#তি_আমো
পর্ব ৩৮
লিখা- Sidratul Muntaz
নিহা আর সাফিন ভাইয়ের রিসেপশনে গানের ব্যান্ড পার্টি তো এলো, কিন্তু নাচার মতো কেউ নেই। শুধু গান দিয়েই কি পরিবেশ জমে? একটু যদি নাচ না হয়! আজ-কাল বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় মানুষ নিজেরাই নাচে; নিজেরাই গান গায়। কিন্তু নিহা কিছুতেই নাচবে না। সাফিন ভাইয়ের নাচার শখ ষোলআনা। তিনি তো নাচবেন বলে লুঙ্গির সাথে স্টাইল মেরে সানগ্লাসও পরে নিয়েছেন। তার এই লুক দেখে আমরা হেসেই কাহিল। তিনি নাকি ঢাকার পোলা ভেরি ভেরি স্মার্ট গানের সাথে নাচবেন। নিহা উঠে বলল,” ভেরি ক্রিঞ্জ সাফিন। ছিঃ, আমার ইচ্ছে করছে এখনি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে।”
সাফিন ভাইয়ের কোনো হেল-দোল নেই। তিনি নিজেকে আয়নায় দেখে পাঞ্জাবীর হাতা ফোল্ড করতে করতে বললেন,” আচ্ছা দাও। কিন্তু একবার দিও। তিনবার না প্লিজ। যেন আবার বিয়ে করতে পারি। ”
আমি এই কথা শুনে হেসে উঠলাম। নিহার দিকে চেয়ে বললাম,” তোকে লেহেঙ্গায় মানাচ্ছে না নিহু। তুই শাড়ি পর না! গ্রামের মেয়েদের মতো। তারপর চোখে তুইও একটা সানগ্লাস লাগা। তোদের দু’জনকে পারফেক্ট লাগবে। এরপর দু’জন একসাথে নাচবি ‘রাব নে বানা দি জোরি’ গানে।”
” তুই কি টিটকিরি মারছিস? আর এই নামে কোনো গান নেই, ওকে? মুভি আছে।”
” ও আচ্ছা। কিন্তু আমি টিটকিরি মারছি না।”
নিহা আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” নিজের অনুষ্ঠানে আমি জীবনেও নাচব না। নাচবি তো তোরা। তুই আর ঈশান ভাই নাচবি।”
আমি কোনো মজার কথা শুনেছি এমনভাবে হাসলাম। নিহা দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” এতো হাসির কিছু নেই। ঈশান ভাইয়া দূর্দান্ত নাচ জানে। সেটা কি তুই জানিস?”
আমি একটু থামলাম। তারপর আবারও হেসে ফেলে অবিশ্বাসী কণ্ঠে বললাম,” ধূর, মিথ্যা কথা।”
নিহা জোর দিয়ে বলল,” সত্যি! কেউ না নাচলে দেখবি উনি একাই স্টেজ মাতিয়ে ফেলেছেন। এই সাফিন, তুমি একটু ঈশান ভাইকে রিকোয়েস্ট করো না, যাতে উনি নাচে!”
সাফিন ভাই আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বলল,” করব। তুমি এই কমলা বেনারসিটা পরতে রাজি হয়ে যাও তাহলে আমিও ঈশানকে নাচতে রাজি করাবো।”
নিহা চিৎকার করে বলল,” ইম্পসিবল। এই বিশ্রী শাড়ি আমি পরব না।”
সাফিন ভাই ঠোঁট উল্টে বললেন,” আমার পছন্দ করা শাড়ি তোমার বিশ্রী মনে হচ্ছে?”
” তোমার সব পছন্দই বিশ্রী সাফিন।”
সাফিন ভাই শাড়িটা বিছানায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন,” তুমিও আমার পছন্দ। ”
নিহা আমার দিকে তাকাল বাঁকা দৃষ্টিতে,” ও যেটা বুঝিয়েছে সেটা কি তুই বুঝেছিস? আমাকে বিশ্রী বলে গেল!”
আমি মেজাজ খারাপ করলাম এবং বললাম,” প্রতিদিন তোদের ঝগড়া করতেই হবে, তাই না? আমি বুঝি না তোরা একজন-অন্যজনের থেকে এতো আলাদা তবুও তোদের মাঝে প্রেম কিভাবে হলো?”
” কিভাবে আবার? অপজিট এট্রাক্টস! আমি তো ভেবেছিলাম ওর মাঝে যা নেই তা আমার মাঝে আছে। আবার ওর মাঝে যা আছে তা আমার মাঝে নেই। এভাবে আমাদের জমবে ভালো। কিন্তু এখন দেখছি উল্টা। সারাক্ষণ শুধু ঝগড়াই লেগে আছে।”
আমি সাফিন ভাইয়ের রেখে যাওয়া কমলা শাড়ির ভাঁজটা খুলতে খুলতে আফসোস করে বললাম,” তোকে এই শাড়িতে দারুণ লাগতো নিহু। সাফিন ভাইয়ের সাদা পাঞ্জাবীর সাথে একদম মানিয়ে গেছে শাড়িটা।”
নিহা আমার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,” শাড়িটা আমি পরব তারু, কিন্তু একদম অনুষ্ঠানের শেষের দিকে।”
আমি অবাক হলাম,” সত্যি? উফ, সাফিন ভাই অনেক খুশি হবে!”
” গাঁধাটাকে খুশি করার জন্যই তো এতোকিছু করি। কিন্তু গাঁধা বোঝেই না!”
আমি নিহার কাঁধে মালিশ করে বললাম,” আরে বোঝে, বোঝে, সবই বোঝে।”
সাফিন ভাই ঈশানকে নাচার জন্য রাজি করিয়ে ফেললেন। আমি জানতাম সাফিন ভাই পারবেন। কিন্তু ঈশান একটা শর্ত দিয়েছে। সে যদি নাচে তাহলে তার সঙ্গে নাচতে হবে আমাকেও। এদিকে আমি জীবনে কখনও নাচিনি। কিছুতেই রাজি হলাম না। আমাকে রাজি করাতে নিহা, রিফাত ভাই, সিয়াম ভাই, রেহেনা, নীরা সবাই একসাথে বসল। কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। নাচ কিছুতেই হবে না। রিফাত ভাই বললেন,” তুমি যদি না নাচো তাহলে ঈশানকে একা নাচতে হবে। আর এখানে অনেক ঈশান পাগলি আছে। দেখা যাচ্ছে তারা ঈশানের সঙ্গে গিয়ে নাচতে শুরু করবে। আর বোঝোই তো। একসাথে নাচা মানে…”
আমি দায়সারা কণ্ঠে বললাম,” ঈশান যার সাথে ইচ্ছা নাচুক। শুধু আমার সাথে না নাচলেই হলো। আমি এসব নাচ-গান করতে পারব না। তাছাড়া এখানে আমার দাদী আছে। সে যদি আমাকে নাচতে দেখে তাহলে আমার খবর আছে। আমার দাদীকে দেখতে খুব সফট মনে হলেও সে খুব রুড। যখন রেগে যায় তখন সবাই তার কাছে বেড়াল।”
নিহা আমার কাঁধ খামচে ধরল। কিড়মিড় করে বলল,” আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড। আর তুই আমার জন্য এইটুকু করতে পারবি না?”
” ইমোশনাল ড্রামা বন্ধ কর। আমি যেটা পারি সেটা তোর জন্য অবশ্যই করব। কিন্তু আমি নাচ পারি না। তাই এই অনুষ্ঠানে যদি আমি নাচি তাহলে তোর মান-সম্মানই যাবে। এছাড়া কিছু হবে না।”
সিয়াম ভাই বললেন,” মান-সম্মান যাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন? আমরা আমরাই তো! আমাদের সামনে তুমি যেভাবে খুশি নাচো, আমরা কিন্তু সিটি বাজাবো।”
আমি বিরক্ত স্বরে বললাম,” এইখানেই তো প্রবলেম। আপনারা আমার জন্য সিটি বাজাবেন আর ওইদিকে আমার দাদী আমার ব্যান্ড বাজাবে।”
রিফাত ভাই আর সিয়াম ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। নিহা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” তারু ওর ভাইয়ের পরে দাদীকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।”
রিফাত ভাই প্রশ্ন করলেন,” মাকে ভয় পাও না তো?”
আমি মৃদু স্বরে বললাম,” না। মা খুব সুইট। মাকে ম্যানেজ করা অনেক সহজ। ”
এবার দেখলাম সিয়াম ভাই আর রিফাত ভাই একসঙ্গে হাত মেলালেন। সিয়াম ভাই বললেন,” আইডিয়া পেয়ে গেছি। যতক্ষণ তুমি স্টেজে ডান্স করবে ততক্ষণ তোমার দাদীকে ঘর থেকে বের হতে দিবো না। আমরা আটকে রাখব। তাহলেই হলো।”
আমি হাত তালি বাজিয়ে বললাম,” আপনাদের বুদ্ধি অনেক ভালো কিন্তু আমি নাচব না।”
সকলে আমার পেছনেই পড়ে গেল। যেন জোর করে হলেও আমাকে নাচিয়ে ছাড়বে। আমি বুঝলাম না, সবাই কেন এমন করছে? আমি না নাচলে কি অনুষ্ঠান থেমে থাকবে? ঈশান কিন্তু আমাকে একবারও নাচার জন্য অনুরোধ করতে এলো না। অবশ্য সে এলেও আমি রাজি হতাম না। কারণ আমি নাচ পারিই না। পরে স্টেজে পড়ে হাত-পা ভাঙলে মান-সম্মান হারানোর মতো ব্যাপার হবে।
আমি রাজি না হলেও ঈশান কিন্তু তার ডান্স পার্টনার পেয়ে গেল। নাশফী আপু, আনিকা, সামিয়া, প্রায় হামলে পড়ল ঈশানের সাথে নাচার খুশিতে। তারপর তাদের তিনজনের মাঝে টস হলো। টসে জিতলো আনিকা। তারপর সে কি আনন্দ তার! যেন ঈশানকেই জিতে নিয়েছে। আমি এসব দূর থেকে দেখছিলাম৷ অদ্ভুত ব্যাপার, আমার একটুও বিরক্ত লাগছে না। আনিকাও নাকি খুব ভালো নাচ জানে। শুনেছি এর আগেও কারো বিয়েতে আনিকা আর ঈশান একসঙ্গে নেচেছিল। এদিকে বহু আগে থেকে আমি শুনে আসছি আনিকা ঈশানকে পছন্দ করে। তাই সে ঈশানের সঙ্গে নাচবে শুনে আমার ঈর্ষা হওয়াই উচিৎ। আর অদ্ভুত ব্যাপার, আমার একটুও ঈর্ষা হচ্ছে না। নিহা যখন জানতে পারল ঈশান আর আনিকা একসাথে স্টেজে আসছে, তখন সে আমার পাশে বসে কানের কাছে রঙ্গসঙ্গীত গাইতে লাগল,
” তুই ভুল করছিস তারু। আনিকাকে ঈশান ভাইয়ের সাথে নাচতে দিস না। তোর কি জেলাস হচ্ছে না? ঈশান ভাইয়ের জায়গায় যদি সাফিন হতো তাহলে এখনি আমি গিয়ে আনিকাকে স্টেজ থেকে লাথি মেরে ফেলে নিজে তার জায়গা দখল করতাম।”
আমি আঁড়চোখে চেয়ে বললাম,” আমি যেটা পারি না, সেই কাজটা আনিকা করছে। আর তোর বিয়েতে তো নাচটা ইম্পোর্ট্যান্ট ছিল তাই না? আমি জানি আমি নাচতে পারবো না৷ তাহলে খামোখা আনিকাকে লাথি কেন মারবো?”
নিহা মলিন মুখে চাইল। ম্লান কণ্ঠে বলল,” তুই না নাচলে আমার নাচেরই দরকার নেই। শুধু গান দিয়েই কাজ চালিয়ে নিব। নাচ ক্যান্সেল করে দেই।”
আমি অনুরোধ করে বললাম,” না নিহা, এমনকিছু করিস না প্লিজ। দেখি না, ওরা দু’জন কেমন নাচে!”
স্টেজে গান শুরু হলো। প্রথমেই বাংলা গান,” ও মধু, আই লভ ইউ।” পর্দা উঠে গেল। চারদিকে বিভিন্ন রঙের আলো ঝলমল করছে। স্টেজের ঠিক মাঝখানে অবস্থান নিয়ে দাঁড়ালো ঈশান আর আনিকা। তারপর দূর্দান্ত পারফরম্যান্স। আনিকা ভালো নাচে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঈশানের নাচ দেখে আমি হতবাক। যতক্ষণ সে নাচছিল আমার একবারের জন্যেও চোখের পলক পড়েনি, মুখের ছোট্ট হা বন্ধ হয়নি, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, শরীর শিরশিরিয়ে উঠছিল। সত্যিই কি এতোটা ভালো কেউ নাচতে পারে? নিহা আমার কানে কানে বলল,” ওই দ্যাখ তারু, ঈশান ভাই আনিকার কোমরে হাত রাখল। তোর কি জেলাস লাগছে না?”
আমি গরম দৃষ্টিতে চাইলাম। উত্তপ্ত কণ্ঠে বললাম,” জেলাস লাগবে কেন? প্রয়োজনে হাত দিয়েছেন, প্রেম করার জন্য তো দেননি।”
নিহা আমার সামনে হাতজোড় করে বলল,” তোর অনেক ধৈর্য্য।”
সত্যি যদি বলি, মনে মনে আমারও একটু ঈর্ষা হচ্ছিল বৈকি! কিন্তু সেটা তো আমি কাউকে বুঝতে দিবো না। “ও মধু গান” শেষ হয়ে গেল। এবার নতুন আরেকটা গান শুরু হয়েছে,” জুলি, জুলি, জনি, জনি।”
এই গানের একটা দৃশ্যে ঈশান আনিকার মুখের কাছে ঝুঁকে গাল টিপে দিয়ে বলে,” থ্যাংকিউ বেবি, থ্যাঙ্কিউ। ”
আনিকা আরও একধাপ এগিয়ে ঈশানের গালে চুম্বন করে বলে,” থ্যাঙ্কিউ হানি, থ্যাঙ্কিউ। ”
আমি কটমট করে বললাম,” এইটা কি ছিল? নাচের জন্য কিস করা কি খুব জরুরী?”
সাফিন ভাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন,” আরে সিচুয়েশন ডিমান্ড! এই জায়গায় কিস না হলে চলছিলই না। ওইখানে তুমি থাকলে এতো সুন্দরভাবে কিস করতে পারতে না। ভালোই হয়েছে তুমি যাওনি। আনিকা বেস্ট।”
আমি বুঝলাম, এরা সবাই আমাকে রাগাতে চাইছে। তাই মাথা ঠান্ডা রাখা উচিৎ। যাই হয়ে যাক, আমি কিছুতেই রাগব না। পর পর তিনটি দূর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর ঈশান আর আনিকা এবার নাচ শুরু করল চতুর্থ গানে,” বান জা তু মেরা রানি।”
এই গানটা শুনে আমার হৃদয়ে শুরু হলো আগুনবৃষ্টি। গতরাতে ঈশান আমাকে বলেছিল আমি নাকি তার মনের রাণী৷ আর এখন সে অন্যকাউকে রানী বানিয়ে নাচছে। খুবই অসহ্য লাগছিল। এই নাচ আমি আর দেখতে পারব না। কেউ যেন না দেখে এমন ভাবে আমি উঠে যেতে চাইলাম। কিন্তু কে জানতো, সবার নজর যে আমার দিকেই আছে! আমি চেয়ার থেকে ওঠা মাত্রই সবাই চেঁচিয়ে উঠল,” তারু, কই যাও?”
আমি আবার বসে পড়লাম। নিহার কানে কানে বললাম,” আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো নিহা।”
নিহা আমার হাত চেপে ধরে বলল,” এখন কোথাও যাওয়া চলবে না। নাচ শেষ হলে তারপর যাবি।”
” ততক্ষণে আমার পেটব্যথা শুরু হবে।”
” হোক পেটব্যথা।”
গানের শেষদিকে নাশফী, সামিয়া, নীরা সবাই উঠে স্টেজে যেতে শুরু করল। নিহা কেবল বসে রইল আমার সাথে। ছেলেরাও বসে রইল। সব মেয়েদের মাঝে ঈশান নাচছে একা। দেখতে একদম ভালো লাগছে না। আমি আবার উঠতে চাইলাম। নিহা বলল,” তুইও যা তারু।”
” কই যাব?”
” স্টেজে।”
” অসম্ভব। আমি যাব না।”
এমন সময় মোহনা আন্টি আমার পাশে এসে বসলেন। হাসিমুখে বললেন,” যাও না তারু, নাচতে না পারলে অন্তত ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। তবুও যাও।”
আমি অসহায়ের মতো আর্তনাদ করলাম,” নাচতে না পারলে আমি দাঁড়িয়ে থেকে কি করব?”
মোহনা আন্টি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,” আমার কথা রাখবে না তুমি? আমি বলছি, তুমি যাও।”
আমি বুঝলাম না, মোহনা আন্টিও কেন এমন করছেন! আমাকে নিহা আর মোহনা আন্টি একসঙ্গে দাঁড় করালেন। তারপর জোরপূর্বক স্টেজে ঠেলে দিলেন। আর দূর্ভাগ্যবশত তখনি লাইট চলে গেল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই হা-হুতাশ করছে। আমি মুখে হাত চেপে স্টেজের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। একবার ভাবলাম নেমে যাবো। হঠাৎ সুক্ষ্ম ভাঁজের মতো আলোর রেখা ফুটে উঠল। তারপর ফট করে আবার লাইট জ্বলে উঠল। ততক্ষণে স্টেজে কেউ নেই। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। আর সামনে চেয়ারে বসে আছে সব মেয়েরা অর্থাৎ এতোক্ষণ যারা স্টেজে ছিল। সকলের চেহারায় ঝলমলে হাসি। তারা হাত-তালি বাজাতে লাগল। আমি কয়েক মুহূর্ত ধরে বুঝলামই না যে কি হচ্ছে! মোহনা আন্টি আর নিহা আমাকে ইশারা দিচ্ছে পাশে তাকাতে। কিন্তু আমি তখনও বোকার মতো সামনে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম আমার ঠিক বামপাশে ঈশান হাঁটু গেঁড়ে বসা। তার চোখ দু’টো চিকচিক করছে। তার হাতে ডায়মন্ড রিং এর একটা বক্স। আমার দিকে বাড়িয়ে বলল,” উইল ইউ ম্যারি মি, তারিন?”
চারদিকে বাজি, পটকা ফোটার মতো আওয়াজ হলো। তারপর সবার চিৎকার এবং হাত-তালির ধ্বনি। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। তবে এইটুকু বুঝতে পারলাম যে এতোক্ষণ সবাই আমাকে কেন স্টেজে উঠতে বলছিল। হঠাৎ অনেক বড় শক পেলে মানুষের জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়। আমিও ঢলে পড়লাম স্টেজের মাঝখানে। সবাইকে চমকে গেল। একটা আর্তনাদের চিৎকার! তারপর সবকিছু নিস্তব্ধ। আমি চোখ বন্ধ করে ভূমিতে পড়ে আছি। ঈশান অস্থিরভাবে কাছে এলো। আমার মাথাটা তার কোলে নিয়ে ভয়ংকর উৎকণ্ঠায় ডাকতে লাগল, ” তারিন, এই তারিন।”
ঈশানের ঠান্ডা হাতের আদুরে স্পর্শ আমি গালে অনুভব করলাম। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। ঈশান রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” আর ইউ ওকে?”
আমি মুচকি হেসে নরম স্বরে বললাম,” ইয়েস! আই উইল!”
ঈশান থমকে রইল। আমার কথার অর্থোদ্ধার করতে পারেনি সে। অন্যদিকে সবাই আবার চিৎকার দিয়ে উঠল পূর্ণ উল্লাসে। ঈশান তখনও হতভম্বের মতো চেয়ে আছে। রিফাত ভাই ঈশানের পিঠে ধাক্কা মেরে বললেন,” আরে, শী এক্সেপ্টেড!”
ঈশানের বুঝতে সময় লাগল। যখন সে ব্যাপারটা বুঝল তখন সশব্দে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি হাসতে লাগলাম। ঈশান আমার আঙুলে হীরার আংটি পরিয়ে দিল। জানি, হীরার আংটি অনেক দামী হয়। কিন্তু ওই সময় ওই মুহূর্তটিই আমার জন্য ছিল সবচেয়ে দামী! তারপর আবার গান শুরু হলো,” মেহেন্দী লাগা কে রাখ না, জোরি সাজাকে রাখ না, লেনে তুজহে ও গোরি, আয়েঙ্গে তেরে সাজনা…”
আমার নাচের প্রয়োজনই পড়ল না। ঈশানই আমাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নাচাতে লাগল। আর আমিও তার ইশারা মতো নাচছিলাম। গান শেষ হতেই চারদিক থেকে পুরোদমে শিষ বাজানোর আওয়াজ, হাত-তালি, চিৎকারের শব্দ। সবাই বলল, এটাই নাকি বেস্ট পারফরম্যান্স। তখন কিন্তু নিহা স্টেজ থেকে চলে গেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে, সাফিন ভাইয়ের হুশ উড়িয়ে কমলা শাড়ি আর চোখে সানগ্লাস পরে স্টেজে উঠল নিহা। আমি আর ঈশান তখন নেমে গেছি। সাফিন ভাই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন। সানগ্লাস খুলে, চোখ পরিষ্কার করে আবার দেখলেন। তারপর আবার সানগ্লাস পরে ঈশানকে প্রশ্ন করলেন,” এটা কি আমার বউ?”
আমি আর ঈশান দু’জনেই হেসে উঠলাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম,” হ্যাঁ, আপনারই বউ।”
নিহা স্টেজ থেকে নেমে সাফিন ভাইয়ের কাঁধের পাঞ্জাবী টেনে ধরল। তারপর তাকে জোরপূর্বক স্টেজে নিয়ে গেল। আমরা সবাই শিষ বাজিয়ে চিৎকার করলাম। জোরালো শব্দে করতালি বাজাতে লাগলাম। এবার শুরু হলো তাদের নাচ। গানের নাম,” ওরে ও আমার রাজা।”
চলবে#তি_আমো
পর্ব ৩৯
লিখা- Sidratul Muntaz
মাইক্রোবাসে আমি আর ঈশান পাশাপাশি বসেছি। আমার আসন জানালার সাথে। ঈশান ঠিক আমার গা ঘেঁষেই বসা৷ তার পাশে সাফিন ভাই আর সাফিন ভাইয়ের পাশে নিহা৷ আমাদের সারিটা সবচেয়ে পেছনে। সামনের সারিতে বসেছেন মোহনা আন্টি, মা, রুবা আন্টি আর নাশফী আপু। তারপরের সারিতে বাকি মেয়েরা। আর একদম সামনে ড্রাইভারের পাশে ফাহিম ভাই আর বুড়ি একসঙ্গে বসেছে। বাকিরা অন্য গাড়িতে যাচ্ছে। আজ আমরা সবাই একসঙ্গে বেরিয়েছি মোহনা আন্টির গেস্ট হাউজ পরিদর্শন করতে।
ফাহিম ভাইয়ের সাথে বুড়ির এই দুইদিনে বেশ ভালো খাতির জমে গেছে। বুড়ি প্রায়ই আমার কাছে এসে বলছে, ” পোলাডা ভালোরে! আমার একটা নাতনি থাকলে হেরেও নাতজামাই বানায় লাইতাম।”
বুড়ির শখ দেখে আমি সবসময়ের মতোই ভিমড়ি খেলাম। ফাহিম ভাই অবশ্য ইচ্ছে করেই বুড়ির সাথে খাতির জমিয়েছে। হাঁটতে গিয়ে বুড়ির পায়ে ব্যথা হলে ফাহিম ভাই বলেছে, “আমার কাঁধে হাত রেখে হাঁটুন দাদী। ” গাড়িতে উঠলে প্রায়ই বুড়ির বমি হয়। ফাহিম ভাই সেজন্য হাতে পলিথিন নিয়ে বসে আছে। পলিথিনগুলো মূলত আনা হয়েছে মোহনা আন্টির জন্য। মোহনা আন্টির শরীর ভালো নেই। তিনি সকালেও বমি করেছিলেন। গাড়িতে আবার বমি করতে পারেন। মাঝে মাঝেই বুড়িকে ফাহিম ভাই প্রশ্ন করছে, ” আপনার খারাপ লাগছে না তো দাদী? খারাপ লাগলে বলবেন। গাড়ি সাইড করা যাবে।” ফাহিম ভাইয়ের আচরণে মাও মুগ্ধ। কিন্তু ঈশান ক্ষুব্ধ। আমি যখন ফিসফিস করে ঈশানকে বললাম,” দেখেছেন, ফাহিম ভাই সবার কত খেয়াল রাখছে?”
ঈশান বিড়বিড় করে বলল,” সবার খেয়াল কই রাখছে? শুধু তোমার পরিবারের খেয়াল রাখছে। এটেনশন পেতে চায়।”
ঈশানের কথার অর্থ বুঝলাম না আমি। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,” মানে?”
ঈশান বড় শ্বাস ছেড়ে পানসে কণ্ঠে বলল,” সে তোমাকে মুগ্ধ করতে চায়, তোমার এটেনশন চায়।”
আমি চোখ সরু করে তাকালাম। আমার বামহাত ঈশানের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম,” আমার আঙুলে আপনার পরানো আংটি। গতকাল ফাহিম ভাইয়ের সামনেই আমাদের এংগেজমেন্ট হলো। তবুও সে আমাকে কেন মুগ্ধ করতে চাইবে? এর পেছনে কি কোনো লজিক আছে?”
ঈশান মুচকি হাসল আমার কথায়। চোখেমুখে একটা কাব্যিক ভাব ফুটিয়ে তুলে কিছুটা সুর দিয়ে বলল,” ডার্লিং, ভালোবাসায় থাকে না কোনো যুক্তি। ভালোবাসার আসল নাম হলো মুক্তি।”
আমি হাসলাম। কিছু সময় ভেবে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম,” এর মানে ফাহিম ভাই আমাকে ভালোবেসে মুক্তি দিয়েছেন। যেন আমি নিজের ভালোবাসার কাছে যেতে পারি। এটাই কি বলতে চাইছেন?”
ঈশান মাথা নেড়ে বলল,” অনেকটা তাই।”
” একজন আমাকে এতো ভালোবাসছে এতে কি আপনার ঈর্ষা হয় না?”
” ঈর্ষা তখনি হবে যখন ব্যাপারটা আমি মানতে পারব না। কিন্তু আমি তো মেনে নিয়েছি! আমি জানি, আমার তারিন এতো বেশি স্পেশাল যে তাকে ভালোবাসতে কারণ লাগে না। সমগ্র পৃথিবীও যদি তোমাকে ভালোবাসে তাও আমি ঈর্ষা করব না। বরং গর্বিত হবো। কারণ আমি তোমাকে পেয়েছি, অন্যরা পায়নি। পার্থক্যটা বুঝতে পারছ?”
আমি মুগ্ধ হওয়ার ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টালাম। বললাম, ” বাহ, ইমপ্রেসিভ! এর মানে আমাকে পেয়ে আপনি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করেন?”
” ধন্য মনে করছি। কোনো সন্দেহ আছে?”
ঈশান আমার চোখের দিকে তাকাল। আমিও একইভাবে চেয়ে থেকে বললাম,” না। কোনো সন্দেহ নেই।”
ঈশান সাথে সাথে একহাত দিয়ে বাউন্ডারির মতো আমার কোমর জড়িয়ে আমার কপালে চুমু দিল। আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম,” সবাই দেখবে।”
যদিও দেখার মতো কেউ নেই। কারণ আমরা পেছনের দিকে আছি। সামনের কেউ অপ্রয়োজনে এদিকে তাকাবে না। ঈশানের পাশে সাফিন ভাই আর নিহা ইয়ারফোন শেয়ার করে মোবাইলে ভিডিও দেখছে। দু’জনের মনোযোগ খুবই গাঢ়। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ঈশান। সে শুধু আমার কপালে চুমু দিয়েই থেমে থাকল না। গালে, চোখে, গলায় এমনকি ঠোঁটেও চুমু দিয়ে ফেলল। আমি বাঁধা দিয়ে বললাম,” ঈশান, স্টপ।”
আমার সেই কথাটাই শুনে ফেললেন সাফিন ভাই। ঠট্টার সুরে কাশলেন। ঈশান আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল; একদম ভালো মানুষের মতো। আমিও জানালার দিকে চেয়ে রইলাম একধ্যানে। যেন কিছুই হয়নি। সাফিন ভাই সকৌতুকে ঈশানের কাঁধে হাত রেখে বললেন,” তোরা বিয়ে কবে করছিস?”
ঈশান কিছু বলার আগেই নিহা বলল,” যখনই বিয়ে করুক, তোমার কি? এদিকে দেখো।”
সাফিন ভাই ইঙ্গিত দেওয়ার মতো ফিসফিস করে বললেন,” ঈশানের তাড়া দেখে আমার টেনশন হচ্ছে তো। কখন কি ঘটে যায়..”
কথাটা শুনতে পেয়েই ঈশান তাকাল। সাফিন ভাইয়ের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। নিহা লজ্জিত কণ্ঠে বলল,” ঘটলে ঘটবে। তোমার কি তাতে?”
” আরে, একটা দায়িত্ব আছে না?”
” এতো দায়িত্বশীল হওয়ার দরকার নেই।”
আমার মনে হলো, দ্বিতীয়বার আমি সাফিন ভাইয়ের চোখের দিকেও আর তাকাতে পারব না। এতো অস্বস্তি লাগছিল। ইশ! সাফিন ভাই আবারও বললেন,” এখানেই বিয়েটা করে ফেল না!”
ঈশান ভ্রু কুচকে বলল,” মানে? গাড়িতে কিভাবে বিয়ে করব?”
নিহা হেসে উঠল ঈশানের উত্তর শুনে। সাফিন ভাই গম্ভীর মুখে বললেন,” আরেহ, গাঁধা! গাড়িতে বিয়ে করতে বলিনি। বলছি সিলেটেই বিয়ে করে ফেল। আমরা সবাই তো আছিই।”
মোহনা আন্টি পূর্ণ সম্মতিতে বলে উঠলেন,” আইডিয়াটা কিন্তু বেস্ট!”
আমার মুখ মলিন হয়ে গেল। ঈশান আঁড়চোখে একবার আমাকে দেখে নিয়ে বলল,” এটা সম্ভব না।”
” কেন?” সাফিন ভাইয়ের সরল প্রশ্ন। ঈশান উত্তর দিল স্পষ্টভাবে,” তারিন তার ভাইয়ের এবসেন্সে বিয়ে করবে না।”
সাফিন ভাই আমার দিকে দূর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” আচ্ছা তারু, তোমার ভাই আছেটা কোথায়?”
মায়ের মুখটা দেখলাম অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেও মা হাসছিল। আমি বিব্রত কণ্ঠে বললাম,” জানি না। তবে ভাইয়া দ্রুত ফিরে আসবে।”
সাফিন ভাই আর কিছু বললেন না। সবাই কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল।
গাড়ি থেকে নেমে আমরা অবাক। ভীষণ সুন্দর রাস্তা। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। কারণ এই জায়গা দিয়ে বড় গাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। গেস্ট হাউজের সামনে বিশাল বড় ঝিল। ঝিলের উপর দৃষ্টিনন্দন ব্রীজ। সেই ব্রীজ দিয়েই হাঁটছি আমরা। পাশে তাকালেই স্বচ্ছ, টলটলে পানির স্রোত। মৃদু বাতাসে দুলছে সমীরণ। আমার আশ্চর্য লাগে। এতো সুন্দর কেন প্রকৃতি? ঈশান আমার হাত ধরে ব্রীজ পার হচ্ছিল। সে আমাকে দুইবার প্রশ্ন করল,”তোমার ভয় লাগছে না তো?”
আমি অতি সহজ গলায় বললাম,” ভয় কেন লাগবে?”
” ধরো, যদি ব্রীজ ভেঙে যায়!”
” কপাল খারাপ হলে ব্রীজ ভাঙতেও পারে। ভয় পেয়ে তো আর লাভ নেই।”
ঈশান নিরস কণ্ঠে বলল,” তুমি এতো আনরোমান্টিক কেন তারিন? তোমার উচিৎ ভয় পেয়ে আমাকে একটু পর পর জড়িয়ে ধরা।”
আমি জোরে হেসে উঠে বললাম,” ইশ, একগাদা মানুষের সামনে এতো ন্যাকামি করতে পারি না আমি। তবে আপনি চাইলে আমি আপনাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরব৷ ভয় পেয়ে কেন?”
ঈশান আমার কানে ফিসফিস করে বলল,” তাহলে সবসময় ভালোবাসতে হবে।”
আমি আবার হাসতে লাগলাম৷ গেস্ট হাউজের অনেকটা কাছে চলে আসার পর নিহাকে জিজ্ঞেস করলাম,” আচ্ছা দোস্ত, এখানে যারা থাকে তাদের কি আমরা চিনি? তুই তো বলেছিলি এই বাড়িটা কেনা হয়েছে!”
নিহা উত্তরে বলল,” হ্যাঁ কেনা হয়েছে। কিন্তু যিনি কিনেছেন তিনি এইখানে থাকেন না। তাঁর কেয়ার টেকারই এই বাড়ির দেখা-শুনা করে।”
” ও আচ্ছা।”
আমরা দরজায় কড়া নাড়লাম। একজন মধ্যবয়স্ক লোক দরজা খুললেন। বসার ঘরে আমরা একটা পিচ্চিকে দেখলাম। আর একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বিছানায় বসে সোয়েটার বুনছেন। আমাদের দেখে তারা সবাই সালাম দিল। মোহনা আন্টি নিজের পরিচয় দিতেই মধ্যবয়স্ক লোকটি হাসিমুখে সবাইকে ভেতরে আসতে বললেন। আমরা সবাই ঘরটি দেখে বিস্ময়ে শব্দ করতে লাগলাম। এতো সুন্দর ঘর! খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একদম বিদেশের মতো। উপরে দুইটা ঘর আছে। নিচে বড় ড্রয়িং, ডাইনিং আর রান্নাঘর। সবকিছুই কাঠের। হাঁটলে ঠকাঠক শব্দ হয়৷ একদম যেন ড্রিম হাউজ। আমার খুব ভালো লাগছিল। ঈশান আমার হাত ধরে বলল,” উপরে চলো।”
” উপরে কি?”
নিহা উত্তর দিল,” অনেক সুন্দর জায়গা। গেলে দেখবি।”
কাঠের বাক্সের মতো সিঁড়িগুলো বেয়ে আমরা খটখট শব্দে উপরে উঠে গেলাম৷ ঈশান আমাকে একটা বড় ঘরের বারান্দায় নিয়ে এলো। ঠান্ডা বাতাসে শরীর কাটা দেয়। নিচের দিকে চাইতেই আমি ভয়ে খামচে ধরলাম ঈশানের জ্যাকেট। ঈশান হেসে বলল,” এবার তোমার ভয় লাগছে, তাই না?”
আমি মাথা নাড়লাম। আসলেই ভয় লাগছে। নিচে শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছে ঘরটা পানির মধ্যে ভেসে আছে। যতদূরে চোখ যায় শুধু সবুজ আর ছোট ছোট ঘর। উপরে নীল আকাশ। নিচে স্বচ্ছ পানি। এতোটা বিশুদ্ধ সুন্দর পরিবেশ আর হতেই পারে না। আমি চোখ বন্ধ করে বললাম,” এই জায়গাটা আমার পছন্দ হয়ে গেছে। টাকা থাকলে আমি এক্ষণি বাড়িটা কিনে ফেলতাম।”
ঈশানের মনখারাপ হয়ে গেল আমার কথা শুনে। আমি সেটা লক্ষ্যও করলাম। নিহা আফসোস করে বলল,” এটা সম্ভব না তারু।”
” কেন সম্ভব না?”
” যেই লোক এই বাড়ি কিনেছে, সে জীবনেও বাড়ি বিক্রি করবে না৷”
” কিভাবে জানলি? তোরা এই বাড়ি কিনতে চেয়েছিলি নাকি?”
” অবশ্যই৷ এতো সুন্দর একটা গেস্ট হাউজ, আমাদের শৈশবের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমরা কেন কিনতে চাইব না?”
” সেই লোকটা বিক্রি করবে না কেন?”
” কে জানে! আসলে হামিদ নানা মানে মোহনা আন্টির বাবা যখন এই বাড়ি বিক্রি করেছিলেন তখন বাড়ির দাম ছিল একদম পানির দামে। সে আরও দশ-বারো বছর আগের কথা। তখন তো এই এলাকা খুব একটা উন্নত ছিল না। এখান থেকে স্কুল-কলেজ, দোকানপাট খুব দূরে- দূরে। এজন্য বিক্রিই হচ্ছিল না। তারপর এক বিদেশী ভদ্রলোক খুব অল্প দামে বাড়িটা কিনে ফেললেন।”
আমি হতাশ কণ্ঠে বললাম,” আহারে, এতো সুন্দর একটা জায়গা বিক্রি না করলে কি হতো?”
” হামিদ নানা মোহনা আন্টির উপর রেগে বাড়ি বিক্রি করেছেন। যেন মোহনা আন্টি আর কখনও এই বাড়িতে ফিরে আসতে না পারে।”
” তোর হামিদ নানার মোহনা আন্টির উপর এতো কিসের রাগ? নিজের মেয়ের সাথে কেউ এমন করে?”
“আমি জানি না কিসের রাগ।” ঈশান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” আমি জানি।”
আমি চমকে তাকালাম। প্রশ্ন করলাম,” বলুন?”
ঈশান দুই পাশে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ সে বলবে না। নিহা আমাকে ইশারায় বলল চুপ করতে৷ আমি যখন বুঝলাম ব্যাপারটা সিরিয়াস, তখনি চুপ হয়ে গেলাম।
এইখানে যতবার আসা হয় ততবারই নাকি সবাই বনভোজন করে। আজও বনভোজন হতে চলেছে। ফাহিম ভাই সাথে করে গিটার এনেছিল। বাড়ির পেছনে একটা জঙ্গলের মতো আছে। সন্ধ্যায় সেখানে ক্যাম্প-ফায়ার হবে। আমরা বার-বি-কিউ বানাবো৷ সেই সরঞ্জাম, উপকরণও আনা হয়েছে। যতক্ষণ আমরা এইখানে থাকব ততক্ষণের ভাড়া দিতে হবে। মাঝে মাঝে নাকি বিদেশী পর্যটকেরাও এই বাড়িতে এসে থাকে। ঈশানরা মাছ ধরতে গেল। নিহা আমাকে নিয়ে জঙ্গলী পরিবেশ দেখতে বের হলো। খুব সুন্দর জায়গা। ফলের গাছ আছে। নিহা আমাকে নিয়ে একটা করম চা গাছের সামনে দাঁড়ালো। আমরা গল্প করছিলাম৷ হঠাৎ দূর থেকে সাফিন ভাই দৌড়ে এসে বলল,” তারু, ইটস মিরাকল।”
আমি আর নিহা চমকে তাকালাম। সাফিন ভাই হাঁটুতে ভর দিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,” জানো কাকে দেখেছি?”
আমি প্রশ্ন করলাম,” কাকে? ”
” তোমার ভাইয়া।”
আমি প্রথমে বিমূঢ় দৃষ্টিতে নিহার দিকে চাইলাম৷ তারপর আবার সাফিন ভাইয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” আমার ভাই?”
” আরে হ্যাঁ ভাই, তোমার ভাই।”
” কিন্তু ভাইয়া এখানে কিভাবে?”
” জানি না। তবে আমি ভুল দেখিনি৷ সত্যি তোমার ভাইয়া এসেছে।”
আমি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একটা দৌড় দিলাম৷ সাফিন ভাই চেঁচিয়ে বললেন,” আরে ওদিকে না। আমার সাথে এসো।”
আমি আর নিহা সাফিন ভাইয়ের সাথে দৌড়াতে লাগলাম। ঈশানরা যেখানে বসে মাছ ধরছিল সেখানেই দেখা হলো তারিফ ভাইয়ের সাথে। আমি ভাইয়াকে দেখে বিস্ময়ে মুখে হাত ঠেকালাম। ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে বলল,” কেমন আছিস তারু?”
আমি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম৷ ভাইয়া আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। আমি ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম,” তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে ভাইয়া? একবারও কি আমাদের কথা মনে পড়েনি তোমার? একটা ফোন পর্যন্ত করোনি। তুমি কোথায় হারিয়ে গেছিলে? আর এখানেই বা এলে কি করে?”
ভাইয়া আমার গালে হাত রেখে কোমল গলায় বলল,” সবই তো বলবো। আগে তুই একটু শান্ত হো। এইটা যে নিহাদের গেস্ট হাউজ সেটা তো আমি ভাবতেই পারিনি। আমার বন্ধু জামশেদকে নিয়ে আজ সকালে এইখানে এলাম। আবার তোরাও এলি আজ সকালে। কি কাকতালীয় ব্যাপার বলতো!”
” জামশেদ কে ভাইয়া?”
” আমার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু।”
” ও। উনি কি এইখানে থাকেন?”
” আরে, এই গেস্ট হাউজ তো তারই।”
ভাইয়ার কথা শুনে সবাই চোখ বড় করে তাকাল। ঈশানও বেশ অবাক৷ নিহা ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জানি সবাই কি চিন্তা করছে! মনে মনে আসলে আমিও সেটাই চিন্তা করছিলাম। ভাইয়ার হাত ধরে আকুলভাবে বললাম,” তোমার বন্ধুকে বলো না, গেস্ট হাউজটা যেন আমাদের কাছে বিক্রি করে দেয়!”
চলবে