েও বেশি।কখনো কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেনি।আফিয়া বেগমের এমন কথা শুনে উনারও মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু রেনু শাসন করাতে আর কিছু বলেননি।বাবা মা দুজনে একসাথে শাসন করা মানে ছেলেমেয়ের মনোভাব নষ্ট করা।কান্নারত বন্যার মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“কাঁদিস না।রেগে আছে,পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
উনি চলে যাবার পরেও বন্যা পাথরের মতো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর রুমে গিয়ে ফোন হাতে নেয়।এই সম্পর্কের আজকেই রফাদফা করতে হবে।
তাহসান রুম থেকে বেরিয়ে মা বাবা কাউকে পায় না।সদর দরজা হাট করে খুলে রাখা।দরজা খুলা দেখেই সে বন্যাদের বাসার দিকে ছুটে যায়।সে ভাবেনি তার বাবা মা যে এখনি তাদের বাসায় যাবে জানলে ফ্রেশ হতে যেতো না।দুই তলায় এসেই বাবা মাকে বিবস মুখে আসতে দেখে।সে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে,আফিয়া বেগমের মুখ অন্ধকারের কালো ছায়ায় লেপ্টে আছে।তাহসানকে দেখে উনি বললেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
তাহসান উত্তর না দিয়ে ফের প্রশ্ন করলো,
“তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?”
আফিয়া বেগম শান্ত গলায় বললো,
“শফিক সাহেবদের বাসা ছাড়ার ওয়ার্নিং দিয়ে এলাম।”
তাহসান হতবাক হয়ে বললো,
“পাগল নাকি?বাবা তুমিও?”
কিন্তু তাহসানের কথা শোনার সময় উনাদের নেই।পা চালিয়ে উপরে চলে গেছে।তাহসান সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।একবার ভাবে বন্যাদের বাসায় যাবে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে কি বলেছে।আবার ভাবে এখন গেলে সবাই খারাপ ভাববে।এরচেয়ে ভালো আগে জানতে হবে কি কথা হয়েছে।তখনি ট্রাউজারের পকেটে রাখা ফোনটা তারস্বরে চেচিয়ে উঠে।এমিন সময় ফোন আসাতে তাহসান যারপরনাই বিরক্ত কিন্তু স্কিনে ভেসে উঠা নাম্বার দেখে মুখের বিরক্তিভাব নিমিষেই উধাও হয়ে যায়।ফোন রিসিভ করে তাহসান বললো,
“হ্যালো।”
বন্যা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
“ছাদে আসেন।”
বন্যার এরূপ কণ্ঠ শুনে তাহসান আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলার সাহস পেলো না।ছোট জবাবে বললো,
“আসছি।”
বন্যা ফোন কেটে নিঃশব্দে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।তাহসান চুপচাপ ছাদে উঠে আসে,কিছুক্ষণ আগে তার মা বাবা বন্যাদের বাসায় গিয়েছিলো এখন বন্যা ছাদে আসছে।তাহসানের মনটা কেমন খারাপ খবরের আশংকায় কেঁপে ওঠে।ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকার দেখে।আজকে রাতটা কেমন গা ছমছমে নিরব।সে দরজার কাছে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেয়।তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে কখন বন্যা আসে।কিছুক্ষণ পরে বন্যা আসে।তাহসানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথচ চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে।তাহসান চুপচাপ বন্যাকে দেখছে।বন্যার গালে লাল লাল আঙুলের দাগ।গালের আঘাত স্পষ্ট হয়ে বন্যার করুন সময় তাহসানের চোখে ধরা দেয়।সে হাত বাড়িয়ে গাল ছুতে গেলে বন্যা পিছিয়ে যায়।মাথা নেড়ে না করে বললো,
“আমাদের থামা উচিত।”
তাহসান বন্যার কথার মানে বুঝেনা।
“মানে?গালে কি হয়েছে?”
বন্যা গালে হাত দিয়ে বললো,
“ভালোবাসার শাস্তি।”
তাহসানের চেহারা শক্ত হয়ে যায়।
“কে থাপ্পড় দিয়েছে?”
বন্যা তাহসানের কথার উত্তর দেয় না।সে বললো,
“আমাদের প্রেমের সম্পর্কে কার আগ্রহ বেশী ছিলো?”
তাহসান বন্যার কান্না চেপে রাখা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার।”
“তাহলে আমাকে আমার ফ্যামিলির মানুষকে আপনার আম্মা এতো অপমান করে কথা বললো কেনো?”
“বন্যা…..।”
তাহসান কথা শেষ করার আগেই বন্যা বললো,
“প্রেম তো করতে চাইনি আপনিই পাগল হয়ে আমাকে রাজী করিয়েছেন।আজকে এই ছু,রিকাঘাতের ভ,য়েই কখনো নারীসুলভ আচরন করতে চাইনি।আমি নিজেই জানি আমি নষ্ট সেটা আপনার সাথে প্রেম করাতে আপনার মা চিৎকার করে বলে গেলো।শুধু আমাকে বলে থামেনি আমার বাবা মা’কেও বলেছে।মানলাম আমি প্রেম করেছি কিন্তু আমার বাবা মা কি করেছে?”
“আম্মু কি কি বলেছে একটু খুলে বলো প্লিজ।”
“কি বলবে আবার,আমরা যে লোভী ফ্যামিলি সেটাই বললো।আপনার বাড়ি দেখেই তো আমার বাবা মা আপনার পিছনে আমাকে লেলিয়ে দিয়েছে।”
তাহসানের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়।
“আমি কি কখনো তোমাকে এসব বলেছি?”
“টাকা হলে এমন হাজারো বাসা পাওয়া যায়।প্রেম করেছি বলে বাসা থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়ার দরকার নেই।”
“বন্যা কি বলছো এগুলো?”
“আমি বলছি না এগুলো আপনার আম্মা বলেছে।”
“আম্মুকে আমি বুঝাবো।”
বন্যা হেসে বললো,
“তার আর দরকার নেই।”
কান্নামুখে বন্যার হাসি দেখতে খুবই অদ্ভুত লাগছে।তাহসান সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“কেনো?”
“আমি জানি আমার অতীত খারাপ,আমি জানি আমি নষ্ট কিন্তু আমি কিংবা আমার ফ্যামিলি লোভী নই।আমাদের যা সম্পর্ক ছিলো তা আজকে থেকে শেষ,সব সম্পর্ক শেষ।আমার সাথে আপনি আর কোনো যোগাযোগ করতে চাইবেন না।আমরা আগামীকালই বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।”
বন্যা আর দাঁড়ায় না।ক্ষিপ্ত গতীতে সিড়িতে পা রেখে নিচে নেমে যায়।তাহসান বন্যার প্রত্যেকটা কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকে।সব সম্পর্ক শেষ মানে?মেয়েটা কি বলে গেলো?এই মেয়েটা তার কলিজা সে কি তা জানে না?জানলে এই কথা বলার সাহস হলো কি করে?সব সম্পর্ক শেষ হওয়া মানে সে নিজে শেষ হয়ে যাওয়া,যা কখনোই হতে দেয়া যাবেনা।বন্যা চলে গেছে সেটা ধাতস্ত হলে তাহসান সিড়ি দিয়ে বন্যার পেছনে ছুটে।প্রেমে বাধা তো আসবেই তাই বলে পিছু হটতে হবে?বন্যাকে হারানোর ভ,য়ে তাহসানের বুকে উত্তাল ঢেউ বয়।যে করেই হোক বন্যাকে তার চাই।কিন্তু আটকাবে কি করে?
চলবে…….#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
তাহসান ছুটে গিয়ে দেখে বন্যা ইতোমধ্যে তিনতলায় চলে গেছে।সে পিছন থেকে কয়েকবার ডাকে বন্যা শুনেও দাঁড়ায় না।তাহসান গিয়ে বন্যার পথ আগলে দাঁড়ায়।বন্যার চোখে তখন পানির স্রোত।তার জন্য বাবা মা অনেক কথা শুনেছে,শুনেছে বললে ভুল হবে প্রতিনিয়ত শুনে আসছে;এখন আবার এই নতুন গল্পের কটু কথাগুলোও শুনতে হচ্ছে।বন্যার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে;সে কিভাবে পারলো বাবা মা কে আবারো নতুন কথা শুনানোর রাস্তা বানিয়ে দিতে,সে তো জানতো তার অতীত কি তারপরও কেনো পা বাড়ালো এই ভ,য়াবহ কঠিন রাস্তায়!মায়ের ছলছল চোখ বন্যার বুকে বর্শার মতো বিধে আছে।তাহসানের ডাক শুনেও তাকানোর ইচ্ছে হয় না।সব নষ্টের মূল এই ছেলে।আঠার মতো গায়ের সাথে লেগে প্রেম করেছে।বন্যা তো প্রেম করতে চায়নি তাহলে তার কেনো সবটা দোষ হবে?তার বাবা মা কেনো কথা শুনবে?তাহসান পথ আগলে দাঁড়ালে বন্যা চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বললো,
“সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।”
তাহসান আকুল আবেদন করে বললো,
“আমার কথাটা শোনো প্লিজ।”
“কোনো কথা শুনতে চাই না।”
“এভাবে সমাধান হবে না।প্রেমে ঝড় আসবেই তাই বলে সরে যাওয়া তো বুদ্ধিমানের কাজ না।”
বন্যা ফুসে উঠে বললো,
“আমার বাবা মা কি আপনার সাথে প্রেম করেছে?প্রেম করেছি আমি কথা শুনালে আমাকে শুনাবে কিন্তু আপনার আম্মা আমার বাবা মা কে অপমান করে গেছে।প্রেম কি একা একা করা যায়?প্রেম করতে ছেলে লাগে না?আমি তো আপনার সাথে প্রেম করেছি তাহলে আমি কেনো একা কথা শুনবো?আমার বাবা মা কেনো মিথ্যা অপবাদ নিবে?মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি?”
তাহসান ক্ষিপ্ত বন্যার দিকে তাকিয়ে থাকে।রাগে মুখ লাল আভা ছড়াচ্ছে।সে অনুনয় করে বললো,
“আমি আম্মুর সাথে কথা বলে সব সমস্যা সমাধান করে নেবো।তুমি প্লিজ উল্টাপাল্টা কিছু বলো না।”
“বলবো না মানে!একশো বার বলবো।আজকে থেকে আমাদের…”
বন্যা কথা শেষ করার আগে তাহসান তাকে থামিয়ে দেয়।
“তুমি আমার হৃদয় বন্যা।আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না।”
বন্যার বুকে শীতল বাতাস বয়।এই ছেলেটার কাছে শক্ত আবরণ মেখে থাকা বড়োই দুষ্কর।সে বললো,
“ভালোবাসলে তাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে রাখতে শিখুন।আমাকে যদি ভালোই বাসেন তো মর্যাদা দিয়ে নিজের করে নিন।আমি এমন ভাবে আপনার হতে চাই যেনো কেউ অপবাদ দিতে না পারে।”
বন্যার কথা শুনে তাহসান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।মুখে বললো,
“হাত ধরেছি এতো সহযে ছেড়ে দেয়ার জন্য নাকি?তুমি শুধু শক্ত থেকো আমি বাকিটা সামলে নেবো।”
বন্যা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।তাহসান সাথে হাটতে হাটতে বললো,
“আরেকটু থাকো।”
বন্যা তাহসানের শান্ত চোখ দু’টোর দিকে তাকায়।
“মা জানতে পারলে আরো খারাপ হবে।”
তাহসান বন্যার হাত ধরে হাটা থামায়।গালের দাগে হাত ছুঁয়িয়ে বললো,
“সব আ,ঘাত আমার হোক।”
বন্যা গাল থেকে হাত সরিয়ে দেয়।মুখে বললো,
“ছেলেদের আ ঘাত করা হয় না আ,ঘাত করা হয় মেয়েদের।”
তাহসান আলতো করে হাত ধরে বললো,
“ভালোবাসি।”
বন্যা আর তর্ক করেনা।সইচ্ছায় তাহসানের ডাকে সাড়া দেয়।ঠোঁট অল্প নাড়িয়ে সায় দিয়ে বললো,
“আমিও ভালোবাসি।”
“এই কথায়ই থেকো।আমার হাত ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও অন্যদিকে যাবে না।তাহলে আমি তান্ডব বয়িয়ে দেবো।”
তারপর বন্যা চুপচাপ বাসায় চলে যায়।সবাই তখন খাবার খাওয়া প্রায় শেষ।বন্যা গিয়ে খেতে বসলো।রেনু বেগম মেয়ের দিকে তাকায়।তখন থাপ্পড় মে,রে উনি নিজেই কষ্ট পেয়েছেন।বাবা হায়ায়া মেয়েকে আ,ঘাত দিতে দশবার ভাবেন।এখন তাহসানের সাথে দেখা করে এসেছে বুঝতে পেরেও চুপ থাকলেন।উনি কড়া গলায় বললেন,
“কালকেই এই বাসা ছেড়ে দেবো।বাসা ছাড়ার আগে আর কোনো অঘটন ঘটিও না।”
বন্যা মাথা নাড়ে।রেনু ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহসানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ। ”
“তাহসানের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।আতোটাও ফালানো হও নি যে কোনো ছেলের পিছনে ঘুরে বিয়ে করতে হবে।”
বন্যা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“তাহসান মানিয়ে ফেলবে সবাইকে।”
ইতোমধ্যেই সবার খাওয়া শেষ।রেনু বেগম সবার প্লেট একসাথে করতে করতে বললো,
“মানালেও কি!ওর মা তোকে একটুও পছন্দ করে না,আর শাশুড়ীর অপছন্দে বিয়ে হলে সংসার কখনো সুখের হয় না।”
বলতে বলতে রেনু বেগমের গলা কেঁপে ওঠে।বন্যা মায়ের সব খেয়াল করছে।মা নিঃসন্দেহে তার ভালো চায়।কিন্তু সেও তো জানে তাহসান তাকে কতোটা চায়।সে তাহসানের পক্ষ নিয়ে বললো,
“মা!তাহসান আমাকে বিয়ে করবে,আর কাউকে খারাপ কথা বলার সুযোগ দেবে না।”
রেনু বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকায়।
“ছেলেরা বিয়ের আগে এসব বলেই কিন্তু বিয়ের পর দেখা যায় কাহীনি উল্টে গেছে।”
বন্যা প্রতিবাদ করে বললো,
“তাহসান এমন না। সে আমাকে ভালোবাসে।”
রেনু বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকায়।এই কি সেই বন্যা যে ছেলেদের সহ্য করতে পারতো না!ভালোবাসা বিয়ে এসবের কথা শুনলে রেগে যেতো?বন্যার বিস্তর পরিবর্তনে উনি অবাক হয়।
তাহসান বাসায় গিয়ে দেখে তার আব্বু আম্মু ড্রয়িং রুমে চুপচাপ বসে কিসের যেনো অপেক্ষায় আছ।সে কাছে যাওয়াতে সবাই নড়েচড়ে বসে যেনো তার জন্যই এই দীর্ঘ অপেক্ষা।আফিয়া বেগম তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সে লজ্জা পেলোনা বরং মায়ের সামনের সোফায় বসে বললো,
“কি? ”
আফিয়া বেগম ছেলের প্রশ্নে থমথম খেয়ে যায়।
“কি?”
“বন্যার বাসায় গিয়ে কি বলেছো?শুনি বলো।”
“যা বলার বলেছি তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। ”
“আম্মু শোনো বন্যাকে আমি ভালোবাসি।বিয়ে করলে বন্যাকেই করবো।”
আফিয়া বেগম উনার স্বামী মোবারক সাহেবের দিকে তাকালেন।মোবারক সাহেব স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।আফিয়া বেগম বললো,
“বাবা মায়ের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে করিস না?”
তাহসান মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
“অনুমতির প্রয়োজন মনে করছি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।”
আফিয়া বেগম চিৎকার করে বললো,
“ওই নষ্ট মেয়েকে আমি মানি না।সমাজ কি বলবে?তুই কি এই সামান্য ব্যাপারগুলোও বুঝিস না?”
“থুরাই কেয়ার সমাজের।আমি খুশী থাকলেই হলো,সমাজ দিয়ে কি করবো?”
আফিয়া বেগম চিৎকার বন্ধ করে না।গলা বাড়িয়ে সমানতালে বললো,
“তোমার সমাজ না লাগলেও আমাদের লাগবে।একটা ধর্ষিতাকে বউ হিসেবে মানা যায় না।”
“বারবার ধর্ষিতা বলবে না।বন্যা খুব ভালো মেয়ে।”
“কতো ভালো মেয়ে তা এই পাড়ার
সবাই জানে।ছেলেদের মতো চলাফেরা,মুখে অকথ্য ভাষা,দেখতেও কি বিশ্রী।”
বন্যার নামে এই কটু কথাগুলো শুনতে তাহসানের ভালো লাগে না।সে বললো,
“তোমার চোখে ভালো না লাগলেও আমার চোখে ভালো লাগে।”
আফিয়া বেগম অনুরোধ করে বললো,
“তোকে এরচেয়ে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করাবো।এসব পাগলামি বন্ধ কর।কয়দিনেই ভুলে যেতে পারবি।”
তাহসান হেসে বললো,
“এরচেয়ে ভালো মেয়ে চাই না আম্মু আমার বন্যাকেই চাই।”
আফিয়া বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তুমি কিছু বলছো না কেনো?”
তাহিয়া ভয়ে ভয়ে বললো,
“আম্মু বন্যা আপু তো ভালো মেয়ে মানতে সমস্যা কি?”
মেয়ের কথায় আফিয়া বেগম আরো রেগে যায়,
“ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতো থাকো।বেশী পাকনামি করতে যেও না।”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“শান্ত হও আফিয়া।ছেলে মেয়েদের পছন্দও তো ভাবতে হবে।”
স্বামীর কথায় আফিয়া বেগমের মুখ আরো অন্ধকার হয়ে যায়।
“কোনো ভাবা ভাবি নেই।কালকেই ওরা বাসা ছেড়ে দেবে।”
তাহসান চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“বাসা ছেড়ে দেবে কেনো?ওরা যদি এই বাসা ছেড়ে দেয় তাহলে আমিও আর এই অহংকারী বাসায় থাকবো না।”
“তাহসান বেশী বাড়াবাড়ি করছিস না?”
তাহসানের রাগে শরীর কাঁপছে।চোখে পানি টলমল।কথা বলতে গিয়ে খেয়াল হলো গলা শুকিয়ে গেছে।
“বাড়াবাড়ি করলে বাড়াবাড়িই। আব্বু কেনো বুঝেননা বন্যা আমার শান্তি।আমি বিয়ে করলে বন্যাকেই করবো।ভুল করেও ওদের বাসা থেকে বের করতে যাবেন না এতে বিপরীত হবে।”
তাহসানের শেষের কথাগুলো জড়ানো শোনা গেলো।কথাগুলো বলেই সে রুমে চলে যায়।ভাইয়ের চোখে পানি দেখে তাহিয়া নিজেও কেঁদে দেয়।মায়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
“এক ছেলে নিয়ে তোমার খুব অহংকার তাই না?যা শুরু করেছো এই ছেলে হারালে বুঝবে।”
আফিয়া বেগম ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে বললো,
“তুমিও কি চুপ করে থাকবে?আমি এই মেয়েকে মেনে নিতে পারবোনা।”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বললো,
“মহিলা মানুষের এই এক ঝামেলা।বুঝে কম লাফায় বেশী।ছেলে মেয়ে ছোট নেই যে তোমার কথা শুনবে।”
আফিয়া বেগম থামে না।
“না শুনলে না শুনবে।তোমার ছেলে ম,রে গেলেও আমি রাজী হবো না।”
চলবে……
(