তি আমো পর্ব -৫৮+৫৯

#তি_আমো
পর্ব ৫৮
লিখা- Sidratul Muntaz

তারিন-ফাহিমের বিয়েতে কোনো ক্লাব ভাড়া করা হয়নি। ঘরোয়া আয়োজনেই শুধু ঘনিষ্ট আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে খুব সাবলীলভাবে আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। পুরো অনুষ্ঠানে তারিনের চোখ কেবল ফাহিমের দিকে ছিল। কত খুশি ছিল ফাহিম। রিফাত, সিয়াম, বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্য কাজিনদের নিয়ে হাসি-তামাশায় মেতে ছিল পুরোটা সময়। কারণে-অকারণে শিষ বাজাচ্ছিল। তার আনন্দ দেখে অতিথিরা সবাই অভিভূত। এই প্রথম কোনো বরকে নিজের বিয়েতে এতোটা আনন্দ করতে দেখা যাচ্ছে যেন। সাউন্ডবক্সে যতগুলো গান বেজেছে সবগুলো গানের সাথেই তালে তালে নেচেছে ফাহিম। এক পর্যায় তো সে তারিনকেও স্টেজ থেকে তুলে নিয়ে এলো নাচার জন্য। তারিন খুশির থাকার অভিনয়টা খুব সুন্দরভাবে পালন করল। ভেতরের অসহ্য অনুভূতি ধামাচাপা দিয়ে শান্ত থাকল। বিদায়ের সময় সে গিলে থাকা কষ্টগুলো একত্রে উগড়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু তার কান্নাই এলো না। বেশি শোকে মানুষ পাথর হয়। তারিন পাথর হয়ে গেছিল। বিদায়ের কষ্ট তার কাছে কোনো কষ্টই মনে হলো না। কিছু ব্যাপার আসলে অজানা থাকাই ভালো। তারিন যদি ঈশানের মনের কথা না জানতো তাহলে আজ তার মনটাও এতো উতলা হতো না। আয়েশা, তারিফ, সূর্যবানু বেগম নিশ্চিন্ত হলেন। তারিন হাসি-খুশি বিদায় নিয়েছে মানে বিয়েতে সে সন্তুষ্ট!

মোহনা আর তারিফের বিয়ে স্থগিত করা হয়েছিল। তারিন এই ব্যাপারটা জানতোই না। হঠাৎ করে সে জানতে পারল। তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে একদম ইচ্ছে করেনি। তাই তারিন কারণ জানার চেষ্টাও করেনি। এখন সে ফাহিমের সাথে গাড়িতে বসে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, ভাইয়া আর ভাবীর বিয়েটা হলো না কেন? আপনি জানেন এই ব্যাপারে কিছু?”

” ঈশান ভাই আসেনি এজন্য বোধহয়।”

” ও.. তাহলে কি ঈশান এলে বিয়ে হবে?”

” হ্যাঁ। কিন্তু ঈশান ভাই কবে আসে তার তো ঠিক নেই।”

তারিন মনে মনে প্রার্থনা করল ঈশান যখন আসবে তখন যেন সে কোনোভাবেই ঈশানের সামনে না পড়ে। চাপিয়ে রাখা কষ্টটা তবে আবার ফুঁসে উঠবে।

” আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?” রাস্তা পরিবর্তন হতে দেখেই তারিন প্রশ্নটা করল। ফাহিম হেসে বলল,” কেন, বাড়িতে!”

” কিন্তু এইদিক দিয়ে তো নিহাদের বাড়ি!”

” নিহাদের বাড়ি কি আমাদের বাড়ি না?”

” হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আর আন্টি না আলাদা ফ্ল্যাটে শিফট হয়েছেন?”

” এখনও আন্টি বলবে? মা বলো!”

” স্যরি, মা।”

” সবাই চাইছিল আমাদের বাসর এই বাড়িতে হবে। ওরা নাকি ঘর-টরও সাজিয়ে ফেলেছে। এজন্য দুইদিন আমরা এখানেই থাকব।”

” ও আচ্ছা।”

তারিনের দমবন্ধকর অনুভূতিটা আবার হচ্ছে। ওই বাড়িতে গেলে ঈশানের স্মৃতিগুলোর কথা মনে পড়বে। মনের সাথে, কান্নার সাথে আবার একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ইশ, এতোদিন তো তারিন খুব ভালো ছিল। সে ধরে নিয়েছিল ঈশান তাকে ভুলে গেছে। তাই সেও ঈশানকে ভুলে ফাহিমকে আঁকড়ে ধরার একটা জেদ পুষে রেখেছিল মনে। সেই জেদ নিয়েই তো সে শান্তিতে ছিল। কিন্তু কালরাতে মোহনার ওই কথাগুলো শোনার পর থেকে তারিন একদম এলোমেলো হয়ে গেছে। ভেতরটা একদম ভেঙে গেছে। মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে জীবনটাকে সবচেয়ে কঠিন বলে বোধ হচ্ছে।

“স্মৃতিগুলো কেন বলো, চলে গেল একা করে.. তুমি নেই আজ, আমার পাশে,, ফিরে এসো.. শূন্য হৃদয়ে!”

গাড়িতে গানটা বাজছে। ঈশান অসহ্য হয়ে বলল,” মিউজিকটা বন্ধ করবেন প্লিজ? মাথা ধরে যাচ্ছে।”

” স্যরি স্যার।”

ঈশান বড় করে শ্বাস নিল। এখন কিছুটা রিল্যাক্স লাগছে। তবে গলা থেকে বুক অবধি দলা পাকানো কিছু একটা আটকে আছে। যা সহ্য হচ্ছে না। তারিনের বিয়ের কথাটা সে কিছুক্ষণ আগেই জানতে পারল। মোহনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলল, ফাহিম-তারিনের বাসর সাজানো হচ্ছে। মোহনা সঙ্গে সঙ্গেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছে। হয়তো সে ভেবেছে ঈশান কথাটা শুনতে পায়নি। কিন্তু ঈশান শুনেছে। এমনকি ওই একটি বাক্য শোনার পর সে আর কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারেনি। হুম, হ্যাঁ করে ফোন রেখে দিয়েছে। চেম্বারেও ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যা না হতেই বের হয়ে গেছে। মাঝরাস্তায় আবার গাড়িতে সমস্যা দেখা দিল। ঈশান ব্যাঞ্জোকে গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে এই গাড়িতে উঠে গেল। এই গাড়ির ড্রাইভার আবার বাঙালী। তাই সে ছেড়েছে বাঙালী গান। আর অদ্ভুতভাবে গানের কথাগুলো ঈশানের জীবনের সাথে যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। হৃদয়ে আঘাত করে। সামান্য একটা গানও বুঝি মানুষকে এতোটা তোলপাড় করে দিতে পারে! বাকিটা পথ ঈশান বসে ছিল নিথর হয়ে। ভাড়া নেওয়ার সময় ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল,” এনি প্রবলেম স্যার?”

ঈশান গম্ভীর গলায় বলল,” না, কেন?”

” তাহলে স্যার.. আপনার চোখে পানি?”

ঈশান দ্রুত মিররে তাকালো। নিজের চোখের পানি দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।

ফুল দিয়ে সজ্জিত ঘরটায় আসতে আসতে রাত বারোটা বেজে গেল ফাহিমের। বিছানায় তারিনকে পাওয়া গেল না। বাথরুমেও নেই। অতঃপর তাকে বারান্দায় দেখা গেল। ফাহিম কিছুটা অবাক হলো। কারণ তারিন বেনারসি বদলে সেলোয়ার কামিজ পরে নিয়েছে। গয়না, চুল, সব নিজেই খুলেছে। মুখের মেকাপও তুলে ফেলেছে। অন্তত ফাহিমের জন্য অপেক্ষা করতে পারতো! ফাহিম তো এখনও শেরোয়ানিটা খোলেনি। ভেবেছিল বাসর ঘরে ঢুকে তারিনের সাথে একান্তে কিছু ছবি তুলবে। ফাহিম পাশে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠল তারিন। তারপর একটু হেসে বলল,” ও, আপনি?”

” এখানে কি করছো?”

” কিছু না। দেখছিলাম।” ভারী একটা নিশ্বাস ছাড়ল তারিন। ফাহিম হঠাৎ করেই বলল,” একটা প্রশ্ন করব তারু?”

” কি প্রশ্ন?”

” তুমি খুশি তো?”

তারিন হাসার ভাণ ধরে বলল,” আপনার কি মনে হয়?”

” তোমাকে সন্ধ্যা থেকেই মনমরা লাগছে। কোনো কিছু নিয়ে কি টেনশন করছো?”

” নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর সব মেয়েরই একটু-আধটু মনখারাপ থাকে।”

বাতাসে অর্কিড গাছটার টব উল্টে গেছিল৷ ফাহিম সেটা ঠিক করার জন্য হাত বাড়াল। টবটা ঠিক তারিনের মাথার পেছনেই ছিল। ফাহিম হাত বাড়াতেই তারিন আৎকে উঠে সরে গেল জায়গাটি থেকে। যেন ফাহিমের ছোঁয়া গায়ে লাগলেই কারেন্টের শক খাবে সে। ফাহিম ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। তাই তারিনকে সহজ করার উদ্দেশ্যে বলল,” অর্কিড গাছটা ঠিক করে দিচ্ছিলাম।”

তারিনও নিজের আচরণে হতভম্ব। মৃদু হেসে বলল,” ও আচ্ছা।”

” চলো ভেতরে যাই? এখানে ঠান্ডা অনেক।”

” আচ্ছা, চলুন।”

ফাহিম বারান্দার গ্লাস বন্ধ করে দিল। তারিন বিছানায় বসে হাই তুলছে। ফাহিম ড্রেসিং টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার কি টায়ার্ড লাগছে তারু?”

” একটু তো লাগছেই। সমস্যা নেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি। তারপর আমরা গল্প করবো।”

” থাক, আজকে আর গল্প করার দরকার নেই। তুমি ঘুমিয়ে যাও। আমারও খুব টায়ার্ড লাগছে।”

তারিন অবাক কণ্ঠে বলল,” শিউর?”

” হুম।”

ফাহিম বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। তারিনের বিশ্বাস হচ্ছে না৷ ফাহিম এতো বুঝদার কেন? এমন একটি মানুষের সাথে বুকে অসহ্য তীব্র ব্যথা নিয়েও নিশ্চিন্তে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়! তারিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সে জীবনে কখনও ফাহিমকে কষ্ট দিবে না। নিজের যত কষ্টই হোক, ফাহিমকে সবসময় ভালো রাখবে। এই মুহূর্তে সে মানুষটির প্রতি যে কি অসম্ভব কৃতজ্ঞতা অনুভব করছে তা ভাবনাতীত।

ঈশান ঘরে ঢুকে তার ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিল। রান্নাঘর থেকে ঘটরঘটর শব্দ আসছে। সাথে সুস্বাদু রান্নার সুঘ্রাণ। বাবা কি রান্না করছে? ঈশান হেলে-দুলে রান্নাঘরে ঢুকতেই অবাক। উর্বশী দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান সবিস্ময়ে বলল,” তুমি আবার এসেছো?”

উর্বশী হাসল,” আপনার ডিনার রেডি করছি। ক্ষিদে পায়নি আপনার?”

” তুমি ঘরে ঢুকলে কিভাবে?”

” আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন ডুপ্লিকেট চাবিটা ড্রয়ার থেকে চুরি করে নিয়ে গেছিলাম।”

ঈশান অসহ্য হয়ে বলল,” দিস ইজ টু মাচ।”

” কিন্তু আমি রান্না করেছি টুনা মাছ।”

” লেইম জোক। যদি চাও আমি তোমার বাড়িতে ফোন না করি তাহলে এক্ষুণি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।”

” মেহমান এলে কেউ এইভাবে তাড়ায়? আপনি না, খুব রুড!”

ঈশান বেডরুমে যেতে যেতে বলল,” আমি বাইরে এসে যেন আর তোমাকে না দেখি।”

ঈশান তার বেডরুমের দরজা ফট করে আটকে দিল। কিন্তু উর্বশীর কাছে বেডরুমের ডুপ্লিকেট চাবিও আছে। সে ঝট করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল। ঈশান তখন বাথরুমে। উর্বশী ফলের একটা স্মুথি বানিয়েছে। ঈশান তো আবার স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। তার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। প্রায় বিশ মিনিট পর গোসল শেষ করে ঈশান যখন বের হলো তখন উর্বশী বিছানার চাদর, বালিশের কভার এসব বদলে ফেলেছে। ঈশান কোমরে হাত রেখে কটমট স্বরে বলল,” তুমি তাহলে এইভাবে যাবে না? আমি কি সত্যিই তোমার বাড়িতে ফোন করব?”

উর্বশী কথাটা শুনতেই পায়নি এমনভাবে বলল,” আপনার জন্য ফলের স্মুথি বানিয়েছি। নিন, খেয়ে দেখুন। ভালো লাগবে।”

স্মুথি দেখে ঈশানের আবার মনে পড়ল তারিনের কথা। সে এই ধরণের স্মুথি বানাতে খুব পছন্দ করতো৷ ঈশান এবার সবচেয়ে অদ্ভুত কাজ করল। উর্বশীর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলল। উর্বশী হকচকিয়ে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গেই তার কান্না পেল। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাগী কণ্ঠে বলল,” আপনি খুব খারাপ।”

উর্বশী বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে চলে যেতে নিচ্ছিল। তখন কাঁচের টুকরোয় তার পা আটকে গেল। উর্বশী তাও থামল না। র/ক্তা/ক্ত পা নিয়েই বের হয়ে গেল। ঈশান বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবার। জানালায় তাকিয়ে আঁধারে মিলিয়ে যাওয়া শহরটার দিকে চেয়ে থেকে ঈশানের হঠাৎ করেই মনে হলো বেঁচে থাকাটা এতো কষ্টের কেন? শান্তি কি তবে কেবল মৃত্যুতেই?

উর্বশীর সাথে এমন ব্যবহারের জন্য মোহনা খুব রেগে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ঈশানকে ফোন করে সে ঝারতে লাগল,” এসব কি ঈশান? মেয়েটার সাথে তুই এমন করলি কেন? এগুলো কোনো কথা? তুই জানিস ও নিজের ঘরে জীবনে একটা কাজ করেনি৷ অথচ তোর জন্য…”

ঈশান ক্লান্ত স্বরে বলল,” কে ও? কেন করছে সে এসব? তুমি ওকে পাঠিয়েছো?”

” হ্যাঁ, আমিই পাঠিয়েছি।”

” কেন মম?”

” তুই আমাকে কি প্রমিস করেছিলি মনে নেই? বিয়ে করবি বলেছিলি।”

” হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এখনি কেন?”

” তোকে আমি কষ্টে দেখতে পারব না। যত দ্রুত তুই মুভ অন করবি তত আমার শান্তি। তোর জীবনটা এলোমেলো রেখে আমি কিভাবে নতুন জীবন শুরু করব বলতো?”

ঈশান এবার বলল,” ঠিকাছে। আমি যদি উর্বশীকে বিয়ে করি তাহলে তুমি খুশি থাকবে তো?”

” অনেক বেশি খুশি থাকবো। ”

” ডান।”

পরেরদিন উর্বশীকে ঘুম থেকে টেনে তুলে রোহিনী বলল,” তোর সঙ্গে ঈশান দেখা করতে এসেছে।”

উর্বশী চোখ কচলাচ্ছিল। ঈশানের নামটা শুনে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল,” হোয়াট? তুমি সত্যি বলছো?”

” সত্যি! বিশ্বাস না হলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দ্যাখ!”

উর্বশীর হাত-পা কাঁপছে উত্তেজনায়। চোখের পলক পড়ছে না বিস্ময়ে। আজকের সকালটা বুঝি তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সকাল! মায়ের কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না বলে নিজেই গেল ড্রয়িংরুমে। ঈশানকে একবার উঁকি মেরে দেখেই ঘরে চলে এলো। সুন্দর করে সাজগোজ করল। এতোদিনে কি তাহলে মন গলেছে মিস্টার পাথরের?

ইনজাদ সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ করল ঈশান,” আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”

” জ্বী আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”

” ভালো। হঠাৎ তুমি কি মনে করে? ইয়াজিনের কাছে এসেছো?”

ঈশান কিছু বলার আগেই উর্বশীর আগমন ঘটল। তার গায়ে কমলা রঙের শাড়ি। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। ইনজাদ সাহেব মেয়ের এমন সাজ দেখে হতবিহ্বল কণ্ঠে জানতে চাইলেন,” কি হয়েছে তোমার? আজ বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান নাকি?”

উর্বশীর মুখ শুকিয়ে গেল। সে যদি আগে জানতো বাবা এখানে আছে তাহলে ভুলেও আসতো না। শুকনো একটা ঢোক গিলে বলল,” আজ ফ্লোরিডাদের বাসায় অনুষ্ঠান আছে। আমি সেখানে যাওয়ার জন্যই তৈরী হয়েছিলাম।”

” ও আচ্ছা। ঠিকাছে যাও। বাইরে অনেক ঠান্ডা। সোয়েটার পরে যাও।”

উর্বশী অসহায় হয়ে ঈশানের দিকে তাকাল। অযথাই তাকে এখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। কি মুশকিল! আড়ষ্ট পায়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল সে। তখনি ঈশান ডাকল,” উর্বশী, তোমার সাথেই কথা বলতে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে যেও? বসো।”

উর্বশী চট করে বসে পড়ল। ইনজাদ সাহেব সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,” উর্বশীর সাথে তোমার কি কথা?”

” আসলে আঙ্কেল আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম৷ গতকালকের সেই মিসবিহেভের জন্য আই এম স্যরি, উর্বশী।”

ঈশান উর্বশীর দিকে চাইল। উর্বশী বিমূঢ় হয়ে আছে। সে ভাবতেও পারেনি ঈশান সকাল সকাল তার বাড়ি বয়ে এসে এইভাবে ক্ষমা চাইবে। সবই চকলেট আন্টির কেরামতী। তিনি নিশ্চয়ই আচ্ছামতো ঝেরে দিয়েছিলেন। তাই ঈশানের বাঁকা রগ সোজা হয়ে গেছে। উর্বশী হালকা হেসে বলল,” ইটস ওকে।”

ইনজাদ সাহেব তাদের ব্যাপার-স্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে বললেন,” গতকাল কি হয়েছিল? আমি কি জানতে পারি?”

উর্বশী চোখের ইশারায় প্রাণপণে ঈশানকে সত্য বলতে নিষেধ করল। ঈশান ইতস্তত কণ্ঠে বলল, ” তেমন কিছু না৷ একটা ছোট্ট ইনসিডেন্ট।”

” ওকে,,আই সী।”

” আঙ্কেল আমি তাহলে এখন উঠি।”

” ব্রেকফাস্ট করে যাও।”

” না থ্যাংকস। আমি খেয়ে এসেছি। আর এখন একটু চেম্বারে যেতে হবে। একজন ক্লায়েন্ট অপেক্ষায় আছে। দেরি হতে পারে।”

” ঠিকাছে বাবা, আবার এসো।”

ঈশান বের হওয়ার সাথে সাথেই উর্বশী বলল,” আমি ফ্লোরিডার বাসায় যাচ্ছি বাবা।”

এই কথা বলে সেও দ্রুত বের হয়ে গেল। ইনজাদ সাহেব তাদের পুরো ব্যাপারটা চট করে বুঝে নিয়েই মুচকি হাসলেন।

ঈশান লিফটে উঠেছে। দরজা বন্ধ হওয়ার সময় উর্বশী দ্রুত হাত দিয়ে আটকালো। তারপর নিজেও ঢুকে গেল। ঈশানের পাশে দাঁড়িয়ে হাসি-খুশি কণ্ঠে বলল,” কেমন আছেন মিস্টার সাইকোলজিস্ট?”

” ভালো।”

” আপনি এভাবে বাড়িতে চলে আসবেন আমি সেটা চিন্তাও করিনি। মনে আছে সেদিন আপনার বাড়ির জিমনেসিয়ামে দেখা করতে এসেছিলাম যখন, আপনি আমাকে কি বলেছিলেন?”

” মনে পড়ছে না। কি বলেছিলাম?”

” আমি তো বলবো না। আপনি নিজেই মনে করুন।”

লিফটের দরজা খুলে গেল। ঈশান বের হয়ে যেতে লাগল। উর্বশী ত্বরিতে তার পিছু নিয়ে বলল,” এখন কোথায় যাচ্ছেন? চেম্বারে?”

” না। বাড়িতে। কিছু গোছগাছ করতে হবে। আজরাতে আমি বাংলাদেশে রওনা হচ্ছি।”

” ওয়াও, বাংলাদেশ! আমাকেও নিবেন প্লিজ? কতবছর হয়ে গেল বাংলাদেশে যাই না৷ আই মিস মাই কান্ট্রি সো মাচ।”

” ঠিকাছে। রাত আটটায় বাড়িতে চলে এসো।”

” ওকে.. হোয়াট? এই আপনি সত্যি আমাকে নিবেন?”

উবশী বিস্ময়ে বিমোহিত। ঈশান হাসল। উর্বশী খুশিতে গদগদ হয়ে চিৎকার করল। তখনি সে খেয়াল করল ইয়াজিন অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বশী তাকে দেখেই ঘাবড়ে গেল। ঈশান বলল,” আমি আসছি।” সে চলে যাওয়ার পর ইয়াজিন বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টি নিয়ে উর্বশীর কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,” এসব কি দেখছি আমি?”

” কোনসব?”

” তুই ঈশানের সাথে কি করছিলি?”

উর্বশী অযথাই একটা ভাব নিয়ে বলল,” আমার বয়ফ্রেন্ড হয়। তোমার কোনো সমস্যা?”

ইয়াজিন চোখমুখ বিকৃত করে বলল,” তোর বয়ফ্রেন্ড? মানে ঈশান?”

” কেন? ভালো চয়েজ না?”

” আমি তোর চয়েজের কথা ভাবছি না। বরং আমি ভাবছি ঈশানের মতো মানুষ তোর মতো ছাগলকে কিভাবে চয়েজ করল? ছিঃ!”

উর্বশী ফুঁসে উঠল,” ভাইয়া, আই হেইট ইউ।”

ঠিক সময়মতো ঈশানের বাড়িতে চলে এলো উর্বশী। দু’টো টিকিট আগেই কেটে রাখা হয়েছিল। উর্বশী যেতে রাজি হবে এটা ঈশান জানতো। তার পরিকল্পনা হলো মোহনাকে খুশি করা। উর্বশীকে নিয়ে বাংলাদেশে গেলে মোহনা অনেক খুশি হবে। শুধুমাত্র এই কারণেই সে উর্বশীকে নিচ্ছে। বাড়িতে সবকিছু ম্যানেজ করে আসতে উর্বশীর খুব একটা অসুবিধা হলো না। রোহিনী অনায়াসে অনুমতি দিয়েছে। ইনজাদ সাহেব মোহনার অনুরোধে রাজি হয়েছেন। সবকিছু এখন সেট। তারা সবরকম ফরমালিটিজ শেষ করে ফ্লাইটে উঠে গেল। উবশীর অসম্ভব ভালো লাগছে। জীবনে অনেকবার বিমান ভ্রমণ করেছে সে। কিন্তু কখনও এতোটা স্পেশাল লাগেনি। সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে উর্বশী প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, আপনি হঠাৎ আমাকে নিজের সাথে নিতে কেন রাজি হলেন?”

ঈশান নির্বিকারচিত্তে বলল,” মমের ইচ্ছা আমি তোমাকে বিয়ে করি।”

উর্বশী বিয়ের কথা শুনে চমকে উঠল। খানিকটা বিব্রত হয়ে প্রশ্ন করল,” আর আপনার কি ইচ্ছা?”

” আমার কোনো ইচ্ছা নেই। তবে আপাতত তোমাকে কিছু কথা বলা একান্ত জরুরী।”

” তারিনের বিষয়ে বলবেন?”

ঈশান অবাক হলো,” তুমি তারিনের ব্যাপারে জানো?”

” আন্টি আমাকে সবকিছু বলেছেন।”

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,” তাহলে তো হয়েই গেল। আমি কখনও ওকে ভুলতে পারবো না উর্বশী। বিয়ের পর কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারব কি-না সেটাও জানি না। কারণ তারিনের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। এখন তুমিই ঠিক করো, আমাকে বিয়ে করবে কি-না?”

উর্বশী কোনো উত্তর দিতে পারল না।

চলবে#তি_আমো
পর্ব ৫৯
লিখা- Sidratul Muntaz

( বলেছিলাম আজকের মধ্যেই শেষ পর্ব দিবো এটা কনফার্ম। হ্যাঁ দিবো।আজকে রাত বারোটার মধ্যেই, কথা দিচ্ছি।)

এল্যার্মের শব্দে তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে জেগে উঠল তারিন। আজ তার নতুন বিয়ের অষ্টম দিন। ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজে। তারিন পায়ের কাছে দেখল লাগেজ ব্যাগ গোছানো। আজ তারা ইন্ডিয়া যাচ্ছে। সেখান থেকে যাবে কাশ্মীর। বিয়ের পর প্রথম হানিমুন। তারিন বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিল। চোখ দু’টো ফুলে আছে। গালে অশ্রুর ছাপ অনেকটা কালশিঁটের মতো দেখা যাচ্ছে। তারিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে কি ঘুমের মাঝেও কাঁদে? ভাগ্যিস ফাহিম তার সঙ্গে থাকছে না। সে রাতে অন্যঘরে গিয়ে ঘুমায়। যদি এই ঘরেই থাকতো তাহলে ঘুমের মধ্যে তারিনের দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে ওঠার ব্যাপারটা তার চোখে অবশ্যই পড়তো। সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে তারিন বেঁচে যাচ্ছে।

ফাহিম খুব বুঝদার মানুষ। সে হয়তো বুঝতে পারে যে এভাবে আলাদা থাকতেই তারিনের স্বস্তি লাগছে। প্রথম কিছুদিন থাকুক দূরত্ব। মানিয়ে নিতেও তো সময় প্রয়োজন! রান্নাঘরে ফারজানা রুটি বেলছেন। তারিন বলল,” মা, কি করছেন এগুলো? আপনার না শরীর খারাপ? দিন আমাকে দিন।”

ফারজানা মসৃণ হাসি দিয়ে বললেন,” হয়ে গেছে মা।রুটি বেলা আর কি এমন কঠিন কাজ? তুমি খেতে বসো।”

” আমি তাহলে ডিম ভাজি করি।”

” দরকার নেই। সব করা আছে।”

তারিন চুলার কাছে দেখল সবজি ভাজি, ডিমভাজি সুন্দরভাবে রান্না করা। তারিন মুচকি হাসল। গতরাতে ফাহিম প্রায় বারোটা পর্যন্ত গোছগাছ করেছে। তারিনকে একটা কাজও করতে হয়নি। সকালে আবার শাশুড়ী মা নাস্তাও বানিয়ে রাখেন। দুপুরের রান্নাটাও নিজেই করেন। তারিনের মনে হচ্ছে সে বেড়াতে এসেছে। এমন শাশুড়ী-জামাই পাওয়া যেকোনো মেয়ের জন্য সৌভাগ্যের। কিন্তু মনেই যদি শান্তি না থাকে হাজার সৌভাগ্য দিয়েও লাভ হয় না। দিনশেষে সবকিছুই ভারী দীর্ঘশ্বাসের কাছে হার মেনে যায়।

ফাহিম ডাইনিং টেবিলে বসল। তারিন এসে পাশে বসতেই ফাহিম হাসিমুখে বলল,” গুড মর্ণিং।”

” গুড মর্ণিং।”

” তারিফ ভাইয়া ফোন করেছিল। তোমার নাকি ওই বাড়িতে যাওয়ার কথা?”

” চলে যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে একবার দেখা করতে তো যেতেই হবে। তাছাড়া আমার কিছু জিনিসও নেওয়ার ছিল।”

ফারজানা খাবার পরিবেশন করতে করতে বললেন,” এখনি চলে যাও তাহলে। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে এসো। সবাইকে ভালো করে বিদায় জানিয়ে আসবে৷ কারণ আমরা কিন্তু কমপক্ষে দশদিনের জন্য যাচ্ছি।”

ফাহিম বলল,” কি বলছো মা? এতো কম? অন্তত একমাসের জন্য যাওয়া উচিৎ।”

ফারজানা ঠাট্টার সুরে বললেন,” হানিমুনে কেউ এতোদিনের জন্য যায়? মানুষ তো নির্লজ্জ বলবে তোকে।”

তারিন হেসে ফেলল। শুকনো আর মলিন হাসি। ফাহিম ঝলমলে কণ্ঠে বলল,” অসুবিধা কি? তুমিও যাচ্ছো মা। সবাইকে বলবো তোমার জন্য দেরি হয়েছে। ইন্ডিয়াতে তোমাকে ডাক্তার দেখাতে গিয়েই দেরি। সিম্পল!”

” হ্যাঁ এখন সব দোষ আমার তাই না?”

মা আর ছেলের এমন দুষ্ট-মিষ্টি খুনশুঁটি সবসময় চলতেই থাকে। এতো ভালো এই মানুষগুলো। সবসময় হাসি-আনন্দে মেতে থাকে। অথচ তাদের দু’জনের মাঝখানে বসেও তারিনের নিজেকে প্রতিনিয়ত খুব নিঃসঙ্গ মনে হয়। কারো আনন্দ তাকে স্পর্শ করতে পারে না৷ তবুও সে হাসে, জোর করে। কতদিন চলবে এই খুশি থাকার অভিনয়? মানুষ কি আসলেই ভুলে যায় নাকি অভ্যস্ত হয়ে যায়? অভ্যস্ত হতে ঠিক কতটা সময় লাগে? এক-দুই মাস, বছর নাকি সারাজীবন?

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠেছে ঈশান আর উর্বশী। মুখে মাস্ক, চুলে স্কার্ফ আর চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গাঁট হয়ে বসে আছে উর্বশী। বাংলাদেশে এতো দূষণ! কিছুক্ষণ পর পরই ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি আটকে যাচ্ছে। অসহ্যকর অবস্থা একদম! তবে শত হলেও নিজের দেশ আবার পাশে আছে পছন্দের মানুষ। তাই ব্যাপারগুলো বিরক্তিকর হলেও উর্বশী মনে মনে উপভোগ করছে। তাদের এতো দীর্ঘসময়ের যাত্রায় বিয়ের বিষয়টা নিয়ে আর একবারও কথা হয়নি। ওইযে ঈশান প্রশ্ন করছিল, ” ভেবে দেখো আমাকে বিয়ে করবে কি-না!” এরপর উর্বশী উত্তর দেয়নি। ঈশানও এই ব্যাপারে আর একটাও প্রশ্ন করেনি। এই মুহূর্তে উর্বশী নিজে থেকেই বলল,” আমি রাজি। ”

ঈশান মোবাইল স্ক্রল করছিল। উর্বশীর কথা কানে আসতেই কিছুটা বিস্ময়ের সুরে বলল,” মানে?”

উর্বশী জানালার দিকে চোখ রেখে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,” আপনাকে বিয়ে করতে আমি রাজি।”

ঈশানের থেকে আর কোনো উত্তর আসছে না৷ সে রীতিমতো বাকরুদ্ধ। উর্বশী একটু পর ঈশানের দিকে তাকাল,” কি ব্যাপার? হাঁ করে চেয়ে আছেন কেন?”

ঈশান বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,” আমার ব্যাপারে সবকিছু জানার পরেও বিয়ে করতে চাও? মানে কেন? ”

” কারণ আমি… আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

ঈশান অকপটে বলল,” কিন্তু আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি। নতুন কাউকে তার জায়গাটা দেওয়া সম্ভব না।”

” প্রবলেম কি? আমাকে নতুন আরেকটা জায়গা দিবেন!”

ঈশান মৃদু হেসে বলল,” বলা খুব সহজ। নিজের লাইফের সাথে এতোবড় রিস্ক নিও না।”

” আমার রিস্ক নিতে ভালো লাগে। এডভেঞ্চার ছাড়া জীবন পানসে। তাছাড়া আমার নিজের প্রতি বিশ্বাস আছে। একদিন হয়তো আপনি তারিনের থেকেও আমাকে বেশি ভালোবাসবেন!”

ঈশান শব্দ করে হেসে উঠল। উর্বশী ভ্রু কুচকে বলল,” কারো কনফিডেন্স দেখে এভাবে হাসতে হয় না। আপনি কি মজা নেওয়ার চেষ্টা করছেন?”

” এটাকে বলে ওভার কনফিডেন্স। হয় তুমি আমার সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছো না আর না হলে নিজের প্রতি বেশিই ভরসা করছো। যাইহোক, তুমি বিয়ে করতে রাজি থাকলেও আমি রাজি না। তবে আমি তোমার কাছে একটা ফেবার চাইবো।”

” আপনি বিয়েতে রাজি না? তাহলে আমাকে কেন জিজ্ঞেস করেছেন যে আমি রাজি কি-না?”

” কারণ আমি ভেবেছিলাম আমার কথা শোনার পর তুমি হয়তো রাজি হবে না। কিন্তু এখন দেখছি তুমি পাগল। আমি তো আর পাগল না। তাই তোমাকে বিয়ে করার মতো পাগলামিটাও করবো না।”

উর্বশী মনখারাপ করে ফেলল। ভাঙা কণ্ঠে বলল,” আপনি এতো রুড কেন?”

ঈশান জবাব দিল না। উর্বশী গালে হাত রেখে কিছুটা অভিমানী কণ্ঠে জানতে চাইল,” আচ্ছা বলুন, কি ফেবার লাগবে? আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

” তুমি মমকে বলবে আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। লন্ডন ফিরে গিয়ে আমরা বিয়ে করবো। কিন্তু আসলে করব না। জাস্ট মিথ্যা বলতে হবে।”

” কেন? মিথ্যা কেন বলবেন?”

” আমি মিথ্যা না বললে মম নিজে বিয়ে করবে না।”

উর্বশী ফিক করে হেসে উঠে বলল,” নিজের মাকে বিয়ে করানোর জন্য মিথ্যা বলে এমন ছেলে হয়তো আপনিই প্রথম।”

ঈশান শক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। উর্বশী হাসা বন্ধ করে কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল,” ঠিকাছে মিথ্যাই বলবো।” যদিও তার মন বলছিল,” দিনশেষে আপনি আমাকেই বিয়ে করবেন মিস্টার পাথর। আর আমিও একদিন আপনাকে গলিয়েই ছাড়ব। এটা উর্বশীর চ্যালেঞ্জ।”

মোহনা ছাদে উঠে যোগব্যায়াম করছিল। তার গায়ে টি-শার্ট আর ট্রাউজার। চোখ বন্ধ করে পদ্মসনে বসে থেমে থেমে শ্বাস নেওয়া। আচমকা একটু অদ্ভুত অনুভব হওয়ায় সে চোখ খুলল। দেখল সূর্যবানু বেগম ঠিক তার সামনে বসে আছেন। চোখ দু’টো বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মোহনা আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠল। সূর্যবানু সঙ্গে সঙ্গে দুইহাতে মোহনার মুখ চেপে ধরল,” বাড়ির বউ হয়া এমনে চিক্কুর করা কুনু ভালো কাম না। চুপ থাকো।”

মোহনা ছটফটিয়ে নিজেকে মুক্ত করে বলল,” আপনি এখানে কি করছেন?”

” আশেপাশে কত বিল্ডিং দেখছো? বেডা মাইনষে লুকায়া তোমারে দেখে প্রত্যেকদিন। আমি আইছি পাহারা দিতে।”

মোহনার বুক ধরফর করছিল। সে দম নিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,” ও আচ্ছা। থ্যাংকস। কিন্তু তাই বলে এইভাবে আমার সামনে এসে তাকিয়ে থাকবেন? আরেকটু হলেই তো আমার প্যানিক এটাক হয়ে যাচ্ছিল।”

” তুমি প্রতিদিন পাগলা বেডাগো মতো ছাদে বয়া ধ্যান করো। আবার ঠোঁটও নাড়ো। মনে মনে কি দোয়া পড়ো? কি চাও? নামায পড়লেই তো হয়। এমন পাগলা কাম করন লাগে না।”

মোহনা কি উত্তর দিবে বুঝতে না পেরে চুপ হয়ে গেল। তারিফ তখনি ছাদে এসেছিল। হাসতে হাসতে বলল,” দাদী এটাকে বলা হয় ইয়োগা। শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য করে। কোনো প্রার্থনা না।”

সূর্যবানু বেগম বিভ্রান্ত হলেন। মুখ কুচকে বললেন,” শইল-সাস্থ ঠিক রাখনের লাইগা এমন পাগলের কাম করন লাগব কে? আমরা তো করি না। আমগো শইল-সাস্থ কি খারাপ আছে?”

তারিফ খোশমেজাজে বলল,” যে যেভাবে অভ্যস্ত।”

” কি জানি ভাই?” সূর্যবানু বেগম বিরক্তি নিয়ে ছাদ থেকে নামলেন। তিনি যে ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না তা আচরণেই বোঝা যাচ্ছে। মোহনা একটু অস্বস্তিবোধ করছিল। তারিফ সেটা বুঝতে পেরেই বলল,” বাদ দাও। দাদী এরকমই। সব বিষয়ে খুঁতখুঁতে। তুমি কিছু মনে কোরো না।”

মোহনা সহজ হেসে বলল,” তোমার কি মনে হয়? এই সামান্য বিষয় নিয়ে আমি মনখারাপ করব?”

” একদম না!”

মোহনা যে মাদুরের উপর বসেছিল সেটা এখন উঠিয়ে ভাঁজ করতে লাগল। তারিফ কার্ণিশের কাছে গিয়ে বলল,” বিয়ে কবে হচ্ছে আমাদের?”

মোহনা এমন প্রশ্নে অবাক হলো। তারপর একটু মজা করেই বলল,” বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছো মনে হয়? এতোবছর ধরে অপেক্ষা করতে পেরেছো আর সামান্য কিছুদিনের জন্য অধৈর্য্য হয়ে পড়লে?”

” অধৈর্য্য হইনি। শুধু জানতে চাইছি। তুমি তো কোনো নির্দিষ্ট সময়ও বলছো না।”

” ঈশান যখন আসবে, বিয়ে তখনি হবে।”

” ঈশান কখন আসবে?”

ট্যাক্সির শব্দ পাওয়া গেল। তারিফ-মোহনা একসঙ্গে নিচে তাকাল। গাড়ি থেকে নামছে ঈশান আর তার সঙ্গে একটা সুন্দরী মেয়ে। মোহনা মুখে হাত দিয়ে বলল,” নাও, চলে এসেছে আমার ছেলে আর ছেলের বউ।”

মোহনা দৌড়ে নিচে গেল। ঈশান বাড়ির ভেতর ঢুকতেই মোহনা তাকে জাপটে ধরল। ঈশান ফিসফিস করে বলল,” মি ইউ আ লট।”

” আই মিস ইউ টু।”

উর্বশী চঞ্চল কণ্ঠে বলল,” চকলেট আন্টি?”

” কেমন আছো লিটল এঞ্জেল?”

” অনেক ভালো। ”

তারিফ ঈশানের সাথে কোলাকুলি করল। ঈশান বলল,” কেমন আছেন ভাইয়া?”

” এইতো ভালো, তোমার কি অবস্থা?”

উর্বশী বলল,” উনিই কি তাহলে…”

মোহনা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। উর্বশী আনন্দভরা কণ্ঠে বলল,” আমি কি আপনাকে চকলেট আঙ্কেল বলে ডাকতে পারি?”

তারিফ একটু হেসে বলল,” আচ্ছা।”

” থ্যাঙ্কিউ চকলেট আঙ্কেল।”

” ভেতরে চলো তোমরা। হুটহাট এমন না জানিয়ে চলে এসে তো বিরাট সারপ্রাইজ দিলে।”

” মমকে সারপ্রাইজ দিতেই চেয়েছিলাম। তাই আগে থেকে বলিনি।”

তারিফ একটু বিরক্ত হয়ে বলল,” নো মম, এখন থেকে শুধু ভাবী। আমাকে যে ভাই ডাকে আমার বউকে সে মম ডাকবে এটা আমি মানতে পারব না।”

ঈশান এই কথায় হেসে ফেলল। উর্বশীও খুব মজা পেল। কিন্তু মোহনা লজ্জায় হাসতেও পারল না আবার কথাও বলতে পারল না। তারিফ ঈশানকে ওয়ার্নিং দেওয়ার মতো বলল,” এখন ও আর তোমার বাবার বউ নেই৷ তাই আমাকে ভাই ডাকলে ওকে ডাকবে ভাবী।”

ঈশান বিব্রতভাবে প্রশ্ন করল,” ভাবীই ডাকতে হবে?”

তারিফ সহজ করার জন্য বলল,” ঠিকাছে, ভাবী না ডাকতে পারলে ভাবী মা ডেকো। অনেক সময় ভাবীও আমাদের মায়ের মতো হয়।”

ঈশান অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তারিফ দৃঢ়চিত্তে বলল,” ভাবী ডাকো। দ্রুত।”

তারিফের এমন আচরণে সকলে অবাক। যেন ঈশান ‘ভাবী’ না ডাকলে তারিফ তাকে ঘরেই ঢুকতে দেবে না আজ। ঈশান বাধ্য হয়ে সব অস্বস্তি দূরে ঠেলে বলল,” ঠিকাছে, ভাবী। এখন থেকে ভাবীই ডাকব।”

তারিফ তীব্র আওয়াজে বলল,” ভেরি গুড। সাবাশ!”

বাড়িতে এতো ভীড়-ভাট্টা দেখে অবাক হলো তারিন। কিছু কি হয়েছে নাকি? নিহাদের বাড়ির অধিকাংশ মানুষ আজ তাদের বাড়িতে। উঠানে বিসমিকে হাঁটতে দেখা গেল। তারিন রিকশা থেকে নেমেই হাত বাড়িয়ে ডাকল,” এই বিসমি, শোনো।”

” আরে তারিন আপু, তুমিও এসে গেছো?”

” কি হচ্ছে আমাদের বাড়িতে? ভাইয়া আর ভাবীর বিয়ে নিয়ে কিছু নাকি? সবাই এখানে কেন?”

বিসমি হাসিমুখে উত্তর দিল,” ঈশান ভাই এসেছে তো। এটা জেনেই সবাই দেখা করতে ছুটে এসেছে।”

তারিনের ভেতরটা কাতরিয়ে উঠল। অচিরেই চোখ ভরে গেল নোনাজলে। ঈশান যে আসবে এটা তাকে কেউ জানাল না কেন? আগে জানলে তো সে ভুল করেও এখানে আসার দুঃসাহস করতো না।

বিসমি বলল,” তুমি ভেতরে আসবে না? ঈশান ভাই এখন ছাদে আছে। তুমি নিশ্চিন্তে নিজের ঘরে যেতে পারো।”
তারিন মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলল,” ঠিকাছে।”

বিসমি চলে যাওয়ার পরেও তারিন দাঁড়িয়ে রইল।তারপর দ্রুতপায়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকতে নিল। কিন্তু পারল না। তার মন এবং চোখ দু’টোই ছাদের দিকে যেতে চাইছে। ঈশানকে দেখতে প্রচন্ড ইচ্ছে করছে। নিষিদ্ধ এই ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া যায় না বলেই তারিন মনকে শাসালো। বহু কষ্টে সে শক্ত হয়েছিল। ঈশানের সাথে দেখা করে আবার দূর্বল হতে চায় না। কিন্তু সে কি করবে? মন যে মানছে না! বিয়ের পর এমন কোনো রাত নেই যে রাতে ঈশান তার স্বপ্নে আসেনি। প্রতি রাতেই তারিন স্বপ্নে দেখে ঈশান কাঁদছে। অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তারিনের কাছে কাতরভাবে অনুরোধ করছে,” আমাকে ক্ষমা করে দাও তারিন৷ তোমার শাস্তি দেওয়া কি এখনও শেষ হয়নি? একটা ভুলের কত শাস্তি হয় বলোতো? এইভাবে নিঃস্ব করে চলে যেতে পারলে আমাকে? আমি এখন কি নিয়ে থাকবো?”

তারিন চোখটা মুছে ছাদের দিকে রওনা হলো। ঈশানকে সে লুকিয়ে শুধু একটিবার দেখবে।

ঈশান নীরবে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হাত রেখে। তার পাশেই মোহনা। দু’জন কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ হয়ে গেছে। কারণ ঈশান কাঁদছে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে পুরনো স্মৃতিগুলো একটু একটু করে মনে আসছে আর ভেতরটা খাঁক হয়ে যাচ্ছে। এইতো, ছাদের এই পাশে দাঁড়িয়েই তারিন প্রথমবার স্বীকার করেছিল যে সে ঈশানকে ভালোবাসে। কত চমৎকার দিন ছিল। তাদের প্রথম চুম্বনও এইখানে হয়েছিল। তারপর কত দুষ্টু-মিষ্টি স্মৃতি, কত হাসি-ঠাট্টা, কত সুখ! ইশ, সুখের ফুলগুলো সব ভুল হয়ে ঝরে গেছে। থেকে গেছে শুধু আফসোস। বুকভরা হাহাকার। ঈশান চোখের কোণ মুছে বলল,” মাঝে মাঝে আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় মম। বেঁচে থাকাটা এতো কঠিন কেন?”

” ছিঃ, এসব কথা বলে না ঈশান। তুই আবার মুভঅন করতে পারবি। মানুষ কি ভালোবাসা হারায় না? শত শত বিচ্ছেদের গল্প আছে। সবাই কি মরে যাচ্ছে বল? সব ভুলে সবাই যদি বাঁচতে পারে তাহলে তুই কেন বাঁচতে পারবি না?”

ঈশান অধৈর্য্য কণ্ঠে বলল, “আমাকে আমার আফসোস বাঁচতে দিচ্ছে না। অপরাধবোধের যন্ত্রণায় তিলে তিলে শেষ হচ্ছি আমি। দুইবছর আগে যদি তারিনকে ছেড়ে না যেতাম তাহলে আজ হয়তো ও আমার সাথেই থাকতো।”

মোহনা কঠিন গলায় বলল,” না, থাকতো না৷ যে ভাগ্যে থাকে না সে কোনো অবস্থাতেই থাকে না। তোকে এটা মানতে হবে।”

” আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন?”

মোহনা ঈশানের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,” সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নিহা হঠাৎ করেই ছাদে এসে শব্দ করল,” তারিনকে দেখেছো তোমরা?”

ঈশান চমকে উঠল,” তারিন এখানে আসবে কি করে?”

” বিসমির কাছে শুনলাম সে এসেছে। আমি তাকে ছাদেও উঠতে দেখেছি।”

মোহনা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” কোথায়? আমরা তো এখানেই দাঁড়িয়েছিলাম। তারিনকে তো দেখলাম না।”

নিহা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,” তাহলে হয়তো ঈশান ভাইকে দেখে চলে গেছে।”

মোহনা বলল,” সেটাই হবে হয়তো।”

নিচ থেকে আয়েশা ডাকলেন মোহনাকে। নিহা আর ঈশানকে গল্প করতে বলে মোহনা নিচে চলে গেল।

নিহা কাছে এসে প্রথমেই প্রশ্ন করল,” মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন ঈশান ভাই? আপনি কি কাঁদছেন?”

ঈশান হেসে জবাব দিল,” কাঁদলে যদি মন হালকা হয় তাহলে ক্ষতি কি কান্নায়? ”

নিহা ব্যথিত কণ্ঠে বলল,” সত্যি, আপনারা এভাবে আলাদা হয়ে যাবেন এটা আমি কখনও কল্পনাই করিনি। যখন শুনেছিলাম আপনাদের ব্রেকাপ হয়েছে তখন ভেবেছিলাম সাময়িক ঝগড়া। দূরে চলে গেলে এমন একটু-আধটু হয়। আবার ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কে জানতো সব যে এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে! ফাহিম ভাইয়ের সাথে তারিনের বিয়ের বিষয়টা যদি আমি আগে জানতে পারতাম তাহলে যেকোনো মূল্যে আটকাতাম। জানেন ঈশান ভাই, তারিন ভেবেছিল আপনি লন্ডন গিয়ে তাকে ভুলে গেছেন৷ তাই সেও ফাহিম ভাইকে নিয়ে মুভঅন করতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন সে জানল আপনি এখনও… ”

ঈশান এই পর্যায় থামালো নিহাকে।

” বাদ দাও নিহা প্লিজ। এসব এখন বলে কি লাভ? তারিনের নতুন সংসার হয়েছে। ও ভালো আছে, এটাই অনেক। আমার কাছে সুখে না থাকলেও ফাহিমের কাছে সুখে থাকবে! সুখে থাকা নিয়ে হলো কথা। ”

নিহা ছলছল দৃষ্টিতে বলল,” শুধু তারিনের সুখটাই দেখবেন? কিন্তু আপনার কি হবে ঈশান ভাই?”

” কি আর হবে? ভুল করেছিলাম। শাস্তি পেয়ে যাবো।”

” তাই বলে আজীবন?”

” আমাকে কথা দাও, তারিনকে কখনোই এসব বুঝতে দিবে না।”

” একজন মানুষ তার কথা ভেবে সারাজীবন কষ্ট পাবে আর সে জানবেও না? এটা তো ঠিক না!”

” আমি ঠিক-বেঠিক বুঝি না। আমি শুধু বুঝি এতেই তারিন ভালো থাকবে। আমার কথা জানলে ও এখন নীরবে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। তাই এটা জেনেই ও ভালো থাকুক যে আমি ওকে ভুলে গেছি।”

তারিন কথাগুলো আড়াল থেকে শুনছিল আর সত্যিই নীরবে কাঁদছিল। কারণ নীরবে কাঁদা ছাড়া তার আর সত্যিই কিছু করার নেই। চিলেকোঠার ঘরের সাথে লাগোয়া যে বাথরুমটা আছে, সেখানেই দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে তারিন। কথাগুলো শুনে তার এখন স্রেফ মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

নিহা বলল,” কিন্তু আপনি যেটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছেন সেটা মিথ্যা।”

” মানে? কোনটা মিথ্যা?”

” তারিন ফাহিম ভাইয়ের কাছেও সুখে নেই। আজ তার বিয়ের প্রায় আটদিন হয়ে গেল৷ এতোগুলো দিনে এমন কোনো রাত নেই যেদিন মেয়েটা কাঁদেনি।”

ঈশান খুব অবাক হয়ে বলল,” কিন্তু কেন? কি হয়েছে তারিনের?”

” ঠিক বিয়ের আগ মুহূর্তে যদি কেউ বুঝতে পারে সে তার বরকে নয় অন্যকাউকে ভালোবাসে তখন তার কি অবস্থা হয় বলুন তো?”

ঈশান কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকিয়েই রইল। নিহা একে একে ঈশানকে সবঘটনা জানিয়ে দিল। বিয়ের দিন তারিনের অদ্ভুত আচরণ, ঈশানের জন্য কাঁদা তারপর বাধ্য হয়ে ফাহিমকে বিয়ে করা। তারিন হঠাৎ পা পিছলে বাথরুমে পড়ে গেল। শব্দ পেয়ে নিহা আর ঈশান চিলেকোঠার ঘরে ঢুকল। তারা ঠিক বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো। তারিন তড়িঘড়ি করে বের হতে নিয়েই একদম ঈশানের সামনে পড়ে গেল। চার চোখের মিলন ঘটল আবারও। অথচ চারটি চোখের কার্ণিশই তখন অশ্রুভেজা। তারিন স্তম্ভের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চট করে বের হয়ে গেল। ঈশান তখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নিহা কিছু একটা বলছিল তাদের দু’জনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই কথা ঈশান বা তারিন কারো কানেই গেল না। তাদের পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিরহ ভালোবাসার দাবদাহে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গেছে।

ছাদ থেকে নেমে ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে দিল তারিন। বুকের ভেতর প্রচন্ড চাপ অনুভব হচ্ছে। এতো করে চেয়েছিল যাতে ঈশানের সঙ্গে দেখাটা না হয়। কিন্তু সেই দেখা হয়েই গেল। তারিন নিজেকে কেন সামলাতে পারছে না? হঠাৎ করে তার কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? এর থেকে দমবন্ধ হয়ে যদি সে ম’রে যেতো তাও ভালো ছিল। বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ এলো। কেউ কি ভেতরে আছে? তারিন শব্দ করে ডাকল,” কে ভেতরে?”

একটি রিনরিনে মেয়েলী কণ্ঠস্বর জবাব দিল,” আমি। আপনার যদি ইমারজেন্সী হয় তাহলে অন্যকোথাও যান প্লিজ। এই বাড়িতে আরও ওয়াশরুম আছে।”

তারিন কোনো কথা বলল না৷ মেয়েটির কণ্ঠ অপরিচিত। সে জানেও না তারই ঘরে, তারই বাথরুমে কে গোসল করছে! আলমারি খুলে নিজের জিনিসগুলো বের করে গোছাতে লাগল। যত দ্রুত এখান থেকে যাওয়া যায় ততই ভালো। তারিনের হাত কাঁপছে। উর্বশী ঠিক পাঁচমিনিট পরেই বের হয়ে গেল। তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে সে তারিনের দিকে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে খুব জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল,” আরে… তুমি তারিন না?”

তারিন চমকে গেল। থতমত খাওয়া কণ্ঠে বলল,” জ্বী। আমিই তারিন। কিন্তু আপনি কে? স্যরি, আমি ঠিক চিনতে পারলাম না।”

” চেনার কথাও নয়। কারণ আমাদের আগে কখনও দেখা হয়নি।”

উর্বশী বিছানায় বসে খুশি খুশি কণ্ঠে আরও বলল,” তবুও আমি তোমাকে চিনি।”

” কিভাবে?”

” ছবিতে দেখেছি। চকলেট আন্টি পাঠিয়েছিল। আমার চকলেট আন্টি মানে তোমার ভাবী। তিনি খুব সুন্দর তো, তাই আমি ডাকি চকলেট আন্টি।”

” ও আচ্ছা।”

” তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে। আমি তো তোমাকেই খুঁজছিলাম। তুমি শ্বশুরবাড়ি চলে গেছো শুনে খুব মনখারাপ হয়েছিল। ভেবেছিলাম দেখাই হবে না।”

তারিন কৌতুহলপূর্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল,” আমাকে কেন খুঁজছেন?”

” কারণ তোমাকে আমি থ্যাংকস দিতে চাই। তোমার জন্যই তো ঈশানকে আমি পেয়েছি। তুমি যদি ওকে না ছাড়তে তাহলে আমার কি হতো বলো? আমি ঈশানকে অসম্ভব পছন্দ করি।”

তারিন প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেল। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ক্ষয়ে গেল। উর্বশী পকপক করে কথা বলে যাচ্ছে,” চকলেট আন্টির কাছে তোমাদের সম্পূর্ণ গল্পটা শুনেছি আমি। হোয়াট এন আমাজিং লাভস্টোরি! কিন্তু এন্ডিংটা খুব স্যাড। ঈশান আমাকে কি বলেছে জানো? সে নাকি সবসময় তোমাকেই ভালোবাসবে। তোমার জায়গা কখনও কাউকে দিতে পারবে না। এমনকি তার ঘর, কাজের জায়গা, ডেস্ক টেবিল সবখানে তোমার ছবি লাগানো। এতো ভালো কেউ বাসতে পারে? ইশ, আমাকে যদি কেউ এভাবে ভালোবাসতো তাহলে আমি কখনও তাকে ছেড়ে যেতাম না। তুমি আমার দেখা সবচেয়ে লাকি গার্ল তারিন। আবার একই সাথে তুমি খুব আনলাকিও। ঈশান তোমাকে কত্ত ভালোবাসে। তবুও তাকে তুমি বিয়ে করতে পারলে না। এটাই তোমার ব্যাডলাক..”

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ তারিনের দিকে নজর যেতেই থেমে গেল উর্বশী। কারণ তারিন কাঁদছে। মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে। তার পুরো শরীরটা কাঁপছে। উর্বশী খুব হকচকিয়ে গেল। কাছে এসে তারিনের বাহু স্পর্শ করে বলল,” তারিন কি হয়েছে? স্যরি যদি আমি তোমাকে হার্ট করে থাকি।”

তারিন জবাব দিল না। সে কেবল কেঁদেই যাচ্ছে। তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। দুইহাতে মুখ চেপে ভীষণ হাহাকার করতে লাগল। উর্বশী স্তম্ভিত। কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে সে আবার বলল,” স্যরি তারিন। আমি বুঝতে পারিনি। তুমি ঈশানকে এখনও খুব ভালোবাসো তাই না? তাহলে বিয়ে কেন করলে? ঈশানও কষ্ট পাচ্ছে, তুমিও কষ্ট পাচ্ছো। এটা কি ঠিক বলো?”

নিহা ঘরে প্রবেশ করল। তারিনের অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” কি হয়েছে ওর?”

উর্বশী মলিন মুখে বলল,” জানি না। আমার কথা শোনার পর থেকে শুধু কাঁদছেই৷ আমি বলেছিলাম…”

” আচ্ছা থাক, তুমি এখান থেকে যাও। আমি ওর সাথে কথা বলছি। আর এই ব্যাপারটা কাউকে বলার দরকার নেই।”

” ওকে।”

উর্বশী বেরিয়ে যাওয়ার পর নিহা দরজা আটকে তারিনের কাছে বসল। ভারাক্রান্ত গলায় সান্ত্বনা দিল,” থাম তারু। শান্ত হো। তোর মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন কি করার আছে বল?”

তারিন দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আর্তনাদ করল,” এসব কি হয়ে গেল নিহা? কেন হয়ে গেল বল না? জীবনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না..”

তারিনের ফোন বেজে উঠল। ফাহিমের নাম্বার। নিহা বিছানা থেকে ফোনটা তুলে তারিনের কাছে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,” ধরবি না কেটে দিবো?”

তারিন চোখ মুছতে মুছতে বলল,” কেটে দিলে আবার ফোন করবে, টেনশন করবে। দে ধরছি।”

” আগে তুই ঠান্ডা হো।”

তারিন কেশে গলা পরিষ্কার করেই কল রিসিভ করল,” হ্যালো।”

” তারু, কোথায় তুমি? বাসায় পৌঁছে গেছো?”

” হুম।”

” আচ্ছা, আমিও আসছি। ঈশান ভাই নাকি তোমাদের বাড়ি আছে?”

” হ্যাঁ কিন্তু আমি এখনি বের হয়ে যাবো। আপনি এলে আমাকে পাবেন না?”

” কেন বের হয়ে যাবে?”

” আমার এখানে কাজ শেষ তাই। আচ্ছা রাখছি।”

তারিন মোবাইল রেখে আবার মুখ চেপে ধরল। অথচ সে জানেও না কল তখনও কাটেনি। ওইপাশ থেকে ফাহিম সব কথা শুনতে পাচ্ছিল। তারিনের মাথায় সেই ভাবনা নেই। তার বুকের কাছের দলা পাকানো কান্নাটা সামলানো যাচ্ছে না কিছুতেই। নিহা তারিনের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,” ঈশান ভাইয়ের সাথে একবার কথা বলে দেখবি?”

” অসম্ভব। আমি মরে যাবো।”

” বার-বার শুধু মরার কথা বলিস কেন বলতো?”

তারিন চিৎকার করে উঠল,” কারণ এখন মৃত্যুই একমাত্র সমাধান। আচ্ছা নিহা, শুনেছি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেলে নাকি মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুকে বলে সুইট ডেথ। তাতে কোনো কষ্ট হয় না। হলেও খুবই সামান্য।অন্তত আমার কষ্টের কাছে তো সামান্যই। আমাকে পটাশিয়াম সায়ানাইড এনে দিতে পারবি?”

” বোকার মতো কথা বলিস না..”

নিহার কথার মাঝেই কেউ দরজা ধাক্কালো। নিহা উঁচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কে?”

” আমি।”

ঈশানের কণ্ঠ শুনে আৎকে উঠল তারিন। প্রাণপণে নিহাকে দরজা খুলতে নিষেধ করল। কিন্তু নিহা শুনল না। সে ঠিক দরজা খুলে দিল।

চলব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here