১.
দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ের আসরে বসে বর বেশে প্রাক্তন প্রেমিককে দেখে চমকে ওঠে নম্রমিতা। রাফিদকে এই জায়গায় কোনোভাবেই আশা করেনি সে। শেষবারের মতো রাফিদের খোঁজ নিয়েছিলো বোধহয় দুই বছর আগে। শুনেছিলো তার নতুন প্রেমিকার কথা। কষ্টের মাঝেও হেসেছিলো নম্রমিতা। বুকের কোথাও চিনচিন ব্যথা হলেও তৃপ্তি ছিলো মনে। কিন্তু আজ!
কাজিসাহেবের তাড়ায় অনেককিছু বলতে চেয়েও বলা হয়না নম্রমিতার। দ্বিধা দ্বন্দের মাঝেই অবশেষে কবুল বলার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় বিয়ে। এবার পালা দুজনের দুজনকে দেখার। নম্রমিতার পাশে বসে আছে রাফিদ। চোখে মুখে অস্থিরতা। আড়চোখে একবার তাকায় নম্রমিতা রাফিদের দিকে। ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। তবে কি বিয়েটা তার অমতে হয়েছে! ভাবনার মাঝেই সাজানো এক ডালার মাঝে আরশি নিয়ে উপস্থিত হয় নম্রমিতার বোন আরুশি। ফুলে ফুলে সজ্জিত ডালার মাঝে কারুকার্য করা আরশি। আরশিতে চোখ রাখে নম্রমিতা। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে রাফিদের দিকে। অথচ রাফিদের দৃষ্টি ভিন্ন। লোক সম্মুখে থাকায় সেও একপলক তাকায় আরশিতে। অথচ তাকায়না নম্রমিতা দিকে। চোখ রাখেনা সে চোখে। আকর্ষণ করেনা দৃষ্টির মোহে। টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে অজান্তেই নম্রমিতার চোখ থেকে।
বাসরঘরে ফুল সজ্জিত খাটের মাঝে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে নম্রমিতা। ভাবনায় রয়েছে অতীত বর্তমানের সবটুকুই। রাফিদকে বিয়ে করে সে ঠিক করেছে কিনা জানেনা, তবে মনের মাঝে একরকম ভালোলাগা কাজ করছে। হারিয়ে ফেলা ভালোবাসাকে ফিরে পাওয়ার প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে দেহ মণ। কিন্তু রাফিদ! সে কি আদৌ খুশি এই বিয়েতে! কই আগের মতো প্রাণোচ্ছল দেখালোনা তো আজ তাকে! যাকে ঘিরে ছিলো তার অজস্র পাগলামি, সে যে আজ তার বিয়ে করা বউ! ভালোবাসাময় এক দৃষ্টিও কি তার প্রাপ্য ছিলনা!
ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়েছে। অথচ রাফিদ আসেনি এখনও। ফুলে ফুলে সজ্জিত রুমটাতে একাই বসে আছে নম্রমিতা। বসে থাকতে থাকতে পিঠ তার ধরে গেছে। তবুও বসে আছে নম্রমিতা রাফিদের জন্য। অনেক কথা আছে আজ রাফিদের সাথে। প্রকাশ করার আছে না বলতে পারা এক উচ্ছ্বাস। বলার আছে সবটুকু সত্যি। রাফিদ নিশ্চই চমকাবে! আনন্দে আত্মহারা হয়ে বুকে টেনে নেবে! ভাবনার বুঁদ নম্রমিতার ধ্যান ভাঙ্গে দরজার শব্দে। রাফিদ এসেছে। আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট হয়েছে।
রুমের দরজা লাগিয়ে হাতের ঘড়ি আর ওয়ালেট ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখলো রাফিদ। চকচক করা আয়নায় একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আড়চোখে তাকালো বিছানার দিকে। লাল টুকটুকে বধূবেশে বসে আছে কেউ। মনে মনে হাসলো রাফিদ। অতঃপর আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের দরজার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নম্রমিতা। আশাহত হয়ে বেলুনের মতো চুপসে যায় সে। বিয়ের পর থেকে একটা কথাও বলেনি রাফিদ। এমনকি এক গাড়িতে পাশাপাশি এলেও সে ব্যস্ত ছিলো নিজের মতো। নম্রমিতা কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে কিছু বলতে। বুক ভেঙ্গে কান্না আসে নম্রমিতার। রাফিদের কি একবারও উচিৎ ছিলোনা তার দিকে তাকানোর! রাগ হয় নম্রমিতার। অভিমানে পিষ্ট হয় কোমল হৃদয়। রাগ, অভিমানের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে গা ভর্তি গহনা আর বিয়ের সাজেই বেডের একপাশে শুয়ে পড়ে নম্রমিতা। ক্লান্তির চোটে বেশ কিছুক্ষনের মাঝেই ঘুম ধরা দেয় চোখে। অতঃপর শোনা যায় নম্রমিতার ভারী নিঃশ্বাস।
২.
খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস নম্রমিতার আছে। তাই ফজরের আজানের আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় নম্রমিতার। ঘুম ঘুম চোখে রুমের চারপাশে তাকিয়ে রাফিদকে দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হয় নম্রমিতা। এতো সকালে তো ওঠার কথা নয় রাফিদের। বিছানার অপর পাশটাও বেশ গোছানো। তার মানে সারারাত এই রুমে ছিলোনা রাফিদ। চিন্তা হয় নম্রমিতার। সাজগোজ আর গহনার কারণে শরীর কিটকিট করছে। আপাতত রাফিদের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফ্রেশ হওয়া জরুরি।
ফজরের নামাজ পড়ে বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেলো নম্রমিতা রুমের মাঝে পায়চারি করছে। মূলত সে অপেক্ষা করছে রাফিদের। নতুন বউ এভাবে কেউ না ডাকা অবদি বাইরে যাওয়া উচিৎ নয়। তাই রুমের মাঝেই অপেক্ষা করছে সে। দরজার দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আবারও অস্থিরভাবে পায়চারী করতে থাকে নম্রমিতা। আচমকা কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে কোমড় আঁকড়ে ধরে একজোড়া হাত। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে যায় নম্রমিতা। নিজেকে সামলাতে একহাতে আঁকড়ে ধরে রাফিদের শার্টের কলার। রাফিদ খানিক্ষণ পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকে নম্রমিতার দিকে। গোলাপি শাড়িতে কি অপূর্ব লাগছে তাকে। বিয়ে হলে রূপ কি আরো খানিকটা বেড়ে যায় নাকি মেয়েদের! রাফিদের তো তাই মনে হচ্ছে। দৃষ্টি সংবরণ করে নিজেকে ধাতস্থ করে রাফিদ। অতঃপর নম্রমিতাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“আম্মা ডাকছে নীচে, নাস্তার জন্য।”
এটুকু বলেই চলে যেতে নেয় রাফিদ। নম্রমিতা রাফিদের হাত ধরে আঁটকায়। এরপর আহত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“রাফিদ”
“বলো। শুনছি।”
“কেমন লাগছে আমাকে?”
“হয়তো ভালোই।”
“দেখবেনা?”
“নাহ”
“এতো অভিমান!”
“অভিমান তো কাছের মানুষদের উপরে হয়। ছলনাময়ীদের উপর শুধু করুণা করা যায়।”
আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় নম্রমিতা। জলে টইটুম্বুর চোখ। পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়বে চিবুক বেয়ে। নিজেকে সামলে নেয় নম্রমিতা।
“করুণা করার জন্য বিয়ে করার প্রয়োজনীয়তা ছিলোনা।”
“এভাবেই করুণা করা যায়।”
হাসে নম্রমিতা। চোখে চোখ রেখে তাকায় রাফিদের দিকে। পরিমাপ করে রাফিদের দৃষ্টির গভীরতা। এরপর গাঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,
“বিধবা হলেও এতো বেশি বয়স নয় আমার, যে কেউ বিয়ে করতোনা। হয়তো বয়স্ক কিংবা ডিভোর্সী কারোর সাথেই বিয়ে হতো আমার, তবুও তা এরচেয়ে সন্মানের। অন্তত কারোর করুণা নিয়ে বাঁচতে হতনা আজীবন।”
মনে মনে রাগ হয় রাফিদের। রাগে মুষ্ঠিবদ্ধ করে হাত। অথচ মুখে হাসলো। একই দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে খানিকটা ঝুঁকলো নম্রমিতার দিকে। অতঃপর রূঢ় কণ্ঠে বললো,
“কে বললো আজীবন থাকবে?”
ধক করে ওঠে নম্রমিতার বুক। জীবন তার সাথে ঠিক কি খেলায় নেমেছে বুঝতে পারছেনা। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট আহাজারি জারি করে বলে উঠলো,
“সহনসীমা পেরিয়ে আত্মসম্মান বিসর্জন হওয়ার আগে তুমি আমার আত্মার নিঃশেষ ঘোষণা কোরো।”
রাফিদের দিকে একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় নম্রমিতা। দরজার কাছে এসে পিছু না ফিরেই বলে ওঠে,
“অসহায় মানুষদের মুখের কাছে দু মুঠো খাবার ছুঁড়ে দিলেই তারা খুশি। সেখানে বিয়ে তো বিলাসিতা। এভাবে নিজের জীবন নষ্ট না করলেও পারতেন।”
ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত আছেন রাফিদের মা, বাবা আর ছোটো বোন তোহা। বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও কাছের কিছু আত্মীয়রাও উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য তাদের সবার নাস্তা আগেই হয়ে গিয়েছে। এখন যে যার রুমে রেস্ট করছে। নম্রমিতা ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। এখন তার কি করা উচিৎ বুঝতে পারছেনা। ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের হওয়ায় সহজ কারোর সাথে মিশতে পারেনা নম্রমিতা। আমতা আমতা করে তোহার পাশের চেয়ার টেনে বসে। কিছুক্ষনের মাঝেই সেখানে উপস্থিত হয় রাফিদ। নম্রমিতার পাশে চেয়ার টেনে বসে নিজের মতো খাওয়া শুরু করে। এদিকে নম্রমিতা পড়েছে বিপাকে। সকালে এক কাপ না হলে তার চলেনা। প্লেটের পরোটা টুকরো টুকরো করে যাচ্ছে সে। অথচ মুখে নিচ্ছেনা একটুও।
“আরে ভাবি, তুমি খাচ্ছনা কেনো? কিছু লাগবে?”
তোহার কথায় না সূচক মাথা নাড়ায় নম্রমিতা। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। এটা ওটা তুলে দিচ্ছে নম্রমিতার প্লেটে। নম্রমিতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় রফিদের দিকে। অথচ রফিদ নিজের মতো খেয়ে চলেছে। একবারের জন্যও তাকাচ্ছেনা এদিকে। নম্রমিতার প্লেটে এক টুকরো মুরগীর মাংস তুলে দিতে দিতে তোহার চোখ পড়ে নম্রমিতার গলায়। কেমন যেনো লাল হয়ে আছে জায়গাটা।
“ভাবি তোমার গলায় লাল হয়ে গেছে কি করে? কে কামড়েছে?”
তোহার কথা শুনে বিষম খায় রাফিদ। খাবার গলায় আঁটকে অনবরত কাশতে থাকে সে। নম্রমিতা অস্থির হয়ে একহাতে পিঠে হাত বুলিয়ে পানি এগিয়ে দেয় রাফিদের দিকে। রাফিদ রাগি দৃষ্টিতে তাকায় নম্রমিতার দিকে। চোখ নামিয়ে নেয় নম্রমিতা। মেয়ের এমন কথায় ভিমরি খান আরিয়ান সাহেবও। নাস্তা শেষ করে লাজুক হেসে উঠে যান তিনি। আনোয়ারা খাতুন মেয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে নিজেও চলে যান রান্নাঘরে। তোহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সবার কান্ড। আসলে হলোটা কি! সবাই এভাবে পালালো কেনো তার মাথায় ঢুকছেনা। অসহায় মুখে অবশেষে তোহা তাকায় নম্রমিতার দিকে।
“কি হলো বলোতো ভাবি সবার? আমি তো শুধু জিজ্ঞাসা করলাম কি কামড়েছে তোমার গলায়?”
#চলবে!
#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#প্রথম পর্ব
নতুন পর্ব সহজে পেতে পেজটিতে ফলো দিয়ে রাখুন